তমাল রায়'এর গল্প : একটি গল্প,যা যুদ্ধের ও হতে পারে

এ হতেই পারতো একটা যুদ্ধের গল্প। যেভাবে ১৯৩০ এর পর থেকে ১৯৫০ অবধি সব গল্পই কম বেশী যুদ্ধের গল্প। বুটের আওয়াজ ভেসে আসছে। আওয়াজগুলো বাড়ছে। বাতাসে বারুদগন্ধ বিষন্নতা। তুমি টের পাচ্ছ? কিছু,যা কিছুর মধ্যে তুমি রয়েছ,তা কেমন অস্বাভাবিক,কিছু চাপা কথা,ভেতরে ভেতরে অপরিসীম উত্তেজনা,কি হয় কি হয়। তুমি খেয়েছ? ঘুমোতে পারো আদৌ? ভয় লাগে না? সত্যি বলছ?


বড় বড় ট্রাকগুলো চলে গেলে তুমিও কি আমারই মত হাঁফ ছেড়ে বাঁচো? সন্ধ্যে নামছে দূরে। কাছে সন্ধ্যে নামুক আমি চাইনা। কেমন শীত করে যে। খুব শীত। খাবার আনতে যাই না বাইরে। ওরা যদি দেখে ফেলে! পরক্ষণেই তো খাঁচাওলা গাড়িতে বসে জলপাই রঙের উর্দির প্রহরায় চলে যেতে হবে,যেটুকু আলো আসবে গতিশীল জানলা দিয়ে তা আমায় আলোস্নানে অক্ষম। যেটুকু বাতাস,ওরাই নেবে,কারণ এ গাড়িতে আমিই শত্রুপক্ষ এবং একক। আর ওরা হাসবে,গান গাইবে,নিজেদের মধ্যে গল্প করতে করতে পান করবে মদ আর রুটি। করুণায় হয়ত আমার দিকেও ছুঁড়ে দেবে রুটি,আর খেতে গেলেই...কেড়ে নিয়ে,তা নিয়ে লোফালুফির আনন্দে...বিশ্বাস কর আমি কুকুর নই! তাকাবো না ওদের দিকে। কারণ তাকালেই ওরা জুড়ে দেবে ঠাট্টা। আর আমার কান লাল হয়ে গেলেও কিছু বলতেই আমি অক্ষম। আর বলে ফেললে...তখন ক্রিকেট বলের মত আমায় নিয়েও লোফালুফি করবে। আর আমি অসহায়,পান্ডুর হতে হতে…আমি কে,কি ও কেন এখানে অবান্তর এক প্রশ্ন...কিছুটা স্থান দখল করে আছি মানে আমি নিশ্চিত পদার্থ,যার বারুদ না থাকুক দাহ্য! তাই দহন...

অথচ জানো,আমার দেশ ও তোমার দেশের মতই কি প্রবল সবুজ! আকাশে বৃষ্টি শেষে কি অসামান্য রামধনু উঠতো,মেঘ থেকে মেঘে রোদ্দুরের শেষ কিরণগুলো ছড়িয়ে পড়লে আমি তোমায় চিঠি লিখতে বসতাম। আর তুমি অপেক্ষা করতে সে চিঠির। পোস্টম্যান আসলে দৌড়ে যেতে তার কাছে। আর সে চিঠি তুলে দিলে হাতে,তুমি তার হাতে তুলে দিতে কাঁসার গ্লাস ভর্তি জল। কেমন পালটে যায় সব দ্রুত,তাই না? এই যে হাওয়ায় কান পাতলেই ভেসে আসছে ফিস ফাস। তোমার মনে হয় না,এ কখনোই তোমার বা আমার নিয়তি হবার ছিল না। গাছে গাছে আম ধরত,সকাল হলে শিউলি পড়ে থাকত গাছের নীচ জুড়ে। আর আমরা দুজন ফুল কুড়োতে কুড়োতেই কুড়িয়ে নিয়েছিলাম আমাদের প্রথম চুম্বন। তুমি পড়তে গেলে সেতুর ওপারে,আমি আরও দূরে...দূরে কোথাও... তখনও জানি দেখা হবে আবার। তুমিও তো তাই জানতে। মাঝে কি দক্ষিণ দেশ থেকে উড়ে এসেছিল নিম্নচাপ? ঘোর দুর্যোগ? আবহাওয়া অফিস জানিয়েছিল বিপদ সংকেত ৭। আর পরে তা বাড়তে বাড়তে ৮,৯,১০। আছড়ে পড়ল,ভেঙে দিলো,তছনছ করে দিলো এতদিনের শান্তি,উষ্ণতার বন্ধন? তোমার কিছু মনে পড়ে? কিছু? আমিও তো সেভ সেভ সেভ বলে ডাকতেই যাচ্ছিলামগো,চাইলেই কি আর সব্বাই সব পারে? তাই গোঁত্তা খাওয়া ঘুড়ির মতই আমিও চুপ...বল মনে পড়ে? প্লিজ বল না?

বাবা চলে গেছিল একদিন হঠাৎ। কিচ্ছু করে উঠতে পারিনি। মার চলে যাওয়ার আগে যুদ্ধ ছিল অনেক। আর সে যেমন তেমন যুদ্ধ নয়,রীতিমত ২৩ বছর ধরেই যুদ্ধ চলেছিল। যুদ্ধ মানেই ক্ষয় ক্ষতি,অনিবার্য বিপর্যয়,যা যুদ্ধই বয়ে আনে শুধু। আর দেওয়ালে কাঁপে অস্তিত্বের ছায়া,আলো কমে আসছে,রক্তের নিভে আসা ক্রমশ। ধর সেই যে সকালে বেরিয়েছিলাম। তারপর ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্তি যখন মাথার ওপর ঘনিয়ে এলো,আর তেমন সরে যাবারও ক্ষমতা নেই,হঠাৎ সাইরেন,আর ট্রেঞ্চে ঢোকা,না পারিনি। পারা যায় বল? প্রস্তুত ও ছিলাম না মোটেই। কিন্তু তুমি বা আমিই কি আমাদের নিয়তি ঠাকরুণের ইচ্ছে বদলাতে পারি? ফল যুদ্ধ। ফল যুদ্ধ সংক্রান্ততায় এক অনিবার্য গল্প। গল্প? যা চিহ্ন রেখে যায়,তাকে কি গল্প শিরোনামেই ডাকবে,না’কি কবিতা? এমন শহর তো দেখিনি এর আগে। রাস্তার ধারের যে সবুজ গাছগুলো আমাদের এই পথ গুলোকে সুন্দর করে তুলেছিল,পৃথক করে তুলেছিল সেই সব গাছ গুলো ঝলসে গেছে। রাস্তা ভরা বড় বড় গর্ত। মোড়ের মাথায় যে পিলুদার দোকান থেকে ললিপপ কিনতাম,তা দুমড়ে,তুবড়ে গেছে। রাধিকা,ছিল আমার বন্ধু। আমরা প্রাইমারী স্কুলে একসাথেই পড়ে এসেছি। সেকেন্ডারির পর আর দেখা হয়নি।দেখাও এক অমীমাংসিত জিজ্ঞাসা,হয়,হয় নাও! ও বড় হয়েছে,আমিও। কেবল ও ছাদে দাঁড়ালে আমায় দেখতে পেতো ৪৩ ডিগ্রীর কোণে। আমি ছাদের ফণিমণসাকে সারা গায়ে মেখেই উদগ্রীব হয়ে দেখতে যেতাম ওকে। ও হাসতো। আমি রক্তাক্ত হতাম কাঁটায় কাঁটায়। ওদের ছাদটা নেই।

দূর থেকে ভেসে আসছে এক নাগাড়ে চলতে থাকা ট্রাকগুলোর শব্দ। সেনা বোঝাই এ সব ট্রাকে এখন শত্রু সৈন্যের ভীড়। ওরা বিদেশী ভাষায় কি যেন গান গাইছে। তবে অনুমেয় ওরা যুদ্ধেরই গান গাইছে,যুদ্ধজয়ের গান। ব্যালাড নয় ঠিক বিজয়ের গান। আর সারা শহর জুড়ে ক্রমিক নিস্তব্ধতা। এ সময়েই কি কসমিক জগত থেকে সংকেত চালাচালি হয়,হ্যালো আর ইউ লিসনিং?...হ্যালো...হ্যা..লো..ও ও ও... এসময় কে তুমি অসময় বলে ডাকতেই পারো। দেখেছি এ সময়ে কিছু কমিক চরিত্রের বড় হয়ে ওঠা। ধর চালের আড়তদার,গম বা কাপড়ের। কমিক কে খারাপ বলিনি। চার্লস চ্যপলিন তো শ্রদ্ধেয় সর্বকালের,এমনকি আমাদের ভানু,জহর,রবি ঘোষ বা সন্তোষ দত্ত। কিন্তু এটা নৃপতিদের সময়। মানে এহেঁহেঁ হাসির চওড়া হবার সময়। আর এ সময়েই ছবি বিশ্বাস হারাবে তার জলঙ্গীর ‘জলসাঘর’। জলসাঘর মানে খারাপ না,এক সময়ের কৃষ্টি ও সংস্কৃতির সেই তো বাহক। শীত করছে,কফি যে করবো ভয় লাগে,পাছে আগুণ জ্বাললে বুঝে যায় উপস্থিতি। অথবা অনুপস্থিত,যা হাইফেনকে ধরে ঝুলে রয়েছে...একা,একাইতো...হ্যালোওওওও..

১১মে থেকে ৩জুন:-

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের খবর নিলে দেখবে তা হয়েছিল মাত্র ৪৫ দিন। আদতে কি তাই? তাই হয়?অনেক ছোট ছোটো যুদ্ধ বড় যুদ্ধ আর তার ভিত্তি স্থাপন। সে আদতে প্রায় ৩ বছরের অধিক এক ক্রমিক যুদ্ধের ফলাফল। আমি গান গাইনা আর। পাছে কেউ শুনতে পায়। জেনে ফেলে আমার উপস্থিতি। ২৩ দিনের যুদ্ধ এর রিপোর্ট কার্ড বেরুবে কাল। কে জিতলো কে হারলো।

আমি কেবল নিজেকে সন্তর্পণে গুটিয়ে নিচ্ছি। ট্র‍য় টা মারা গেছে। আমার পায়ে পায়ে ঘুরতে থাকা সেই প্রিয় বিশ্বাস ভাজন। পরশু সকালে উঠে দেখলাম সারা বারান্দা জুড়ে মরে আছে অনেক গুলো চড়াই। ওরা কি তবে বাতাসে নাইট্রাস অক্সাইড মেশালো? শ্বাসকষ্টতো আমারও। এ শহরে এসেছি অনেকদিন হল। ধবংসস্তুপকে শহর নামেই ডাকাই তো রেওয়াজ। রুমাল নাড়িয়ে জানাতে পারিনি আমি এসেছি।ফোনের লাইন কাটা। তুমি কি জানতে না আমি এসেছি,না’কি তুমিও ভয়ে আমারই মত? ১১মের যুদ্ধ ছিল কিছু অসতর্ক মুহুর্ত আর একতরফা মার। তুমি বুঝে উঠে ফুঁসে ওঠার আগেই তা থেমে গেছিল। কিন্তু প্রতিরোধ তো মানুষের ধর্ম। তার সুযোগ তুমি পাওনি। এমনটাই করেছিল আমেরিকা ৬জুন। বাট কিন্তু তুমি জানো আই হেট আমেরিকা! তিতলি আমায় চিনতে পারেনি। না চেনারই কথা। সারা গায়ে দগ্ধতার ক্ষত চিহ্ন। ওর মা,মানে আমার কাগুজে স্ত্রী গাল মন্দ করতে করতে পালিয়েছে তিতলিকে নিয়েই। তিনি অবশ্য পালানো বলায় ইচ্ছুক নন। বলেছেন লিভ করেছেন। স্টেশন লিভই তো করে,উন্নত প্রজাতির মানুষ! খাবার আর পাওয়া যায় না এ শহরে। সব ওদের দখলে,শত্রু সেনার। যে বাড়িগুলো সুন্দর করে বানিয়েছিল গৃহস্বামীরা। অথবা যে গুলো নিতান্তই বাসযোগ্য করে তুলে বসবাস করত গেঁড়ি গুগলির মত মানুষ সেই সব বাড়িই আপাতত পরিত্যক্ত। পরিত্যক্ততার ওপরেই হয়ত গড়ে ওঠে ভার্চুয়াল মিনার...শত্রু সেনা ঘাঁটি গেড়েছে সুন্দর বাড়ি গুলোয়।

এখন এখানে কিছু নেই,কিছু নেই,কিছু নেই

ভুল করা মানুষের স্বভাব। সে তুমি যতই সতর্ক হও ভুল তুমি করবেই। সামনে পরিত্যক্ত ফোন বুথ। ক্রিং ক্রিং ফোন বাজতে দেখেই চুপিসারে এসেছি। রিং থামতেই ক্র‍্যাডল থেকে ফোন তুলে সোজা তোমার নাম্বারে-হ্যালো…

হ্যান্ডস আপ। ডু নট মুভ। আমি ক্ষমা চাইতে এসেছিলাম তোমার কাছেই।

রাত সাড়ে তিনটেতে প্রবল যুদ্ধর শুরু হল। তার আগে ওরা আমায় বসিয়ে রেখেছিল অন্ধকার ঘরে। আমি যুদ্ধবন্দী। ছেড়ে দিইনি। আমার হারানোর মত কিছুই ছিল না আর। তাই ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। ওদের সাথে আমি পারি বল? ওরা একটা ৭২ জনের ট্রুপ। আমি একা। বিট বিট বিট। লাবডুপ আর বুটের আওয়াজ এক রকম জানো। ওদের মুখে হাসি। কমে আসছে বুটের শব্দ। ল্যাব ডুপ। বিট….বিট...বিট।

এখন সাড়ে পাঁচটা সকাল। ভোর ভাঁয়ো। ভোরের বাতাস মেখে শত্রু জিপে করে আমি চলেছি,আমার শরীর এলানো। সেপিয়া কালারের এ শহর ছেড়ে যেতে মনে পড়ছে মা,তিতলি,আর হ্যাঁ তোমাকেই…

ক্ষমা চাওয়ার ছিলো তোমার কাছে। ওদের কাছেও। শহর ছেড়ে যাচ্ছে শত্রু জিপ।

সে একটা জীবন ছিলো বটে,বল? না ছেড়ে যাওয়া অবধি যার অস্তিত্ত্বই কেউ বুঝলো না...ভোর...ধোঁয়া উঠছে এদিক ওদিক... ক্ষতচিহ্ন...যুদ্ধশেষে যেভাবে মাথা নীচু করে থাকে,সব...কোথাও একটা ঘড়ি চলছে টিক টিক...একটা শিশুকান্নার শব্দ যেন…

যুদ্ধের গল্পগুলো কেমন যেন জীবনের মতই,তাই না?

পরিচিতি



তমাল রায়ের জন্ম ১৯৭০-এর নকশাল আন্দোলনের জন্য বিখ্যাত বরানগরে। কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞানে ও বাংলা সাহিত্যে স্নাতক। ছোটগল্প লেখার শুরু ২০বছর বয়সেই। ছক ভাঙা গল্প লেখার দিকেই ছিলো মূল ঝোঁক। গল্প ও গদ্য উভয় ধারাতেই সাবলীল। ১৯৯০থেকে ঐহিক পত্রিকার সম্পাদক। প্রকাশিত ছোটগল্পের বই দুটি। নিঝুমপুরের না-রূপকথা ও তিতিরের নৌকোযাত্রা। ২০১৫-তে একাডেমী পুরস্কারে সম্মানীত, সম্পাদনার জন্য।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ