সাধন চট্টোপাধ্যায়'এর গল্প : ভারততীর্থ

একটো হিস্যা শুনিয়ে মালিক :

'চিন্তাসে চতুরাই ঘটে
দুখসে ঘটে শরীর
পাপ সে ধন- লছমী ঘটে
কহ গয়া দাস কবীর--;

চিন্তা করে মেজাজ নষ্ট, দুঃখে নষ্ট শরীর। আর পাপ করলে সব অর্থ নষ্ট হয়ে যায়-- এমন কথা বলেন কবীরদাস।

কানী লাইন ক'টি উচ্চারণ করেই মনের প্রশান্তিতে হেসে উঠল। তার চোখের লালচে ড্যালা দুটো থিরথির করে কেঁপে উঠতেই আমি চমকালাম। ঝড়ের দাপটে, এলোমেলো বাতাসের মোচড়ে এক হিচলায় শরীরের বেশ কিছু অংশ গেল ভিজে।


আর্দ্র বাতাসে সারাটা দিন ছিল ভয়ানক গুমোট। ভাপে সিদ্ধ হবার মত চামড়ার অভ্যন্তর জ্বলে পুড়ে যাচ্ছিল। এক ফোঁটা ঘাম শুকোবার মত বাতাস ছিল না। বিকেলের কিছু আগে গৃহত্যাগী হয়ে পায়ে পায়ে শহর পেরিয়ে অপেক্ষাকৃত নিরালা-নির্জন এলাকায় চলে এলাম। দূরে দূরে ইটভাটায় চিমনি, পীচ-ঢালা বাস রাস্তা এবং বেশ কিছুটা দূরে হাটের বাঁধা চালা। সপ্তাহে দুদিন দূর-দূরান্তের মানুষ সওদা কেনা-বেচার আসর জমায়। সব কিছু টপকে সবুজ অঞ্জন রেখা।

শহর আমাকে আকর্ষণ করতে পারে না। শহরবাসীদেরও অবিমিশ্র ভালবাসায় গ্রহণ করতে পারি না। এই গুমোট পরিবেশে তারাও আপন আপন গৃহকোণ ছেড়ে সেজেগুজে রাস্তায় নাক উঁচিয়ে হাঁস-ফাঁস করছে, সোনা শাড়ি কিংবা এক আধ টুকরো ফল মিষ্টি চপ কাটলেটের লোভে হুমড়ি খাচ্ছে দোকানে--কিনুক না কিনুক একটু শুঁকতে পারলেও যেন কৃতার্থ! আর জীবনযন্ত্রণা অর্থাৎ মাংস-মজ্জার লোভে হয়ে উঠছে কামাতুর।

আমি এই শহর জীবনের গুহা পেরিয়ে আসতে আসতেই মধ্যপথে আকাশের দক্ষিণ পশ্চিম কোণে রহস্যের মত মেঘ জমে উঠল। ঘন, কাল এবং গুরুগুরু। তার পটভূমিতে দূরের গাছপালারা ধূসর হয়ে উঠল। আহা মেঘ! ঝড়! অস্বস্তিকর স্থবিরত্বের শেষে হয়ত এমন করেই ঝড় ফুঁসে ওঠে। ভেসে আসে ঠাণ্ডা বাতাস, সঙ্গে সঙ্গে ধুলোর ঘূর্ণি এবং ঝটপট গাছেদের সর্বাঙ্গে এলোপাথাড়ি-- যেন উপড়ে ফেলবে।

একটু পরেই, আর দশটা মানুষের মত ঝড়-জলের হাত থেকে শরীরটুকু বাঁচাতে আশ্রয়ের উদ্দেশ্যে ছুটতে হল। আমার পোশাক ও চুলের আনাচাকানাচে তখন বাতাসের ক্ষিপ্ত আস্ফালন। পাকা রাস্তার পাশে, মস্ত নর্দমা টপকে একটা চালা।

কুঁড়ো, ভুষি ইত্যাদি নানা প্রকার শস্য-ছালের ধূসর গন্ধ এবং তীব্র গোময়ের ঝাঁজ। পাশেই একটা আটাচাকির কল--দুটো পাথরের মাঝে শস্যকে যেখানে পেশাই করা হয়। আমি এসে একটা চালার নিচে দাঁড়ালাম বৃষ্টি তখন ধেয়ে এসেছে। একটু পরেই টের পেলাম আশ্রয়ের স্থানটি মোটেই মজবুত নয়, জংধরা টিনের। ফলে জলের ধারা গলগলিয়ে উঠলে টুপটাপ নিরাপত্তা ক্ষুণ্ণ হতে লাগল।

অন্ধকার ছায়া-ছায়া। বাতাসের মোচড়ের সঙ্গে জলের উচ্ছ্বাস এবং নিমেষে মেঘটা আদিগন্ত ছড়িয়ে ঈষৎ পিঙ্গল হয়ে গেল। আমি প্রকৃতির নিয়ম নিপুণত্বের কথা ভাবতে ভাবতে অলস দৃষ্টিতে দেখছিলাম জলকণার শুভ্র অস্পষ্টতা ও ক্কচিৎ যানবাহন চলাচলের কদমফুলি হেডলাইটগুলো।

অন্ধকার পারিপার্শ্বিকে আমি এতক্ষণ দৃষ্টি দিই নি, হঠাৎ বিড়ির গাঢ় ধোঁয়া আমার অনুভূতি স্পর্শ করল। তাকিয়ে দেখলাম একই আশ্রয়ের কোণে কয়েকটা মানুষের অস্পষ্ট অবয়ব। উবু হয়ে হাঁটু ঠেকিয়ে আছে। তাদের কথাবার্তা কম, উপরন্তু বৃষ্টিতে আমার কিছুই কানে আসছিল না। মাটি-মাখা আঙুলে বিড়ির স্থূল সশব্দ টানে লালচে চোখগুলো উসকে উঠছিল শুধু।

সামনেই বাতাস চাবকাচ্ছে প্রাচীন গাছটাকে।

একঘেয়েমির হাত থেকে রেহাই পাবার আশায়, বিনা সংকোচে এবং ভূমিকা ব্যতিরেকেই হ্যালা-ফ্যালা ভাবে জিজ্ঞেস করলাম, 'কোথায় যাবে সব?' কেউ জবাব দিল না। যেন এড়িয়ে গিয়ে চুপচাপ বসে থাকলে বেঁচে যায়। আমারও একটু খোঁচাবার কৌতূহল হল। জানি প্রতিপক্ষের কাছে আমি যথার্থই ভদ্র ও বাবু গোছের। সুতরাং এ কৌতূহলটা স্বাভাবিক।

'কি হে, বলছ না যে... কদ্দুর যাবে?'

টুক করে কে যেন জবাবটা ছেড়ে দিল, 'সামনের ভাটায় বাবু'।

আমি নড়া-চড়া মানুষগুলোর দিকে মুখ ফিরিয়ে বললাম, 'ঐ ভাটায়?... তা এদিকে দল বেঁধে কেন?'

ওরা নিজেদের মধ্যে কি যেন বিড় বিড় করল। তাদের জীবনযাত্রার আপন গণ্ডীর মধ্যে আমার কৌতূহলী আলাপের ছায়া নিশ্চয়ই বিরক্ত উৎপাদন করেছে। অনিচ্ছায় উত্তর দিল একজন, 'হাটে এয়েছিলাম'।

হাট! হ্যাঁ, আজ হাটবার। আমি তাকালাম সওদা কেনা-বেচার নির্দিষ্ট স্থানটুকুর দিকে। আমার হাসি পেল। ওখানে এখন চালার খুঁটিগুলো নিঃশব্দে নির্জনে এত অসহায়ভাবে ভিজছে, মনেই হয় না সপ্তাহে দুদিন ঐ এলাকাটুকু ঘিরে মানুষ এত চঞ্চল হয়ে উঠতে পারে।

বুঝলাম ভাটার কুলিরা হাট করতে এসে আটকা পড়েছে। সাপ্তাহিক সওদায় সুবিধা হল না আজ। এর বেশি ওরা আমার প্রশ্নের জবাব দিল না। নিজেরা ফিসফিস শুরু করে দিল। তালুতে টকাস্‌ টকাস্‌ বা ঠোঁটে চুকচাক শব্দ-- বুঝলাম কোন দুঃখজনক ভাগ্যের আলোচনা চলছে।

সামনেই বাতাস চাবকাচ্ছে প্রাচীন গাছটাকে।

বৃষ্টির একটানা দৃশ্যে একঘেয়েমি না-কাটতে পেরে মানুষগুলোর মধ্যেই ফিরে আসতে হল। 'আগুন আছে, আগুন?'

পেতলের সস্তা পেট্রোল বাতিটা জ্বালিয়ে কাল মোটা আঙুলগুলো আগুনটা আড়াল করতে, আমি ঠোঁটেচাপা নেশার বস্তুটা সেখানে গলিয়ে দিলাম।

'খাবে বিড়ি?'

তিনজন আমার দান গ্রহণ করে ঠাণ্ডায় খকখক কাশতে লাগল।

আমি মানুষের এই ছোট্ট পালটিকে চিনি। খনি, বাগিচা এবং শস্যক্ষেত্রে এরা মুখ বুজে কাজ করে। উত্তরভারত থেকে ধান গম কেটে নেমে আসে পুবে, পশ্চিমে-- উদরের উৎকণ্ঠায়। হ্যাঁ, উত্তরভারত থেকে। ভৌগোলিক সীমানায় এ ভূখণ্ড হল হিমালয়ের নীচে গাঙ্গেয় সমতলভূমিতে। এই সেই ভূখণ্ড যেখানে যুগে যুগে ইতিহাসের মানুষ ভারতবর্ষের বুকে এসে প্রথম উপস্থিত হয়েছিল। প্রথম সেই হিন্দুকুশ থেকে সভ্যতার মন্ত্র নিয়ে এল একদল। দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে-- ভারততীর্থের সৃষ্টি হয়েছিল। আজ এই ছোট্ট পালটার পিতৃপুরুষদের তারা দিয়েছিল পার্থিব জীবনের ঊর্ধ্বে নতুন জন্মের আস্বাদ আর গ্রহণ করেছিল বস্তু অর্থাৎ ভূমি। দুয়ের সংঘাতেই ত ভারততীর্থ।

এই দীর্ঘ বছর পরও, এই মানুষের পালেরা সারাটা বছর ভুরু ঝরা ঘাম পায়ে ফেলে কয়েকটা কাঁচা পয়সার জন্য। বর্ষার কাদাজলে গ্রামের জমিতে শস্যের কাজ শেষ হয়ে গেলেই, আশ্বিনের পরেই গাঁয়ে গাঁয়ে দাদন পৌঁছে যায়। সময় হলেই সর্দারেরা গাদাই ট্রেনে পার্সেল করে আনে এখানে-- পুবের বিখ্যাত শহরে। এখান থেকেই কেউ কেউ চালান যায় ইটভাটায়-- উদয়াস্ত মাটি কাটে, ইট বানায়, আগুনে সেঁকে, গুনে গুনে তোলে লরীতে। কেউ কেউ যায় জন খাটতে, জোগান দিতে। রোদে জলে চামড়া পুড়িয়ে, পুনরায় গ্রীষ্মের দাবদাহে মজুরের পাল ফিরে যায় উত্তরে, আপন আপন গাঁয়ে। সেখানে খেতের কাজের পর মরশুমি হাওয়া দলাদল মেঘ মাথায় জলের ঝাঁঝরি ঢালতে শুরু করে মাঠ-ঘাট, পাহাড়ে জঙ্গলে। ধরতি ঋতুমতী। চাষবাস লাঙ্গলের দরকার। এই মানুষের পালেরা, আজকের এমনভাবে হাঁটু লাগিয়ে থাকার মত জমিদারের উঠোন প্রান্তে একদা গোপনে খৈনির চিমটি দাঁতে গুঁজে পিচ্‌ পিচ্‌ করে থুতু ফেলত। খেতির কাজে মালিকের দয়াভিক্ষা চায়। দিনে তিনসের ধান আর কিছু গম। উঠোনে এদের ছায়া পড়া নিষেধ। কারণ নিম্নবর্ণের রক্ত বহন করছে এরা। কূরসী, ভূমিহার, মুচি-মাহাতোদের ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় বা রাজপুতদের উঠোনে ওঠাবার কোন বিধি নেই। সমানেই বাতাস চাবকাচ্ছে প্রাচীন গাছটাকে।

প্রথম কথা বলে উঠল ধনচাঁদ মাহাতো। ধূলিধূসর রুক্ষ চুল, কাল গাঁট্টাগোট্টা চেহারা এবং রোদজলে পোড়া চামড়া। নিজের দলের কাছে আপশোস করে বলল, 'জলে আর চাকি খুলবে না... আটা মিলবে কোথায়?'

'কোথায় আর মিলবে? এখন ঘর চল।'

চুকচুক আপশোসের শব্দ করল সে।

আমি ওর কথায় যোগ দিলাম এবং আলাপ পরিচয়ের সূত্রে একটা কুলপঞ্জি বার করে নেয়াও কষ্টসাধ্য হল না।

ওর মুলুক বর্তমান ভৌগোলিক হিসাব অনুযায়ী হাজারীবাগ জেলায়। গ্রাম থেকে নিকটতম রেললাইন সাতাশ মাইল, বাসরাস্তা মাইল উনিশের মত হবে। হাতুড়ে ডাক্তারটিকেও দেখাতে গেলে মুমূর্ষু রুগীকে নিয়ে ডুলিতে এগার মাইল পথ পাড়ি দিতে হয়। ডাক্তারের ব্যাপারে ওদের অবশ্য কোন অসুবিধে নেই, কারণ ওসব শয়তান অর্থাৎ সুঁচ-ওষুধ পবিত্র শরীরে ওরা ঢুকতে দেয় না।

ধনচাঁদ মাহাতোর বাপ কালু মাহাতো প্রভুর সম্পত্তি রক্ষায় প্রাণটুকু বিসর্জন দিয়ে গ্রামে প্রশংসা কুড়িয়েছিল। খুব ধর্মভীরু ছিল সে এবং পার্থিব জীবনের দুঃখ-দারিদ্র্যে কোনদিন হা-হুতাশ করত না। কারণ আগামী জন্মের পুণ্যকর্মে দিনরাত মশগুল থাকত সে। জমিদার অনুগ্রনারায়ণ সিং-এর বাড়িতে ছিল চাকর। রাতের অন্ধকারে ডাকাতের টাঙ্গির মুখ তুচ্ছ করে বুক পেতে দিয়েছিল।

গ্রামের পণ্ডিতজী বলত শাস্ত্রের কথা। শূদ্রদের এই পার্থিব জীবনের জ্বালা-যন্ত্রণা থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় প্রভুর সেবা করা। নিমকহারামি করলে নাকি দশ নরক ভোগের পর মানুষ গাধা বা শুয়োরের যোনিতে স্থান পায়। কালু মাহাতো সজ্ঞানে কোন পাপ করেনি অথবা শয়তানকে মাথায় দেয়নি স্থান। সামান্য সুতোটুকুতে লজ্জা ঢেকে প্রাণপাত করেছে প্রভুর সম্পত্তি রক্ষায়। শাস্ত্রজ্ঞানবিবর্জিত রাক্ষসের বংশধর ডাকাতেরা-- সীতাকে যাদের নির্দয় পূর্বপুরুষেরা চুরি করেছিল-- টাঙ্গির ঘায়ে খসিয়ে দিল মুণ্ডুটা, ফেড়ে ফেল্ল বুক। কাছারি ঘরের উঠোনে কি রক্তের কাদা! গাঁয়ের লোক ওজন করিয়েছিল বিশাল কলজেটা-- প্রায় সের দেড়েকের মত হবে। প্রভু শোকে কেঁদেছিলেন-- গাঁয়ের জনসমক্ষেই ঝরিয়েছিলেন চোখের জল।

জলের হিচলা আসছে। সমানেই বাতাস চাবকাচ্ছে প্রাচীন গাছটাকে।





কালু মাহাতোর বাপের নাম ঢিলং মাহাতো। হাবা-হাবা নুলো। তার কোন সন্তান উৎপাদনের ক্ষমতা ছিল না। তবুও ঘর ভরে উঠেছিল শিশু সন্তানে। পণ্ডিতজীর কথা সত্য প্রমাণিত হয়েছিল-- ভগবানের অপার করুণায় পৃথিবী টিকে আছে, বংশবৃদ্ধি হচ্ছে জীবের। ঢিলং বেশিদিন পৃথিবীর আলো-বাতাস পায় নি, জঙ্গলে কাঠ আনতে গিয়ে উধাও। পরে গাঁয়ের একজন স্মৃতিচিহ্ন হসাবে কুড়ুলটা আর নখে আঁচড়ান রক্তাক্ত পোশাকটা নিয়ে ফিরে এসেছিল।

ঢিলং-এর বাপ তিলু মাহাতোরা প্রথম পাহাড় কেটে জঙ্গল সাফ করে জমির পত্তন করেছিল। পরে ডিকুরা এসে চাষযোগ্য জমি হাত বদল করে। কারণ শাস্ত্রে ইতরজনের কাছে মা ধরিত্রীর মালিকানা দেয়া লেখা নেই। সর্বজনভোগ্য জলবাতাসের মত ভূমিবিলি নিয়ে ছেলেখেলা করা যায় না।

এই সব কুলপঞ্জী বর্ণনার ফাঁকে ফাঁকে, ধনচাঁদ মাহাতোর কথা শুনে মনে হল আমাকে সে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করে না। দশটা কথার উত্তরে পাচ্ছিলাম একটা। বিশেষ করে ওদের রুজি রোজগার, বাপ-ঠাকুর্দার কথা, দাদন, পার্থিব সুখদুঃখের ব্যাপারে বেশি কথাবার্তায় সে নারাজ। বরঞ্চ আপনার গণ্ডির মধ্যে আলোচনা, গুজগুজ বা হাসিঠাট্টায় এই ছোটখাট পালটার উৎসাহ বেশি। রাস্তা দিয়ে চলন্ত লরীতে ছাগল পাঁঠার মত জলে বিপর্যস্ত কুলিদের দেখে দলটা হাসছিল কিংবা ভাঙা হাটের কোন ঘটনা নিয়ে অহেতুক গালগল্পে মেতে উঠেছিল। এরই ফাঁকে ফাঁকে ধনচাঁদ আপশোসের দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিল শস্য পেষাইয়ের দোকানটার দিকে। একজন শরীর অর্থাৎ তবিয়ত নিয়ে আলোচনা তুলল। ধনচাঁদ বোঝাল, 'দেহটা মাটি। চোখ বুঝলেই শেষ... কি হবে ভেবে?--'

'মাটি কেন? পেট থেকে কি গাছ হয়?--'

'দূর! আস্ত গাধা! মরার পর ভগবান বাতাসে মিলিয়ে গেলে... গরু ছাগলদের দেখিস না।'

আমি হাসি দিয়ে ওদের অপ্রস্তুত করে বল্লাম, 'বাঃ, বেশ বুঝিস ত!'

ধনচাঁদ ক্ষুণ্ণ হল। তোতলাতে তোতলাতে বল্ল, 'সব বুঝি আমরা...। থাকি বোকাপানা, সব বুঝি বাবু।'

সামনেই বাতাস চাবকাচ্ছে প্রাচীন গাছটাকে।

হঠাৎ বামা-কণ্ঠ হাই-তোলা স্বরে অন্ধকার ফুঁড়ে উঠল। সে যেন এসব আলোচনা থেকে অনেক দূরে। 'কি মাসরে ইটা?... জষ্টি?... উঃ কবে দেশে যাব। ... কে বিড়ি খাচ্ছিস? দে'গ বাবু একটা বিড়ি।' মানুষেরা পালটা ধমক দেয়। আমিই একটা বিড়ি এগিয়ে দিই। ওরা কিন্তু উষ্মার বিড়বিড়ানি থামায় না।

কানী জন্ম-অন্ধ। ইটভাটারই একজন মেয়েকুলির বোন। ওখানে সে ওর ক্ষমতা মত খাটে আর সপ্তাহে দুদিন হাটে ভিক্ষে করতে আসে। গায়েগতরে মাংস-টাংস আছে। জন্মান্ধ বলে ওর সাদি হল না কিন্তু পাঁচ ছবার ভোগ করেছে প্রসব যন্ত্রণা। এখনও ওর কোলে একটা বাচ্চা। ভাটার মালিক, লরীড্রাইভার, কুলী, হাটের ব্যাপারী কিংবা নিরালা পথের কোন বেখাপ্পা পথিক এই সর্বশেষ সন্তানটির পিতা হতে পারে।

পালের সঙ্গে প্রতিবছর কানীকে আনে ওর বোন।

আর্থিক লাভ মন্দ হয় না। ভিক্ষের পয়সা কিংবা মজুরীটা নিজের কবলে রাখতে পারে। জ্যৈষ্ঠের প্রারম্ভে দলের সঙ্গে কানীও ফিরে যায় দেশে, সন্তান হারিয়ে যায় পৃথিবীর জনারণ্যে, লেগে পড়ে ফসলের কাজে। ফের আশ্বিনে হাজিরা দেয় এখানে-- গর্ভভারে তার শরীরে তখন চিকন লাবণ্যের ঢল নেমেছে।

পৃথিবীর আলো-বাতাস না চিনলেও, রাস্তাঘাট সে নির্বিঘ্নে পার হয়ে যায়। অনেক চোখঅলা লোকের চাইতেও ভাল।

এই কানীর কূলপঞ্জীতেও দেখা যায় তার মা যাযাবরের মত কাজের সন্ধানে ঘুরে বেড়াত। তার মাকে অর্থাৎ কানীর দিদিমাকে ছ্যাঁকা দিয়ে মেরেছিল শাশুড়ি। দিদিমার মা অবিশ্যি মরেছিল নিজেই; গলায় পাথর চাপিয়ে জলে ডুবে। তার মা বা দিদিরা পালে পালে বিক্রি হত এ হাটে ও হাটে।

বাতাস চাবকাচ্ছে প্রাচীন গাছটাকে।

বিড়ির ধোঁয়ায়, আনন্দে কানী আমায় বলে উঠল, 'ভগবান মঙ্গল করবে বাবু, হাটত বসল না, দুটো পয়সা ফেলে যা। ... কি ভাবছিস অত?'

'ভাবছি আর কি? চিন্তা ছাড়া ত মানুষ বাঁচে না। তাই একটা কিচ্ছু ভাবতেই হবে।'

কানী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তখন বলে উঠল, 'একটা হিস্যা শুনিয়ে মালিক...'

ভাবলাম প্রতিবাদ করব না, কিন্তু বৃষ্টি তখনও ধরে আসে নি। তাই ইচ্ছে করেই যোগ দিলাম, 'পাপে ধন-লক্ষ্মী নষ্ট হবে কেন? ... পাপ না করলে ধন-লক্ষ্মী আসবে কি করে?'

কানীর সঙ্গে ধনচাঁদও জিব কেটে উঠল, 'ই ঠিক না।'

যেন বজ্রপাত হল আমার এ উল্টো কথায়।

'কেন ঠিক না? ... পৃথিবীতে এত লোক, এত তাদের টাকা, তাদের কেউ পাপ করছে না?'

ধনচাঁদ জবাব দিল, 'ই'ত এ জনমের টাকা নয় বাবু। ... অন্য জনমের।'

হেসে জবাব দিলাম, 'মরলেই ত মাটি। ... অন্য জনম মানে?'

'দশটা জনম আছে বাবু। ... তারপর সুখ।'

আমি কিছু বলতে গেলে সে তীব্র প্রতিবাদ করে উঠল। ইতিমধ্যে কানী যেন আঘাত খেয়ে জেগে উঠেছে।

'আপনি বলছেন দুনিয়ার মালিক নাই? ... নিশ্চয় আছে, এ'ত হাট গ। ভগবান আমাদের হাটে পাঠাচ্ছেন কেমন সওদা করি দেখতে। হুঁ বাবা! ভগবান নাই বল্লে চলে?'

প্রসঙ্গত আমি কানীর সঙ্গে ও ব্যাপারে কোন কথাই তুলি নি। এ তার কাল্পনিক অভিযোগ। আমার হাসি পেল। হালকা গলায় জিজ্ঞাসা করলাম, 'তোমার এই কয় জনম?'

'ই মস্ত জ্ঞানের কথা বাবু। ... আমি কি বলতে পারি?'

ধনচাঁদ মনে মনে এতক্ষণ কিছু কথা ভাবছিল। রাগত স্বরে আমাকে উল্টে জিজ্ঞেস করল, 'পৃথিবী-- মানে এই সোনার মাটির জনম আপনি জানেন?'

'হুঁ, না-জানার কি আছে? সূর্য থেকে।'

কানী তাচ্ছিল্যের হাসি দিল। ধনচাঁদ আমার অজ্ঞতার জবাবই দিল না। কানী মুখ ফুটে বল্ল, 'না'গ, ঠিক না।'

'কি তবে?'

আমাকে সে মুচির মেয়ের কাহিনীটি শুনিয়েছিল, যে না' কি ছিল অসাধারণ সুন্দরী ও অসূর্যম্পশ্যা। তার রূপের বর্ণনায় সূর্যদেবও নাকি টলে উঠেছিল। থাকত সে মস্ত এক গাছের মাথায়। পৃথিবী তখন জলমগ্ন, শুধু জল আর জল, স্থল বলতে কিছু নেই। একদিন সেই রূপবতী মুচি-কন্যা একটি পাতা ছিঁড়ে ফেলেছিল জলে। হাজার হাজার বছর সে পাতাটি জলে ঘুরপাক খেয়ে, দৈবাৎ স্থির হয়ে গেল একবার। সেই সুযোগে জন্ম নিল মাটি, গড়ে উঠল ধরিত্রী, জমি, ঘাস এবং শস্য। গম, যব, ধান।

হ্যাঁ, ধান থেকে ফুলের পাপড়ির মত ভাত। আহা কি স্বাদ! কি গন্ধ! কানীরা জানবে কোত্থেকে? বর্ষায় ওদের থালায় শুধু ঘাসবীজ জোটে।

ঠাণ্ডা আমেজে কানীর কণ্ঠে গান বেজে উঠল, 'জানি না, কয় জনমের শেষ হল'গ...।'

জলের ধারা একটু কমতেই ছপ্‌ ছপ্‌ শব্দে মানুষের ছোটখাট পালটা রাস্তা পেরিয়ে ছুটল অন্ধকারে ভাটার উদ্দেশ্যে।

কানীর গানের রেশ কানে বাজতে মনে হল ও না জানলেও, আমি জানি ওর কত জনম হল। চোখ বুজতেই ভাসতে লাগল এই ত সেদিন জনম শুরু। হিন্দুকুশ পেরিয়ে দলে দলে যেন কারা আসছে। মালিনীর তীরে শান্ত বনচ্ছায়ে তারা মন্দ্রস্বরে উচ্চারণ করল 'স্বর্গ!' পুনর্জন্ম! পাপপুণ্য! আত্মা! সেবা!' জ্ঞানের অঞ্জলি উজাড় করে দিল। দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে-- সৃষ্টি হল ভারততীর্থের। সেই থেকে এই পালেরা উলঙ্গ দেহে যাযাবরের মত ছুটছে ত ছুটছেই। কাল মেঘের মত এক দেশ থেকে অন্যদেশে। সুতরাং দশ জনমান্তে সুখ আসার দিন কত বাকি হিসেবটা বিশেষ অসুবিধের নয়।

বাতাস চাবকাচ্ছিল প্রাচীন গাছটাকে। উপড়ায় নি; কারণ শিকড় থাকে গভীর গভীরে যেখানে বাতাস এখনো পৌঁছয়নি।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ