মোহছেনা ঝর্ণা'র গল্প : লালপদ্ম

প্রখর রোদ। ঘামে ভিজে যাচ্ছে পুরো শরীর।
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছি সেই প্রিয়মুখ।কত বছর পর দেখা!এভাবে কোনোদিন দেখা হবে ভাবতেও পারিনি।খুব দামী কিছু হারিয়ে ফেললে মাঝে মাঝে বুকের মধ্যে যেমন হাহাকার জেগে উঠে, মিতালীদি’কে ছেড়ে যাওয়ার পর থেকে মাঝে মাঝে ঠিক সে রকম হাহাকারই জেগে উঠত আমার।


মিতালীদি আমার স্কুল টিচার ছিল। তার চেয়ে বেশি সম্পর্ক ছিল তারা আমাদের প্রতিবেশি ছিল বলে।আমি আর আমার ছোট বোন নকশী দিনের বেশির ভাগ সময়ই মিতালীদি’দের বাসায় থাকতাম।মা কোথাও বেড়াতে গেলে আমাদেরকে মিতালীদি’র মায়ের জিম্মায় রেখে যেত। মিতালীদি’র ছোট বোন চিত্রাদি কী সুন্দর গান করতো!মুগ্ধ হয়ে শুনতাম।মিতালীদি’র বাবা একটা সরকারী চাকরী করতো।আর মিতালীদি’র ভাই মৃত্যুঞ্জয়দা’তো ছিল আমার স্বপ্নের মানুষ।

জয়’দা কত কিছু জানতো। জয়দা আবার ভীষণ রাগী ছিল। তবে জয়দা গল্প বলতো দারুণ। রাস্তার এপার আর ওপার ছিল আমাদের বাসা। মিতালীদিদের বাসার সামনে ছোট খোলা একটা জায়গা ছিল।সেই ছোট্ট জায়গাটাতে মাসী যে কত রকম ফুল গাছ লাগিয়েছিল! গোলাপ, বেলী, কামিনী, হাসনাহেনা, নয়নতারা, রংগন, টগর,শিউলি, জবাসহ আরো কত নাম না জানা ফুল। রাতে কারেন্ট চলে গেলে আমরা দু’বোন মিতা্লীদি’দের বাসার সামনের খোলা মাঠে চলে যেতাম। অবশ্য এটাকে খোলা মাঠ না বলে সবুজ উদ্যান বলা যায় অনায়াসে।এত সবুজের সমাহার! চাঁদনী রাত গুলোতে গল্প জমতো দারুণ। আমি আর নকশী থাকতাম মুলত শ্রোতা। বলতেন ওনারা তিন ভাই বোনই।

জয়দা আমাদেরকে ঈশপের গল্প বলতেন। লেভ টলস্টয়ের গল্প বলতেন। কাঠুরিয়ার গল্প,রাজকন্যার গল্প,মানুষের গল্প বলতেন। আনা ফ্রাঙ্কের ডায়েরীর কথা শুনে আমার কান্না চলে আসছিল। হিটলার নামের ঐ বদ লোকটার উপর সে কী রাগ হচ্ছিল। জমির একটা গল্প বলেছিলেন টলস্টয়ের। সকাল থেকে শুরু করে যতটুকু জমি সেই মানুষটা হেঁটে যেতে পারবে তার সবটুকুই তার হয়ে যাবে। শুধু শর্ত হচ্ছে সুর্য ডোবার আগেই শুরুর জায়গায় ফিরে আসতে হবে। লোভী মানুষটা ফিরে আসতে পারেনি।একজন মানুষের আসলে কতটুকু প্রয়োজন একথাটা সে বুঝতে পারেনা বলেই এত সমস্যা। মাত্র সাড়ে তিন হাত জমি যার শেষ ভরসা সেই কিনা বেঁচে থাকার প্রতিটা মুহূর্তে চায় আরও বেশি। আরও বেশি।

আঙ্গুর ফল টকের গল্পটা শুনে তো হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছিলাম আমি আর নকশী। কাঠুরিয়ার গল্পটাও বেশ লেগেছিল। কাঠুরিয়ার কুঠারটা নদীতে পড়ে গেল। দরিদ্র কাঠুরিয়ার মন খারাপ। ঠিক তখনই সেখান দিয়ে উড়ে যাচ্ছিল এক পরী। পরী নিচে নেমে এসে কাঠুরিয়াকে জিজ্ঞেস করল, তুমি কাঁদছ কেন?
কাঠুরিয়া কান্নাসিক্ত গলায় বলল,আমার কুঠারটা পানিতে পড়ে গেছে।কাল থেকে আমি কিভাবে কাঠ কাটব? কাঠ না কাটলে আমি বাজারে গিয়ে কি বিক্রি করব? বাজার করব কিভাবে? আমার ছেলেমেয়েরা কি খাবে?
কাঠুরিয়ার কথা শুনে পরীর মায়া হয় কাঠুরিয়ার জন্য। সে কাঠুরিয়াকে চোখ বন্ধ করতে বলে পানির নিচ থেকে একটা কুঠার তুলে কাঠুরিয়ার চোখের সামনে ধরে বলে, এবার চোখ খুলে দেখ তো এই কুঠারটা তোমার নাকি?
কাঠুরিয়া ভালো করে দেখে বলল, না এটা আমার কুঠার না।এটাতো সোনার কুঠার।আমারটা ভাঙ্গা ছিল।
পরী বলল,তুমি ভাল করে দেখে বলছ তো এই কুঠারটা তোমার না?
কাঠুরিয়া বলল,এটা আমার কুঠার না।
পরী আবার তাকে চখ বন্ধ করতে বলে পানির নিচ থেকে আবার একটি কুঠার এনে বলল,দেখোতো এটা তোমার কুঠার নাকি?
কাঠুরিয়া কুঠারটা ভাল করে দেখে বলল,না এটাও আমার না।এটাতো রূপার কুঠার।
পরী আবার পানির নিচ থেকে আরেকটা কুঠার এনে বলল,এবার দেখো এটা তোমার নাকি?
কাঠুরিয়া নিজের ভাঙ্গা কুঠারটি দেখে বলল, হ্যাঁ, এটাই আমার।
পরী কাঠুরিয়ার সততায় মুগ্ধ হয়ে বলল,বাকী দু’টা কুঠারও আজ থেকে তোমার।
সততার পুরষ্কার যে মানুষ পায় এই গল্পটা যেন সে কথাই মনে করিয়ে দেয়।
জয়দা এমন কত শত গল্প যে শোনাতো!

মিতালীদি’র মা সবসময় সিঁদুর দিয়ে বড় একটা টিপ দিত কপালে। আমার মনে হতো মাসির কপালে ফুটে আছে একটা লালপদ্ম। মিতালী দি আমার স্কুল টিচার হলেও আমাদের সম্পর্কটা ছিল বেশ পারিবারিক। আর তাই সম্বোধনটাও ছিল তুই আর তুমি তে। মিতালীদি’কে আমি জিজ্ঞেস করতাম,দিদি তুমি কপালে লালপদ্ম দেবে না? দিদি বলতো,লালপদ্মতো চাইলেই দেয়া যায় না,লালপদ্ম ফুটতে হয়।
চিত্রাদি অবশ্য হেসে বলেছিল,আর কিছুদিন পর দিদির কপালে একটা লালপদ্ম ফুটবে রে আরশী।তুই আর আমি মিলে তখন অনেক মজা করব। আমি হেসে সম্মতি প্রকাশ করেছিলাম।

হঠাৎ একদিন দিদিদের বাসায় গিয়ে দরজার কড়া নাড়ছি কেউ দরজা খুলছে না। অনেকক্ষণ পর দিদির মা দরজা খুলে আমাদের ঢুকিয়ে আবার তাড়াতাড়ি বন্ধ করে দিলেন। বাসার পরিবেশটা কেমন থমথমে। আমি মিতালী দিকে জিজ্ঞেস করলাম,দিদি কি হয়েছে ?
দিদি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,তুই বুঝবিনা।
কারো মুখে কোনো কথা নেই। সবগুলো মুখে বিষাদের ছায়া। খুব প্রিয় কোনো স্বজন হঠাৎ করে মারা গেলে ঘটনার আকস্মিকতায় যেমন মানুষ বিহবল হয়ে পড়ে ওদের সবার চোখেমুখে যেন ঠিক সে রকম বিহবলতার চিহ্ন। এসময় আবার দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে ওরা সবাই চমকে উঠল। দিদির মা ধীর পায়ে দরজার সামনে গিয়ে দরজা না খুলে ভেতর থেকেই জিজ্ঞেস করল, কে? কে ?
বাহিরে বোধহয় জয়দার বন্ধুরা ছিল। কারণ মাসী বলল,জয় বাসায় নেই।
আর তখনই আমার মনে হলো জয়দা নিশ্চয়ই কোথাও কোনো ঝামেলায় পড়েছে।
আমি তাদের পূজার আসনের পাশের ঘরটাতে গিয়ে দেখি জয়দা শুয়ে আছে। আমাকে দেখে বললেন,কিরে আরশী,তুই এ সময়ে?
আমি বললাম,জয়দা,তোমার সাথে কি কারো ঝগড়া হয়েছে?
জয়দা বললেন,কেন?
তাহলে তোমাদের বাসায় সবাই এমন মুখ গোমড়া করে আছে কেন?
জয়দা বললো,আমরা তো মানুষ নই,আমরা শুধু হিন্দু তাই সবাই মুখ গোমড়া করে রেখেছে।
কথাটা বলার সময় জয়দার কন্ঠে অভিমান ঝরে পড়ছিল কলকল করে। আমি কিছু না বুঝে তাকিয়ে থাকি অভিমানী বালকের দিকে।
জয়দা বললেন,ইন্ডিয়াতে কারা বাবরী মসজিদ ভেঙ্গেছে,আর তাই বাংলাদেশে ধরে ধরে হিন্দু মারো আর মন্দির ভাঙ্গো। গাধারা বোঝে না,মসজিদ, মন্দির ভেঙ্গে ধর্ম প্রতিষ্ঠা হয় না। যা হয় তার নাম অশান্তি আর বিশৃংখলা। এটার সভ্য নাম হচ্ছে ধর্মান্ধতা, উগ্রতা, বর্বরতা...।

চিত্রাদি’র স্কুলে যাওয়া বন্ধ ছিল কিছুদিন। জয়দাকেও মাসী চোখে চোখে রাখতো। জয়দা কিসব রাজনীতির কথা বলতো আমি বুঝতাম না।কার্ল মার্কস, লেনিন, মাওসেতু, রাশীয়াপন্থী, মস্কোপন্থী, সমাজতন্ত্র, পুঁজিবাদী অর্থনীতির কথা যখন বলতো আমি কিছু বুঝতাম না দেখে বলতো, তোকে দিয়ে কিছু হবে না। আমার অবশ্য এসব বুঝতে না পারার কোনো দুঃখ ছিল না। আমি আমার সরল অংক মিলাতেই হিমশিম খেতাম আর সেখানে কী সব কঠিন কঠিন কথা বলতো জয়দা?
সে সময় একদিন বাসায় বাবা-মা কে বলতে শুনি দেশের পরিস্থিতি খারাপ। সংখ্যালঘুদের উপর খুব নির্যাতন চলছে। সংখ্যালঘু শব্দটা সেদিনই প্রথম শুনেছিলাম মনে হলো।
পরদিন আমি মিতালীদি’কে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,সংখ্যালঘু কী?
মিতালীদি খুব অবাক চোখে তা্কিয়ে ছিল আমার দিকে।
পাশেই ছিল জয়দা।

এটা যে অনেক যন্ত্রণার বিষয় তা তো আমি জানতাম না। মিতালীদি বলল,হঠাৎ করে সংখ্যালঘুর কথা জিজ্ঞেস করলি কেন?
কাল বাবাকে বলতে শুনেছি। মিতালীদি আর কোনো কথা না বলে হাতের কাজে মন দিল।
কিন্তু জয়দার চোখেমুখে কেমন যেন একটা ক্রোধের ছাপ ফুটে উঠেছিল।
জয়দাকে ইন্ডিয়াতে পাঠিয়ে দেয়ার জন্য জয়দার বাবা সব ঠিক ঠাক করে ফেলেছে। কিন্তু জয়দা যাবে না। মাসী বলল,বাবা ওখানে তোর মামারা আছে। কোনো সমস্যা হবে না তোর। আর এদিকের পরিস্থিতি শান্ত হয়ে গেলে আবার চলে আসবি।
জয়দা বলল,মা তুমি আমাকে পালিয়ে যেতে বলছ? ওখানে ভালো থাকব তার নিশ্চয়তা কি? আর তোমাদের সবাইকে রেখে আমি একা ভালো থাকবো কেন?
কিছুদিন পরই ছিল দিদিদের পূজা। এর আগে পূজার সময় দিদিদের কত আয়োজন করে কেনাকাটা করতে দেখতাম,অথচ এবার কেমন যেন প্রাণহীন ভাব সবকিছুতে। মিতালীদির মা বেশ মজার মজার পিঠা,নারকেলের নাড়ু আরো কত কিছু বানাতো। চিত্রাদির সাথে ভাব করে আমি আর নকশীই প্রায় সব নাড়ু খেয়ে ফেলতাম। এবারের পূজায় দিদিদের ঘরে কোনো উৎসব নেই। বাড়তি কোনো আয়োজন নেই।নিষ্প্রাণ একটা ঘর মনে হচ্ছিল দিদিদের ঘরটাকে।

জয়দার বন্ধুদের মধ্যে বেশির ভাগই ছিল মুসলিম। এ নিয়ে মাসী প্রায় দুঃশ্চিন্তায় থাকতো। মুসলিম ছেলেগুলো কখন না জানি কি ক্ষতি করে বসে! এসব কথা জয়দা’র কানে গেলেই জয়দা চিৎকার করে বাড়ি মাথায় তুলতো। মাসীর উপর খুব রাগ হয়ে বলতো,তোমরা মানুষ হতে পারলে না কেন মা?

আমার বাবার বদলির চাকরি। হঠাৎ করে বাবার বদলির কারণে মিতালীদি’দের ছেড়ে আমাদের চলে যেতে হয় খুলনায়। যাওয়ার সময় জয়দা আমাকে একটা বই দিয়েছিল। সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতা সমগ্র।আমি বললাম,ধূর কবিতার বই না কিনে গোপালভাঁড়ের বই কিনলেই পারতা জয়দা বললো, কবিতা গুলো মনোযোগ দিয়ে পড়িস।অনেক ভালো লাগবে।
যেদিন আমরা চলে যাচ্ছিলাম সেদিন দিদিরা সবাই মন খারাপ করে তাদের বাসার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। প্রিয়স্বজন হারানোর ব্যথায় আমাদের সবার চোখই ছলছল করছিল।

খুলনায় যাওয়ার পর কিছুদিন মিতালীদি’দের সাথে বাবার যোগাযোগ ছিল। এরপর কিভাবে যেন একটা সময় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে কি হবে মিতালীদি,জয়দা,চিত্রাদি তো ছিল আমার সমগ্র চেতনায়। যত বড় হচ্ছিলাম আমি জয়দার কথাগুলো ততই যেন সত্যি হয়ে ধরা দিচ্ছিল জীবনে। এ জীবনে যে সামান্য কিছু আমি জানি মনে হয় তা জয়দার কারণেই জানি। জয়দা’র কথা খুব মনে পড়তো। যখন থেকে বন্ধুরা ভালোবাসা বা প্রেম বিষয়ক কথা বলতো তখন থেকে জয়দার মুখটাই ভেসে উঠত সন্তর্পণে। জয়দা মাঝে মাঝে কবিতা আবৃত্তি করতো।
জীবন গিয়েছে চ’লে আমাদের কুড়ি কুড়ি বছরের পার-তখন আবার যদি দেখা হয় তোমার আমার।জীবনানন্দের কুড়ি বছর পরে এই কবিতা পড়তে গিয়ে হোঁচট খাই। জয়দা তো প্রায় সময় গুন গুন করে এই কবিতাই আবৃত্তি করতো।

২০০১ সালে আবার যখন সখ্যালঘুদের উপর চরম নির্যাতন হচ্ছিল তখন আমার শুধু মিতালীদি, জয়দা আর চিত্রাদির কথা মনে পড়ছিল। পূর্ণিমার মায়ের আর্তনাদ কেন জানি জয়দার ক্ষোভ হয়ে ঝরে পড়ছিল আমার কানে। সেই একবারই চেয়েছিলাম জয়দার সাথে যেন কোনোদিন দেখা না হয় আমার। কারণ জয়দার চোখের ঐ ক্রোধের সামনে দাঁড়ানোর সাহস হারিয়ে গেছে আমার। ধর্মের নামে এমন অধর্ম আর হয়েছে কিনা আমি জানি না। জয়দা নিশ্চয় আমার দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের একটা হাসি দিয়ে বলতো এরা সবাই ধর্মপ্রাণ মানুষ। যাদের উপর অত্যাচার হয়েছে তারাও ধর্মপ্রাণ।কারণ অত্যাচারের সময়টাতেও তারা ঈশ্বরের কৃপাই চেয়েছিল। মানুষের চেয়ে ধর্ম বড় হয়ে গেলে সেখানে অধর্মই হয় বেশি।

রিকশার জন্য দাঁড়িয়ে ছিলাম। হঠাৎ করে মনে হলো যেন মিতালীদি দাঁড়িয়ে আছে পাশে। ভালো করে তাকিয়ে দেখে বিস্ময়ে চিৎকার করে ডেকে উঠলাম,মিতালীদি।
মিতালীদি আমার দিকে তাকালো অচেনা ভঙ্গিতে। বললাম,চিনতে পারোনি, তাইতো?
মিতালীদি বিড়বিড় করে বলল,আরশী।
হ্যাঁ, মিতালীদি।
মিতালীদি বিশ্রী রকম শুকিয়ে গেছে।এত জরা-জীর্ণ দেখাচ্ছিল! মিতালীদিকে কাছে পেয়ে সুখ আমার ধরে না প্রাণে। পাশের আইস্ক্রীম পার্লারে গিয়ে বসি। দিদি বললেন,তুই এখনো আগের মতো আইস্ক্রীম খাস নাকি?
জবাবে শুধু হাসলাম আমি।আমার সে হাসি অবশ্য বেশিক্ষণ থাকলো না। মিতালীদির মুখে যা শুনলাম আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল। ২০০১ সালের সাম্প্রাদায়িক দাঙ্গায় দিদিদের গ্রামের বাড়িতে খুব নির্যাতন হয়। জয়দা সেখানে প্রতিবাদ করতে গিয়ে মারাত্মক শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়। বেশি কষ্ট পেয়েছে যখন দেখল তার অনেক কাছের বন্ধুও এই অত্যাচারে শরিক হয়েছে। জয়দার মন ভেঙ্গে গিয়েছিল। সারাক্ষণ ঘরের মধ্যে ঝিম মেরে বসে থাকতো আর বলতো এদেশ আমার না। আমার দেশ কোথায়? জয়দার বাবা জয়দাকে একরকম জোর করেই ইন্ডিয়াতে পাঠিয়ে দিয়েছিল। প্রচন্ড মানসিক চাপ কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেনি জয়দা। তাইতো আত্মহত্যা করার আগ মুহূর্তে লিখে যাওয়া চিরকুটে আকুতি ছিল তার মরদেহ যেন তার প্রিয় বাংলাদেশের মাটি কোনোভাবেই স্পর্শ না করে। সেই শোক সইতে পারেনি জয়দার বাবা। একমাত্র পুত্রের এমন করুণ পরিণতি সহ্য করতে পারেননি তিনি। আমি যেন পাথর হয়ে গেলাম। জয়দার সাথে বলার জন্য কত কথা জমিয়ে রেখেছিলাম আমি।
জয়দা এভাবে হেরে গেল! জয়দার প্রিয় গান ছিল ধনধান্যে পুষ্পে ভরা আমাদেরই বসুন্ধরা......সকল দেশের রানী সে যে আমার জন্মভুমি.........। সেই জন্মভুমির উপর এত অভিমান করে চলে গেল জয়দা!

চোখ ছল ছল করে উঠছিল আমার। কোনোমতে নিজেকে সামলে নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম চিত্রাদির কথা। চিত্রাদির ভালো আছে। এক ছেলে এক মেয়ে নিয়ে সাজানো সংসার। চিত্রাদির বরও নাকি ভালো মানুষ। জয়দাকে হারানোর পর এখন চিত্রাদির বরকেই মাসী নিজের জয় বলে জানে।
হঠাৎ করে খেয়াল করলাম দিদির কপালটা খালি। বললাম,মিতালীদি লালপদ্ম ?
মিতালীদি বিষণ্ন একটা হাসি দিয়ে বলল, সবার কপালে লালপদ্ম ফোটে না।
আমার চোখ আবার ছল ছল করে উঠে। মিতালীদি প্রসংগ পাল্টাতে বলে তোর খবর বল। নকশী কত বড় হয়েছে? কি করে? খালাম্মা-খালু কেমন আছে? প্রশ্নের কোনো শেষ নেই।কথায় কথায় অনেক সময় চলে গেছে। তাই দিদিই বলল,চল বাসায় চল,মা তোকে দেখলে অনেক খুশি হবে। আমি হেসে বললাম,আজ না দিদিমনি,আরেকদিন যাব। আবার বললাম,দিদি তোমাদের সেই ফুল গাছগুলো এখনো আছে? সেই কলতলাটা ? সেই কাঁসার জিনিসপত্রগুলো? দিদি এখনো কি আমলকির আচার বানাও? নাড়কেলের নাড়ু? মনে আছে আমি আর নকশী চিত্রাদির সাথে ভাব করে সব নাড়ু খেয়ে ফেলতাম।
মিতালীদি হেসে বলল,মনে থাকবে না আবার।সবই আছে। থাকার জন্য থাকা। প্রাণ নেই কিছুতে। প্রাণবিন্দুটা নিজেই যে হারিয়ে গেছে! দিদির চোখে পানি। বিব্রত বোধ করি আমি। জয়দার কথা মনে পড়ে আবার। জয়দার সেই ছোটবেলার গল্পগুলিতো এখন আমি বেশ বুঝি।এখন নিশ্চয়ই জয়দা আমার সাথে আরো নতুন নতুন অনেক গল্প করতো। গল্পের কোনো এক ফাঁকে কি জয়দা বুঝতে পারতো জয়দাই আমার সেই স্বপ্নের কাঠুরিয়া।

আইস্ক্রীম পার্লার থেকে বেরিয়ে মিতালীদি রিকশায় উঠা পর্যন্ত আমি দাঁড়িয়েছিলাম। মিতালীদির হাঁটাচলা কী অদ্ভুত মন্থর হয়ে গেছে। আমার মনটাই খারাপ হয়ে যায়। মনে হচ্ছিল মিতালীদির সাথে এভাবে দেখা না হলেই ভালো হতো। আমি থাকতাম আমার স্বপ্ন নিয়ে। আমি ঠিক করেছি মিতালীদিদের বাসায় কোনো দিন যাবো না আমি।কারণ সেখানে আরো অনেক স্বপ্ন মড়মড় করে ভেঙ্গে যাওয়ার শংকা রয়ে গেছে। মিতালীদিদের ঠাকুর ঘরের সেই লালফুল গুলো দেখলে মিতালীদির কপালে লালপদ্ম না ফোটার আক্ষেপ আমাকে আবার সাপে কাটার মতো যন্ত্রণা দেবে। শখ করে কষ্ট কেনার কোনো মানে হয়?

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ