কৃষ্ণেন্দু পালিত'র গল্প : দশ টাকার নোট

তিনটে লুচি পনের, চা দুটো আট টাকা – মোট তেইশ টাকা । খুচরো তিনটাকা আর একটা পাঁচশো টাকার নোট ধরিয়ে দিলাম মউয়ের হাতে । মউ আমাদের স্কুল-ক্যানটিনের মালকিন । ফাইভ থেকে টুয়েলভ – বারশোর উপর ছাত্র । বিক্রিবাটা ভালো হয় বলেই আমার ধারণা । 

টাকাটা নিয়ে সে চলে গেল । ফিরে এল কিছুক্ষণ পরে । এক তাড়া দশটাকার নোট আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, গুনে নিন ।


- বড় নোট ছিল না ?

- ছাত্ররা বড় নোট কোথায় পাবে !

ভুল বুঝতে পেরে কথা বাড়ালাম না । চকচকে ময়লা নতুন পুরানো কাটা ফাটা হরেক কিসিমের নোট । কিছুক্ষণ আগেও এগুলো ছাত্রদের পকেটে ছিল । সাত রাজার ধন এক মানিকের মত আগলে রেখেছিল । কতবার পকেট থেকে বের করে দেখেছে তার ঠিক নেই । যতবার দেখেছে ততবার নতুন নতুন আকাঙ্ক্ষার জন্ম হয়েছে । সে সব স্বপ্ন এখন বাস্তব ছুয়ে অতীতের ঘরে । আমাদের সময় বরাদ্দ হত পাচ-দশ পয়সা, তাও কখনও সখনও । বাবা-মার ধারনা ছিল হাতে নগদ পয়সা বেশি পেলে ছেলেমেয়ে খারাপ হয়ে যাবে । এখনকার বাবা-মায়েরা বোধহয় অতটা গোঁড়া নয় । তিরিশ বছরের ব্যবধানে পাচ-দশ পয়সাই এখন পাচ-দশ টাকা ।

টাকাগুলো গুনতে গুনতে আমার চোখের সামনে ক্লাসরুম ভেসে ওঠে । কখনও তিরিশ বছর আগের কখনও বর্তমানের । কখনও ছাত্রদের দৃষ্টিতে কখনও শিক্ষকের । সেদিন যেমন এক একটা পয়সার পেছনে এক একটা গল্প থাকত, আজও আছে । কেউ না খেয়ে এসেছে, কেউ মায়ের তহবিল থেকে না বলে এনেছে, কেউ বা দীর্ঘদিন বায়না করতে করতে আজ বরফ গলাতে পেরেছে । কেউ খেয়েছে লুচি, কেউ চাউমিন, কেউ চিপস । সবগুলো আলাদা আলাদা স্বাদ , ভিন্ন ভিন্ন স্বপ্ন পূরণ ।

এসব ভাবনার মধ্যেই একটা নোটে চোখ আটকে যায় । মহাত্মা গান্ধীর জলছাপের উপর লেখা বনমালী দাস । বনমালী ক্লাস নাইনের ছাত্র । আজ চতুর্থ পিরিয়ডে নাইন এ সেকশনে ক্লাস ছিল । ক্লাসে ঢুকে দেখলাম বেশ হট্টগোল চলছে । আমাকে পেয়ে নালিশের ঝড় বয়ে গেল । বিষয় গুরুতর । বনমালীর দশটাকা চুরি গেছে । মনিটর দু জন নিজের দায়িত্বে সকলের ব্যাগ আর পকেট চেক করছে ।

- টাকাটা চুরি হয়েছে কি করে বুঝলি ? হারিয়েও তো যেতে পারে । ক্লাস শান্ত করে নিজের চেয়ারে বসতে বসতে বনমালীকে বললাম, ভালো করে খুঁজে দেখ কোথায় রেখেছিস ।

- খুঁজেছি স্যার, সব জায়গায় ভালো করে খুঁজেছি ।

ছাত্রদের উদ্দেশ্য করে বললাম, তোমরাও খুঁজে দেখ । কেউ বদমায়েশি করে তোমাদের ব্যাগে বা পকেটে ঢুকিয়ে দিতে পারে । আমার কথায় কেউ কেউ নিজের ব্যাগ হাতড়ে দেখল, পকেট উলটে দেখল । টাকাটা তবু পাওয়া গেল না । বলতে বাধ্য হলাম , এবার আমি সকলের ব্যাগ চেক করব । পেলে কপালে দুঃখ তো আছেই, সারা জীবন বন্ধুদের কাছে চোর বদনাম নিয়ে বাঁচতে হবে । আমি জানি তোমরা কেউ বন্ধুর টাকা চুরি করবে না । এত খারাপ ছেলে তোমাদের মধ্যে কেউ নেই । কিন্তু কুড়িয়ে পেতেই পারো । তাই বলছি কেউ পেয়ে থাকলে দিয়ে দাও । তাতে তোমার সুনাম হবে ।

কেউ বলল, টিফিন খেতে দশটাকা এনেছি , কেউ বলল মা দশটাকা দিয়েছে, কেউ বলল আমাকে রোজ দশটাকা করে দেয় । জনা চল্লিশেক ছাত্রের মধ্যে বাইশ জনকে পাওয়া গেল যাদের কাছে দশটাকার নোট আছে । সকলকে টাকাগুলো বের করতে বললাম ।

বনমালী বলল, টাকাগুলো একবার দেখব স্যার ?

- দেখতে পারিস । কিন্তু দেখে কি লাভ, সব দশটাকার নোট একরকম দেখতে ।

- না স্যার , চিনতে পারব । নাম লেখা আছে ।

এবার বনমালীকেই সন্দেহ হয়, হারিয়ে যাবে বলেই কী টাকায় নাম লিখে রেখেছিস ?

- আমি স্যার টাকা পেলেই নাম লিখি ।

- বদ অভ্যাস । টাকায় নাম লিখলে টাকাটা তাড়াতাড়ি নষ্ট হয় । কেন লিখিস ?

- মেসোমশাই বলেছে টাকা একবার হাত থেকে বেরিয়ে গেলে আর কখনও ফেরত আসে না । দশ বছর ধরে অনেক টাকায় তিনি নাম লিখেছেন, আজ পর্যন্ত একটা টাকাও ফেরত আসেনি । আমিও পরীক্ষা করে দেখছি ।

- ফেরত পেয়েছিস কখনও ?

- না স্যার ।

- সকালে কী খেয়ে এসেছিস ?

- কিছু না ।

- কেন ?

- মা রাতের খাবার যে বাড়ি থেকে আনে তারা বেড়াতে গেছে । রাতের খাবার থেকে বাঁচিয়ে সকালের জন্যে রেখে দেয় । রাতে মুড়ি খেয়েছিলাম । সকালে ঘুম থেকে উঠেই মা কাজে বেরিয়ে যায় । রান্নার সময় পায় না । আমাকে তাই দশটাকা দিয়েছিল টিফিন খেতে ।

- বাবা কী করেন ?

- নেই স্যার ।

- সেকি, কী হয়েছিল !

- মারা যায়নি স্যার , চলে গেছে ।

- কোথায় ?

- জানি না ।

এরপর আর কথা বাড়ানো যায় না । বাধ্য হয়ে প্রসঙ্গ বদলাই, তোরা কয় ভাইবোন ?

-আমি একা ।

খারাপ লাগে । টাকাটা চুরি গেছে বুঝতে পারি অভিজ্ঞতা থেকে । ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা আছে বলেও মনে হচ্ছে না । পেলে এতক্ষণে পেতাম । দশটা টাকা দিয়ে সাহায্য করব সে উপায়ও নেই । হেড স্যারের বারন । ইতিপূর্বে এ ধরনের ঘটনায় অপ্রীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে । ষষ্ঠ শ্রেণির একটি ছাত্র একজন শিক্ষককে বোকা বানিয়ে দশটাকা আদায় করে ছুটির পর সোজা চলে যায় সাইবার কাফে, ভিডিও গেম খেলতে । সম্প্রতি ভিডিও গেমের নেশায় ধরেছিল তার । বাড়ি থেকে জানতে পেরে হাতে নগদ টাকা দেওয়া বন্ধ করে । সেদিন বাড়ি ফিরতে দেরি দেখে ছাত্রটির বাবার সন্দেহ হয়, খুঁজতে খুঁজতে তিনি পৌঁছে যান সাইবার কাফেতে । জেরার মুখে ছেলেটি সত্যি কথা বলে দেয় । পরদিন ভদ্রলোক প্রধান শিক্ষকের কাছে অভিযোগ জানান । প্রধান শিক্ষক সমস্ত টিচার্সদের এক জায়গায় স্পষ্ট নির্দেশ দেন, কোন ছাত্রের সাহায্য প্রয়োজন মনে হলে আমাকে জানাবেন । স্কুল তাকে সাহায্য করবে । ছাত্রদের সাহায্য করার মত টাকা স্কুল ফান্ডে আছে । দয়া করে আপনারা কেউ দায়িত্ব নেবেন না ।

সাহায্য করার ইচ্ছাটা দমন করে ছাত্রদের উদ্দেশ্যে বললাম, তোরা সব কথা শুনলি । ওরা সত্যিই খুব গরীব । কাল রাত থেকে না খেয়ে আছে । তোদেরই এক বন্ধু খিদের জ্বালায় কষ্ট পাচ্ছে । নিশ্চয় তোদেরও খারাপ লাগছে । টিফিনে সবাই মিলে খুঁজে দেখবি । আমার বিশ্বাস খুঁজে পাওয়া যাবে ।

এসব কথা বলার অর্থ, টাকাটা যে নিয়েছে, ফেরত দেওয়ার আর একটা সুযোগ করে দেওয়া । যদি তার মধ্যে সামান্য হলেও সহানুভূতির জন্ম নেয় ।


দুই

বনমালীর নাম লেখা টাকাটায় চোখ পড়তে খুশি হই । আমার উদ্দেশ্য সফল হয়েছে । টাকাটা পাওয়া গেছে শেষ পর্যন্ত । বনমালীর মেসোমশায়ের ধারণা ভুল ।

অসম্ভব কাজটা কী করে সম্ভব হল জানাতে কৌতূহল হয় । টিফিন শেষ হতে তখনও মিনিট দশেক বাকি । ছেলেরা সামনের মাঠে হুল্লোড় করে বেড়াচ্ছে । নাইনের ফার্স্ট বয় অভিজিৎ টিফিনে বাইরে বেরোয় না, হাই বেঞ্চে মাথা রেখে বিশ্রাম নেয়। ওকে জিজ্ঞাসা করলে সত্যটা জানা যাবে ।

হাঁটতে হাঁটতে নাইনের ঘরে যাই । একজন নয়, আজ দু জন হাইবেঞ্চে মাথা দিয়ে শুয়ে আছে । বনমালীকে দেখব ভাবিনি । টিফিনে ঘরে থাকার ছেলে ও নয় । তবে কী শরীর খারাপ ?

অসময়ে আমাকে ঢুকতে দেখে ধড়মড় করে উঠে দাঁড়ায় দুজন । বসতে বলি ওদের । বনমালীকে জিজ্ঞাসা করি, ঘরে কেন ? শরীর খারাপ ?

- না স্যার , এমনিই ।

- টাকাটা কোথায় পেলি ?

- পাইনি তো স্যার ।

- পাইনি মানে !

বনমালীর হয়ে অভিজিৎ উত্তর দেয় , টিফিনে কয়েকজন মিলে অনেক খুঁজেছি, পাওয়া যায়নি । আমার মনে হয় টাকাটা কেউ চুরি করেছে । মাঝে মাঝেই ক্লাস থেকে কিছু না কিছু হারাচ্ছে । একটা কিছু ব্যবস্থা করুন স্যার ।

- দেখছি । চোরের সাতদিন গৃহস্থের একদিন, ধরা তাকে পড়তেই হবে । বাইরের ছেলে ঢুকছে নাতো ?

- না স্যার , কেউ না কেউ ক্লাসে আমরা সবসময় থাকি । আমাদের ভেতর থেকেই কেউ...

- হারিয়েও যেতে পারে । হয়ত বাইরে বেরিয়ে ছিল জল খেতে কিংবা টয়লেট করতে, পকেট থেকে তখন পড়ে গেছে ।

- না স্যার পড়েনি । পকেটে আমি টাকা রাখি না , ব্যাগেই রাখি ।

- আজ ভুল করে রেখেছিলিস হয়ত । দেখত এটা চিনতে পারিস কিনা ?

আলাদা করে রাখা দশ টাকার নোটটা বুক পকেট থেকে বের করে ওর সামনে ধরি । এক নজর দেখেই চিনতে পারে । জিজ্ঞাসা করে, কোথায় পেলেন স্যার ?

- সেকথা পরে জানবি, আগে কিছু খেয়ে আয় ।

অনাবিল হাসিতে ভরে ওঠে বনমালীর মুখ । সামান্য মিথ্যাচারের বিনিময়ে পাওয়া এই খুশিতে আমিও খুশি । স্কুলে ছাত্রকে সাহায্য করা অপরাধ হতে পারে, হারানো অর্থ ফেরত দেওয়ার মধ্যে তো কোন অন্যায় নেই ! আরও একটু অভিনয় করতে ইচ্ছে হয় । বনমালীকে বলি , ফেরত আসে তাহলে ! তোর মেসোমশাইকে বলিস...

বনমালী ঘাড় কাত করে সম্মতি জানিয়ে এক ছুটে বেরিয়ে যায় । কে জানে ক্যানটিনে তার জন্যে শেষ বেলায় কী পড়ে আছে !

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ