মূল: লক্ষ্মী কানন
অনুবাদ: মনোজিৎকুমার দাস
রত্না চম্পক গাছে উঠে একটা ডালে হেলান দিয়ে বসল। ডালপালা মেলা গাছটা ছায়ায় ঘেরা। ওখানটাতে বসে সে আরাম
বোধ করছে। গাছটা পত্রপুষ্পে সুশোভিত। সে তার মুখটা উঁচু
করে গাছের ডালে বসে পাখিদের কিচিরমিচির শব্দ শুনতে লাগল। পখির কলকাকলিতে মুখরিত শান্ত
স্নিগ্ধ ছায়ায় তার মনটা খুশিতে ভরে উঠল। সে তার পরনের স্কার্টটা ঠিকঠাক
করে নিয়ে ওখান থেকে একটা মগডালে উঠে বসল। এখন তাকে আর কেউ খুঁজে পাবে না !
সে ডালটাতে বসে তার চোখ দুটো বন্ধ করার
চেষ্টা করল। কিস্তু সে তার চোখ দুটোকে পুরোপুরি বন্ধ করতে পারল না। সে এক সময় দেখলো গাছের ডালের
উপর দিয়ে কালো কালো পিঁপড়ের সারি দলবেঁধে তার দিকে আসছে। বেশ কয়েকটা তার হাতের উপর এসে
পড়ল। ভয় লাগল ,ডাসাডাসা পিঁপড়েগুলো
তাকে কামড়ের শেষ করে দেবে না তো। সে তার গা থেকে পিঁপড়েগুলোকে সরিয়ে দিল।
তাকে বড়রা চম্পক গাছে উঠতে কেন যে
বারণ করেন তা সে বুঝতে পারে না। বয়জেষ্ঠ্যরা সব সময়ই তাকে বলে এটা করো না, ওটা করো না। কেন করব না তা জিজ্ঞেস করলে
তার জবাব তারা তাকে দেয় না।
সবাই নাগপুষ্প দিয়ে অলঙ্কার না বানিয়ে জুঁইফুল দিয়ে বানাতে কেন যে বলে সে বুঝে
উঠতে পারে না! আমি তাদেরকে বলি কেন আমি আমার চুলের বেণীতে নাগপুষ্প পরব না? কিন্তু কেউই নাগপুষ্প দিয়ে আমাকে সাজাতে দেয় না। রত্না তার চোখদুটো বন্ধ করে উৎসবের দিনগুলোতে ফুলের অলঙ্কার
পরার কথা ভেবে আনন্দ পায় । সংক্রান্তি, দীপাবলী,
দশেরা
আর নবরাত্রির আনন্দ উৎসবের কথা ভেবে রত্না বেশ মজা পায়। ছোট ছোট মেয়েরা ঝলমলে
সিল্কের ঘাঘরা আর ব্লাউজ পরে ঘর থেকে বের হয়। বাড়ির বয়স্ক মহিলাদের
মধ্যে মা, দাদী, চাচীরা তাদের মেয়েদেরকে গয়নাগটি পরিয়ে সাজিয়ে দেয়। তারা নানা রকমের ফুল
দিয়ে মেয়েদের চুল বেঁধে দেয়। নানা রকমের ফুলের মধ্যে
জুঁই,গোলাপ,পারিজাত ইত্যাদি ফুল অবশ্যই থাকে। তারা মাঝে মধ্যে নাগপুষ্প ফুল
দিয়েও খোঁপা সাজায়। তারা সূচ ও সুতো দিয়ে নাগপুষ্পের মালা গাঁথে । নাগপুষ্পের সুগন্ধ
অন্যান্য ফুলের চেয়ে বেশি। শেষবার নাগপুষ্প দিয়ে
কেশদাম সজ্জিত করার কথা রত্নার মনে পড়ে। সেদিনটি সে কত না স্ফুর্তিতে
কাটিয়েছিল। প্রত্যেকের চোখ ছিল তার উপর। সে যেখানে যায় সেখানেই লোকজন তার চুলের খোঁপার দিকে তাকিয়ে থাকে।সেদিন সে সবার চোখের
মণি হয়ে উঠেছিল। কিন্তু আজ আর সেদিন নেই । দুবছর আগের মতো পরিবারের লোকজন নাগপুষ্পকে ঘরে আনতে দেয় না। যদি রত্না তাদের কাছে
জিজ্ঞেস করে -- কেন? তবে কেউই তার প্রশ্নের
জবাব দেয় না। সে বড়দের কাছ থেকে এর কারণ জানতে চাইলে তারা পরষ্পরের সাথে ফিসফিস করতে থাকে। সে এর একটা কারণ জানতে
পেরেছে। পরিবারের একজন বন্ধু নাকি একগাদা নাগপুষ্প কিনে নিয়ে আসে। পরিবারের সবার কাছেই নাগপুষ্প
ছিল অতি প্রিয়। তারপর একটা সাপ তাদের বাড়িতে এসে নাগপুষ্প দিয়ে খোঁপা বাঁধা একটা ছোট মেয়েকে কামড়িয়ে
দেওয়ায় মেয়েটি তৎক্ষণাৎ মারা যায়। দু:খজনক সেই ঘটনার পর থেকে তারা নাগপুষ্পের কথা শুনতেই পারে
না। তারা নাগপুষ্পের কথা
শুনলেই ভয়ে আঁতকে উঠে ।
রত্না নাগপুষ্পের সুগন্ধ সবচেয়ে ভালবাসে। সে এবার নবরত্রিতে
নাগপুষ্প দিয়ে তার কেশদাম সাজানোর বায়না ধরেছিল। কিন্তু কেউ তাকে নাগপুষ্প দিয়ে
চুলে অলঙ্করণ করতে রাজি হয়নি। তার মমতাময়ী মা অহল্যা নাগপুষ্পের নামটি পর্যন্ত শুনতে চায় না। ‘আমি এখন নাগপুষ্পের
জন্য এখানে এসেছি। কেউই আমাকে খুঁজে পাবে না। তারা আমাকে খুঁজে পেয়ে নেমে
আসার জন্য বারবার অনুরোধ করলেও আমি কিন্তু এখান থেকে নেমে যাবো না’।
রত্না গাছের ডালের
আরো উপরে উঠে দুচোখ বন্ধ করে। সে বুঝতে পারছে তার গোড়ালি
বেয়ে কিছু একটা যেন তার গায়ে উঠে আসছে। সে তাকিয়ে দেখলো একটা বড় পিঁপড়ে -- ওহ, তুমি ! তুমি আমাকে
না কামড়িয়ে তোমার পথে যাও। কালো পিঁপড়েটা তার
গোড়ালি থেকে গাছের অন্য একটা ডালের দিকে চলে গেল। সন্ধ্যা প্রায় আগত। বাগানের চারদিকে আঁধার
নেমে আসবে একটু পড়েই। নাগপুষ্পের পাঁপড়িগুলো একে একে গুটিয়ে আসছে। জুঁই, গোলাপ আর রজনীগন্ধার সুগন্ধী ছাপিয়ে নাগপুষ্পের
সুবাস চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে ।
--রত্না,ও রত্না ! চুলে নাগপুষ্প
পরো না। ওটা পরলে তোমাকে কামড়িয়ে দেবে ।
-কে আমাকে কামড়িয়ে দেবে , মা?
-
আর একদিন
তা তোমাকে বলব ,তোমার কি তা মনে নেই? এখন নেমে এসো। তুমি ভাল করে মনে করার চেষ্টা
করো।
তুমি
না জানার ভান করো না। বাছা, তুমি বোঝবার চেষ্টা
করো।
তুমি
ভুলেও তার নাম করো না। তারা তাকে যতই সাবধান
করছে ততোই সে জানার জন্য উৎসুক হয়ে উঠছে। যদি সাপ ভয়ঙ্কর হয়ে থাকে,তবে কোন সাপ তার কাছে হাজির হবে। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর সাপকে কি তামিল
ভাষায় চাঙ্গিল কারুপ্পান বলা হয়ে থাকে?
নাকি
কালো ডোরাকাটা ভাইপার, নাকি সবুজ রঙের সাপ
, কিং কোবরা হবে কী? রত্না তার জীববিজ্ঞানের ক্লাস থেকে এদের সম্বন্ধে
জেনেছিল। একবার সে তার মামার সাথে চেন্নাইয়ের স্নেক পার্কে বেড়াতে গিয়েছিল। সেখানে সে নানা জাতের সাপ দেখেছিল। সেখানে সাপদের অবস্থা দেখে
মনে হয়েছিল সাপগুলো কতই না কষ্টে কাচের বদ্ধ ঘরে বাস করছে। সাপগুলো নির্জীব অবস্থায় ছিল। ছেলেমেয়েরা সাপগুলোকে
একেবেঁকে চলতে দেখেছিল। কতকগুলো সাপের গায়ে রোদ পড়ে চকচক করছিল। তাদের চোখগুলো মণির
মতো জ্বলছিল। রত্না মনে করার চেষ্টা করল চারপাশের লোকজনের ভিতরও কোবরা কেমন ভাবে লকলক করছিল আর
মুহূর্তের মধ্যে ফণা তুলছিল। সেই দৃশ্যটা মর্মান্তিক ছিল। রত্না মনে মনে
ভাবলো, গাছের শুকনো ডালে সাপ
কুণ্ডলী পাকিয়ে থাকে। সাপ মনের সুখে কেন ঘুরে বেড়াতে পারবে না ?
রত্না প্রায় প্রায়ই উঁই ঢিবির ভিতরে
কী ঘটে তা জানার চেষ্টা করে ! -- রত্না খুব কাছে যেও না, উই ঢিবির ভিতরে সাপ বাস করে।
তার মা তাকে সতর্ক করে দেয়। তবুও রত্না উই ঢিবির
কাছে দাঁড়িয়ে থাকে যে পর্যন্ত না তার পা ধরে আসে। একবার সে একটা উইয়ের ঢিবি ভাঙ্গতে
গিয়েছিল। ওখানে সত্যি সত্যি সাপ আছে কিনা সেটা জানাই ছিল তার উদ্দেশ্য । তার ভিতর থেকে বালির
একটা স্তূপ বের হয়ে এসেছিল। সেখানে একগাদা পিঁপড়ে নিরাপদে আশ্রয় নিয়ে বসবাস করছিল। দিনটা ছিল প্রচণ্ড
গরমের। লোকেরা বলে, সাপ গরম সহ্য করতে
পারে না।
--রত্না , রত্না !
আহ-----মা আমাতে খুঁজছে। যদি আমি চম্পক গাছের মগডালেও লুকিয়ে পড়ি তাহলেও মা আমাকে খুঁজে
পাবে। রত্মার মা গাছের নিচের উই ঢিবির পাশে দাঁড়িয়ে গাছের উপরের ডালের দিকে উঁকি মারছিল
।
- তুমি ওখানে ! আমি দেখতে
পেয়েছি। তোমাকে চিনতে আমার বাকী নেই। বাছা, তুমি নেমে এসো, নেমে এসো। দেরি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু !
- না আমি নামবো না।
- কেন নেমে আসবে না?
- এমনিতেই নেমে আসবো
না।
-কী !
-আমি এখানটা পছন্দ করি। আমি এখানেই থাকতে চাই। সূর্য এখনই ডুবে যাবে। তারপরই সব রকমের পোকামাকড়
বের হয়ে আসবে। ভয়ঙ্কর রাত নামবে এখনই। বাছা আমার,নেমে এসো।
-- এখানে কোন বিপদের আশংকা
নেই।
শুধুমাত্র
কালো পিঁপড়ে আর কাঠবিড়াল ছাড়া। তাদের নিয়ে কোন চিন্তার কারণ নেই।
-ভালো কথা। কিন্তু এক সময় রাত
নামবে, আর রাত নামলে সব রকমের পোকা
মাকড় আর সাপপোক চলাচল করবে-----।
অহল্যা তার ঠোঁটে কামড় খেয়ে
তার কথা মাঝ পথে থামিয়ে দেয়। সে রত্নার দিকে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকাল। রত্না গাছের মগডাল
থেকে জিজ্ঞেস করল, - কী বললে মা ?
- কিছুই না , কিছুই বলিনি তো , তুমি তাড়াতাড়ি নেমে এসো , সোনামণি ।
- তুমি এইমাত্র সাপ না----
?
-মাইরি , আমি তা বলি নি। আমি বলতে চেয়েছি পোকামাকড়দের
কথা।
তা বেশ, তাড়াতাড়ি নেমে এসো তো দেখি । আমি কতক্ষণ এখানে দাড়িয়ে
থাকব ? আমার অনেক কাজ পড়ে আছে।
-তুমি আমার একটা শর্ত
পূরণ করলে আমি নেমে আসতে পারি।
--কী শর্ত ?
-নাগপুষ্প দিয়ে অলঙ্কার
বানিয়ে তা দিয়ে আমাকে সাজিয়ে দিতে হবে।
-হায় ঈশ্বর ! নাগপুষ্প
! আমরা তোমার ভালোর জন্যই বলছি। নাগপুষ্পের সম্মোহনী গন্ধ আছে। এই ফুল পরলে তোমার মতো ছোট্ট
মেয়েদেরও মাথা ব্যথা করে থাকে। তুমি হয়তো জানো না কখনো কখনো এই ফুলের কড়া গন্ধে নাক থেকে রক্ত
পর্যন্ত ঝরে। তাছাড়া, তুমি হয়তো জান কিংবা নাও জানতে
পার নাগপুষ্পের আকর্ষণে সা---
অহল্যা এবারও শব্দের মাঝ পথে থেমে তার কথা থামিয়ে দিল ।
-সাপ সম্বন্ধে তুমি
কী বলতে যাচ্ছিলে?
--রত্না , তোমাকে কতবার নিষেধ করেছি আঁধার নামলে ওই শব্দটা
মুখে আনবে না। তুমি কী একে ঠাট্টা মনে করো? ভাল মেয়ের মতো তুমি
তাড়াতাড়ি নেমে এসো ।
-তাহলে নাগপুষ্প সম্বন্ধে
কী বলছো ?
- এ সম্বন্ধে তোমাকে
পরে বলব ।
অহল্যাকে বড়ই ক্লান্ত দেখচ্ছিল। রত্না বুঝতে পারল সে তার
মমতাময়ী মাকে অযথাই নাজেহাল করছে। সে গাছ থেকে নেমে এসে মায়ের কোমর জড়িয়ে ধরে মাটির
দিকে তাকাল।
-আমার সোনামণি, আমার ছোট্টখুকি,তুমি আমাদের নয়নের মণি নাগরত্না । কথাটা বলে সে রত্নার গালে ও চুলে চুমু দিল ।
বিশেষ বিশেষ উপলক্ষে অহল্যা মেয়েকে তার
কেতাবী নাম নাগ রত্না বলে সম্বোধন করে থাকে। কোন খুশির ঘটনার পর সে রত্নার কানে কানে
মিষ্টি সুরে ফিসফিস করে সংগোপনে ডাকে , -- নাগরত্না, নাগরত্না ---। তাকে নাগরত্না নামে ডাকার জন্য সে প্রথম প্রথম তার মায়ের
কাছে প্রতিবাদ করত। সে বলত এটা আদ্দিকালের নাম, মহিশূরে অনেক অনেক নাগ রত্না নামের মহিলা আছে। দাদী, দাদীর মায়েদের নামও নাগরত্না ছিল। -আমি নাগরত্না নামটাকে পছন্দ করি না। সে তার মাকে বুঝিয়েসুঝিয়ে বলত। আমারে ক্লাসের ছেলেমেয়েরা নাগরত্না নাম নিয়ে
আমাকে ঠাট্টাতামাশা করে। মেয়ের আপত্তির ফলে বাবা মা ও বড়রা তার স্কুলের রেকর্ডে নাম সংক্ষেপ
করে রত্না করার ব্যবস্থা করে ।
রত্না নাগ শব্দের অর্থ সাপ জানতে পেরে
বিস্মিত হয়। সে এটা ভেবে অবাক হয় কেন তাদের পরিবারের বড়রা তার মুখ দিয়ে সাপ শব্দ বলতে নিষেধ করে। কেনই বা বড়রা সাপ শব্দটা
মুখে আনে না। তারা নাগ শব্দটা মুখে না আনলেও
কেন তারা তাদের মেয়ের নাম নাগরত্না রাখেছে? সে একদিন এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করবেই।
রত্নের আভিধানিক অর্থ মণি। তাহলে রত্নার অর্থ দাড়ায়
একটা বালিকা রত্ন। উৎসবের দিনগুলোতে সে সিল্কের সুন্দর শাড়ি আর ব্লাউজ
পরে। তার চুলগুলোকে সুন্দর করে আঁচড়িয়ে বিনুনি বেঁধে দেওয়া হয়। আর বিনুনিটাকে ফুল দিয়ে
সাজানো হয়। আর সেটাকে মাথার উপর দিয়ে সুন্দর করে সাজিয়ে দেওয়াও হয়। সে তাদের পরিবারের
একটা গর্ব। তাকে সাজানোর জন্য বেগুনী রঙের গয়নার বাক্স থেকে দামী গয়নাগুলো বের করা হয়। তার চুলের সিঁথিতে
পরানো হয় সোনার টিকলী,সারা শরীরে পরানো হয়
কত না রকমের গয়না।উৎসবের দিন নানা অলঙ্কারে সজ্জিত হয়ে রত্না আনন্দে
নাচতে থাকে।
সেদিন ছিল নাগপঞ্চমী পূজা। রত্না তার মা
এবং পিসির সাথে মন্দিরে গিয়েছিল। তার মা অহল্যা অন্যান্য মহিলাদের সাথে সাপের ফণা
তোলা পাথরের দেবমূর্তিতে পূজা দিচ্ছিল। রত্না চারদিক ঘুরে ফিরে দেখছিল। মন্দিরগুলোতে গোখুরা সাপের ফণা তোলা পাথরের বড় বড় দেবমূর্তি
শোভা পাচ্ছিল। মহিলারা মূর্তিগুলোতে সুগন্ধি ফুলের মালায় সাজিয়ে দিচ্ছিল। মহিলাদের মাঝ থেকে
একজন দুটো নাগপুষ্পের মালা দেবমূর্তির গলায় পরিয়ে দিয়ে প্রণাম করল। অন্য কয়েকজন মহিলা
দেবমূর্তির মুখে মিষ্টি পুরে দিল। তারা পাথরের দেবমূর্তির মাথায় দুধও ঢালল ।
এক সময় রত্না মহিলাদের
মাঝ থেকে তার মাকে খুঁজে দেখার চেষ্টা করল। দুহাত জড়ো করে দেবতার উদ্দেশে প্রার্থনা করতে সে তাকে
দেখতে পেল। মায়ের ফিসফিস করে মন্ত্র পাঠ করার শব্দও সে শুনতে পেল। তার মা ষষ্টী আর একাদশীতে উপবাস করে। ওইদিনগুলোতে তার মা
সুতির শাড়ি পরে। রত্নার কাছে অদ্ভুত লাগে এটা ভেবে যে সাপের নাম পর্যন্ত মুখে আনে না সে কেমন করে
সাপের পূজা করতে পারে। মহিলারা কয়েকবার মন্দির প্রদক্ষিণ করে মন্ত্র জপ করে। বেচারী মা সেই মহিলাদের
দলের মধ্যে একজন! তারা নাগরাজকে প্রদক্ষিণ করার সময় গোলাপী রঙের শাড়ি পরা একজন মহিলা
অহল্যাকে জিজ্ঞেস করেছিল কেন সে ফিসফিস করে মন্ত্র উচ্চারণ করছে। তার উত্তরে মা মহিলাকে
চুপ করতে বলায় নীল শাড়ি পরা একজন মহিলা বলেছিল যে বেচারী অহল্যা জোরে জোরে মন্ত্র উচ্চারণ
করতে ইতস্তত করছে পাছে নাগরাজ তার মেয়ে নাগ রত্নার কোন ক্ষতি করে এটা ভেবে। মহিলাটির কথা শুনে
গোলাপী শাড়ি পরা মহিলাটি বলেছিল, ওই যে অহল্যার ছোট্ট
মেয়েটি ওখানে দাঁড়িয়ে আছে। নীল শাড়ি পরা মহিলাটি তার কথা শুনে হাসতে থাকল।
এটা কি সত্যি? সাপ কি আমাকে দান করেছে ? সাপ কি বাচ্চা দান করে? যদি ভুলক্রমে কোন পরিবারে মেয়ে শিশু জন্ম নেয় তবে
তা কি নাগরাজের দান হিসেবে বিবেচিত হয় ?
আর তাদের
নাম কি নাগ রাখা হয়। আর তা থেকেই ভয়ের উদ্রেক ঘটে। যাকে আমরা ভয় পাই তাকে কেন
আমরা পূজা করি! সম্ভবত মহিলারা ছেলে সন্তান ছাড়া থাকতে ভয় পায়। কারণ একজন মহিলার শাশুড়ী, শ্বশুর,
স্বামী
এবং অন্যান্য আত্মীয়স্বজনরাও তার কাছ থেকে ছেলে সন্তানই প্রত্যাশা করে। একারণেই কি মহিলারা
ভয়ের মাঝে থাকে ?
তার দাদী, নানী তার মাকে প্রায় প্রায়ই বলে --দেখ বাছা, যদি তোমার ছেলে সন্তান না থাকে তবে তোমার জীবনের কোন অর্থই থাকবে
না। যদি তোমার গর্ভে কোন
ছেলে ধারণ করতে না পার তবে বৃথাই হবে তোমার এ জীবন। মোটের উপর কথা হল যদি তুমি
পরিবারের জন্য একটা ছেলে জন্ম দিতে না পার তবে আমাদের পরিবারটি নি:শেষ হয়ে যাবে, তাই না? যখন দাদী এ সব বলে তখন অহল্যার মুখটা লাল হয়ে যেত। ব্যপারটা খুবই লজ্জা,দু:খ,আর তিক্ততায় ভরা! তাদের কথা শুনে অহল্যার বেজায় রাগ হতো। রত্না তাকে কিছু বলার আগেই তার মা নিজের ঘরে চলে যেত। যদি রত্না তার পিছু পিছু মায়ের ঘরে গিয়ে উপস্থিত হত
তখন সে তাকে তার কোলের মধ্যে টেনে নিয়ে একের পর এক তার গালে চুমু দিয়ে কেঁদে বলে উঠত, -বাছা আমার রত্না,
নাগরত্না, আমার সোনামণি --। মায়ের দুচোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ত।
কলকাতার রাসবিহারী এভিনিউতে স্বামী আর
ছোট্ট মেয়েকে নিয়ে সংসার পাতার আগ পর্যন্ত বাগানে আর উঁইয়ের ঢিবিতে সাপ খোঁজার কাজটা
রত্না চালিয়ে গিয়েছিল। রত্নার সাপ খোঁজার কারণ তাদের জেলা ও পাশ্ববর্তী জেলাগুলোতে যেন সাপেরই
রাজত্ব ছিল । সালেম অঞ্চলের দক্ষিণের জেলাগুলোতে আর রাজস্থানের উত্তরাঞ্চলের
জেলাগুলোর যত্রতত্র সাপ কিলবিল করে বেড়াত। সাপের ভয়ে ভতি মহিলারা
দুধকলা আর ফুলবিল্লপত্র দিয়ে সাপের পূজা দিত। সাপেদের গায়ের রঙ ছিল সবুজ
, কালো আর ধূসর রঙের। বিহারের পাশ্ববর্তী
রাজ্য কাথার, ফাসিয়তোলা , তেজাতোলা, বুদ্ধচক এবং রাজস্থানে কয়েকটি জেলার ঝোপঝাড়, ঘাস আর বাড়িঘরে বিষধর সাপের আনাগোনা লেগেই ছিল। এমনকি ধনী লোকদের বাড়িতেও বিষধর সাপের উপস্থিতি ছিল উল্লেখ করার মতো। নাপপুষ্পের উপস্থিতি ছাড়াই ওই সব স্থানে সাপ বসবাস করত। আতুড় ঘরও সাপের হাত
থেকে রেহাই পেত না। আতুর ঘরের আনাচে কানাচেয় সাপকে লুকিয়ে থাকতে দেখা যেত। বিহার,রাজস্থানের বিভিন্ন জেলার সব স্থানেই প্রসূতি মায়েদের সন্তান
প্রসব কালে ছোট্ট আতুর ঘরে থাকতে হত । আর সেই ঘরে যখন তখন সাপ দেখা যেত। অহল্যার আতুর ঘরেও
কি এমনটাই ঘটেছিল? অহল্যার মনোজগতটাও
কি সাপের ভয়ে ত্রস্ত ছিল? অহল্যা ছেলে সন্তানের
জন্য উপবাস আর পূজার্চনা কি কম করেছিল ?
অহল্যার
শরীরটা একটা সুতির শাড়িতে জাড়ানো থাকত ,
তার শরীরের
ত্বক আর চুলে কি মাতৃত্বের গন্ধ লেগে থাকত না?
সাপেরা বিভিন্ন আকার আকৃতিতে তাদের
কাছে দেখা দিত। তারা নবজাত মেয়ে শিশুর স্পাইনাল কর্ডের ভিতর ডুকে যেত ফলে প্রসূতির মেয়ে শিশুর
মৃত্যু ঘটত। সাপেরা দড়ির রূপ ধরে নবজাতক মেয়ে শিশুর গলা পেঁচিয়ে ধরে তাকে মেরে ফেলত। কিংবা তারা বিশাল আকারের
কালো পাথরের রূপ ধরে নবজাতকের গলা চেপে ধরে রাখতো তার মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত। সাপেরা শিশুর খাবারে বিষ ঢেলে তার মৃত্যু ঘটাত। যে সব সঙ্গীরা তাদের
মেয়ে সন্তানকে মেরে ফেলতে অস্বীকার করত তাদের স্বামীদের শরীরে সাপেরা প্রবেশ করত । সাপেরা স্বামীকে দিয়ে
মেয়ে সন্তানকে হত্যা করাত সাপের রূপ ধরে। অহল্যাদের ক্ষেত্রে কি ঘটেছিল ? এ জগতের অহল্যারা কীভাবে মেয়ে শিশু জন্ম দিয়ে পার
পেয়ে গিয়েছিল! যে অহল্যারা তাদের হাড়জিড়ে শরীরে জীর্ণ সুতির শাড়ি জড়িয়ে থাকতো যাদের
শরীর থেকে ফুল, কপ্পুর আর হলুদের গন্ধের
মতো ট্যালকাম পাউডারের সুবাসের মতো ভালোবাসা
আর কুমকুমের গন্ধের মতো দয়ামায়া ঝরে পড়তো তাদের কি হয়েছিল ? ওই সব অহল্যারা ভুলক্রমে কি তাদের গর্ভ থেকে মেয়ে সন্তান দিতে সক্ষম হয়েছিল
?
তারপর অনেক বছর কেটে যায়। এক সময় অহল্যা মারা
গেলে নাগরত্নের পরিবারের লোকজন রত্নাকে বলল যে মায়ের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করার অধিকার তার নেই
, কারণ তার মা ছেলে সন্তান না
দিয়ে মারা গেছে। তার মা সারাজীবন একটা অতৃপ্ত বাসনা নিয়ে কাল কাটিয়েছে ।
মায়ের একটা হলুদ রঙের ট্রাঙ্ক নিজের
অধিকারে রেখে রত্না তার মায়ের স্মৃতি ধরে রাখতে চায়। ওটাই তার মায়ের একমাত্র
স্মৃতিচিহ্ন ! সে ওই ট্রাঙ্কটিতে কারো হাত লাগাতে দিতে চায় না। ট্রাঙ্কের ভিতরে সুন্দর
সুন্দর সিল্কের শাড়ি, দামী জুয়েলারী যা সে
কোন দিনই পরে নি যদিও সে সাধারণ সুতির শাড়ি পরে থেকেছে । রত্না মাঝেমধ্যে
ট্রাঙ্ক খুলে তার মায়ের সখের জিনিসগুলোতে চোখ রেখে বসে থাকে। সে ট্রাঙ্কের ভিতরের
মায়ের সখের জিনিসগুলো থেকে এক ধরনের সুমিষ্ট সুবাস পায়। সে তার মায়ের গন্ধ দ্রব্যসামগ্রীর
ভিতর থেকে গোলাপ, কপ্পুর, চন্দনের সুবাস পেলেও সে কিন্তু নাগপুষ্পের সুবাস
কখনোই পায় না ।
লেখক পরিচিতি: লক্ষ্মী কানন ( জন্ম: ১৯৪৭) সুখ্যাত দ্বিভাষিক লেখিকা। তিনি তামিল ও ইংরেজি
ভাষায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক গল্প, কবিতা সংকলন ও উপন্যাস
রচনা করে বিশ্বসাহিত্যাঙ্গনে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছেন। তামিল সাহিত্যে তিনি অনেকক্ষেত্রে
কাবেরী
ছদ্মনাম
ব্যবহার করেন। তিনি একজন অনুবাদক হিসাবেও সমধিক সুখ্যাত। তাঁর পাণ্ডিত্যের জন্য তিনি
এশিয়া, ইউরোপ,আমেরিকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও সাহিত্য সংস্থার সাথে সুমর্যাদার
সম্পৃক্ত আছেন। তামিল ভাষায় লেখা তাঁর নাগপুষ্পম গল্পের স্বকৃত ইংরেজি ভাষান্তর
নাগপুষ্পমকে বঙ্গানুবাদ করা হল। এ গল্পে মেয়ে সন্তানের জন্ম দেবার জন্য মায়েদের লাঞ্ছনা গঞ্জনার
কাহিনী গল্পের আকারে উঠে এসেছে । সাপকে নিয়ে যে বদ্ধমূল কুসংস্কার সে সময়ের মহিলাদের মনে গেঁথে
ছিল তা এ কাহিনীতে গল্পের আঙ্গিকে ব্যক্ত হয়েছে।
মনোজিৎকুমার দাস
প্রাবন্ধিক, অনুবাদক ও গল্পকার
লাঙ্গলবাঁধ, শ্রীপুর, মাগুরা, বাংলাদেশ।
0 মন্তব্যসমূহ