নীহারুল ইসলামের গল্প : সুফিয়ার আত্মকথা

দেশে নাকি যুদ্ধ লাগবে! যুদ্ধ! চারদিকে তেমনই ফিশফিশানি শোনা যাচ্ছে। আব্বা আমার স্কুল যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। স্কুলটা এখন নাকি একটা সেনা-ছাউনি। দেশের অবস্থা ভাল না।
যদিও আমি এসবের কিছুই বুঝতে পারি না। পদ্মার পাড়ে আমাদের গ্রাম। ওপারে ইন্ডিয়া। পদ্মাপাড়ে দাঁড়িয়ে পদ্মায় আগেও যেমন ভাসমান নৌকা দেখতাম, এখনও দেখি। পদ্মায় ভেসে বেড়ায় বেশিরভাগ জেলেদের মাছধরা ডিঙি নৌকা। পাল তুলে কিছু বড় নৌকাও চলাচল করে। চরে আমাদের দেশের যেসব গ্রাম আছে ওইসব গ্রামের মানুষেরা পারাপার হয়। ওদের সঙ্গে জীবজন্তুও থাকে। গরু-ছাগল-মুরগি। আমার খুব ইচ্ছে করে ওইসব নৌকায় চড়ে চরের গ্রাম পেরিয়ে ইন্ডিয়ায় চলে যেতে। মনে হয় দেখি আসি দেশটাকে। যে দেশে নবাবদের তৈরি হাজারদূয়ারি আছে। কাটরা মসজিদ আছে। হিমালয় পর্বত আছে। যে পর্বতের ওপর দার্জিলিং নামে একটা শহর আছে। খুব সুন্দর শহর নাকি! হাতে মেঘ ছোঁয়া যায়। শুধু তাই নয়, মেঘের ভেতর দিয়ে হাঁটা যায়। দরজা জানালা খোলা রাখলে ঘরের ভিতরেও মেঘ ঢুকে পড়ে।

কিন্তু যুদ্ধ যুদ্ধ ফিশফিশানিতে আমার শুধু স্কুল যাওয়া বন্ধ হল না, বিকেলবেলা যে সময়টুকু পদ্মাপাড়ে দাঁড়িয়ে কাটাতাম সেটাও বন্ধ হয়ে গেল। একদিন আব্বা মাকে বললেন, সুফিয়া যেন আর পদ্মার পাড়ে না যায়! গ্রামে রাজাকাররা ঘুরে বেড়াচ্ছে।

স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আমার তো খুব মন খারাপ ছিলই, তার ওপর এখন আবার পদ্মার পাড়ে যাওয়াও বন্ধ। কী করি বুঝে পাই না। সব রাগ গিয়ে পড়ে রাজাকারদের ওপর। তাই মাকে একদিন জিগ্যেস করি, মা রাজাকার কী?

মা বললেন, তোর অতসব বুঝ্যা কাম নাই। চুপচাপ ঘরে বস্যা থাক।

কিন্তু ঘরে বসে থাকতে বললেই কি ঘরে বসে থাকা যায়? পদ্মাপাড়ে যেতে ইচ্ছে করে যে! সেখানে তো আর সেনা-ছাউনি বসেনি। তাই এর মধ্যে লুকিয়ে একদিন পদ্মাপাড়ে গিয়ে হাজির হই। দেখি সেই একই দৃশ্য। পদ্মার স্রোত যেমন আগে বইত এখনও তেমনই বইছে। জেলেদের মাছ-ধরা ডিঙি নৌকাগুলি ভেসে বেড়াচ্ছে। বড় নৌকাও ভাসছে। তবে সংখ্যায় কম। যদিও তা নিয়ে আমার ভাবনা হয় না। বরং আমার মাথায় আবার সেই ইন্ডিয়া দেখার ইচ্ছেটা চেগে উঠে। হাজারদূয়ারি, কাটরা মসজিদ, হিমালয় পর্বত, দার্জিলিং শহর!

কিন্তু পদ্মাপাড়ে আমি বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারি না। আমাদের পাড়ার কাজল কোথা থেকে ছুটতে ছুটতে এসে হাঁফাতে হাঁফাতে বলল, বুবু- তুমি এখ্যানে বস্যা আছো। ওদিকে যেই দ্যাখো গা তুমাদের বাড়ির অবস্থা!

আমি জিগ্যেস করলাম, কেন- কী হয়েছে?

তুমাকে নাকি আলবদরের লোকেরা তুলে লিয়ে গেলছে, এমুন খবর শুন্যা তুমাদের বাড়িতে তুমার বাপ বেহুঁশ হুই গেলছে। আর তুমার মা পাগলের মুতোন কাঁদছে।

আমার মনে পড়ে আব্বা-মা আমাকে বাড়ি ছেড়ে বেরোতে বারণ করেছিল। আমি তাঁদের কথা না শুনে পদ্মাপাড়ে এসে বসে আছি। আর ওদিকে আমাকে খুঁজে না পেয়ে আব্বা-মা ...! আমার ইন্ডিয়া যাওয়ার ইচ্ছেটা কোথায় হারিয়ে যায়। হাজারদূয়ারি, কাটরা মসজিদ, হিমালয় পর্বত কিংবা দার্জিলিং শহরের কথা মনে থাকে না। শুধু বাড়ির কথা মনে পড়ে। আব্বাকে মনে পড়ে। মাকে মনে পড়ে। আমি বাড়ির উদ্দেশে ছুটতে শুরু করি।


দুই

আমার মায়ের পরিবার আমাদের এই অঞ্চলের খানদানি পরিবার। আমার আব্বার পরিবারও ইন্ডিয়ার খানদানি পরিবার। পদ্মানদীর এপার ওপার। তখন একটাই দেশ। মধ্যে একটা নদী। তবু কোনও ভেদ ছিল না। কিন্তু যখন দেশভাগ হল, দুই পরিবারের মধ্যে সীমানা গড়ে উঠল। যদিও এই দুই পরিবার চায়নি তাদের মধ্যে কোনও সীমানা গড়ে উঠুক। তাই আমার আব্বার পরিবার দেশভাগের সময় এখানে এসে উঠেছিল। আমার নানা তাঁদের আশ্রয় দিয়েছিলেন। আমার দাদুর সঙ্গে আমার নানার নাকি গলায় গলায় দোস্তি ছিল। সেই দোস্তি যাতে আরও মজবুত হয় তাই তাঁরা তাঁদের ছেলে-মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন পর্যন্ত। তার অনেক পরে আমার জন্ম।

রাতে মায়ের কোলে মাথা রেখে আমি এসব গল্প শুনলাম। এও শুনলাম যে আমার আব্বা যেহেতু ইন্ডিয়ার মানুষ তাই তিনি এখানকার অনেকের চোখে পাকিস্তান বিরোধী। আর পাকিস্তান বিরোধী মানেই বিধর্মী- কাফের। তার মানে আমার আব্বা কাফের। মাকে আমি জিগ্যেস করলাম, আব্বা কাফের হল তো কী হল?

মা বললেন, কাফের হলে অরা তোর বাপকে খুন কর‍্যা মারবে। তোকে আমাকে বাড়ি থেকে উঠিয়ে লিয়ে যাবে। আমাদের বাড়ি-ঘরে আগুন জ্বালিয়ে দিবে।

আমি আবার জিগ্যেস করলাম, ওরা কারা মা?

ওই রাজাকার-আল বদরের দল। এখন চুপ কর‍্যা নিঁদ যা তো!

আমি চুপ করলাম তবে নিঁদ যেতে পারলাম না। কে রাজাকার আর কে-ই বা আলবদর ভাবতে লাগলাম। বাইরে কুকুর ডাকছে। তাছাড়া আর কোনও শব্দ নেই। তাই বুঝি আমার মনে হল কুকুরের ওই ডাক যেন আতঙ্ক ছড়িয়ে বেড়াচ্ছে দুনিয়াজাহানে।


তিন

পরের দিন সকালবেলা দেখি বাড়িতে একজন নতুন লোক। লোক বলতে খুব বেশি বয়স না। ছেলেমানুষই। তবে আমার চেয়ে বয়সে বেশ বড়। আমাদের বৈঠক-ঘরে বসে আব্বার সঙ্গে গল্প করছেন। মাকে জিগ্যেস করতে মা বললেন, তোর আব্বার কেমুন ভায়ের ছেল্যা। তোর ভাই লাগে। এই দুঃসময়ে হামরা সব কেমুন আছি তার খবর লিতে এস্যাছে। যা চা দিয়ে আয় গা।

আমি যাব চা দিতে! মনটা কেমন করে উঠল। মাকে জিগ্যেস করলাম, আমি চা দিতে যাব কেন? তাজকেরা খালা কোথায়?

মা বললেন, কে জানে! কতি মরতে গেলছে? আইজ অর এখুনো কুনু পাত্তা নাই।

তাজকেরা খালা আমাদের বাড়ির কাজের মেয়ে। বয়সে আমার থেকে সামান্য একটু বড়। যদিও এর মধ্যেই তার বিয়ে হয়েছিল। দু’টি বাচ্চাও আছে। কিন্তু স্বামী ভাত দেয় না। তাই আমাদের বাড়িতে কাজ করে দুই সন্তানকে নিয়ে জীবন অতিবাহিত করে। সেই তাজকেরা খালা নাকি আজ কাজে আসেনি! তাহলে আজ কী হল তার? কই-একদিনের জন্যেও তো কখনও তাকে কামাই করতে দেখিনি!

আমার কেমন সন্দেহ হয়। আমার মন কু গাইতে শুরু করে। সেনা! আল-বদর! রাজাকার! যদিও এদের নিয়ে আমার তেমন কোনও ধারণা নেই। বেশকিছুদিন থেকে শুনে শুনে যেটুকু বুঝেছি তাতে এরা ভাল নয়, খুব খারাপ। এরা আমার আব্বাকে কাফের ভাবে। তাহলে এরা আমার তাজকেরা খালার কোনও অনিষ্ট করেনি তো? না, আমি এ ব্যাপারে মাকে কিছু জিগ্যেস করি না। চা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছিল, মায়ের দেওয়া ট্রে-তে সাজানো চা নিয়ে গিয়ে হাজির হই আমাদের বৈঠক-ঘরে।

শুধু চা নয়, চায়ের সঙ্গে প্লেটে বিস্কুটও আছে। যিনি এসেছেন তিনি শুধু অতিথি নন, আমার নাকি আত্মীয়! কেমন ভাই লাগে। ভাল করে দেখলাম তাকে। দেখে আর পাঁচজনকে যেমন লাগে তেমনই লাগল। আত্মীয় বলে মনে হল না। আমি ফিরে এলাম আবার রান্নাঘরে। মা জিগ্যেস করলেন, চা দিয়ে এলি?

আমি বললাম, হ্যাঁ।

কেমুন?

মায়ের কথায় আমি চমকে উঠি। মাকে জিগ্যেস করি, কেমুন কী?

বুলছি কী, তোর ওই ভাইটোকে কেমুন দেখলি?

তাজকেরা খালা আজ কাজে আসেনি তবুও মায়ের কোনও বিরক্তি নেই। অথচ অন্যদিনে কাজের সময়- বিশেষ করে এই সকালবেলা তাজকেরা খালা সঙ্গে থাকা সত্বেও মায়ের চোখের সামনে দাঁড়াতে রীতিমতো ভয় পেতাম। অথচ আজ মা হেসে হেসে কথা বলছেন।

অবাক হলেও বললাম, ভাল।

মা যেন আমার কথায় খুশি হলেন। বললেন, তোর আব্বা আর আমি ভাবছি এনামুলের সুথে তোকে ইন্ডিয়ায় পাঠিয়ে দিব।

এনামুলের সঙ্গে আমাকে ইন্ডিয়ায় পাঠিয়ে দিবে মানে! কে এনামুল?

কেনে, তোর ওই ভাই!

মায়ের কথায় আমার আবার হাজারদূয়ারি, কাটরা মসজিদ, হিমালয় পর্বত, দার্জিলিং শহরের কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে কী, আমি যেন সবগুলিকেই একসঙ্গে স্বচক্ষে দেখতে পাই।


চার

দুপুরে খাওয়াদাওয়া পর আমি আমার এনামুলভায়ের সঙ্গে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়ি ইন্ডিয়ার উদ্দেশে। আমাদের বাড়ির খুব কাছেই পদ্মার ঘাট। নৌকা বাঁধা ছিল। আমি আর এনামুলভাই গিয়ে চড়লাম সেই নৌকায়। নৌকা ছেড়ে দিল। উথালপাথাল পদ্মা এই সময়ে খুব শান্ত। তবে উত্তরে বাতাস আছে। প্রচন্ড ঠাণ্ডা। আমি রীতিমতো কাঁপছি। এনামুলভাই বলল গায়ে ভাল করে চাদর জড়িয়ে নিতে। আমি সেটাই করলাম। তবু ঠান্ডা যায় না। যেন আমি দার্জিলিংয়ে এসে পড়েছি। আমার স্কুলের শিক্ষক তরুস্যারের মুখে শুনেছিলাম, ‘দার্জিলিং এমনই জায়গা- যেখানে সোয়েটার, চাদরে কিছু হয় না। ঠান্ডার চোটে শরীরে কাঁপুনি ধরে।’ আমার শরীরেও কাঁপুনি। আমি দার্জিলিংকে উপভোগ করছি।

কখন যে পদ্মা পেরিয়ে গেলাম, টের পেলাম না। কিন্তু এবারে বালির চর। নির্দিষ্ট চলার কোনও পথ নেই। মানুষ হাঁটছে দেখে আমরাও হাঁটছি। যেমন পিঁপড়ে হাঁটে! আমার সঙ্গী এনামুলভাই।

গ্রামে থাকতে পদ্মাপাড়ে দাঁড়িয়ে আমি ইন্ডিয়াকে দেখতাম। অথচ ইন্ডিয়ার পথে হাঁটতে হাঁটতে আমি দেখছি পদ্মার চর। যেখানে শুধুই বালি আর বালি। আর কিছু নেই, যেন সাহারা মরুভূমি!

কোথায় যেন পড়েছিলাম সাহারা মরুভূমিতে নাকি উট পাওয়া যায়! এনামুলভাইকে সেকথা জিগ্যেস করি। সে বলে, কুরবানির আগে আমাদের বেলডাঙা হাটে আসে। লোকে কিনে নিয়ে যায় কুরবানি দেওয়ার জন্যে।

এনামুলভায়ের কথায় আমি চমকে উঠি। তাকে জিগ্যেস করি, আপনি কী করেন?

ব্যবসা।

কীসের ব্যবসা?

এই আমদানি রপ্তানির।

কতদূর পড়াশুনা করেছেন?

এবারে আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে এনামুলভাই বলে, ওই যে গ্রামটা দেখছো সুফিয়া! ওটা তোমাদের দেশেরই গ্রাম। নাম কোদালকাটি।

আমিও আমার প্রশ্ন ভুলে তার দেখা গ্রামটিকে দেখি। সত্যিই কী সুন্দর একটি গ্রাম। তাও এই সাহারা মরুভূমির মধ্যে। আমার যে কী ভাল লাগে! নিজের গ্রামটিকে মনে পড়ে। সঙ্গে আব্বা এবং মাকেও।

একটা শিরদাঁড়ার মতো কিছু একটা। তার ওপর পাশাপাশি সব ঘরবাড়ি। গাছগাছালির ছায়া। আমার অদ্ভুত লাগে। কতক্ষণে সেখানে পৌঁছাব সেই ভাবনায় আমার শরীরের কাঁপুনি থেমে যায়। আমি জোরে আরও জোরে আমার শিরদাঁড়া শক্ত করে এনামুলভায়ের সঙ্গ ধরে হাঁটতে থাকি।


পাঁচ

সত্যিই শিরদাঁড়ার মতো বেশ লম্বা উঁচু একটা পাড়। তার ওপরেরই গ্রামটা। সব হতদরিদ্র মানুষের বাস। বাড়ি-ঘরের চেহারা দেখেই তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। হঠাৎ এনামুলভাই আমাকে জিগ্যেস করল, পানি খাবে?

এনামুলভায়ের কথায় বালির চরে এতটা পথ হেঁটে এসে সত্যি যে আমার পানির পিয়াস পেয়েছিল, হঠাৎ-ই টের পাই। বলি, খাব।

আমার একথা শুনে একটা বাড়ির দরজায় আমাকে সঙ্গে করে এসে দাঁড়ায় এনামুলভাই। হাঁক ছাড়ে, কে আছেন গো- একটু পানি খাওয়াবেন!

প্রায় সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে এক বৃদ্ধ বেরিয়ে এলেন। আমাদের দেখে বললেন, পানি খাবেন তো বাহিরে দাঁড়িয়ে কেনে? ভিতরে আসেন। বলে বৃদ্ধ লোকটি আবার সেই বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলেন। পিছে পিছে এনামুলভাই। তার পিছে আমি।

এই গ্রামের অন্য বাড়িগুলির চেয়ে এই বাড়িটা একটু অন্য রকমের। অন্য বাড়িগুলির টাটি-বেড়ার তৈরি, কিন্তু এটা ইটের গাঁথুনি। অন্য বাড়িগুলিতে যেখানে পাটকাঠির ঝাঁপের দরজা এই বাড়িতে সেখানে কাঠের পাল্লা। অথচ বাড়িতে ওই বৃদ্ধ ছাড়া আর কোনও প্রাণী নেই। এমন কী একটাও মুরগি চরে বেড়াচ্ছে না কোথাও।

আমার কেমন সন্দেহ হয়। আমি এনামুলভাইকে কিছু জিগ্যেস করব তার আগে সেই বৃদ্ধ আমাদের দু’জনের হাতে দু’গেলাস সরবত ধরিয়ে দেন। চোখ বন্ধ করে পরম তৃপ্তিতে আমি সেই সরবত পান করি।

ছয়

তারপর কতক্ষণ কেটে গেছে, কী হয়েছে- আমি তার কিছুই জানি না। শুধু চোখ মেলতে গিয়ে দেখি চোখের পাতা খুলতে পারছি না। চোখ কেমন টেনে টেনে আসছে। তবে আমি যে একটা চৌকির ওপর বিবস্ত্র অবস্থায় শুয়ে আছি তা টের পাচ্ছি। আমার শরীরে অসহ্য যন্ত্রণা! তার মানে আমার ওপর দিয়ে প্রচন্ড একটা ঝড় বয়ে গেছে। আমার যা সর্বনাশ হওয়ার হয়ে গেছে। না, এরপর আর চোখ বন্ধ করে বিছানায় পড়ে থাকা যায় না। আমি উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করি। উঠতে গিয়ে দু’বার টাল খেয়ে পড়ি। শেষপর্যন্ত তবু উঠে দাঁড়াই। কিন্তু ঘরটা যে বড্ড অন্ধকার! চৌকিতে বসে একটু ধাতস্থ হই। ঘরে জানালা-টানালা কিছু নেই। তবে ইট খসে দেওয়ালের একটু উঁচুতে একটি ফুটো আছে। সেখান দিয়ে ক্ষীণ আলো প্রবেশ করছে। সেই আলোতে আমি ঘরটাকে দেখি। আসবাব তেমন কিছুই নেই। একদিকে শুধুই একটা চৌকি, তার ওপর লণ্ডভণ্ড একটা বিছানা। আর একদিকে একটা টেবিল। তার ওপর পানির জগ। আর কয়েকটি কাঁচের ফুল-তোলা গ্লাস। মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে কয়েকটি কাগজের ঠোঙা, পোড়া সিগারেটের অংশ। যেগুলিকে ঘিরে পিঁপড়েদের উৎসব চলছে। তার পাশেই পড়ে আছে আমার পরণের পোশাক। যা দেখে আমার ভীষণ কান্না পাই। তবু আমি কাঁদতে পারি না। টের পাই কাছে ভিতে কোথাও হয়ত বাঁশের ঝাড় আছে। পাখপাখালিরা সব জেগে উঠছে। তাদের কিচিরমিচিরে ভরে যাচ্ছে পৃথিবী। তাহলে এখন আমার কান্না শুনবে কে?

হঠাৎ আমার মনে প্রশ্ন জাগে- কে ওই এনামুলভাই? যার হাতে আব্বা-মা আমাকে তুলে দিয়ে আমার সর্বনাশ বাঁচাতে চেয়েছিল? সেই বুড়োটাকেও আমার স্মরণ হয়, যে বাড়ির দরজা খুলে দিয়েছিল! সরবত খেতে দিয়েছিল! না- আমি আর বসে থাকতে পারি না, চৌকি ছেড়ে উঠে কোনও রকমে পরণের পোশাক পরে ঘরের দরজার দিকে এগিয়ে যাই। আশ্চর্য- পাল্লা ধরে টান দিতে দরজাও খুলে গেল। খুব সাবধানে বেরিয়ে দেখি বাইরে বারান্দায় বুড়োটা গভীর ঘুমে অচেতন। এনামুল নামের শয়তানটারও পাত্তা নেই। তাহলে এটাই সুযোগ। আমি খুব সন্তর্পণে ওই অভিশপ্ত বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পদ্মার চরে নেমে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূণ্য হয়ে ছুটতে শুরু করি।


সাত

নদীর ঘাটে পৌঁছে দেখি নৌকা বাঁধা আছে। কিন্তু মাঝি কিংবা পারাপারের কোনও লোকজন নেই। কোথায় গেল তাহলে সব? এদিক ওদিক তাকিয়ে শেষপর্যন্ত ঘাট থেকে বেশ কিছুটা দূরে, আমাদের পাশের গ্রাম চর-বাঘডাঙার সামনাসামনি মানুষের জটলা দেখতে পাই। নিশ্চয় তাহলে ওরা সব পারাপারের মানুষজন! তাহলে কি ওখানেও কোনও ঘাট আছে? পায়ে পায়ে এগিয়ে যাই সেদিকেই। আর গিয়ে দেখি পদ্মার স্রোতে ভেসে আসা তাজকেরা খালার অর্ধউলঙ্গ লাশ। জটলা হা করে দেখছে। কারও মুখে কোনও কথা নেই। ভয়ে।

আমিও কোনও কথা বলতে পারি না। কী বলব? আমি যে আমার নিজের লাশকেই দেখতে পাচ্ছি ওই তাজকেরা খালার লাশের মধ্যে ...

----------+
মে ২০১৭।। ‘সাগরভিলা’, লালগোলা, মুর্শিদাবাদ, ৭৪২১৪৮, পশ্চিমবঙ্গ, ভারতবর্ষ।। মুঠোফোন : ৯৪৩৪৯৯৫৪৬৫ / ৯৬৭৯০১৩৯৯৬

e-mail: niharulislam@yahoo.com






[সুফিয়ার আত্মকথা : ৫]























একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ

  1. সমাপ্তিতে এমন একটি করুন রস অপেক্ষায় ছিল বুঝতেই পারিনি...........

    উত্তরমুছুন