সাব্বির জাদিদ'এর গল্প : ছবি

ভোর। পাখির পালক খোলার মতো রাতের গা থেকে খসে গেছে অন্ধকার, বেশ আগেই। কাচের জানালায় নরম আলোর উঁকিঝুঁকি। সিঙ্গেল বিছানায় ঘুমিয়ে আছে রাফিদ। মোবাইলের এলার্মে চোখ খুলে দেখে, বিছানার কোণায় বসে আছে একটা মেয়ে, পা ঝুলিয়ে। দুই হাতের তালু ঠেসে আছে বিছানায়। মাথাটা বাঁদিকে বাঁকা। রাফিদের প্রথমে মনে হয় স্বপ্ন। কিন্তু কপালে বসা নাদুস নুদুস মশাটা এক থাপ্পড়ে মেরে হাতে রক্তের উষ্ণতা অনুভব করলে সে টের পায়-- এ স্বপ্ন নয়। স্বপ্ন কখনো এত ডিটেইলে যোগাযোগ করে না।
সে আসে ঝাপসা হয়ে। ফাঁকিবাজ ছাত্রের ভাসা ভাসা জ্ঞানের উত্তরপত্রের মতো। স্বপ্ন নয় নিশ্চিত হয়ে সে তড়াক করে উঠে বসে। প্রথমে তার চোখ যায় দরজার সিটকিনিতে। সিটকিনি তোলা। যদ্দুর মনে পড়ে, শোয়ার আগে এভাবেই সে সিটকিনি তুলে ঘুমিয়েছিল। মেয়েটা তবে ঢুকল কিভাবে! রাফিদের চোখ এবার দরজা থেকে ফিরে আসে মেয়েটার বাম গালের উপর। পাশ থেকে মেয়েটার অর্ধেক কপাল, একটা চোখ, অর্ধেক নাক, একটা গাল আর ঠোঁটের অর্ধেক দেখা যাচ্ছে। আর তাতেই কেমন চেনা চেনা লাগছে। বিশেষ করে য-ফলা চিহ্নের মতো বাম গালের উপর লুটিয়ে থাকা একগাছি চুল তো খুবই চেনা।

রাফিদের পুরো না রাফিদ ধ্রুব। অবশ্য নামের লেজটুকু তার আকিকাকৃত নামের অংশ নয়। কেউ ডাকেও না ও-নামে। ওটা তার নিজের সৃষ্টি। বিখ্যাত প্রচ্ছদ শিল্পী ধ্রুব এষ থেকে ধার করা। অন্যভাবে বললে ধ্রুব এষের প্রতি অনুরাগ এই নাম ধারণের কারণ। সে একটা দ্বিতীয় শ্রেণীর দৈনিকে অলঙ্করণের কাজ করে। মালিবাগের দিকে একা এক রুমের ভাড়া বাসায় থাকে। বাবা-মা গ্রামে। দুই ঈদ ছাড়াও কখনো কখনো বাবা-মাকে দেখতে ছুটি নিয়ে গ্রামে যায়। এখনো বিয়ে করেনি। তবে ক্ষুরধার একটা প্রেমিকা আছে। সেলুনে নাপিতরা ক্ষুর দিয়ে খদ্দেরের মুখ এবং বোগলের লোম পরষ্কিার করে। ক্ষুরের ধার থাকে খুবই তীক্ষ্ম। আঙুলে পোচ মারলে সঙ্গে সঙ্গে নেমে যাবে। রাফিদের ধারণা, রাইশার ধার খুরের চেয়েও তীব্র। কেমন? উদাহরণ নেয়া যাক। ফেসবুকে রাফিদ সেলিব্রেটি। ফ্রেন্ডলিস্ট অনেক আগেই পরিপূর্ণ। লিস্টের নির্ধারিত বন্ধু ছাড়াও হাজার খানেক লোক সব সময় তাকে ফলো করে। এদের ভেতর তুলনামূলক মেয়ের সংখ্যা বেশি। রাফিদের প্রতি মেয়েদের অনুরাগ, কারণ, রাফিদ ভালো ছবি আঁকে। তার পেন্সিলের কাজ খুবই নিখুঁত। সময় নিয়ে করা কাজ তো বটেই, ব্যস্ততার ফাঁকে হেলাফেলায় আঁকা ছবি দেখেই মেয়েরা মুগ্ধতায় গড়াগড়ি খায়। বেশির ভাগই উঠতি বয়সী মেয়ে। দুধের সরের মতো ঘন যাদের আবেগ।

অনলাইনে রাফিদের পেন্সিলে আঁকা কাজের খ্যাতি ছড়ায় গতবারের ক্রিকেট বিশ্বকাপ থেকে। খেলা চলাকালে প্রতিদিন রাতে সে বাংলদেশের একেকজন ক্রিকেটারের পেন্সিল পোর্ট্রটে ফেসবুকে প্রকাশ করেছিল। সেইসব ছবি দেখে কিছু মেয়ে ক্রিকেটারদের উপর ক্রাশ খাওয়া শুরু করে। কিছু মেয়ে খোদ রাফিদের উপর। রাইশা দ্বিতীয় দলের। তারপর থেকেই মূলত রাফিদের ইনবক্স ব্যস্ত। অল্পবয়সী মেয়েরা তাদের সুন্দর মুখ নিয়ে হাজির হয় ইনবক্সে। গদগদ গলায় পেন্সিলের টানে একটা ছবি এঁকে দেয়ার অনুরোধ রাখে। প্রথম প্রথম রাফিদ এমন অনেক ‘অনুরাধার’ ছবি এঁকে দিয়েছে খুশি মনে। কিন্তু রাইশার সাথে প্রেমটা হয়ে গেলে সেসব থেমে পড়েছে মুখ থুবড়ে। সম্পর্কটা একটু দানা বাঁধতেই রাইশা জানিয়েছে, কোন অনুরাধার ছবি আঁকতে পারবে না রাফিদ। এতে তার ঈর্ষা হয়। ভয়ও। যদি কোন অনুরাধা ঝুলে পড়ে রাফিদের গলায়! যেভাবে ছবির অনুরোধে এসে সে নিজে ঝুলে পড়েছে রাফিদের গলায়। রাইশার আব্দার রাফিদ রেখে চলেছে বটে। তবে সব সময় রাখা হয়ে ওঠে না। মাঝে মাঝে এমন সব নাছোড়বান্দা টাইপ মেয়ে আসে ইনবক্সে, গা বাঁচানো দায় হয়ে পড়ে। আর অপরিচিত মেয়েদের ছবি আঁকতে খুব যে খারাপ লাগে রাফিদের, তা কিক্তু নয়। নিজের ভেতরের উস্কানি তো থাকেই। তবে ঘটনা হল, রাফিদ যখনই কোন অনুরাধার অনুরোধ রক্ষা করে, ঠিক বুঝ ফেলে রাইশা। এমনই ধারালো মেয়ে সে। তখন রাজনৈতিক অস্থিরতার মতো তাদের প্রেমের মঞ্চে অস্থিরতা শুরু হয়। সংলাপের জন্য ডাকতে হয় তৃতীয় পক্ষকে।

আজ রাইশার জন্মদিন। প্রেমের পর প্রথম জন্মদিন। প্রেমিকাকে উপহার দেবে বলে রাফিদ রাতজেগে রাইশার একটা ছবি এঁকেছে। কিন্তু ছবিটায় শেষ পর্যন্ত রাইশার মুখ আসেনি। এসেছে অন্য এক নারীর মুখ। আঁকাআঁকির প্রথম দিনগুলোর পর এমন ঘটনা এবারই প্রথম। পেন্সিলের উপর তার কঠোর নিয়ন্ত্রণ। যখন সে যা-ই আঁকতে চেয়েছে, তা-ই এঁকেছে। কিন্তু এবার পেন্সিল তার কথা শোনেনি। রাফিদ বুঝতে পারছে, এটা এক ধরণের চাপ। ভালো আঁকার চাপ। চাপের মুখে বিশ্বসেরা খেলোয়াড়ও খানিকটা দিশেহারা বোধ করে। কখনো পরাস্ত হয় সম্পূর্ণ। আজ রাফিদ যেমন হয়েছে। রাফিদ চেয়েছিল, রাইশার মুখের অনাবিষ্কৃত একটা কোণ উন্মোচন করতে। সে পারেনি। অনাবিষ্কৃত কোণ আবিষ্কার করতে গিয়ে আবিষ্কার করেছে সম্পূর্ণ অপরিচিত এক মুখ। আঁকার পর রাফিদ অনেকক্ষণ তাকিয়েছিল মুখটার উপর। ভাবছিল, এই মুখের মানুষ কি আছে পৃথিবীতে! নাকি শুধুই কল্পনা! রাত তখন তিনটে সতেরো। পরদিন সকাল ন’টায় উত্তরার একটা রেস্টুরেন্টে রাইশার সাথে মিলিত হওয়ার কথা। সেই রেস্টুরেন্টে কেক কাটা এবং জন্মদিনের উপহার দেয়ার প্লান রাফিদের। কিন্তু কী উপহার দেবে! ছবিটাই তো আঁকা হল না। রাফিদ তখন তাড়াতাড়ি ঘুমোতে যায়। খুব ভোরে উঠে নতুন আরেকটা ছবি এঁকে রওনা দেবে উত্তরায়। ভোরে ওঠা নিশ্চিত করতে সে মোবাইল এলার্ম দিয়ে রাখে। অপরিচিত মুখের ছবিটা রেখে দেয় টেবিলে, চাবির রিঙ চাপা দিয়ে।

সব কিছুই ঠিকঠাক ছিল। ভোর হওয়া, মোবাইলের এলার্ম বেজে ওঠা, রাফিদের চোখ খুলে যাওয়া-- সব। কিন্তু গোল বাঁধায় বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে থাকা মেয়েটা। এই মেয়ে আসল কোথা থেকে! একলা ঘরে মেয়েটাকে দেখে রাফিদের মনে পড়ে এই বাসায় ওঠার প্রথম দিনের স্মৃতি। অনেক প্রচেষ্টার পর মান-সম্মত এই বাসাটা পাওয়ার পর বাড়িওয়ালা আন্টি বলেছিলেন, আমার বাড়িতে কোন অনৈতিক কাজ যেন না হয়। বলেছিলেন ভদ্রভাষার পোশাক লাগিয়ে। কিন্তু ওই অনৈতিকতার অনুবাদ রাফিদের অজানা নয়। সে বোঝে, আর যাই হোক, এই বাসায় কোন মেয়েছেলে আনা যাবে না। কিক্তু সাত সকালে এ কোন উপদ্রব! আন্টি যদি কোনভাবে জানতে পারে মেয়েটার কথা, বিনা নোটিশে বাসা ছেড়ে রাস্তায় নামতে হবে। বাসা হারানোর শঙ্কায় রাফিদের প্রথমে রাগ হয়। তারপর ভয়। জানতে চায়, আপনি কে? এখানে কিভাবে আসলেন?

মেয়েটা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় রাফিদের দিকে। রাফিদের চোখের সামনে মেয়েটার পূর্ণ মুখ উন্মোচিত হয়ে ওঠে। আর কেমন চেনা চেনা লাগে তখন। কোথাও, খুব কাছ থেকে যেন দেখেছে মেয়েটাকে। কিন্তু মনে করতে পারে না।

মেয়েটা বলে, আমি ছবি, অবশ্য আপনি নিজের পছন্দ মতো যে-কোন নামে আমাকে ডাকতে পারেন।

আমার রুমে কিভাবে ঢুকলেন? আমি দরজা খুলেছি বলে তো মনে পড়ে না।

আপনি দরজা খোলেননি।

তাহলে!

আমি এখানেই ছিলাম।

হেঁয়ালী রাখুন। আসল ঘটনা বলুন। এত রহস্য ভালো লাগছে না।

আপনি আমাকে চিনতে পারছেন না দেখে আমার খারাপ লাগছে।

দেখুন, পৃথিবীর সব মানুষকে চেনার দায়িত্ব দিয়ে আমাকে পাঠানো হয়নি।

তা হয়নি। কিন্তু আমাকে এতো যত্ন করে আঁকলেন অথচ চিনছেন না তাই খারাপ লাগছে। আপনার যত্নে কি কোন ফাঁক ছিল!

যত্ন করে আঁকলাম মানে! রাফিদের গাল হা হয়ে যায় অজান্তে।

মেয়েটা বলে, কাল রাতজেগে যাকে আঁকলেন, আমি সে।

ধুর মিয়া! সাত সকালে কী রসিকতা শুরু করেছেন! আপনাকে কে পাঠিয়েছে বলুন তো!

বিশ্বাস না হয় আপনার আর্টপেপার দেখুন।

রাফিদ টেবিলের দিকে তাকায়। টেবিলের উপর চাবির রিঙ চাপা দেয়া আর্টপেপারটা আছে, তবে পেপার সম্পূর্ণ সাদা। কোন ছবি নেই। সাদা কাগজটা দেখে রাফিদের মনে হয় কাফনের কাপড়। লাফ দিয়ে সে বিছানা থেকে নামে। নিশ্চিত সে কোন ভূতের খপ্পড়ে পড়েছে। সিটিকিনি খুলে বের হতে গেলে মেয়েটা পেছন থেকে তার গেঞ্জি টেনে ধরে আলতো করে। রাফিদ চোখ বন্ধ করে চিৎকার দিয়ে ওঠে ভয়ে। মেয়েটা বলে, প্লিজ, চিৎকার করবেন না। বাড়িওয়ালা টের পেলে আপনার অসুবিধা হবে।

রাফি অবাক হয়ে তাকায়-- অসুবিধা হবে আপনি কিভাবে জানলেন!

মেয়েটা কানের পাশে চুল গুঁজে কোমলভাবে হাসে। বলে, আমি জানি।

মেয়েটার হাসি রাফিদের বড় স্নিগ্ধ লাগে। কোন ভান নেই যেন। যাকে বলে রিয়েল স্মাইল। সে সিটকিনি থেকে সরে এসে এক গ্লাস পানি খায় ঢকঢক করে। তারপর মেয়েটার মুখোমুখি হয়-- সত্যি করে বলুন তো আপনি কে? কী মতলব নিয়ে এসেছেন?

আমি মিথ্যা বলি না। আমি আপনার সৃষ্টি। আপনি এতো যত্নে এঁকেছেন আমাকে, নিষ্প্রাণ বসে থাকতে পারলাম না কাগজের গায়। ভাবলাম একটু গল্প করে আসি। তবে হ্যাঁ, একটা উদ্দেশ্য আমার আছে। সেটা সময় মতো জানতে পারবেন।

আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না। রাফিদ ডান হাতের চেটো দিয়ে গালের পানি মোছে।

পৃথিবীর সব যে আপনাকে বিশ্বাস করতে হবে এমন কোন কথা নেই। আমাদের চারপাশে অবিশ্বাস্য এমন অনেক ঘটনা ঘটে চলেছে।

তা ঠিক। তবে আপনার মুখের সারল্য দেখে আপনাকে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে। মনে হচ্ছে আপনি মিথ্যা বলতে পারেন না।

আপনার কথায় আমার সংকোচ লাগছে। অবশ্য এই যে মুখের গড়ন, যা দেখে আপনি বিশ্বাস করছেন আমি মিথ্যা বলতে পারি না, এসবের কৃতিত্ব আপনার। সংকোচ লাগলে আপনারই লাগা উচিত। এক্ষেত্রে আমি শুধুই পুতুল।

আপনি খুব সুন্দর করে কথা বলেন।

এসব রাখুন। আর কথা নয়। এখন ওয়াশরুমে ঢুকুন। ফ্রেশ হয়ে বাইরে থেকে ঘুরে আসুন। মোড়ের হোটেলটা নিশ্চয় খুলে গেছে এতক্ষণ। আমার জন্য খাবার নিয়ে আসুন। আপনার জন্যও। দুজন একসাথে খাব। খুব খিদে পেয়েছে আমার।

ঘুম থেকে উঠেই আমার গোসল দেয়ার অভ্যাস। গোসল না দিয়ে আমি বাইরে যাইনে।

তাহলে গোসল দিয়েই বেরোন। রাত চারটে থেকে খিদে নিয়ে বসে আছি। এতক্ষণ যখন পারলাম, আর আধঘণ্টাও পারব।

রাফিদ তোয়ালে কাঁধে নিয়ে ঢুকে যায় ওয়াশরুমে। ছবি নামের মেয়েটা ঘরের চারপাশ হেঁটে হেঁটে দেখে। দেয়ালে অনেকগুলো পেইন্টিঙ ঝোলানো। সবই রাফিদের কাজ। পেইন্টিঙ দেখে মেয়েটার চোখে মুখে মুগ্ধতার আলো ফুটে ওঠে। মুগ্ধতার রেশ বেশিক্ষণ থাকে না। কারণ, কেউ দরজায় টোকা দিচ্ছে। এখন দরজা খুললে রাফিদ বিপদে পড়বে ভেবে মেয়েটা চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। তবু করাঘাত অব্যাহত থাকলে মেয়েটা ওয়াশরুমের দরজায় মুখ লাগিয়ে ফিসফিসিয়ে সমস্যার কথা জানায়। জবাবে রাফিদও ফিসফিস করে বলে, খোলার দরকার নেই। যেই আসুক পরে বলব যে ওয়াশরুমে ছিলাম বলে সাড়া দিতে পারিনি। মেয়েটা রাফিদের বিছানায় আগের মতো পা ঝুলিয়ে বসে থাকে। ওয়াশরুমে রাফিদের গোসলের আওয়াজ পাওয়া যায়। সে গোসলের শব্দ কান পেতে শোনে। তার মনে হয়, কোথাও যেন বৃষ্টি নেমেছে।

রাফিদ বের হয় টানা আধঘণ্টা পরে, কোমরে তোয়ালে পেচিয়ে। মেয়েটার সামনে লজ্জা লাগে। তবে কিছু করার নেই। কারণ ঢোকার সময় তড়িঘড়ি করে প্যান্ট নিতে ভুলে গেছে। মেয়েটা রাফিদের ভেজা চুল দেখে। রাফিদ প্যান্ট আর টিশার্ট পরে দেয়ালে লটকানো আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আচড়ায়। চিরুনির আচড়ে চুল থেক তিরতির করে পানি ছিটে পড়ে। মেয়েটার মুখে এসে লাগে সুচের ডগার মতো তীক্ষ্ম সেই পানির ছিটা। শ্যাম্পুর গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে ফ্যানের বাতাসে।

বেরোনোর সময় রাফিদ সাবধান করে যায়, আমি বাইরে থেকে তালা দিয়ে যাচ্ছি। খবরদার শব্দ করবেন না। পনের মিনিটের ভেতর ফিরছি।

আর যদি না ফেরেন? মেয়েটার গলায় ভয়ের চিহ্ন।

ফিরব না কেন, অবশ্যই ফিরব!

আমি আপনার অপেক্ষায় থাকলাম।



রাফিদ বেরিয়ে যায় দরজায় তালা ঝুলিয়ে। মেয়েটা তখন খেয়াল করে, রাফিদের ঘর বড্ড অগোছাল। আলনায় ঘামের গন্ধমাখা এলোমেলো দুটো শার্ট। খাটের স্ট্যান্ডে ঝুলছে একটা বেল্ট। বেল্টের পাশে একটা কালো জাঙ্গিয়া। কয়েকটা রঙপেন্সিল গড়াগাড়ি খাচ্ছে খাটের নিচে। টেবিলের উপর এ্যাসট্রেতে গলাভর্তি ছাই। তার পাশে দুদিনের শুকিয়ে যাওয়া কমলার খোসা। মেয়েটা কোমরে ওড়না পেঁচিয়ে ঘর গোছানো শুরু করে। আবর্জনা গুছিয়ে ফেলে দেয় ওয়েস্ট বক্সে। শার্টদুটো ঝুলিয়ে দেয় হ্যাঙ্গারে। চাদর তুলে দুটো ঝাড়া মেরে আবার বিছিয়ে দেয় বিছানায়। বালিশদুটোর দুই পাশে দুটো ঘুসি মেরে ফুলিয়ে রাখে ব্যাঙের মতো। কাজ শেষে ক্লান্তি লাগলে সে গা এলিয়ে দেয় বিছানায়। চোখ এঁটে আসি আসি অবস্থায় বাইরে থেকে তালা খোলার শব্দ হয়। মেয়েটা তাড়াতাড়ি উঠে বসে। রাফিদ দুই প্যাকেট ভুনা খিচুড়ি নিয়ে হাজির। প্যাকেটদুটো মেয়েটার হাতে দিয়ে সে দরজায় সিটকিনি তুলে দেয়। তারপরই তার চোখে ধরা দেয় বদলে যাওয়া ঘরের মানচিত্র। অবাক হয়ে বলে, আরেব্বাহ! করেছেনটা কী এসব! বাড়িওয়ালা যদি কখনো আসে, নিশ্চিত ধরা খেয়ে যাব! আলনা দেখেই বুঝে ফেলবে এই ঘরে বউ আছে।

বউয়ের কথা শুনে মেয়েটা লজ্জা পায়। শাহাদাত আঙুলের মাতায় ওড়না পেঁচিয়ে লাজুক গলায় বলে, যাহ! কী যে বলেন না!

আর শোনেন, তখন বাড়িওয়ালা আন্টি এসেছিল আমার চিৎকার শুনে কী হয়েছে জানার জন্য। বললাম, দুঃস্বপ্ন দেখে ভয় পেয়েছিলাম। ভালো বলিনি?

সত্য বলেছেন।

আচ্ছা ছবি, রুমে প্লেট একটা, প্যাকেট ধরে খেতে পারবেন না?

আলবত পারব।

তাহলে নিন, শুরু করুন। আপনার তো আবার অনেক খিদে পেয়েছে।

আপনি আমার জন্য একটু অপেক্ষা করুন। আমি ফ্রেশ হয়ে আসি। কষ্ট হবে না তো অপেক্ষা করতে?

কষ্ট কেন হবে! আপনি যান, আমি বসছি।

মেয়েটা ওয়াশরুমে ঢোকে আর রাফিদ খাবার সাজাতে বসে। পুরো ব্যাপারটা তার কাছে গোলকধাঁধার মতো লাগে। তবে যেমনই লাগুক মেয়েটার সান্নিধ্য তার ভালো লাগছে। তীব্র অসুখে মাথার কাছে আপনজন বসে থাকলে যেমন প্রশান্তি লাগে, তেমন। এই যে মেয়েটা তার ঘর গুছিয়ে দিল, একেবারে বউয়ের মতোন, তার মনে হচ্ছে, ঘরে এমন একটা বউ থাকলে মন্দ হয় না।

খাবার সাজাতে সাজাতে মেয়েটা বেরিয়ে আসে হাতমুখে পানির ছিটা দিয়ে। রাফিদ তোয়ালে এগিয়ে দেয়। মেয়েটা ধন্যবাদ জানায়।

খেতে খেতে রাজ্যের গল্প শুরু করে মেয়েটা। অনেকটা সাক্ষাতকারধর্মী।

আপনার প্রিয় খাবার কী?

আলুভর্তা, ডাল, চিঙড়ি মাছের মালাইকারি, ইলিশ মাছের ডিম।

প্রিয় রঙ?

নীল।

প্রিয় জায়গা?

আমাদের গ্রাম।

কখন অনেক দিন বাঁচতে ইচ্ছে করে?

সুন্দর কোন ছবি আঁকার পর।

মেয়েদের কোন জিনিসটা বেশি ভালো লাগে?

ওদের অভিমান।

এমন অসংখ্য প্রশ্নের ছয়লাবে পনের মিনিটের খাওয়া শেষ হয় সোয়া এক ঘণ্টায়। খাওয়া শেষে সেভেন-আপের বোতলের মুখ খুলতে খুলতে রাফিদের মনে পড়ে রাইশার কথা। তখন ঘড়ি বলছে সাড়ে ন’টা বাজে। রাফিদ একেবারে লাফিয়ে ওঠে। বিরাট সর্বনাশ হয়ে গেছে। এতক্ষণে রাইশা নিশ্চয় পৌঁছে গেছে রেস্টুরেন্টে। রাফিদের চেহারার বদলে যাওয়া রং দেখে মেয়েটা বলে, কী হল, ঠিক আছেন তো!

রাফিদ বলে, উত্তরায় খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা মিটিং আছে ন,টায়। অথচ এখন বাজে সাড়ে নয়। কী করি এখন!

তাহলে এখনই বেরিয়ে পড়ুন। বিলম্বের জন্য জ্যামের দোষ দিবেন। আমি থাকছি আপনার রুমে। অপনার জন্য অপেক্ষা করব। বাইরে থেকে তালা দিয়ে যান।

গোছাতে গোছাতে সময় যায় আরো পনের মিনিট। ট্রেন ধরার মতো ব্যস্ততায় বেরিয়ে পড়ে রাফিদ। দরজায় তালা ঝুলাতে ঝুলাতে দুইবার ফোন দেয় রাইশাকে। ফোন বন্ধ। রাফিদ মনে মনে অজুহাত ঠিক করতে থাকে যা রাইশার রাগের আগুনে পানির কাজ দেবে। কিন্তু জ্যাম ছাড়া জুতসই কোন অজুহাত খেলে না মাথায়। জ্যামের দোহাই দিয়ে পার পাওয়া যাবে না রাইশার হাত থেকে। সে বলবে, জ্যাম ঢাকা শহরের সোনালি ঐতিহ্য। এক ঘণ্টা হাতে নিয়ে বেরোও নি কেন! খুব যে রেগে গেছে সে, বোঝাই যাচ্ছে। রেগে গেলে সে ফোন অফ করে রাখে।

বাসা থেকে তড়িঘড়ি বেরোনোর মুখে দারোয়ান তাকে আটকায়। রাফিদের মুখ ফসকে বেরিয়ে যায় একটা গালি। কিন্তু দারোয়ান যা জানায় তা শুনে রাফিদের শিরাদাড়া বেয়ে শীতল রক্ত নেমে যায় সড়াত করে। উত্তরার যে রেস্টুরেন্টে তাদের মিট করার কথা, নয়টা পাঁচ মিনিটে সেখানে জঙ্গি হামলা হয়েছে। পাঁচজন নিহত। নিহতের ভেতর এক তরুণীও আছে। তবে কারো পরিচয় এখনো জানা যায় নি। দারোয়ান একটু আগে এই সংবাদ দেখেছে টিভিতে।

খবর শুনে লাটিমের মতো বোঁ করে ঘুরে ওঠে রাফিদের মাথা। তার মনে হয় পৃথিবীতে ভূমিকম্প শুরু হয়েছে। সবকিছু দুলছে। সেই দুলুনির ভেতরই রাফিদ তিনবার রাইশাকে ফোন করে। কিন্তু ফোন অফ। এই দুর্ঘটনার পরও রাফিদ উত্তরা যেতে চাইলে দারোয়ান তাকে বাঁধা দেয়। কারণ, উত্তরায় যাওয়া এখন কোনভাবেই নিরাপদ নয়। তাছাড়া পুলিশ জায়গাটা ঘেরাও করে রেখেছে। অগত্যা রাফিদ টলতে টলতে ফিরে আসে দোতলায়, তার রুমে। কষ্টে ভেঙে যাচ্ছে তার বুক। ছবি মেয়েটার কাছে সবকিছু বলে সে মনের বোঝা হালকা করতে চায়। কিন্তু রুমে ঢুকে সে দ্বিতীয় দফা চমকায়। মেয়েটা নেই। ভাবে ওয়াশরুমে। ওয়াশরুম চেক করে। সেখানেও নেই। রাফিদের মনে পড়ে সেই আর্টপেপারের কথা, যার উপর সে মেয়েটার ছবি এঁকেছিল। সে কি আবার ফিরে গেল তার গন্তব্যে! রাফিদ আর্টপেপার হাতে তুলে নেয়। মেয়েটা নেই সেখানে। আছে এক চিঠি। কাঁপতে কাঁপতে সে ঝাপসা চোখের সামনে মেলে ধরে কাগজটা:

‘জানি, আপনার মন খুব খারাপ। কারণ, এতক্ষণে উত্তরার রেস্টুরেন্টে জঙ্গি হামলার খবর পেয়ে গেছেন। এবং এটাও বুঝে ফেলেছেন, আপনার প্রেমিকা রাইশা এই জঙ্গি হামলায় নিহত হয়েছে। আপনার মনে আছে কি না জানি না, আলাপের শুরুতে বলেছিলাম, একটা উদ্দেশ নিয়ে আমি আপনার কাছে এসেছি। আমার সেই উদ্দেশ্য বলার সময় এসেছে। আসলে আমি এসেছিলাম আপনাকে বাঁচাতে। আর তাই অমন ইনিয়ে বিনিয়ে গল্প করে সাড়ে নয়টা পর্যন্ত রাইশাকে আপনার মগজ থেকে দূরে রাখতে পেরেছিলাম। আমি আপনার সৃষ্টির ছায়া। আমি চাইনি, আপনার মতো সৃষ্টিশীল মানুষ এতো শিগগির চলে যাক। আপনার মতো মানুষের খুব প্রয়োজন পৃথিবীর। আমার এই কাজ যদি আপনার কাছে হঠকারিতা কিংবা অনধিকার চর্চা মনে হয়, ক্ষমা চাইছি। আবার হয়ত আমি আসব। আপনার অন্য কোন সৃষ্টিতে হয়ত উন্মোচিত হব।’

চিঠিটা পড়ে রাফিদের সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়। রাইশাকে হারিয়ে ফেলার সাথে সাথে ছবি মেয়েটিকে হারিয়ে ফেলায় বড় অসহায় লাগে নিজেকে। বিছানায় শরীর ছেড়ে দিয়ে কতক্ষণ বসে থাকে সে নিজেই জানে না। ঝাপসা চোখে টিঠিটা দেখার পর অভিমানে টনটন করে ওঠে বুক। অভিমান থেকে ক্রোধ। না বলে চলে গেল মেয়েটা! বিদায় নেয়ার সৌজন্যটুকু দেখাল না! কাঁদতে কাঁদতে রাফিদ টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলে চিঠি। পরিত্যক্ত চিঠির টুকরোগুলো ওয়াশরুমে ফেলতে গিয়ে সে অনুভব করে, মেয়েটার শরীরের গন্ধ ভাসছে ওয়াশরুমে।



লেখক পরিচিতি
সাব্বির জাদিদ।
জন্ম: ১৯৯৪ সালের ১৭ আগস্ট।ইসলামী ‍বিশ্ববিদ্যালয় কুষ্টিয়ায় অধ্যয়নরত।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ