মুঠো ফোনটা কানে ধরেই নীলা ওপাশ থেকে শুনতে পায় হেনা রীতিমত হাঁপাচ্ছে। পাশের বাড়ির ডাহা সাইজের বেড়ালটা যখন সকালবেলায় বুলার খেলনাগুলো শুঁকে টুকে তারপর রান্না ঘরের দিকে যায়, ঠিক তখনই শলার ঝাড়ুটা নিয়ে ওর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে হেনা, সপাং সপাং দুচারটা বাড়ি মেরে তারপর হাঁপাতে থাকে। কিন্তু আজ ঠিক সেরকমটি করছেনা। কেবল ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে আর জোরে জোরে দম ফেলে হাঁপাচ্ছে। অফিস যাবার জন্য নীলা বাড়ি থেকে বেড়িয়েছে দু ঘন্টাও হয়নি। এরই মধ্যে এমন কি হল যে হেনাকে কাঁদতে হবে?
বিড়ালের উৎপাত এত বেড়েছে যে রান্নাঘরের বাসনপত্র কোনটা ‘চেটে রাখা’ আর কোনটা নয় বুঝে ওঠা খুবই মুশকিল। নীলার আবার শুচিবাই আছে। সবকিছুতেই তাঁর চিটচিটে ঘিনঘিন লাগে। হেনাকে তাই রোজ সকালে ঘষে ঘষে টিফিনবাক্সটা ধূঁতে হয়। কোন খুঁত পেলে সে খাবার আর নীলা অফিসে নিতে চায়না। তাছাড়া খাবারের রুচিটাও আগের মতন নেই। ঘুষ খেয়ে কয়েক মাস আগেই চাকরীটা গেছে মামুনের। এ নিয়ে বাড়িতে অশান্তি চলছিল। অবচেতনে নানা রকম সন্দেহ থাকলেও বাইরে এক ধরণের নির্বিকার ভাব-ই দেখাচ্ছিল নীলা। তাঁর ধারণা, টাকার গন্ধ পেলে মামুনের আদিম ইচ্ছেটা জেগে ওঠে। বেড়ালটার মতন চেটেচুটে খেয়ে ফেলতে চায় সে সবকিছু। হাত খুলে খরচ করে, বুলা যা চায় তা-ই কিনে দেয়, রিকশাওয়ালা, ফকির, দারোয়ান, সবাই এ টাকার ভাগ পায়। লোকে দেখে বলে, ‘আহা, মানুষটা কত ভাল’। ঘুষের টাকা খরচ করতে এতটুকু লজ্জ্বা হয়না মামুনের। সাপ্লাইয়ার’রা ঘুষ দিয়ে কাজ পাবে সেটাই খুব স্বাভাবিক। কিন্তু এবার কোন এক ঘাগু ব্যবসায়ী বাটপারী করে ঝামেলা করে ফেলাতেই কোম্পানীর বড়কর্তা ডেকে নিয়ে সরাসরি ছাটাই করে দিল। ‘এটা এমন কোন দোষের ব্যাপার নয়’ আর সেটাই সে নীলাকে বোঝাতে ব্যর্থ হচ্ছিল। হতাশা আর মানসিক চাপ আঁকড়ে ধরছিল নীলাকে। সংসারের দায়িত্ব, বাচ্চাটাকে কাজের লোকের হাতে ছেড়ে দেয়া, সারাদিন অফিস করা, সবটাই ছিল বাড়তি চাপ। এতসব স্বত্তেও কোন ঝামেলা ছাড়াই শান্তি বজায় রেখে এক বিছানায় ঘুমাতে চেষ্টা করছিল দুজনই। কিন্তু বারবারই অনিচ্ছাকৃত যুক্তি তর্ক আর ক্ষমতার দ্বন্দ গ্রাস করছিল ওদেরকে। গত রাতে অবশ্য তেমন কিছু ঘটেনি। নীলা নিজের মত করে রাতের খাবার খেয়ে বুলাকে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। তাই এসবের বাইরে আর কি দূর্ঘটনা ঘটতে পারে ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলনা সে।
ফোন ধরে এবার চিৎকার করে উঠে নীলা, ‘কী রে, কী হয়েছে, বল? বুলা ঠিক আছে? পড়ে যায়নি তো? আগুন লাগেনিতো কোথাও?’
হেনা ধরা গলায় ঢোক গিলছে, ঠিকমতো কথা বলতে পারছেনা।
উদ্বিগ্ন কন্ঠে আবার প্রশ্ন করলো নীলা; ‘তোরা ঠিক আছিস তো? তোর মামা কোথায়?’
হেনা ধরা গলায় বললো; মামী, ‘আপনি কি এটটু বাসায় আসতি পারবেন’,এক্ষুনি ?’
‘অফিসে পৌঁছুতে না পৌঁছুতেই এসব কী শুরু করলি? সারা সকাল কোথায় ছিলি? আবার ঠিকমত কথাও বলছিস না, কী হয়েছে?‘ কোন শব্দ নেই ওপাশে।
‘কথা বলছিস না কেন? কী হয়েছে? আরে কিছু বলবি তো? হেনা...হেনা?’
হেনা খুব ঠান্ডা গলায় বললো; ‘মামী, আপনে সামনে আলি পরে কতি পারতাম।‘ বলেই ঠাস করে ফোনটা রেখে দিল।
মনটা ছুটে যায়। অস্থির লাগতে থাকে। সকালে বেরুবার আগেও তো সব ঠিকঠাক ছিল। মামুন আর বুলা একসাথে ঘুমোচ্ছিল। মামুন কোনটা খেতে ভালোবাসে, কোনটা বাসে না, কোন সবজি দিয়ে কি রান্না হলে ভাল স্বাদ হবে, এসব মাথায় রেখেই ইন্সট্রাকশন দিতে দিতে রেডী হচ্ছিল সে। হেনা তখন রুটি আর সবজী ডাইনিং টেবিলে বেড়ে রাখছিল। বেরুবার সময় টিফিন বক্সটাও এগিয়ে দিয়েছিল। এর মধ্যে এমন কি হলো যে অফিসে আসতে না আসতেই ফোন? বড় কোন দূর্ঘটনা ঘটেনিতো? কিন্তু বুলাওতো এখনও ঘুমাচ্ছে? কী-ইবা ঘটতে পারে? মামুনকে কল করেও ফোন বন্ধ পাচ্ছে। মাথায় আসলেই কিছু ঢুকছেনা নীলার। বাসাটাও অফিস থেকে অনেক দূর, সেই মোহাম্মদপুর। যেতেও প্রায় ঘন্টাখানেক লেগে যায়।
বাড়ীতে দুজন কাজের লোক। হেনা যখন একা ছিল প্রায়ই বিল্ডিংয়ের নিচের অসভ্য দাড়োয়ানটা সময়ে অসময়ে উৎপাত করতো। আড়াই বছরের বুলা আর হেনাকে একা রেখে অফিস যেতে ভয় হতো। মামুন ব্যবসা করে। আসা যাওয়া, খাওয়া দাওয়া কোনকিছুরই কোন ঠিক ঠিকানা নেই। তাই মামুনের মায়ের বাড়ী থেকেই মাজেদাকে যোগাড় করে দেয়া হলো। হেনা রান্না করবে আর মাজেদা বাচ্চা দেখবে। ভালই চলছিল এভাবে। বাচ্চাটা হাসিখুশীই থাকতো আজকাল। হঠাৎ কি হলো আজ!
মাসের শেষ, অফিসে অনেক ঝামেলা। স্টাফদের বেতনের হিসাব, একাউন্টসে পাঠানো, ডিরেক্টরের সাইন নিয়ে ব্যাংকে টাকা জমা দেওয়া, ম্যালা কাজ। কোনমতে জুনিয়র স্টাফকে হাতের কাজটা ধরিয়ে দিয়েই দৌড়ে বেড়িয়ে পড়েছিল নীলা। গত রাতে বৃষ্টি হওয়াতে ভ্যাপসা গরম খানিকটা শীতল এখন। গুলিস্থানের ফুটপাত জুড়ে দোকানীদের পসরা; দাঁতের মাজন, জুতা পলিশ, আয়ূর্বেদী ওষুধ, চানাচুর মুড়ি, মাছি ভনভন গুড়, কুড়মুড়ি; কিযে বিস্বাদ লাগছে এইসব দৃশ্য! হাঁটার পথটা পর্যন্ত খালি নেই। ঠাসাঠাসি গুতোগুতি করেই জায়গা নিতে হচ্ছিল। বেশী হাঁটলে দু ফিতার স্যান্ডেলটাও ছিড়ে যেতে পারে। ভাগ্যিস ওভারব্রীজের নিচেই একটা নতুন সিএনজি পাওয়া গেল। হা ঈশ্বর! বুলার যেন কিছু না হয়! মনে মনে প্রার্থনা চলতে থাকে।
সিএনজিওয়ালা যতটা পারা যায় চেষ্টা করছে দ্রুত চালাতে। রোকেয়া সরণীর কোণে আসতেই বিরাট জ্যাম। তাড়াহুড়ো করে রাস্তা পেরুতে গিয়ে আছাড় খেয়ে বাদামওয়ালার থালাটা পড়ে গেল। চারদিকে বাদাম আর বাদাম। টোকাইরা সেই বাদাম তুলছে আর সময় খেয়ে ফেলছে। টেনশনে নীলার হাত পা কাঁপছে। সিএনজি বেরুবে সেই পথ নেই। চারদিকে রিকশা আর রিকশা। মামুনকে সমানে ফোন দিয়ে যাচ্ছে । কিন্তু ক্রমাগত একই স্বর বার বার বলে যাচ্ছে; ‘দুঃক্ষিত, এই মুহূর্তে সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছেনা। অনুগ্রহ করে আবার চেষ্টা করুন।’ তারপরও বার বার চেষ্টা করেই যাচ্ছে সে। কিন্তু ধরছে না। তারপর কি মনে করে যেন আর চেষ্টা করল না।
শেষ পর্যন্ত বাড়ি পৌছাতে সকাল সাড়ে এগারটা বেজে গেল। ভাড়া মিটিয়ে গেট খুলছিল, চোখের সামনে সেই দারোয়ান। বিশাল শরীর আর কায়দা করে প্যাচানো মোচ। সালাম দিয়েই দরজাটা খুলে ধরলো সে। কিছু হলেতো নিশ্চয়ই এ ব্যাটা বলতো। কিন্তু কিছু বলছেনা । ওর দিকে তাকাবার সময় নেই এখন। দৌড়ে দৌড়ে লাফিয়ে লাফিয়ে সিড়ি ভেঙে ছ’তলায় উঠছিল নীলা। শাড়ীর কুঁচিগুলো জড়িয়ে যেতে চাইছে। হুস নেই ওর।
ঠাস...ঠাস...ঠাস...’এই মাজেদা...এই হেনা...দরজা খোল...’
অদ্ভুত ব্যপার। বাড়িতে ঢুকেই দেখলো সব কিছু স্বাভাবিক। একদম চুপচাপ ঠান্ডা। বেডরুমের বিছানাটা টানটান গুছানো। বুলা ওর বেতের চেয়ারে বসে কার্টুন দেখছে আর পটেটো চিপস খাচ্ছে। হেনা ঘরবাড়ি মুছে ঝকঝকে তকতকে করে রেখেছে। নীলার হাতপা অবশ হয়ে আসছিল। দৌড়ে গিয়ে বুলাকে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরলো সে।
হেনা মাজেদা দুজনকেই ডাকলো বেডরুমে। দরজার চৌকাঠ ধরে মলিন দাঁড়িয়ে আছে দুজন ।
‘কি হয়েছে বল? চুপ করে আছিস কেন?
মাজেদা বললো, ‘মামী, একগ্লাস পানি খান।’
‘না...পানি লাগবেনা। কি হয়েছে বল!’
ঢোক গিলতে গিলতে হেনা ঝপ করে নীলার পা দুটো জড়িয়ে ধরে বসে পড়লো মাটিতে। তারপর অঝোরে কান্না শুরু করলো
নীলা হতভম্ব। ‘কি হয়েছে? মেয়েটা কাঁদে কেন?
‘আরে...আগে বলবি তো কি হয়েছে’?
হেনা কাঁদতে কাঁদতেই বলে;‘মামী, এ কতা কতি পারতিসিনা। কাল রাত্তিরে মামা আমার গায়ে হাত দিয়িসিল’
‘হোয়াট? কি বলছিস তুই? তোরা দুজন না একসাথে ঘুমাস?’
‘বিশ্বাস না হলি পরে মাজেদারে জিজ্ঞেস করি দ্যা্খেন’
‘মাজেদা? তুই কিছু টের পেয়েছিলি?’
‘জ্বী মামী’, বলে মাথা নিচু করে রাখলো...।
কাল রাতে মাথা ধরেছিল বলে মামুন একটা প্যারাসিটামল আর ঘুমের অসুধ খেতে দিয়েছিল। তারপর এমন বেহুশ ঘুম হলো যে কিচ্ছু টের পায়নি নীলা। এক ঘুমে সকাল।
‘তোরা আমাকে সকালে বলিসনি কেন?’
‘মামা বাসায় ছেল’, ভয়ে কিছু কতি পারিনি’, হেনা বলে।
নীলার মাথা ভনভন করছে...চোয়াল শক্ত হয়ে গেছে। কি বলবে কিছুই মাথায় আসছেনা। খুবই কষ্ট হচ্ছে মেয়েটার জন্য। ওর মাথায় হাত দিয়ে জিজ্ঞেস করে; ‘এর আগে আর কোনদিন এমন করেছিল?’
‘না, মামী; এই পয়লাবার...
নীলা জানে, চাকরী থেকে ছাটাই হবার পর মামুনের টেনশন বেড়েছে। নতুন করে ছোটখাট কন্ট্রাক্টের ব্যবসা করতে গিয়ে এর ওর কাছে ধারও করেছে। নীলা এসব ঠিক মেনে নিতে পারছিলনা। পাওনাদাররা প্রায়ই ফোন করছিল। বাকিতে মাল কেনার টাকার তাগাদায়। কিন্তু তাই বলে, নিজের সম্মানের কথা একটুও ভাববেনা! আর সবচেয়ে বড় কথা এক বিছানায় তিনজন ঘুমাচ্ছিল। দুজন দুপাশে, বুলা মাঝখানে। কখন ঘটলো এই ঘটনা! কেন সে একটুও টের পেলোনা? মামুন কি ইচ্ছে করেই ওকে ঘুমের অসুধ খাইয়েছিল?
নীলার মুখের দিকে তাকিয়ে হেনা বললো; ‘মামী, মামারে কিছু কতি হবিনানে। আমিই চলি যাবানে।‘
‘কেন? তুই যাবি কেন? অন্যায় কি তুই করেছিস?’
‘না মামী, আপনাগের সংসারে আমার জন্যি কোন অশান্তি হউক চাই নে।’
‘ওসব নিয়ে তোকে ভাবতে হবেনা। তুই যা। আজ আর আমি অফিস যাচ্ছিনা।’
বেশ কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থাকলো নীলা। চুরমার হয়ে যাচ্ছে ভেতরটা। সমস্যাটা কোথায়? কাজের লোকের কাছে যেতে হবে কেন? এটা শুধুই কি সেক্সুয়েল ডিজঅর্ডার? নাকি ল্যাক অফ কালচার? আরে ব্যাটা তোর শরীর লাগেতো টানবাজারে যা! কাজের মেয়ে কেন? কত ভরসা করে এ বাড়িতে আছে ওরা, বিশ্বাসই হচ্ছেনা না যে তাদের এতটুকুন নিরাপত্তা দিতে পারেনি, কিযে অসহায় লাগছে। ফ্যানের বাতাসটা হাই স্পিডে দেয়া আছে অথচ তরতর করে ঘামছে সে। জানালার পর্দাটা উড়ছে। বুলা ভাঙা ভাঙা বাংলায় বলছে ‘বাতাস...উলে...বাতাস উলে’...জানালা দিয়ে রোদের ছটা এসে হংসধ্বনি খেলছে মোজাইক ফ্লোরে।
প্রেমের সময়টায় রুম্পাদের বাড়িতে একদিন জোর করেছিল মামুন। সেদিন রুম্পার জন্মদিন ছিল। নীলা বলেছিল; ‘এভাবে না, চলো আগে বিয়ে করি, তারপর সব হবে।’ ওদের একটাই বেডরুম। ড্রইংরুমের সোফার উপর কোনমতে চাপাচাপি করে রাতটা পার করবার কথা। কিন্তু ওর মধ্যেই শেষরাতে স্পষ্ট টের পেয়েছিল মামুন অস্থির হয়ে কাজটি সারবার চেষ্টা করছে। ভিলেনরা যেরকম করে বাংলা সিনেমায় সাইড নায়িকাকে ধর্ষণ করে, ঐ কায়দায়। মধ্যবিত্ত মন চুরমার হয়েছিল তখন, ঠিক বুঝতে পারছিলনা নীলা কষ্টটা কিসের। ফিসফিস করে বলেওছিল ‘প্লিজ মামুন, এটা করোনা, ‘যদি প্রেগনেন্ট হয়ে যাই? আমার ভয় করছে।’ তীব্র দায়িত্বহীন চাওয়ায় ভাসছিল মামুন। সেই প্রথমবার নিজের শরীরের প্রতি ঘেন্না হয়েছিল নীলার। প্রেমের মানে কি? যদি আতংক নিয়েই শরীর দিতে হয়?
মাজেদা ঘরে ঢুকতেই হুস হলো, ‘কি কিছু বলবি?’
‘মামী, এক কাপ লাল চা দেই?
বুকের ভেতর ভার ভার লাগছে, হাত-পা ঝিঁ ঝিঁ করছে। মেয়ে দুটোর নিশ্চয়ই খুব কষ্ট হচ্ছে। ‘নারে, কড়া কফি দে’।
এরপরের ঘটনাটা বেশ নাটকীয়। দুপুরে মামুন ফোন করে জানালো সে একটা কন্ট্রাক্টের কাজে তেজগা থাকছে, বাড়ি ফিরতে রাত হবে। নীলা হু হা ছাড়া আর কোন প্রসঙ্গ আনেনি। গুমোট অবস্থা বাড়িতে । হেনা মুখ কালো করেই রান্নাবান্না করছে। মাজেদা এমনিতে খুব হাসে,আজ হাসছেনা, বুলাকে রোজকারমত দেখাশুনা করছে। বারান্দার তারে মামুনের গোসলের তোয়ালে আর ভেজা লুঙ্গিটা ঝুলছে। নীলা তীব্র চোখে সেগুলোর দিকে তাকিয়ে থেকে হ্যাচকা টানে মাটিতে ফেলে দিল। দুপুরে মামুনদের বাড়িতে ফোন করে ওর বড় বোনকে জানালো। মহিলা ফোনের মধ্যেই চেঁচিয়ে হেনার গুষ্ঠি উদ্ধার করলো। ‘ভাল করে দেখেশুনে কাজের মেয়ে না রাখলে এমনই হয়। কোথা থেকে এইসব আজেবাজে লোকজন এনে রাখো, বেশ্যাগিরি করে কিনা কে জানে!’ নীলার কান ঝাঁ ঝাঁ করছিল, কিন্তু একটা শব্দ বলেনি উত্তরে! অর্ধেক কথা শুনেছে, বাকিটা হাওয়ায় উড়ে গেছে।
বিকেল নাগাদ মামুনের বড় দুবোন বাড়িতে এসে হাজির। ওরা জেরা শুরু করলো;
‘কখন গিয়েছিল তোর কাছে? শুধুই কি হাত ধরেছিল? নাকি...। মাজেদাতো তোর পাশেই ঘুমাচ্ছিল। ও টের পেয়েছিল কিছু?
চোখের সামনে জ্যান্ত দুটো বাঘ পারলে মেয়েটাকে খাবলে খেয়ে ফেলে। হেনা শক্ত, বিব্রত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে, কথা বলছেনা।
এত বাড়াবাড়ি আর নিতে পারছিলনা নীলা। সারাদিন থমকে থাকার পর এবার গলা ফাঁটিয়ে চিৎকার করে উঠলো সে। ‘স্টপ......। স্টপ ইট। কি করতে এসেছেন আপনারা? বিচার করতে? আমি কি বলেছি আপনারা বিচার করেন? আর বিচারই যদি করতে হয় নিজের ভাইয়েরটা করেন। এই মেয়েটাকে এসব বলছেন কেন?’
এরপর পরিবেশ একদম শীতল। বুলা ভয় পেয়েছে চিৎকার শুনে। মাজেদা ওকে ছাদে নিয়ে গেল।
দুবোন বেডরুমে গিয়ে হু হু করে কাঁদতে থাকলো। যেন এইমাত্র কেউ মারা গেছে বাড়িতে। আজাব পড়েছে দুনিয়ায়। তারপর হঠাৎই বড়বোনটা শক্ত করে নীলার হাত দুটো জাপটে ধরলো।
‘ তুমি আমাদের ভাইটাকে মাফ করে দাও, নীলা।’
‘কাজটা যদি আপনার ভাই না করে আমি করতাম, আপনি কি মাফ করতেন?
‘বেয়াদপের মতন কথা বলো কেন? সংসারে এরকম দুচারটা ঘটনা ঘটেই। তাই বলে এত তেজ দেখালে চলে?’
‘আপনার স্বামী করলে কি করতেন? মাফ করে দিতেন?’ বলেই আছাড় দিয়ে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নেয় নীলা।
তারপর কোন কথা না বলে কোন রকমে স্যন্ডেলটা পায়ে জড়িয়ে দরজাটা খুলে হন্তদন্ত করে বেড়িয়ে পড়ে। পেছনে হেনা ডাকছে, ‘মামী...মামী...কনে যাতিছেন? বিয়ান বেলা থেকে কিছু মুখে নেননি...... মামী...’ কোনদিকে না তাকিয়ে তরতর করে সিড়ি দিয়ে নেমে আসে নীলা। মেয়েটার জন্যে অবাধ চোখের জল…. দেখতে পায় না কেউ।
গলির মুখে টিউবলাইটগুলো জ্বলেনি তখনও, চায়ের দোকানে জটলা। এ সময়টায় সাধারনত বুলাকে একা রেখে কোথাও যায় না সে। কিন্তু আজ বড় বেশী এলোমেলো হয়ে গেল সবকিছু। একটা অর্থহীন অতীত ভেতরে কিলবিল করছে। বাইরে থেকে দেখে মনে হচ্ছে রাগ, দুঃখ অভিমান, কোন কিছুই তাকে স্পর্শ করছেনা। অথচ ভেতরে উথলে পড়ছে কষ্ট, উল্টাপাল্টা বকছে সে নিজের মনেই; ‘হারামজাদা, শুয়োর, আমি ঘরে থাকতে এত ঘাটাঘাটির শখ হয় কেন তোর ? ...নাচতো শিখেছিলাম আমি, ধাগ... ধিনা... ধিন, নাক... তিনা...তিন, আর খেলা খেলিস তুই? কয়টা তাল বুঝিস? ক্ষ্যামটা? কাহারবা? দ্রুম দ্রুম ড্রাম বাজতে থাকে ভেতরে আর ঝুম্পা তালে হাটতে থাকে সে.....
প্রথম যেদিন মামুনের সাথে দেখা হয়েছিল সেদিন একটা ছেড়া শার্ট গায়ে ছিল ওর। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ার সময়কার ঘটনা। মিলি পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলেছিল, ‘আমাদের বন্ধু, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েনা, কিন্তু দারুণ আড্ডাবাজ, পলিটিক্স করে।’ সেদিন একটা কাঠালচাঁপা গাছের নিচে বসে ছিল ওরা। নানা জাতের গাছ ছিল সে মাঠে; ইউক্যালিপ্টাস, কৃষ্ণচূড়া, মেহগনি,কড়ই,রেইনট্রি,আকাশমণি আরও কত কি। সে মাঠে শুয়ে বসে আড্ডায় আড্ডায় কখন যে মামুনের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে গেল, তারপর কতগুলো বছর কী ভাবে কেটে গেল, কিছুই যেন টেরই পেলনা নীলা । তবে মিলির সাথে বন্ধুত্বটা তখন থেকেই ভীষন স্বচ্ছ ছিল। ওর মনে হত মিলি ছাড়া ঠিক ঠিক বুঝবে এমন কেউ নেই পৃথিবীতে। বিয়ের পরও সমস্ত কথা ওর সাথেই হত। মামুনের ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে সংসার করা, অভাব, অসহায়ত্ব, স...ব। মিলিই মামুনকে একরকম টেনেটুনে ব্যবসায় নিয়ে এসেছিল। এমনকি সুদে টাকা খাঁটিয়ে নিজেও কিছুটা লাভের চেষ্টা করেছিল। তখন মামুন আর মিলি ঠিক কতটা ঘনিষ্ট হয়েছিল নীলা তা্র কিছুই জানে না। আজ প্রথমবারের মতন হঠাৎ মনে প্রশ্ন এলো, মিলি কি ঠিক আগের মতন আছে?’ কোথায় যেন একটা দূরত্ব তৈরী হয়েছে এবং ওরা কেউ কাউকে কিছু বলছেনা। যেন দীর্ঘ সময় ধরে নিশ্চুপ স্থির দাঁড়িয়ে আছে নীলা, কোথাও কোন অপরাধ খূঁজে পাচ্ছেনা।
নীলা জোরে জোরে হাঁটছে। বিকেলের রোদটা মলিন হয়ে লম্বা ছায়াটা সামনা সামনি চলতে থাকে। নিজেকে অপেক্ষাকৃত লম্বা মনে হয়। পড়নে জিন্স আর সাদা ফতুয়া, চুন্দ্রির ওড়না। মেইন রোড পর্যন্ত হেটে গিয়ে রিকশা নেবে সে। মিলির সাথে মামুনের বন্ধুত্বটা কি আসলে খাঁটি ছিল? এত বছর পর কেন আজ হঠাৎ এ প্রশ্ন মনে এলো! ওদের আদৌ কি কোন পার্টনারশীপ ছিল? নাকি ঝামেলা আছে কোথাও। সন্দেহ ঘন হয়। তারপরই কি মনে করে যেন ফোন দেয় সে মিলিকে।
‘মিলি; ‘বাড়ি আছিস?’
‘হ্যা, নীল? কই তুই? তোর গলাটা এমন শোনাচ্ছে কেন? কি হয়েছে?’
নীলা কোন উত্তর না দিয়ে আবার পালটা প্রশ্ন করে, ‘তোর কাছ থেকে না মামুন টাকা নিয়েছিল? শোধ দিয়েছে?...
‘হঠাৎ টাকার প্রশ্ন আসছে কেন, বন্ধু? আমি কি কোনদিন তোকে কিছু বলেছি এসব নিয়ে?’ মিলি’র গলায় উত্তেজনার আভাস।
‘বলিস নি, কিন্ত কেন বলিসনি, সেটাই তো আমার প্রশ্ন’।
‘দ্যাখ, এমনিতেই তোর অনেক ঝামেলা, আবার নতুন কোন টেনশন দিতে চাইনি’
‘ও তুইতো কমিশনে খাটিয়েছিস? তাইনা? তা এ পর্যন্ত কত টাকা লাভ করেছিস? সত্যি করে বলতো? তুই কি আমার জন্য এটা করেছিলি? নাকি নিজের লাভ চেয়েছিলি?’
মিলির কন্ঠ শুকিয়ে আসে। ও কোনদিন ভাবতেও পারেনি নীলা এভাবে ওকে প্রশ্ন করতে পারে। এটা তো ঝগড়া নয়। রীতিমত জেরা। মিলি একটু উদ্বিগ্ন গলায় আবার প্রশ্ন করলো’ তোর কি হয়েছে বলতো? তুই ঠিক আছিস?’
নীলার মনে হতে থাকে, বিশ্বাস ভেঙে গেছে। আর বিশ্বাস করতে পারছেনা ও মিলিকে কিংবা মামুনকে। একের পর এক কত প্রতিজ্ঞা ভেঙেছে মামুন। কথা দিয়ে কথা রাখেনি। কখন কী ভাবে মিলির সাথে মিশেছে সে সব নিয়েও মাথা ঘামায়নি সে কখনও। সব কিছু জমা করলে একটা ক্ষমার পাহাড় হয়ে যাবে। নীলার মাথা্টা ঝিম ঝিম করতে থাকে। তারপরও কথা থামেনা।
‘তুই জানতি না কেন আমি মামুনকে বিয়ে করেছিলাম?’ নীলা প্রশ্ন করে।
‘হ্যা, জানতাম। তুই প্রেগনেন্ট হয়ে গেলি আর বাচ্চাটাকে ফেলতে চাইলি না...!
‘বাহ! কত্ত সহজভাবে বলে ফেললি.....,বিষয়টা কি এতই সহজ ছিল তখন? একটা বি. এ. থার্ডক্লাস রাস্তার ছেলেকে বাড়ি থেকে পালিয়ে বিয়ে করা?’
‘হ্যা তুই অনেক সিনেমা করেছিলি। নীলা দ্যা...খ, কত্ত বছর আগে কি হয়েছে না হয়েছে সেগুলো ভুলে গিয়েই তো সংসারটা করেছিলি, না কী ?’
‘তোর যদি এটা নিয়ে এতই ঝামেলা ছিল, তবে বিয়ে করেছিলি কেন? এবরশন করিয়ে নিলেই তো ঝামেলা চুকে যেত।’ রেগে রেগে কথাগুলো বলে সে।
নীলার চোখ দুটো লাল। সারাদিন না খাওয়াতে মুখ শুকিয়ে আছে। চুলগুলো এলোমেলো। নবোদয় হাউজিং এর মোড়ে এসেই রিকশায় উঠলো সে। কথা চলছে। রিকশাওয়ালা কান পেতে কথা গিলছে।
মিলি বলছে, ‘প্রেমতো স্থবির কিছুনা; সময়ে এর অবয়ব, চরিত্র, সব বদলে যায়। কিছুদিন যাবার পর খোদাই হয়ে গেলে একঘেয়ে লাগতে থাকে।’
‘সে না হয় বুঝলাম, একঘেয়ে লাগে। কিন্তু তাই বলে কি কাজের মেয়ের কাছে যেতে হবে?
‘কী? এটা কি বলছিস নীলা? মামুন এটা করেছে?
‘হ্যা...কাল রাতে...বলতে বলতে গলাটা কাঁপে নীলার।
‘এসব কথা এখন ফোনে বলছিস কেন? কোথায় এখন তুই? এক্ষুনি আমার বাসায় আয়...’
‘আসবো। তার আগে তুই আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দে। অনেস্টলি বলবি...আগে বল মিথ্যে করে বলবি না?’
‘না, মিথ্যে বলবোনা। তোকে বলতে পারলে ভেতরটা ফাঁকা লাগবে। কষ্ট কমে যাবে।’
‘মামুন কখনো তোর কাছে গিয়েছিলো?’
ফোনের ওপারে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলবার শব্দ। কিছুক্ষন টান টান নিস্তব্ধতা। নীলা শক্ত করে সেলফোনটাকে আঁকড়ে ধরে আছে আর ভেতরে কুলকুল ঘামছে। অপেক্ষা করছে উত্তরের।
‘আমি এবরশন করিয়েছিলাম’, বলেই মিলি অঝরে কাঁদতে শুরু করে। বলে, ‘কোনকিছুই আমার ইচ্ছেয় হয়নি।‘
কথা যেন মুহুর্তেই থেমে যায় দুজনের । চারদিকে এত শব্দ তার মধ্যেও যেন হু হু নিস্তব্ধতা।
সন্ধ্যা জমাট বেঁধে গেছে। বাতাসে টায়ার পোড়া তীব্র গন্ধ। অফিস থেকে বাড়ি ফিরছে মানুষ। মোহাম্মদপুর হাউজিং লিমিটেড এর বড় রাস্তাটা পার করে লালমাটিয়ার দিকে রিকশা চলছে। নীলা’র চোখে মুখে আর এক ফোটাও বিষন্নতার চিন্থ নেই। কেবল নিশ্চল তাকিয়ে আছে সে পথের দিকে।
বিড়ালের উৎপাত এত বেড়েছে যে রান্নাঘরের বাসনপত্র কোনটা ‘চেটে রাখা’ আর কোনটা নয় বুঝে ওঠা খুবই মুশকিল। নীলার আবার শুচিবাই আছে। সবকিছুতেই তাঁর চিটচিটে ঘিনঘিন লাগে। হেনাকে তাই রোজ সকালে ঘষে ঘষে টিফিনবাক্সটা ধূঁতে হয়। কোন খুঁত পেলে সে খাবার আর নীলা অফিসে নিতে চায়না। তাছাড়া খাবারের রুচিটাও আগের মতন নেই। ঘুষ খেয়ে কয়েক মাস আগেই চাকরীটা গেছে মামুনের। এ নিয়ে বাড়িতে অশান্তি চলছিল। অবচেতনে নানা রকম সন্দেহ থাকলেও বাইরে এক ধরণের নির্বিকার ভাব-ই দেখাচ্ছিল নীলা। তাঁর ধারণা, টাকার গন্ধ পেলে মামুনের আদিম ইচ্ছেটা জেগে ওঠে। বেড়ালটার মতন চেটেচুটে খেয়ে ফেলতে চায় সে সবকিছু। হাত খুলে খরচ করে, বুলা যা চায় তা-ই কিনে দেয়, রিকশাওয়ালা, ফকির, দারোয়ান, সবাই এ টাকার ভাগ পায়। লোকে দেখে বলে, ‘আহা, মানুষটা কত ভাল’। ঘুষের টাকা খরচ করতে এতটুকু লজ্জ্বা হয়না মামুনের। সাপ্লাইয়ার’রা ঘুষ দিয়ে কাজ পাবে সেটাই খুব স্বাভাবিক। কিন্তু এবার কোন এক ঘাগু ব্যবসায়ী বাটপারী করে ঝামেলা করে ফেলাতেই কোম্পানীর বড়কর্তা ডেকে নিয়ে সরাসরি ছাটাই করে দিল। ‘এটা এমন কোন দোষের ব্যাপার নয়’ আর সেটাই সে নীলাকে বোঝাতে ব্যর্থ হচ্ছিল। হতাশা আর মানসিক চাপ আঁকড়ে ধরছিল নীলাকে। সংসারের দায়িত্ব, বাচ্চাটাকে কাজের লোকের হাতে ছেড়ে দেয়া, সারাদিন অফিস করা, সবটাই ছিল বাড়তি চাপ। এতসব স্বত্তেও কোন ঝামেলা ছাড়াই শান্তি বজায় রেখে এক বিছানায় ঘুমাতে চেষ্টা করছিল দুজনই। কিন্তু বারবারই অনিচ্ছাকৃত যুক্তি তর্ক আর ক্ষমতার দ্বন্দ গ্রাস করছিল ওদেরকে। গত রাতে অবশ্য তেমন কিছু ঘটেনি। নীলা নিজের মত করে রাতের খাবার খেয়ে বুলাকে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। তাই এসবের বাইরে আর কি দূর্ঘটনা ঘটতে পারে ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলনা সে।
ফোন ধরে এবার চিৎকার করে উঠে নীলা, ‘কী রে, কী হয়েছে, বল? বুলা ঠিক আছে? পড়ে যায়নি তো? আগুন লাগেনিতো কোথাও?’
হেনা ধরা গলায় ঢোক গিলছে, ঠিকমতো কথা বলতে পারছেনা।
উদ্বিগ্ন কন্ঠে আবার প্রশ্ন করলো নীলা; ‘তোরা ঠিক আছিস তো? তোর মামা কোথায়?’
হেনা ধরা গলায় বললো; মামী, ‘আপনি কি এটটু বাসায় আসতি পারবেন’,এক্ষুনি ?’
‘অফিসে পৌঁছুতে না পৌঁছুতেই এসব কী শুরু করলি? সারা সকাল কোথায় ছিলি? আবার ঠিকমত কথাও বলছিস না, কী হয়েছে?‘ কোন শব্দ নেই ওপাশে।
‘কথা বলছিস না কেন? কী হয়েছে? আরে কিছু বলবি তো? হেনা...হেনা?’
হেনা খুব ঠান্ডা গলায় বললো; ‘মামী, আপনে সামনে আলি পরে কতি পারতাম।‘ বলেই ঠাস করে ফোনটা রেখে দিল।
মনটা ছুটে যায়। অস্থির লাগতে থাকে। সকালে বেরুবার আগেও তো সব ঠিকঠাক ছিল। মামুন আর বুলা একসাথে ঘুমোচ্ছিল। মামুন কোনটা খেতে ভালোবাসে, কোনটা বাসে না, কোন সবজি দিয়ে কি রান্না হলে ভাল স্বাদ হবে, এসব মাথায় রেখেই ইন্সট্রাকশন দিতে দিতে রেডী হচ্ছিল সে। হেনা তখন রুটি আর সবজী ডাইনিং টেবিলে বেড়ে রাখছিল। বেরুবার সময় টিফিন বক্সটাও এগিয়ে দিয়েছিল। এর মধ্যে এমন কি হলো যে অফিসে আসতে না আসতেই ফোন? বড় কোন দূর্ঘটনা ঘটেনিতো? কিন্তু বুলাওতো এখনও ঘুমাচ্ছে? কী-ইবা ঘটতে পারে? মামুনকে কল করেও ফোন বন্ধ পাচ্ছে। মাথায় আসলেই কিছু ঢুকছেনা নীলার। বাসাটাও অফিস থেকে অনেক দূর, সেই মোহাম্মদপুর। যেতেও প্রায় ঘন্টাখানেক লেগে যায়।
বাড়ীতে দুজন কাজের লোক। হেনা যখন একা ছিল প্রায়ই বিল্ডিংয়ের নিচের অসভ্য দাড়োয়ানটা সময়ে অসময়ে উৎপাত করতো। আড়াই বছরের বুলা আর হেনাকে একা রেখে অফিস যেতে ভয় হতো। মামুন ব্যবসা করে। আসা যাওয়া, খাওয়া দাওয়া কোনকিছুরই কোন ঠিক ঠিকানা নেই। তাই মামুনের মায়ের বাড়ী থেকেই মাজেদাকে যোগাড় করে দেয়া হলো। হেনা রান্না করবে আর মাজেদা বাচ্চা দেখবে। ভালই চলছিল এভাবে। বাচ্চাটা হাসিখুশীই থাকতো আজকাল। হঠাৎ কি হলো আজ!
মাসের শেষ, অফিসে অনেক ঝামেলা। স্টাফদের বেতনের হিসাব, একাউন্টসে পাঠানো, ডিরেক্টরের সাইন নিয়ে ব্যাংকে টাকা জমা দেওয়া, ম্যালা কাজ। কোনমতে জুনিয়র স্টাফকে হাতের কাজটা ধরিয়ে দিয়েই দৌড়ে বেড়িয়ে পড়েছিল নীলা। গত রাতে বৃষ্টি হওয়াতে ভ্যাপসা গরম খানিকটা শীতল এখন। গুলিস্থানের ফুটপাত জুড়ে দোকানীদের পসরা; দাঁতের মাজন, জুতা পলিশ, আয়ূর্বেদী ওষুধ, চানাচুর মুড়ি, মাছি ভনভন গুড়, কুড়মুড়ি; কিযে বিস্বাদ লাগছে এইসব দৃশ্য! হাঁটার পথটা পর্যন্ত খালি নেই। ঠাসাঠাসি গুতোগুতি করেই জায়গা নিতে হচ্ছিল। বেশী হাঁটলে দু ফিতার স্যান্ডেলটাও ছিড়ে যেতে পারে। ভাগ্যিস ওভারব্রীজের নিচেই একটা নতুন সিএনজি পাওয়া গেল। হা ঈশ্বর! বুলার যেন কিছু না হয়! মনে মনে প্রার্থনা চলতে থাকে।
সিএনজিওয়ালা যতটা পারা যায় চেষ্টা করছে দ্রুত চালাতে। রোকেয়া সরণীর কোণে আসতেই বিরাট জ্যাম। তাড়াহুড়ো করে রাস্তা পেরুতে গিয়ে আছাড় খেয়ে বাদামওয়ালার থালাটা পড়ে গেল। চারদিকে বাদাম আর বাদাম। টোকাইরা সেই বাদাম তুলছে আর সময় খেয়ে ফেলছে। টেনশনে নীলার হাত পা কাঁপছে। সিএনজি বেরুবে সেই পথ নেই। চারদিকে রিকশা আর রিকশা। মামুনকে সমানে ফোন দিয়ে যাচ্ছে । কিন্তু ক্রমাগত একই স্বর বার বার বলে যাচ্ছে; ‘দুঃক্ষিত, এই মুহূর্তে সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছেনা। অনুগ্রহ করে আবার চেষ্টা করুন।’ তারপরও বার বার চেষ্টা করেই যাচ্ছে সে। কিন্তু ধরছে না। তারপর কি মনে করে যেন আর চেষ্টা করল না।
শেষ পর্যন্ত বাড়ি পৌছাতে সকাল সাড়ে এগারটা বেজে গেল। ভাড়া মিটিয়ে গেট খুলছিল, চোখের সামনে সেই দারোয়ান। বিশাল শরীর আর কায়দা করে প্যাচানো মোচ। সালাম দিয়েই দরজাটা খুলে ধরলো সে। কিছু হলেতো নিশ্চয়ই এ ব্যাটা বলতো। কিন্তু কিছু বলছেনা । ওর দিকে তাকাবার সময় নেই এখন। দৌড়ে দৌড়ে লাফিয়ে লাফিয়ে সিড়ি ভেঙে ছ’তলায় উঠছিল নীলা। শাড়ীর কুঁচিগুলো জড়িয়ে যেতে চাইছে। হুস নেই ওর।
ঠাস...ঠাস...ঠাস...’এই মাজেদা...এই হেনা...দরজা খোল...’
অদ্ভুত ব্যপার। বাড়িতে ঢুকেই দেখলো সব কিছু স্বাভাবিক। একদম চুপচাপ ঠান্ডা। বেডরুমের বিছানাটা টানটান গুছানো। বুলা ওর বেতের চেয়ারে বসে কার্টুন দেখছে আর পটেটো চিপস খাচ্ছে। হেনা ঘরবাড়ি মুছে ঝকঝকে তকতকে করে রেখেছে। নীলার হাতপা অবশ হয়ে আসছিল। দৌড়ে গিয়ে বুলাকে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরলো সে।
হেনা মাজেদা দুজনকেই ডাকলো বেডরুমে। দরজার চৌকাঠ ধরে মলিন দাঁড়িয়ে আছে দুজন ।
‘কি হয়েছে বল? চুপ করে আছিস কেন?
মাজেদা বললো, ‘মামী, একগ্লাস পানি খান।’
‘না...পানি লাগবেনা। কি হয়েছে বল!’
ঢোক গিলতে গিলতে হেনা ঝপ করে নীলার পা দুটো জড়িয়ে ধরে বসে পড়লো মাটিতে। তারপর অঝোরে কান্না শুরু করলো
নীলা হতভম্ব। ‘কি হয়েছে? মেয়েটা কাঁদে কেন?
‘আরে...আগে বলবি তো কি হয়েছে’?
হেনা কাঁদতে কাঁদতেই বলে;‘মামী, এ কতা কতি পারতিসিনা। কাল রাত্তিরে মামা আমার গায়ে হাত দিয়িসিল’
‘হোয়াট? কি বলছিস তুই? তোরা দুজন না একসাথে ঘুমাস?’
‘বিশ্বাস না হলি পরে মাজেদারে জিজ্ঞেস করি দ্যা্খেন’
‘মাজেদা? তুই কিছু টের পেয়েছিলি?’
‘জ্বী মামী’, বলে মাথা নিচু করে রাখলো...।
কাল রাতে মাথা ধরেছিল বলে মামুন একটা প্যারাসিটামল আর ঘুমের অসুধ খেতে দিয়েছিল। তারপর এমন বেহুশ ঘুম হলো যে কিচ্ছু টের পায়নি নীলা। এক ঘুমে সকাল।
‘তোরা আমাকে সকালে বলিসনি কেন?’
‘মামা বাসায় ছেল’, ভয়ে কিছু কতি পারিনি’, হেনা বলে।
নীলার মাথা ভনভন করছে...চোয়াল শক্ত হয়ে গেছে। কি বলবে কিছুই মাথায় আসছেনা। খুবই কষ্ট হচ্ছে মেয়েটার জন্য। ওর মাথায় হাত দিয়ে জিজ্ঞেস করে; ‘এর আগে আর কোনদিন এমন করেছিল?’
‘না, মামী; এই পয়লাবার...
নীলা জানে, চাকরী থেকে ছাটাই হবার পর মামুনের টেনশন বেড়েছে। নতুন করে ছোটখাট কন্ট্রাক্টের ব্যবসা করতে গিয়ে এর ওর কাছে ধারও করেছে। নীলা এসব ঠিক মেনে নিতে পারছিলনা। পাওনাদাররা প্রায়ই ফোন করছিল। বাকিতে মাল কেনার টাকার তাগাদায়। কিন্তু তাই বলে, নিজের সম্মানের কথা একটুও ভাববেনা! আর সবচেয়ে বড় কথা এক বিছানায় তিনজন ঘুমাচ্ছিল। দুজন দুপাশে, বুলা মাঝখানে। কখন ঘটলো এই ঘটনা! কেন সে একটুও টের পেলোনা? মামুন কি ইচ্ছে করেই ওকে ঘুমের অসুধ খাইয়েছিল?
নীলার মুখের দিকে তাকিয়ে হেনা বললো; ‘মামী, মামারে কিছু কতি হবিনানে। আমিই চলি যাবানে।‘
‘কেন? তুই যাবি কেন? অন্যায় কি তুই করেছিস?’
‘না মামী, আপনাগের সংসারে আমার জন্যি কোন অশান্তি হউক চাই নে।’
‘ওসব নিয়ে তোকে ভাবতে হবেনা। তুই যা। আজ আর আমি অফিস যাচ্ছিনা।’
বেশ কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থাকলো নীলা। চুরমার হয়ে যাচ্ছে ভেতরটা। সমস্যাটা কোথায়? কাজের লোকের কাছে যেতে হবে কেন? এটা শুধুই কি সেক্সুয়েল ডিজঅর্ডার? নাকি ল্যাক অফ কালচার? আরে ব্যাটা তোর শরীর লাগেতো টানবাজারে যা! কাজের মেয়ে কেন? কত ভরসা করে এ বাড়িতে আছে ওরা, বিশ্বাসই হচ্ছেনা না যে তাদের এতটুকুন নিরাপত্তা দিতে পারেনি, কিযে অসহায় লাগছে। ফ্যানের বাতাসটা হাই স্পিডে দেয়া আছে অথচ তরতর করে ঘামছে সে। জানালার পর্দাটা উড়ছে। বুলা ভাঙা ভাঙা বাংলায় বলছে ‘বাতাস...উলে...বাতাস উলে’...জানালা দিয়ে রোদের ছটা এসে হংসধ্বনি খেলছে মোজাইক ফ্লোরে।
প্রেমের সময়টায় রুম্পাদের বাড়িতে একদিন জোর করেছিল মামুন। সেদিন রুম্পার জন্মদিন ছিল। নীলা বলেছিল; ‘এভাবে না, চলো আগে বিয়ে করি, তারপর সব হবে।’ ওদের একটাই বেডরুম। ড্রইংরুমের সোফার উপর কোনমতে চাপাচাপি করে রাতটা পার করবার কথা। কিন্তু ওর মধ্যেই শেষরাতে স্পষ্ট টের পেয়েছিল মামুন অস্থির হয়ে কাজটি সারবার চেষ্টা করছে। ভিলেনরা যেরকম করে বাংলা সিনেমায় সাইড নায়িকাকে ধর্ষণ করে, ঐ কায়দায়। মধ্যবিত্ত মন চুরমার হয়েছিল তখন, ঠিক বুঝতে পারছিলনা নীলা কষ্টটা কিসের। ফিসফিস করে বলেওছিল ‘প্লিজ মামুন, এটা করোনা, ‘যদি প্রেগনেন্ট হয়ে যাই? আমার ভয় করছে।’ তীব্র দায়িত্বহীন চাওয়ায় ভাসছিল মামুন। সেই প্রথমবার নিজের শরীরের প্রতি ঘেন্না হয়েছিল নীলার। প্রেমের মানে কি? যদি আতংক নিয়েই শরীর দিতে হয়?
মাজেদা ঘরে ঢুকতেই হুস হলো, ‘কি কিছু বলবি?’
‘মামী, এক কাপ লাল চা দেই?
বুকের ভেতর ভার ভার লাগছে, হাত-পা ঝিঁ ঝিঁ করছে। মেয়ে দুটোর নিশ্চয়ই খুব কষ্ট হচ্ছে। ‘নারে, কড়া কফি দে’।
এরপরের ঘটনাটা বেশ নাটকীয়। দুপুরে মামুন ফোন করে জানালো সে একটা কন্ট্রাক্টের কাজে তেজগা থাকছে, বাড়ি ফিরতে রাত হবে। নীলা হু হা ছাড়া আর কোন প্রসঙ্গ আনেনি। গুমোট অবস্থা বাড়িতে । হেনা মুখ কালো করেই রান্নাবান্না করছে। মাজেদা এমনিতে খুব হাসে,আজ হাসছেনা, বুলাকে রোজকারমত দেখাশুনা করছে। বারান্দার তারে মামুনের গোসলের তোয়ালে আর ভেজা লুঙ্গিটা ঝুলছে। নীলা তীব্র চোখে সেগুলোর দিকে তাকিয়ে থেকে হ্যাচকা টানে মাটিতে ফেলে দিল। দুপুরে মামুনদের বাড়িতে ফোন করে ওর বড় বোনকে জানালো। মহিলা ফোনের মধ্যেই চেঁচিয়ে হেনার গুষ্ঠি উদ্ধার করলো। ‘ভাল করে দেখেশুনে কাজের মেয়ে না রাখলে এমনই হয়। কোথা থেকে এইসব আজেবাজে লোকজন এনে রাখো, বেশ্যাগিরি করে কিনা কে জানে!’ নীলার কান ঝাঁ ঝাঁ করছিল, কিন্তু একটা শব্দ বলেনি উত্তরে! অর্ধেক কথা শুনেছে, বাকিটা হাওয়ায় উড়ে গেছে।
বিকেল নাগাদ মামুনের বড় দুবোন বাড়িতে এসে হাজির। ওরা জেরা শুরু করলো;
‘কখন গিয়েছিল তোর কাছে? শুধুই কি হাত ধরেছিল? নাকি...। মাজেদাতো তোর পাশেই ঘুমাচ্ছিল। ও টের পেয়েছিল কিছু?
চোখের সামনে জ্যান্ত দুটো বাঘ পারলে মেয়েটাকে খাবলে খেয়ে ফেলে। হেনা শক্ত, বিব্রত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে, কথা বলছেনা।
এত বাড়াবাড়ি আর নিতে পারছিলনা নীলা। সারাদিন থমকে থাকার পর এবার গলা ফাঁটিয়ে চিৎকার করে উঠলো সে। ‘স্টপ......। স্টপ ইট। কি করতে এসেছেন আপনারা? বিচার করতে? আমি কি বলেছি আপনারা বিচার করেন? আর বিচারই যদি করতে হয় নিজের ভাইয়েরটা করেন। এই মেয়েটাকে এসব বলছেন কেন?’
এরপর পরিবেশ একদম শীতল। বুলা ভয় পেয়েছে চিৎকার শুনে। মাজেদা ওকে ছাদে নিয়ে গেল।
দুবোন বেডরুমে গিয়ে হু হু করে কাঁদতে থাকলো। যেন এইমাত্র কেউ মারা গেছে বাড়িতে। আজাব পড়েছে দুনিয়ায়। তারপর হঠাৎই বড়বোনটা শক্ত করে নীলার হাত দুটো জাপটে ধরলো।
‘ তুমি আমাদের ভাইটাকে মাফ করে দাও, নীলা।’
‘কাজটা যদি আপনার ভাই না করে আমি করতাম, আপনি কি মাফ করতেন?
‘বেয়াদপের মতন কথা বলো কেন? সংসারে এরকম দুচারটা ঘটনা ঘটেই। তাই বলে এত তেজ দেখালে চলে?’
‘আপনার স্বামী করলে কি করতেন? মাফ করে দিতেন?’ বলেই আছাড় দিয়ে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নেয় নীলা।
তারপর কোন কথা না বলে কোন রকমে স্যন্ডেলটা পায়ে জড়িয়ে দরজাটা খুলে হন্তদন্ত করে বেড়িয়ে পড়ে। পেছনে হেনা ডাকছে, ‘মামী...মামী...কনে যাতিছেন? বিয়ান বেলা থেকে কিছু মুখে নেননি...... মামী...’ কোনদিকে না তাকিয়ে তরতর করে সিড়ি দিয়ে নেমে আসে নীলা। মেয়েটার জন্যে অবাধ চোখের জল…. দেখতে পায় না কেউ।
গলির মুখে টিউবলাইটগুলো জ্বলেনি তখনও, চায়ের দোকানে জটলা। এ সময়টায় সাধারনত বুলাকে একা রেখে কোথাও যায় না সে। কিন্তু আজ বড় বেশী এলোমেলো হয়ে গেল সবকিছু। একটা অর্থহীন অতীত ভেতরে কিলবিল করছে। বাইরে থেকে দেখে মনে হচ্ছে রাগ, দুঃখ অভিমান, কোন কিছুই তাকে স্পর্শ করছেনা। অথচ ভেতরে উথলে পড়ছে কষ্ট, উল্টাপাল্টা বকছে সে নিজের মনেই; ‘হারামজাদা, শুয়োর, আমি ঘরে থাকতে এত ঘাটাঘাটির শখ হয় কেন তোর ? ...নাচতো শিখেছিলাম আমি, ধাগ... ধিনা... ধিন, নাক... তিনা...তিন, আর খেলা খেলিস তুই? কয়টা তাল বুঝিস? ক্ষ্যামটা? কাহারবা? দ্রুম দ্রুম ড্রাম বাজতে থাকে ভেতরে আর ঝুম্পা তালে হাটতে থাকে সে.....
প্রথম যেদিন মামুনের সাথে দেখা হয়েছিল সেদিন একটা ছেড়া শার্ট গায়ে ছিল ওর। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ার সময়কার ঘটনা। মিলি পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলেছিল, ‘আমাদের বন্ধু, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েনা, কিন্তু দারুণ আড্ডাবাজ, পলিটিক্স করে।’ সেদিন একটা কাঠালচাঁপা গাছের নিচে বসে ছিল ওরা। নানা জাতের গাছ ছিল সে মাঠে; ইউক্যালিপ্টাস, কৃষ্ণচূড়া, মেহগনি,কড়ই,রেইনট্রি,আকাশমণি আরও কত কি। সে মাঠে শুয়ে বসে আড্ডায় আড্ডায় কখন যে মামুনের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে গেল, তারপর কতগুলো বছর কী ভাবে কেটে গেল, কিছুই যেন টেরই পেলনা নীলা । তবে মিলির সাথে বন্ধুত্বটা তখন থেকেই ভীষন স্বচ্ছ ছিল। ওর মনে হত মিলি ছাড়া ঠিক ঠিক বুঝবে এমন কেউ নেই পৃথিবীতে। বিয়ের পরও সমস্ত কথা ওর সাথেই হত। মামুনের ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে সংসার করা, অভাব, অসহায়ত্ব, স...ব। মিলিই মামুনকে একরকম টেনেটুনে ব্যবসায় নিয়ে এসেছিল। এমনকি সুদে টাকা খাঁটিয়ে নিজেও কিছুটা লাভের চেষ্টা করেছিল। তখন মামুন আর মিলি ঠিক কতটা ঘনিষ্ট হয়েছিল নীলা তা্র কিছুই জানে না। আজ প্রথমবারের মতন হঠাৎ মনে প্রশ্ন এলো, মিলি কি ঠিক আগের মতন আছে?’ কোথায় যেন একটা দূরত্ব তৈরী হয়েছে এবং ওরা কেউ কাউকে কিছু বলছেনা। যেন দীর্ঘ সময় ধরে নিশ্চুপ স্থির দাঁড়িয়ে আছে নীলা, কোথাও কোন অপরাধ খূঁজে পাচ্ছেনা।
নীলা জোরে জোরে হাঁটছে। বিকেলের রোদটা মলিন হয়ে লম্বা ছায়াটা সামনা সামনি চলতে থাকে। নিজেকে অপেক্ষাকৃত লম্বা মনে হয়। পড়নে জিন্স আর সাদা ফতুয়া, চুন্দ্রির ওড়না। মেইন রোড পর্যন্ত হেটে গিয়ে রিকশা নেবে সে। মিলির সাথে মামুনের বন্ধুত্বটা কি আসলে খাঁটি ছিল? এত বছর পর কেন আজ হঠাৎ এ প্রশ্ন মনে এলো! ওদের আদৌ কি কোন পার্টনারশীপ ছিল? নাকি ঝামেলা আছে কোথাও। সন্দেহ ঘন হয়। তারপরই কি মনে করে যেন ফোন দেয় সে মিলিকে।
‘মিলি; ‘বাড়ি আছিস?’
‘হ্যা, নীল? কই তুই? তোর গলাটা এমন শোনাচ্ছে কেন? কি হয়েছে?’
নীলা কোন উত্তর না দিয়ে আবার পালটা প্রশ্ন করে, ‘তোর কাছ থেকে না মামুন টাকা নিয়েছিল? শোধ দিয়েছে?...
‘হঠাৎ টাকার প্রশ্ন আসছে কেন, বন্ধু? আমি কি কোনদিন তোকে কিছু বলেছি এসব নিয়ে?’ মিলি’র গলায় উত্তেজনার আভাস।
‘বলিস নি, কিন্ত কেন বলিসনি, সেটাই তো আমার প্রশ্ন’।
‘দ্যাখ, এমনিতেই তোর অনেক ঝামেলা, আবার নতুন কোন টেনশন দিতে চাইনি’
‘ও তুইতো কমিশনে খাটিয়েছিস? তাইনা? তা এ পর্যন্ত কত টাকা লাভ করেছিস? সত্যি করে বলতো? তুই কি আমার জন্য এটা করেছিলি? নাকি নিজের লাভ চেয়েছিলি?’
মিলির কন্ঠ শুকিয়ে আসে। ও কোনদিন ভাবতেও পারেনি নীলা এভাবে ওকে প্রশ্ন করতে পারে। এটা তো ঝগড়া নয়। রীতিমত জেরা। মিলি একটু উদ্বিগ্ন গলায় আবার প্রশ্ন করলো’ তোর কি হয়েছে বলতো? তুই ঠিক আছিস?’
নীলার মনে হতে থাকে, বিশ্বাস ভেঙে গেছে। আর বিশ্বাস করতে পারছেনা ও মিলিকে কিংবা মামুনকে। একের পর এক কত প্রতিজ্ঞা ভেঙেছে মামুন। কথা দিয়ে কথা রাখেনি। কখন কী ভাবে মিলির সাথে মিশেছে সে সব নিয়েও মাথা ঘামায়নি সে কখনও। সব কিছু জমা করলে একটা ক্ষমার পাহাড় হয়ে যাবে। নীলার মাথা্টা ঝিম ঝিম করতে থাকে। তারপরও কথা থামেনা।
‘তুই জানতি না কেন আমি মামুনকে বিয়ে করেছিলাম?’ নীলা প্রশ্ন করে।
‘হ্যা, জানতাম। তুই প্রেগনেন্ট হয়ে গেলি আর বাচ্চাটাকে ফেলতে চাইলি না...!
‘বাহ! কত্ত সহজভাবে বলে ফেললি.....,বিষয়টা কি এতই সহজ ছিল তখন? একটা বি. এ. থার্ডক্লাস রাস্তার ছেলেকে বাড়ি থেকে পালিয়ে বিয়ে করা?’
‘হ্যা তুই অনেক সিনেমা করেছিলি। নীলা দ্যা...খ, কত্ত বছর আগে কি হয়েছে না হয়েছে সেগুলো ভুলে গিয়েই তো সংসারটা করেছিলি, না কী ?’
‘তোর যদি এটা নিয়ে এতই ঝামেলা ছিল, তবে বিয়ে করেছিলি কেন? এবরশন করিয়ে নিলেই তো ঝামেলা চুকে যেত।’ রেগে রেগে কথাগুলো বলে সে।
নীলার চোখ দুটো লাল। সারাদিন না খাওয়াতে মুখ শুকিয়ে আছে। চুলগুলো এলোমেলো। নবোদয় হাউজিং এর মোড়ে এসেই রিকশায় উঠলো সে। কথা চলছে। রিকশাওয়ালা কান পেতে কথা গিলছে।
মিলি বলছে, ‘প্রেমতো স্থবির কিছুনা; সময়ে এর অবয়ব, চরিত্র, সব বদলে যায়। কিছুদিন যাবার পর খোদাই হয়ে গেলে একঘেয়ে লাগতে থাকে।’
‘সে না হয় বুঝলাম, একঘেয়ে লাগে। কিন্তু তাই বলে কি কাজের মেয়ের কাছে যেতে হবে?
‘কী? এটা কি বলছিস নীলা? মামুন এটা করেছে?
‘হ্যা...কাল রাতে...বলতে বলতে গলাটা কাঁপে নীলার।
‘এসব কথা এখন ফোনে বলছিস কেন? কোথায় এখন তুই? এক্ষুনি আমার বাসায় আয়...’
‘আসবো। তার আগে তুই আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দে। অনেস্টলি বলবি...আগে বল মিথ্যে করে বলবি না?’
‘না, মিথ্যে বলবোনা। তোকে বলতে পারলে ভেতরটা ফাঁকা লাগবে। কষ্ট কমে যাবে।’
‘মামুন কখনো তোর কাছে গিয়েছিলো?’
ফোনের ওপারে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলবার শব্দ। কিছুক্ষন টান টান নিস্তব্ধতা। নীলা শক্ত করে সেলফোনটাকে আঁকড়ে ধরে আছে আর ভেতরে কুলকুল ঘামছে। অপেক্ষা করছে উত্তরের।
‘আমি এবরশন করিয়েছিলাম’, বলেই মিলি অঝরে কাঁদতে শুরু করে। বলে, ‘কোনকিছুই আমার ইচ্ছেয় হয়নি।‘
কথা যেন মুহুর্তেই থেমে যায় দুজনের । চারদিকে এত শব্দ তার মধ্যেও যেন হু হু নিস্তব্ধতা।
সন্ধ্যা জমাট বেঁধে গেছে। বাতাসে টায়ার পোড়া তীব্র গন্ধ। অফিস থেকে বাড়ি ফিরছে মানুষ। মোহাম্মদপুর হাউজিং লিমিটেড এর বড় রাস্তাটা পার করে লালমাটিয়ার দিকে রিকশা চলছে। নীলা’র চোখে মুখে আর এক ফোটাও বিষন্নতার চিন্থ নেই। কেবল নিশ্চল তাকিয়ে আছে সে পথের দিকে।
0 মন্তব্যসমূহ