এভলিন

মূলঃ জেমস্ জয়েস
অনুবাদঃ ফজল হাসান

[বিংশ শতাব্দীর অন্যতম কথাসাহিত্যিক এবং বিশ্বনন্দিত ‘ইউলিসিস’ উপন্যাসের রচয়িতা জেমস জয়েস (১৮৮৪-১৯৪১)-এর জন্ম আয়ারল্যান্ডের ডাবলিন শহরে এবং তার মৃত্যু হয় সুইজারল্যান্ডের জুরিখে । অনূদিত গল্পটিতে লেখক একজন তরুণীর একদিকে মাতৃহীন সংসারের দায়িত্ব এবং অন্যদিকে ভালোবাসার পুরুষটির সঙ্গে অচেনা ভুবনে ঘরসংসার করার রঙিন স্বপ্নের মানসিক টানাপোড়েনের বিয়োগান্তক ও মর্মস্পর্শী কাহিনী অত্যন্ত সাবলীল ভাষায় ফুটিয়ে তুলেছেন - অনুবাদক ।]


মেয়েটি জানালার ধারে বসে রাস্তা দখল করে ছড়িয়ে থাকা গোধূলির শেষ প্রহরের মলিন আলো দেখছিল । সে জানালার পর্দায় মাথা ঠেকিয়ে হেলান দিয়ে বসেছিল এবং ধূলোমাখা ময়লা কাপড়ের গন্ধ তার নাকের ফুটো গলিয়ে ভেতর ঢুকছিল । সে ভীষণ ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত ।

কয়েকজন পথচারী চলে গেল । রাস্তার শেষ প্রান্তের বাড়ি থেকে যে লোকটি বেরিয়ে এসেছিল, সে-ও পাকা রাস্তা ধরে বাড়ির দিকে চলে গেছে । মেয়েটি তার পায়ের আওয়াজ শুনতে পেয়েছে । একসময় সেখানে মাঠ ছিল । তখন অন্যান্য ছেলেমেয়েদের সঙ্গে তারা খেলাধূলা করতো । তারপর একদিন বেলফাষ্ট থেকে একজন লোক এসে সেই মাঠ কিনে নেয় এবং পরবর্তীতে সে সেখানে বাড়িঘর নির্মাণ করে । বাড়িগুলো তাদের বাদামি রঙের ছোট্ট বাড়ির মতো নয়, বরং উজ্জ্বল লাল ইটের বাড়ি এবং চকমকে ছাদ । রাস্তার দু’পাশের ডিভাইন, ওয়াটার ও ডান পরিবারের ছেলেমেয়ে এবং খোঁড়া কিওগের সঙ্গে সে ও তার ভাইয়েরা সেই মাঠে খেলতো । আর্নেষ্ট কখনই তাদের সঙ্গে খেলায় অংশগ্রহণ করতো না, কেননা বয়সের দিক থেকে সে ছিল বড় । মাঝেমাঝে মেয়েটির বাবা বিশেষ ধরনের হাতের লাঠি নিয়ে ছেলেমেয়েদের খুঁজতো । তবে লাঠি হাতে তার আগমনের হদিশ পেলেই কিওগ সবাইকে সতর্ক করার জন্য রীতিমত চিৎকার করে ডাকাডাকি করতো । তারপরেও তারা মহাআনন্দে সেই দিনগুলো কাটিয়েছে । তবে মেয়েটির বাবা খুব খারাপ ছিল না এবং তার মা-ও বেঁচে ছিল । সে অনেক বছর আগের কথা । এখন মেয়েটি এবং তার ভাইয়েরা বড় হয়েছে এবং তাদের মা বেঁচে নেই । তিজি ডানও ইহলোক ত্যাগ করেছে এবং ওয়াটার পরিবার স্থায়ী ভাবে বসবাস করার জন্য ইংল্যান্ডে পাড়ি দিয়েছে । সময়র সঙ্গে সঙ্গে সব কিছুই বদলে গেছে । অন্যদের মতো সে-ও এখন নিজেদের বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র যাওয়ার পায়তারা করছে ।

বাড়ি ! মেয়েটি চারপাশে দ্রুত চোখ বুলিয়ে আনে । এত বছর ধরে ঘরের যেসব জিনিসপত্র সে সপ্তাহে একদিন ঝাড়মোছ করে পরিস্কার রেখেছে, সেই সব জিনিসপত্রের দিকে তাকিয়ে আপনমনে ভাবে কোথা থেকে এত ধূলোবালি এসে ঘরের ভেতর জমা হয় । হয়তো পরিচিত জিনিপত্রের সঙ্গে তার কখনই দেখা হবে না । সে কোনোদিনও ভাবেনি যে, একদিন এসব থেকে তাকে বিচ্ছিন্ন হতে হবে । এছাড়া আজও সে পাদ্রীর নাম জানে না । গির্জার ভেতর ভাঙা হারমোনিয়ামের ওপর দেওয়ালে মার্গারেট মেরী অ্যালোকোকের ছবির পাশে পাদ্রীর বিবর্ণ ছবি এখনো ঝুলছে । পাদ্রী ছিলেন তার বাবার স্কুল জীবনের বন্ধু । মেয়েটির বাবা যখন কোনো আগুন্তুককে পাদ্রীর ছবি দেখাতো, তখন সে স্বাভাবিক গলায় বলতো, ‘এখন সে মেলবোর্ণ থাকে ।’

মেয়েটি বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র যাওয়ার জন্য অনুমতি পেয়েছে । সেটা কি বুদ্ধিমানের কাজ ? যাহোক, সে সমীকরণের উভয় দিক বিবেচনা করেছে । বাড়িতে তার আশ্রয় এবং খাওয়ার জন্য কোনো চিন্তা-ভাবনা নেই । এছাড়া তার চারপাশে পরিচিত মানুষজন । এসব মানুষ তাকে এবং তার জীবনের সব কিছু সম্পর্কে ওয়াকিবহাল । অবশ্যই তাকে ঘরে এবং বাইরের দোকানে অত্যন্ত পরিশ্রমের কাজ করতে হয় । যখন দোকানের অন্য কর্মচারীরা জানতে পারবে যে, সে একজন লোকের সঙ্গে পালিয়ে গেছে, তখন তারা তার সম্পর্কে কি ভাববে ? হয়তো তারা বলাবলি করবে, মেয়েটি বোকা । তার শূন্যস্থান হয়তো বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে পূরণ করা হবে । তার কথা শুনলে মিস গ্যাভান বরং খুশিই হবে । কেননা এই মহিলা সবসময় তার পেছনে লেগে থাকে এবং খুঁত পেলে এক হাত নেয়, বিশেষ করে যখনই দোকানে ক্রেতা থাকে ।

‘মিস হিল, তুমি কি দেখতে পারছো না এই মহিলারা অপেক্ষা করছে ?’

‘দয়া করে ভালো ভাবে তাকিয়ে দেখ, মিস হিল ।’

দোকান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য মেয়েটির বেশি কান্না-কাটি করার কোনো প্রয়োজন পড়েনি ।

মেয়েটি জানে, অজানা দূর দেশে তার বাড়িঘর এখনকার মতো হবে না । তখন সে বিবাহিতা – সে অর্থাৎ এভলিন । ওখানে সবাই তাকে সম্মান দেখাবে । তার সঙ্গে মা যেমন ব্যবহার করেছে, ওরকম ব্যবহার কেউ করবে না । এখন তার বয়স উনিশ এবং এই বয়সে সে তার বাবার নির্যাতনের ভয়ে সারাক্ষণ আতঙ্কিত থাকে । সেই আতঙ্ক তার বুকের ধুকপুকানি বাড়িয়ে দেয় । তারা যখন বড় হচ্ছিল, তখন হ্যারি এবং আর্নেষ্টের সঙ্গে বাবা যেমন ব্যবহার করতো, সেরকম ব্যবহার সে বাবার কাছ থেকে পায়নি । কেননা সে একজন মেয়ে । বাবা তাকে কড়া শাসনের বেড়াজালে আটকে রাখতো এবং সরাসরি বলতো যে, তার জন্য সে যা করেছে, তা শুধু তার মৃত মায়ের জন্যই করেছে । তখন বাবার নিগ্রহের হাত থেকে তাকে রক্ষা করার জন্য কেউ ছিল না । ইতিমধ্যে আর্নেষ্ট মারা গেছে এবং হ্যারি, যে গির্জা সাজানোর কাজ করে, সে অন্যত্র চলে গেছে । নিয়মমাফিক প্রতি শনিবার রাতে টাকার জন্য বাবার সঙ্গে উচ্চস্বরে তার ঝগড়া হতো এবং ঝগড়ার পর সে ভীষণ ক্লান্তি বোধ করতো । সবসময় সে তার উপার্জনের পুরোটাই, অর্থাৎ সাত শিলিং, বাবার হাতে তুলে দিত এবং হ্যারিও ওর সাধ্যমত সাহায্য করতো । কিন্তু তারা কখনো বাবার কাছ থেকে কোনো অর্থকড়ি খসাতে পারেনি । বাবার ধারনা, সে অপব্যয় করবে । তবে রবিবার রাতের খাবারের জন্য মেয়েকে টাকা দিত । তখন সে ভীড় ঠেলে দোকানে গিয়ে খাদ্যসামগ্রী কিনে বাড়ি ফিরতো । সংসার সচল রাখার জন্য সে প্রচন্ড পরিশ্রম করতো । এছাড়া ছোট ভাই দু’টোকে দেখভাল করতে হতো । তার জীবন ছিল কঠিন । কিন্তু এখন সে এই কঠোর জীবন ছেড়ে অন্য এক অপ্রত্যাশিত জীবনের পথে পা বাড়াতে যাচ্ছে ।

মেয়েটি ফ্রাঙ্কের সঙ্গে জড়িয়ে আরেক জীবন খুঁজে নেওয়ার জন্য প্রায় তৈরী হয়ে আছে । ফ্রাঙ্ক অত্যন্ত দয়ালু, পৌরুষদীপ্ত চেহারা এবং সাদা মনের মানুষ । স্ত্রী হিসাবে সে ফ্রাঙ্কের সঙ্গে রাতের আঁধারে জাহাজে করে বুয়েন্স আয়ার্সে গিয়ে নতুন জীবন গড়ে তুলবে । ফ্রাঙ্ককে প্রথম দেখার স্মৃতি তার মনের মধ্যে ভেসে ওঠে । মনে হয় এই তো সেদিনের ঘটনা । পরিচয়ের পর থেকে তারা প্রতিদিন বিকেলে দোকানের বাইরে অভিসারে বের হতো । কখনও তারা নাটক দেখতে যেত । তখন ফ্রাঙ্কের পাশাপাশি বসার জন্য সে একধরনের পুলক শিহরণ অনুভব করতো । তাদের এই মেলামেশা লোকজনের অগোচরে ছিল না । প্রথম দিকে সে বেশ উত্তেজনা বোধ করতো এবং পরবর্তীতে তার মনের মধ্যে ভালো লাগার অনুভূতি ক্রমশ জমাট বাঁধতে থাকে । ফ্রাঙ্ক আহ্লাদ করে তাকে পপেনস্ বলে ডাকতো । শুরুতে ফ্রাঙ্ক মাসে এক পাউন্ড বেতনের অ্যালান লাইন কোম্পানীর কানাডাগামী জাহাজের ডেক বয়ের চাকুরী করে । জাহাজে কাজ করার নানান অভিজ্ঞতা নিয়ে সে গল্প করে । সেবার স্বল্প সময়ের জন্য সে দেশে এসেছে । এভলিনের বাবা মেয়ের সঙ্গে ফ্রাঙ্কের সম্পর্ক জেনে যায় এবং সে ফ্রাঙ্কের সঙ্গে কথা বলার বিষয়ে মেয়ের প্রতি সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা জারী করে ।

‘আমি এই নাবিকদের ভালো করেই চিনি’, বাবা বলে ।

একদিন মেয়েটির বাবা ফ্রাঙ্কের সঙ্গে তুমুল ঝগড়া করে । তারপর থেকে এভলিন গোপনে তার ভালোবাসার মানুষটির সঙ্গে মোলাকাত করে ।

সড়কের ওপর তরল অন্ধকার জমাট বেধেছে । মেয়েটির মানসপটে তার ভাই ও বাবার মুখচ্ছবি ফুটে ওঠে । আর্নেষ্টকে সে বেশী পছন্দ করতো, তবে হ্যারিকেও সে ভালোবাসে । সে লক্ষ্য করেছে, বাবা বুড়ো হয়ে গেছে এবং তার অনুপস্থিতি সে ভীষণ ভাবে উপলব্ধি করবে । কখনো কখনো বাবা অত্যন্ত ভালো মানুষ । খুব বেশী দিন আগের ঘটনা নয়, একদিন বাবা ছুটি নিয়েছিল এবং তাকে বই পড়ে শুনিয়েছে । মা বেঁচে থাকতে তারা একসঙ্গে বনভোজনে গিয়েছিল এবং বাবা তাদের প্রচুর হাসিয়েছিল ।

মেয়েটির সময় খুব দ্রুত চলে যাচ্ছে । তবুও সে জানালার পর্দায় মাথা হেলান দিয়ে বসে আছে এবং ধূলোমাখা ময়লা কাপড়ের গন্ধ এসে নাকে লাগছে । রাস্তার শেষ প্রান্ত থেকে তার কানে বাদ্যযন্ত্রের করুণ সুর ভেসে আসে । মৃত মায়ের সে আদেশ জানে । মৃত্যুর আগে মা বলে গেছে, সাধ্য অনুযায়ী সে যেন সংসার টিকিয়ে রাখে । যেই রাতে মা মারা যায়, সেই রাতে সে এমন করুণ সুর শুনতে পেয়েছিল । অবচেতন মন ক্রমশ তাকে ভাবনার অচিন ভুবনে নিয়ে যায় । মায়ের শেষ কথাগুলো তার কানে অনুরণিত হতে থাকে ।

আকস্মিক ভয় পেয়ে মেয়েটি দাঁড়ায় । পালাও ! অবশ্যই তাকে পালাতে হবে । সে জানে, এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি থেকে ফ্রাঙ্ক তাকে উদ্ধার করবে । পালিয়ে যাওয়ার পথ নিয়ে ফ্রাঙ্ক অনেকবার তার সঙ্গে কথা বলেছে । জাহাজ ঘাটে উর্দি পড়া অনেক সৈনিক । দরোজার ফাঁক গলিয়ে আবছা অন্ধকারে সে ঘাটের শেষদিকে সারিবন্দী অনেক জাহাজ দেখেছে । মেয়েটি জবাবে কিছুই বলেনি । সেই মুহূর্তে সে অনুভব করে, তার গাল দু’টো আরক্তিম এবং হিম হয়ে গেছে । চোখের পাতা বন্ধ রেখে সে ঈশ্বরের কাছে আকুল প্রার্থনা করে যেন তিনি সঠিক পথ বাতলে দেন । তার একদিকে মাতৃহীন সংসারের গূঢ় দায়িত্ব এবং অন্যদিকে ভালোবাসার মানুষকে জড়িয়ে রঙিন স্বপ্ন । সে কোন দিকে যাবে ? কুয়াশার ভেতর জাহাজ ছাড়ার হুইসেল শোনা যায় । সে যদি জাহাজে ওঠে, তাহলে পরদিন সে ফ্রাঙ্কের সঙ্গে বুয়েন্স আয়ার্সের পথে সমুদ্রে থাকবে । তার জন্য টিকেট কাটা হয়েছে । ফ্রাঙ্ক এতকিছু করার পরও কি সে ফিরে যাবে ? এই দোদুল্যমান পরিস্থিতিতে তার শরীর রীতিমত কাঁপতে থাকে এবং দ্রুত ঠোঁট নেড়ে নিঃশব্দে প্রার্থনা করে ।

মেয়েটির বুকের ভেতর অচেনা সুর বেজে ওঠে । মনে হলো ফ্রাঙ্ক তার দু’হাত আলতো করে চেপে ধরে বলছে, ‘এসো !’

মহাসমুদ্রের তামাম উত্তাল তরঙ্গ যেন মেয়েটির বুকের ভেতর এসে এক সঙ্গে আছড়ে পড়ছে । ফ্রাঙ্ক বুঝি সমুদ্রের সেই বিশাল ঢেউয়ের মাঝে তাকে ডুবিয়ে দিতে চাইছে । ভয় পেয়ে মেয়েটি পাশের লোহার রেলিং শক্ত করে চেপে ধরে ।

‘এসো !’

না ! না ! না ! এটা অসম্ভব ।

প্রবল উত্তেজনায় মেয়েটি আরো শক্ত করে রেলিং চেপে ধরে । নিদারুন মানসিক যন্ত্রণায় সে সমুদ্রের ঢেউয়ের শব্দের সঙ্গে তীব্র চিৎকারের আওয়াজ মিশিয়ে দেয় ।

‘এভলিন ! ঈভি !’

ফ্রাঙ্ক চটজলদি বাঁধা পেরিয়ে কাছে এসে বলে, এভলিন যেন তাকে অনুসরণ করে । চিৎকার করে ফ্রাঙ্ক তাকে ডাকতে চাইছিল, কিন্তু তা না করে সে আলতো করে নরম গলায় ডাকে । এভলিন অসহায় বোবা পশুর মতো ফ্রাঙ্কের মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে । সেই মুহূর্তে ফ্রাঙ্ককে দেওয়ার মতো তার চোখের তারায় ভালোবাসার লেশমাত্র চিহ্ন নেই, এমনকি বিদায়ের করুণ ছবি কিংবা পূর্ব পরিচয়ের মতো কোনো আলামতও দেখা যায়নি ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ