শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের গল্প -তোমার উদ্দেশে


"In search of you, in search of you....

ওইখানে তুমি থাকো। ওই সাদা বাড়িটায়, যার চূড়ায় শ্বেতপাথরের পরিটাকে বহু দূর থেকে দেখা যায়! নির্জন তোমাদের ব্যালকনি, বড়-বড় জানালায় ভারী পরদা ঝুলছে, দেয়ালে লাগানো এয়ারকুলার। মসৃণ সবুজ লনে বুড়ো একটা স্প্যানিয়াল কুকুর ঘুমিয়ে আছে।

পরিস্কার বোঝা যায়, এসব এক পুরুষের ব্যাপার নয়। জন্মের পর থেকেই তুমি দেখেছ খিলান-গম্বুজ, বড় ঘর, ছাদের ওপর ডানা মেলে-দেওয়া পরি-যা কেবলই উড়ে যেতে চায়। যায় না।

বিকেলের রাস্তায় ক্কচিৎ চোখে পড়ে কালো যুবতী আয়া মন্থর পায়ে প্র্যাম ঠেলে নিয়ে চলেছে কদাচিৎ দু-একজন ভবঘুরে লক্ষহীন চোখ চেয়ে হেঁটে যায়। বড় সুন্দর অভিজাত নিস্তব্ধতা তোমাদের তাই যদিও আমার পথে পড়ে না, তবু আমি মাঝে-মাঝে তোমাদের এই নির্জন পাড়ার রাস্তা দিয়ে ঘুরপথে যাই।

আজ দেখলুম তোমাকে। তুমি একা হেঁটে যাচ্ছিলে।

যখন ক্কচিৎ কখনও তুমি এরকম হেঁটে যাও, তখনই বলতে কি তোমার সঙ্গে এক সমতলে তোমার দেখা হয়। আজ যেমন, নইলে মাঝে-মাঝে তোমাকে দেখি তোমাদের মভ রঙের মোটর গাড়িতে হু-হু করে চলে তোমাদের পুরোনো মোটর গাড়িটার কোনও গোলমাল ছিল কি আজি! কিংবা নিকেলের চশমা চোখে তোমাদের সেই বুড়ো ড্রাইভারটার।

অনেকদিন দেখা হয়নি। দেখলুম। এই শীতকালে তুমি বেশ কৃশ হয়ে গেছ। সাদা শাড়ি পরেছিলে, তবু কচি সন্ন্যাসিনীর মতো দেখাচ্ছিল তোমাকে। সুন্দর অভ্যাস তোমার-শাড়ির আঁচল ডান ধার দিয়ে ঘুরিয়ে এনে সমস্ত শরীর ঢেকে দাও, মুখ নীচু করে হাঁটাে-যেন কিছু খুঁজতে খুঁজতে চলেছো। নাকি পাছে কারও চোখে চোখ পড়ে যায়, সেই ভয়েই তোমার ওই সতর্কতা। ওরকম মুখ নীচু করে যাও বলেই বোধহয় তুমি কোনওদিন লক্ষ করোনি আমায়। আজকেও না।

মোড়ের মাথায় রঙ্গন গাছের ছায়ার যে লাল ডাকবাক্সটা আছে তুমি সেটা পেরিয়ে গিয়ে বাঁক নিলে। তোমাকে আর দেখা গেল না। এত কাছ দিয়ে গেলে আজ যে, বোধহয় তোমার আঁচলের বাতাস আমার গায়ে লেগেছিল। ইচ্ছে হয়েছিল একটুক্ষণের জন্য তোমার পিছু নিই। নিলুম না। কেননা ফাঁকা রাস্তার মোড় থেকে বেঁটে, মোটাসোটা কালো টুপি পরা লাল ডাকবাক্সটা স্থির গভীরভাবে আমার দিকে চেয়ে ছিল। মনে হচ্ছিল তোমার পিছু নিতে গেলেই সে গটগট করে হেঁটে এসে আমার পথ আটকাবে।

একটু আগে আমি ওই মোড় পেরিয়ে এলুম। বাঁক ছাড়িয়ে কিছুদূরে এক গাড়িবারান্দার তলায় দেখলুম জটলা করছে। পাড়ার বখাটে ছেলেরা। বড় রাস্তাতেও রয়েছে নির্বোধী পুরুষের ভিড়। একা ওইভাবে কোথায় যাচ্ছিলে তুমি? আমার কাছ থেকে তুমি যত দূরে আছ, সুরক্ষিত আছ, অনেকের কাছ থেকে কিন্তু তুমি তত দূর নও। আমি তাই অনেকক্ষণ ভাবলুম তুমি ঠিকঠাক চলে যেতে পেরেছিলে কি না।

তোমাদের পাড়া ছাড়িয়ে বড় রাস্তায় পা দিতেই কয়েকটা ভিখিরির ছেলেমেয়ে আমাকে ঘিরে ধরল। রুক্ষ চুল করুণ চোখ কৃশ চেহারা। লক্ষ করলুম একটি ছেলের মাথায় ঠোঙার মুকুট। একটি মেয়ের গলায় শুকনো গাঁদা ফুলের মালা। কাছেই ফুটপাতের কোথাও বসে এতক্ষণ বর-বউ খেলছিল বোধহয়। কিছু সময় তারা আমার পিছু নিল। ‘দাও না, দাও না।’ উলটাে দিক থেকে ধীর গতিতে হেঁটে আসছিল একজন পুলিশ। কাছাকাছি হতে হঠাৎ কি ভেবে সে তার হাতের ব্যাটনটা দুলিয়ে বলে, “ভাগ।” বাচ্চাগুলো পালিয়ে গেলে সে একবার আমার দিকে চেয়ে একটু তৃপ্তির হাসি হাসল। আমিও হাসলুম। বাচ্চাগুলো দূর থেকে চেঁচিয়ে বােধহয় আমাকেই বলছিল “ভাগ! ভাগ!”




রাত সোয়া ন’টায় সোমেনের পড়ার ঘরের পাশে হলঘর থেকে ওদের পুরোনো প্রকাণ্ড দেওয়াল ঘড়িটায় পিয়ানোর টুংটাং বেজে উঠল। আমি দাঁড়িয়ে হাই তুললাম। সোমেন তার বইপত্র গুছিয়ে রাখছিল।

চলে আসছিলুম, সোমেন ডাকল, “মাস্টারমশাই।'

'বলো।'

‘কাল সবাই বরানগর যাচ্ছি, মাসিমার বাড়ি। পড়ব না।'

“আচ্ছা।”

আর মাস্টারমশাই...” বলে ও লাজুক মুখে একটু হাসল।

‘কী হল?”

কথা না বলে ও ইঙ্গিতে হলঘরের দরজাটা দেখিয়ে দিল। হলঘর পেরিয়ে ওদের অন্দরমহল। আজ হলঘরটা অন্ধকার। মাঝে-মাঝে অন্ধকার থাকে। বললুম, “তুমি না এসো ও পি সি-তে বক্সিং করো! একটা অন্ধকার হলঘর পার হতে পারো না! বলতে-বলতে কাঁধে হাত রাখলুম। কিছুদিন আগে পৈতে হওয়ার পর মাথার চুল এখনও ছোট ছোট-আর দণ্ডীঘরের ব্রহ্মচর্যের আভা এখনও ওর সমস্ত শরীরে ফুটে আছে।

"এই ঘরে তোমার দাদু মারা গিয়েছিলেন না! বেঁচে থাকতে যিনি তোমাকে অত ভালোবাসতেন, মরার পর কি তিনি তোমাকে ভয় দেখাতে আসবেন?”

শুনে সামান্য শিউরে উঠল সোমেন। আমি ওর মাথায় হাত রাখলুম। কখনও যখন হােমটাস্কের খাতার দিকে ঝুঁকে থাকা ওর মনোযোগী মুখে টেবিল বাতির সবুজ ঢাকনার আলো এসে পড়ে, কিংবা যখন কখনও ভুলে যাওয়া পড়া মনে করার চেষ্টায় ও দাঁতে ঠোঁট চেপে, হাত মুঠো করে অসহায় চোখে টাল-মাটাল তাকায় তখন আমার কখনও-কখনও মনে হয়-এই সুন্দর, পবিত্ৰ ছেলেটি আমার। এই আমার ছেলে সোমেন-যার হাতে রাজ্যপাট দিয়ে খুব শীগগিরই একদিন আমি বানপ্রস্থে যাব।

আমি হলঘরের দরজার কাছে দাঁড়ালুম। সোমেন এক ছুটে অন্ধকার হলঘর পার হয়ে গেল।

আমাদের বাসার সদর দরজার ছিটিকিনিটা বাইরে থেকেই খোলা যায়। প্রথমে দরজাটা টেনে বন্ধ করো। তারপর ডানদিকের পাল্লাটা আস্তে-আস্তে চেপে ধরো। খুব অল্প একটু ফাঁক হবে। সেই ফাঁকে সাবধানে ঢুকিয়ে দাও বাঁ-হাতের আঙুল। এইবার আঙুলটা ডানদিকে বেঁকিয়ে দিলেই তুমি ছিটিকিনির মুখটা নাগালে পাবে। সেটা ওপরে তুলে ঘোরাও। তারপর ছেড়ে দাও। ঠিক করে ছিটিকিনি খুলে যাবে।

রাত সাড়ে দশটায় কৌশলে সদরের ছিটিকিনি খুলে, অন্ধকার প্যাসেজ পার হয়ে আমি ঘরে ঢুকলাম। বাতি জ্বলছে। মা'র বিছানায় মশারি ফেলা। মার জেগে থাকার কোনও শব্দ শোনা যায় না।

রান্নাঘরে আমার ভাতের ঢাকনা খুলে বেড়ালে মাছ খেয়ে গেছে। মা টেরও পায়নি। আজকাল বড় সহজেই ঘুমিয়েই পড়ে মা। বয়স হচ্ছে। কথা বলতে বলতেও হঠাৎ বুকের ওপর ঝুঁকে নেমে আসে মাথা। খেয়াল হতে চমকে জেগে উঠে। জিগ্যেস করে, "কী বলছিলাম যেন।' আমি হোসে বলি” কিছু না মা, কিছু না”

রান্নাঘরের জানালার একটি শার্সি ভাঙা। মেঝের ওপর ফোঁটা-ফোঁটা ঝোল, আর তার সঙ্গে এখানে-ওখানে বেড়ালের পায়ের ছাপ। ভাঙা শার্সিওলা জানালাটা পর্যন্ত গেছে। ভাতের পাশে কালচে আর মেরুন রঙের দুটাে তরকারি, হাতল ভাঙা কাপে হলুদ। ডাল! রাতে ঠাণ্ডা এই খাবারের দিকে চেয়ে মনে হয় মুখে দিলে বড় বিস্বাদ লাগবে।

খেয়ে ঘরে এসে একটা সিগারেট ধরাব, মা ঘুমের মধ্যেই আঃ” শব্দ করে পাশ ফিরল। ‘কে।”

‘আমি।”

মা চৌকির শব্দ করে উঠে বলল, “দেখ তো, একটা চিঠি এসেছে বিকেলে। চোখে ভালো দেখি না। দ্যাখো তো। কর্তার চিঠি মনে হয়।”

মশারির ভিতর থেকে হাত বের করে মা আমার হাতে চিঠি দিল, “জোরে পড়।”

কালচে রঙের পাকিস্তানি পোস্টকার্ডের ওপরে ইংরেজিতে লেখা-“কালী। তার নীচে পাঠ : ‘পরমকল্যাণবরেষু। বাবা রম, ইতিপূর্বে তোমার নিকটে কার্ডে পত্ৰ দিয়াছি তাহা পাইয়াছ কিনা জানাইও। তোমাদের চিঠি না পাইলে চাঞ্চল্য ও চিন্তা অত্যন্ত বাড়িয়া যায়, তখুনি অসুখ অশান্তি দেখা দেয়, সঙ্গে-সঙ্গে শারীরিক ও মানসিক অবস্থা খারাপ হইয়া যায়-চোখে ভালোরুপ দেখিতে পারি না বলিয়া নানারুপ জ্বালা যন্ত্রণা ভোগ করিতেছি। বর্তমান অবস্থা ব্যবস্থা দৃষ্ট প্রতীয়মান হয়, তাড়াতাড়ি কোনও কিছু না হইলে ব্যবস্থা ক্রমশ জটিল ও সঙ্কটাপন্ন হইবে। তোমার কাগজাত ঢাকা আসিলে অবশ্য খবর পাওয়া যাইত। অনিলের সহিত যোগাযোগ করিও। ওই সঙ্গে কলিকাতা পাকিস্তানি হাই-কমিশনার বরাবর দরখাস্ত দিয়া তাহাতে অনুমতি পাইবার ব্যাপারে রিকমেন্ড করাইয়া পাঠাইতে পারিলে সর্বাপেক্ষা ভালো হয়। কারণ এখানকার ডি আই জি হইতে পাওয়া অত্যন্ত কষ্টকর ও দুস্প্রাপ্য জানিবা৷...বলিয়াছিলাম, বরং মুসলমান হইব। তবু ভিটা ছাড়িব না।...অসুখে অত্যন্ত দুর্বল হইয়া পড়িয়াছি.তোমরা নিকটে না থাকায় অত্যন্ত অসহায় ও দুর্বল বোধ করি। মাইগ্রেশন সাটিফিকেট পাওয়া অত্যন্ত কঠিন ব্যাপার, রিকমেন্ড থাকিলে কাজের সুবিধা হইবে। দেরি হইলে আরও বৃদ্ধ ও অশক্ত হইয়া পড়িব...তোমাদের সহিত আর দেখা হইবে না। হিন্দুস্থানে মরিতে চাহি। তোমরা গুড়া কাকিমার মাথার কিচু বিকৃতি দেখা দিয়াছে—আজি চার-পাঁচ মাস যাবৎ নানারুপ চিকিৎসা চলিতেছে। সোনারপুরে আমাদের যে জমি তাহাতে অন্তত দুইখানি দুই চালা তোলার চেষ্টা করিও। বর্তমান যে দুঃসময় দেখা দিয়াছে তাহাতে মিতব্যয়ী না হইলে নিরুপায় হইবা। সাবধানে থাকিও ও মঙ্গল জানাইও। অন্যান্য এক প্রকার। ইতি আং তোমার বাবা।”

চিঠি শুনে মা কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর আস্তে-আস্তে বলল, “সারাদিন তুই করিস কি ? সার্টিফিকেটটার জন্য একটু ঘোরাঘুরি করলে যদি হয়, করিস না কেন! অনিলের কাছে যা— ও অত বড় চাকরি করে, ঠিক বের করে দেবে।’

'যাব।'

“যাস। বুড়ো বয়সে এখন জেদ কমেছে লোকটার, এইবেলা নিয়ে আয়।'

মা মশারির ভিতরে বসে চুলের জট ছাড়াচ্ছে। বলল, চোখে কেন কুয়াশার মতো দেখি আজকাল। কর্তা আসবে, তার আগেই একবার হাসপাতালে নিয়ে যাস তো!’

আমি মা'র মশারি তুলে দিয়ে ভিতরে পায়ের কাছে গুটিসুটি মেরে শুলুম। মশা ঢুকছে না।” বলে ছোট্ট একটু ধমক দিয়ে মা আমার পিঠে হাত রেখে বলল, “কী এত খরচ করিস। এতদিন একটু আধটু জমালে দুটাে দোচালা সত্যিই উঠে যেত। একটু গাছ-গাছালি লাগাতে পারতুম। নিজেদের বাগানের ফল-পাকুড় খাই না কত দিন।'

"একটু আদর করো না সোনা মা'




আমার সামনের রাস্তায় হঠাৎ পড়ে লাফিয়ে উঠল একটা লাল বল। এমন চমকে উঠেছিলুম! তারপরই শোনা গেল সামনের হলুদ বাড়িটার দেওয়ালের আড়াল থেকে বাচ্চা ছেলেদের চিৎকার, ‘ওভারবাউন্ডারি.ওভারবাউন্ডারি!..মিলনের একুশ।' শুনে আমি আপন মনে হেসে উঠলুম।

পিছনের পার্কটায় দেখে এলুম এক পাল কাকের সভা বসেছে। আর খোলা মাঠে ছেড়া কাগজ উড়িয়ে খেলছে বাতাস। মোড় ফিরতেই মুখোমুখি দেখা হল সেই মোটা, লাল ডাকব্যাক্সটার সঙ্গে। দূরে দেখা যায় তোমাদের বাড়ির চুড়ায় পরিটাকে-আকাশের দিকে বাড়ানো এক হাত অন্য হাতে সে তার বাঁদিকের স্তন ছুঁয়ে আছে।

এখন দুপুর। রাধাচুড়া গাছের তলায় জলের ড্রাম, পেতলের থালা, আর ছাতুর ঝুড়ি সাজিয়ে বসেছে এক অল্পবয়সি ছাতুওয়ালা। তাকে ঘিরে রিকশাওয়ালাদের ভিড়। এক হাত খাবারের থালায় রেখে অন্য হাতে লোভী পাখিপক্ষীদের তাড়াতে-তাড়াতে যখন মাঝে-মাঝে আকাশের দিকে চেয়ে দেখে তখন মনে হয় খাবারের সঙ্গে আকাশ, মাটি ও উদ্ভিদদের বড় মায়া মিশে আছে। ইচ্ছে করে ওদের সঙ্গে বসে যাই।

চমৎকার দিন আজ। আকাশে এতটুকু মেঘ নেই। শীতের খরা বাতাস বইছে।

তুমি আজ কোথাও ছিলে না। যখন তোমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে হেঁটে গেলুম তখন দেখি একটা ঘাস-ছাঁটা কল বাগানময় ঠেলে নিয়ে বেড়াচ্ছে তোমাদের মালী। ব্যালকনিতে দুটাে ডেকচেয়ার। তোমাদের অর্ধবৃত্তাকার গাড়িবারান্দার তলায় দাঁড়িয়ে আছে একটা একটু স্কুটার, যার রং ছানার জলের মতো সবুজ।

সারা দুপুর আমি আজ আর ভুলতে পারলুম না-ওই ঘাস-ছাঁটা কল, দুটাে ডেকচেয়ার, আর ওই সবুজ একা একটা স্কুটার।


8

আজ প্রথম পিরিয়ডে আমি ক্লাসে ছাত্রদের ফুল্পরার বারো মাসের দুঃখের ভিতরে তখনকার গাৰ্হস্থ্য চিত্র আর সমাজজীবন বিষয়ে একটা প্রশ্ন লিখতে দিয়ে জানালার কাছে এসে যখন দাঁড়ালুম তখন দেখা যাচ্ছে আকাশে নীচু একটু মেঘ। বৃষ্টি হবে কি! বৃষ্টির আগে ভেজা মাটির যে গন্ধ পাওয়া যায় আমি তার জন্য অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেছিলুম। বৃষ্টি এল না। শেষ ক্লাস ছিল সেভেন-এ। ওরা গেল ক্লাস লিগে ক্রিকেট খেলতে। টিফিনে তাই ছুটি পেয়ে বেরিয়ে আসছি, গিরিজা হালদার একটা কাগজ এগিয়ে দিয়ে বলল, সই করুন।” চটপট সই করে দিলুম! হালদার গজগজ করতে করতে কমনরুম থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল, কীসে সই করলেন, একবার পড়েও দেখলেন না।” চেচিয়ে বললুম, “যে কোনও আন্দোলনই করুন-আমি সঙ্গে আছি। বিপ্লব দীর্ঘজীবী হােক।’ বেরিয়ে এসে খুশি মনে দেখলুম ঝকঝক করছে দিন।

পাবলিক ইউরিন্যালের নোংরা দেয়ালে পেনসিলে লেখা অনেক অশ্লীল কথার মধ্যে কে লিখে -গোপাল আর নাই। 'গোপাল’ থেকে পেন্সিলের হালকা রেখা নাই।’-তে এসে গভীর। যেন বা হতাশা থেকে ক্ৰমে ক্ৰোধ। লেখা নেই, তবু মনে হয়। হতাশার ‘হায় গোপাল' থেকে শুরু, শেষে এসে রাগ-"নাই কেন?” লেখা আছে-গোপাল আর নাই। আমি পড়লুম-হায়! গোপাল!' পড়লুম, ‘গোপাল আর নাই কেন?”

বেরিয়ে আসছি, দেখি দেশপ্রিয় পার্কের কাছে ট্রামের স্টপে ভিড়ের মধ্যে একটা চেনা মুখ! সুধাকর না। কলেজ টিমের দুর্দান্ত লেফট আউট ছিল! দেখি গায়ে চর্বি জমেছে, থলথল করছে ভুড়ি, কাঁধে ঝুলছে শাস্তিনিকেতনের ঝোলা ব্যাগ। পরনে ধুতি-পাঞ্জাবি। পায়ে চপ্পল।

ফাস্ট ডিভিশনেও কিছুদিন খেলেছিল সুধাকর। তখন ওর দৌলতে ডে ক্লিপে কত খেলা দেখেছি। মনে পড়ে লাইটহাউসে দুজনে দশ আনার লাইন দিতে গেছি, দুটাে অচেনা ছেলে লাইন থেকে ডেকে বলল, “আপনি এস সেন না?” সুধাকর মাথা নাড়ল-"হাঁ'। 'আসুন না, এখানে জায়গা করে দিচ্ছি।' লাইনে দাঁড়িয়ে সুধাকর চাপা গলায় বলেছিল, “কিরে শালা দেখলি।”

চার বছর আগে শেষ দেখা চিত্তরঞ্জন ক্যান্সার হাসপাতালের সামনে। তখন ওর মায়ের ক্যানসার। ইউটেরাসে। দুজনে চৌরঙ্গি পর্যন্ত হেঁটে গিয়েছিলুম। বললে, “খেলা ছাড়ার পরই একটা মজার চাকরি পেয়ে গেছি ভাই। কনস্ট্রাকশনে। কাজকর্ম কিছু বুঝি না, কিন্তু এধার-ওধার থেকে কেমন করে যেন পয়সা এসে যায়।” পরমুহূর্তে গম্ভীর হয়ে বলল, কিন্তু আমি ইমমরাল নই, খেলার মাঠেও মার না খেলে কখনও মারিনি।” তখন শীত শেষ হয়ে কলকাতায় গরম পড়ে গেছে, তবু সুধাকারের গায়ে ছিল একটা পুরোনো ব্লেজার-বুকের কাছে মনোগ্রাম করা, যেন চোখ পাকিয়ে বলছিল-আমি খেলোয়াড় সুধাকর।

আমি ওকে ডাকলুম না। দূর থেকে দেখলুম ধুতি-পাঞ্জাবি চপ্পল পরা মোটা থলথলে সুধাকর যেন সবাইকে দেখিয়ে চলন্ত ট্রামের হ্যান্ডেল ধরে চটপটে পায়ে পা-দানিতে উঠে গেল।

সন্ধেবেলায় কফি হাউসে অনেকের সঙ্গে দেখা। অমর ফিরেছে। বিলেত থেকে অনেক দিন পর। আডা তাই জমজমাট ছিল। অমররা সিং। পাঞ্জাবি শিখ, বাঙালি হয়ে গেছে। আগে দাড়ি গোঁফ পাগড়ি ছিল না।

আজ দেখি জালে ঢাকা দাড়ি, মাথায় জরির চুমকি দেওয়া পাগড়ি, বললুম, আগে না তুই ছিলি মেকানাইজড শিখ! তবে আবার কেন দাড়ি গোঁফ পাগড়ি, হাতে কেন তোর বালা ?”

হাতজোড় করে বলল, রিলিজন নয় ভাই, এ আমার পলিটিক্স। বিলেতে গিয়ে দেখি ইন্ডিয়ানদের পাত্তা দেয় না। আমার গায়ের রং ফরসা, অনেকেই সাহেব বলে ভুল করে, খাতির যত্ন পাই। কেমন লেগে গেল সেন্টিমেন্টে। তাই দাড়ি গজিয়ে পাগড়ি বেঁধে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াতে লাগলুম-ইন্ডিয়ানদের যে পাওনা তাই দাও আমাকে। খাতির চাই না।

রাত আটটার সময় ওরা উঠে গেল মদের দোকানে। সেলিব্রেট করবে। আমি গেলুম না। যাওয়ার সময় তুলসী আড়ালে ডেকে বলে গেল, অনিমেষকে একবার দেখতে যাস। ওর অসুখ।”

‘কী অসুখ।'

মুখ টিপে হেসে বলল, “বলছিল, অসুখের নাম মীরা। দেখিস গিয়ে।'




রাত সাড়ে ন’টায় আমি লন্ডনের এক অচেনা রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিলুম। চারদিক হিম কুয়াশায় আচ্ছন্ন, কিছুক্ষণের মধ্যেই বরফ পড়বে। একটা দোতলা বাস হল্টে থেমে আছে, বাস-এর পিছনে বিজ্ঞাপন ‘সিনজানাে’। চােখ পড়ে অদ্ভুত পুরোনাে ধরনের গথিক লাইটপোস্ট, ভিকটােরিয় দালানের ভারী স্থাপত্য, পিছনে দূরের বহুতল স্কাইক্র্যাপারের জানালায় আলোর আভাস। ওভারকোটের পকেটে আমার দুই হাত। আমি হেঁটে যাব। সামনের যে কোনও পাব-এ রহস্যময়ভাবে ঢুকে আমি খেয়ে নিব এক গ্লাস বিয়ার, অল্প গুনগুন করে গাইব ওই অচেনা শব্দটি যা কিনা কোনও মদের নাম-“সি-ই- ন-জী-আন-ও-ও”। ঘরে ফেরার আগে আমি কোনও হােটেলের বলরুমে ঢুকে নেচে নেব। দু-চক্কর নাচ, “হেঃ এ, টুইস্ট, টুইস্ট, টুইস্ট।'

আমি দূর বিদেশে পৌঁছে গেছি আজ। ঘন কুয়াশার পরদা সরালেই দেখা যাবে আমার চারধারে জীবন্ত এই ছবি।

চেনা রাস্তাঘাট আজ আর চেনা যাচ্ছিল না। বিবৰ্ণ দেওয়াল, ছেঁড়া পোস্টার, কালো ক্ষয়া চেহারার মানুষ-এই সবই ঢাকা পড়েছিল। কলকাতায় বড় সুন্দর ছিল আজকের কুয়াশা। হাজরার মোড়ে দাঁড়িয়ে আমি ধরিয়ে নিলুম একটা সিগারেট। ট্রাফিকের সবচেয়ে সুন্দর আর ক্ষণস্থায়ী হলুদ বাতিটি ঝলসে উঠলে স্টেটবাসের গিয়ার বদলানোর শব্দ হয়েছিল। জ্বলে উঠল সবুজ। আস্তে ভাই ট্যাক্সিওয়ালা' বলতে-বলতে আমি ডান হাত ট্র্যাফিক পুলিশের ভঙ্গিতে তুলে ধরে দুই লাফে রাস্তা পার হয়ে গেলুম।

আমার যাওয়ার কথা বলুকবাগান, সেদিকে না গিয়ে আমি মোড় নিলুম ডাইনে, এসে দাঁড়ালুম আদিগঙ্গার পোলের ওপর। আমার পায়ের তলা দিয়ে অন্ধকার রেলগাড়ির মতো বয়ে চলেছে জল। না, গঙ্গা কোথায়! এ তো রাইন। অদূরে ট্রাফলগার স্কোয়ার থেকে ভেসে আসছে রাতের ঘুমভাঙা কবুতরের পাখার শব্দ, আমার পিছনে অস্পষ্ট ইফেল টাওয়ার, সামনে বহুদূরে স্ট্যাচু অব লিবার্টি, বাঁয়ে ব্ৰহ্মপুত্রের ওপর দিয়ে শম্ভুগঞ্জের দিকে ভেসে চলেছে গুদারা নৌকা। কুয়াশার আবডাল সরে গেলেই সব দেখা যাবে। কিংবা বলা যায়, কুয়াশার আবডালেই বহু দূরের সবকিছু পুরোনো এই কলকাতার হৃদয়ের বড় কাছাকাছি এসে গেছে। কাছে আসবার এই তো সুসময়-বর্ষায়, বা ঝড়ে, বা কুয়াশায়! ভালোবাসায় একাকার হয়ে যায় পৃথিবী, সমুদ্র তার তট অতিক্রম করে উত্তাল হয়ে আসে স্থলভূমির দিকে, আমাদের চেনা শহরে ফুটে ওটে অচেনা বিদেশের ছবি।

আজ রাতে তুমি একবারও খোলা জানালার কাছে এসে দাঁড়াবে কি? যদি দাঁড়াও, তবে আমার মনে হয়, তুমি টের পাবে তোমাদের বাড়ির চুড়ার শ্বেতপাথরের পরিটা কুয়াশার আড়ালে তার মার্বেলের ভিত ছেড়ে উড়ে গেছে মোড়ের ওই লাল রঙের বেঁটে ডাকবাক্সটার কাছে। বহুকালের পুরোনো তাদের প্ৰেম-কেউ কখনও টেরও পায়নি। এখন পায়ের কোনও শব্দ না করে যদি তুমি ছাদে উঠে যেতে পারো। তবে দেখবে-পরিটা সত্যিই নেই।

নাকি রাতের ডাকে চিঠিপত্র চলে গেছে বলে হালকা সেই ডাকবাক্সটা বেলুনের মতো উড়ে এসেছে তোমাদের ছাদে! পরিটার কাছে! এখন তাই ডাকবাক্সটা খুঁজে না পেয়ে পৃথিবীর ভুলো মানুষেরা ভাবছে-কোথায় গেল আমাদের এতকালের চেনা সেই ডাকবাক্স! নাকি আমাদেরই রাস্তা ভুল!




অনিমেষ একা থাকে। অসুখ শুনে দেখতে গিয়েছিলুম।

শুয়ে আছে। দেখলুম নাকটা অল্প ফুলে লাল হয়ে আছে। মুখের এখানে ওখানে ফাটা-ছোঁড়া, কপাল থেকে থুতনি পর্যন্ত টানা লম্বা একটি কালশিটের দাগ।

আমাকে দেখে কনুইয়ে ভর রেখে উঠবার চেষ্টায় মুখ ভয়ঙ্কর বিকৃত করে বলল, 'চারটে লোক! বুঝলি, চারটে লোক ফিলজফি পালটে দিয়ে গেল।”

‘কী হয়েছে তোর?”

“কি জানি। একা পড়ে আছি, সিগারেট এনে দেওয়ারও লোক নেই। আর শালা দুপুরটা যে কি লম্বা মনে হয়!"

'চারটে লোক কারা?”

পাশ ফিরে বলল, “চিনি না! নাইট শো দেখে ট্যাক্সিতে ফিরছি, তখন রাত বারোটা। আমার ঘরের সামনে ওই যে অনেকটা ফাঁকা জায়গা, মাঠের মতো, বড় রাস্তায় ট্যাক্সিটা ছেড়ে দিয়ে যেই মাঠে পা দিয়েছি, টের পেলুম ঘরের বারান্দায় অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আবছা চারটি লোক। তক্ষুনি কেন যেন মনে হল—বিপদ। ফিরে দেখলুম ট্যাক্সিটা ব্যাক করে মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছে। ভাবলুম ট্যাক্সিওয়ালাকে একবার ডাকি। ততক্ষণে চারটে লোক চটপটে পায়ে এসে আমার চারধারে দাঁড়াল। মুখোমুখি যে, তার হাতে একটা সাইকেল চেন। জিজ্ঞাসা করল-তুমি শালা অনিমেষ চৌধুরী? মীরার সঙ্গে তোমারই ভাব? বোঁ করে চেনটা এসে মুখে লাগল। পড়ে যাচ্ছিলুম, ধরে বলল, ঘরে চল। ঘর নিয়ে এল! আমি তালা খুললে চারজনেই ঢুকাল ঘরে। বলল, তোমাকে কাট মারতে হবে। আমি অল্প টলছিলুম, মাথার ভিতরটা ধোঁয়াটে লাগছিল, তবু ওদের কথা বুঝলুম। বললুম, কেন? বলল, মীরার সঙ্গে বিয়ে হবে হরির। ছেলেবেলা থেকে ওদের ভাব, মাঝখানে তুমি কে? হরিকে আমি চিনি, মীরাদের বাসায় কাজকর্মে আসে, ছুতোরের কাজ করে, জগুবাজারে দোকান আছে। আমি মাথা ঠিক রাখার চেষ্টা করে বললুম, মীরা শিক্ষিতা মেয়ে, হরিকে বিয়ে করবে কেন? আমার বুকে আঙুল ঠুকে বলল, কেন, শালা শিক্ষিতা মেয়ের শরীরে ফুল ফোঁটে না! পাতা গজায় না? হাসল, বিয়ে করতে না চায়, আমরাই জোর করে দেব। সমাজের ব্যবস্থা আমরা পালটে দিচ্ছি। শিগগিরই। তোমাকে চিঠি লিখতে হবে। লেখো। ওরা বলে গেল, আমি লিখলুম-প্রিয় মীরা, তোমার সঙ্গে আমার আর সম্বন্ধ নেই। কাল থেকে তোমার সঙ্গে কাট। দেখা হলে আমাকে না চিনবার চেষ্টা কোরো। আমি তোমাকে আর ভালোবাসি না। ইতি অনুতপ্ত অনিমেষ। লেখা হলে ওরা একটা খাম বের করে দিয়ে বলল, নিজের হাতে ঠিকানা লিখে দাও। দিলুম। তারপর ওরা আমাকে মারল, মেরে শুইয়ে দিয়ে গেল মেঝোয়। বলে গেল, “যদি কথার নড়াচড় হয় তবে আবার দেখা হবে, না হলে গুডবাই।”

অনিমেষ আমার দিকে চেয়ে চকমকে চোখে হাসল, মীরা এসেছিল দু-দিন পর। দরজা খুললুম না। বাইরে থেকেই বলল, “অফিসে তোমাকে ফোন করে পাইনি। তুমি এত খারাপ বাংলা লেখো, জানতুম না। এ চিঠি তুমি লিখেছ?” শান্তভাবে বললুম, হাঁ। জিগ্যেস করল, কেন? বললুম -

কি বললি!'

ধাপ করে বালিশ মাথা থেকে ফেলে অনিমেষ মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে হাত নাড়ল, “দূর শালা! সে অনেক কথা। ছেড়ে দে। তোর কাছে যে কটা সিগারেট আছে দিয়ে যা।”

আমার সিগারেটের প্যাকেট নিয়ে বালিশের পাশে রাখল, মীরার কথা এখন আর ভাবছিই না। ভাবছি। ওই চারটে লোকের কথা। কী আত্মবিশ্বাস!! আমাকে দিয়ে ওই চিঠি লিখিয়ে নিল, আর ঘরে ঢুকে মেরে গেল আমাকে, বুঝিয়ে দিয়ে গেল আমার জোর কতখানি। আমি শালা হারামির বাচ্ছা এতদিন ভদ্রলোক...'

রাতে বেড়াল খুঁজতে গিয়ে মা পড়ে গিয়েছিল উনুনের ধারে। হাঁটুতে চোট। একটা আঙুল সামান্য পুড়েছে। ডাক্তার বলে গেল-হাই প্রেসার, সাবধানে রাখবেন। খুব বিশ্রাম। আর নুন বারণ।

পায়ে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললুম, “কেন মা, এত কাজকর্ম করতে যাও?’

মা মিনমিন করে বলল “বউ আন”

স্বপ্ন দেখলুম।

আমার চোখের সামনে দেয়ালের পর দেয়ালের সারি। আর সেই অসংখ্য দেয়ালের গায়ে কে যেন অবিশ্রাম চক দিয়ে লিখে যাচ্ছে-গোপাল আর নাই। গোপাল আর নাই। গোপাল আর নাই। কোথাও লেখা-‘হায় গোপাল!' কোথাও বা-‘গোপাল আর নাই কেন?” আর রাস্তার মোড়ে মোড়ে বিয়ের ‘স্বাগতম' লিখবার লাল শালুতে উড়ছে কর্পোরেশনের বিজ্ঞাপন, বসন্ত-টাকা নিন। বিপদ-টীকা নিন। ভয়-টিকা নিন।




দেখলুম স্টিয়ারিং হুইলে তোমার দুই অসহায় হাত, অহঙ্কারে একটু উচু তোমার মাথা। কপালের ওপর নেমে এসে দুলছে চুলের একটা ঘুরলি। দাঁতে ঠোঁটে চেপে হাসছি। তোমার কপালে ঘাম। তোমার মুখ লাল। পাশে খাকি শার্ট পরা নিকেলের চশমা চােখে বুড়ো সেই ড্রাইভার। একটু ডান দিকে হেলে সে তার একখানি সাবধানী হাত বাড়িয়ে রেখেছে স্টিয়ারিং হুইলের ওপর তোমার হাতের দিকে।

বড় ভালোবাসার তোমাকে আগলে নিয়ে গেল তোমাদের পুরোনো মভ্ রঙের গাড়ি। মোড়ের বেঁটে মোটা লাল ডাকবাক্সটা তার কালো টুপি পরা মাথা নেড়ে নিঃশব্দে চিৎকার করে বলল, “হ্যাপি মোটরিং মাদামোয়াজেল, হ্যাপি মোটরিং” বাড়ির চুড়া থেকে শ্বেতপাথরের পরিটা পূব থেকে পশ্চিম মাথা ঘুরিয়ে বহুদূর পর্যন্ত একবার দেখে নিল-কোনও বিপদ আছে কি না। যত দূরেই যাও, সে তোমাকে ঠিক চোখে চোখ রাখে।

যদিও একটু টাল খাচ্ছিল তোমার গাড়ি, তবু বলি, তুমি অনেকটা শিখে গেছ। আর কদিন পরেই তুমি তোমার গাড়ি একা চালিয়ে নিয়ে যাবে।

চোখ বুজে দেখলুম, দূরে রাসবিহারীর জংশনে ট্রাফিকের লাল আলোয় থেমে আছো তুমি।

থেমেছিলো? নাকি অপেক্ষা করেছিলে? দেখো একদিন আমি ঠিক রাস্তার মাঝখানে দুহাত দুদিকে ছড়িয়ে দাঁড়াব তোমাদের ওই মভ্ রঙের মোটর গাড়িটার মুখোমুখি। চেঁচিয়ে হয়তো বলব, “বাঁচাও”, কিংবা হয়তো বলব, মারো আমাকে” কুয়াশায় বা ঝড়ে বা বৃষ্টিপাতে কোনওদিন সেই সুসময় দেখা দিলে, তখন আর ওই দুই শব্দের আলাদা মানে নেই।




ফেব্রুয়ারি। কলকাতায় এবারের শীত শেষ হয়ে এল। বাতাসে চোরা গরম। রাস্তায় খুব ধুলো উড়ছে। চারদিকেই রাগী ও বিরক্ত মানুষের মুখ।

বিদায়ী শীতের সম্মানে একদিন স্কুল কামাই করা গেল। ম্যাটিনিতে বেলোল্লা একটা হিন্দি ছবি দেখলুম। আমি আর তুলসী। বেরিয়ে দেখি বৃষ্টি। লবিতে দাঁড়িয়ে তুলসী হাত বাড়িয়ে বৃষ্টির জল ধরছিল। বললুম, “তোর জমবে না কিছুই। তোর হাতে জল দাঁড়ায় না।” অসময়ে বৃষ্টি, তবু রাস্তায় জল জমে গেল। ট্রাম বাস বন্ধ। হাতে স্যান্ডেল, কাপড় গুটিয়ে দুজনে ছপ করে জলে নামলুম। হঠাৎ অকারণে খুশি গলায় তুলসী বলল, ‘পৃথিবী জায়গাটা মন্দ নয়, কী বলিস।”

পাড়ার চেনা ডাক্তার ধরে একদিন টি এ বি সি দিয়ে দিল। দুদিন জ্বরে পড়ে রইলুম। মা কাছাকাছি ঘুরঘুর করে গেল বারবার। এমন ভাব-কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়াস, হতভাগা ছেলে, এবার পেয়েছি তোকে। তৃতীয় দিনে গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে বসলুম। সকালেই দেখি, মা বাক্স খুলে কবেকার পুরোনো লালপেড়ে গরদের শাড়িটা বের করে পরেছে। "কী ব্যাপার?” মা অপ্রস্তুত মুখে একটু হাসল কাল রাতে একটা বিচ্ছিরি স্বপ্ন দেখেছি।” মুখ ফিরিয়ে বলল, “তোর জ্বরটাও সারল। কালীঘাটে একটু পুজো দিয়ে আসি।”

আমি আর গিরিজা হালদার স্কুল থেকে একসঙ্গে বেরোলুম একদিন। হালদার গলা নামিয়ে বলল, “আমার জীবনে একটা ট্র্যাজেডি আছে মশাই। আপনাকে বলব একদিন৷” পরমুহুর্তেই রুমাল বের করে বলল, “গরম পড়ে গেল।” রেস্টুরেন্টে বসলুম দুজনে, গিরিজা হালদার কাটলেট খেল না, আঙুল দেখিয়ে বলল, “দুটাে টােস্ট। আমার মশাই নিরামিষ। দেখেন না হিন্দুর বিধবারা কতদিন বাঁচে।” হালদার প্রাণায়াম-টানায়াম করে। দম বন্ধ করে এক গ্লাস জল খেয়ে মুখ মুছে বাইরের দিকে তাকিয়ে বলল, “লক্ষ করেছেন কলকাতায় অনেকদিন কিছুই ঘটছে না! না লাঠিচার্জ, না গোলাগুলি, না কারফিউ। তেমন বড়সড় একটা মিছিলও দেখছি না বহুকাল। লোকগুলো মরে গেছে, কি বলেন।” অন্যমনস্কভাবে বললুম, হাঁ।' হালদার টেবিলে আঙুল বাজিয়ে গুন গুন করল, “জন্মিলে মরিতে হবে, অমর কে কোথা কবে.'

দূর গঙ্গায় বেজে ওঠে জাহাজের ভোঁ। মাথার ওপরে উড়োজাহাজের বিষন্ন শব্দ। অন্যমনে সাড়া দিই—“যাই।”

রাতে হঠাৎ চমকে ঘুম ভেঙে উঠে বসলুম, মা, ও মা, তুমি আমার ডাকলে।” মা জেগে উঠে অবাক গলায় বলল, “না তো।” বিড়বিড় করে বীজমন্ত্র পড়ে বলল, ‘ঘুমো' চৌকির শব্দ করে পাশ ফিরল মা, বলল, “বাইরে খুব বৃষ্টি হচ্ছে, না রে!'৷ আমি নিঃশব্দে হাসলুম, না তো!’

তারপর অনেকক্ষণ জেগে থাকি। মা'রও ঘুম আসে না। বলে, “সারাদিন কী যে করিস। ঘুরে ঘুরে আত্মীয়স্বজনদের একটু খোঁজখবরও তো নিতে হয়! আমি মরলে আর কেউ তোকে চিনবেই না। দেখলেও ভাববে কে না কে!' মা'র দীর্ঘশ্বাসের শব্দ হয়, ‘বুঝতেও পারি না, কে বেঁচে আছে, আর কে মরে গেছে। একটু খোঁজ নিস।' জবাব দিই, “কে কোথায় থাকে মা!' মা আস্তে-আস্তে বলে যায়, ‘কেন, মাঝেরহাটে তোর রাঙা কাকিমা, কাঁচড়াপাড়ায় সোনা ভাই...” শুনতে-শুনতে ঘুমিয়ে পড়ি।

মনে পড়ে, ছুটির এক দুপুরে বসেছিলুম ছোট একটা চায়ের দোকানে। চারটি টেবিল, প্রতি টেবিলকে ঘিরে চারটি চেয়ার, আর সবুজ পরদাওয়ালা দুটাে কেবিন খালি পড়ে আছে। মাছি ওড়ার শব্দ শোনা যায়। দেয়ালে ভয়ঙ্কর সব যুবতীদের ছবিওলা ক্যালেন্ডার। দুপুরের ঝিমঝিম ভাবের মধ্যে অনেকক্ষণ একা বসেছিলুম। এ সময়ে দরজায় এসে দাঁড়ালেন সাদা চাদর গায়ে বুড়ো এক ভদ্রলোক। চোখে চোখ পড়তেই ভীষণ চমকে উঠেছিলুম। বড় দয়ালু ওঁর চোখ। আমি স্পষ্ট শুনতে পেলুম উনি মনে-মনে বললেন, “এই যে, কী খবর?” তটস্থ আমি তৎক্ষণাৎ মনে-মনে উত্তর দিলুম 'এই যে, সব ভালো তো?” পরমুহুর্তেই উনি চোখ সরিয়ে নিলেন, গিয়ে বসলেন কোণের একটা চেয়ারে, পত্রিকা খুলে মুখ আড়াল করে নিলেন। আমি টেবিলের কাছে আমার অন্ধকার ছায়ার দিকে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে চেয়ে রইলুম। সেই ভাবটুকু তারপর কেটে গিয়েছিল, যখন সদ্য ঘুম-থেকে-ওঠা বাচ্চা বয় খালি গায়ে হাই তুলতে-তুলতে এসে চা দিয়ে গেল।

একদিন স্কুলে এল টেলিফোন। শিগগির বাড়িতে আসুন।’ শরীর হিম হয়ে গেল। রিসিভার নামিয়ে রাখলুম আস্তে-আস্তে। দীর্ঘদিন ধরে যেন এ রকম একটি আহ্বানেরই ভয় ছিল আমার। আমার সমস্ত শরীর জুড়ে “মা”। এই শব্দ বেজে উঠেছিল। অদ্ভুত ঘোরের মধ্যে আমি এসে দেখলুম ঘরে চার-পাঁচজন পাড়া পড়শি, বালিশে মার নিবন্ত মুখ, আধাখোলা চোখ ভয়ঙ্কর লাল, ঠোঁট ফ্যাকাসে। ডাক্তার ব্লাডপ্রেসারের পারদের দিকে চেয়ে আছে। বলল-“তাড়াতাড়ি করুন।’ বুঝতে না পেরে আমি চারদিকে চেয়ে বললুম, কী? আবার কে যেন বলল, তাড়াতাড়ি করুন।' আমি বুঝতে পারলুম। না, বাচ্চা ছেলের মতো সামনের শূন্যতার দিকে চেয়ে প্রশ্ন করলুম, “কী?” বাড়িওয়ালার বউ আমাকে একদিন টেনে নিয়ে বলল, “যা তারকেশ্বরে মানত করে আয়!”

পরদিন। আমি তারকেশ্বর থেকে ফিরছিলুম। ভিড়ের ট্রেন। আমি বসবার জায়গা পাইনি। ট্রেন থামছে। প্রতিবার আমি মফসসলের লোকের মতো নিজেকেই জিগ্যেস করছি, “এটা কি হাওড়া? এই কি হাওড়া?’ অনেক ঘাড়, অনেক মাথার জঙ্গল সামনে, আমি পায়ের পাতায় ভর দিয়ে উচু হয়ে বাইরেটা দেখবার চেষ্টা করছিলুম। হঠাৎ এক ঝলক তেতো জলে ভেসে গেল মুখ, কষ বেয়ে জামা-কাপড় ভাসিয়ে দিল, “এটা কি হাওড়া” আবার এই প্রশ্ন করতে গিয়ে দেখি চোখের সামনে নড়ছে কালো-চাদর, ঝড়ের মতো ছুটছে ট্রেন, অথচ যেন বাতাস লাগছে না। পড়ে যাচ্ছি, কয়েকটা হাত আমাকে ধরল। টের পেলুম, আস্তে-আস্তে দূরে সরে যাচ্ছে পৃথিবীর সব শব্দ-যেন আমি আবার মায়ের কোলের সেই শিশু রম-এক্ষুনি ঘুমিয়ে পড়ব। তবু সেই আধ-চেতনার মধ্যে আমার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছিল, “আপনারা সবাই শুনুন। আমি রমেন। আমার মায়ের বড় অসুখ। দুদিন আমি তাই কিছুই খাইনি।” আমি বলতে চাইছিলুম, “আমি দীর্ঘকাল ধরে আপনাদের সকলের কাছে অপরাধী।” আমার প্রাণপণে বলবার ইচ্ছে হয়েছিল, “আমি আজ। আপনাদের ইচ্ছাশক্তিগুলি ভিক্ষা চাই। আপনাদের আশীৰ্বাদগুলি ভিক্ষা চাই।' ট্রেনের মেঝেয় ঘোর অন্ধকারের ভিতরে দুটাে সাদা পা। যেন চেনা!! মুখ দেখা যায় না, তবু বুঝলুম সেই বুড়ো ভদ্রলোক। আজও তার চোখ কথা বলছিল। আমি তোমােরর জন্যই এসেছি। রমেন। তুমি ভাগ্যবান। চলে এসো।' আমি কাঁদছিলুম, “আমার মা’র বড় অসুখ। আমার বাবা বিদেশে পড়ে আছে।' সহজে উত্তর দিল না তার চোখ, বলল, “জীবন ও মৃত্যুই কিছু লোকের দেখাশোনা করে; কিছু লোককে দেখে ভাগ্য; কিছু লোককে ধর্ম এসে নিয়ে যায়।”

ভালো হয়ে গেলে মা একদিন চিহ্নিত মুখে বলল, “চোখে ভালো দেখি না। কিন্তু মনে হচ্ছে তুই বড় রোগা হয়ে গেছিস।' হাসলুম, “কই।” কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে মা বলল, আর কর্তার সার্টিফিকেটটা? সেটা পেলি না।”

তখন বিকেল। পাকিস্তানি হাই কমিশনারের অফিস থেকে বেরিয়ে গড়িয়াহাটার দিকে যাব, এমন সময় হঠাৎ দেখি-তুমি! শিকড়সুদ্ধ আমার ডালপালা নাড়া খেয়ে গেল।

বলতে কি, স্কুটারের পিছনের সিটে তোমাকে মানায় না। এত খোলামেলা আর এত ভিড়ের মধ্যে।

দেখলুম সবুজ রুমালে ঘিরেছ মুখ, আজ নীল শাড়ি পরেছিলে, স্কুটারের পিছনের সিটে তুমি জড়োসড়ো, টালমাটাল। চওড়া পুরুষের কাঁধ আঁকড়ে ধরে হাসছিলে ভয় পাওয়া হাসি-'পড়ে গেলু-উ-উম!'

তারপরই অবহেলায় আমাকে পিছনে ফেলে রেখে ছুটে গেল তোমাদের স্কুটার। যেতে যেতে আচমকা ঘুরে গেল বাঁয়ে-পড়ো পড়ো হল, পড়ে গেল না। তোমরা গেলে পার্ক স্ট্রিটের দিকে।

আমি গড়িয়াহাট রোড ধরলুম। অপরাহ্নের আলোয় ফুটপাথে আমার দীর্ঘ ছায়ার ওপর দিয়ে হেঁটে চলেছে অচেনা মানুষ। তাদের ছায়া ছুঁয়ে যাচ্ছে আমাকে। সামনেই ট্রাফিক পুলিশের উত্তোলিত হাত, আর গাড়ির মিছিল দাঁড়িয়ে আছে। একজন হকার আমাকে উদ্দেশ করে ধীর গম্ভীর গলায় হাঁকল ‘গেঞ্জি।” এসব কিছুই আমি তেমন খেয়াল করলুম না। আমার মন গুনগুন করছিল, কেন তুমি কোনওদিনই লক্ষ করলে না আমায়! হায়, আমি যে আছি তুমি তো জানোই না!'

রাতে ঘুম না এলে জেগে থেকে মাঝে-মাঝে বড় সাধ হয়। তুমি এসে একদিন বলবে, “আমাকে চাও?”

আত্মবিশ্বাসে ভরপুর আমি শান্ত চোখে চেয়ে বলব, "চাই না।”

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ