শ্রাবণী দাশগুপ্ত'র গল্প : ভ্রূপল্লবে ডাক দিলে

আমি

একটা চুমু খাবো তোমাকে? হাওয়ায় উড়িয়ে দিলাম - দেখ পালকের মতো উড়ে তোমার গালে, ঠোঁটে... দুহাজার কিলোমিটার পেরিয়ে! একটু কি তুবড়ে গেছ? অনেক রোগা হয়েছ? পুরনো পুরনো? তোমাদের মানে, আমাদের বাড়িটার মতো? স্টেশনের রাস্তাতে অন্নপূর্ণা হলটা আছে, না ভেঙে মল-টল্‌?

কোন্‌ অতীত সভ্যতার তুমি মতো জান? ভেবে বলি! মাহেঞ্জোদারো হতে পার, বা মিশ্‌র। ভাস্কর্য নিবিড়, সনাতনী। বুঝতে তুমি? তোমাকে বলিনি, আসলে কাউকেই বলিনি। ইচ্ছে করত... না গুছিয়ে, বিনা ভাবনায়, হেঁয়ালি না করে।

রঞ্জিনীর মুছে যাওয়া থেকে জীবনে হয়তো বের হতে পারবনা। ট্রমা হন্ট করে, দুঃস্বপ্ন থাকে! দ্বৈত প্রতিজ্ঞার মূল্যে আমি একা কেঁচো হয়ে উত্তর খুঁজতে থাকি। হ্যাঁ, এখনও। কবছর যেন হয়ে গেল।


ভিসার মেয়াদ শেষ, শার্ল্‌ট পর্শু ফিরে গেছে। আশ্বাস দিয়ে গেছে, আমাকে বিশ্বাস ভরে গেছে। আমার শ্বাস নেওয়া সহজ করে গেছে। ওর অনুভব অদ্ভুত অতল। আলজিভের তলায় স্তব্ধতার শব্দ সাজাতে পারে। মাটির নিচে শেকড়ের ডগা না দেখে ছুঁতে পারে। প্রতিশ্রুতি রাখতে না পারলেও, ফাটল ধরবে না। দুজনের মাঝখানে কোনো প্রশ্নের ভাঁজ রেখে যায়নি। বরং সমান করে, কোণা মিলিয়ে পাটপাট করে দিয়ে গেছে।


জান, খানিক আগে প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টি হয়েছে। আকাশ বাদুড়ের ডানা হয়ে আছে। বাগানের কোণার ঝাঁকড়া পেয়ারা গাছটায় যেগুলো বসে থাকত? ছোটোবেলায় সাঙ্ঘাতিক ভয় পেতাম! ছুটে তোমায় জড়াতাম.. আমার আশ্রয়...

কিন্তু বলতে, সর্‌ ধুমসি... কী রকম জন্তুর চার হাতপায়ে আকঁড়েছে দেখ!

এখানে কিছুক্ষণ বৃষ্টি ভীষণ শব্দ করে আছড়ে পড়ে, তারপর থেমে যায়। থেমে গেছে এখন। শিশুমুখের মতো ধোয়া পথঘাটে স্ট্রিটলাইটের তির্যক প্রতিফলন।


ব্যালকনিতে রাখা দ্বিতীয় চেয়ারটা শার্ল্‌ট-এর। খালি। ছাদের ড্রেনপাইপ বেয়ে অঝোরে নামা জল বন্ধ হয়েছে। শুধু নিচের ছাজ্‌জায় ঢপঢপ ফোঁটা পড়ছে অনেকক্ষণ পরে পরে। পায়ের পাতা পেঁচিয়ে উঠছে সরু সাপ, ফুঁসছে। পায়ের তলায় সুইমিং পুল। শান্ত হয়ে বসতে পারছি না। আজ আমার ভাইব্রেটার লাগবে, ওসব রেখে গেছে শার্লট। সেটা কি? তুমি বুঝবেনা, থাক...। শার্লটের গন্ধ আমাদের ওয়ান-রুম ফ্ল্যাটের বাথরুমে, ওয়াল-পেপারে, ওয়ার্ড্রোবে, ফ্রিজে, থালা-বাটি-চামচ। বড্ড ভালো, সংগঠিত, আমার মতো না। নিজের খুঁটিনাটি নিয়ে গেছে। দুএকটা... চুলের রিবন, ডিওর খালি বোতল, বাতিল ঢিলে ব্রা, খেলনা, ম্যাগাজিন... ছড়িয়ে আমাদের বিছানায়। 


মা

কবছর দেখিনি রে তোকে? আমার খবর পাস? জানিনা আর কতদিন থাকব। সারা গা জ্বালা। কেমো নিয়ে নিয়ে ন্যাড়ামুণ্ডি। হাতপা খসখসে। চামড়া ওঠা কালো রঙে পোড়াপোড়া দাগ। জানিস, আমার দুটো ব্রেস্ট বাদ গেছে। তুই বলতিস না, খাজুরাহোর নর্তকীর মতো? জরায়ু আর ওভারি কবে যেন অপারেশন হল... তুই যেবছর কলেজে ঢুকলি, সেবছর না?

যখন আসবি, যদি কখনো আসিস, আমি কি আর থাকব? তোদের মতো অত লেখাপড়া করিনি। গড়াতে গড়াতে বারোক্লাস, বড্ড শক্ত। পরীক্ষা দিইনি, তখনই বিয়ে। বুদ্ধিই নেই তোর মতো, অত বুঝতাম না। স্বাস্থ্য ভালো ছিল, দেখতে শুনতে ভালোই বলত লোকে। বিয়ে হতে আর কি লাগে? আমি তো চেয়েছিলাম ভরা সংসার, পুরুষমানুষের খবর্দারি। পেয়েছি, বেশি বেশি পেয়েছি। বর বন্ধু নাকি আবার? বিয়ের পরে সে-ই গার্জেন, আদর, বকুনি, শাসন। আর বুঝে, মানিয়ে, মেনে চলা। এটাই শিখেছি।

তুই মানলি না। ভেতরে আঁধার গুহায় পথ খুঁজতে লাগলি। সেজন্যে গোলমাল বাধল। বলতে লাগলি, ঢুকতে পারলে রামধনু দেখতে পাবে। পাইনি রে আমি। কত বুঝিয়েছি তোকে, মেরে ধরে, কষ্ট... খালি যন্তন্না দিলাম!


আমি

গলিতে চুটিয়ে ডাংগুলি খেলতাম, ক্যাম্বিস বল পেঁদাতাম। ছোটো ছিলাম যখন, তখন বেশি বকতে না। যত ডানপিটেরা আমার বন্ধু, অভি, নিশু, শান্তু, বাপী, গাজন। তখন বোধহয় এইট বা নাইন। স্কুলে যাওয়ার আগে গোপুদার ইটালিয়ান সেলুনে চুল কেটে, হাবুলদার চায়ের দোকানে লেড়ো দিয়ে চা, আর টেবিল পেটাচ্ছিলাম – চোলি-কে-পিছে...। বাড়ি ফিরতেই কী মেরেছিলে, মনে আছে? কে নালিশ করেছিল, আমি বুঝেছিলাম। বাবার চামচে খোচর রমেনবুড়ো। শালা খুব সুধীন্দা সুধীন্দা করত। আর সুয়ো ছিল তোমারও, বৌদি-বৌদি করে অস্থির। আমি তো কাউকে নালিশ করিনি ওর ইতরামির? বলিনি তো গাণ্ডুটা কোথায় কোথায় খামচে দিয়েছিল? শুধু ঠাটিয়ে রদ্দা মেরেছিলাম। কান ধরে ক্ষমা চাইয়েছিলাম।

বলেছিল, সরি, আর হবেনা। তুই আমার মেয়ের মতো। আড়ালে বলত, নীতু-মর্দানা... হিজড়ে। তুমি জানতেও পারনি এসব।

মেয়েস্কুলে মেয়েগুলোর লম্বা চুল হবেই, অন্তত কাঁধ অবধি। দুচারটের ভুরুও প্লাকড। কাকলি টিফিন পিরিয়ডে হাটের মধ্যে বলছিল, তোকে পুরো ছেলে মনে হচ্ছে। ওই ছেলেগুলোর মধ্যে তোর লাভার কোনটা রে নবনীতা? কি কি করেছে রে তোকে?

কী রাগ ধরেছিল, উদমা ক্ষেপে গেছিলাম। একটা কথা না বলে জাপটে ধরে চকাম চুমু খেয়েছিলাম ওর গালে, ঠোঁটেও। হৈচৈ, গার্জেন কল। বাড়ি ফিরে উপদেশের বন্যা তোমার, বড়ো হয়েছিস, ছেলেদের সঙ্গে আর মিশবি না। দেখা হল, একটু কথা বললি... তাতে দোষ হয়না। কিন্তু ওরকম করলে তোমাকে সকলে নিন্দে করবে। বিয়ে হবেনা, তখন? ছিঃ।

দুত্তোর নিকুচি... বিয়ে! আমি একমনে তোমার পাপড়ির মতো চোখ দেখছিলাম, ছুঁচলো চিবুক। গরমকাল, বারবার আঁচল সরিয়ে ঘাড়গলার ঘাম মুছছিলে। দেখছিলাম।

দুআঙুলে গাল টিপে দিয়ে বলেছিলাম, এত সুন্দর না তুমি, হেব্বি সেক্সি...!

তোমার চোখের মণি গলে গেল। হাসলে, দূর্‌ পাগলি একটা। কী কড়া তোর আঙ্গুল... দেখি? ঈস। রোদ-ঝলসা চামড়া, চ্যাপ্টা কবজি। মেয়েরা এরকম থাকলে লোকে নিন্দে করে নীতু। কাল থেকে খবর্দার খেলবি না ওই বাঁদরগুলোর সাথে।

আমি চোখ মেরেছিলাম তোমায়। ভুলে গেছ তো!

কে মানত গো তোমার কথা? ঠিক বেরিয়েছিলাম, পিট্টু খেলতে। প্রিয় খেলা, সাঙ্ঘাতিক ভালো টিপ ছিল। বসেছিলাম, বল ছুঁড়তে ওঠামাত্র শান্তু বলেছিল, নীতুদি তোর স্কার্টে লাল কি? পা দিয়ে গড়াচ্ছে... বরং বাড়ি যা। প্রথম পিরিয়ড হল। তুমি বোঝালে, শেখালে। অসম্ভব রাগ দাউদাউ। কেন কে জানে, ভীষণ অপমানিত লাগছিল। কদিন স্কুল যাইনি, ঠিক করে খাইনি, খেলতে যাইনি। এটা কেন হবে আমার? মেয়েদের বাজে অসভ্য ঝামেলা?


মা

তুই কী খোঁজার কথা বলতিস। শেষ যেবার এলি, তোকে ভাঙাচোরা দেখাচ্ছিল, চোখমুখ কোটরে। চলে গেলি সকালে উঠে, আটকাতে পারলাম না। কী অপবাদ! কী নিন্দে! আত্মীয়-পরিজন, পাড়ার মানুষ... কানচাপা দিয়ে আমাদের প্রায় ঘরবন্দী দশা।

অনেক আগে একবার ফুলপিসি, তোর বাবাদের খুড়তুতো বোন সীমা এসেছিল মনে আছে? নর্থ কলকাতার বনেদি ওরা। ওর ক্ষীরের পুতুলের মতো মেয়েটা, হিয়া? কত ছোটো তোর চেয়ে, আট নবছরের বোধহয়। ফর্সা ধবধবে বাতাবির মতো গাল। কাজল-টানা ছোটো চোখ, ঝিকঝিকে দাঁত। কী মিষ্টি, কী মিষ্টি। নেচে গেয়ে মাতিয়ে রেখেছিল।

তুই ওকে কি করেছিলি নীতু? চুমু খেয়েছিলি? পাড়ার দোকানে চকোলেট খাওয়াতে নিয়েছিলি কোলে করে। ফিরে এসে হাপুস কান্না বেচারির, মুখ লাল। আহারে, বুঝতে পারছিলাম না।

সীমার মেয়ে ওর নয়নতারা, হীরেমানিক। রেগে গিয়ে বলল, নীতুর কী ছিরি হয়েছে দেখেছ বৌদি! ঢ্যাঙা, চ্যালা কাঠ, সামনে যেন ইস্তিরি করা। দেখতে পাওনা? চুলগুনো ছেঁটে ছেলে না মেয়ে আরো বোঝা যায়না। মাসিক হয় তো? আমার বাপু কেমন লাগছে। ডাক্তার-টাক্তার দেখিও। শুধু লেখাপড়া ভালো হলেই কি হল? বিয়েথা দেবেনা?

সত্যি তুই কেমনধারা, ধ্যাড়ধ্যাড়া লম্বা। শরীরের বাড় নেই, না একটু মেয়েলি গড়ন। রাগ হল, খুব দুঃখ হল, নিজেকে দোষী ভাবলাম। আমি মা, আমার উচিৎ ছিল ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধপত্তর... তোর বাবার সঙ্গে কথা বলব ভেবেছিলাম।

আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকিস, অসোয়াস্তি হত কেমন একটা। বলতিস, আর্টিস্ট হলে তোমাকে মডেল বানাব। আঁকড়ে ধরতিস, ফিসফিস করতিস কানের কাছে।

বলতাম, সর জ্বালানি ধুমসিটা, চান করেনা ভালো করে।

তোর ফেলে যাওয়া আঁকার কাগজ খুঁজে পেলাম তুই চলে যাবার পরে। আমাকে ওরকম করে এঁকেছিস, লজ্জায় মরে গেছি। আলমারিতে তুলে রেখেছি আমার ভালো শাড়ির তলায়। মরে গেলে নিয়ে যাবি তো এসে?


আমি

শুধু বাধা, কত যে নিয়ম তোমাদের – আমার জন্যে, মেয়ে বলে। রাগ জ্বলতাম। বাবা আমাকে পছন্দ করতনা, আমি বুঝিনি ভেবেছ? শুধু বাবিনকে ভালোবাসত। একে ছেলে, তারপরে বাধ্য, শান্ত স্বভাব। আমার উলটো। আচ্ছা, আমাকে কি ভয় পেত বাবা?

কতবার বলেছি, বাবিন তোমাদের মনের মতো আদর্শ ছেলে হয়েছে, আমি নাহয় খারাপ বেপরোয়া ছেলে হই!

রেগে উঠে ঝাড়তে, ছেলে কি আবার? কষে দুই থাপ্পড় দেব। ওরকম জংলী হয়ে থাকিস... এতবড়োটি হয়েছিস...

ব্যাস, শুরু করে দিতে অনর্গল। অবান্তর কথা কেন বলতে তুমি? বকরবকর সারাক্ষণ। কেউ পাত্তা দিতনা, বাবা একদমই না।

পাড়ার ছেলেদের টেক্কা দিয়ে পরীক্ষাগুলো, এমনকি জয়েন্ট এন্ট্রান্সেও বেশ বলার মতো উৎরেছিলাম। চ্যাটাল হাতের পাতাওয়ালা মফঃস্বলের বিশ্রী একটা...। যাক, তোমরা কেউ বিশেষ প্রশংসার কথা বলনি। বাবিন চুপিচুপি বলেছিল, আমি তোর উপযুক্ত ভাইয়ের মতো রেজাল্ট করব, তোর চেয়েও ভালো। দেখিস।

বাবিনকে এলেবেলে ভাবতাম। আসলে আমাকে হিংসে করত।


মা

দূরে পাঠাতে চাইনি তোকে, নিজে গেলি। জেদ, খালি জেদ! গরমেন্ট কলেজ। কাছাকাছি শিলিগুড়িতে থাকত হাসি, ভেবেছিলাম যাহোক সে ইস্কুলের টিচার। দরকারমতো তোকে বোঝাতে পারবে, খোঁজটোজও দেবে। মাসির বাড়িতে যেতিস কই? ওই এক-আধবার। হাসি নিজেই ভালোমন্দ খবর নিতে যেত, ফোন করে জানাত। না হলে কিছু জানতে পারতাম? হ্যাঁরে, সে ঘটনা না জানাজানি হলে কি ভালো থাকতিস তোরা?


আমি

রঞ্জিনীকে বলতাম, কোন্‌ ফুল বল তুই? পিঙ্ক গোলাপ?

বলত, ধরেনে তাই। তোর গায়ে বকুলের সোঁদা গন্ধ নীতু।

আমি বলতাম, ধুস, আমি হলাম বিষগোটা। আমি ধুতরো। গন্ধ কই? মরে যেতে পারিস।

ও বলত, গেছিই তো। দেখতে পাসনা?

কথার খেলা। অনায়াসে আমার কাঁধের ওপরে মাথা হেলিয়ে রাখত। লম্বা চুলের জাল বেয়ে শ্যাম্পুর গন্ধ উড়ে মুখের ওপরে। ওর চোখে কাজল, আমার চোখে নেশা। অনেকটা তোমার ধাঁচে ছোটো গোলমুখ, থুতনির কাছটায় সরু। আমার মুখের ঠিক নিচে ওর লিপগ্লসমাখা ঠোঁট। গোলাপ আর ধুতুরার গোপন রসায়ন কোন আগারে হয়েছিল, বলব না। কারন, বুঝবে না। বাঁচতে দিলেনা কেউ, টক্সিক হয়ে উঠল সমস্ত। বিষাক্ত।

ওর মতো কেউ বোঝনি, আমার কমতি, খামতি, অন্ধকারের ছায়াপথ। আমার সই, আমার শী, আমার প্রিয়তমা, আমার আত্মা। পরে শার্লটও আন্তরিক ছিল, ওর নিজের মতো... আমিও তাই। তাসত্বেও অনধিক্রম্য ছোট্টো দূরত্ব... বিদেশি। আমার স্ট্রাগলের আদ্যন্ত হৃদয়ঙ্গম সম্ভব ছিলনা।

বলছিলাম, জানিস পাড়ার ছেলেগুলো আড়ালে আমায় কি নাম দিয়েছে? নিমাই মানে বুঝিস জিনি?

আমার মুষড়ে-থাকা খোলা পাপড়িগুলোয় ওর ভেজা সরু আঙুল বুলিয়ে দিত রঞ্জিনী, শুশ্রূষার আরাম। বলত, তাতে কি? এতো তোর চামড়া শুধু, ভেতরে পাঁজর, তার তলায় যত্নে রাখা লাল টকটকে গোলাপ।

বলতাম, তোর জন্যে... তুই এ্যারবিয়ান নাইটস-এর সুন্দরী, আমি বীস্ট...

বলত, ঢেকে রাখিস বলে তোকে এতদিন দেখতে পায়নি কেউ...

ওর শ্বাস, পাতলা জিভ, সাজানো দাঁত। ভরন্ত ফুলন্ত নিষ্পাপ দেহ, কুয়াশায় ভেজা কাঁঠালিচাঁপা রঙ, দেখতাম। পাগলের মতো শুঁকতাম। ওর খালি দুহাতের বেড়ে আমার মাথা। নাকমুখ গুঁজে হাঁটকাতাম, তল্লাশি করতাম। আমার অনেক না-থাকার, না-পাওয়ার অস্থিরতা আর আক্ষেপ শুষে নিয়ে ও হাসত। অগোছালো দুটি প্রায়-কিশোরী দেহ, স্পর্শকাতর মন।

বলত, জানি সোনা জানি।

মুখ না তুলে বলতাম, কি জানিস বল?

আমার জটলাগা ঘন চুলে হাত বুলিয়ে বলত, মাকে খুব ভালোবাসিস... সেজন্যে বাবাকে অত হিংসে...।

আমি ওর মুখে হাতচাপা দিয়ে বলতাম, চুপ।

কালো মুখর চোখ বলত, অনেক কিছু লুকোস তুই... সব দুঃখ চেটে নেব তোর...।


মা

মন ছটফট করত তোকে দেখার জন্যে। সারাদিন কাজ করে যেতাম অভ্যেসে, অন্যমনষ্কভাবে। বরাবরের মতো তোর বাবার অযথা চোটপাট। বাবিন অগ্রাহ্যি করতে শুরু করেছিল, উঁচু ক্লাস হচ্ছিল কিনা। একাএকা বড্ড কষ্ট পেতাম। তুই যখন ছিলি নীতু, ওসব তেমন গায়ে মাখতাম না। ইরাদিদি একটা সম্বন্ধ এনেছিল, হাসির কোন্‌ দেওর বিদ্যুতের সঙ্গে। চমৎকার পাত্র নাকি! বয়সটা বেশি – একতিরিশের মতো, কিছু নেবেটেবে না। তোর বাবা দেখলাম এককথায় রাজি। সত্যি বলতে আমিও নিমরাজি। তাও বললাম, এগারো বছরের তফাতে আজকাল বিয়ে হয় ইরাদি? মেয়ে রাজি হলে হয়।

বলেছিল, বাজে বকিস না। সোনার টুকরো ছেলে, পুনায় থাকে। তোর মেয়েকে শাসনে রাখতে গেলে, এরকম দরকার কিনা ভাব। তাছাড়া দেখাশুনোর ব্যাপারও আছে। ফোটো না পাঠিয়ে ওকে ডেকে পাঠা, দেখতে আসবে ছেলেপক্ষ।

তখন তোর হয়ে বলেছিলাম জানিস, আমি আর কি ভাবব? পাশ করেই চাকরি পাবে মেয়েটা। তাকে কেউ আর শাসনে রাখতে পারে? ওর মতামত বাদ দিয়ে বিয়েটিয়ে হবেনা।

খুব খচেছিল ইরাদিদি। তোর বাবা আমায় তুলো ধুনেছিল, তোর হাওয়া লেগে নাকি বিগড়ে গেছি। মন হাল্কা লেগেছিল, লুকিয়ে হেসেছিলাম। গোপন ইচ্ছেটা বলিনি তোকে, এখন বলব? শুনতে পাবিনা, জানতে পারবিনা। তবু বলি। ভাবতাম তুই চাকরি পেলে যদি বিয়ে না করিস, তোর কাছে থাকব গিয়ে। বাড়িতে দম আটকে হাঁসফাস করে মরি।


আমি

তোমার পলিশড টেরাকোটা রঙের চামড়া, আমি নেব কি করে? তোমার শরীর থেকে আমি উৎপন্ন। সম্পূর্ণ উলঙ্গ ঐ দেহের স্মৃতি আমার মনে থাকা অসম্ভব। পরে তোমাকে ফলন্ত গাছ মনে করতাম। বুকের ঠিক নিচ থেকে নাইকুণ্ডুলির মধ্যেকার জায়গাটুকু যেন গাছের কাণ্ড...। ছাল সরিয়ে ভেতরের হলদেটে সাদা রঙ হ্যালুসিনেট করতাম।

মধ্যরাতে আমার জন্মদাতাকে দেখেছি পাশের ছোটোঘরে তোমাকে টেনে নিয়ে যেতে। জোর করে বন্ধ চোখ পিটপিট করতাম, বাকি দৃশ্যগুলো কল্পনা করতাম। যেন সীতাহরণ, কিম্বা দুঃশাসনের হাতে, কীচকের হাতে দ্রৌপদী – এরকম। যদি দৌড়ে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তাম, কেমন হত? রাত্তির অনেক কথা লুকিয়ে ফেলে। তারপর কখন অন্ধকারে তুমি ঝুপ করে মুর্ঝানো ভাঙা ডালের মতো এসে বিছানায় পড়তে। আমার ঘুম ভাঙত। ইচ্ছে করত গায়ে আলতো হাত বুলিয়ে দিই, অনেক গল্প করি।

তুমি আমার জন্মদাত্রী, তবু মা হওনি। জানো? আমার হাসনসখি, বকুলফুল, আমার ললিপপ, লিপিস্‌টিক... তোমার না-বোঝা অবোধ কিশোরী কষ্টের ভার বুক পেতে নিতে চেয়েছি। বুকের উপত্যকার স্রোতের গহীন চলনে সাঁতরেছি।

মা, তুমি বুঝতে পেরেছ কোনোদিন?


মা

তোকে আর কে একটা মেয়েকে নাকি কলেজ হস্টেল থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে! শুনে আমি তাজ্জব। ওমা, কীসব খবর আনল হাসি? কোথায় নাকি থাকছিলি তোরা ঘরভাড়া করে। আনচান করছিল মনটা, ধরতে পারছিলাম না। হয়ত রেগিং করেছিস, ওরকম দুষ্টুমি তো তোর বরাবর। ফোন করে হন্যে হয়ে পাচ্ছিলাম না তোকে। ভেবেছিলাম হারিয়েই ফেলেছিস ফোনটা। ভয়েভয়ে বললাম তোর বাবাকে, একবার গিয়ে খোঁজ করে আসতে। রাজি হলনা কিছুতে, মাথা আগুণ। খুব নাকি কাজের চাপ। বাবিন কোলকাতার কলেজেই ভর্তি হতে পেরেছিল। ওকে যেতে বললাম, উচ্চবাচ্য করলনা। আঁচ করছিলাম কী লুকোচ্ছে।

মন বলছিল, প্রেমে-ট্রেমে পড়েছিস তুই। কী খুশি যে লেগেছিল! তক্ষুণি ইরাদিদিকে ফোন করতে ইচ্ছে হয়েছিল, ওকে মর্দানা বল, ডানপিটে বল। ওকেও পছন্দ করার, বোঝার মতো ছেলে আছে দুনিয়াতে। কিন্তু বলিনি, অত বোকা নাকি আমি?

কদিন পরে যেন হুট করে হাজির হলি, একটা রাত্তির থাকলি। কারো সঙ্গে কথা বললিনা। সারারাত আমার বুকের ভেতর মুখ গুঁজে গুমরে কাঁদলি। ভোরবেলা কিছু কাপড়জামা নিয়ে বেরিয়ে গেলি কোথায়... আর দেখিনি তোকে!


আমি

শার্লট আমার আইডেন্টিটি স্পষ্ট করে, বেঁধে দিল আমায়। ভেঙেচুরে রিফর্মড হলাম... সংস্কৃত। বুঝতে পারলে?

বলল, তুমি যা তাই, গুটিয়ে থেকনা। পাশ করে চাকরি করেছ, লিভ নিয়ে পড়তে এসেছ, স্কলার ব্রাইট...

আমার চাপচাপ চুল অনাদরে খরখরে বটের ঝুরি। একদিন পাকড়ে নিয়ে গেল চুলকাটা সেলুনে।

বলল, চল নীটা হেয়ার-ডু... তোমায় পিক্সি-কাট বেস্ট মানাবে।

অসাধারণ! আয়নায় চিনতে নারি নিজেকে, দুষ্টু কিশোরের মুখ! সেদিন লক্ষ্য করলাম, মুখখানি প্রায় জন্মদাতার আদলে, চোখাচোখা, টিঁকলো নাকটাক। ঢলঢলে বারমুডা, কালো টী-শার্টে রেনবো ডিজাইন পেইন্ট করেছি নিজেই। গ্লাইডারস স্যাণ্ডাল, কাঁধে ডিজাইনারের ব্যাগ। শার্লটকে রাস্তাতে জড়িয়ে ধরলাম। বিদেশে হলে চুমু খেতাম। ও হাসল, জানে আমার অস্বস্তির জায়গাগুলো। চোখ কুঁচকে শ্রাগ্‌ করল। বলল, হোয়াটস দ্য প্রবলেম? এভ্রিবডি নোজ্‌ উই আর গুড ফ্রেঞ্জ অনলি।

এ্যাপার্টমেন্টে ঢুকে শাওয়ারে। শার্লট আমাকে স্নান করাতে ভালোবাসত। নানান বিদেশী জেল, বাথসল্ট, ফোম, অডি-কোলনের সুগন্ধ ভুরভুর করে আমাদের ছোট্ট বাথরুম। বোঝাত কোন্‌ প্রসাধনীর ব্যবহার কী, উপকারিতা...।

সেদিন বললাম, কথাগুলো বিজ্ঞাপনের মতো শোনাচ্ছে। খুব উঁচু নাক তোমার...

ও অতি নিচুস্বরে কথা বলত, জিভ পাতলা এবং গোলাপি।

একটুও চিন্তা না করে বলল, ঠিক তা নয়। বরং বলতে পার আর্ট অব লিভিং-এর একটা পার্ট। ভালো শাওয়ার ভালো ঘুমের মতো। অনেক ক্লেদ ধুয়ে পরিষ্কার হয়ে যায়।

দরকারি জ্ঞানগুলো ও অবলীলায় দিত। বিরক্ত হয়ে বলতাম, শেষ অবধি কি কনভেন্টের নান্‌ হতেই যাচ্ছ?

স্নানভেজা শরীরে আমরা ঘনিষ্ঠ হতাম। ওর আঙুল আমার মোহনায়, আমার হাত ওর বর্ফিল চূড়ো আর উপত্যকায়। চামড়ায় চকমকি। শার্লটের ত্বক অদ্ভুত ল্যুমিনাস... আলোকিত! কৃস্টালের অপার্থিব জলকন্যা। ভেজা চুল লেপটে সারস গলায়, কাঁধে। বুকের স্ফটিক রঙে। কৃতার্থ, সম্মোহিত মেল গেজ্‌ আমার! শ্বেত পাথরের পিছল পা সমুদ্রী মাছের... বিভঙ্গিত মোহিনী ভেনাস। অর্গাজম-সুখের তৃপ্তি আমাদের!

আমি ওকে ছুঁতে পারতাম না যখন তখন, সঙ্কোচ হত। ও মাটির তৈরি নয়, ভয় করত ফসফরাস ছুঁলে ঝলসে যাই যদি!

বাথরুম থেকে বেরিয়ে শার্লট সাজাল আমায়। চুল শুকিয়ে, আঁচড়ে দিল। আমার কসমেটিক্স ছিলনা, ওরটা নিতাম না। সেদিন নিজেই লিপস্টিক, লাইনার, আইশ্যাডো, ব্লাশার লাগাল যত্ন করে। ঝোলা দুল মাঝেমধ্যে আমি পরতাম। একজোড়া পরাল। টাইমার সেট করে ক্যামেরায় নগ্ন ফোটো তুলল একসাথে। আয়ত নীলনয়না কাঁচের চোখে চেয়ে রইল অনেকক্ষণ।

বলল, সো গ্রেসফুল, সো সাটল্‌ ইণ্ডিয়ান বিউটি! এখন যে কোনো পুরুষ তোমার প্রেমে পড়ত নভ্‌অনীটা। আই সোয়্যার...

মুখ বেঁকিয়ে বলেছিলাম, ডোন্ট বী সিল্লি...।


মা

সকলকে তোর কথামতো বললাম, রঞ্জিনী তোর বেস্ট ফ্রেণ্ড। ওর বাবা-মা একদিন ফোনে ডেকে পাঠাল আমাদের, আমাকে আর তোর বাবাকে। কলকাতার রেস্টুরেন্টে খেতে গেছি ক’বার? ভীষণ জড়োসড়ো লাগছিল। যেরকম সাজগোজ রঞ্জিনীর মা’র, আমাদের মফঃস্বলে কি তেমন পারি? মহিলাটা প্রায় ফিসফিস করে কথা বলছিল, আর ওর বর চুপ। জানতে চাইল ব্যাপারটা সম্পর্কে কতটা জানি, কতটা বুঝেছি, আরও কেউ কিছু জানে কিনা! আমি তোর হাসিমাসির কথা বলব ভেবেও চেপে গেলাম। কেমন ঘোঁট পাকানো বিচ্ছিরিমতো লাগছিল।

মহিলাটার গা থেকে ভুরভুর করে সেন্টের গন্ধ, কী ভালো!

বলল, দেখুন, জিনিয়ার প্রচুর ভালো সম্বন্ধ আসছে বিদেশ থেকে, একটি এন-আর-আই ছেলে সায়েন্টিস্ট। ছেলেপক্ষ তো পারলে কালই বিয়ে দেয়...।

এন-আর-আই কিরে নীতু? আমি বললাম, আপনার কথা ঠিক বুঝতে পারছিনা।

ওর মা বলতে লাগল, রঞ্জিনী ওদের একমাত্র সন্তান। বাবা বিরাট বড়ো চাকরি করে, সেই সুবাদে অনেক ঘুরেছে ওরা। খুব মুডি, মেজাজী, খামখেয়ালি মেয়ে। অনেক নাকি লাভার ছিল, দুতিন মাসের বেশি টেঁকেনি। মনের ডাক্তার দেখিয়েছে কবার।

মামলাটা কি? শুনে মনে হচ্ছিল, জোরজার করে মতের বিরুদ্ধে বিয়ে দিতে চাইছে মেয়েটার। রঞ্জিনী নামের অদেখা অচেনা বড়োলোকের মেয়েটার জন্য দুঃখ লাগছিল।

তোর বাবা একটু অধৈর্‍য হয়ে বলল, কি বলতে চাইছেন, খুলে বললে ভালো হয়!

ওর বাবার গলাটা কী গম্ভীর, পেট গুড়গুড় করে উঠল। বলল, আপনার মেয়েকে বলে দিন, রঞ্জিনীর সঙ্গে যেন আর কোনো যোগাযোগ না রাখে। বরং অন্য কলেজে পাঠিয়ে দিন, আমি ব্যবস্থা করে দেব।

আমার কত সাহস, বুঝলি? বললাম, সে হবেনা। পড়া প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, এখন কলেজ পালটানো ওসবে নীতু রাজী হবে কেন? খুব জেদ আমার মেয়ের। পারলে, আপনার মেয়েকে সরান।

ওর মা লালমুখে প্রথমে ইংরেজিতে, তারপর বাংলায় বলল, জিনিয়ার খুব বাজে ইনফেকশন হয়েছে, টের পেয়েছি। আপনার মেয়ের থেকে...

সারাটা পথ মাথায় অপমানের পোকা কুরকুর করল। কি হয়েছে? বড়লোক আর সাধারণ ঘরের মেয়ের কি বন্ধুত্ব হয়না? আমরা রাস্তার কুকুর? তোর ওপরেও রাগ হচ্ছিল। ভাবলাম, তুই এলে খুব চেঁচামিচি করব। ইরাদিদির দেওয়া সম্বন্ধটায় রাজী হব। কি দরকার আমাদের মধ্যবিত্ত বাড়ির মেয়ের অত বড়লোকের মেয়েকে বন্ধু করার?

কলকাতার ঝলমলে পথ ছাড়িয়ে গাছপালা-ঘেরা চেনা মফঃস্বলের অন্ধকারে পৌঁছে তোর শুকনো মুখ মনে পড়ছিল বারবার।


আমি

তুমি কখনো কোনোদিনও আমার মতো করে ভাবনি? মামাবাড়ি গেছি যখন, দেখেছি তুমি ছোটোমাসির গলা জড়িয়ে গায়ের ওপরে পা তুলে শুয়ে থেকেছ। তুমি খুব ভালোবাস না, ছোটোমাসিকে? প্রাণের সখি তোমার, পিঠোপিঠি। বিয়ের আগে অবধি একসাথে শুতে, স্নান করতে, তাইনা? ছোটোমাসি গল্প করেছিল আমাকে।

দুপুরভর গুনগুন করতে দুবোনে, যত গোপণ কথা! নিন্দে করতে যে যার শ্বশুরবাড়ির, বরের। আমিও শুনে ফেলতাম গল্পের বইয়ের ফাঁকে।

ওর বাবা-মা রঞ্জিনীকে কি বলে নিরস্ত করেছিল, সরিয়ে নিয়েছিল, জানতে পেরেছিলে? আমাকে খুন করিয়ে দেবে। এইটুকু খালি জানাতে পেরেছিল সোমক বলে আমাদের ক্লাসমেটেকে দিয়ে। আমাদের আর দেখা হয়নি। রাত্তিরে বাড়িতে এসে তোমার ভরন্ত বুকের নিভৃতিতে মাথা গুঁজে ওকে খুঁজেছিলাম। ওর গন্ধ তোমার গন্ধে কেমন মিশে যাচ্ছিল। বাকি অন্ধকার। আমি অসভ্য বেপরোয়া। তবু ভয় করেছিল, হারিয়ে যাওয়ার ভয়... বুঝি তোমাকেও! ঘটনাচক্রে সেটাই তোমার সাথে শেষ দেখা।

কেন এরকম করল সকলে? কেন একটুও সাহস দেখাতে পারলাম না? একগাদা প্রশ্ন নিয়ে সীমাহীন মরুভূমির ভয়ঙ্কর উত্তাপে দিশেহারা একা ছুটে ছুটে মরুদ্যান খুঁজেছি। আমি পঞ্চতপা! বালির নিচে কবরস্থ সময়, আর আমার চোখের জল।


মা

কাউকে বলিনি বুঝলি শুরুতে, ভেবেছিলাম গরম-গোটা। বললে নাকি এত বাড়ত না। অনেক লেট হয়েছে, বলেছে ডাক্তারেরা। হাসপাতাল, অপারেশন, কষ্ট, আমারই। জলের মতো পয়সা যাচ্ছে। তোরা দুজনে গরমেন্ট কলেজে পড়েছিস, কত কম খরচাতে হয়ে গেছে। বড্ড সঙ্কোচ হয়। তোর বাবা আজকাল সারাদিন আমার খেয়াল রাখে। হাসি পায়, জীবনে প্রথম আর শেষবারের জন্য বউয়ের সেবা করে নিচ্ছে। বাবিন ভালো চাকরি পেয়েছে, ভাইজাগে থাকে।

শুয়ে শুয়ে তোর কথা চিন্তা করি। তোদের ছোটোবেলার কথা মনে এলে, মন খুশি লাগে। তুই ঠিকানা ফোন নম্বর আমাকে আর জানাস নি। কেউ যদি ইচ্ছে করে হারিয়ে যায়, তাকে বাঁধি কি দিয়ে বল্‌?


আমি

কলেজ ক্যান্টিনের বেঞ্চে বসে একলা কফি খাচ্ছিল। হাতের ম্যাগাজিনের কভার চেনা, ইন্টারনেটে ছবি দেখেছিলাম। ভাষাটা ইংরেজি নয়। উলটোদিকে গিয়ে বসলাম। লো-কাট স্লিভলেস টপ, হটপ্যান্টস মেয়েটা অপলকে আমারই দিকে তাকিয়েছিল মধুর আঠাল দৃষ্টি নিয়ে। ইঙ্গিত? উঠে কফি কাপটা ফেরত দেবার সময়ে কনুই ঘষে দিলাম মাখন বাহুতে। ছুরির মতো ঠোঁটে হেসেছিল একটু।

তখন শুধু গল্পে মেলামেশা, ওর হাঁটুতে হাত রেখে চোখে পড়েছিল ঊরুতে। গোলাপি ত্রিভুজের ট্যাটু। শার্লটের রঙিন কর্ণিয়া, নীল আর সবুজে মেশানো। দিবাস্বপ্নেও এমন কল্পনা করিনি আমি। এই ইন্সটিট্যুটে এসেছিল একবছরের এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামে। আমি সিনিয়ার। আমার দৌড় আমি জানি। পারফর্মেন্স দেখালে, ভেকেন্সি হলে, জয়েন করতে পারি এখানেই।

দক্ষিণ ফ্রান্সে সমুদ্রের কাছে শার্লটের বাড়ি। পূর্বপুরুষ অভিজাত জমিদার ছিলেন ফরাসি বিপ্লবের সময়ে। মাইলের পর মাইল সজীব মাঠ, একধারে আল্পসের সবুজ। আর ভূমধ্যসাগরতীর ঘেঁষে পাথুরে বেলা। শস্যক্ষেত চিরে ছোটোবড়ো নদী। ওর বর্ণনা চোখে ছবি হয়ে ভাসে। তুলি ধরতে চাই। এক গ্রাম্য মেয়ে, দিগন্তব্যাপী মাঠ, লম্বা গাছ, অনামী ফুলের ঝোপ। চোখ বুজে ঘন হয়ে বসি। ঢেউ গড়িয়ে আসার শব্দ, নোনা গন্ধ, ফরাসি পারফ্যুমের অপার্থিব বাস মিশে যায়। ওর চাপা আধো নরম উচ্চারণ, শ্যাম্পেনরঙ চুল কানের পাশে ওড়ে। কল্পনার আকাশযানে চড়ে ব্যাকরেস্ট-এ মাথা হেলিয়ে ভাবি, পায়ের নিচে ফেলে যাচ্ছি কত কী!


মা

পেয়ারা গাছটায় এখনো পেয়ারা হয়, জানিস নীতু? আগের মতো বাদুড় আসেনা অবশ্যি। পোকা-মাকড় সাপও কমে যাচ্ছে ক্রমশ। এদিকে আজকাল সমানে দোকানপাট বাড়ছে। ঘিঞ্জি হয়ে উঠছে ভীষণ। ক’টা বছর কেমন হুড়হুড় করে পার হয়ে গেল!

তুই ভালো আছিস তো? বিয়ে-থা করলি কিনা জানালি না? জামাই কি অবাঙালি? তাহলে বাঙলা শিখিয়ে আনিস। আমি বাবা আবার অন্য ভাষাটাষা বুঝিনা।


আমি

শার্লট বলেছিল, সো ইয়ু হ্যাড আ গর্লফ্রেণ্ড। শী ও’’জ ভেরি কিউট, বাবলি এন এটসেটরা... সোসাইটি ডিন্ট একসেপ্ট! ইট হ্যাপেনস্‌।

উচ্চারণে অদ্ভুত গভীরতা, আমি উত্তর দিইনি। জিনীর সব ফোটো ডিলিট করলেও একটা পারিনি। ফ্রক পরে, চুলের ঝুঁটিতে দুটো রিবন, হস্টেলের বারান্দায় হাসছে। বলেছিল, ঠিক তোদের পাড়ার মেয়ে মনে হচ্ছেনা?

তোমার কথা বলেছি, কিছুই বুঝতে পারেনি শার্লট। ও একেবারে স্বচ্ছ, ভান নেই একটুও। বলেছিল, নীটা, রিয়েল্লি আই হ্যাভ নো আইডিয়া এবাউট দ্য মাদার-ডটার রিলেশন!

ওর বাবা-মা ওর শৈশবে বিচ্ছিন্ন। মা’র মুখ মনে পড়েনা। স্টেপ মাদার আছে, সৌজন্যসূচক সম্পর্ক। ও প্যারিসে থেকে পড়াশোনা করছিল। চাপা একরকম অভিজাত আর উঁচু পর্দার রুচি, মর্‍যাদাবোধ আমার জন্যে সম্মোহনের কাজ করত। অদৃশ্য সূক্ষ্ম আড়াল। যতটুকু অন্তর থেকে সহজভাবে দিয়েছে, ততটুকুই নিয়েছি... হ্যাংলামো করিনি।

আমার কোলবালিশটা, ঘরোয়া, ছিটীয়াল, প্যাম্পার্ড, অথচ আদর না-পাওয়া জিনিটাকে অবান্তরভাবে মনে পড়ত।

পাগলি কথায় কথায় বলত, তোকে ছেড়ে আমি থাকতে পারব নারে।

বলেছিলাম, শার্ল, ডিড ইয়ু এভার হ্যাভ এনি বয়ফ্রেন্ড?

সোজা স্পষ্ট চোখে তাকিয়ে ধীরে মাথা নেড়েছিল, না কেউ ছিলনা কোনোদিন। এ হয়ত মানসিক বিকার, হয়ত নয়। এই ব্যাপারে ভাবতে চায়না। এর বেশি বলেনি, আমিও প্রশ্ন করিনি।

গোড়ায় একদিন বলেছিল, নীটা তোমার অবচেতনে সাপ্রেসড্‌ এ্যাগ্রেসিভনেস আছে। ডমিনেটিং, অধিকাংশ পুরুষের মতো। বলেছি তো, তোমার সাথে আমার প্রথম সম্পর্ক নয়। বাট আই হেটেড্‌ টু লিভ উইথ আ বাচ্‌, এন ডোন্ট এক্সপেক্ট মী টু এ্যাক্ট লাইক আ ফেম। লিভ-ইন্‌ রিলেশনে একটাই শর্ত, সমানাধিকার... প্লিজ ডু রিমেম্বার।

শার্লটকে গালি দিয়েছি, কৃপন, আত্মকেন্দ্রিক।

আমূল শুধরেছি, অনেক সংযত আমি। প্রতিদিন শার্লট শিখিয়েছে আমায়। বাধ্যতামূলকভাবে সম্পূর্ণ নির্লোম হয়েছি।

ব্যঙ্গ করেছিলাম, হোয়াটস দ্য ইস্যূ? সত্যি শার্ল, তুমি এদেশের প্রাচীন উইডোদের মতো বাতিকগ্রস্ত।

অনুত্তেজে বলেছিল, না নীটা, আমি সর্তক। অপরিচ্ছন্ন যৌনতায় অসুখ হতে পারে। কৈশোরে এজন্যে আই গট পেইনফুল হার্পিস... দীর্ঘ চিকিৎসা করাতে হয়েছে।

ও আর আমি এক... দেহ, যন্ত্রণা, অনুভব, দাবী, চাহিদা একরকম। ফিরে দেখি, একবুক অনাস্বাদিত আলোকিত বোধ দিয়ে গেছে। গতমাসে পাসপোর্ট করাতে দিয়েছি। শার্লট প্রতিশ্রুতি দিয়ে গেছে, ওদের গ্রামে যাব আমরা। ছসাতশো বছর আগেকার স্থাপত্যের শাটো দেখব। নোৎরদেম গির্জার সামনে অবধারিত চুমু খাওয়ার ফোটো তুলব। ভূমধ্যসাগরের তটভূমিতে জলে পা রেখে পাশাপাশি শোব। ওর তুলতুলে নরম গোলাপী কোমরে থাকবে আমার অবাধ্য আঙুল।

নির্জন রেইন ফরেস্টে আমি একলা। এখানে গভীর ছায়াময় জ্বালাহীন সমস্তদিন, রোদের ঝাঁঝে পুড়তে হয়না। দেখছি মুষলধার তুমুল বৃষ্টিতে ঢেকে যাচ্ছে বন। ধুয়ে যাচ্ছে রাগ ক্ষোভ অপমান অভিযোগ। ভালোলাগায় সম্পূর্ণ হয়ে স্নান করছি...।

আমি – একা – আমি!

গলা ছেড়ে বলছি, লভ ইয়ু শার্ল, লভ ইয়ু জিনী, লভ ইয়ু মা.........

এ্যাণ্ড, লভ ইয়ু নবনীতা...


মা

বাইরে জোরে বৃষ্টি নেমেছে রে নীতু! কালো করেছিল মেঘে, যেন রাত্তির। শুকনো কাপড়গুলো গুটিয়ে বিছানার ওপরে রেখে গেছে শান্তি। তোর বাবা কোথাও বেরিয়েছে, হয়ত আবার ডাক্তারের কাছে। অন্য কোথাও হতে পারে। একটু ভাবনা হচ্ছে। তবু কে জানে, মন খুশি খুশি লাগছে। তোর গলার স্বর শুনতে পাচ্ছি যেন। অনেকবছর আগে খাজুরাহো বেড়াতে গেছিলাম, মনে আছে? তুই হাঁ করে গিলছিলি, আমি টেনে টেনে সরিয়ে নিচ্ছিলাম।

জানিস ঐযে পলাশ বলে ছেলেটা, যার বাবার স্টেশনারি দোকান আছে, তোর পেছনে খুব লাগত? তুই দুচোখে দেখতে পারতিস না। সরকারি চাকরি পেয়েছে। কাল ওর বিয়ে, কার্ড দিয়ে গেছে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

10 মন্তব্যসমূহ

  1. ekta kom chena bo-dwiper eto sundor vromon kahini.osamanyo lekha srabani.

    উত্তরমুছুন
  2. দুর্দান্ত অনুভূতি!মুগ্ধ।
    আপনার এই গল্পটির প্রসঙ্গ একটি রিসার্চ আর্টিকেলে সসম্মানে উল্লেখ করতে চাই। প্রথম প্রকাশ ২০১৬ সালে তো? প্রকাশকের নাম জানতে পারলে ভালো হত।

    উত্তরমুছুন
  3. আমি আপনার মন্তব্য এখন দেখলাম । অনেক ধন্যবাদ । শ্রাবণী দাশগুপ্ত ।

    উত্তরমুছুন
  4. দারুণ লাগলো শ্রাবণী! খুব ভালো লেখা |

    উত্তরমুছুন