সব দোষ সন্ধ্যাটার, এমন নিঃসঙ্গ, নিশ্চুপ আর ছায়াচ্ছন্ন হয়ে উঠলো আচমকা, জানালা দিয়ে খোলা মাঠের দিকে তাকিয়ে থাকা লোকটার চোখে ঝিমুনি নামতে শুরু করলো।
সন্ধ্যার প্রচ্ছায়া অত্যাশ্চর্য হলুদাভ রঙের এক নিমিষ পেখম তুলে আঁধার হওয়ার আগমুহূর্তেই দরজায় একটা কিম্ভূতে মুখ দেখে ধড়াস করে উঠলো সে।
কিশোরী মেয়েটি মুখ থেকে মুখোশ নামিয়ে বললো, মা পাঠাইছিলো আপনের জানি কী সব কামকাজ, মাঠে আইসা খেলতে নাইমা ভুইলা গেছিলাম।
এবার অপরাধবোধের শরমে আর ভয়ে মেয়েটি জবুথবু হয়ে উঠতে থাকে।
লোকটিরও এই বয়সী একটি কন্যা আছে। বদলির চাকরিতে মফস্বলের এই নির্জন কোয়ার্টারে দুদিনেই লোকটির হাঁপ ধরে গেছে, সন্তানদের স্কুল বদলে সব গুছিয়ে কবে যে আসে তার পরিবার।
তুমি এই মুখোশ কোথায় পেলে?
এইবার মেয়েটি কাঠ হয়ে যায়, তার পলকহীন চোখে কাঁপন ধরে...।
এদিকে এসো...।
মেয়েটি নড়ে না। লোকটি উঠে মেয়েটির হাতের মুখোশটি ধরে, সম্ভবত নেপালের মুখোশ... লোকটি সেখানে গিয়ে এ-জাতীয় অনেক মুখোশ দেখেছে। আচমকা দেখায় যেমন কিম্ভূত লেগেছিলো তা নয়, বরং উল্টো, অদ্ভুত সব কারুকাজের জাদু আছে এর মধ্যে।
লোকটিকে তাজ্জব করে দিয়ে মেয়েটি সজোরে মুখোশটি আঁকড়ে থাকে -- এইটা আমার।
মেয়েটার মুখ থেকে ভয়-ছায়া অপসৃত হয়ে তার এই কঠিনতায় লোকটি প্রথমে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে।
কিছু সময় অতিবাহিত হলে লোকটি নিজেকে ধাতস্থ করে মেয়েটির মুখে কন্যার আদল খুঁজতে থাকে। কী কী কাজ পারিস তুই... ?
ইত্যাকার কথার মাঝেই মেয়েটি তার অদ্ভুত আচরণে যেন কোথাও রাখলে লোকটি মুখোশটি নিয়ে যাবে, মুখের মধ্যেই তা লাগিয়ে ঘর ঝাঁট দিতে থাকে... সান্ধ্য আলোয় পাক খেয়ে খেয়ে নিজে নিজে বিড়বিড় করে -- বিবি সাইবরা দেওয়ালে হেলায় ফালায়া রাখছিলো। কেউ চাইয়াও দেখতো না। আমি গেলেই মুখোশটা কী খুশি হয়। সে আমারে দেখতো... ডাকতো... য্যান কইতো -- আমি তোমার কাছে যামু... আমারও ওর দিকে তাকাইলে শইল্যে মনে কী যে বিদ্যুৎ খেলতো... ক্যান যে খেলতো।
কার কথা বলছে মেয়েটি?
সান্ধ্য বুনো বাতাসের আচ্ছন্নতার মধ্যেই লোকটি অনুভব করতে পারে মেয়েটি মুখোশের গল্প করছে।
তুই এটা চুরি করেছিস?
আমার জিনিস আমি ক্যান চুরি করবো? মেয়েটি টেবিলের বইপত্তর গোছাতে থাকে। আজব এক পরিবেশ তৈরি হয়েছে। বসন্ত শেষ হতে থাকা এক হুহু বাতাসের সন্ধ্যা পেরুনো আবহে একটি মেয়ে মুখে মুখোশ লাগিয়ে তার ঘরে বিচরণ করছে। না... না... ব্যাপারটাকে কোনোভাবেই অস্বাভাবিকভাবে নেয়ার প্রশ্রয় পরিবেশকে দেয়া যাবে না... ভাবতে ভাবতে লোকটি নিজেকে লুকাতে ‘ইডিপাস’ বিষয়ক বইয়ে ডুব দেয়।
রাজা অয়দিপাউস ভূপাতিত হয়ে আছে শূন্যতার সামনে -- যদি এই সত্য হবে, আমার জন্মের আগেই নির্ধারিত হয়ে থাকবে আমার নিয়তি, আমার জন্ম হবে, আমি আমার পিতাকে হত্যা করবো, নিজ মা-কে না চিনে স্ত্রীরূপে গ্রহণ করবো; বলুন, এই পাপের দায় আমাকে নিতে হবে কেন? ঈশ্বর যে খেলার পুতুল আমাকে বানিয়েছেন, সেই খেলার প্রায়শ্চিত্ত আমাকে কেন ভোগ করতে হবে? আমার মতোন একজন সামান্য মানুষের সামনে ঈশ্বরের মতোন প্রবল শক্তি বিপন্ন হবেন?
ফাজলামো? বিড়বিড় করে লোকটি মুখ তুলতেই দেখে এক অদ্ভুত ভঙ্গি নিয়ে মুখোশটি তার দিকে তাকিয়ে আছে।
মেয়েটি নিজের মুখের মুখোশ সম্পর্কে তখন বিস্মৃত... তার চোখ লোকটার দিকে তাকিয়ে জানতে চাইছিল এর পর কী তার কাজ?
সন্ধ্যা প্রগাঢ় হতে থাকে। মাঠ থেকে ধেয়ে আসা বাতাস জানালা বেয়ে কর্মক্লান্ততায় মেয়েটির ওড়না খসা অবস্থা সেফটিপিন দিয়ে আটকে রাখা ফ্রক বুকের অর্গল উড়িয়ে নিয়ে যায়... সে মেয়েটির চোখ দেখবে কী করে? মুখোশটা এইবার তাকে টানছে... না মুখোশ না... তারও নিচের কণ্ঠের নিচের ছেঁড়া আধছেঁড়া কাপড়ের উপচে ক্ষুদে স্তনের অনেকটাই... নিজের মধ্যে দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠা আগুন নেভাতে সে মেয়েটির ওপর ঝাঁপ দেয়।
দুই
লোকটির পরিবার এসেছে। দুই ভাইবোনের হৈচৈ, স্ত্রীর হাঁকডাকে বাড়িটি যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে। সেই সন্ধ্যায় যে লোকটি কিশোরী মেয়েটির ওপর পৈশাচিক হামলায় নিজেকে ধাবিত করেছিল, তাই নয়, ছিন্নভিন্ন মুখোশের নিচে যন্ত্রণায় আর্তনাদরত মেয়েটি যখন বলছিলো, মা-রে কইয়া দিমু... বেবাকরে কইয়া দিমু... তখন শরীর নিভন্ত লোকটির মধ্যে ভয়-ক্রোধ মিশেল হয়ে কোত্থেকে যে এই শক্তি এসেছিল, মেয়েটিকে বালিশ চাপা দিয়েও নিশ্চিত হতে লোকটি তার গলায় বঁটি চালিয়েছিলো। এরপর জীবনে একটি পশু হত্যাও না-করা লোকটি পরম ঠা-া মাথায় কোদাল দিয়ে বাড়ির পেছনটা খুঁড়ে তার মধ্যে মেয়েটিকে চাপা দিয়ে ঘরে ফিরে বাথরুম থেকে বালতি ভর্তি পানি এনে নিখুঁতভাবে সব চিহ্ন, রক্ত পরিষ্কার করতে করতে বিড়বিড় করছিলো, আমার কী দোষ? ইদিপাসই পারেনি নিয়তির সাথে... আমি কোন ছার। এসব আমি করতে পারি? নিজের ইচ্ছায়? আমার যা স্বভাব, আমার শত্রুও তা বলতে পারবে?
দুমড়ানো মুখোশটিও মেয়েটির নিচে মাটিচাপা ছিল।
রাতে এসেছিলো মেয়েটির মা, খোঁজ নিতে উল্টো ধমক দিয়েছিলো লোকটি, তোমাদের কথার ঠিক নেই, বলেছিলে একটি মেয়ে পাঠাবে।
কাঁদতে কাঁদতে চলে গেছে রমণী।
পরদিন ঘাস-মাটি ভালো করে বিন্যস্ত করে লোকটি ওই জায়গার ওপর একটি গোলাপগাছ লাগিয়ে দিয়েছিলো।
চক্রাকারে সকালগুলো আসে... রাত্রিগুলো যায়... ভেতরটা হিম হয়ে ওই সন্ধ্যা সামনে এলে লোকটা ঝেড়ে ফেলে... সব ওই নির্জন সন্ধ্যার ভ্রম... ওই লোকটি আমি ছিলাম না... তখন তো আমি একটি বই পড়ছিলাম... ওটা ওই বইয়ে পঠিত কোনো কাহিনি।
ক্রমশ প্রাত্যহিক কাজে লোকটি ডুবে যেতে তাকে। এর মধ্যেই তার কন্যাটি এক সময় মরণ অসুখে পড়ে। মফস্বল-রাজধানী সব ডাক্তার দেখিয়ে লোকটি হাল ছেড়ে বেডরুমের মধ্যে শুয়ে থাকা শীর্ণ থেকে শীর্ণকায় হতে থাকা মেয়েটির দিকে তাকিয়ে স্তব্ধ কান্নায় গুমরে গুমরে উঠতে থাকে।
কিছু পরে অকস্মাৎ কন্যাটি বেডরুমের পেছন জানালার দিকে তাকিয়ে লোকটির অন্তরাত্মাকে কাঁপিয়ে দিয়ে বলে, বাবা দেখো, কী সুন্দর টকটকে গোলাপ ফুটেছে, এর পাপড়িগুলো যখন ঝরে যাবে, আমি মরে যাবো।
অধঃপাতে তলাতে থাকে লোকটি। আত্মসম্মোহনে বুঁদ হয়ে মেয়েটির দিকে অসহায় তাকিয়ে থাকা লোকটির চক্ষুর ছিলা টান দিয়ে ওঠে। স্ত্রী ক্রমাগত নামাজে ক্রন্দনরত... ভাইটি মৃতের মতো ঘরে হাঁটাচলা করে। এর মধ্যে যেন-বা শব্দ, অথবা ফেনিয়ে উঠতে থাকা জলের হিসহিসানির মধ্যে লোকটি বিস্ফারিত চোখে দেখে, ঠক ঠক শব্দ তুলে ঘরে একজন পুলিশ এসে দাঁড়িয়েছে। লোকটি বোবার মতো তাকিয়ে থাকে।
কিরে? ভূত দেখছিস নাকি? আরে আমি... নিজের বন্ধুকে চিনছিস না?
তুই এখানে? তোতলাতে থাকে লোকটি।
যা হয়, আবার ট্রান্সফার, তুই তো জানিস, আমি আমার বাপেরেও ছাড়ি না, দেখি কত ট্রান্সফার করে, কোথায় নিয়ে ফেলে।
নাস্তা হাতে এগিয়ে আসে স্ত্রী।
তিন
এক সন্ধ্যায় প্রতিবেশিনীর কথায় ছেলেকে নিয়ে স্ত্রী কোথায় যেন তাবিজ আনতে গেছে। সমস্ত ঘরে আঁধারের ঘূর্ণায়মান অবস্থার মধ্যে লোকটির আবছায়া চোখে পড়ে কন্যাটি বিছানায় নেই।
কম্পিত হাতে বাতি জ্বালাতেই লোকটি বিস্ময়ে কম্পনে পাথরে রূপান্তরিত হতে থাকে। দেখে, দরজায় সেই মুখোশ পরা বালিকাটি এসে দাঁড়িয়েছে... লোকটির সমস্ত অস্তিত্বে পাক খায়, মা-রে কইয়া দিমু... বেবাকরে কমু।
হিতাহিত জ্ঞানশূন্য লোকটি মোবাইল কানে নেয়, পুলিশ বন্ধুকে বলে, আমি একটা বই পড়ছিলাম এক সন্ধ্যায়, সেখানে একটা খুন হয়েছিলো... সেই খুনি আজ বই থেকে বেরিয়ে এসে আমার মেয়েকে বিছানা থেকে উঠিয়ে বঁটি দিয়ে খুন করে আমার বাড়ির পেছনে মাটিচাপা দিয়েছে... ও আমাকে মারতে এসেছে, তুই আমাকে বাঁচা।
কিছুক্ষণ পরই পরিচিত হাসির শব্দে লোকটির হুঁশ ফিরে আসে... মুখ থেকে মুখোশ সরিয়ে কন্যাটি ঝরঝরে সুস্থ কণ্ঠে বলে -- এসব কী বলছো বাবা?
তুই এই মুখোশ পেলি কোথায়?
বিকেলে বৃষ্টি হলো না? এর পরে জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি গোলাপ গাছের নিচে মুখোশটা আমার দিকে তাকিয়ে আছে, আমাকে ডাকছে... বাবা... ওটা মুখে নিয়ে তোমার কাছে আসতে আসতেই জানো আমার সব ব্যথা সেরে গেছে... ভয় পেয়ো না বাবা, দেখো তুমি, আমি আর মরবো না...।
ততক্ষণে পুলিশ বন্ধুর নির্দেশে বাড়ির পেছনের মাটি খোঁড়া শুরু হয়ে গেছে।
সন্ধ্যার প্রচ্ছায়া অত্যাশ্চর্য হলুদাভ রঙের এক নিমিষ পেখম তুলে আঁধার হওয়ার আগমুহূর্তেই দরজায় একটা কিম্ভূতে মুখ দেখে ধড়াস করে উঠলো সে।
কিশোরী মেয়েটি মুখ থেকে মুখোশ নামিয়ে বললো, মা পাঠাইছিলো আপনের জানি কী সব কামকাজ, মাঠে আইসা খেলতে নাইমা ভুইলা গেছিলাম।
এবার অপরাধবোধের শরমে আর ভয়ে মেয়েটি জবুথবু হয়ে উঠতে থাকে।
লোকটিরও এই বয়সী একটি কন্যা আছে। বদলির চাকরিতে মফস্বলের এই নির্জন কোয়ার্টারে দুদিনেই লোকটির হাঁপ ধরে গেছে, সন্তানদের স্কুল বদলে সব গুছিয়ে কবে যে আসে তার পরিবার।
তুমি এই মুখোশ কোথায় পেলে?
এইবার মেয়েটি কাঠ হয়ে যায়, তার পলকহীন চোখে কাঁপন ধরে...।
এদিকে এসো...।
মেয়েটি নড়ে না। লোকটি উঠে মেয়েটির হাতের মুখোশটি ধরে, সম্ভবত নেপালের মুখোশ... লোকটি সেখানে গিয়ে এ-জাতীয় অনেক মুখোশ দেখেছে। আচমকা দেখায় যেমন কিম্ভূত লেগেছিলো তা নয়, বরং উল্টো, অদ্ভুত সব কারুকাজের জাদু আছে এর মধ্যে।
লোকটিকে তাজ্জব করে দিয়ে মেয়েটি সজোরে মুখোশটি আঁকড়ে থাকে -- এইটা আমার।
মেয়েটার মুখ থেকে ভয়-ছায়া অপসৃত হয়ে তার এই কঠিনতায় লোকটি প্রথমে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে।
কিছু সময় অতিবাহিত হলে লোকটি নিজেকে ধাতস্থ করে মেয়েটির মুখে কন্যার আদল খুঁজতে থাকে। কী কী কাজ পারিস তুই... ?
ইত্যাকার কথার মাঝেই মেয়েটি তার অদ্ভুত আচরণে যেন কোথাও রাখলে লোকটি মুখোশটি নিয়ে যাবে, মুখের মধ্যেই তা লাগিয়ে ঘর ঝাঁট দিতে থাকে... সান্ধ্য আলোয় পাক খেয়ে খেয়ে নিজে নিজে বিড়বিড় করে -- বিবি সাইবরা দেওয়ালে হেলায় ফালায়া রাখছিলো। কেউ চাইয়াও দেখতো না। আমি গেলেই মুখোশটা কী খুশি হয়। সে আমারে দেখতো... ডাকতো... য্যান কইতো -- আমি তোমার কাছে যামু... আমারও ওর দিকে তাকাইলে শইল্যে মনে কী যে বিদ্যুৎ খেলতো... ক্যান যে খেলতো।
কার কথা বলছে মেয়েটি?
সান্ধ্য বুনো বাতাসের আচ্ছন্নতার মধ্যেই লোকটি অনুভব করতে পারে মেয়েটি মুখোশের গল্প করছে।
তুই এটা চুরি করেছিস?
আমার জিনিস আমি ক্যান চুরি করবো? মেয়েটি টেবিলের বইপত্তর গোছাতে থাকে। আজব এক পরিবেশ তৈরি হয়েছে। বসন্ত শেষ হতে থাকা এক হুহু বাতাসের সন্ধ্যা পেরুনো আবহে একটি মেয়ে মুখে মুখোশ লাগিয়ে তার ঘরে বিচরণ করছে। না... না... ব্যাপারটাকে কোনোভাবেই অস্বাভাবিকভাবে নেয়ার প্রশ্রয় পরিবেশকে দেয়া যাবে না... ভাবতে ভাবতে লোকটি নিজেকে লুকাতে ‘ইডিপাস’ বিষয়ক বইয়ে ডুব দেয়।
রাজা অয়দিপাউস ভূপাতিত হয়ে আছে শূন্যতার সামনে -- যদি এই সত্য হবে, আমার জন্মের আগেই নির্ধারিত হয়ে থাকবে আমার নিয়তি, আমার জন্ম হবে, আমি আমার পিতাকে হত্যা করবো, নিজ মা-কে না চিনে স্ত্রীরূপে গ্রহণ করবো; বলুন, এই পাপের দায় আমাকে নিতে হবে কেন? ঈশ্বর যে খেলার পুতুল আমাকে বানিয়েছেন, সেই খেলার প্রায়শ্চিত্ত আমাকে কেন ভোগ করতে হবে? আমার মতোন একজন সামান্য মানুষের সামনে ঈশ্বরের মতোন প্রবল শক্তি বিপন্ন হবেন?
ফাজলামো? বিড়বিড় করে লোকটি মুখ তুলতেই দেখে এক অদ্ভুত ভঙ্গি নিয়ে মুখোশটি তার দিকে তাকিয়ে আছে।
মেয়েটি নিজের মুখের মুখোশ সম্পর্কে তখন বিস্মৃত... তার চোখ লোকটার দিকে তাকিয়ে জানতে চাইছিল এর পর কী তার কাজ?
সন্ধ্যা প্রগাঢ় হতে থাকে। মাঠ থেকে ধেয়ে আসা বাতাস জানালা বেয়ে কর্মক্লান্ততায় মেয়েটির ওড়না খসা অবস্থা সেফটিপিন দিয়ে আটকে রাখা ফ্রক বুকের অর্গল উড়িয়ে নিয়ে যায়... সে মেয়েটির চোখ দেখবে কী করে? মুখোশটা এইবার তাকে টানছে... না মুখোশ না... তারও নিচের কণ্ঠের নিচের ছেঁড়া আধছেঁড়া কাপড়ের উপচে ক্ষুদে স্তনের অনেকটাই... নিজের মধ্যে দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠা আগুন নেভাতে সে মেয়েটির ওপর ঝাঁপ দেয়।
দুই
লোকটির পরিবার এসেছে। দুই ভাইবোনের হৈচৈ, স্ত্রীর হাঁকডাকে বাড়িটি যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে। সেই সন্ধ্যায় যে লোকটি কিশোরী মেয়েটির ওপর পৈশাচিক হামলায় নিজেকে ধাবিত করেছিল, তাই নয়, ছিন্নভিন্ন মুখোশের নিচে যন্ত্রণায় আর্তনাদরত মেয়েটি যখন বলছিলো, মা-রে কইয়া দিমু... বেবাকরে কইয়া দিমু... তখন শরীর নিভন্ত লোকটির মধ্যে ভয়-ক্রোধ মিশেল হয়ে কোত্থেকে যে এই শক্তি এসেছিল, মেয়েটিকে বালিশ চাপা দিয়েও নিশ্চিত হতে লোকটি তার গলায় বঁটি চালিয়েছিলো। এরপর জীবনে একটি পশু হত্যাও না-করা লোকটি পরম ঠা-া মাথায় কোদাল দিয়ে বাড়ির পেছনটা খুঁড়ে তার মধ্যে মেয়েটিকে চাপা দিয়ে ঘরে ফিরে বাথরুম থেকে বালতি ভর্তি পানি এনে নিখুঁতভাবে সব চিহ্ন, রক্ত পরিষ্কার করতে করতে বিড়বিড় করছিলো, আমার কী দোষ? ইদিপাসই পারেনি নিয়তির সাথে... আমি কোন ছার। এসব আমি করতে পারি? নিজের ইচ্ছায়? আমার যা স্বভাব, আমার শত্রুও তা বলতে পারবে?
দুমড়ানো মুখোশটিও মেয়েটির নিচে মাটিচাপা ছিল।
রাতে এসেছিলো মেয়েটির মা, খোঁজ নিতে উল্টো ধমক দিয়েছিলো লোকটি, তোমাদের কথার ঠিক নেই, বলেছিলে একটি মেয়ে পাঠাবে।
কাঁদতে কাঁদতে চলে গেছে রমণী।
পরদিন ঘাস-মাটি ভালো করে বিন্যস্ত করে লোকটি ওই জায়গার ওপর একটি গোলাপগাছ লাগিয়ে দিয়েছিলো।
চক্রাকারে সকালগুলো আসে... রাত্রিগুলো যায়... ভেতরটা হিম হয়ে ওই সন্ধ্যা সামনে এলে লোকটা ঝেড়ে ফেলে... সব ওই নির্জন সন্ধ্যার ভ্রম... ওই লোকটি আমি ছিলাম না... তখন তো আমি একটি বই পড়ছিলাম... ওটা ওই বইয়ে পঠিত কোনো কাহিনি।
ক্রমশ প্রাত্যহিক কাজে লোকটি ডুবে যেতে তাকে। এর মধ্যেই তার কন্যাটি এক সময় মরণ অসুখে পড়ে। মফস্বল-রাজধানী সব ডাক্তার দেখিয়ে লোকটি হাল ছেড়ে বেডরুমের মধ্যে শুয়ে থাকা শীর্ণ থেকে শীর্ণকায় হতে থাকা মেয়েটির দিকে তাকিয়ে স্তব্ধ কান্নায় গুমরে গুমরে উঠতে থাকে।
কিছু পরে অকস্মাৎ কন্যাটি বেডরুমের পেছন জানালার দিকে তাকিয়ে লোকটির অন্তরাত্মাকে কাঁপিয়ে দিয়ে বলে, বাবা দেখো, কী সুন্দর টকটকে গোলাপ ফুটেছে, এর পাপড়িগুলো যখন ঝরে যাবে, আমি মরে যাবো।
অধঃপাতে তলাতে থাকে লোকটি। আত্মসম্মোহনে বুঁদ হয়ে মেয়েটির দিকে অসহায় তাকিয়ে থাকা লোকটির চক্ষুর ছিলা টান দিয়ে ওঠে। স্ত্রী ক্রমাগত নামাজে ক্রন্দনরত... ভাইটি মৃতের মতো ঘরে হাঁটাচলা করে। এর মধ্যে যেন-বা শব্দ, অথবা ফেনিয়ে উঠতে থাকা জলের হিসহিসানির মধ্যে লোকটি বিস্ফারিত চোখে দেখে, ঠক ঠক শব্দ তুলে ঘরে একজন পুলিশ এসে দাঁড়িয়েছে। লোকটি বোবার মতো তাকিয়ে থাকে।
কিরে? ভূত দেখছিস নাকি? আরে আমি... নিজের বন্ধুকে চিনছিস না?
তুই এখানে? তোতলাতে থাকে লোকটি।
যা হয়, আবার ট্রান্সফার, তুই তো জানিস, আমি আমার বাপেরেও ছাড়ি না, দেখি কত ট্রান্সফার করে, কোথায় নিয়ে ফেলে।
নাস্তা হাতে এগিয়ে আসে স্ত্রী।
তিন
এক সন্ধ্যায় প্রতিবেশিনীর কথায় ছেলেকে নিয়ে স্ত্রী কোথায় যেন তাবিজ আনতে গেছে। সমস্ত ঘরে আঁধারের ঘূর্ণায়মান অবস্থার মধ্যে লোকটির আবছায়া চোখে পড়ে কন্যাটি বিছানায় নেই।
কম্পিত হাতে বাতি জ্বালাতেই লোকটি বিস্ময়ে কম্পনে পাথরে রূপান্তরিত হতে থাকে। দেখে, দরজায় সেই মুখোশ পরা বালিকাটি এসে দাঁড়িয়েছে... লোকটির সমস্ত অস্তিত্বে পাক খায়, মা-রে কইয়া দিমু... বেবাকরে কমু।
হিতাহিত জ্ঞানশূন্য লোকটি মোবাইল কানে নেয়, পুলিশ বন্ধুকে বলে, আমি একটা বই পড়ছিলাম এক সন্ধ্যায়, সেখানে একটা খুন হয়েছিলো... সেই খুনি আজ বই থেকে বেরিয়ে এসে আমার মেয়েকে বিছানা থেকে উঠিয়ে বঁটি দিয়ে খুন করে আমার বাড়ির পেছনে মাটিচাপা দিয়েছে... ও আমাকে মারতে এসেছে, তুই আমাকে বাঁচা।
কিছুক্ষণ পরই পরিচিত হাসির শব্দে লোকটির হুঁশ ফিরে আসে... মুখ থেকে মুখোশ সরিয়ে কন্যাটি ঝরঝরে সুস্থ কণ্ঠে বলে -- এসব কী বলছো বাবা?
তুই এই মুখোশ পেলি কোথায়?
বিকেলে বৃষ্টি হলো না? এর পরে জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি গোলাপ গাছের নিচে মুখোশটা আমার দিকে তাকিয়ে আছে, আমাকে ডাকছে... বাবা... ওটা মুখে নিয়ে তোমার কাছে আসতে আসতেই জানো আমার সব ব্যথা সেরে গেছে... ভয় পেয়ো না বাবা, দেখো তুমি, আমি আর মরবো না...।
ততক্ষণে পুলিশ বন্ধুর নির্দেশে বাড়ির পেছনের মাটি খোঁড়া শুরু হয়ে গেছে।
4 মন্তব্যসমূহ
এই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।
উত্তরমুছুনখুব ভালো লেগেছে, রুপক গল্পটি ! পাপ বাপকেও ছাড়ে না !
উত্তরমুছুননাসরীন খুব পছন্দ হলো গল্প। পড়লাম। (লোচন)
উত্তরমুছুনগল্পটা খুব ভালো লাগলো আপা, আসলে সকলেই নিয়তির হাতের ক্রীড়নক, সকলে মানুষ হয়ে উঠতে পারে না। বিপাশা
উত্তরমুছুন