সময়টা উনিশশো ছত্রিশ কি সাইত্রিশ হবে । আমার অফিসেই কাজ করতো ছেলেটা । বিয়ে-টিয়ে করেনি । একটু সরল, সাদাসিধে গোচের, কিন্তু বেশ কাজের । কিভাবে যেন রাশিয়ান উদ্বাস্তুদের সাহায্যার্থে আয়োজন করা এক সরকারি অনুষ্ঠানে লটারিতে বেড়াতে যাবার একটা টিকিট পেয়েছিল । বার্লিনে তখন গরমকাল, তবে খাতায় কলমেই । সপ্তাহ দুয়েক হল যেমন মেঘলা, স্যাঁতস্যাতে, তেমনি হাড় কাঁপানো ঠাণ্ডা । যে দু একটা সবুজ পাতা উঁকি দিতে শুরু করে ছিল তাও গুটিসুটি মেরে কোথায় লুকিয়ে পড়ল কদিনে । শুধু কটা চড়ুই পাখির কিচির-মিচির থামেনি ।
বেড়ানোর টিকিট পেলেও কোথাও যাবার তেমন ইচ্ছে ছিল না । প্রথমে ভেবেছিলো যেহেতু সরকারি টিকিট, সরকারি অফিসেই ফেরত দিয়ে আসবে । কাজের ফাঁকে একদিন সেখানে গিয়ে জানতে পারে যে ফেরত দিতে গেলে যোগাযোগ মন্ত্রালয়ের বিশেষ আনুমতি লাগবে । তার আগে লম্বা চওড়া একটা দরখাস্ত তৈরি করতে হবে এবং একটা স্ট্যাম্পপেপারে অনুপস্থিতির কারন লিখে সরকারি আমলাকে দিয়ে সই করাতে হবে । এছাড়াও আলাদা ভাবে স্থানীয় পুলিশের কাছ থেকে একটা সম্মতিপত্র দরকার।
অগত্যা একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাসের সঙ্গে যাওয়ার সিন্ধান্তই নিতে হয়েছিল । এক বন্ধুর কাছে ধার নিল একটা স্টিলের জলের জায়গা । কিছুদিন ধরে জুতোয় জল ঢুকছিল । মুচির কাছে গিয়ে সারালো । কিনল একটা বেল্ট আর সুতির ছাপা সস্তা জামা । জানাই ছিল যে একবার ধোলাই দিলেই কাঁচুমাচু করে ছোটো হয়ে যাবে । তাই দেখে শুনে কিছুটা ঢিলাঢালা গোচের একটা পছন্দ করেছিল । মাপ করে চুল ছাঁটা থাকতো । দিপ্তিময় অথচ দয়ালু দুটো চোখ । নামটাই মনে পড়ছে না ঠিক । খুব সম্ভবত ভাসিলি ইভানভিচ ।
যাবার আগের রাতে ভাল ঘুম হয় নি । সারারাত মাথার মধ্যে বিছানার পাশের টেবিলে রাখা গোলাকার ঘড়িটার ছবি মাথায় ভাসছিল । তার ছোটবড় দুটো কাঁটার সরে সরে যাওয়া, রোমান হরফে এক থেকে বারো লেখা সংখ্যা গুলোর বেষ্টনী । অন্ধ্যকারে জ্বলতে থাকা রেডিয়াম । আধাস্বপ্নে এই সব দেখতে দেখতে ভোর রাতে ঘুম ভেঙে গেছিল । সময় মতো রেলস্টেশনে না পৌঁছাতে পারার একটা আশঙ্কা একটু ছিল ঠিকই, কিন্তু একটা ধোঁয়া ধোঁয়া প্রত্যাশাও মাথায় বাসা বেঁধে ছিল । হয়তো না চেয়েও এই ঘুরতে পাওয়ার সুযোগটা আসলে বিশেষ কোনও কারনেই এসেছে । একটা কি সুখের পথ যা সে সারাজীবন খুজে চলেছে ? যে সুখ ছাপিয়ে যাবে তার শৈশবের স্মৃতিগুলোও । কবিতার পংতির মতো সুন্দর একটা কিছু । অথবা বহুদিন আগে ঘুমের মধ্যে দিগন্তে জমে ওঠা সন্ধ্যার লালচে মেঘরাশির । এখনো মনে আছে । কে বলতে পারে যে সেই দৃশ্যটাই তার অপেক্ষায় দিন গুনছে না । এক যুগ ধরে এক বিবাহিত মহিলার প্রতি তার এই পরিনতিহীন, এক তরফা যে প্রেম, তার চেয়েও হয়তো অর্থবহ, গভীর কিছু । যেন একটা পথ নির্দিষ্ট হয়ে আছে । একটা ভবিতব্য । কে বলতে পারে ?
সপ্তাহের অন্য দিন গুলোর মতো সকালটা সেদিনও মেঘলা । কিন্তু মনের মধ্যে জ্বলে ওটা এক সূর্যের উষ্ণতা অনুভব করছিলো সে । ট্রামের বগীর সঙ্গে নড়তে চড়তে দূরের রেল স্টেশনের যাত্রাপথ, খুব খারাপ লাগছিল না । টিকিটে লেখা ছিল সকাল সাত’টা । ছ’নম্বর জানলা । মিনিট তিনেক দেরি হয়েছিল । পৌঁছে দেখল যেমন টা ভেবেছিল ঠিক তেমনটা নয় । কারন সে একা নয়, আরও কিছু লোকজন অপেক্ষা করছিল সেখানে । মনে হয় ওরা অনেক আগে এসেছে । দু একজন তো ওখানেই ঘুমচ্ছিল ।
চারপাশ চোখ বোলাতে গিয়ে ঢেঙা লাল চুলো কমবয়সী ছেলেটাকে প্রথমেই চোখে পড়লো । মাথায় বলিভিয়ান টুপি । মোরগ চূড়া ফুলের মতো চোখ টাটানো রঙ । লালচে লোমশ হাত-পা । চোখ মুখ চকচকে । কাঁধে এক বিশাল ঝোলা । মনে হয় বেশ ভারী । সহজেই বোঝা গেল যে সরকারি অফিস থেকে ওকেই এই বেড়ানোর বাবস্থাপনার জন্য নেতা নিযুক্ত করা হয়েছে । যেই নতুন আসছে, তাকেই একটু এগিয়ে এসে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে একটা দাঁড়িয়ে থাকা ট্রেনের বগির দিকে এগিয়ে দিচ্ছে । তারপর অনায়াসেই কাঁধের ভারী ঝোলাটাকে দোলাতে দোলাতে আবার পরের জনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে । পায়ে হাজার পেরেক পোঁতা জুতো আর নানান ঝালুর-ঝুলুর লোহা লস্কর । চলাফেরায় ঝনঝন আওয়াজ ।
এখনো পর্যন্ত চারজন মহিলা আর সমান সংখ্যক পুরুষ । ভাসিলিকে নিয়ে বিজোড় সংখ্যায় হল ওদের দল । ফাঁকা ট্রেনে সবাই সহজে জায়গা পেল । তৃতীয় শ্রেণীর বগী সেটা প্রায় চোখ বুজেই বলা যায় । একটু নিভৃতে বসে পিপারমেন্ট মুখে দিল । সাথে টিউটিচেভের একটা ছোটো সংস্করণ । অনেকবার পড়া । তবু ওর সাথে সাথে ঘোরে । সময় পেলেই চোখ চলে যায় প্রিয় কটা কবিতায় । বইটা খুলে মুখের সামনে ধরতেই ডাক । ওদের মধ্যে একজন চশমা-পরা বয়স্ক লোক অনেক কিছু বলে যাচ্ছিল । বোঝা গেল সে পোস্ট অফিসের কেরানী । নীলচে অমসৃণ গাল, চিবুক । মনে হচ্ছে বাড়ি থেকে আসার আগে সেগুলো কাটাছাঁটায় বেশ পরিশ্রম করতে হয়েছে । আলাপ হবার আগেই কিছুটা ঘোষণার ছলে বলে উঠল যে সে কয়েকবার রাশিয়া গ্যাছে, শুধু তাই নয় কিছু রাশিয়ান কে চেনেও সে ; যেমন পাটজুলি নামের মেয়েটা – সেই ভল্গগ্রাদের কয়েক রাতের সঙ্গিনী । এখনো মনে আছে । কথা গুলো রসিয়ে শেষ করতে করতে একবার চোখ পিটপিট করল । মনে হল তার নাদুশ-নুদুস স্ত্রী একটু অস্বস্তিতে পড়েছে । ইতিমধ্যে আরও কিছু লোকের জমায়েত । একটু হৈচৈটাও বাড়ছে । চারজন ছেলে মেয়ে । চেনাশোনা। মনে হল সহকর্মী । একে অপরের উদ্দেশ্যে বেশ ভারী-ভরকম রকমের স্থূল ঠাট্টা তামাশা ছোঁড়াছোঁড়ি করতে থাকল । কমবয়সী ছেলেটার নাম স্লজ । মধ্যবয়স্ক লোকটা, সেও স্লজ । মেয়ে দুটো চুলবুলে প্রকিতির । পুরু ঠোঁট । ভরাট শরীর । একটু খুঁটিয়ে দেখলে বোঝা যায়, লালচে চুলের ছোটো মতো স্কার্ট পড়া মেয়েটা আসলে মধ্যবয়স্কা । সেও রাশিয়া সম্বন্ধে কিছু জানে ।অন্তত রিগার সমুদ্রসৈকতটা । এদের মধ্যে কালচে কম বয়সী একজন । নাম স্ক্রাম । চোখদুটো খেয়াল করার মতো নিস্প্রভ । একটু কৃপণ গোছের মানুষ বলে মনে হয় । এটা ওটা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে বার বার প্রমোদভ্রমনের এই সুযোগের প্রশংসায় পঞ্চমুখ । পরে জানা গেলো আসলে সেও সরকারী পর্যবেক্ষক।
ধোঁয়া ছেড়ে কনুই মুড়তে মুড়তে ট্রেনটা বেশ জোরেই ছুটছে । কখনও পাইনের ঘন অরন্য, কখনও ফাঁকা মাঠ ধরে চোখের কিছুটা বিশ্রাম, আবার অরণ্যের অন্ধকার । অচেনা এই পরিস্থিতি আর অপছন্দের কিছু সহযাত্রীর মাঝে বসে কখনও কখনও কেমন একটা শঙ্কা উঁকি দেয়। ভাসিলি সেটাকে প্রশ্রয় দিতে চায়না । সে ভাবে কত বড় একটা বিস্ময় এই পৃথিবী । শুন্যে ভাসতে ভাসতে নাগরদোলার মতো ঘুরে একই জায়গায় ফিরে আসে প্রতিদিন । তার ওপর গাছগাছালি, পশুপাখি, জনপদ । এই অজানা রাস্তা, অচেনা এই মানুষদের মাঝেও হয়তো কোনও বিস্ময় তারই অপেক্ষায় আছে । হঠাৎ জানলা দিয়ে ছিটকে এসে সূর্যটা হলুদ বেঞ্চিতে ছড়িয়ে পড়লো । ট্রেনর চ্যাপ্টা ছায়াটা হন্তদন্ত হয়ে ছুটছে । ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে বুনো ঘাসের ঢিবি, সেখানে নাম না জানা ফুলের রঙিন পাতলা স্তর । একটা রেল ক্রসিং । সাইকেল থেকে একটা পা মাটিতে রেখে অপেক্ষা করছে কেউ । গাছেরা কখনও সারে সারে, কখনও একলা এগিয়ে আসে, এক পাক খেয়ে আবার ফিরে যায় । হালফিল কোনও ফ্যাশনের প্রদর্শনীর মতো। দূরের নীলচে উপত্যকা থেকে ভেসে আসছে ভ্যাপসা একটা বাতাস । ছড়িয়ে থাকা তৃণভুমিতে লুকিয়ে পড়ছে এক পুরনো প্রেমের স্মৃতি । পালকের মতো মেঘ – সর্গ থেকে ছুটে আসা লম্বা পায়ের কুকুর দল ।
আমার আর ভাসিলির এ ব্যাপারে কিছুটা মিল ছিল । আমরা দুজনেই প্রকৃতির অগাধ আজানা রূপের বিস্তৃতি নিয়ে ভাবতাম । প্রকৃতি মানুষের স্বত্বার কাছে ভয়ঙ্কর সব প্রশ্ন রেখে যায় । ওই যে হাঁটাপথ ;ওই যে ঘন অরন্যে হারিয়ে গেলো । একটু হাঁটলে কোথায়ে নিয়ে যাবে সে ? কোনোদিন কি কেউ জানতে পারবে আর ? হয়তো দূরের কোনও টিলায় অথবা গাছের পাশে পাশে কিছুক্ষণের জন্য বেঁচে উঠবে সেই পথ, বিশ্রাম নেবে, যেমন বাতাস ফুসফুসের মধ্যে দাঁড়ায় কিছুক্ষন । দাঁড়িয়ে দেখবে সুন্দর কোনও বনভূমি, একটা ঘোরানো সিঁড়ির মতো ধাপ । কোমলতার কি নিখুঁত অভিব্যাক্তি – একটা মন্ত্রমুগ্ধতা । ট্রেন টা থামিয়ে যদি ওখানে যাওয়া যেত – চিরতরে – হয়তো খুঁজে পেলেও পাওয়া যেতো হারিয়ে যাওয়া এক আধটা সম্পর্ক । অন্তত একটা সম্ভাবনা তো আছে । একদল পুরুষালী গাছ হঠাৎ সামনে ছুটে এসে সব মুছে জ্বলন্ত সূর্যের হ্রদে হারিয়ে গেল । মনের প্রসন্ন ভাবটাও নিয়ে গেল সাথে ।
স্টেশনে ট্রেন থামলে ভাসিলি এখানে সেখানে পরে থাকা তুচ্ছ জিনিসপত্র খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দ্যাখে । ঘসে যাওয়া প্লাটফর্মের মেঝে, সেখান থেকে বেরিয়ে পড়া লালচে পাথর, তার উপর পরে থাকা সিগারেটের টুকরো, এইসব । সেগুলো দেখতে দেখতে সে ভাবে এই তিনটে সামান্য জিনিস এখন ঠিক যেভাবে এই মুহূর্তে আটকে আছে, ওদের মধ্যে যে একটা সম্পর্ক সেটা সে ছাড়া আর কেউ জানবে না কোনোদিন । কিছুদিন পর সেও হয়তো ভুলে যাবে । ষ্টেশনে অপেক্ষারত কিছু স্কুল পড়ুয়া । ওদের দেখতে দেখতে মনে হল, এমনও তো হতে পারে যে অনেক অনেক দিন পরে ওদের একটা গ্রুপ ফটোতে এই ছবিটাই তোলা থাকবে । একটা বেহালা, একটা মুকুট অথবা একটা বিখ্যাত যন্ত্রের পাশে রাখা থাকবে সে ছবি । লেখা থাকবে ‘বীরপুরুষের শৈশব’ ; আর মাথার ওপর একটা সাদা দাগ টেনে চিহ্নিত করা থাকবে ওই পেছনের সারির ডানদিকের শেষের ছেলেটাকে । ভাবনাটা আরও দানা বাঁধার আগেই জানলা দিয়ে একটা কাগজ উড়ে এলো। লেখা একটা গান । জাতীয় সঙ্গীত গোছের । মনে হয় সরকারি অফিস থেকে দেওয়া । সমবেত ভাবে গাইতে হবে ।
মুক্ত করো ভয়, বন্ধ করো ক্ষয়
শক্ত করো হাত, আর তো ক্লান্তি নয়
এসে গ্যাছে ডাক, আজকে কাজটা থাক
দূরে চলো দূরে যাবো, মৈত্রী যদি হয়
এই যে তোমার দেশ, অন্য কারো নয়
দূরে চলো দূরে যাবো, মৈত্রী যদি হয়
আর তো ভাবনা নয়, হাতে হাতটা দাও
একলা একলা মন, জেনো কারো বন্ধু নয়
একটা দুটো পা, আরো দশটা পা
নীলচে নীলচে জল, আবার তোরা বল
মুক্ত করো ভয়, বন্ধ করো ক্ষয়
দূরে চলো দূরে যাবো, মৈত্রী যদি হয়
ভাসিলি শুধু গান গাইতেই জানতো না তা নয়, সে জার্মান শব্দ পরিষ্কার উচ্চারণও করতে পারত না । তাই সে সবার গর্জনের আড়ালে মুখ নাড়িয়ে গাওয়ার ভান করতে থাকল । কিন্তু স্ক্রামের ইশারায় দলের নেতার সেটা চোখে পরে গেল । সে তির্যক ভাবে একটু চোখ কুঁচকে চাইল, তারপর, সবাইকে থামিয়ে ভাসিলিকে একা গাইতে বলল । প্রথমে একটু থতমত খেলেও, একটু সামলে নড়বড়ে মৃদু গলায় শুরু করল সে । মিনিট খানেক সেটা চলার পর সবাই গলা মেলাল । পরের অংশটায় সে আর ফাঁকি ছিল না । অনিচ্ছায় গেয়ে চলল ।
সন্ধ্যা নামছে । পশ্চিমের গাড় লাল সূর্যটা প্রায় ঢুকে আসছে ট্রেনের জীর্ণ বগীটায় । সবার কাছে যা যা রসদ আছে রাতের খাবারের জন্য জমা করতে বলা হল । সবাই কে সমান সমান ভাগ করে দেওয়া হবে। ও কিছু শসা, একটা পাউরুটি আর তিনটে ডিম এনে ছিল । প্রিয় রাশিয়ান দোকান থেকে কেনা । ভাগাভাগিটা খুব সহজই ভাবে হয়ে গেল, শুধু শসাগুলোই সবার রসিকতার খোরাক হল । কেউ কেউ ‘অখাদ্য’ বলে জানলা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলেও দিল । এই অক্ষমতার কথা মাথায় রেখে সে রাতে সসেজের ভাগ একটু কম পেল ভাসিলি ।
খাবার পর ওকে তাস খেলায় যোগ দিতে হল । তারপর মানচিত্র খুলে যাত্রাপথ বিষয়ে নানান জিজ্ঞাসাবাদ । পর পর কিছু প্রশ্নবান সামলালেও সেসব উত্তর তেমন মনে ধরল না কারোর । বরং ছোঁয়াচে রোগের মতো ওকে নিয়ে একটু খুঁটে খুঁটে দেখতে ইচ্ছে হচ্ছিল অনেকেরই । প্রথমে একটু ভদ্রভাবে তারপর যত রাত বাড়তে থাকল সেটা তত হিংস্র রুপ নিতে থাকল । দুটো মেয়ের নামই গ্রিটা। লালচুলের মধ্যবয়স্কা; তারও কেমন সাহস বাড়ছে । যেন সেও আরেক এক লালচুলো নেতা । তৃতীয় শ্রেণীর টিমটিমে আবছা আলোয় স্ক্রাম, স্লজ, অন্য স্লজ, পোস্ট অফিসের কেরানী তার বউ সবাই ধিরে ধিরে একসাথে মিলে মিশে গেল । যেন একটা টলটলে ভয়ঙ্কর মাংসপিণ্ড। অনেকগুলো হাত-পায়ের কোনও এক জন্তু । যার থেকে কোনও নিস্তার নেই । ওটা সব দিক থেকে ওর দিকে চেপে আসছিল । হঠাৎ কোন একটা স্টেশনে ট্রেনটা থামতে সবাই এক মুহূর্তে আবার আলাদা আলাদা । চারিদিক বেশ অন্ধকার, তবু পশ্চিমে খুব লম্বা, গোলাপি রঙের একটা মেঘ তখনও বেঁচে ছিল। আরও দূরে রেল লাইন বরাবর তীক্ষ্ণ একটা কম্পমান আলোর বিন্দু । ইঞ্জিনের মন্থর ধোঁয়ার ওপার থেকে চেয়ে আছে মহাকাশের কোনও এক নক্ষত্র । অন্ধকারে ঝিঁঝিঁর ডাক । কোথা থেকে ভেসে আসছে জুঁই ফুল আর খড়কুটোর সোঁদা গন্ধ । একটা প্রেমের সুবাস ।
ওরা রাত উঠল একটা হতশ্রী সরাইখানায় । ধারি ধারি ছারপোকা গুলো খুবই অসহ্যকর, বরং রেশমি কাঠ-উকুন গুলোর চলাফেরার মধ্যে কিছুটা স্নিগ্ধতা । ভাসিলিকে বলা হল কেরানীর সাথে শয্যা ভাগ করে নিতে । ওর বউ চলে গেল লাল চুলো মেয়েটার সাথে। । পুরো ঘর জুড়ে দুটো বিছানা । ওপরে সুতির কাঁথা, নীচে একটা পাত্র । রাত বিরিতে প্রকতির ডাকে সারা দেওয়ার জন্য । কেরানী বলল তার খুব একটা ঘুম পায়নি । অগত্যা সে আবার তার রাশিয়া অভিযানের গল্প শুরু করল । এবার ট্রেনে বলা ঘটনার নাড়িনক্ষত্র বিবরণ দিতে লাগলো । সুতির ছাপা হাফপ্যান্ট , লম্বা আর নোংরা পায়ের নখ আর ভাল্লুকের মতো এক বুক চুল । অবান্তর গল্প গুলোর মতই লোকটা ধিরে ধিরে আরও অসহ্য হয়ে উঠছে , “আমি যেখানে গেছিলাম, মানে ওই বল্গ্রাদে, বুঝলে কিনা, তিন তিনটে ইস্কুল ছিল সেখানে, একটা জার্মান, একটা চেক আর একটা চাইনীজ । তাই আমার ভায়রা-ভাই সুযোগ বুঝে সেখানে গেছিলো ট্র্যাক্টর বানাতে ।”
এসব শুনতে শুনতে কখন ঘুম এসেছিল মনে নেই । একটা মথ তার ছায়ার সাথে ছোঁয়াছুঁই খেলে গেল সারারাত ।
পরের দিন ভোর থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত ঢেউ খেলানো রাস্তায় রাস্তায় ওরা ধুলো উড়িয়ে হাঁটা । এক পাহাড় থেকে অন্য এক পাহাড় । তারপর একটা সবুজ রাস্তা ধরে ঘন জঙ্গলের দিকে হাঁটা দিল ওরা । ভাসিলি কে ভারী একটা পাউরুটির ঝোলা বইতে হল সারাদিন । তারপর আবার আর একটা ট্রেন। ছোটো বগী । কোনও ভাগ করা আলাদা বসার জায়গা নেই । একটাই খোলা জায়গা আর জানলা বরাবর বেঞ্চি । স্লজের ইচ্ছে হল ভাসিলিকে একটু ম্যান্ডলিন শেখাতে । সবাই খুব হাসল । বেশ কিছুক্ষণ ।হাসতে হাসতে ক্লান্ত হয়ে যাবার পর ওদের একটা আরও মজার খেলা খেলতে ইচ্ছে হল । স্ক্রামের মাথাতেই বোধহয় প্রথম কথাটা এসেছিল । খেলাটা এই রকম; ছেলেরা প্রথমে এক একটা বেঞ্চের নীচে শুয়ে থাকবে । তারপর সেখান থেকে একটা পা, হাত অথবা একটা আঙ্গুল বেঁকিয়ে নানান সঙ্কেত দিতে হবে । সেটা দেখে যে মেয়ের ভাল লাগবে সে তখন সেই বেঞ্চির ওপর শুয়ে পরে বন্ধুত্বের পাল্টা সম্মতি জানাবে । ভাসিলি তিন তিন বার বেঞ্চির নিচে অন্ধকার, নোংরায় শুয়ে থাকল । তিনবারই বেরিয়ে এসে দেখল তার বেঞ্চির ওপর কেউ শুয়ে নেই । সবাই মিলে তাকে হেরো হিসাবে চিহ্নিত করল । হেরে যাবার সাজা হিসাবে একটা পোড়া সিগারেট চিবোতে হল ।
রাতটা একটা গোলাবাড়ীর খড়ের গাদায় শুয়ে কাটিয়ে দিল ওরা । ঘুম এসেছিল কিনা মনে নেই । সাতসকালে উঠেই পায়ে হাঁটা । জঙ্গল, পাহাড়, ফেনা বয়ে নিয়ে যাওয়া নদী । খুব গরম এখানে । তারপর বার বার ওই একই গান । কাঁধে ভারী ঝোলা । সব মিলিয়ে ভাসিলি খুব ক্লান্ত হয়ে পড়ছিল । দুপুরে বিশ্রামের সময় বসে বসেই ঘুমিয়ে গেল । ঘুম ভেঙে দেখল কতকগুলো মাছি ভোঁ ভোঁ করছে মুখের ওপর । আবার শরীরটা টানতে টানতে ঘণ্টা খানেকের হাঁটা । কিন্তু এই কষ্টটা আসলে সার্থক প্রমানিত হল ।
একটা নীল হ্রদ । খুব চেনা অথচ অদ্ভুত একটা অভিব্যক্তি তার জলে । একটা স্নিগ্ধতা । দিগন্ত জোড়া একটা মেঘের পরিপূর্ণ প্রতিফলন ভেসে আছে । অন্যদিকের পাহাড়ে দাঁড়িয়ে আছে থমথমে ঘন অরণ্যমালা । গাঢ়, সবুজ ঢেউ খেলানো । একটা কবিতার মত তার উপস্তিতি । এক ছন্দ থেকে অন্য ছন্দের পংতি । তার মাঝে প্রাচীন, কালো এক দুর্গের অবয়ব । ইউরোপে এই ধরনের দুর্গের অভাব নেই। কিন্তু এই দুর্গ, এই হ্রদ, এই মেঘের মধ্যে অবর্ণনীয়ও একটা সমন্বয় । এর হাওয়ায় একটা মিষ্টি হাসির সুর । এক রহস্যময়ির সরলতা । গাঢ় সবুজ প্রেমের মতো চেনা । দীর্ঘ প্রতিশ্রুত । ভাসিলি নিজের হাত দিয়ে বুকের বাম দিকটা ছুঁয়ে দেখল । এখনো হৃদয়ে কিছুটা স্পন্দন রয়ে গেছে । ভাবছিল সেটাও আজ বিলিয়ে দেবার সময় এসেছে ।
একটু দূরে, ঘাসের ওপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে সবাই বসে আছে । স্ক্রাম একটা লাঠি শূন্যে খোঁচা মেরে মেরে সবাইকে কি সব বোঝাচ্ছে । দলের নেতা হ্রদের দিকে পেছন করে একটা কাঠের গুঁড়ির ওপর বসে কি একটা খাচ্ছে । ভাসিলি চুপি চুপি সেখান থেকে সরে পরে । সে হ্রদের উপকুল বেয়ে হাঁটতে হাঁটতে একটা ছোট্ট সরাইখানায় পৌঁছায় । দরজায় একটা কুকুরছানা শুয়ে । তড়াক করে উঠে চোয়াল ঝুলিয়ে, লেজ নাড়তে নাড়তে যেন ভাসিলিকে স্বাগত জানাল । সে কুকুরটার পিছু পিছু ভেতরে ঢোকে। দুতলা বাড়ি ; চোখের ধাঁচে জানলা ;তার ওপর চোখেরই পাতার মতো গোল ছাউনি । ভেতরের দেওয়াল গুলো নানান ধরনের কাঠ দিয়ে তৈরি । ঘরের এক একটা জায়গা এক এক রকমের রঙ করা । মালিক বয়স্ক লম্বা এক অবসরপ্রাপ্ত রাশিয়ান সৈনিক ।দেখা হয়ে গেল বারান্দাতেই । খুব আস্তে এতো ভাঙ্গা ভাঙ্গা জার্মান বলছিল যে বার্তালাপের দায়িত্বটা ভাসিলিকেই নিতে হল । দেশজ ভাষায় ফিরতেই সহজ হয়ে গেলো সব কিছু । অল্পসময়েই সুখদুঃখের নানান গল্প জুড়ল ওরা । যেন কতদিনের চেনা ।
দুতলার ঘর গুলো অথিতিদের জন্য । ‘আমি এই ঘরটা সারা জীবনের জন্য ভাড়া নিতে চাই’ ভাসিলি ঘরটাতে পা রেখেই নাকি বলেছিল । সাধারন একটা ঘর । আসলে একেবারেই সাধারন । চটে যাওয়া লাল রঙ্গের মেঝে, সাদা দেওয়ালে আঁকা ফুল । সেখানে পুরু ধুলোর পড়ত । । অন্য দেওয়ালে একটা ছোটো আয়না । উল্টোদিকের ফুলগুলোর হলদেটে প্রতিফলন দেখা যায় । জানলা খুললেই নীল হ্রদ । হ্রদের বুকে মেঘ আর দুর্গের মিলনের স্থির সুখছিত্র ভাসছে । যুক্তি , সাধারন বিচার বিবেচনা থেকে সরে অন্য পথে হাঁটছিল তার মন । কিসের একটা অদম্য আকর্ষণ । হৃদপিণ্ডের শব্দটা যেন চার দেওয়াল থেকে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসছে তারই দিকে । এমনটা কখনও হয়নি । এত শক্তি, মনের ভেতর এত সাহস কোনও দিন পায়নি সে । ওই ছোট্ট ঘর । খোলা জানালা সামনে দাঁড়িয়ে ওর চোখে টলটলে জল এলো ।এক মুহূর্তে বিদ্যুতের রেখার মতো মনে বসে গেলো একটা চিন্তা ‘এই তো, এই রকমই কিছু একটা জিনিস সে সারা জীবন খুঁজছিল । হয়তো অবচেতনেই । এখানেই যাত্রা শেষ । এখানেই শান্তি ।’
এর পর ঠিক কি হবে জানা নেই তবে ওর মন বলছিল ওর চারপাশের জগৎ, ওই থতথমে ঝাউগাছ, ওই পাহাড় ঘেঁষা হ্রদ, সবাই সাহায্যের হাত বাড়াবে, ওকে কথা দেবে, সান্ত্বনা দেবে । ওর ফিরে যাবার আর কোনও দ্বিধা থাকবে না । এক মুহূর্তে সে ভেবে নিল কি ভাবে সব ব্যবস্থা করলে তাকে আর বার্লিন ফিরতে হবে না । এখানে থেকে যেতে ঠিক কি কি লাগবে? গুনতে গুনতে শুধু তিনটে জিনিস মাথায় এলো – কবিতার বইগুলো, নীল স্যুটটা আর ওর পরিণতি হীন সম্পর্কের একটা ফটো ফ্রেম – কি সামান্য অথচ সুন্দর সব প্রয়োজন গুলো । আমি জানতাম রাশিয়ান উদ্বাস্তু হিসেবে যা কিছু টাকাপয়সা পেতো সেটাই ওর ছাপোষা জীবনের জন্য যথেষ্ট ।
হঠাৎ পেছন থেকে স্ক্রামের গলা ভেসে এলো ‘ আমরা এওল্ডে পৌঁছলে আজ বিয়ার পাবই পাব । ট্রেনে ঘণ্টা পাঁচেক, একটু হাঁটা পথে একটা লজ, কয়লা খনি, দারুন সব জায়গা ’। ভাসিলি স্থির গলায় উত্তর দিল ‘আর পারছি না । আমার ব্যাগটা ফেরত চাই । আমি আর কোথাও যাচ্ছি না । যেখানে চাই থাকার অধিকার আছে আমার ।’। কথাগুলো গিলোটিনে মাথা দেবার মতই সাঙ্ঘাতিক প্রমানিত হল । কিছু কথা কাতাকাটির পর, স্ক্রাম আর তার পেছন পেছন দলের নেতা, চ্যাং দোলা করে তুলতে এলো ওকে। না পেরে টানতে টানতে নিয়ে গেলো । ভাসিলি আমাকে বলেছিল যে ও কান্না চাপতে পারেনি । একটা শিশুর মত । সরাইখানা দরজায় বাকিদের জঠলা । নেতার গলায় শাসানি ‘দরকার হলে আমরা তোমার হাত পা বেঁধে কাঁধে করে নিয়ে যাব । কিন্তু সেটা কি খুব সুখের হবে ? তোমাদের সবার দায়িত্ব আমার । যেমন নিয়ে এসেছি, তেমনি ফিরিয়ে নিয়ে যাব । বাঁচো কি মর, আমার কিছু যায় আসে না ।’
পরের ঘটনাগুলো কোনো রুপকথার গল্পের অসহ্য নিয়তির মতো ঘটতে থাকল । আবার ঘন জঙ্গলের হাঁটা পথ । ওর হাত চেপে, মুচড়ে একটা ঝাঁটার মতো টানতে টানতে নিয়ে চলল ওরা । ভাসিলি ফিরে তাকাবার সুযোগ পায়নি । তবে অনুভব করেছিল যে ওর পেছনে দেবদারু গাছের জঠলায় ক্ষতবিক্ষত হয়ে একটা ঔজ্জ্বল্য ফিকে হয়ে আসছে । তারপর আর নেই । ট্রেনটা চলতে শুরু করতেই ওরা ওকে পেটাতে লাগল । শুরুটা বোধহয় স্ক্রামই করেছিল । তারপর লালচুলো নেতাটা । তারপর সবাই । অনেক ক্ষণ । যার যততুকু বুদ্ধি সেই দিয়ে নানান পন্থায় নিজেদের কৃতিত্ব দেখিয়ে গেলো । কারুর ইচ্ছে হল কক্সক্রু দিয়ে হাতে পায়ে খোঁচা মারতে । পোস্ট অফিসের কেরানীটা বেল্ট, জঙ্গল থেকে আনার কঞ্ছি এই সব দিয়ে গায়ের জোর দেখাল । মারতে মারতে হাঁপানি ওঠার আগে সবাই বাহবা দিল ওকে । বাকিরা জুতোর লোহার গোড়ালি আর মেয়েরা কেউ চিমটি, কেউ চড়চাপড় চালিয়ে গেলো যতক্ষণ পারল । ফিরতি ট্রেন যাত্রায় চমৎকার সময় কাটল সবার ।
বার্লিনে ফিরে ও আমার কাছে এসেছিল । মনে হল সম্পূর্ণ বদলে গেছে । সাদাসিদে ভাবটাই নেই । আমার সামনে এসে আস্তে আস্তে বসলো । হাতগুলো হাটুঁর কাছে রেখে সবটা বলল । কখনও কাঁদল । কখনও চুপ করে থাকল । বার বার বলল ওর আর এই কাজে থাকা সম্ভব নয় । আসলে আর শক্তিই নেই মানবসভ্যতায় মিশে থাকার । আমি ওকে যেতে দিলাম ।
0 মন্তব্যসমূহ