টেবিলে ভাত বেড়ে পাশে দাঁড়িয়েছে পিয়া। কিছু বলবে। অফিস বেরুবার মুখে কিছু না কিছু রোজ বায়না থাকবেই। বললো,
-ক’দিন থেকেই ঘরের মেঝেটা খুব ঘামছে।
মাথায় ফ্যান পাঁচে ঘুরছে। আগজ্বলন্ত ভাত। ফুঁ দিচ্ছি। উত্তর দেওয়ার সময় নেই।
ফের বললো- ঘরে দোরে খুব পিঁপড়ে উঠছে।
ওর হাতে ভাঁজ করা খবরের কাগজ। বাতাস করছে।
গলা গলিয়ে গলা ভাত গলগল বেগে ঢোকাবার চেষ্টা করছি। আর উশ্ আশ্ করছি।
-এ বছর বন্যা হবে।
কান তুচ্ছ, একমাত্র মুখগহবর ছাড়া শরীরের কোনো ছিদ্রই কাজ করছে না।
-মাসখানেকের মতো চাল ডাল, তেল, নুন কিনে রাখা দরকার ..
একথালা ধোঁয়া ওঠা ভাত, একশো ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে মাছের ঝোল, সাড়ে সাত মিনিট তিপ্পান্ন সেকেন্ড সময়। বউ সামলাবো না গলার আগুন? নইলে বাস টা-টা। অফিসেরব্যাগ এখনো অগোছালো। আজ রেমিট্যান্স (ক্যাশ সেন্টার বহরমপুর থেকে ক্যাশ আনা কিংবা পৌঁছে দেওয়া) আছে। হেডক্যাশিয়ারবাবু পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন, রেমিট্যান্স করতে পারবেন না। শেখবাগানে ডাকাতের মাঠ পেরিয়ে জান হাতে আসতে তিনি রাজি নন।
খাদ্যঠাসা কণ্ঠনালি পেরিয়ে বৌ ঠেকানো হুম, হাম শব্দ অভ্যাস মতো বেরিয়ে আসছে।, যার কিছুই মানে হয় না। বিরক্ত পিয়া বেরুবার মুখে ফর্দখানা বুকপকেটে গুঁজে দিয়ে বললে – দয়া করে মুদিখানায় এটা দিয়ে যেও।
ব্যাঙ্কে ঢুকতে না ঢুকতে মাষ্টারমশায়রা দল বেঁধে হা হা ভিখিরির মতো ঢুকে পড়বেন। স্ট্রংরুমে সেফ (টাকা রাখার সিন্দুক )খালি, ভাঁড়ে মা ভবানি। এর বেশি বলতে হলে বৌকে অফিসের ‘মে আই হেল্প য়ু’ কাঊন্টারে এসে দাঁড়াতে হবে। ছেলেদুটো বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে। বাবা চলে যাবে, টা টা দেবে। ছেলে দুটোর জন্যে হাতনাড়াটা বরাদ্দ। ব্যাগের ভিতর একহাত ঢুকিয়ে চাবির হিসাব মেলাতে মেলাতে অন্যহাত বাতাসে তুলে নাড়তে নাড়তে রিকসায় উঠে বসলুম।
-টা টা।
পারিবারিক বিচ্ছেদ বেদনা হুমড়ি খেয়ে পড়ে থাকলো বাড়ির সামনের রাস্তায়। রোজই থাকে।
বিশ্বকর্মাপূজোয় এবার ঢাক আর মেঘের যুগলবন্দী শুরু হয়েছে সকাল থেকে। শারদীয়ার আগমনী। ঢাকের কাঠির সাথে পাল্লা দিয়ে কালো কালো মোষের মতো মেঘ, ঈশান থেকে পশ্চিমে আসা যাওয়া করছে। ডাকও কেমন অচেনা। গুরুগম্ভীর। গুরু গুরু গুর গুর গুড়ি গুড়ি হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে। আবার শুরু হচ্ছে। বিরাম দিচ্ছে না। মাঝে মাঝে ভয় পাওয়ানো হুংকার। একসময় ঢাকের কাঠি থামিয়ে মেঘের আওয়াজ জিতে গেলো। শুরু হলো বৃষ্টি। হাওয়া নেই। দমবন্ধ চরাচর । মেঘে মেঘে আকাশ ত্রিপলের মতো চেপে ধরেছে।
টানা দু’দিন বৃষ্টির পর তৃতীয় দিনেও যখন কামাই হলো না। বোঝা গেলো মুর্শিদাবাদের আকাশে দূর্যোগের ঘনঘটা।
তৃতীয়দিন বেলা তিনটে নাগাদ অফিসে খবর এলো সিঁড়ির ঘরে জল ঢুকছে। বাড়িতে বারো এবং আট বছরের দু’জন পুরুষ মানুষ, আর
তাদের স্নেহার্দ্র মাতাঠাকুরাণী! সাবক্যাশবুকের পাতায় দস্তখত দাঁড়িয়ে গেলো। ম্যানেজারবাবুর বাড়ি নদিয়া। মুর্শিদাবাদের ঘনঘটায় নদিয়ার
(২)
ভ্রুকুঞ্চন তখন ধনুকের আকার ধারন করছে।
বন্যার সাথে বঙ্গভূমির বছরকি চুক্তি। বন্যার সাথে উঠবোস, ঘর কর্না, জল ভাত। আক্ষরিক ভাবে বন্যার জল আর চোখের জলে ভাত ভিজিয়ে খাওয়া ফি-বছরের অভ্যেস। বছর দু’তিন হলো, এলাকায় বরষার বড়ো অনটন। কড়োকড়ো ভাত (শুকনো) খেয়ে কেটেছে মুর্শিদাবাদির। এবার পুষিয়ে দেবে, মনে হচ্ছে। তৃতীয়দিনেও বৃষ্টি মহানন্দে খেলে বেড়াচ্ছে, আকাশে বাতাসে। চতুর্থদিনে জল থৈ থৈ, একতলা ঘরে গলায় গলায় জল। সংসারের পাতাল প্রবেশ ঘটে গেলো। ডুব সাঁতার, চিৎ সাঁতারের কসরতে খাট, বিছানা, হাঁড়ি খুন্তি গ্যাস ওভেন সঙ্গে নিয়ে ত্রিপল টাঙানো ছাদে উঠে আসতে পেরেছি।
বাড়ি থেকে নামলেই ডুবজল ডুবজল।
বৃষ্টির তিন নম্বর রাত্রি থেকে ঘরবন্দী। অফিস যেতে পারলাম না। গলি পথ, বাঁকা পথ, বড়ো রাস্তা, জলরাস্তা হয়ে ঢেউ খেলছে। জল জল জ্বলুনি, জলের মাথায় চালুনি, চালের মাথায় ঘরনি। বলতে পারলে বলো, না পারলে কেরানি। কবে যেনো শিখেছিলুম।, জল ধাঁধা। জলে জলাকার। বন্যা। চতুর্দিকে বাস, লরি, ট্রেন, টেম্পো চলাচল স্তব্ধ। তিনদিন অফিস যেতে পারলাম না, রাম কামাই। এমন হাত পা বেঁধে মার খাওয়া কামাই, কতোকাল খাইনি, আহা! কী মজা, অফিস না যাওয়ার আগে ফ্যানাভাত খাওয়ার ছড়াছড়ি সময়। গলায় আটকে আটকে দম নিয়ে নিয়ে নামছে। সাত রাজার ধন এক মানিক ছুটি, আরাম করে বসে বসে খাচ্ছি।
আশঙ্কাকে ধন্যবাদ, অফিসের চাবি ছোড়ান অলিখিত ছেড়ে এসেছিলুম ম্যানেজার বাবুর দয়ায়! বৃষ্টি আর জলস্রোতে এমন তান্ডব বইছে, লঙ্গরখানার নৌকো ভিড়তে পারেনি। পাড়ায় এসেছিলো। ফিরে গেছে। সার বাঁধা পাকা ঘরের কাঁধে কাঁধে ঢেউ ভাঙছে। হালদার পাড়ায় দরমার কুঁড়েগুলো এক এক করে হেঁটমুণ্ডে ভেসে চলেছে। ঘরে থাকার এক জ্বালা, গরীব বৌএর কথা দিনরাত বাসি হচ্ছে, যতো বাসি হচ্ছে ততো দামি হচ্ছে। অফিসের ভারমুগ্ধ চাপে ভবিষ্যত বাণীর সেই চাল ডাল তেল নুন অফিসকয়েদির ঘরে ঢোকেনি। ভুলে গেছি। ফর্দ পকেটে থেকে থেকে যথাপূর্বং ভিজেপুড়ে হারিয়ে গেছে। ফিরে পেতে ডাইরি লেখানোর উপায়ও নেই। শহরখানা ডুবুডুবু থানা ভেসে যায়। হাফপেট খেয়ে, টেনেটুনে আর দু’তিন সাঁজ চলবে, অতঃপর হরিমটর! মা পিয়ার শূন্যভান্ড!! প্রসাদ কনিকা মাত্র যতো পারো বন্যার থৈ থৈ জল।
এ মতো দুর্যোগে দোলায়মান নৌকো চড়ে পুলিশ হাজ়ির। জেলাব্যপি দূর্ভিক্ষ, হাহাকার, নৈরাজ্য চলছে; হরিপাড়ার ডেপুটি ম্যানেজারের ঘরে থাকা মানায় না। জরুরিভিত্তিতে অফিসে জয়েন করতে হবে। কন্ট্রোলিং অফিসের অর্ডার। স্কুলশিক্ষকদের মাইনে, বৃদ্ধদের পেনশান, বন্যার্তমানুষের পঞ্চায়েত ফান্ড দিতেই হবে। অধমের বিনীত প্রশ্ন ছিলো – ম্যানেজারবাবুতো আছেন?
উত্তর –এখন পাঁচজন ম্যানেজারেও অবস্থা সামাল দিতে পারছে না।
মরিয়া হয়ে বলে উঠলুম – ঘরে চাল, ডাল, তেল, গ্যাস বাড়ন্ত। অনাহার শুরু হয়েছে। এখন সংসার ছেড়ে যাওয়া অসম্ভব।
শর্ত দিলুম, -হপ্তা দুয়েকের আহার্য ঘরে পৌঁছে দিলে যেতে পারি। মানে নিয়ে যেতে হবে।
পুলিশের ছোটো কিংবা কোনো একবাবু বলে উঠলেন– পৌঁছে যাবে।
পুলিশের কথা নাতো ব্যাঙের মাথা। কলজে নিংড়ানো রস তখন চোখের গোড়ায় এসে জমেছে। দম বন্ধ করে বললুম
-পৌঁছে দিলে তবে যাবো।
-পৌঁছে যাবে।
এর বেশি কিছু শুনতে পেলুম না। আমাকে তুলে নেওয়া হলো নৌকোয়। অকুল জল-যাত্রা! এক ত্রিপল খাটানো দ্বীপে তন্ডুল শূণ্য তিন প্রাণীকে ফেলে চললুম। কচি কচি চারখানা উদ্বাহু হাত, ছ’চোখে জলোচ্ছ্বাস, বন্যার চেয়ে কোনো অংশে কম তীব্র ছিলো না। একমাত্র গৃহস্বামীকে বিসর্জনে পাঠানো চারখানা কচি আর মুখ চাপা দেওয়া আঁচল ঢাকা দু’খানা কোমল হাত তখন চোখগুলি মুছতে ব্যস্ত, ভেসে চললুম জলমগ্ন ভারতবর্ষের দুর্গতি মোচনে। দৃষ্টির সীমানা পেরিয়ে, পাকখাওয়া নৌকোয় দাঁড়িয়ে, মনে পড়লো, ছেলেদুটোর জন্যে বরাদ্দ হাতখানা নাড়াতে ভুলে গেছি। ভুল সংশোধন করার প্রবল আকাঙ্খায় , অসীম আকাশের দিকে তাকিয়ে শূণ্য বাতাসে হাত নেড়েই চললাম –টা টা টা টা .. .. ..
৩
জল বিদ্ধ ঘর সংসার, ছেলে দুটো, বউ তখন বন্যার আড়ালে হারিয়ে গেছে।
জলের তোড়ে দাঁড়ের তড়পানিতে বন্যার জল এসে পড়েছে চোখে, নাকি অন্য কিছু!
শহরের তাবড়ো সমাজসেবী পুলিশেরা আমাকে কদমফুলির কুলে নামিয়ে নৌকো নিয়ে চম্পট দিলো। চললো, হয়তো আবার কোনো ডেপুটির বাড়ি মহান উদ্দেশে! এতক্ষণ বৃষ্টি বন্ধ ছিলো। আবার শুরু হলো টিপ টিপিয়ে। জলভেদি রাস্তা কাদাময়, দুর্দান্ত পিছল। অফিস মুগ্ধ মানুষের প্রতিমুহূর্তে আছাড় খাওয়ার ফাঁদ। চোখদুটো পায়ের আগায় লাগিয়ে ছাতা খুললুম। পিছনে অথৈ জল। সামনে বন্যার বিভীষিকা।
অফিসে ঢোকার মুখে, সিঁড়িতে, ঘরের মেঝেতে, কাউন্টারে মানুষ ঠাসাঠাসি। সবাই টাকা নেবে। টাকা চায়, টাকা! ম্যানেজারবাবু চেম্বার বন্ধ করে, বসে আছেন। ভয়ে চোখ বন্ধ। শেয়ালের কুমিরছানা দেখানোর মতো সবাইকে তিনি ডেপুটি ম্যানেজার দেখিয়ে থামিয়ে রেখেছেন। জল ভেঙে এসে আগুনের মধ্যে পড়লুম। টাকা নেই। ক্যাশের খাঁচা ফাঁকা। ক্যাশিয়ারবাবু ফুড়ুত। বাঙালিরা যুদ্ধের শেষে আর ভোজনের আগে ওস্তাদ। আওয়াজ পাচ্ছি, তিনি ক্যান্টিন ঘরে। কাজ নেইতো খৈয়ের বদলে বন্যার সস্তা মাছ ভাজার তদারকিতে ব্যস্ত। ভল্ট শূণ্য। কাষ্টমার সার্ভিস সসেমিরা। টাকা দেওয়া ছাড়া এখন কোনো কাম হচ্ছে না। রাস্তা ভেসে গেছে। গাড়ি ঘোড়া বন্ধ। রেমিট্যান্স সম্ভব নয়। স্টাফ নেই। যার বাড়ি হাওড়া, বন্যা বিধধস্ত এলাকা থেকে তিনশো কিলোমিটার দূরে সেও চলে গেছে ঘর বাড়ি রক্ষার দায়ে। যার বাড়ি জলপাইগুড়ি সেও চলে গেছে। বারোজন স্টাফের সবেধন নিলমনি তিনজন পড়ে আছে। লাগে টাকা দেবে এই গৌরী সেন।
আর আছে হীনগতি খোঁড়া ক্যাশপিয়ন গৌর। তার বাড়ি হরিপাড়া। খুঁটোয় বাঁধা নিরুপায়। বেচারি! সে আর যাবে কোন চুলোয়? অগত্যা গৌরকে সঙ্গী করেই বেরুতে হবে অধম এই গৌরী সেনকে।
ম্যানেজারবাবু হাঁ হাঁ করে উঠলেন, -আপনি ডেপুটি ম্যানেজার। অফিস বস। আপনি কোথায় বেরুবেন? এই বিপদে আপনার বেরুনো চলবে না। যে কোনো মুহূর্তে ব্যাঙ্ক লুটপাট হয়ে যেতে পারে। কোথায় যেতে হবে বলেন, আমি যাচ্ছি।
ম্যানেজারবাবু বেরুলে ফল কী হবে আন্দাজ করে, ফোন করলুম পুলিশে । ফোন বিকল। কাছেই থানা। অগত্যা ক্যাশিয়ারবাবু এবং গৌরের সাহায্যে মেন গেট বন্ধ করে দিলুম। ম্যানেজারবাবু সার্কুলার রেফারেন্স দিয়ে জানালেন,কাষ্টমার্স আওয়ার্সে গেট বন্ধ করা বেআইনি।
বললুম –আমিই বেরুবো। আপনার নিরাপত্তার জন্যে এই বে-অফিসি ব্যবস্থা।
কোনো উত্তর নেই। লুটপাটের দায় এড়াতে, তিনি বেরিয়ে পড়তে চেয়েছিলেন।
ম্যানেজারবাবুর থোঁতা মুখ ভোঁতা। বসের আদেশ অমান্য করে ছাতা মাথায় এবং খোঁড়াগৌরকে সঙ্গী করে বেরুলাম। প্রথমেই থানা অভিযান। বড়োবাবুর হাতে পায়ে পড়ে দু’জন বন্দুকধারী, একজন লাঠিয়াল পেয়ে গেলুম। বন্দুকধারী দুজনকে ব্যাঙ্কে পাঠিয়ে, লাঠিয়ালকে পেছনে জুড়ে ছাতা মাথায় চললুম তিনজন। পিট পিটে বৃষ্টিও চলেছে আমাদের সঙ্গে। হরিপাড়ায় যদু সিংহরায়-টাটা, রাম বিশ্বাস-গোয়েঙ্কা, এবং ভবহরি বিড়লাদের বাড়ি বাড়ি চলেছি। এঁরা টাকার কুমির। বিনয়ের অবতার সেজে, ঘাড় হেঁট করে, হাত জোড় করে ওদের কাছে ভিক্ষে চাইতে। ভিক্ষে চাওয়া অভ্যেস আমাদের। ওদের কেঊ কেউ তুড়ি মেরে দু’একদিন ব্যাঙ্ক চালিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন। সরকারি মাথা টাটা বিড়লার কাছে মুড়িয়ে দেবো, এ নতুন কিছু নয়, লজ্জারও কিছু নয়। আর গেলাম জে সি আই ম্যানেজারের কাছে। তার কাছেও অসময়ে টাকা পেয়েছি। কাকুতি মিনতি করে যা পেলাম হিসেব করে পেমেন্ট দিলে দিন দুয়েক চলে যাবে।
অফিসে ফিরে দেখি, ম্যানেজারবাবু নেই। উঁকি মেরে ক্যাশিয়ারবাবুকে পাওয়া গেলো সেই ক্যান্টিন ঘরে। ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে এক মিনিটের পথ ক্যাশের খাঁচায় এলেন পনেরো মিনিট হেঁটে। এবং দীর্ঘ পথশ্রমে ক্লান্ত ক্যাশিয়ারবাবু জানালেন, ব্যাগে কাগজপত্র গুছিয়ে ম্যানেজারবাবু নদিয়া চলে গেছেন। এইমাত্র খবর এসেছে ওনার ফ্যামিলি বিপদগ্রস্থ।
বুঝলাম, রেডি হয়েই ছিলেন। ফাঁক পেয়ে য পলায়তি স জীবতি।
৪
থম মেরে দাঁড়িয়ে গেলাম জানালার রড ধরে। বৃষ্টি থামেনি। হারাধনের চারটি ছেলে, রইলো বাকি তিন! কিন্তু দিনমান উজ্জ্বল হয়েছে। বাতাসও হালকা লাগছে। চাপমেঘও ভেঙে টুকরো। দমধরা আকাশ পরিষ্কার হওয়ার লক্ষণ। আকাশের দিকে তাকিয়ে সবাই শ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করছে, আর মানাচোনা করছে।
-আর না দেওয়া, ধরন দাও।
আকাশের সাথে গুমোট ধরা মানুষের মনও শুকোতে চাইছে। টাকার সংস্থান কিছু হয়েছে। ব্যাঙ্কে পুলিশ মোতায়েন করা গেছে। এমন সময় স্যারের চলে যাওয়াটা ভীষণই শত্রুতা মনে হলো। কিছুতেই ভুলতে পারছিনে, বিডিও, পুলি্শ, পঞ্চায়েতপ্রধানের সাহায্য নিয়ে তিনি বিপদ সংকুল হরিপাড়া এবং নিজেকে উদ্ধার করার জন্যে ডেপুটি ম্যানেজারকে বন্যার স্রোতে ধাক্কা মেরে গেলেন। অতঃপর ছাগলের শিংএ পা রেখে ধূর্ত ম্যানেজারের দ্রুত পলায়ন। খানিক বিমূঢ বিস্ময়ে হতবাক পৃথিবী দেখছিলাম। গায়ে গু মাখলে যমে ছাড়বে না। বিমূঢ হওয়ার সময় নেই। দেওয়ালে নোটীশ ঝুলিয়ে দিলাম, দু’হাজারের বেশি টাকা কাঊকেই দেওয়া হবে না। সন্ধে রাত যাই হোক, টাকা থাকলে, বেলা দু’টো পর্যন্ত যারা লাইনে দাঁড়াবেন প্রত্যেককেই দেওয়া হবে।
ক্যাশিয়ারবাবুর কাউন্টারের সামনে থেকে লাইন দাঁড়িয়ে গেলো হরিপাড়া বাজার ছাড়িয়ে ‘হক মিষ্টান্ন ভান্ডার’ পর্যন্ত। নুরুহকের মিষ্টি বিনি পয়সায় খেয়ে গোঁফ মুচড়ে পুলিশ লেগে গেলো লাইন তদারকিতে।
লোকাল যোগানের টাকা দু’দিনেই ফতুর। আবার কোলাপ্সিব্লগেট বন্ধ। বিকেল, সন্ধে, মাঝ রাতেও বেজে উঠছে কোলাপসিবলের ঝনঝন শব্দ, টাকা চাই, টাকা।
-টাঙুন থিকা টাকা আনা করান।
করানতো বটে, যাবে কে? কোন পথে? টাঙুনে যাওয়ার একটাই রাস্তা, বন্ধ। আসার সময় দেখেছি চরের মতো জেগে থাকা পথে পলিথিনতাঁবু ছড়াছড়ি। বন্যার্ত মানুষেরা পেটে গামছা উবু হয়ে বসে আছে খোলা আকাশের নীচে। শূন্য ভাগাড়ে ঝাঁক ঝাঁক শকুনের মতো মানুষে মানুষে ছয়লাপ।
-উপায়, ক্যাশিয়ারবাবু?
-কী হবে গৌর?
আমরা তিনজন, তিনজন থানার সেপাই , ব্যাঙ্ক বন্দী, নজর বন্দী, জল বন্দী। ছ’জন প্রাণী, মুখ চাওয়ি করছি। উপায়?
বন্ধ কোলাপসিবল বাজছে, ঝনঝন ঝনঝন। টাকা চাই, টাকা।
-টাকা নাই, টাকা নাই। পালাবার পথ নাই, নাইরে.. যম আছে পিছে।
রেমিট্যান্স সেন্টারে টাকা পাঠাবার আর্জি জানালাম। বহরমপুর খবর পাঠালো, বিপদ সংকুল পথ, যে কোনো জায়গায় লুটপাট হয়ে যেতে পারে, ( হতে পারে না, খবর পাচ্ছি, হচ্ছে।) তাঁরা কেউ টাকা দিতে আসবে না, নিজের দায়িত্বে আনতে হবে। প্রথমদিন টাকা পাওয়ার পর দেখেছি, আশা সত্যি হলে, ক্ষুধার্ত মানুষও লাইনে দাঁড়িয়ে থাকে। শৃঙ্খলার সঙ্গে ঘন্টার পর ঘণ্টা ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করে। এ্যাকাউন্টে হাজার হাজার টাকা থাকলেও প্রতিবেশীর কথা ভেবে দু’হাজার টাকা সমবন্টনে রাজি হয়। এই সব মানুষের কাছে কৃতজ্ঞ আমি। তাঁদের কাছে দেওয়া
কথা রাখার জন্য আমাকে রেমিট্যান্সে যেতেই হবে। একান্ত নিজের নিরাপত্তার কারনে, বুভুক্ষু এই সব মানুষের কাছে চুন-কালি মাখার কোনো মানে হয় না। জানি, পথে বুভুক্ষু, মরণ মুখি বেপরোয়া মানুষেরা। শেখবাগানের ডাকেতেরা উঁচুপোঁতায় কদমফুলির কাছাকাছি উঠে এসেছে। চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, চাকরী যাওয়ার ভয়, জেলে যাওয়ার ভয়, প্রাণের ভয়ের সামনে টান টান হয়ে দাঁড়িয়ে গেলো কয়েকটা কথা। যার শক্তি প্রাণের ভয়ের চেয়ে বেশি। সে আমার নিজেরই উচ্চারণ।
৫
-কেউ হতাশ হবেন না। শনিবার বারোটা, অন্যদিন বেলা দু’টো পর্যন্ত লাইনে যতোবার দাঁড়াবেন দু’হাজার করে পাবেন। সন্ধে হোক, রাত্রি হোক টাকা পাবেন।
লঙরখানা থেকে খিচুড়ি এসেছিলো খেয়েছি। ঘুম আসছে না। অফিসঘরে টেবিল জোরা দিয়ে শুয়ে আছি, মাত্র দু’জন। আমি চিৎ। পাশে ক্যাশিয়ারবাবুর টেবিল। তিনি কাত। বিদ্যুত এখনও বিপর্যস্ত। শুনশান অন্ধকার। আর কেঊ নেই। তিনজন পুলিশেরও মায়া পড়ে গেছে আমাদের উপর। সময়ের হিসেব চুলোয় দিয়ে কাল ভোরেই ডিউটিতে হাজির হয়ে যাবে। খোঁড়াগৌর লেংচে লেংচে সর্বক্ষণ পিছন পিছন ঘুরে বেড়াচ্ছে। দূর্যোগে জটিল মানুষ ক্যাশিয়ারবাবুও সরল নরম হয়ে গেছেন। সমস্ত ঝক্কি ঝামেলা সহ্য করে বিস্বস্ত সৈনিকের মতো হরি পাড়ার মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে গেছেন। উনিও যে কোনো মুহূর্তে কোনো না কোনো কৌশলে ধূর্ত শেয়াল হয়ে যেতে পারতেন। কিন্তু আশ্চর্য, হ’ননি! মানুষের বিপদে মানুষই বোধহয় এমন বদলে যেতে পারে। পাশ ফিরে বললেন – স্যর, আপনি রেমিট্যান্সে যাবেন না। রাস্তার অবস্থা একদম ভালো না। কাল নোটিশ দিন একশো লোককে দেওয়া হবে। একশো লোককে দেওয়ার মতো টাকা ভল্টে আছে। বিকেলে না হয় আর একবার টাটা বিড়লাদের কাছে যাবেন।
কটকট কটকট.. ..
অফিসের নীচে, পিছন দিকে বাঁশ ঝাড়। ওদিক থেকে বিশ্রী একটা আওয়াজ আসছে। বেশ কিছুক্ষণ অন্তর শব্দটা হচ্ছে। দিনেরবেলাও শুনেছি। মনে হয়েছিলো বাতাসে বাঁশঝাড়ের কারসাজি। তখন কিছু মনে হয়নি, এখন ফাঁকা শুনশান রাত্রি। বড্ড কানে বাজছে। দু’দিন ধরেই শুনছি। যেনো কিছুর আর্তনাদ। কেউ যন্ত্রণা দাঁতে দাঁত চেপেও ঢেকে রাখতে পারছে না। এই দূর্যোগে শব্দেরাও স্বাভাবিক নয়। চেষ্টা করেও চিনতে পারলুম না। বললুম- সে হবে না। মানুষের গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। এখন থুতু দিয়ে চিঁড়ে ভেজানো যাবে না।
কটকট কটকট..
- আচ্ছা ক্যাশিয়ারবাবু, ওটা কিসের শব্দ?
-কে জানে? ক্যাশিয়ারবাবু বললেন - সবচে’ ভয় কদমফুলির চরে। ডাকাতগুলো খেতে না পেয়ে হন্যে হয়ে আছে।
বললুম -আপনি গেট বন্ধ করে ভিতরে থেকে যাবেন। আমি একটা প্ল্যান এঁটে ফেলেছি। সিংহরায়বাবুর গ্যারেজে জল ঢুকে ওনার এ্যাম্বাসাডর বিকল। ছ’চাকার লরিখানা দিতে রাজি হয়েছেন। লরি থাকবে কদমফুলির এপারে। ওপারে আটকে থাকা রামবাবুর ম্যাটাডোরখানা পেয়ে যাবো।
ভজহরিবাবুর ডানহাত সোনা ঘোষ থাকছে সঙ্গে। ভজহরিবাবুই পাঠাতে রাজি হয়েছেন। সোনা ঘোষ একাই একশো। থাকলে, হরিপাড়া থেকে বহরমপুর যেখানে খুশি বিশ পঞ্চাশ মানুষ হাজির করে দেবে।
জলপথটুকু ঘুরে ঘুরে নৌকোয় মেরে দেবো। জলে ডাকাতির খবর এখনও পাওয়া যায়নি। বহরমপুর ব্রাঞ্চ বলেছে দু’জন পুলিশের ব্যবস্থা করে দেবে। ভজহরিবাবু, রাম বিশ্বাস, সোনা ঘোষ এক একজন রাজনৈতিক চাঁই। সবাই মিলে যখন সাহায্য করতে রাজি হয়েছেন। আশা করি, পলিটিকাল কালার থাকবে না।
ক্যাশিয়ারবাবুর গলায় ঘুম জড়িয়ে আসছে। বললেন -সোনা ঘোষ লোকটাকে আমার ঠিক পছন্দ নয়। দেখবেন স্যর, চাকরী নিয়ে টানাটানি না
হয়?
কটকট কটকট…
- রাম বিশ্বাস চেয়েছিলেন, এলাকার চার রাজনৈতিক দলেরই ফ্ল্যাগ টাঙিয়ে কাজটা সারতে। রাজি হইনি।
-ভুলে যাবেন না স্যর, আপনার একটা সংসার আছে। দুটো বাচ্চা আছে। বড্ড রিক্স নিচ্ছেন। কিছু হলে বৌদি .. ..
কটকট কটকট…
শব্দটা রাতেরবেলা বাড়ছে।
৬
অফিসের পিছনে সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় চোখে পড়েছিলো, বাঁশঝাড়ের গোড়ায় ডোবাটা ভেসে গেছে। পাশে একটা মাটির ঘর, খড়ের চাল। ওটাতে জল ঢুকে পড়েছে। ঘরে-বাইরে বন্যার সোঁত বইছে। শক্ত হলুদ টনটনে দেওয়াল ভিজে গাঢ়োকালো। দু’টো কচি বাচ্চা নিয়ে একজন ভিখিরি মা, এই ঘরে থাকে। দেখেই বুকের ভিতর ছ্যাঁৎ করে উঠলো। যেনো বুকের ভিতরে বন্যার স্রোত ঢুকে পড়লো। ভিতে জল বসে ঘরখানা একদিকে কাত হয়ে গেছে। যে কোনো মুহূর্তে হুড়মুড় করে ভেঙে পড়বে। ওরা নিশ্চয় জল ঢোকার রাতে পালিয়ে যেতে পেরেছিলো! কিংবা হারিয়ে গেছে অথবা ভেসে গেছে! যেখানেই থাক, বেঁচে থাক। শূন্যঘর পড়ে থাকে থাক, একদিন ভরে উঠবেই।
কটকট কটকট..
শব্দটা ওই ঘরের ভিতর থেকে আসছে। মা না থাকলে, যখন খিদে পেতো, হাত ধরাধরি করে ভিখিরির বাচ্চাদুটো মাঝে মাঝেই হানা দিতো অফিসে। ওদের চিনি। আমার ছেলেদুটোর বয়সী হবে। দশ পয়সা বিশ পয়সা কেউ দিতো, কেঊ দিতো না। হাতের কলম তুলে কেউ ছেই করতো। পাশের কলিগকে কানকি মেরে কেউ আমার টেবিলে ঠেলে দিতো। আমি নাকি অফিসের বাবা।
আদুল গা। বড়োটা নেংটি পরা, ছোটোটা ল্যাংটো। মুখ দুখানা খিদের হাসিতে ভরা। টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে থাকতো চুপচাপ। কিছু চাইতো না।
রেমিট্যান্সে যাচ্ছি, মন শক্ত রাখা দরকার, এসব আজেবাজে ভাবলে চলবে না। অসময়ে বুকের ভিতর একগাদা ফালতু জল ঢুকে পড়লো। হৃদপিন্ডের চারপাশ স্যাঁতসেতে লাগছে। এখন প্রতিমুহূর্তে সচেতন থাকতে হবে। জলেজলাকার চারদিক, অভাবে স্বভাব নষ্ট মানুষের ছড়াছড়ি। কোথায় কী বিপদ ওত পেতে আছে, প্রতিটা পা মাপতে মাপতে যাওয়া উচিত। মনে করতে চাই না, তবু দুম করে মনে পড়ে যায়। বুকের ভিতর সোঁত পাক দিয়ে ওঠে। অকুল জল-যাত্রা! এক ত্রিপল খাটানো দ্বীপে তন্ডুল শূণ্য তিনটি প্রাণী...। দুটি কচি হাতের উল্টো দিকে ঢাকা মুখ। আঁচলের খুঁট দাঁতে চেপে দাঁড়িয়ে থাকা আর একটি অসহায় প্রাণী। নৌকো ভেসে যাচ্ছে। বেয়াড়া ভাবনা কিছুতেই রেহাই দেয়না। ট্রেনিংএ আমাদের শেখানো হয়, সবসময় ব্যাঙ্কম্যানদের এক পা অফিসে আর এক পা জেলে। সংসার থাকলেও পা রাখতে নেই। রাখতে চাইছিও না। মাসের বাজার করা হয়নি। দেখে এসেছি, ঘরে চাল নেই। ডাল নেই। বন্যা ভেজা আলসেয় কাঁকড়াবিছে ঘুরে বেড়ায়। ভয়ে বউ দু হাত তুলে আর্তনাদ করে। দুপুর হলে ছোটো ছেলেটার খুব খিদে পায়। বড়োছেলেটা সহ্য করতে পারে। কাঁদে না। আঁচল দিয়ে মার কান্না মুছিয়ে দেয়। ভাবনাটা খুব বেয়াদপ। অফিসের নিয়ম ভেঙে তবু মাথার চারপাশে ঘুরঘুর করছে। শুধুমুধু বুকের ভিতর কটকট করে ওঠে।
হরিপাড়া বাজারের বুড়ো ফেকুদর্জি বলেছিলো –বন্যায় জল বসে ভেঙে পড়ার আগে মাটির ঘরের বাঁধন সব কাঁদতে থাকে। তখন কটকট শব্দ হয়। ঘরের আড়ায় যতো বাঁশ, চালা, চটা, খুঁটি, আছে ঘর থেকে আলগা হতে থাকে। বাঁধন কাটতে না পেরে দু’একটা চটা, বাঁশের খুঁটি ফাটতে থাকে। দু’তিন দিন এমন কি পাঁচ সাত দিন এই রকম অনাসৃষ্টি শব্দ হয়। তারপর একদিন ধুপ করে ভেঙে পড়ে। নাও পড়তে পারে। পড়তে পড়তে বেঁকেচুড়ে ত্রিভঙ্গ হয়ে যদি দাঁড়িয়েও যায়। তবে সে কালে ভাদ্রে। সে ঘর কোনোদিন সোজা হয় না। ভেঙে ফেলতে হয়। মনে হলো বাঁধনতো নয়, মায়ার বাঁধন। কাটছে। কানের ভিতর নয়, বুকের ভিতর যেখানে জলের সোঁত বইছে, যেনো ঘরখানা আর একবার শব্দ করে উঠলো।
কটকট কটকট।
যেখানে বাঘের ভয় সেখানে সন্ধে হয়। কদমফুলি পর্যন্ত ভালোয় ভালোয় ফিরে এসেছি। নৌকো থেকে মাল-পত্র ফের নির্বিঘ্নে লরিতে উঠে গেছে। প্রাণ ভরে শ্বাস নিতে গিয়ে দুম করে দম আটকে গেলো বুকে। কদমফুলি থেকে স্টার্ট নেওয়ার সময় লরি আর নড়ছে না। সর্বনাশ! লরিতে টাকার ডাঁই। ছোটো পেমেন্ট দেওয়ার জন্য, ছোট ডিনোমিনেশানস নিয়েছি। সিটের উপরে নীচে বাক্স ভর্তি টাকা। বসার জায়গা নেই। পাশেই কদমফুলির চর। ক্যাশিয়ারবাবুর কথা মনে পড়ে গেলো। বুভুক্ষু ডাকাতদের আস্তানা। বুক কেঁপে উঠলো। সঙ্গে সঙ্গে বুকের খাঁচা, কলজে সমেত মেরামত করে ফেললাম। অস্থির হলে চলবে না। অনেক লড়তে লড়তে আসছি। দমও ধরে রেখেছি। আর কয়েক মাইল, ঠিক পৌঁছে যাবো। তবু মনে হচ্ছে সাহসের গোড়াটা আর আগের মতো জমাট নেই। কদমফুলির চর এখন ভয়ঙ্কর এলাকা।
৭
দূরে একটা আমবাগান দেখা যাচ্ছে। ওখানে মাটি জেগে আছে। অগুন্তি কালো কালো পলিথিল তাঁবু। পিলপিল করছে মানুষ। ওটাই সেই চর। একটা লঙরখানা। খাওয়া দাওয়া চলছে। মনে হচ্ছে, ভালো মানুষদের ভীড়ে, তিনারা ওখানেই আস্তানা গেড়েছেন। বিডিও সাহেব, থানার বড়োবাবু খুব ভালো করেই জানেন, লঙর খাইয়ে ওদের পেট ঠান্ডা না রাখলে হরিপাড়া, অরূপপুর, জামতলা ডাকাতিতে লোপাট হয়ে যাবে। টাটা বিড়লারাও রেহাই পাবেন না। রামদা, ভজহরিবাবুরা এটা ভালোই বোঝেন। নিজেদের বাঁচার তাগিদে মহাপুরুষ হয়ে শুনেছি, লঙরখানা চালাচ্ছেন ওরাই।
সোনাদা খুব স্বার্থপর। এই সব মানুষের উপর নির্ভর করা বোকামি। কোথায় পাশে পাশে থেকে ভরসা দেবে, তা নয়। কিছু না বলেই টাকা ভর্তি লরি ফেলে চলে গেলো লঙরখানার দিকে। ডাকাতদের, নাকি নিজের পেট সেবা করতে, কে জানে? দু’জন পুলিশ আর আমি পড়ে রইলাম। বৃষ্টি পড়েই চলেছে। ভিজছি। ভয়ে না কি ঠান্ডায় কেনো যে কাঁপছি! জানি না। ড্রাইভার লরির নীচে কাদায় শুয়ে শুয়ে অনন্ত কাল ধরে খুটুর খুটুর করেই চলেছে। টাকা ছেড়ে নড়তেও পারছিনে। এই বুঝি লুট হয়ে গেলো। মাথা কাজ করছে না। সোনা ঘোষ লোক পাঠিয়ে ড্রাইভারকেও ডেকে নিয়ে গেলো। যাঃ! বুকের বাঁ দিকটা চিনচিন করে উঠলো। লরির নীচ থেকে যখন বেরিয়ে এলো, দশাসই ড্রাইভার, হাতে একখানা লোহার রড। মনে হয়েছিলো, দু পাঁচটা ডাকাতের মহড়া নিতে পারবে। ওকেও সরিয়ে নিলো। যদি কিছু হয়, সোনা হারামির জন্যেই হবে। কাঠির মাথায় আলুর দমের মতো পুলিশ দুটো বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে ঘুমুচ্ছে। কেউ যদি চোখ মোটা করে তাকায়, ল্যাঙপেঙে পুলিশ শুদ্ধু পেচ্ছাব করে ফেলবো। মাথায় বাক্স নিয়ে ড্যাং ড্যাং করে চোখের সামনে দিয়ে ডাকাতরা চলে যাবে। খুন করে গেলেও কেঊ দেখার নেই। পলিটিক্যাল নেতাদের ভরসায় রিক্স নিয়ে বড্ড বাড়াবাড়ি করে ফেলেছি। কাজটা যেমন বে আইনি, সাদা চোখে তেমনই আহাম্মুকি। তবে যতো বড়ো জোয়ানমদ্দই হোক দু’চারজনের পক্ষে টাকা নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। বাক্সদুটো চেন তালা দিয়ে আচ্ছা করে লরির গ্রীলে আটকানো। চাবি আমার কাছে। মরে গেলেও দিচ্ছি না। দরকার হলে কদমফুলির জলে ফেলে দেবো।
কিন্তু এখন উপায়?
কোত্থেকে এক এঁচোড়েপাকা ছোকরা এসে কিনা বলে - ম্যানেজারবাবু, বেলা গড়িয়ে যাচ্ছে, হাতে মুখে জল দিয়ে চাড্ডি খেয়ে নিন!
ইয়ার্কি হচ্ছে? কণ্ঠায় প্রাণ এসে ঠেকে আছে। কলাগাছকেও ডাকাত ভাবছি। খাওয়ানোর নাম করে ডাকাতির সুলুক নিতে এসেছে! টিকটিকি কোথাকার! হুঙ্কার দিয়ে উঠলাম,
–কে? কী চাই? ভাগো হিঁয়াসে।
ছেলেটি আমতা আমতা করে বললে –সোনা ঘোষ আমাকে পাঠালে।
দলেরম্যাড়া রামদা পই পই করে দিব্যি দিয়ে পাঠিয়েছে , রাস্তায় উল্টোপাল্টা কিছু হলে যেনো বেগোরবাঁই না করি। সোনা ঘোষ যেমন বলবে, অক্ষরে অক্ষরে চলতে হবে। মহা মুশকিলে পড়া গেলো। খিদে ফিদে কিছু নেই। টাকা ছেড়ে নড়া যায় না। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে তিনজন শালপাতায় দু’চার গ্রাস খেয়ে নিলাম। খিচুড়ি গলায় আটকে রইলো। পেট পর্যন্ত নামলো না।
পালাতে পারলে বাঁচি। ছোকরা সরেজমিনে কী তদন্ত করে গেলো, সেই জানে। শেষ পর্যন্ত সোনা ঘোষ, ড্রাইভার ডাকাতদের দলে ভিড়ে গেলো নাতো?
লঙরখানার দিক থেকে একদল ডাকাত হারে রে রে করে ছুটে আসছে। যাঃ, সব শেষ হয়ে গেলো। রামদা, সিংহরায়বাবু তোমাদের মনে এইছিলো? আনাড়ির বাচ্চা আমি। কী করি! ধুকপুকটুকু ছিঁড়ে না নিলেও আতঙ্কে বুক ফেটে যাবে।
অকস্মাৎ চিৎকার করে উঠলুম।
-ফায়ার।
কোথায় পুলিশ! স্বধর্মে লুকিয়ে পড়েছে কোথাও! যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলো, হাওয়া খেলা করছে। কপাল ভালো, গলা শুকিয়ে কাঠ। মুখ দিয়ে কোনো স্বর বেরোইনি। ভাগ্যিস, পুলিশরা পালাতে জানে। নইলে খুনের দায়ে পড়ে যেতাম।
৮
হাড় জিড়জিড়ে কতোগুলো না খেতে পাওয়া মানুষ, কুঁজো, পরনে ত্যানা, বুকের হাড় কলজেতে ঠেকেছে, এসেছে লরি ঠেলতে। একদল খেতে না পাওয়া মানুষ আর একদল না খেতে পাওয়া মানুষের টাকা পৌঁছে দিতে, বন্যা বন্যা ভাই ভাই। জাতভাইদের দু’মুঠো খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে।
ও,হরি! এদেরকে আমরা ডাকাত বলি! মানুষ চিনতে এতো ভুল! আর একটু হলে কেলেংকারি ঘটিয়ে ফেলেছিলুম। একদল বন্যার্ত মানুষ হাত লাগালো লরির পিছনে।
-হেঁইয়ো মারি কলের গাড়ি
-কল চলেছে তাড়াতাড়ি।
-শ্বশুরবাড়ি, শ্বশুরবাড়ি।
লরি চলতে শুরু করলো। বুকে হাত রাখলাম। নিশ্বাস বইতে শুরু করেছে। মনে হচ্ছে এ যাত্রা বেঁচে গেলুম। এই সেই মানুষেরা যাদের ভয়ে হাত পা অবশ হয়ে আসছিলো। মাটির ভিতর পুঁতে যাচ্ছিলুম।
-হরিপাড়াব্যাঙ্ক মায় কি!
-জয়।
পাক্কা দু’মাইল রাস্তা বন্যার্ত মানুষের হাতে ঠেলা খেয়ে বাক্স ভর্তি টাকা পৌঁছে গেলো, ব্যাঙ্কের নীচে। বৃষ্টি ধরন দিলেও। চারদিকের জল ঠেল ধরেছে। হরিপাড়ার এই জায়গাটা নিচু নয়। তবু জল এখনও বাড়ছে। যাওয়ার সময় পায়ের গোছ পর্যন্ত জল পার হয়ে লরিতে উঠেছিলুম। এখন হাঁটু জল। বাঁশবাগানের নীচে ঘরখানায় জানলার খুপরি পর্যন্ত জল উঠে গেছে। ব্যাঙ্কে ঢুকে দু’হাত কপালে তুলে মনে মনে বললুম –জয় বন্যার্ত মানুষের জয়।
কেঊ শুনতে পেলো না। কোনোদিন শুনতে পাবেও না। কারন এ জয় বে-আইনি জয়। যারা জেনে গেছেন চেপে রাখুন । আমি এই জয়ের কথা কাঊকে বলতে পারবো না। এই জয়ধবনি শুনতে পাবো আমি একা। আমার বুকের ভিতর। যতদিন বাঁচবো, বেঁচে থাকবো, মাঝে মধ্যে হাঁক দিয়ে উঠবে –জয় বন্যার্ত মানুষের জয়।
স্ট্রং রুমে টাকার হিসেব মিলে গেলো। ভল্টে টাকা ঢুকিয়ে যখন উঠে দাঁড়ালাম, কোমর টনটন করে উঠলো। শিরদাঁড়া, পায়ের শিরা উপশিরা ব্যথায় ফেটে পড়ছে। শরীরের ভিতর কেমন পাক মেরে উঠলো। একটা চোঁয়া ঢেঁকুর মেঘের মতো ডাক ছাড়লো। গলা বুক জ্বলছে। গোটা বন্যার জল এ্যাসিড হয়ে বুকের ভিতর ঠেল ধরেছে। বুঝলুম, খিচুড়ি খাওয়ার পর জল খাওয়া হয়নি।
অকস্মাৎ হুড়মুড়, বিশাল শব্দ হলো। একটা আর্তনাদ গোটা ব্যাঙ্কখানাকে কাঁপিয়ে দিলো। একটা বিশাল জলচ্ছ্বাসের ধাক্কা এসে লাগলো ব্যাঙ্কের বাড়িতে। বাড়ির দেওয়াল ফুঁড়ে আমার বুকে। কুঁড়েঘরখানা ভেঙে পড়লো। ছ’দিন ধরে একটা সংসার ভেঙে পড়তে পড়তে আজ জলস্যাৎ হয়ে গেলো। নাকি মাথা ঘুরে পড়ে গেলাম। চারপাশের হাওয়া বাতাস, ছবি ঝাপসা হয়ে এলো। কচি কচি দুখানা হাত বাতাসে দুলছে। শুনতে পেলাম কারা যেনো ডাকছে –বাবা.. বাবা বা.. ..
-ক’দিন থেকেই ঘরের মেঝেটা খুব ঘামছে।
মাথায় ফ্যান পাঁচে ঘুরছে। আগজ্বলন্ত ভাত। ফুঁ দিচ্ছি। উত্তর দেওয়ার সময় নেই।
ফের বললো- ঘরে দোরে খুব পিঁপড়ে উঠছে।
ওর হাতে ভাঁজ করা খবরের কাগজ। বাতাস করছে।
গলা গলিয়ে গলা ভাত গলগল বেগে ঢোকাবার চেষ্টা করছি। আর উশ্ আশ্ করছি।
-এ বছর বন্যা হবে।
কান তুচ্ছ, একমাত্র মুখগহবর ছাড়া শরীরের কোনো ছিদ্রই কাজ করছে না।
-মাসখানেকের মতো চাল ডাল, তেল, নুন কিনে রাখা দরকার ..
একথালা ধোঁয়া ওঠা ভাত, একশো ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে মাছের ঝোল, সাড়ে সাত মিনিট তিপ্পান্ন সেকেন্ড সময়। বউ সামলাবো না গলার আগুন? নইলে বাস টা-টা। অফিসেরব্যাগ এখনো অগোছালো। আজ রেমিট্যান্স (ক্যাশ সেন্টার বহরমপুর থেকে ক্যাশ আনা কিংবা পৌঁছে দেওয়া) আছে। হেডক্যাশিয়ারবাবু পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন, রেমিট্যান্স করতে পারবেন না। শেখবাগানে ডাকাতের মাঠ পেরিয়ে জান হাতে আসতে তিনি রাজি নন।
খাদ্যঠাসা কণ্ঠনালি পেরিয়ে বৌ ঠেকানো হুম, হাম শব্দ অভ্যাস মতো বেরিয়ে আসছে।, যার কিছুই মানে হয় না। বিরক্ত পিয়া বেরুবার মুখে ফর্দখানা বুকপকেটে গুঁজে দিয়ে বললে – দয়া করে মুদিখানায় এটা দিয়ে যেও।
ব্যাঙ্কে ঢুকতে না ঢুকতে মাষ্টারমশায়রা দল বেঁধে হা হা ভিখিরির মতো ঢুকে পড়বেন। স্ট্রংরুমে সেফ (টাকা রাখার সিন্দুক )খালি, ভাঁড়ে মা ভবানি। এর বেশি বলতে হলে বৌকে অফিসের ‘মে আই হেল্প য়ু’ কাঊন্টারে এসে দাঁড়াতে হবে। ছেলেদুটো বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে। বাবা চলে যাবে, টা টা দেবে। ছেলে দুটোর জন্যে হাতনাড়াটা বরাদ্দ। ব্যাগের ভিতর একহাত ঢুকিয়ে চাবির হিসাব মেলাতে মেলাতে অন্যহাত বাতাসে তুলে নাড়তে নাড়তে রিকসায় উঠে বসলুম।
-টা টা।
পারিবারিক বিচ্ছেদ বেদনা হুমড়ি খেয়ে পড়ে থাকলো বাড়ির সামনের রাস্তায়। রোজই থাকে।
বিশ্বকর্মাপূজোয় এবার ঢাক আর মেঘের যুগলবন্দী শুরু হয়েছে সকাল থেকে। শারদীয়ার আগমনী। ঢাকের কাঠির সাথে পাল্লা দিয়ে কালো কালো মোষের মতো মেঘ, ঈশান থেকে পশ্চিমে আসা যাওয়া করছে। ডাকও কেমন অচেনা। গুরুগম্ভীর। গুরু গুরু গুর গুর গুড়ি গুড়ি হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে। আবার শুরু হচ্ছে। বিরাম দিচ্ছে না। মাঝে মাঝে ভয় পাওয়ানো হুংকার। একসময় ঢাকের কাঠি থামিয়ে মেঘের আওয়াজ জিতে গেলো। শুরু হলো বৃষ্টি। হাওয়া নেই। দমবন্ধ চরাচর । মেঘে মেঘে আকাশ ত্রিপলের মতো চেপে ধরেছে।
টানা দু’দিন বৃষ্টির পর তৃতীয় দিনেও যখন কামাই হলো না। বোঝা গেলো মুর্শিদাবাদের আকাশে দূর্যোগের ঘনঘটা।
তৃতীয়দিন বেলা তিনটে নাগাদ অফিসে খবর এলো সিঁড়ির ঘরে জল ঢুকছে। বাড়িতে বারো এবং আট বছরের দু’জন পুরুষ মানুষ, আর
তাদের স্নেহার্দ্র মাতাঠাকুরাণী! সাবক্যাশবুকের পাতায় দস্তখত দাঁড়িয়ে গেলো। ম্যানেজারবাবুর বাড়ি নদিয়া। মুর্শিদাবাদের ঘনঘটায় নদিয়ার
(২)
ভ্রুকুঞ্চন তখন ধনুকের আকার ধারন করছে।
বন্যার সাথে বঙ্গভূমির বছরকি চুক্তি। বন্যার সাথে উঠবোস, ঘর কর্না, জল ভাত। আক্ষরিক ভাবে বন্যার জল আর চোখের জলে ভাত ভিজিয়ে খাওয়া ফি-বছরের অভ্যেস। বছর দু’তিন হলো, এলাকায় বরষার বড়ো অনটন। কড়োকড়ো ভাত (শুকনো) খেয়ে কেটেছে মুর্শিদাবাদির। এবার পুষিয়ে দেবে, মনে হচ্ছে। তৃতীয়দিনেও বৃষ্টি মহানন্দে খেলে বেড়াচ্ছে, আকাশে বাতাসে। চতুর্থদিনে জল থৈ থৈ, একতলা ঘরে গলায় গলায় জল। সংসারের পাতাল প্রবেশ ঘটে গেলো। ডুব সাঁতার, চিৎ সাঁতারের কসরতে খাট, বিছানা, হাঁড়ি খুন্তি গ্যাস ওভেন সঙ্গে নিয়ে ত্রিপল টাঙানো ছাদে উঠে আসতে পেরেছি।
বাড়ি থেকে নামলেই ডুবজল ডুবজল।
বৃষ্টির তিন নম্বর রাত্রি থেকে ঘরবন্দী। অফিস যেতে পারলাম না। গলি পথ, বাঁকা পথ, বড়ো রাস্তা, জলরাস্তা হয়ে ঢেউ খেলছে। জল জল জ্বলুনি, জলের মাথায় চালুনি, চালের মাথায় ঘরনি। বলতে পারলে বলো, না পারলে কেরানি। কবে যেনো শিখেছিলুম।, জল ধাঁধা। জলে জলাকার। বন্যা। চতুর্দিকে বাস, লরি, ট্রেন, টেম্পো চলাচল স্তব্ধ। তিনদিন অফিস যেতে পারলাম না, রাম কামাই। এমন হাত পা বেঁধে মার খাওয়া কামাই, কতোকাল খাইনি, আহা! কী মজা, অফিস না যাওয়ার আগে ফ্যানাভাত খাওয়ার ছড়াছড়ি সময়। গলায় আটকে আটকে দম নিয়ে নিয়ে নামছে। সাত রাজার ধন এক মানিক ছুটি, আরাম করে বসে বসে খাচ্ছি।
আশঙ্কাকে ধন্যবাদ, অফিসের চাবি ছোড়ান অলিখিত ছেড়ে এসেছিলুম ম্যানেজার বাবুর দয়ায়! বৃষ্টি আর জলস্রোতে এমন তান্ডব বইছে, লঙ্গরখানার নৌকো ভিড়তে পারেনি। পাড়ায় এসেছিলো। ফিরে গেছে। সার বাঁধা পাকা ঘরের কাঁধে কাঁধে ঢেউ ভাঙছে। হালদার পাড়ায় দরমার কুঁড়েগুলো এক এক করে হেঁটমুণ্ডে ভেসে চলেছে। ঘরে থাকার এক জ্বালা, গরীব বৌএর কথা দিনরাত বাসি হচ্ছে, যতো বাসি হচ্ছে ততো দামি হচ্ছে। অফিসের ভারমুগ্ধ চাপে ভবিষ্যত বাণীর সেই চাল ডাল তেল নুন অফিসকয়েদির ঘরে ঢোকেনি। ভুলে গেছি। ফর্দ পকেটে থেকে থেকে যথাপূর্বং ভিজেপুড়ে হারিয়ে গেছে। ফিরে পেতে ডাইরি লেখানোর উপায়ও নেই। শহরখানা ডুবুডুবু থানা ভেসে যায়। হাফপেট খেয়ে, টেনেটুনে আর দু’তিন সাঁজ চলবে, অতঃপর হরিমটর! মা পিয়ার শূন্যভান্ড!! প্রসাদ কনিকা মাত্র যতো পারো বন্যার থৈ থৈ জল।
এ মতো দুর্যোগে দোলায়মান নৌকো চড়ে পুলিশ হাজ়ির। জেলাব্যপি দূর্ভিক্ষ, হাহাকার, নৈরাজ্য চলছে; হরিপাড়ার ডেপুটি ম্যানেজারের ঘরে থাকা মানায় না। জরুরিভিত্তিতে অফিসে জয়েন করতে হবে। কন্ট্রোলিং অফিসের অর্ডার। স্কুলশিক্ষকদের মাইনে, বৃদ্ধদের পেনশান, বন্যার্তমানুষের পঞ্চায়েত ফান্ড দিতেই হবে। অধমের বিনীত প্রশ্ন ছিলো – ম্যানেজারবাবুতো আছেন?
উত্তর –এখন পাঁচজন ম্যানেজারেও অবস্থা সামাল দিতে পারছে না।
মরিয়া হয়ে বলে উঠলুম – ঘরে চাল, ডাল, তেল, গ্যাস বাড়ন্ত। অনাহার শুরু হয়েছে। এখন সংসার ছেড়ে যাওয়া অসম্ভব।
শর্ত দিলুম, -হপ্তা দুয়েকের আহার্য ঘরে পৌঁছে দিলে যেতে পারি। মানে নিয়ে যেতে হবে।
পুলিশের ছোটো কিংবা কোনো একবাবু বলে উঠলেন– পৌঁছে যাবে।
পুলিশের কথা নাতো ব্যাঙের মাথা। কলজে নিংড়ানো রস তখন চোখের গোড়ায় এসে জমেছে। দম বন্ধ করে বললুম
-পৌঁছে দিলে তবে যাবো।
-পৌঁছে যাবে।
এর বেশি কিছু শুনতে পেলুম না। আমাকে তুলে নেওয়া হলো নৌকোয়। অকুল জল-যাত্রা! এক ত্রিপল খাটানো দ্বীপে তন্ডুল শূণ্য তিন প্রাণীকে ফেলে চললুম। কচি কচি চারখানা উদ্বাহু হাত, ছ’চোখে জলোচ্ছ্বাস, বন্যার চেয়ে কোনো অংশে কম তীব্র ছিলো না। একমাত্র গৃহস্বামীকে বিসর্জনে পাঠানো চারখানা কচি আর মুখ চাপা দেওয়া আঁচল ঢাকা দু’খানা কোমল হাত তখন চোখগুলি মুছতে ব্যস্ত, ভেসে চললুম জলমগ্ন ভারতবর্ষের দুর্গতি মোচনে। দৃষ্টির সীমানা পেরিয়ে, পাকখাওয়া নৌকোয় দাঁড়িয়ে, মনে পড়লো, ছেলেদুটোর জন্যে বরাদ্দ হাতখানা নাড়াতে ভুলে গেছি। ভুল সংশোধন করার প্রবল আকাঙ্খায় , অসীম আকাশের দিকে তাকিয়ে শূণ্য বাতাসে হাত নেড়েই চললাম –টা টা টা টা .. .. ..
৩
জল বিদ্ধ ঘর সংসার, ছেলে দুটো, বউ তখন বন্যার আড়ালে হারিয়ে গেছে।
জলের তোড়ে দাঁড়ের তড়পানিতে বন্যার জল এসে পড়েছে চোখে, নাকি অন্য কিছু!
শহরের তাবড়ো সমাজসেবী পুলিশেরা আমাকে কদমফুলির কুলে নামিয়ে নৌকো নিয়ে চম্পট দিলো। চললো, হয়তো আবার কোনো ডেপুটির বাড়ি মহান উদ্দেশে! এতক্ষণ বৃষ্টি বন্ধ ছিলো। আবার শুরু হলো টিপ টিপিয়ে। জলভেদি রাস্তা কাদাময়, দুর্দান্ত পিছল। অফিস মুগ্ধ মানুষের প্রতিমুহূর্তে আছাড় খাওয়ার ফাঁদ। চোখদুটো পায়ের আগায় লাগিয়ে ছাতা খুললুম। পিছনে অথৈ জল। সামনে বন্যার বিভীষিকা।
অফিসে ঢোকার মুখে, সিঁড়িতে, ঘরের মেঝেতে, কাউন্টারে মানুষ ঠাসাঠাসি। সবাই টাকা নেবে। টাকা চায়, টাকা! ম্যানেজারবাবু চেম্বার বন্ধ করে, বসে আছেন। ভয়ে চোখ বন্ধ। শেয়ালের কুমিরছানা দেখানোর মতো সবাইকে তিনি ডেপুটি ম্যানেজার দেখিয়ে থামিয়ে রেখেছেন। জল ভেঙে এসে আগুনের মধ্যে পড়লুম। টাকা নেই। ক্যাশের খাঁচা ফাঁকা। ক্যাশিয়ারবাবু ফুড়ুত। বাঙালিরা যুদ্ধের শেষে আর ভোজনের আগে ওস্তাদ। আওয়াজ পাচ্ছি, তিনি ক্যান্টিন ঘরে। কাজ নেইতো খৈয়ের বদলে বন্যার সস্তা মাছ ভাজার তদারকিতে ব্যস্ত। ভল্ট শূণ্য। কাষ্টমার সার্ভিস সসেমিরা। টাকা দেওয়া ছাড়া এখন কোনো কাম হচ্ছে না। রাস্তা ভেসে গেছে। গাড়ি ঘোড়া বন্ধ। রেমিট্যান্স সম্ভব নয়। স্টাফ নেই। যার বাড়ি হাওড়া, বন্যা বিধধস্ত এলাকা থেকে তিনশো কিলোমিটার দূরে সেও চলে গেছে ঘর বাড়ি রক্ষার দায়ে। যার বাড়ি জলপাইগুড়ি সেও চলে গেছে। বারোজন স্টাফের সবেধন নিলমনি তিনজন পড়ে আছে। লাগে টাকা দেবে এই গৌরী সেন।
আর আছে হীনগতি খোঁড়া ক্যাশপিয়ন গৌর। তার বাড়ি হরিপাড়া। খুঁটোয় বাঁধা নিরুপায়। বেচারি! সে আর যাবে কোন চুলোয়? অগত্যা গৌরকে সঙ্গী করেই বেরুতে হবে অধম এই গৌরী সেনকে।
ম্যানেজারবাবু হাঁ হাঁ করে উঠলেন, -আপনি ডেপুটি ম্যানেজার। অফিস বস। আপনি কোথায় বেরুবেন? এই বিপদে আপনার বেরুনো চলবে না। যে কোনো মুহূর্তে ব্যাঙ্ক লুটপাট হয়ে যেতে পারে। কোথায় যেতে হবে বলেন, আমি যাচ্ছি।
ম্যানেজারবাবু বেরুলে ফল কী হবে আন্দাজ করে, ফোন করলুম পুলিশে । ফোন বিকল। কাছেই থানা। অগত্যা ক্যাশিয়ারবাবু এবং গৌরের সাহায্যে মেন গেট বন্ধ করে দিলুম। ম্যানেজারবাবু সার্কুলার রেফারেন্স দিয়ে জানালেন,কাষ্টমার্স আওয়ার্সে গেট বন্ধ করা বেআইনি।
বললুম –আমিই বেরুবো। আপনার নিরাপত্তার জন্যে এই বে-অফিসি ব্যবস্থা।
কোনো উত্তর নেই। লুটপাটের দায় এড়াতে, তিনি বেরিয়ে পড়তে চেয়েছিলেন।
ম্যানেজারবাবুর থোঁতা মুখ ভোঁতা। বসের আদেশ অমান্য করে ছাতা মাথায় এবং খোঁড়াগৌরকে সঙ্গী করে বেরুলাম। প্রথমেই থানা অভিযান। বড়োবাবুর হাতে পায়ে পড়ে দু’জন বন্দুকধারী, একজন লাঠিয়াল পেয়ে গেলুম। বন্দুকধারী দুজনকে ব্যাঙ্কে পাঠিয়ে, লাঠিয়ালকে পেছনে জুড়ে ছাতা মাথায় চললুম তিনজন। পিট পিটে বৃষ্টিও চলেছে আমাদের সঙ্গে। হরিপাড়ায় যদু সিংহরায়-টাটা, রাম বিশ্বাস-গোয়েঙ্কা, এবং ভবহরি বিড়লাদের বাড়ি বাড়ি চলেছি। এঁরা টাকার কুমির। বিনয়ের অবতার সেজে, ঘাড় হেঁট করে, হাত জোড় করে ওদের কাছে ভিক্ষে চাইতে। ভিক্ষে চাওয়া অভ্যেস আমাদের। ওদের কেঊ কেউ তুড়ি মেরে দু’একদিন ব্যাঙ্ক চালিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন। সরকারি মাথা টাটা বিড়লার কাছে মুড়িয়ে দেবো, এ নতুন কিছু নয়, লজ্জারও কিছু নয়। আর গেলাম জে সি আই ম্যানেজারের কাছে। তার কাছেও অসময়ে টাকা পেয়েছি। কাকুতি মিনতি করে যা পেলাম হিসেব করে পেমেন্ট দিলে দিন দুয়েক চলে যাবে।
অফিসে ফিরে দেখি, ম্যানেজারবাবু নেই। উঁকি মেরে ক্যাশিয়ারবাবুকে পাওয়া গেলো সেই ক্যান্টিন ঘরে। ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে এক মিনিটের পথ ক্যাশের খাঁচায় এলেন পনেরো মিনিট হেঁটে। এবং দীর্ঘ পথশ্রমে ক্লান্ত ক্যাশিয়ারবাবু জানালেন, ব্যাগে কাগজপত্র গুছিয়ে ম্যানেজারবাবু নদিয়া চলে গেছেন। এইমাত্র খবর এসেছে ওনার ফ্যামিলি বিপদগ্রস্থ।
বুঝলাম, রেডি হয়েই ছিলেন। ফাঁক পেয়ে য পলায়তি স জীবতি।
৪
থম মেরে দাঁড়িয়ে গেলাম জানালার রড ধরে। বৃষ্টি থামেনি। হারাধনের চারটি ছেলে, রইলো বাকি তিন! কিন্তু দিনমান উজ্জ্বল হয়েছে। বাতাসও হালকা লাগছে। চাপমেঘও ভেঙে টুকরো। দমধরা আকাশ পরিষ্কার হওয়ার লক্ষণ। আকাশের দিকে তাকিয়ে সবাই শ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করছে, আর মানাচোনা করছে।
-আর না দেওয়া, ধরন দাও।
আকাশের সাথে গুমোট ধরা মানুষের মনও শুকোতে চাইছে। টাকার সংস্থান কিছু হয়েছে। ব্যাঙ্কে পুলিশ মোতায়েন করা গেছে। এমন সময় স্যারের চলে যাওয়াটা ভীষণই শত্রুতা মনে হলো। কিছুতেই ভুলতে পারছিনে, বিডিও, পুলি্শ, পঞ্চায়েতপ্রধানের সাহায্য নিয়ে তিনি বিপদ সংকুল হরিপাড়া এবং নিজেকে উদ্ধার করার জন্যে ডেপুটি ম্যানেজারকে বন্যার স্রোতে ধাক্কা মেরে গেলেন। অতঃপর ছাগলের শিংএ পা রেখে ধূর্ত ম্যানেজারের দ্রুত পলায়ন। খানিক বিমূঢ বিস্ময়ে হতবাক পৃথিবী দেখছিলাম। গায়ে গু মাখলে যমে ছাড়বে না। বিমূঢ হওয়ার সময় নেই। দেওয়ালে নোটীশ ঝুলিয়ে দিলাম, দু’হাজারের বেশি টাকা কাঊকেই দেওয়া হবে না। সন্ধে রাত যাই হোক, টাকা থাকলে, বেলা দু’টো পর্যন্ত যারা লাইনে দাঁড়াবেন প্রত্যেককেই দেওয়া হবে।
ক্যাশিয়ারবাবুর কাউন্টারের সামনে থেকে লাইন দাঁড়িয়ে গেলো হরিপাড়া বাজার ছাড়িয়ে ‘হক মিষ্টান্ন ভান্ডার’ পর্যন্ত। নুরুহকের মিষ্টি বিনি পয়সায় খেয়ে গোঁফ মুচড়ে পুলিশ লেগে গেলো লাইন তদারকিতে।
লোকাল যোগানের টাকা দু’দিনেই ফতুর। আবার কোলাপ্সিব্লগেট বন্ধ। বিকেল, সন্ধে, মাঝ রাতেও বেজে উঠছে কোলাপসিবলের ঝনঝন শব্দ, টাকা চাই, টাকা।
-টাঙুন থিকা টাকা আনা করান।
করানতো বটে, যাবে কে? কোন পথে? টাঙুনে যাওয়ার একটাই রাস্তা, বন্ধ। আসার সময় দেখেছি চরের মতো জেগে থাকা পথে পলিথিনতাঁবু ছড়াছড়ি। বন্যার্ত মানুষেরা পেটে গামছা উবু হয়ে বসে আছে খোলা আকাশের নীচে। শূন্য ভাগাড়ে ঝাঁক ঝাঁক শকুনের মতো মানুষে মানুষে ছয়লাপ।
-উপায়, ক্যাশিয়ারবাবু?
-কী হবে গৌর?
আমরা তিনজন, তিনজন থানার সেপাই , ব্যাঙ্ক বন্দী, নজর বন্দী, জল বন্দী। ছ’জন প্রাণী, মুখ চাওয়ি করছি। উপায়?
বন্ধ কোলাপসিবল বাজছে, ঝনঝন ঝনঝন। টাকা চাই, টাকা।
-টাকা নাই, টাকা নাই। পালাবার পথ নাই, নাইরে.. যম আছে পিছে।
রেমিট্যান্স সেন্টারে টাকা পাঠাবার আর্জি জানালাম। বহরমপুর খবর পাঠালো, বিপদ সংকুল পথ, যে কোনো জায়গায় লুটপাট হয়ে যেতে পারে, ( হতে পারে না, খবর পাচ্ছি, হচ্ছে।) তাঁরা কেউ টাকা দিতে আসবে না, নিজের দায়িত্বে আনতে হবে। প্রথমদিন টাকা পাওয়ার পর দেখেছি, আশা সত্যি হলে, ক্ষুধার্ত মানুষও লাইনে দাঁড়িয়ে থাকে। শৃঙ্খলার সঙ্গে ঘন্টার পর ঘণ্টা ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করে। এ্যাকাউন্টে হাজার হাজার টাকা থাকলেও প্রতিবেশীর কথা ভেবে দু’হাজার টাকা সমবন্টনে রাজি হয়। এই সব মানুষের কাছে কৃতজ্ঞ আমি। তাঁদের কাছে দেওয়া
কথা রাখার জন্য আমাকে রেমিট্যান্সে যেতেই হবে। একান্ত নিজের নিরাপত্তার কারনে, বুভুক্ষু এই সব মানুষের কাছে চুন-কালি মাখার কোনো মানে হয় না। জানি, পথে বুভুক্ষু, মরণ মুখি বেপরোয়া মানুষেরা। শেখবাগানের ডাকেতেরা উঁচুপোঁতায় কদমফুলির কাছাকাছি উঠে এসেছে। চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, চাকরী যাওয়ার ভয়, জেলে যাওয়ার ভয়, প্রাণের ভয়ের সামনে টান টান হয়ে দাঁড়িয়ে গেলো কয়েকটা কথা। যার শক্তি প্রাণের ভয়ের চেয়ে বেশি। সে আমার নিজেরই উচ্চারণ।
৫
-কেউ হতাশ হবেন না। শনিবার বারোটা, অন্যদিন বেলা দু’টো পর্যন্ত লাইনে যতোবার দাঁড়াবেন দু’হাজার করে পাবেন। সন্ধে হোক, রাত্রি হোক টাকা পাবেন।
লঙরখানা থেকে খিচুড়ি এসেছিলো খেয়েছি। ঘুম আসছে না। অফিসঘরে টেবিল জোরা দিয়ে শুয়ে আছি, মাত্র দু’জন। আমি চিৎ। পাশে ক্যাশিয়ারবাবুর টেবিল। তিনি কাত। বিদ্যুত এখনও বিপর্যস্ত। শুনশান অন্ধকার। আর কেঊ নেই। তিনজন পুলিশেরও মায়া পড়ে গেছে আমাদের উপর। সময়ের হিসেব চুলোয় দিয়ে কাল ভোরেই ডিউটিতে হাজির হয়ে যাবে। খোঁড়াগৌর লেংচে লেংচে সর্বক্ষণ পিছন পিছন ঘুরে বেড়াচ্ছে। দূর্যোগে জটিল মানুষ ক্যাশিয়ারবাবুও সরল নরম হয়ে গেছেন। সমস্ত ঝক্কি ঝামেলা সহ্য করে বিস্বস্ত সৈনিকের মতো হরি পাড়ার মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে গেছেন। উনিও যে কোনো মুহূর্তে কোনো না কোনো কৌশলে ধূর্ত শেয়াল হয়ে যেতে পারতেন। কিন্তু আশ্চর্য, হ’ননি! মানুষের বিপদে মানুষই বোধহয় এমন বদলে যেতে পারে। পাশ ফিরে বললেন – স্যর, আপনি রেমিট্যান্সে যাবেন না। রাস্তার অবস্থা একদম ভালো না। কাল নোটিশ দিন একশো লোককে দেওয়া হবে। একশো লোককে দেওয়ার মতো টাকা ভল্টে আছে। বিকেলে না হয় আর একবার টাটা বিড়লাদের কাছে যাবেন।
কটকট কটকট.. ..
অফিসের নীচে, পিছন দিকে বাঁশ ঝাড়। ওদিক থেকে বিশ্রী একটা আওয়াজ আসছে। বেশ কিছুক্ষণ অন্তর শব্দটা হচ্ছে। দিনেরবেলাও শুনেছি। মনে হয়েছিলো বাতাসে বাঁশঝাড়ের কারসাজি। তখন কিছু মনে হয়নি, এখন ফাঁকা শুনশান রাত্রি। বড্ড কানে বাজছে। দু’দিন ধরেই শুনছি। যেনো কিছুর আর্তনাদ। কেউ যন্ত্রণা দাঁতে দাঁত চেপেও ঢেকে রাখতে পারছে না। এই দূর্যোগে শব্দেরাও স্বাভাবিক নয়। চেষ্টা করেও চিনতে পারলুম না। বললুম- সে হবে না। মানুষের গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। এখন থুতু দিয়ে চিঁড়ে ভেজানো যাবে না।
কটকট কটকট..
- আচ্ছা ক্যাশিয়ারবাবু, ওটা কিসের শব্দ?
-কে জানে? ক্যাশিয়ারবাবু বললেন - সবচে’ ভয় কদমফুলির চরে। ডাকাতগুলো খেতে না পেয়ে হন্যে হয়ে আছে।
বললুম -আপনি গেট বন্ধ করে ভিতরে থেকে যাবেন। আমি একটা প্ল্যান এঁটে ফেলেছি। সিংহরায়বাবুর গ্যারেজে জল ঢুকে ওনার এ্যাম্বাসাডর বিকল। ছ’চাকার লরিখানা দিতে রাজি হয়েছেন। লরি থাকবে কদমফুলির এপারে। ওপারে আটকে থাকা রামবাবুর ম্যাটাডোরখানা পেয়ে যাবো।
ভজহরিবাবুর ডানহাত সোনা ঘোষ থাকছে সঙ্গে। ভজহরিবাবুই পাঠাতে রাজি হয়েছেন। সোনা ঘোষ একাই একশো। থাকলে, হরিপাড়া থেকে বহরমপুর যেখানে খুশি বিশ পঞ্চাশ মানুষ হাজির করে দেবে।
জলপথটুকু ঘুরে ঘুরে নৌকোয় মেরে দেবো। জলে ডাকাতির খবর এখনও পাওয়া যায়নি। বহরমপুর ব্রাঞ্চ বলেছে দু’জন পুলিশের ব্যবস্থা করে দেবে। ভজহরিবাবু, রাম বিশ্বাস, সোনা ঘোষ এক একজন রাজনৈতিক চাঁই। সবাই মিলে যখন সাহায্য করতে রাজি হয়েছেন। আশা করি, পলিটিকাল কালার থাকবে না।
ক্যাশিয়ারবাবুর গলায় ঘুম জড়িয়ে আসছে। বললেন -সোনা ঘোষ লোকটাকে আমার ঠিক পছন্দ নয়। দেখবেন স্যর, চাকরী নিয়ে টানাটানি না
হয়?
কটকট কটকট…
- রাম বিশ্বাস চেয়েছিলেন, এলাকার চার রাজনৈতিক দলেরই ফ্ল্যাগ টাঙিয়ে কাজটা সারতে। রাজি হইনি।
-ভুলে যাবেন না স্যর, আপনার একটা সংসার আছে। দুটো বাচ্চা আছে। বড্ড রিক্স নিচ্ছেন। কিছু হলে বৌদি .. ..
কটকট কটকট…
শব্দটা রাতেরবেলা বাড়ছে।
৬
অফিসের পিছনে সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় চোখে পড়েছিলো, বাঁশঝাড়ের গোড়ায় ডোবাটা ভেসে গেছে। পাশে একটা মাটির ঘর, খড়ের চাল। ওটাতে জল ঢুকে পড়েছে। ঘরে-বাইরে বন্যার সোঁত বইছে। শক্ত হলুদ টনটনে দেওয়াল ভিজে গাঢ়োকালো। দু’টো কচি বাচ্চা নিয়ে একজন ভিখিরি মা, এই ঘরে থাকে। দেখেই বুকের ভিতর ছ্যাঁৎ করে উঠলো। যেনো বুকের ভিতরে বন্যার স্রোত ঢুকে পড়লো। ভিতে জল বসে ঘরখানা একদিকে কাত হয়ে গেছে। যে কোনো মুহূর্তে হুড়মুড় করে ভেঙে পড়বে। ওরা নিশ্চয় জল ঢোকার রাতে পালিয়ে যেতে পেরেছিলো! কিংবা হারিয়ে গেছে অথবা ভেসে গেছে! যেখানেই থাক, বেঁচে থাক। শূন্যঘর পড়ে থাকে থাক, একদিন ভরে উঠবেই।
কটকট কটকট..
শব্দটা ওই ঘরের ভিতর থেকে আসছে। মা না থাকলে, যখন খিদে পেতো, হাত ধরাধরি করে ভিখিরির বাচ্চাদুটো মাঝে মাঝেই হানা দিতো অফিসে। ওদের চিনি। আমার ছেলেদুটোর বয়সী হবে। দশ পয়সা বিশ পয়সা কেউ দিতো, কেঊ দিতো না। হাতের কলম তুলে কেউ ছেই করতো। পাশের কলিগকে কানকি মেরে কেউ আমার টেবিলে ঠেলে দিতো। আমি নাকি অফিসের বাবা।
আদুল গা। বড়োটা নেংটি পরা, ছোটোটা ল্যাংটো। মুখ দুখানা খিদের হাসিতে ভরা। টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে থাকতো চুপচাপ। কিছু চাইতো না।
রেমিট্যান্সে যাচ্ছি, মন শক্ত রাখা দরকার, এসব আজেবাজে ভাবলে চলবে না। অসময়ে বুকের ভিতর একগাদা ফালতু জল ঢুকে পড়লো। হৃদপিন্ডের চারপাশ স্যাঁতসেতে লাগছে। এখন প্রতিমুহূর্তে সচেতন থাকতে হবে। জলেজলাকার চারদিক, অভাবে স্বভাব নষ্ট মানুষের ছড়াছড়ি। কোথায় কী বিপদ ওত পেতে আছে, প্রতিটা পা মাপতে মাপতে যাওয়া উচিত। মনে করতে চাই না, তবু দুম করে মনে পড়ে যায়। বুকের ভিতর সোঁত পাক দিয়ে ওঠে। অকুল জল-যাত্রা! এক ত্রিপল খাটানো দ্বীপে তন্ডুল শূণ্য তিনটি প্রাণী...। দুটি কচি হাতের উল্টো দিকে ঢাকা মুখ। আঁচলের খুঁট দাঁতে চেপে দাঁড়িয়ে থাকা আর একটি অসহায় প্রাণী। নৌকো ভেসে যাচ্ছে। বেয়াড়া ভাবনা কিছুতেই রেহাই দেয়না। ট্রেনিংএ আমাদের শেখানো হয়, সবসময় ব্যাঙ্কম্যানদের এক পা অফিসে আর এক পা জেলে। সংসার থাকলেও পা রাখতে নেই। রাখতে চাইছিও না। মাসের বাজার করা হয়নি। দেখে এসেছি, ঘরে চাল নেই। ডাল নেই। বন্যা ভেজা আলসেয় কাঁকড়াবিছে ঘুরে বেড়ায়। ভয়ে বউ দু হাত তুলে আর্তনাদ করে। দুপুর হলে ছোটো ছেলেটার খুব খিদে পায়। বড়োছেলেটা সহ্য করতে পারে। কাঁদে না। আঁচল দিয়ে মার কান্না মুছিয়ে দেয়। ভাবনাটা খুব বেয়াদপ। অফিসের নিয়ম ভেঙে তবু মাথার চারপাশে ঘুরঘুর করছে। শুধুমুধু বুকের ভিতর কটকট করে ওঠে।
হরিপাড়া বাজারের বুড়ো ফেকুদর্জি বলেছিলো –বন্যায় জল বসে ভেঙে পড়ার আগে মাটির ঘরের বাঁধন সব কাঁদতে থাকে। তখন কটকট শব্দ হয়। ঘরের আড়ায় যতো বাঁশ, চালা, চটা, খুঁটি, আছে ঘর থেকে আলগা হতে থাকে। বাঁধন কাটতে না পেরে দু’একটা চটা, বাঁশের খুঁটি ফাটতে থাকে। দু’তিন দিন এমন কি পাঁচ সাত দিন এই রকম অনাসৃষ্টি শব্দ হয়। তারপর একদিন ধুপ করে ভেঙে পড়ে। নাও পড়তে পারে। পড়তে পড়তে বেঁকেচুড়ে ত্রিভঙ্গ হয়ে যদি দাঁড়িয়েও যায়। তবে সে কালে ভাদ্রে। সে ঘর কোনোদিন সোজা হয় না। ভেঙে ফেলতে হয়। মনে হলো বাঁধনতো নয়, মায়ার বাঁধন। কাটছে। কানের ভিতর নয়, বুকের ভিতর যেখানে জলের সোঁত বইছে, যেনো ঘরখানা আর একবার শব্দ করে উঠলো।
কটকট কটকট।
যেখানে বাঘের ভয় সেখানে সন্ধে হয়। কদমফুলি পর্যন্ত ভালোয় ভালোয় ফিরে এসেছি। নৌকো থেকে মাল-পত্র ফের নির্বিঘ্নে লরিতে উঠে গেছে। প্রাণ ভরে শ্বাস নিতে গিয়ে দুম করে দম আটকে গেলো বুকে। কদমফুলি থেকে স্টার্ট নেওয়ার সময় লরি আর নড়ছে না। সর্বনাশ! লরিতে টাকার ডাঁই। ছোটো পেমেন্ট দেওয়ার জন্য, ছোট ডিনোমিনেশানস নিয়েছি। সিটের উপরে নীচে বাক্স ভর্তি টাকা। বসার জায়গা নেই। পাশেই কদমফুলির চর। ক্যাশিয়ারবাবুর কথা মনে পড়ে গেলো। বুভুক্ষু ডাকাতদের আস্তানা। বুক কেঁপে উঠলো। সঙ্গে সঙ্গে বুকের খাঁচা, কলজে সমেত মেরামত করে ফেললাম। অস্থির হলে চলবে না। অনেক লড়তে লড়তে আসছি। দমও ধরে রেখেছি। আর কয়েক মাইল, ঠিক পৌঁছে যাবো। তবু মনে হচ্ছে সাহসের গোড়াটা আর আগের মতো জমাট নেই। কদমফুলির চর এখন ভয়ঙ্কর এলাকা।
৭
দূরে একটা আমবাগান দেখা যাচ্ছে। ওখানে মাটি জেগে আছে। অগুন্তি কালো কালো পলিথিল তাঁবু। পিলপিল করছে মানুষ। ওটাই সেই চর। একটা লঙরখানা। খাওয়া দাওয়া চলছে। মনে হচ্ছে, ভালো মানুষদের ভীড়ে, তিনারা ওখানেই আস্তানা গেড়েছেন। বিডিও সাহেব, থানার বড়োবাবু খুব ভালো করেই জানেন, লঙর খাইয়ে ওদের পেট ঠান্ডা না রাখলে হরিপাড়া, অরূপপুর, জামতলা ডাকাতিতে লোপাট হয়ে যাবে। টাটা বিড়লারাও রেহাই পাবেন না। রামদা, ভজহরিবাবুরা এটা ভালোই বোঝেন। নিজেদের বাঁচার তাগিদে মহাপুরুষ হয়ে শুনেছি, লঙরখানা চালাচ্ছেন ওরাই।
সোনাদা খুব স্বার্থপর। এই সব মানুষের উপর নির্ভর করা বোকামি। কোথায় পাশে পাশে থেকে ভরসা দেবে, তা নয়। কিছু না বলেই টাকা ভর্তি লরি ফেলে চলে গেলো লঙরখানার দিকে। ডাকাতদের, নাকি নিজের পেট সেবা করতে, কে জানে? দু’জন পুলিশ আর আমি পড়ে রইলাম। বৃষ্টি পড়েই চলেছে। ভিজছি। ভয়ে না কি ঠান্ডায় কেনো যে কাঁপছি! জানি না। ড্রাইভার লরির নীচে কাদায় শুয়ে শুয়ে অনন্ত কাল ধরে খুটুর খুটুর করেই চলেছে। টাকা ছেড়ে নড়তেও পারছিনে। এই বুঝি লুট হয়ে গেলো। মাথা কাজ করছে না। সোনা ঘোষ লোক পাঠিয়ে ড্রাইভারকেও ডেকে নিয়ে গেলো। যাঃ! বুকের বাঁ দিকটা চিনচিন করে উঠলো। লরির নীচ থেকে যখন বেরিয়ে এলো, দশাসই ড্রাইভার, হাতে একখানা লোহার রড। মনে হয়েছিলো, দু পাঁচটা ডাকাতের মহড়া নিতে পারবে। ওকেও সরিয়ে নিলো। যদি কিছু হয়, সোনা হারামির জন্যেই হবে। কাঠির মাথায় আলুর দমের মতো পুলিশ দুটো বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে ঘুমুচ্ছে। কেউ যদি চোখ মোটা করে তাকায়, ল্যাঙপেঙে পুলিশ শুদ্ধু পেচ্ছাব করে ফেলবো। মাথায় বাক্স নিয়ে ড্যাং ড্যাং করে চোখের সামনে দিয়ে ডাকাতরা চলে যাবে। খুন করে গেলেও কেঊ দেখার নেই। পলিটিক্যাল নেতাদের ভরসায় রিক্স নিয়ে বড্ড বাড়াবাড়ি করে ফেলেছি। কাজটা যেমন বে আইনি, সাদা চোখে তেমনই আহাম্মুকি। তবে যতো বড়ো জোয়ানমদ্দই হোক দু’চারজনের পক্ষে টাকা নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। বাক্সদুটো চেন তালা দিয়ে আচ্ছা করে লরির গ্রীলে আটকানো। চাবি আমার কাছে। মরে গেলেও দিচ্ছি না। দরকার হলে কদমফুলির জলে ফেলে দেবো।
কিন্তু এখন উপায়?
কোত্থেকে এক এঁচোড়েপাকা ছোকরা এসে কিনা বলে - ম্যানেজারবাবু, বেলা গড়িয়ে যাচ্ছে, হাতে মুখে জল দিয়ে চাড্ডি খেয়ে নিন!
ইয়ার্কি হচ্ছে? কণ্ঠায় প্রাণ এসে ঠেকে আছে। কলাগাছকেও ডাকাত ভাবছি। খাওয়ানোর নাম করে ডাকাতির সুলুক নিতে এসেছে! টিকটিকি কোথাকার! হুঙ্কার দিয়ে উঠলাম,
–কে? কী চাই? ভাগো হিঁয়াসে।
ছেলেটি আমতা আমতা করে বললে –সোনা ঘোষ আমাকে পাঠালে।
দলেরম্যাড়া রামদা পই পই করে দিব্যি দিয়ে পাঠিয়েছে , রাস্তায় উল্টোপাল্টা কিছু হলে যেনো বেগোরবাঁই না করি। সোনা ঘোষ যেমন বলবে, অক্ষরে অক্ষরে চলতে হবে। মহা মুশকিলে পড়া গেলো। খিদে ফিদে কিছু নেই। টাকা ছেড়ে নড়া যায় না। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে তিনজন শালপাতায় দু’চার গ্রাস খেয়ে নিলাম। খিচুড়ি গলায় আটকে রইলো। পেট পর্যন্ত নামলো না।
পালাতে পারলে বাঁচি। ছোকরা সরেজমিনে কী তদন্ত করে গেলো, সেই জানে। শেষ পর্যন্ত সোনা ঘোষ, ড্রাইভার ডাকাতদের দলে ভিড়ে গেলো নাতো?
লঙরখানার দিক থেকে একদল ডাকাত হারে রে রে করে ছুটে আসছে। যাঃ, সব শেষ হয়ে গেলো। রামদা, সিংহরায়বাবু তোমাদের মনে এইছিলো? আনাড়ির বাচ্চা আমি। কী করি! ধুকপুকটুকু ছিঁড়ে না নিলেও আতঙ্কে বুক ফেটে যাবে।
অকস্মাৎ চিৎকার করে উঠলুম।
-ফায়ার।
কোথায় পুলিশ! স্বধর্মে লুকিয়ে পড়েছে কোথাও! যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলো, হাওয়া খেলা করছে। কপাল ভালো, গলা শুকিয়ে কাঠ। মুখ দিয়ে কোনো স্বর বেরোইনি। ভাগ্যিস, পুলিশরা পালাতে জানে। নইলে খুনের দায়ে পড়ে যেতাম।
৮
হাড় জিড়জিড়ে কতোগুলো না খেতে পাওয়া মানুষ, কুঁজো, পরনে ত্যানা, বুকের হাড় কলজেতে ঠেকেছে, এসেছে লরি ঠেলতে। একদল খেতে না পাওয়া মানুষ আর একদল না খেতে পাওয়া মানুষের টাকা পৌঁছে দিতে, বন্যা বন্যা ভাই ভাই। জাতভাইদের দু’মুঠো খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে।
ও,হরি! এদেরকে আমরা ডাকাত বলি! মানুষ চিনতে এতো ভুল! আর একটু হলে কেলেংকারি ঘটিয়ে ফেলেছিলুম। একদল বন্যার্ত মানুষ হাত লাগালো লরির পিছনে।
-হেঁইয়ো মারি কলের গাড়ি
-কল চলেছে তাড়াতাড়ি।
-শ্বশুরবাড়ি, শ্বশুরবাড়ি।
লরি চলতে শুরু করলো। বুকে হাত রাখলাম। নিশ্বাস বইতে শুরু করেছে। মনে হচ্ছে এ যাত্রা বেঁচে গেলুম। এই সেই মানুষেরা যাদের ভয়ে হাত পা অবশ হয়ে আসছিলো। মাটির ভিতর পুঁতে যাচ্ছিলুম।
-হরিপাড়াব্যাঙ্ক মায় কি!
-জয়।
পাক্কা দু’মাইল রাস্তা বন্যার্ত মানুষের হাতে ঠেলা খেয়ে বাক্স ভর্তি টাকা পৌঁছে গেলো, ব্যাঙ্কের নীচে। বৃষ্টি ধরন দিলেও। চারদিকের জল ঠেল ধরেছে। হরিপাড়ার এই জায়গাটা নিচু নয়। তবু জল এখনও বাড়ছে। যাওয়ার সময় পায়ের গোছ পর্যন্ত জল পার হয়ে লরিতে উঠেছিলুম। এখন হাঁটু জল। বাঁশবাগানের নীচে ঘরখানায় জানলার খুপরি পর্যন্ত জল উঠে গেছে। ব্যাঙ্কে ঢুকে দু’হাত কপালে তুলে মনে মনে বললুম –জয় বন্যার্ত মানুষের জয়।
কেঊ শুনতে পেলো না। কোনোদিন শুনতে পাবেও না। কারন এ জয় বে-আইনি জয়। যারা জেনে গেছেন চেপে রাখুন । আমি এই জয়ের কথা কাঊকে বলতে পারবো না। এই জয়ধবনি শুনতে পাবো আমি একা। আমার বুকের ভিতর। যতদিন বাঁচবো, বেঁচে থাকবো, মাঝে মধ্যে হাঁক দিয়ে উঠবে –জয় বন্যার্ত মানুষের জয়।
স্ট্রং রুমে টাকার হিসেব মিলে গেলো। ভল্টে টাকা ঢুকিয়ে যখন উঠে দাঁড়ালাম, কোমর টনটন করে উঠলো। শিরদাঁড়া, পায়ের শিরা উপশিরা ব্যথায় ফেটে পড়ছে। শরীরের ভিতর কেমন পাক মেরে উঠলো। একটা চোঁয়া ঢেঁকুর মেঘের মতো ডাক ছাড়লো। গলা বুক জ্বলছে। গোটা বন্যার জল এ্যাসিড হয়ে বুকের ভিতর ঠেল ধরেছে। বুঝলুম, খিচুড়ি খাওয়ার পর জল খাওয়া হয়নি।
অকস্মাৎ হুড়মুড়, বিশাল শব্দ হলো। একটা আর্তনাদ গোটা ব্যাঙ্কখানাকে কাঁপিয়ে দিলো। একটা বিশাল জলচ্ছ্বাসের ধাক্কা এসে লাগলো ব্যাঙ্কের বাড়িতে। বাড়ির দেওয়াল ফুঁড়ে আমার বুকে। কুঁড়েঘরখানা ভেঙে পড়লো। ছ’দিন ধরে একটা সংসার ভেঙে পড়তে পড়তে আজ জলস্যাৎ হয়ে গেলো। নাকি মাথা ঘুরে পড়ে গেলাম। চারপাশের হাওয়া বাতাস, ছবি ঝাপসা হয়ে এলো। কচি কচি দুখানা হাত বাতাসে দুলছে। শুনতে পেলাম কারা যেনো ডাকছে –বাবা.. বাবা বা.. ..
1 মন্তব্যসমূহ
এক অসাধারণ গল্প।
উত্তরমুছুন