অনুবাদ - রুখসানা কাজল ও দীপেন ভট্টাচার্য
লেখক পরিচিতি :
আন্দ্রেই প্লাতোনভ রুশ ভাষার এক আশ্চর্য লেখক যাঁর সঙ্গে বাংলাভাষীরা একেবারেই পরিচিত নন । ১৮৯৯ সালে জন্ম, ১৯৫১ সনে বলতে গেলে অল্প বয়সেই মৃত্যু। স্তালিন তাঁর পনেরো বছরের সন্তানকে গুলাগে পাঠিয়েছিল, সেই সন্তান যখন যক্ষ্মা নিয়ে মুক্তি পায় তার শুশ্রষা করতে গিয়ে নিজে যক্ষ্মাক্রান্ত হয়ে মারা যান। অনেকের মতে বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ রুশ লেখক হলেন প্লাতোনভ। তাঁর Foundation Pit পড়লে পাঠক এমন অর্থহীনতার সম্মুখীণ হবেন যেখান থেকে পরিত্রাণ কঠিন। জোসেফ ব্রদস্কির মতে প্লাতোনভ ভাষাকে, বিশেষত রাজনৈতিক ভাষাকে ভেঙে দিয়েছেন। তাঁর গল্পের প্লট ও ভাষার ব্যবহার ব্যতিক্রমী যেটা এই ছোট গল্পের মধ্যে দিয়েই পাঠক বুঝতে পারবেন। এখানে একদিকে যান্ত্রিক সভ্যতার প্রতিভূ রেলের ইঞ্জিন ও লাইন, অন্যদিকে ভাষাহীন একটি গরু। এই দ্বান্দ্বিকতাকে সংবেদী কিন্তু অতিরঞ্জন না করে প্লাতোনভ প্রকাশ করেছেন। তাঁর মৃত্যুর বহু পরে তাঁর সৃষ্টিকর্ম প্রকাশিত হয়।
স্তেপ অঞ্চলের ধূসর চেরকাসিয়ান গরুটি চালাঘরে একাই থাকত। কাঠের বোর্ড দিয়ে তৈরি, বাইরের দিকে রঙ করা, চালাঘরটি দাঁড়িয়ে ছিল লেভেল ক্রসিং গার্ডের বাড়ির পাশের ছোট জায়গাটিতে। চালাঘরের মধ্যে ছিল জ্বালানী কাঠ, শুকনো ঘাস, বাজরার খড় আর সংসারের যাবতীয় জিনিস, যেমন ঢাকনাবিহীন একটি ট্রাঙ্ক, পুড়ে যাওয়া সামোভারের চিমনী, পুরনো কিছু ন্যাকড়া, পা ভাঙ্গা একটি চেয়ার – এদের সবার সুখের দিন বিগত হয়েছে – আর এই সবের পাশে গরুটির জন্যে ছিল রাতে শুয়ে থাকার আর দীর্ঘ শীতগুলো পার করার জন্য অল্প জায়গা ।
গরুটির মালিকের ছেলে ভাসিয়া রুবৎসভ অপরাহ্ন ও সন্ধ্যায় গরুটিকে দেখতে আসত, ওর মাথা ঘিরে থাকা নরম পশমে হাত বুলিয়ে দিত। আজকেও ছেলেটি এসেছে।
‘গরু গরু,’ ভাসিয়া গরুটিকে ডাকল, কারণ গরুটির তো নিজস্ব কোনো নাম ছিল না, ভাসিয়া তাই গরুটিকে গরু বলেই ডাকে যে নামটি লেখা ছিল তার পড়ার বইতে। ‘তুমি তো গরুই। শোনো গরু, তুমি একটুও অস্থির হয়ো না, তোমার ছেলে ভালো হয়ে যাবে। আমার বাবা ওকে শীগগিরি ফিরিয়ে নিয়ে আসবে।’
এই মা গরুটির একটি ছোট্ট ষাঁড়-বাছুর ছিল। গতকাল ওর গলায় কী যেন আটকে গিয়েছিল, মুখ দিয়ে অনবরত লালা আর পিত্তি ঝরে পড়ছিল। বাছুরটি মরে যাবে এই ভেবে ভাসিয়ার বাবা তো ভয়ই পেয়ে গেলেন, তাই আজ ওকে নিয়ে ষ্টেশনে গেছেন পশুডাক্তারের কাছে।
গরুটি এক পাশ দিয়ে ভাসিয়ার দিকে তাকিয়ে চুপ করে থাকে। বহু আগে মরে যাওয়া একটি জীর্ণ ঘাসের ডগা চিবুচ্ছিল সে। এই ছোট ছেলেটিকে দেখলেই সে চিনতে পারে, ছেলেটি তাকে খুব ভালোবাসে। গরুটির সবকিছুই ছেলেটির পছন্দ – কালো ফ্রেমের বৃত্তে নিবদ্ধ আন্তরিক মায়াময় দুটি চোখ, ক্লান্ত কিংবা ভাবনায় নিমজ্জিত থাকে সেগুলো, দুটি শিং, কপাল আর বড় রুগ্ন শরীর, সেই রুগ্নতার কারণ হল যে শক্তি তার মেদ ও মাংসে ধরে রাখার কথা ছিল, তা সে অকাতরে বিলিয়ে দিচ্ছিল দুধ এবং কাজের জন্যে। ভাসিয়া চেয়ে দেখে গরুটির নরম কোমল ওলানের নিচে কুচকে যাওয়া ছোট দুধের বাটগুলি যেগুলো থেকে দুধের জোগান আসে। সে গরুটির শক্ত ছোট্ট গলকম্বল এবং সামনে বেরিয়ে আসা হাড়গুলোকে ছুঁয়ে দেখে।
অল্পক্ষণের জন্যে ছেলেটির দিকে তাকিয়ে থেকে গরুটি মাথা নীচু করে চাঙ্গড়ের ভেতর দিকে কিছু ঘাস মুখে পুরে নেয় তার নির্লিপ্ত মুখে। তার বিশ্রাম নেবার বা তাকিয়ে থাকবার সময় ছিল না, কোনো ক্ষান্তি না দিয়ে তার চিবিয়ে যেতে হয় যাতে তার মধ্যে দুধও জন্ম নেয় ক্ষান্তিহীন ভাবে; কিন্তু তার খাদ্য ছিল শুকনো ও একঘেয়ে, তাই গরুটিকে অনেকক্ষণ ধরে তা চিবাতে হয় তার ভেতর থেকে পুষ্টি বার করতে।
ভাসিয়া চালাঘরের বাইরে বেরিয়ে আসে। বাতাসে শরতের সুভাষ বইছে। লেভেল-ক্রসিং রক্ষকের বাড়ির চারপাশে ছড়িয়ে রয়েছে খা খা শূন্য মাঠ যা কিনা গ্রীষ্মকালে জীবন্ত ছিল ভুট্টা গাছের দোলুনিতে। সমানভাবে চষা মাঠগুলো এখন বিষণ্ণ শূন্যতায় পড়ে থাকে।
সন্ধ্যা নেমে আসে; ধূসর ঠান্ডা কুয়াসায় জড়ানো আকাশ এরই মধ্যে ঢেকে যায় অন্ধকারে; শীতের প্রস্তুতি নিতে যে খড়-নাড়া আর পত্রহীন ঝোপ মরে গেছে তার ওপর দিয়ে যে বাতাস বয়ে গেছে সারাদিন খচমচ শব্দ করে সেই বাতাস এখন শুয়ে আছে পৃথিবীর নিচু নিশ্চল কোনাগুলোয়, মাঝে মধ্যে শুধু চিমনির উপর থাকা বায়ু-পাখাটিকে সযত্নে ক্যাঁচক্যাঁচ করে ঘোরায় সেই বাতাস; শরৎ-আগমনীর গান শুরু করে পাখাটি।
এক ট্র্যাকের রেলপথটি ওদের বাড়ির খুব কাছ দিয়েই গেছে, একেবারে সামনের বাগান ঘেঁসে যে বাগানের সবকিছু, ঘাস ফু্ল সব, এখন শুকিয়ে গেছে, নুয়ে পড়ছে। ভাসিয়ার বাগানের বেড়া পেরিয়ে ঢুকতে অস্বস্তি হয়। যে গাছগুলি সে বুনেছিল বসন্তে, যাদেরকে যত্নে জীবন দিয়েছিল, এই বাগানটা এখন মনে হচ্ছে সেই গাছগুলির নিঝুম সমাধি ক্ষেত্র।
ভাসিয়ার মা ঘরের ভেতরে একটি বাতি জ্বালালেন আর সিগন্যাল দেখানোর লন্ঠনটি বাইরের বেঞ্চের উপর রেখে ছেলেকে বললেন, ‘৪০৬ নম্বর ট্রেন তো এখুনি চলে আসবে, তুমিই না হয় সিগন্যালটা দিয়ে দিও। তোমার বাবার ত এখনো টিকিখানাও দেখা যাচ্ছে না। আশা করি সে কোথাও মদ খেতে বসে পড়ে নি!’
সেই সকালে, সাত কিলোমিটার দূরের স্টেশনের দিকে, ভাসিয়ার বাবা বাছুরটাকে নিয়ে রওনা হয়ে গেছেন। সম্ভবত এখন সে বাছুরটাকে পশু-ডাক্তারের কাছে রেখে হয় যন্ত্রপাতির কাজ শিখছে, নয় ষ্টেশনে পার্টি মিটিংএ আছে, অথবা ক্যান্টিনে বসে বীয়ার খাচ্ছে। তাছাড়া এমনও হতে পারে যে, পশু-ডাক্তারের কাছে লম্বা লাইন পড়েছে বলে সেখানে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছে ! ভাসিয়া লন্ঠনটা নিয়ে ক্রসিং এর কাছে একটা কাঠের পাটাতনের ওপর গিয়ে বসে। এখনো ট্রেন আসার কোনো নামগন্ধ নেই, ভাসিয়া একটু ক্ষিপ্তই হয়। আসলে এখানে বসে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করার মত সময় ছিল না তার। কাল তাকে অনেক ভোরে উঠতে হবে, আর ঘুমোতে যাবার আগে ইশকুলের কাজ শেষ করতে হবে। ভাসিয়া তার বাড়ি থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরের যৌথ খামারের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ে।
ইশকুলে যেতে ভালোবাসে সে। ক্লাশে যখন সে বই পড়ে বা শিক্ষকদের পড়া শোনে তখন সে মনে মনে সমস্ত পৃথিবীটাকে দেখতে পায়, যে পৃথিবীটা সে এখনো চেনে না, যে পৃথিবীটা তার থেকে ছিল বহু দূরে। নীল নদ, মিশর, স্পেন এবং দূর প্রাচ্য, বিরাট সব নদী যেমন মিসিসিপি, ইয়ানিসেই, প্রশান্ত দন, আর আমাজান – আরাল সাগর, মস্কো, মাউন্ট আরারাত, আর্কটিক সাগরের বিজন দ্বীপ ভাসিয়াকে আকৃষ্ট করত, উতলা করে তুলত। তার মনে হত এই সমস্ত দেশ আর তাদের লোকজন তার বড় হয়ে ওঠার জন্যে, তাকে অতিথি হিসেবে পাবার জন্য, বহুদিন ধরে অপেক্ষা করে আছে। কিন্তু শুধুমাত্র যৌথ খামারের ইশকুল আর স্টেশন ছাড়া এখন পর্যন্ত তার তো আর কোথাও যাবার সময় হয়নি, সে এখনো সেখানেই রয়ে গেল যেখানে সে জন্মেছে। তাই এক ধরণের প্রত্যাশী আনন্দে সে সেই সব লোকদের মুখকে লক্ষ করত যারা যাত্রীবাহী ট্রেনের জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকত। এরা কারা ? এরা কী ভাবে? কিন্তু ট্রেন এত দ্রুত চলে যেত যে ক্রসিংএ দাঁড়ানো ভাসিয়া তাদের ভালো করে জানতে পারে না। তাছাড়া খুব বেশি ট্রেনও এই পথ যাতায়াত করত না। দু দিক থেকে চব্বিশ ঘন্টায় মাত্র দুটো করে ট্রেন আসত, আর এদের মধ্যে তিনটে ট্রেনই রাতে পাস করত।
একবার একটা ট্রেন খুব আস্তে যাচ্ছিল বলে ভাসিয়া একজন ভাবুক তরুণ মানুষের মুখ স্পষ্ট দেখতে পেয়েছিল। পাইপ খেতে খেতে জানালা দিয়ে সে স্তেপের পাড়ে দিগন্তের ধারে কোনো অজানা জায়গার দিকে তাকিয়ে ছিল। সবুজ পতাকা হাতে রেলক্রসিং এর কাছে দাঁড়ানো ছেলেটিকে দেখে সে হেসেছিল, স্পষ্ট স্বরে বলেছিল, ‘বিদায়, বন্ধু!’ তারপর হাত নাড়িয়ে বিদায় জানিয়েছিল। ভাসিয়াও মনে মনে উত্তর দিয়েছিল, ‘আমি বড় হলে আবার আমাদের দেখা হবে। বেঁচে থেকে আমার জন্য অপেক্ষা করো, মরে যেও না।’ অনেকদিন পর্যন্ত ভাসিয়া ট্রেনের কামরার সেই ভাবুক তরুণটিকে মনে রেখেছিল যে তাকে পেরিয়ে চলে গেছিল কোন সুদূরের ঠিকানায়। ভাসিয়া ভাবল তরুণটি হয়ত ছিল কোনো পারাস্যুটিস্ট, শিল্পী, পদক-বিজয়ী বা এর চেয়েও ভাল কেউ। কিন্তু দ্রুতই এই তরুণটি, যে কিনা তাদের বাড়ি পার হয়ে গিয়েছিল, তার কথা ভাসিয়ার মন থেকে মুছে যেতে থাকে, কারণ তাকে তো তার জীবন চালিয়ে যেতে হবে, অন্য অনেক কিছুকে অনুভব করতে হবে, চিন্তা করতে হবে।
দূরে, শরতের মাঠের অন্ধকার শূন্যতায়, ট্রেনের ঝমঝম শব্দ শোনা যায়। ভাসিয়া লাইনের কাছে এসে মাথার উপর উজ্জ্বল বাতিটা তুলে ধরে ‘সব ক্লিয়ার’ সঙ্কেত দেখায়। আরো কিছুক্ষণ সে এগিয়ে আসা ট্রেনটির ক্রম-বর্ধমান গর্জন শোনে, তারপর তার বাড়ির দিকে তাকায়। উঠোনে গরুটি বিষণ্ন সুরে গোঙাচ্ছে। গরুটি অনেক সময় ধরে অপেক্ষা করেছে তার বাছুর সন্তানটির জন্য, কিন্তু সে তো ফিরে এল না। ভাসিয়া মনে মনে বিরক্তই হল, “বাবা কেন এত দেরি করছে? কোথায় সে এত সময় নষ্ট করছে? এদিকে আমাদের গরুটি কাঁদছে। রাত হয়ে গেল, সব অন্ধকার, ওদিকে বাবার টিকিটিরও দেখা নেই।”
ট্রেনের ইঞ্জিন ক্রসিংএর কাছে পৌঁছাল, চাকাগুলোর ঘুরতে অসুবিধা হচ্ছিল, সর্বশক্তি দিয়ে অন্ধকারে আগুনের ফুলকি ছিটিয়ে ইঞ্জিনটি শ্বাস নিয়ে বাতি হাতে দাঁড়ানো একমাত্র মানুষটিকে পার হয়ে গেল। ইঞ্জিন চালক ভাসিয়াকে যেন খেয়ালই করল না, জানালা দিয়ে শরীর বার করে সে ইঞ্জিনটাকে দেখছিল – পিস্টন রডের প্যাকিংএর সিল ফেটে গিয়েছিল আর পিস্টনের প্রতিটি ঘা’র সাথে সাথে সাথে সাথে সেখান থেকে বাষ্প বেরুচ্ছিল। ভাসিয়াও সেটা লক্ষ করল। সামনেই একটা লম্বা চড়াই আসছে, এরকম খারাপ সিলিন্ডার নিয়ে ট্রেনটিকে টানা ইঞ্জিনের জন্য কঠিন হয়ে পড়বে। ছেলেটি জানত বাষ্প ইঞ্জিন কীভাবে কাজ করে, সে তার পদার্থবিদ্যা বইতে এ বিষয়ে পড়েছে। আর বইতে যদি কিছু লেখা নাও থাকত তবু সে বিষয়টি খুঁজে বের করে ফেলত। কোনো জিনিস দেখে তা কীভাবে কাজ করে বা তার ভেতরে কী হয় সেটা না জানা সে সহ্য করতে পারত না। তাই ইঞ্জিন চালক যে তার লন্ঠনকে লক্ষ না করেই তাকে পার হয়ে গেছে তা নিয়ে সে মন খারাপ করেনি, কেননা চালক তার ইঞ্জিন নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিল – সামনের দীর্ঘ খাড়া পথ পাড়ি দিতে এটা রাত্রির যে কোনো সময়ে বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তখন চালকের জন্য ট্রেনকে পুনরায় চালু করা কঠিন হবে। আর একবার ট্রেনের চলন বন্ধ হলে ওয়াগনগুলি একটু পিছিয়ে পড়বে এবং তাদের মধ্যের সংযোগস্থলগুলোয় টান পড়বে। আর চালক যদি পুর্ণ গতিতে ট্রেন চালাতে শুরু করে তবে সংযোগগুলো ছিঁড়ে যেতে পারে, অন্যদিকে পূর্ণ গতিতে না চালালে ট্রেন তো নড়বেই না।
কিছু ভারি চার এক্সেলের ওয়াগন চলে গেল, তাদের স্প্রিংগুলো একেবারে সংকুচিত দেখে ছেলেটি বুঝল সেগুলো ভারী ও দামি মালামালে ভর্তি। এরপর এল খোলা ওয়াগনগুলো; সেগুলোর ওপর ছিল মোটর গাড়ি, ত্রিপল দিয়ে ঢাকা যন্ত্রপাতি, কয়লার ঢিপি, কপির পাহাড় এবং কিছু রেলের জিনিস। এরপর এল গবাদি পশুতে ভর্তি বদ্ধ বগিগুলি। ভাসিয়া তার জ্বলন্ত লন্ঠনটি চাকা এবং এক্সেলের বাক্সের ওপর ধরে দেখতে চাইছিল কোন গড়বড় আছে কিনা, কিন্তু সবকিছুই ঠিকঠাক মনে হল। কেবল গবাদি পশুর বগিগুলি থেকে একটা অজানা বাছুরের নিচু ডাকের শব্দ ভেসে এল, আর তাই শুনে, তার সন্তানটির জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়া ওদের নিজেদের গরুটি চালাঘর থেকে দীর্ঘ বিলাপের স্বরে সাড়া দিল।
শেষ ওয়াগনটি আস্তে আস্তে ভাসিয়াকে ছাড়িয়ে চলে যায়। সে স্পষ্ট শুনতে পায় ইঞ্জিনের সংগ্রাম, হাঁসফাঁস করছিল সেটি ট্রেনের সামনে। কিন্তু চাকাগুলো পাক খাচ্ছিল, ট্রেনকে টানতে পারছিল না। ইঞ্জিনটা বেশ অসুবিধায় পড়েছে দেখে ভাসিয়া লন্ঠন হাতে সেদিকে এগিয়ে যায়। সে চাইছিল ইঞ্জিনের কাছে থাকতে, সেটার দুর্ভাগ্যকে ভাগ করে নিলে সে যেন স্বস্তি পাবে।
ইঞ্জিনটাকে জোরে চালানো হচ্ছিল বলে চিমনি দিয়ে কয়লার গুঁড়ো উড়ে যাচ্ছিল এবং ভেতরে বয়লারের প্রতিধ্বনিত শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ স্পষ্টই শোনা যাচ্ছিল। চাকাগুলোর ঘুরতে অসুবিধে হচ্ছিল, ইঞ্জিন-চালক তার কেবিনে বসে তা পর্যবেক্ষণ করছিল। চালকের সহকারী ইঞ্জিনের সামনে রেলপথ ধরে হাঁটছিল। সে নুড়িস্তর থেকে বালু ছুঁড়ে রেললাইনের ওপর ফেলছিল যাতে ট্রেনের চাকা না পিছলায়। ইঞ্জিনের হেডলাইট আলোকিত করে রেখেছিল তার তেলকালি মাখা কালো, ক্লান্ত শরীরকে। ভাসিয়া তার লন্ঠনটি মাটিতে রেখে, রেলপথে উঠে, সহকারীর দিকে এগিয়ে যায়।
‘এটা আমাকে করতে দাও,’ ভাসিয়া বলে, ‘তুমি বরং গিয়ে ইঞ্জিনটাকে সাহায্য কর। যে কোনো মুহূর্তে ওটা বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
‘তুমি কি পারবে?’ ছেলেটির চিন্তাগ্রস্থ মুখমণ্ডলের উজ্জ্বল বড় চোখদুটির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল চালকের সহকারী। ‘বেশ, তাহলে চালিয়ে যাও। কিন্তু সতর্ক থেকো– ইঞ্জিনের দিকে নজর রেখো কেমন!’
কোদালটা ভাসিয়ার জন্য বেশী বড় ও ভারি ছিল। সে সেটাকে সহকারীকে ফেরত দিয়ে দেয়।
‘আমি বরং হাত দিয়েই কাজটা করে ফেলছি, এটাই সহজ।’
ভাসিয়া উপুড় হয়ে বসে বালু কুড়িয়ে রেললাইনের ওপর লম্বা ফিতের মত ছিটিয়ে দিতে শুরু করে।
‘আর অন্য পাশের লাইনটাও দেখো,’ আদেশ দেয় চালকের সহকারী, তারপর ইঞ্জিনের দিকে দৌড়ায়।
ভাসিয়া প্রথমে একপাশের, পরে অন্য পাশের, লাইনের উপর বালু ছেটাতে আরম্ভ করে। বালুকে তার ইস্পাতের চাকা দিয়ে পিষতে পিষতে পরিশ্রান্ত ইঞ্জিনটি খুব ধীরে ছেলেটিকে অনুসরণ করে। ওপর থেকে অঙ্গার ও বাষ্পের ঘনীভূত জলকণা একই সাথে এসে পড়ছিল ভাসিয়ার গায়ে, কিন্ত সে কাজটা আনন্দের সাথেই করছিল। তার মনে হচ্ছিল ইঞ্জিনের চাইতে সে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ, কেননা ইঞ্জিন তার পেছন পেছন আসছিল এবং শুধুমাত্র তার কাজের জন্যেই ইঞ্জিনের চাকা একবারও পিছলে যায় নি, থেমে যায়নি।
কাজের আনন্দে ভাসিয়া যখন সব ভুলে যাচ্ছিল ইঞ্জিন যে তার ওপর চলে আসছে সেটা সে খেয়াল করছিল না। চালক বাঁশিতে ছোট্ট করে একটি শিস বাজিয়ে চেঁচায়, ‘এই যে, এদিকে খেয়াল রেখো। আর বালুকে আরেকটু ঘন করে, আরো সমান করে ছিটিয়ে দিও।’
ভাসিয়া ইঞ্জিনের সামনে থেকে সরে চুপ করে কাজ করে। কিন্তু চালকের চেঁচিয়ে হুকুম করায় তার রাগ হয়। লাইনের বাইরে লাফিয়ে এসে চালককে চিৎকার করে বলে, ‘আর আপনারাই বা কোন আক্কেলে বালু ছাড়া চলে এসেছেন? খেয়াল ছিল না?’
‘বালু শেষ হয়ে গেছে,’ চালক বলে, ‘আমাদের একটা মাত্র ছোট বাক্স আছে বালু রাখার জন্য।’
ইঞ্জিনের পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে ভাসিয়া আদেশ দেয়, ‘আরেকটি বাক্স রাখবেন। পুরোনো লোহালক্কড় বাঁকিয়েই তো বানানো যায়। কোনো মিস্ত্রীকে বলবে।’
ইঞ্জিন চালক ছেলেটাকে দেখার চেষ্টা করল, কিন্তু অন্ধকারে ভালমত দেখতে পায় না। ভাসিয়ার মুখমণ্ডল ছিল ছোট, পোশাক বেশ পরিপাটি, পায়ে পরা ছিল একজোড়া চামড়ার জুতো, আর তার চোখ দুটো ইঞ্জিনের দিক ছেড়ে নড়ছিল না। ইঞ্জিন চালকের বাড়িতে ওরকমই একটি ছেলে বড় হচ্ছে।
‘আর বাষ্প বেরিয়ে যাচ্ছে যেখান থেকে বের হবার কথা নয়, সিলিন্ডার থেকে, বয়লারের পাশ দিয়ে, শুধোশুধি ফুটো দিয়ে সব শক্তি বেরিয়ে যাচ্ছে।’
চালক বলে, ‘বাহ! ঠিক বলেছ। তুমি বরং আমার এখানে বস, আর আমি লাইনের পাশ দিয়ে হাঁটি।’
‘বেশ তো,’ আনন্দের সাথে সায় দেয় ভাসিয়া।
তখনই, একটুও না নড়ে, ইঞ্জিনের চাকাগুলো সর্বশক্তি নিয়ে, মুক্তির খোঁজে উদভ্রান্ত কয়েদীর মত, এমনভাবে এক জায়গায় ঘুরতে থাকে, যে তার নিচে রেলের লাইন বহু দূর পর্যন্ত গর্জে ওঠে।
ভাসিয়া লাফ দিয়ে ইঞ্জিন কেবিন থেকে নেমে পড়ে প্রথমদিকের চাকাগুলোর নিচে লাইনে বালু ছেটাতে শুরু করে। ‘আমার যদি কোনো সন্তান না থাকত তাহলে এই ছেলেটিকে আমি পুষ্যি নিতাম,’ পিছলিয়ে যাওয়া চাকাগুলোকে বাগে আনতে আনতে বিড় বিড় করে ইঞ্জিন চালক। ‘এই অল্প বয়সেই ও যেন একটা বড় মানুষ হয়ে গেছে, অথচ ওর সবকিছুই এখনো সামনে পড়ে আছে….আচ্ছা! এটা হচ্ছে কী! ট্রেনের পেছনে কি কোনো ব্রেক ধরা আছে? আর আমার কর্মীরা সব আরামে ঝিমুচ্ছে এমন যেন এখন ছুটির দিন! সামনের ঢালুপথে আমি ওদের মজা দেখাব।’ চালক জোরে জোরে দু’বার বাঁশি বাজায় যাতে পেছনে ব্রেক ধরা থাকলে কর্মীরা সেটা খুলে দেয়।
ভাসিয়া সবদিক দেখে রেললাইন থেকে সরে যায়।
চালক চেঁচায়, ‘কি হল কী তোমার?’
‘কিছু না,’ বলে ভাসিয়া, ‘খাড়া পথ শেষ, এখন আমার সাহায্য ছাড়াই ইঞ্জিন চলবে, আর তারপর তো ঢালুপথ।’
‘সবই সম্ভব,’ ওপর থেকে বলে চালক, ‘নাও, ধরো দেখি!” সে দুটো বড় আপেল ভাসিয়ার দিকে ছুঁড়ে দেয়।
ভাসিয়া মাটি থেকে তার উপহার তুলে নেয়। ‘দাঁড়াও, এখনি খেয়ো না!’ বলে চালক, ‘ফিরে যাবার পথে বগিগুলোর নিচের দিকে একটু দেখো, আর শুনতে চেষ্টা কোরো – কোথাও ব্রেক আটকে আছে কিনা। তারপর লাইনের পাশের ঢিপি থেকে তোমার লন্ঠন তুলে আমাকে জানান দিও। জানো তো কেমন করে?’
‘আমি সব সিগন্যালই জানি,’ ভাসিয়া উত্তর দিয়ে ইঞ্জিনের সাথে লাগানো একটা মইতে, মজা পাবার জন্য, চড়তে চড়তে । তারপর ঝুঁকে ইঞ্জিনের নিচে কোথাও কিছু দেখে, ‘ব্রেক আটকানো!’ চিৎকার করে সে।
‘কোথায়?’ জিজ্ঞেস করে চালক।
‘তোমার কাছেই, জ্বালানী বগির নিচে। ওটার চাকাগুলো প্রায় নড়ছেই না, তবে অন্য বগিগুলোর চাকা চলছে।’
চালক নিজেকে, তার সহকারী এবং সারা জীবনকে শাপশাপন্ত করে, আর ভাসিয়া মই থেকে নেমে বাড়ির দিকে হাঁটে। দূরে মাটিতে রাখা তার লন্ঠনটি জ্বলজ্বল করে। সাবধানের মার না রেখে সে শুনতে চায় ওয়াগনগুলোর নিচে যান্ত্রিক অংশগুলো কীরকম কাজ করছে, কিন্তু কোথাও ব্রেক প্যাডের ঘর্ষণ বা ক্ষয়ের শব্দ শোনা গেল না।
ট্রেন চলে গেলে সে লন্ঠনের দিকে ঘুরে দাঁড়ায়। কিন্তু লন্ঠনের আলো হঠাৎ করে শূন্যে ওঠে, কেউ একজন লন্ঠন হাতে তুলে নিয়েছে। ভাসিয়া সেখানে ছুটে গিয়ে দেখে মানুষটি হল তার বাবা।
‘আর আমাদের বাছুরটা কোথায়?’ ছেলেটা তার বাবাকে জিজ্ঞেস করে, ‘ও কি মারা গেছে?’
‘না, ও ভাল হয়ে উঠেছিল,’ উত্তর দিল বাবা, ‘আমি ওকে কসাইখানায় বিক্রি করে দিয়েছি, ভাল দাম দিয়েছে। আমাদের একটা ষাঁড়-বাছুর দিয়ে কী’বা লাভ!’
‘ও তো এখনো খুব ছোট ছিল!’ বলে ভাসিয়া।
‘ওরা ছোট থাকলেই মূল্য বেশী,’ বোঝায় বাবা, ‘ওদের মাংস নরম।’
ভাসিয়া লন্ঠনের কাচ বদলে নিল, সাদার পরিবর্তে সবুজ কাচ পরিয়ে, আস্তে আস্তে কয়েকবার মাথার ওপর তুলে সিগন্যাল জানিয়ে দেয়, তারপর লন্ঠনটা মাটিতে নামিয়ে রাখে, তার আলোটা চলে যাওয়া ট্রেনের দিকে তাক করে। বগির নিচে চাকাগুলো মসৃণভাবে চলছিল, কোথাও আটকে যাচ্ছিল না। চলুক ট্রেন বহু দূরে, ভাবে ভাসিয়া।
সব নীরব হয়ে গেল। কেবল উঠোন থেকে গরুটির দুর্বল ও বিষণ্ন ডাক ভেসে আসছিল, সে তার ছেলের আশায় ঘুমায় নি।
‘তুমি একাই বাড়ি চলে যাও,’ বলে বাবা, ‘আমি লাইনটা একটু দেখে আসি।’
‘তোমার যন্ত্রপাতির বাক্স কোথায়?’ ভাসিয়া তাকে মনে করিয়ে দেয়।
‘সেটা ঠিক আছে, আমি কেবল দেখে আসছি কোথাও রেলের পেরেক উঠে এসেছে কিনা, এখন আর কাজ করব না,’ বিষন্নভাবে বলে বাবা, ‘বাছুরটার জন্য খুব মন খারাপ করছে, এতদিন ধরে বড় করলাম, অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল, এরকম মন খারাপ হবে জানলে কি আর ওকে বিক্রি করতাম !’
ভাসিয়ার বাবা লন্ঠন হাতে রেলপথ ধরে এগিয়ে যায়, একবার ডানে তো আর একবার বাঁয়ে মাথা ঘুরিয়ে লাইন চেক করে।
ভাসিয়া আঙ্গিনার গেট খুললে গরুটা মানুষের উপস্থিতি বুঝে আবার দীর্ঘ কান্নার সুরে ডাকল। ছেলেটি চালাঘরে ঢুকে গরুটির দিকে চাইল, অন্ধকারে চোখ সয়ে এল তার। গরুটি তখন কিছু খাচ্ছিল না, ধীরে ধীরে নিঃশব্দে শ্বাস নিচ্ছিল। এক গভীর কঠিন মর্মযাতনা তাকে কুরে খাচ্ছিল, যে যন্ত্রণার কোনো শেষ নেই, যা শুধু বাড়তেই পারে। কেননা মানুষের মত, সে তার দুঃখকে কথা দিয়ে, কি চেতনা দিয়ে, কি বন্ধু দিয়ে, বা বিনোদন দিয়ে চাপা দিতে পারে না। ভাসিয়া অনেক সময় ধরে গরুটির গায়ে আদর করে হাত বোলাল, কিন্তু নির্বিকার গরুটি নড়ল না। তার তখন একটি জিনিসই দরকার ছিল – তার ছেলেকে, তার বাছুরকে, আর কোনো কিছুই তার স্থান দখল করতে পারে না, না মানুষ, না ঘাস, না সূর্য। গরুটি বুঝতে পারছিল না যে, একটি সুখকে ভুলে যেয়ে, আর কষ্ট যন্ত্রণা না সয়ে, অন্য আরেকটি সুখ খুঁজে নতুন করে বেঁচে থাকা যায়। তার ক্ষীণ বুদ্ধির সামর্থ ছিল না তাকে প্রতারণা করে সাহায্য করার, একবার যা তার হৃদয় বা অনুভূতিতে প্রবেশ করেছে তাকে চাপা দেওয়া বা বিস্মৃত হওয়া সম্ভব ছিল না।
গরুটি বিষন্ন সুরে ডাকছিল, কারণ সে অনুগত ছিল জীবনের কাছে, প্রকৃতির কাছে, তার সন্তানের কাছে যে কিনা এখনও এমন বড় হয় নি যে গরুটি তাকে ছেড়ে যেতে পারে। তার ভেতর ভরে ছিল বেদনা ও অস্থিরতায়, তার বড় রক্তাক্ত চোখদুটি তাকিয়ে ছিল অন্ধকারের দিকে, কিন্তু সেই চোখ দিয়ে কেঁদে সে নিজেকে বা নিজের দুঃখকে কমাতে করতে পারছিল না।
সকালে ভাসিয়া খুব তাড়াতাড়ি ইশকুলে চলে গেল, তার বাবা একটা এক-ফলা লাঙলকে কাজের জন্য প্রস্তুত করছিল। বাবা চাইছিল গরুটিকে লাঙ্গলের সাথে জুতে রেললাইনের পাশে একটুকরো জমি চাষ করে রাখতে যাতে আগামী বসন্তে সেখানে বাজরা বোনা যায়।
ইশকুল থেকে ফিরে ভাসিয়া দেখল তার বাবা জমি চাষ করছে, কিন্তু খুব কম অংশই চাষ হয়েছে। গরুটি মাথা নিচু করে বাধ্যভাবে লাঙ্গল টানছিল, তার মুখ থেকে জমিতে লালা ঝরে পড়ছে। এর আগে ভাসিয়া ও তার বাবা এই গরুটি দিয়ে কাজ করিয়েছে, গরুটি লাঙ্গল টানতে জানত এবং সহিষ্ণুতার সাথে জোয়াল কাঁধে নিতে অভ্যস্থ ছিল।
সন্ধ্যার দিকে ভাসিয়ার বাবা গরুটিকে জোয়াল থেকে ছাড়িয়ে পুরনো ক্ষেতের খড়-নাড়ার মধ্যে চরে বেড়ানোর জন্য ছেড়ে দিল। ভাসিয়া বাসার টেবিলে বসে ইশকুলের কাজ করছিল আর বার বার জানালা দিয়ে বাইরে তাকাচ্ছিল - সে গরুটিকে দেখতে পাচ্ছিল। গরুটি কাছের জমিটিতে দাঁড়িয়ে ছিল, সে চরছিল না, কিছুই করছিল না।
গতকালের মতই সন্ধ্যা নামে, বিষণ্ণ ও রিক্ত, ছাদের ওপরে বায়ুপতাকাটা কিরকির শব্দ করে বেজে যায়, মনে হয় সে শরতের দীর্ঘ গান গাইছে। অন্ধকার হয়ে আসা মাঠের দিকে ঠায় চেয়ে গরুটি তার সন্তানের জন্য অপেক্ষা করে। এখন সে আর নীচু সুরে কাঁদছিল না বা বাছুরটিকে ডাকছিল না। সে কিছুই বুঝতে পারছিল না, কিন্তু সব সহ্য করছিল।
ইশকুলের কাজ শেষ করে ভাসিয়া এক টুকরো রুটি নিয়ে তার ওপর নুন ছড়িয়ে গরুটির জন্য বাইরে নিয়ে আসে। গরুটি রুটিটা খায় না, নির্বিকার থাকে আগের মতই। ভাসিয়া গরুটির পাশে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে, তারপর দুহাত দিয়ে নিচ থেকে তার গলা জড়িয়ে ধরে যাতে গরুটি জানতে পারে যে, ভাসিয়া তাকে বোঝে ও ভালবাসে। কিন্তু গরুটি হঠাৎ করে তার কাঁধ ঝাঁকিয়ে ভাসিয়াকে ছুঁড়ে ফেলে, তারপর কন্ঠ থেকে উচ্চারিত অদ্ভূত চীৎকার করে মাঠের দিকে ছুটে যায়। কিছু দূর দৌড়ে গিয়ে গরুটি হঠাৎ ঘুরে দাঁড়ায়, তারপর কখনো লাফিয়ে, কখনো সামনের পা দুটি বেঁকিয়ে মাটিতে মাথা ঘষে, ভাসিয়া যেখানে দাঁড়িয়ে তার জন্য অপেক্ষা করছিল সেদিকে এগিয়ে আসতে থাকে।
ভাসিয়ার পাশ দিয়ে গরুটি ছুটে যায়, তাদের ঘরবাড়ি পেছনে ফেলে অন্ধকার মাঠে হারিয়ে যায়, আর সেখান থেকে ভাসিয়া আবার শোনে তার কন্ঠ-উচ্চারিত অদ্ভূত চিৎকার।
সন্ধ্যায় সমবায় সমিতির কাজ থেকে ভাসিয়ার মা ফিরে আসার পর তারা সবাই মিলে কাছাকাছি সবগুলো মাঠ, আশেপাশের অন্যান্য জায়গাগুলোতে প্রায় মাঝরাত্তির পর্যন্ত গরুটিকে খোঁজে। জোরে জোরে চীৎকার করে তারা গরুটিকে বার বার ডাকে। কিন্ত গরুটি তাদের কাছে আসে না বা তাদের ডাকে কোন সাড়া দেয় না। আসলে গরুটি তখন সেখানে ছিলই না। রাতের খাওয়া শেষে ভাসিয়ার মা গরু হারানোর দুঃখে কাঁদতে শুরু করে, কারণ সে তো তাদের কাছে শুধুমাত্র একটি গরু ছিল না। সে ছিল তাদের নিত্যকারের যোগ্য সহকর্মী এবং সত্যিকারের একজন বিনীত যোগানদার। ভাসিয়ার মা যখন কাঁদছিল সে সময় ভাসিয়ার বাবা চিন্তা করছিল নতুন আরেকটি গরু কেনার উপায় । সে জন্যে কিভাবে মিউচুয়াল এইড ফান্ড এবং রেলশ্রমিক ইউনিয়ন থেকে ঋণ নেওয়ার দরখাস্ত করতে পারে তাই নিয়ে মনে মনে হিসাব নিকাশ করছিল সে।
পরদিন ভোরে সবার আগে ভাসিয়ার ঘুম ভেঙ্গে যায়। তখনো জানালা দিয়ে ভোরের নরম আলোকে ধূসর বলে মনে হচ্ছিল। এসময় সে শুনতে পেল ঘরের কাছে কে যেন ঘন নিঃশ্বাস ফেলছে এবং নিঃশব্দে হেঁটে চলে বেড়াচ্ছে। ভাসিয়া জানালা দিয়ে দেখতে পেলো, বন্ধ গেটের সামনে গতকাল রাতে হারিয়ে যাওয়া তাদের সেই গরুটি ফিরে এসেছে। সে অপেক্ষা করছে, কেউ একজন গেট খুলে দিলেই ফের সে আঙ্গিণার ভেতরে চলে আসবে।
এভাবে ফিরে এসে গরুটি কিছুদিন আগের মতই স্বাভাবিক কাজকর্ম করল। দরকার হলে জোয়ালে জুতে গরুটিকে দিয়ে জমিতে চাষ করানো হত। আবার প্রয়োজনে সমবায় সমিতিতে থেকে আটা ময়দা বয়ে আনত গরুটি। তবে তার দুধ দেওয়ার ক্ষমতা একেবারে শুকিয়ে গেছিল; সে ধীরে ধীরে অত্যন্ত আনমনা আর বিভ্রান্ত হয়ে পড়ল। ভাসিয়া খুব যত্ন করে তাকে পানি দিয়ে ধুত, পরিচ্ছন্ন করে রাখত এবং আদর করে খাওয়াত কিন্তু এই যত্ন আত্তির বিনিময়ে কখনো সে সামান্যতম সাড়া দিত না। যদিও কেউই গরুটির ভেতরকার এই তারতম্য বুঝতে পাচ্ছিল না।
দিনের বেলা তারা গরুটিকে মাঠে ছেড়ে দিয়ে আসত যাতে নিজের ইচ্ছামত ঘুরতে পারে, চরতে পারে। কিন্তু গরুটি আগের মত চরত না, হয়ত সামান্য হেঁটে কখনো থেমে যেত কিম্বা ঘন্টার পর ঘন্টা একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকত। একবার তো সে রেল লাইন ধরে খুবই আনমনাভাবে স্লিপারের ওপর হাঁটতে শুরু করেছিল। ভাসিয়ার বাবা দেখতে পেয়ে তাড়াতাড়ি তাকে বাড়িতে নিয়ে আসে। এর আগে কখনো গরুটি রেললাইনের ওপর চলে যায়নি। সে ছিল খুবই বাধ্য, শান্ত, কিছুটা ভীতু, কিন্তু সংবেদনশীল একটি বুদ্ধিমান প্রাণী। এসব দেখেশুনে ভাসিয়ার ভয় হল। কি জানি গরুটি হয়ত ট্রেনের নীচে পড়ে মরবে কিম্বা এমনিতেই কোনদিন মরে যাবে। সারাক্ষণ সে গরুটিকে নিয়ে ভাবতে থাকে। এমনকি ইশকুলে বসেও ভাসিয়া এ সম্বন্ধে চিন্তা করত এবং এই দুশ্চিন্তায় সে ছুটির পর দৌঁড়ে বাড়িতে ছুটে আসত।
একদিন দিনগুলো তখন ছোট হতে শুরু করেছে, চারদিক অন্ধকার হয়ে আসছে, সেই সময় ভাসিয়া ইশকুল থেকে ফেরার পথে দেখে একটি মালবাহী ট্রেন তাদের বাড়ির উল্টোদিকে থেমে আছে। কিছু একটা খারাপ ঘটনা হয়েছে ভেবে সে দৌঁড়ে ইঞ্জিনের কাছে যায়।
থেমে থাকা ট্রেনের ইঞ্জিন চালক তার পরিচিত সেই আগের ব্যক্তি যাকে ভাসিয়া এই কিছুদিন আগে যথেষ্ট সাহায্য করেছিল। আর তার বাবা ট্রেনের নীচ থেকে গরুটিকে টেনে বের করার চেষ্টা করছে। গরুটি সত্যি সত্যি নিহত হয়েছে। ভাসিয়া হতবাক বিহবল হয়ে মাটিতে বসে পড়ে। এই প্রথম সে তার এত কাছের কোন প্রিয়জনের মৃত্যু দেখল, সে নিথর বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ে।
'আমি প্রায় দশ বার হুইশল দিয়েছি গরুটিকে,' ইঞ্জিন চালক ভাসিয়ার বাবাকে বলে, 'গরুটি কি বোবা, বধির বা বোকা ছিল নাকি? ইমার্জেন্সি ব্রেক টেনে পুরো ট্রেন থামাতে হল, ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে!'
'না, না, সে বধির নয়।' ড্রাইভারকে ভাসিয়ার বাবা বলে, 'আসলে ও পাগল হয়ে গিয়েছিল। হয়ত চলতে চলতে রেললাইনের উপরই ঘুমিয়ে পড়েছিল।'
'না! ও ইঞ্জিনের থেকে দূরে সরে যাবার জন্যই দৌড়ুচ্ছিল। যদিও খুব ধীরে, কিন্তু রেললাইন থেকে সময় মত নেমে যাওয়ার কথা ওর মনে ছিলনা। আমি ভেবেছিলাম হয়ত সে নেমে পড়বে,'— চালক ভাসিয়ার বাবাকে বিষয়টা জানায়।
চালকের সহকারী, ফায়ারম্যানসহ চারজনে মিলে ট্রেনের নীচ থেকে মৃত গরুটিকে টেনে বের করে ট্র্যাকের পাশের একটি গর্তে রাখল।
'বাহ, একেবারে তাজা মাংস' – ইঞ্জিন চালক জিজ্ঞেস করে, 'তুমি কি এই মাংস নুন দিয়ে জারিয়ে রাখবে, নাকি বিক্রি করে দেবে?
'বিক্রি করে দিতে হবে, 'ভাসিয়ার বাবা সিদ্ধান্ত নেয়, 'আরেকটি গরুর জন্য পয়সা তুলতে হবে, গরু ছাড়া জীবন কঠিন হবে।'
'গরু ছাড়া তোমার চলবে না,' ভাসিয়ার বাবার সাথে একমত হয়ে চালক জানায়, 'টাকা জোগাড় কর, গরুও কেনো। আমিও তোমাকে কিছু সাহায্য করব। আমার কাছে খুব বেশি নেই, তবে হয়ে যাবে। খুব শিঘ্রই একটি বোনাস পাচ্ছি আমি।'
'তুমি কেন আমাকে পয়সা দেবে?' অবাক হয় ভাসিয়ার বাবা, 'আমি তো তোমার আত্মীয় নই, কেউ নই। ও আমি নিজেই ব্যবস্থা করে ফেলব। তুমি তো জানই কীভাবে। আমাদের ট্রেড ইউনিয়ন রয়েছে, সমবায়, কাজ কত কী আছে। এখান থেকে, ওখান থেকে।'
'আমিও তাতে যোগ করব,' ইঞ্জিন চালক অনুরোধ করে, 'তোমার ছেলে আমাকে সাহায্য করেছিল। আমিও তেমনি. ওই যে ওখানে বসে আছে। ভাসিয়ার দিকে তাকিয়ে নরম হাসি দিয়ে সম্ভাষণ জানায় ইঞ্জিন চালক।
'হ্যালো,' উত্তর দেয় ভাসিয়া।
'আজ পর্যন্ত আমি আমার জীবনে একটি কুকুর ছাড়া আর কোন দুর্ঘটনায় পড়ি নি,' বলে চালক, এই ঘটনা আমাকে তাড়া করে ফিরবে যদি না আমি গরুটির জন্যে কিছু না দিই।'
'তুমি কী করে বোনাস পাবে?' ভাসিয়া চালককে জিজ্ঞেস করে, 'তুমি তো খুব বাজে ভাবে চালাও!'
'আজকাল আমি একটু ভালোভাবেই চালাচ্ছি,' ইঞ্জিন চালক স্মিত হেসে ভাসিয়াকে বলে, 'শিখছি |'
ভাসিয়া জানতে চাইল, 'তুমি কি বাড়তি আরেকটি বালুর বাক্স রেখেছ ট্রেনে ?'
'রেখেছি , তবে ছোট বাক্সটিকে বদলে আমরা বড় একটি বাক্সে করে নিয়েছি,' উত্তর দেয় চালক।
'এটা বুঝতে তোমাদের সময় লাগল,' একটু রাগ করে বলল ভাসিয়া।
এ সময় প্রধান গার্ড এসে চালককে একটি কাগজ ধরিয়ে দেয়, কাগজটিতে ট্রেনটি মাঝ পথে কেন থামল তার কারণটি সে লিখেছে।
পরের দিন ভাসিয়ার বাবা মৃত গরুটির দেহসহ সমস্ত মাংস জেলা সমবায় সমিতির কাছে বিক্রি করে দেয়। যারা কিনল একটি গাড়িতে সব তুলে তারা নিয়ে গেল। ভাসিয়া আর বাবাও ওদের সাথে গাড়িতে করে শহরে গিয়েছিল। ওর বাবা চাইছিল মাংস বিক্রির টাকাটা নিয়ে আসতে আর ভাসিয়া আসা করছিল শহরের দোকান থেকে কতগুলি পড়ার বই কেনার। একটি রাত এবং পরের দিন আধ বেলা পর্যন্ত ওরা শহরেই কাটিয়ে দিল। এটা সেটা নানা কিছু কিনে দুপুরের খাবার খেয়ে ঘরে ফেরার পথ ধরেছিল ওরা দুজন।
ওদের ফেরার পথ সমবায় ক্ষেতের মধ্যেই পরেছিল যেখানে ছিল ভাসিয়ার ইশকুল। ফার্মে পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধ্যা হয়ে এল । ভাসিয়া সে রাতে ইশকুলের তত্ত্বাবধায়কের কাছে ইশকুলেই থেকে যায় জাতে ভোরে উঠে আবার শুধোশুধি ইশকুলের পথ না মাড়াতে হয়। বাবা একাই ঘরে ফিরলেন।
ভাসিয়ার ইশকুলে পরদিন সকাল থেকে তাদের প্রথম সাময়িক পরীক্ষা শুরু হল। ছাত্রদের জন্যে একটি রচনা লিখতে দেওয়া হয়েছে। রচনার বিষয়বস্তু হচ্ছে, “আমি কিভাবে বেঁচে থেকে আমার মাতৃভূমির সেবার জন্যে কাজ করে যাবো।”
ভাসিয়া তার পরীক্ষার খাতায় লিখেছিল, 'আমি এখনো জানিনা, আমি কীভাবে বেঁচে থাকব। আমার কোনো ধারণাই নেই এ বিষয়ে। আমাদের একটি গরু ছিল। আমাদের সাথেই সে থাকত। আমি, আমার মা বাবা প্রতিদিন তার দুধ খেতাম। সেই গরুটির একটি ছোট্ট সুন্দর বাছুরও ছিল। বাছুরটিও আমাদের মত তার মা গরুটির দুধ খেত। আমরা তিনজন এবং বাছুরটি মিলে চারজন তার দুধ খাওয়ার পরেও অনেক দুধ থাকত। চাষের কাজে আমরা গরুটিকে ব্যবহার করতাম। তাছাড়া অনেক সময় দরকারি ভারি জিনিসপত্র বহনের কাজও করত সে। একদিন তার ছেলে, তার প্রিয় সন্তানটিকে মাংসের জন্যে কসাইয়ের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হল। কসাই বাছুরটিকে জবাই করে তার মাংস বিক্রি করে দিল। লোকে বাছুরটির সুস্বাদু মাংস খেয়ে ফেলল। বাছুর হারিয়ে মা গরুটি অসুখী এবং মন খুব খারাপ করে ঘুরে বেড়াত। এবং শিগগীরই একদিন ট্রেনের নীচ পড়ে সে মারা গেল। মা গরুটির মাংসও খেয়ে ফেলা হল। কেননা তারা ছিল কেবলই গরু। এখন আর কিছু নেই। গরুটি আমাদের সবকিছু দিয়ে দিয়েছিল, তার দুধ, তার প্রিয় ছেলে, তার মাংস, চামড়া, তার নাড়িভুড়িসহ হাড় মজ্জা সবকিছু। সে ছিল খুবই দয়ালু। আমি সব সময় তাকে মনে রাখব এবং কখনো তাকে ভুলে যাব না।'
ভাসিয়া যখন ঘরে ফিরে আসে, তখন গোধূলি সন্ধ্যারাগে রক্তিম। ওর বাবাও রেল লাইন থেকে ঘরে ফিরেছে। বাবা ভাসিয়ার মাকে একশ রুবেলের দুটি নোট দেখাল, একটা তামাকের কৌটার ভেতরে সেই ইঞ্জিন চালক এগুলো তার জন্যে ছুঁড়ে দিয়েছে।
-------------------------------------
লেখক পরিচিতি :
আন্দ্রেই প্লাতোনভ রুশ ভাষার এক আশ্চর্য লেখক যাঁর সঙ্গে বাংলাভাষীরা একেবারেই পরিচিত নন । ১৮৯৯ সালে জন্ম, ১৯৫১ সনে বলতে গেলে অল্প বয়সেই মৃত্যু। স্তালিন তাঁর পনেরো বছরের সন্তানকে গুলাগে পাঠিয়েছিল, সেই সন্তান যখন যক্ষ্মা নিয়ে মুক্তি পায় তার শুশ্রষা করতে গিয়ে নিজে যক্ষ্মাক্রান্ত হয়ে মারা যান। অনেকের মতে বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ রুশ লেখক হলেন প্লাতোনভ। তাঁর Foundation Pit পড়লে পাঠক এমন অর্থহীনতার সম্মুখীণ হবেন যেখান থেকে পরিত্রাণ কঠিন। জোসেফ ব্রদস্কির মতে প্লাতোনভ ভাষাকে, বিশেষত রাজনৈতিক ভাষাকে ভেঙে দিয়েছেন। তাঁর গল্পের প্লট ও ভাষার ব্যবহার ব্যতিক্রমী যেটা এই ছোট গল্পের মধ্যে দিয়েই পাঠক বুঝতে পারবেন। এখানে একদিকে যান্ত্রিক সভ্যতার প্রতিভূ রেলের ইঞ্জিন ও লাইন, অন্যদিকে ভাষাহীন একটি গরু। এই দ্বান্দ্বিকতাকে সংবেদী কিন্তু অতিরঞ্জন না করে প্লাতোনভ প্রকাশ করেছেন। তাঁর মৃত্যুর বহু পরে তাঁর সৃষ্টিকর্ম প্রকাশিত হয়।
____________________________________
স্তেপ অঞ্চলের ধূসর চেরকাসিয়ান গরুটি চালাঘরে একাই থাকত। কাঠের বোর্ড দিয়ে তৈরি, বাইরের দিকে রঙ করা, চালাঘরটি দাঁড়িয়ে ছিল লেভেল ক্রসিং গার্ডের বাড়ির পাশের ছোট জায়গাটিতে। চালাঘরের মধ্যে ছিল জ্বালানী কাঠ, শুকনো ঘাস, বাজরার খড় আর সংসারের যাবতীয় জিনিস, যেমন ঢাকনাবিহীন একটি ট্রাঙ্ক, পুড়ে যাওয়া সামোভারের চিমনী, পুরনো কিছু ন্যাকড়া, পা ভাঙ্গা একটি চেয়ার – এদের সবার সুখের দিন বিগত হয়েছে – আর এই সবের পাশে গরুটির জন্যে ছিল রাতে শুয়ে থাকার আর দীর্ঘ শীতগুলো পার করার জন্য অল্প জায়গা ।
গরুটির মালিকের ছেলে ভাসিয়া রুবৎসভ অপরাহ্ন ও সন্ধ্যায় গরুটিকে দেখতে আসত, ওর মাথা ঘিরে থাকা নরম পশমে হাত বুলিয়ে দিত। আজকেও ছেলেটি এসেছে।
‘গরু গরু,’ ভাসিয়া গরুটিকে ডাকল, কারণ গরুটির তো নিজস্ব কোনো নাম ছিল না, ভাসিয়া তাই গরুটিকে গরু বলেই ডাকে যে নামটি লেখা ছিল তার পড়ার বইতে। ‘তুমি তো গরুই। শোনো গরু, তুমি একটুও অস্থির হয়ো না, তোমার ছেলে ভালো হয়ে যাবে। আমার বাবা ওকে শীগগিরি ফিরিয়ে নিয়ে আসবে।’
এই মা গরুটির একটি ছোট্ট ষাঁড়-বাছুর ছিল। গতকাল ওর গলায় কী যেন আটকে গিয়েছিল, মুখ দিয়ে অনবরত লালা আর পিত্তি ঝরে পড়ছিল। বাছুরটি মরে যাবে এই ভেবে ভাসিয়ার বাবা তো ভয়ই পেয়ে গেলেন, তাই আজ ওকে নিয়ে ষ্টেশনে গেছেন পশুডাক্তারের কাছে।
গরুটি এক পাশ দিয়ে ভাসিয়ার দিকে তাকিয়ে চুপ করে থাকে। বহু আগে মরে যাওয়া একটি জীর্ণ ঘাসের ডগা চিবুচ্ছিল সে। এই ছোট ছেলেটিকে দেখলেই সে চিনতে পারে, ছেলেটি তাকে খুব ভালোবাসে। গরুটির সবকিছুই ছেলেটির পছন্দ – কালো ফ্রেমের বৃত্তে নিবদ্ধ আন্তরিক মায়াময় দুটি চোখ, ক্লান্ত কিংবা ভাবনায় নিমজ্জিত থাকে সেগুলো, দুটি শিং, কপাল আর বড় রুগ্ন শরীর, সেই রুগ্নতার কারণ হল যে শক্তি তার মেদ ও মাংসে ধরে রাখার কথা ছিল, তা সে অকাতরে বিলিয়ে দিচ্ছিল দুধ এবং কাজের জন্যে। ভাসিয়া চেয়ে দেখে গরুটির নরম কোমল ওলানের নিচে কুচকে যাওয়া ছোট দুধের বাটগুলি যেগুলো থেকে দুধের জোগান আসে। সে গরুটির শক্ত ছোট্ট গলকম্বল এবং সামনে বেরিয়ে আসা হাড়গুলোকে ছুঁয়ে দেখে।
অল্পক্ষণের জন্যে ছেলেটির দিকে তাকিয়ে থেকে গরুটি মাথা নীচু করে চাঙ্গড়ের ভেতর দিকে কিছু ঘাস মুখে পুরে নেয় তার নির্লিপ্ত মুখে। তার বিশ্রাম নেবার বা তাকিয়ে থাকবার সময় ছিল না, কোনো ক্ষান্তি না দিয়ে তার চিবিয়ে যেতে হয় যাতে তার মধ্যে দুধও জন্ম নেয় ক্ষান্তিহীন ভাবে; কিন্তু তার খাদ্য ছিল শুকনো ও একঘেয়ে, তাই গরুটিকে অনেকক্ষণ ধরে তা চিবাতে হয় তার ভেতর থেকে পুষ্টি বার করতে।
ভাসিয়া চালাঘরের বাইরে বেরিয়ে আসে। বাতাসে শরতের সুভাষ বইছে। লেভেল-ক্রসিং রক্ষকের বাড়ির চারপাশে ছড়িয়ে রয়েছে খা খা শূন্য মাঠ যা কিনা গ্রীষ্মকালে জীবন্ত ছিল ভুট্টা গাছের দোলুনিতে। সমানভাবে চষা মাঠগুলো এখন বিষণ্ণ শূন্যতায় পড়ে থাকে।
সন্ধ্যা নেমে আসে; ধূসর ঠান্ডা কুয়াসায় জড়ানো আকাশ এরই মধ্যে ঢেকে যায় অন্ধকারে; শীতের প্রস্তুতি নিতে যে খড়-নাড়া আর পত্রহীন ঝোপ মরে গেছে তার ওপর দিয়ে যে বাতাস বয়ে গেছে সারাদিন খচমচ শব্দ করে সেই বাতাস এখন শুয়ে আছে পৃথিবীর নিচু নিশ্চল কোনাগুলোয়, মাঝে মধ্যে শুধু চিমনির উপর থাকা বায়ু-পাখাটিকে সযত্নে ক্যাঁচক্যাঁচ করে ঘোরায় সেই বাতাস; শরৎ-আগমনীর গান শুরু করে পাখাটি।
এক ট্র্যাকের রেলপথটি ওদের বাড়ির খুব কাছ দিয়েই গেছে, একেবারে সামনের বাগান ঘেঁসে যে বাগানের সবকিছু, ঘাস ফু্ল সব, এখন শুকিয়ে গেছে, নুয়ে পড়ছে। ভাসিয়ার বাগানের বেড়া পেরিয়ে ঢুকতে অস্বস্তি হয়। যে গাছগুলি সে বুনেছিল বসন্তে, যাদেরকে যত্নে জীবন দিয়েছিল, এই বাগানটা এখন মনে হচ্ছে সেই গাছগুলির নিঝুম সমাধি ক্ষেত্র।
ভাসিয়ার মা ঘরের ভেতরে একটি বাতি জ্বালালেন আর সিগন্যাল দেখানোর লন্ঠনটি বাইরের বেঞ্চের উপর রেখে ছেলেকে বললেন, ‘৪০৬ নম্বর ট্রেন তো এখুনি চলে আসবে, তুমিই না হয় সিগন্যালটা দিয়ে দিও। তোমার বাবার ত এখনো টিকিখানাও দেখা যাচ্ছে না। আশা করি সে কোথাও মদ খেতে বসে পড়ে নি!’
সেই সকালে, সাত কিলোমিটার দূরের স্টেশনের দিকে, ভাসিয়ার বাবা বাছুরটাকে নিয়ে রওনা হয়ে গেছেন। সম্ভবত এখন সে বাছুরটাকে পশু-ডাক্তারের কাছে রেখে হয় যন্ত্রপাতির কাজ শিখছে, নয় ষ্টেশনে পার্টি মিটিংএ আছে, অথবা ক্যান্টিনে বসে বীয়ার খাচ্ছে। তাছাড়া এমনও হতে পারে যে, পশু-ডাক্তারের কাছে লম্বা লাইন পড়েছে বলে সেখানে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছে ! ভাসিয়া লন্ঠনটা নিয়ে ক্রসিং এর কাছে একটা কাঠের পাটাতনের ওপর গিয়ে বসে। এখনো ট্রেন আসার কোনো নামগন্ধ নেই, ভাসিয়া একটু ক্ষিপ্তই হয়। আসলে এখানে বসে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করার মত সময় ছিল না তার। কাল তাকে অনেক ভোরে উঠতে হবে, আর ঘুমোতে যাবার আগে ইশকুলের কাজ শেষ করতে হবে। ভাসিয়া তার বাড়ি থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরের যৌথ খামারের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ে।
ইশকুলে যেতে ভালোবাসে সে। ক্লাশে যখন সে বই পড়ে বা শিক্ষকদের পড়া শোনে তখন সে মনে মনে সমস্ত পৃথিবীটাকে দেখতে পায়, যে পৃথিবীটা সে এখনো চেনে না, যে পৃথিবীটা তার থেকে ছিল বহু দূরে। নীল নদ, মিশর, স্পেন এবং দূর প্রাচ্য, বিরাট সব নদী যেমন মিসিসিপি, ইয়ানিসেই, প্রশান্ত দন, আর আমাজান – আরাল সাগর, মস্কো, মাউন্ট আরারাত, আর্কটিক সাগরের বিজন দ্বীপ ভাসিয়াকে আকৃষ্ট করত, উতলা করে তুলত। তার মনে হত এই সমস্ত দেশ আর তাদের লোকজন তার বড় হয়ে ওঠার জন্যে, তাকে অতিথি হিসেবে পাবার জন্য, বহুদিন ধরে অপেক্ষা করে আছে। কিন্তু শুধুমাত্র যৌথ খামারের ইশকুল আর স্টেশন ছাড়া এখন পর্যন্ত তার তো আর কোথাও যাবার সময় হয়নি, সে এখনো সেখানেই রয়ে গেল যেখানে সে জন্মেছে। তাই এক ধরণের প্রত্যাশী আনন্দে সে সেই সব লোকদের মুখকে লক্ষ করত যারা যাত্রীবাহী ট্রেনের জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকত। এরা কারা ? এরা কী ভাবে? কিন্তু ট্রেন এত দ্রুত চলে যেত যে ক্রসিংএ দাঁড়ানো ভাসিয়া তাদের ভালো করে জানতে পারে না। তাছাড়া খুব বেশি ট্রেনও এই পথ যাতায়াত করত না। দু দিক থেকে চব্বিশ ঘন্টায় মাত্র দুটো করে ট্রেন আসত, আর এদের মধ্যে তিনটে ট্রেনই রাতে পাস করত।
একবার একটা ট্রেন খুব আস্তে যাচ্ছিল বলে ভাসিয়া একজন ভাবুক তরুণ মানুষের মুখ স্পষ্ট দেখতে পেয়েছিল। পাইপ খেতে খেতে জানালা দিয়ে সে স্তেপের পাড়ে দিগন্তের ধারে কোনো অজানা জায়গার দিকে তাকিয়ে ছিল। সবুজ পতাকা হাতে রেলক্রসিং এর কাছে দাঁড়ানো ছেলেটিকে দেখে সে হেসেছিল, স্পষ্ট স্বরে বলেছিল, ‘বিদায়, বন্ধু!’ তারপর হাত নাড়িয়ে বিদায় জানিয়েছিল। ভাসিয়াও মনে মনে উত্তর দিয়েছিল, ‘আমি বড় হলে আবার আমাদের দেখা হবে। বেঁচে থেকে আমার জন্য অপেক্ষা করো, মরে যেও না।’ অনেকদিন পর্যন্ত ভাসিয়া ট্রেনের কামরার সেই ভাবুক তরুণটিকে মনে রেখেছিল যে তাকে পেরিয়ে চলে গেছিল কোন সুদূরের ঠিকানায়। ভাসিয়া ভাবল তরুণটি হয়ত ছিল কোনো পারাস্যুটিস্ট, শিল্পী, পদক-বিজয়ী বা এর চেয়েও ভাল কেউ। কিন্তু দ্রুতই এই তরুণটি, যে কিনা তাদের বাড়ি পার হয়ে গিয়েছিল, তার কথা ভাসিয়ার মন থেকে মুছে যেতে থাকে, কারণ তাকে তো তার জীবন চালিয়ে যেতে হবে, অন্য অনেক কিছুকে অনুভব করতে হবে, চিন্তা করতে হবে।
দূরে, শরতের মাঠের অন্ধকার শূন্যতায়, ট্রেনের ঝমঝম শব্দ শোনা যায়। ভাসিয়া লাইনের কাছে এসে মাথার উপর উজ্জ্বল বাতিটা তুলে ধরে ‘সব ক্লিয়ার’ সঙ্কেত দেখায়। আরো কিছুক্ষণ সে এগিয়ে আসা ট্রেনটির ক্রম-বর্ধমান গর্জন শোনে, তারপর তার বাড়ির দিকে তাকায়। উঠোনে গরুটি বিষণ্ন সুরে গোঙাচ্ছে। গরুটি অনেক সময় ধরে অপেক্ষা করেছে তার বাছুর সন্তানটির জন্য, কিন্তু সে তো ফিরে এল না। ভাসিয়া মনে মনে বিরক্তই হল, “বাবা কেন এত দেরি করছে? কোথায় সে এত সময় নষ্ট করছে? এদিকে আমাদের গরুটি কাঁদছে। রাত হয়ে গেল, সব অন্ধকার, ওদিকে বাবার টিকিটিরও দেখা নেই।”
ট্রেনের ইঞ্জিন ক্রসিংএর কাছে পৌঁছাল, চাকাগুলোর ঘুরতে অসুবিধা হচ্ছিল, সর্বশক্তি দিয়ে অন্ধকারে আগুনের ফুলকি ছিটিয়ে ইঞ্জিনটি শ্বাস নিয়ে বাতি হাতে দাঁড়ানো একমাত্র মানুষটিকে পার হয়ে গেল। ইঞ্জিন চালক ভাসিয়াকে যেন খেয়ালই করল না, জানালা দিয়ে শরীর বার করে সে ইঞ্জিনটাকে দেখছিল – পিস্টন রডের প্যাকিংএর সিল ফেটে গিয়েছিল আর পিস্টনের প্রতিটি ঘা’র সাথে সাথে সাথে সাথে সেখান থেকে বাষ্প বেরুচ্ছিল। ভাসিয়াও সেটা লক্ষ করল। সামনেই একটা লম্বা চড়াই আসছে, এরকম খারাপ সিলিন্ডার নিয়ে ট্রেনটিকে টানা ইঞ্জিনের জন্য কঠিন হয়ে পড়বে। ছেলেটি জানত বাষ্প ইঞ্জিন কীভাবে কাজ করে, সে তার পদার্থবিদ্যা বইতে এ বিষয়ে পড়েছে। আর বইতে যদি কিছু লেখা নাও থাকত তবু সে বিষয়টি খুঁজে বের করে ফেলত। কোনো জিনিস দেখে তা কীভাবে কাজ করে বা তার ভেতরে কী হয় সেটা না জানা সে সহ্য করতে পারত না। তাই ইঞ্জিন চালক যে তার লন্ঠনকে লক্ষ না করেই তাকে পার হয়ে গেছে তা নিয়ে সে মন খারাপ করেনি, কেননা চালক তার ইঞ্জিন নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিল – সামনের দীর্ঘ খাড়া পথ পাড়ি দিতে এটা রাত্রির যে কোনো সময়ে বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তখন চালকের জন্য ট্রেনকে পুনরায় চালু করা কঠিন হবে। আর একবার ট্রেনের চলন বন্ধ হলে ওয়াগনগুলি একটু পিছিয়ে পড়বে এবং তাদের মধ্যের সংযোগস্থলগুলোয় টান পড়বে। আর চালক যদি পুর্ণ গতিতে ট্রেন চালাতে শুরু করে তবে সংযোগগুলো ছিঁড়ে যেতে পারে, অন্যদিকে পূর্ণ গতিতে না চালালে ট্রেন তো নড়বেই না।
কিছু ভারি চার এক্সেলের ওয়াগন চলে গেল, তাদের স্প্রিংগুলো একেবারে সংকুচিত দেখে ছেলেটি বুঝল সেগুলো ভারী ও দামি মালামালে ভর্তি। এরপর এল খোলা ওয়াগনগুলো; সেগুলোর ওপর ছিল মোটর গাড়ি, ত্রিপল দিয়ে ঢাকা যন্ত্রপাতি, কয়লার ঢিপি, কপির পাহাড় এবং কিছু রেলের জিনিস। এরপর এল গবাদি পশুতে ভর্তি বদ্ধ বগিগুলি। ভাসিয়া তার জ্বলন্ত লন্ঠনটি চাকা এবং এক্সেলের বাক্সের ওপর ধরে দেখতে চাইছিল কোন গড়বড় আছে কিনা, কিন্তু সবকিছুই ঠিকঠাক মনে হল। কেবল গবাদি পশুর বগিগুলি থেকে একটা অজানা বাছুরের নিচু ডাকের শব্দ ভেসে এল, আর তাই শুনে, তার সন্তানটির জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়া ওদের নিজেদের গরুটি চালাঘর থেকে দীর্ঘ বিলাপের স্বরে সাড়া দিল।
শেষ ওয়াগনটি আস্তে আস্তে ভাসিয়াকে ছাড়িয়ে চলে যায়। সে স্পষ্ট শুনতে পায় ইঞ্জিনের সংগ্রাম, হাঁসফাঁস করছিল সেটি ট্রেনের সামনে। কিন্তু চাকাগুলো পাক খাচ্ছিল, ট্রেনকে টানতে পারছিল না। ইঞ্জিনটা বেশ অসুবিধায় পড়েছে দেখে ভাসিয়া লন্ঠন হাতে সেদিকে এগিয়ে যায়। সে চাইছিল ইঞ্জিনের কাছে থাকতে, সেটার দুর্ভাগ্যকে ভাগ করে নিলে সে যেন স্বস্তি পাবে।
ইঞ্জিনটাকে জোরে চালানো হচ্ছিল বলে চিমনি দিয়ে কয়লার গুঁড়ো উড়ে যাচ্ছিল এবং ভেতরে বয়লারের প্রতিধ্বনিত শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ স্পষ্টই শোনা যাচ্ছিল। চাকাগুলোর ঘুরতে অসুবিধে হচ্ছিল, ইঞ্জিন-চালক তার কেবিনে বসে তা পর্যবেক্ষণ করছিল। চালকের সহকারী ইঞ্জিনের সামনে রেলপথ ধরে হাঁটছিল। সে নুড়িস্তর থেকে বালু ছুঁড়ে রেললাইনের ওপর ফেলছিল যাতে ট্রেনের চাকা না পিছলায়। ইঞ্জিনের হেডলাইট আলোকিত করে রেখেছিল তার তেলকালি মাখা কালো, ক্লান্ত শরীরকে। ভাসিয়া তার লন্ঠনটি মাটিতে রেখে, রেলপথে উঠে, সহকারীর দিকে এগিয়ে যায়।
‘এটা আমাকে করতে দাও,’ ভাসিয়া বলে, ‘তুমি বরং গিয়ে ইঞ্জিনটাকে সাহায্য কর। যে কোনো মুহূর্তে ওটা বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
‘তুমি কি পারবে?’ ছেলেটির চিন্তাগ্রস্থ মুখমণ্ডলের উজ্জ্বল বড় চোখদুটির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল চালকের সহকারী। ‘বেশ, তাহলে চালিয়ে যাও। কিন্তু সতর্ক থেকো– ইঞ্জিনের দিকে নজর রেখো কেমন!’
কোদালটা ভাসিয়ার জন্য বেশী বড় ও ভারি ছিল। সে সেটাকে সহকারীকে ফেরত দিয়ে দেয়।
‘আমি বরং হাত দিয়েই কাজটা করে ফেলছি, এটাই সহজ।’
ভাসিয়া উপুড় হয়ে বসে বালু কুড়িয়ে রেললাইনের ওপর লম্বা ফিতের মত ছিটিয়ে দিতে শুরু করে।
‘আর অন্য পাশের লাইনটাও দেখো,’ আদেশ দেয় চালকের সহকারী, তারপর ইঞ্জিনের দিকে দৌড়ায়।
ভাসিয়া প্রথমে একপাশের, পরে অন্য পাশের, লাইনের উপর বালু ছেটাতে আরম্ভ করে। বালুকে তার ইস্পাতের চাকা দিয়ে পিষতে পিষতে পরিশ্রান্ত ইঞ্জিনটি খুব ধীরে ছেলেটিকে অনুসরণ করে। ওপর থেকে অঙ্গার ও বাষ্পের ঘনীভূত জলকণা একই সাথে এসে পড়ছিল ভাসিয়ার গায়ে, কিন্ত সে কাজটা আনন্দের সাথেই করছিল। তার মনে হচ্ছিল ইঞ্জিনের চাইতে সে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ, কেননা ইঞ্জিন তার পেছন পেছন আসছিল এবং শুধুমাত্র তার কাজের জন্যেই ইঞ্জিনের চাকা একবারও পিছলে যায় নি, থেমে যায়নি।
কাজের আনন্দে ভাসিয়া যখন সব ভুলে যাচ্ছিল ইঞ্জিন যে তার ওপর চলে আসছে সেটা সে খেয়াল করছিল না। চালক বাঁশিতে ছোট্ট করে একটি শিস বাজিয়ে চেঁচায়, ‘এই যে, এদিকে খেয়াল রেখো। আর বালুকে আরেকটু ঘন করে, আরো সমান করে ছিটিয়ে দিও।’
ভাসিয়া ইঞ্জিনের সামনে থেকে সরে চুপ করে কাজ করে। কিন্তু চালকের চেঁচিয়ে হুকুম করায় তার রাগ হয়। লাইনের বাইরে লাফিয়ে এসে চালককে চিৎকার করে বলে, ‘আর আপনারাই বা কোন আক্কেলে বালু ছাড়া চলে এসেছেন? খেয়াল ছিল না?’
‘বালু শেষ হয়ে গেছে,’ চালক বলে, ‘আমাদের একটা মাত্র ছোট বাক্স আছে বালু রাখার জন্য।’
ইঞ্জিনের পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে ভাসিয়া আদেশ দেয়, ‘আরেকটি বাক্স রাখবেন। পুরোনো লোহালক্কড় বাঁকিয়েই তো বানানো যায়। কোনো মিস্ত্রীকে বলবে।’
ইঞ্জিন চালক ছেলেটাকে দেখার চেষ্টা করল, কিন্তু অন্ধকারে ভালমত দেখতে পায় না। ভাসিয়ার মুখমণ্ডল ছিল ছোট, পোশাক বেশ পরিপাটি, পায়ে পরা ছিল একজোড়া চামড়ার জুতো, আর তার চোখ দুটো ইঞ্জিনের দিক ছেড়ে নড়ছিল না। ইঞ্জিন চালকের বাড়িতে ওরকমই একটি ছেলে বড় হচ্ছে।
‘আর বাষ্প বেরিয়ে যাচ্ছে যেখান থেকে বের হবার কথা নয়, সিলিন্ডার থেকে, বয়লারের পাশ দিয়ে, শুধোশুধি ফুটো দিয়ে সব শক্তি বেরিয়ে যাচ্ছে।’
চালক বলে, ‘বাহ! ঠিক বলেছ। তুমি বরং আমার এখানে বস, আর আমি লাইনের পাশ দিয়ে হাঁটি।’
‘বেশ তো,’ আনন্দের সাথে সায় দেয় ভাসিয়া।
তখনই, একটুও না নড়ে, ইঞ্জিনের চাকাগুলো সর্বশক্তি নিয়ে, মুক্তির খোঁজে উদভ্রান্ত কয়েদীর মত, এমনভাবে এক জায়গায় ঘুরতে থাকে, যে তার নিচে রেলের লাইন বহু দূর পর্যন্ত গর্জে ওঠে।
ভাসিয়া লাফ দিয়ে ইঞ্জিন কেবিন থেকে নেমে পড়ে প্রথমদিকের চাকাগুলোর নিচে লাইনে বালু ছেটাতে শুরু করে। ‘আমার যদি কোনো সন্তান না থাকত তাহলে এই ছেলেটিকে আমি পুষ্যি নিতাম,’ পিছলিয়ে যাওয়া চাকাগুলোকে বাগে আনতে আনতে বিড় বিড় করে ইঞ্জিন চালক। ‘এই অল্প বয়সেই ও যেন একটা বড় মানুষ হয়ে গেছে, অথচ ওর সবকিছুই এখনো সামনে পড়ে আছে….আচ্ছা! এটা হচ্ছে কী! ট্রেনের পেছনে কি কোনো ব্রেক ধরা আছে? আর আমার কর্মীরা সব আরামে ঝিমুচ্ছে এমন যেন এখন ছুটির দিন! সামনের ঢালুপথে আমি ওদের মজা দেখাব।’ চালক জোরে জোরে দু’বার বাঁশি বাজায় যাতে পেছনে ব্রেক ধরা থাকলে কর্মীরা সেটা খুলে দেয়।
ভাসিয়া সবদিক দেখে রেললাইন থেকে সরে যায়।
চালক চেঁচায়, ‘কি হল কী তোমার?’
‘কিছু না,’ বলে ভাসিয়া, ‘খাড়া পথ শেষ, এখন আমার সাহায্য ছাড়াই ইঞ্জিন চলবে, আর তারপর তো ঢালুপথ।’
‘সবই সম্ভব,’ ওপর থেকে বলে চালক, ‘নাও, ধরো দেখি!” সে দুটো বড় আপেল ভাসিয়ার দিকে ছুঁড়ে দেয়।
ভাসিয়া মাটি থেকে তার উপহার তুলে নেয়। ‘দাঁড়াও, এখনি খেয়ো না!’ বলে চালক, ‘ফিরে যাবার পথে বগিগুলোর নিচের দিকে একটু দেখো, আর শুনতে চেষ্টা কোরো – কোথাও ব্রেক আটকে আছে কিনা। তারপর লাইনের পাশের ঢিপি থেকে তোমার লন্ঠন তুলে আমাকে জানান দিও। জানো তো কেমন করে?’
‘আমি সব সিগন্যালই জানি,’ ভাসিয়া উত্তর দিয়ে ইঞ্জিনের সাথে লাগানো একটা মইতে, মজা পাবার জন্য, চড়তে চড়তে । তারপর ঝুঁকে ইঞ্জিনের নিচে কোথাও কিছু দেখে, ‘ব্রেক আটকানো!’ চিৎকার করে সে।
‘কোথায়?’ জিজ্ঞেস করে চালক।
‘তোমার কাছেই, জ্বালানী বগির নিচে। ওটার চাকাগুলো প্রায় নড়ছেই না, তবে অন্য বগিগুলোর চাকা চলছে।’
চালক নিজেকে, তার সহকারী এবং সারা জীবনকে শাপশাপন্ত করে, আর ভাসিয়া মই থেকে নেমে বাড়ির দিকে হাঁটে। দূরে মাটিতে রাখা তার লন্ঠনটি জ্বলজ্বল করে। সাবধানের মার না রেখে সে শুনতে চায় ওয়াগনগুলোর নিচে যান্ত্রিক অংশগুলো কীরকম কাজ করছে, কিন্তু কোথাও ব্রেক প্যাডের ঘর্ষণ বা ক্ষয়ের শব্দ শোনা গেল না।
ট্রেন চলে গেলে সে লন্ঠনের দিকে ঘুরে দাঁড়ায়। কিন্তু লন্ঠনের আলো হঠাৎ করে শূন্যে ওঠে, কেউ একজন লন্ঠন হাতে তুলে নিয়েছে। ভাসিয়া সেখানে ছুটে গিয়ে দেখে মানুষটি হল তার বাবা।
‘আর আমাদের বাছুরটা কোথায়?’ ছেলেটা তার বাবাকে জিজ্ঞেস করে, ‘ও কি মারা গেছে?’
‘না, ও ভাল হয়ে উঠেছিল,’ উত্তর দিল বাবা, ‘আমি ওকে কসাইখানায় বিক্রি করে দিয়েছি, ভাল দাম দিয়েছে। আমাদের একটা ষাঁড়-বাছুর দিয়ে কী’বা লাভ!’
‘ও তো এখনো খুব ছোট ছিল!’ বলে ভাসিয়া।
‘ওরা ছোট থাকলেই মূল্য বেশী,’ বোঝায় বাবা, ‘ওদের মাংস নরম।’
ভাসিয়া লন্ঠনের কাচ বদলে নিল, সাদার পরিবর্তে সবুজ কাচ পরিয়ে, আস্তে আস্তে কয়েকবার মাথার ওপর তুলে সিগন্যাল জানিয়ে দেয়, তারপর লন্ঠনটা মাটিতে নামিয়ে রাখে, তার আলোটা চলে যাওয়া ট্রেনের দিকে তাক করে। বগির নিচে চাকাগুলো মসৃণভাবে চলছিল, কোথাও আটকে যাচ্ছিল না। চলুক ট্রেন বহু দূরে, ভাবে ভাসিয়া।
সব নীরব হয়ে গেল। কেবল উঠোন থেকে গরুটির দুর্বল ও বিষণ্ন ডাক ভেসে আসছিল, সে তার ছেলের আশায় ঘুমায় নি।
‘তুমি একাই বাড়ি চলে যাও,’ বলে বাবা, ‘আমি লাইনটা একটু দেখে আসি।’
‘তোমার যন্ত্রপাতির বাক্স কোথায়?’ ভাসিয়া তাকে মনে করিয়ে দেয়।
‘সেটা ঠিক আছে, আমি কেবল দেখে আসছি কোথাও রেলের পেরেক উঠে এসেছে কিনা, এখন আর কাজ করব না,’ বিষন্নভাবে বলে বাবা, ‘বাছুরটার জন্য খুব মন খারাপ করছে, এতদিন ধরে বড় করলাম, অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল, এরকম মন খারাপ হবে জানলে কি আর ওকে বিক্রি করতাম !’
ভাসিয়ার বাবা লন্ঠন হাতে রেলপথ ধরে এগিয়ে যায়, একবার ডানে তো আর একবার বাঁয়ে মাথা ঘুরিয়ে লাইন চেক করে।
ভাসিয়া আঙ্গিনার গেট খুললে গরুটা মানুষের উপস্থিতি বুঝে আবার দীর্ঘ কান্নার সুরে ডাকল। ছেলেটি চালাঘরে ঢুকে গরুটির দিকে চাইল, অন্ধকারে চোখ সয়ে এল তার। গরুটি তখন কিছু খাচ্ছিল না, ধীরে ধীরে নিঃশব্দে শ্বাস নিচ্ছিল। এক গভীর কঠিন মর্মযাতনা তাকে কুরে খাচ্ছিল, যে যন্ত্রণার কোনো শেষ নেই, যা শুধু বাড়তেই পারে। কেননা মানুষের মত, সে তার দুঃখকে কথা দিয়ে, কি চেতনা দিয়ে, কি বন্ধু দিয়ে, বা বিনোদন দিয়ে চাপা দিতে পারে না। ভাসিয়া অনেক সময় ধরে গরুটির গায়ে আদর করে হাত বোলাল, কিন্তু নির্বিকার গরুটি নড়ল না। তার তখন একটি জিনিসই দরকার ছিল – তার ছেলেকে, তার বাছুরকে, আর কোনো কিছুই তার স্থান দখল করতে পারে না, না মানুষ, না ঘাস, না সূর্য। গরুটি বুঝতে পারছিল না যে, একটি সুখকে ভুলে যেয়ে, আর কষ্ট যন্ত্রণা না সয়ে, অন্য আরেকটি সুখ খুঁজে নতুন করে বেঁচে থাকা যায়। তার ক্ষীণ বুদ্ধির সামর্থ ছিল না তাকে প্রতারণা করে সাহায্য করার, একবার যা তার হৃদয় বা অনুভূতিতে প্রবেশ করেছে তাকে চাপা দেওয়া বা বিস্মৃত হওয়া সম্ভব ছিল না।
গরুটি বিষন্ন সুরে ডাকছিল, কারণ সে অনুগত ছিল জীবনের কাছে, প্রকৃতির কাছে, তার সন্তানের কাছে যে কিনা এখনও এমন বড় হয় নি যে গরুটি তাকে ছেড়ে যেতে পারে। তার ভেতর ভরে ছিল বেদনা ও অস্থিরতায়, তার বড় রক্তাক্ত চোখদুটি তাকিয়ে ছিল অন্ধকারের দিকে, কিন্তু সেই চোখ দিয়ে কেঁদে সে নিজেকে বা নিজের দুঃখকে কমাতে করতে পারছিল না।
সকালে ভাসিয়া খুব তাড়াতাড়ি ইশকুলে চলে গেল, তার বাবা একটা এক-ফলা লাঙলকে কাজের জন্য প্রস্তুত করছিল। বাবা চাইছিল গরুটিকে লাঙ্গলের সাথে জুতে রেললাইনের পাশে একটুকরো জমি চাষ করে রাখতে যাতে আগামী বসন্তে সেখানে বাজরা বোনা যায়।
ইশকুল থেকে ফিরে ভাসিয়া দেখল তার বাবা জমি চাষ করছে, কিন্তু খুব কম অংশই চাষ হয়েছে। গরুটি মাথা নিচু করে বাধ্যভাবে লাঙ্গল টানছিল, তার মুখ থেকে জমিতে লালা ঝরে পড়ছে। এর আগে ভাসিয়া ও তার বাবা এই গরুটি দিয়ে কাজ করিয়েছে, গরুটি লাঙ্গল টানতে জানত এবং সহিষ্ণুতার সাথে জোয়াল কাঁধে নিতে অভ্যস্থ ছিল।
সন্ধ্যার দিকে ভাসিয়ার বাবা গরুটিকে জোয়াল থেকে ছাড়িয়ে পুরনো ক্ষেতের খড়-নাড়ার মধ্যে চরে বেড়ানোর জন্য ছেড়ে দিল। ভাসিয়া বাসার টেবিলে বসে ইশকুলের কাজ করছিল আর বার বার জানালা দিয়ে বাইরে তাকাচ্ছিল - সে গরুটিকে দেখতে পাচ্ছিল। গরুটি কাছের জমিটিতে দাঁড়িয়ে ছিল, সে চরছিল না, কিছুই করছিল না।
গতকালের মতই সন্ধ্যা নামে, বিষণ্ণ ও রিক্ত, ছাদের ওপরে বায়ুপতাকাটা কিরকির শব্দ করে বেজে যায়, মনে হয় সে শরতের দীর্ঘ গান গাইছে। অন্ধকার হয়ে আসা মাঠের দিকে ঠায় চেয়ে গরুটি তার সন্তানের জন্য অপেক্ষা করে। এখন সে আর নীচু সুরে কাঁদছিল না বা বাছুরটিকে ডাকছিল না। সে কিছুই বুঝতে পারছিল না, কিন্তু সব সহ্য করছিল।
ইশকুলের কাজ শেষ করে ভাসিয়া এক টুকরো রুটি নিয়ে তার ওপর নুন ছড়িয়ে গরুটির জন্য বাইরে নিয়ে আসে। গরুটি রুটিটা খায় না, নির্বিকার থাকে আগের মতই। ভাসিয়া গরুটির পাশে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে, তারপর দুহাত দিয়ে নিচ থেকে তার গলা জড়িয়ে ধরে যাতে গরুটি জানতে পারে যে, ভাসিয়া তাকে বোঝে ও ভালবাসে। কিন্তু গরুটি হঠাৎ করে তার কাঁধ ঝাঁকিয়ে ভাসিয়াকে ছুঁড়ে ফেলে, তারপর কন্ঠ থেকে উচ্চারিত অদ্ভূত চীৎকার করে মাঠের দিকে ছুটে যায়। কিছু দূর দৌড়ে গিয়ে গরুটি হঠাৎ ঘুরে দাঁড়ায়, তারপর কখনো লাফিয়ে, কখনো সামনের পা দুটি বেঁকিয়ে মাটিতে মাথা ঘষে, ভাসিয়া যেখানে দাঁড়িয়ে তার জন্য অপেক্ষা করছিল সেদিকে এগিয়ে আসতে থাকে।
ভাসিয়ার পাশ দিয়ে গরুটি ছুটে যায়, তাদের ঘরবাড়ি পেছনে ফেলে অন্ধকার মাঠে হারিয়ে যায়, আর সেখান থেকে ভাসিয়া আবার শোনে তার কন্ঠ-উচ্চারিত অদ্ভূত চিৎকার।
সন্ধ্যায় সমবায় সমিতির কাজ থেকে ভাসিয়ার মা ফিরে আসার পর তারা সবাই মিলে কাছাকাছি সবগুলো মাঠ, আশেপাশের অন্যান্য জায়গাগুলোতে প্রায় মাঝরাত্তির পর্যন্ত গরুটিকে খোঁজে। জোরে জোরে চীৎকার করে তারা গরুটিকে বার বার ডাকে। কিন্ত গরুটি তাদের কাছে আসে না বা তাদের ডাকে কোন সাড়া দেয় না। আসলে গরুটি তখন সেখানে ছিলই না। রাতের খাওয়া শেষে ভাসিয়ার মা গরু হারানোর দুঃখে কাঁদতে শুরু করে, কারণ সে তো তাদের কাছে শুধুমাত্র একটি গরু ছিল না। সে ছিল তাদের নিত্যকারের যোগ্য সহকর্মী এবং সত্যিকারের একজন বিনীত যোগানদার। ভাসিয়ার মা যখন কাঁদছিল সে সময় ভাসিয়ার বাবা চিন্তা করছিল নতুন আরেকটি গরু কেনার উপায় । সে জন্যে কিভাবে মিউচুয়াল এইড ফান্ড এবং রেলশ্রমিক ইউনিয়ন থেকে ঋণ নেওয়ার দরখাস্ত করতে পারে তাই নিয়ে মনে মনে হিসাব নিকাশ করছিল সে।
পরদিন ভোরে সবার আগে ভাসিয়ার ঘুম ভেঙ্গে যায়। তখনো জানালা দিয়ে ভোরের নরম আলোকে ধূসর বলে মনে হচ্ছিল। এসময় সে শুনতে পেল ঘরের কাছে কে যেন ঘন নিঃশ্বাস ফেলছে এবং নিঃশব্দে হেঁটে চলে বেড়াচ্ছে। ভাসিয়া জানালা দিয়ে দেখতে পেলো, বন্ধ গেটের সামনে গতকাল রাতে হারিয়ে যাওয়া তাদের সেই গরুটি ফিরে এসেছে। সে অপেক্ষা করছে, কেউ একজন গেট খুলে দিলেই ফের সে আঙ্গিণার ভেতরে চলে আসবে।
এভাবে ফিরে এসে গরুটি কিছুদিন আগের মতই স্বাভাবিক কাজকর্ম করল। দরকার হলে জোয়ালে জুতে গরুটিকে দিয়ে জমিতে চাষ করানো হত। আবার প্রয়োজনে সমবায় সমিতিতে থেকে আটা ময়দা বয়ে আনত গরুটি। তবে তার দুধ দেওয়ার ক্ষমতা একেবারে শুকিয়ে গেছিল; সে ধীরে ধীরে অত্যন্ত আনমনা আর বিভ্রান্ত হয়ে পড়ল। ভাসিয়া খুব যত্ন করে তাকে পানি দিয়ে ধুত, পরিচ্ছন্ন করে রাখত এবং আদর করে খাওয়াত কিন্তু এই যত্ন আত্তির বিনিময়ে কখনো সে সামান্যতম সাড়া দিত না। যদিও কেউই গরুটির ভেতরকার এই তারতম্য বুঝতে পাচ্ছিল না।
দিনের বেলা তারা গরুটিকে মাঠে ছেড়ে দিয়ে আসত যাতে নিজের ইচ্ছামত ঘুরতে পারে, চরতে পারে। কিন্তু গরুটি আগের মত চরত না, হয়ত সামান্য হেঁটে কখনো থেমে যেত কিম্বা ঘন্টার পর ঘন্টা একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকত। একবার তো সে রেল লাইন ধরে খুবই আনমনাভাবে স্লিপারের ওপর হাঁটতে শুরু করেছিল। ভাসিয়ার বাবা দেখতে পেয়ে তাড়াতাড়ি তাকে বাড়িতে নিয়ে আসে। এর আগে কখনো গরুটি রেললাইনের ওপর চলে যায়নি। সে ছিল খুবই বাধ্য, শান্ত, কিছুটা ভীতু, কিন্তু সংবেদনশীল একটি বুদ্ধিমান প্রাণী। এসব দেখেশুনে ভাসিয়ার ভয় হল। কি জানি গরুটি হয়ত ট্রেনের নীচে পড়ে মরবে কিম্বা এমনিতেই কোনদিন মরে যাবে। সারাক্ষণ সে গরুটিকে নিয়ে ভাবতে থাকে। এমনকি ইশকুলে বসেও ভাসিয়া এ সম্বন্ধে চিন্তা করত এবং এই দুশ্চিন্তায় সে ছুটির পর দৌঁড়ে বাড়িতে ছুটে আসত।
একদিন দিনগুলো তখন ছোট হতে শুরু করেছে, চারদিক অন্ধকার হয়ে আসছে, সেই সময় ভাসিয়া ইশকুল থেকে ফেরার পথে দেখে একটি মালবাহী ট্রেন তাদের বাড়ির উল্টোদিকে থেমে আছে। কিছু একটা খারাপ ঘটনা হয়েছে ভেবে সে দৌঁড়ে ইঞ্জিনের কাছে যায়।
থেমে থাকা ট্রেনের ইঞ্জিন চালক তার পরিচিত সেই আগের ব্যক্তি যাকে ভাসিয়া এই কিছুদিন আগে যথেষ্ট সাহায্য করেছিল। আর তার বাবা ট্রেনের নীচ থেকে গরুটিকে টেনে বের করার চেষ্টা করছে। গরুটি সত্যি সত্যি নিহত হয়েছে। ভাসিয়া হতবাক বিহবল হয়ে মাটিতে বসে পড়ে। এই প্রথম সে তার এত কাছের কোন প্রিয়জনের মৃত্যু দেখল, সে নিথর বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ে।
'আমি প্রায় দশ বার হুইশল দিয়েছি গরুটিকে,' ইঞ্জিন চালক ভাসিয়ার বাবাকে বলে, 'গরুটি কি বোবা, বধির বা বোকা ছিল নাকি? ইমার্জেন্সি ব্রেক টেনে পুরো ট্রেন থামাতে হল, ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে!'
'না, না, সে বধির নয়।' ড্রাইভারকে ভাসিয়ার বাবা বলে, 'আসলে ও পাগল হয়ে গিয়েছিল। হয়ত চলতে চলতে রেললাইনের উপরই ঘুমিয়ে পড়েছিল।'
'না! ও ইঞ্জিনের থেকে দূরে সরে যাবার জন্যই দৌড়ুচ্ছিল। যদিও খুব ধীরে, কিন্তু রেললাইন থেকে সময় মত নেমে যাওয়ার কথা ওর মনে ছিলনা। আমি ভেবেছিলাম হয়ত সে নেমে পড়বে,'— চালক ভাসিয়ার বাবাকে বিষয়টা জানায়।
চালকের সহকারী, ফায়ারম্যানসহ চারজনে মিলে ট্রেনের নীচ থেকে মৃত গরুটিকে টেনে বের করে ট্র্যাকের পাশের একটি গর্তে রাখল।
'বাহ, একেবারে তাজা মাংস' – ইঞ্জিন চালক জিজ্ঞেস করে, 'তুমি কি এই মাংস নুন দিয়ে জারিয়ে রাখবে, নাকি বিক্রি করে দেবে?
'বিক্রি করে দিতে হবে, 'ভাসিয়ার বাবা সিদ্ধান্ত নেয়, 'আরেকটি গরুর জন্য পয়সা তুলতে হবে, গরু ছাড়া জীবন কঠিন হবে।'
'গরু ছাড়া তোমার চলবে না,' ভাসিয়ার বাবার সাথে একমত হয়ে চালক জানায়, 'টাকা জোগাড় কর, গরুও কেনো। আমিও তোমাকে কিছু সাহায্য করব। আমার কাছে খুব বেশি নেই, তবে হয়ে যাবে। খুব শিঘ্রই একটি বোনাস পাচ্ছি আমি।'
'তুমি কেন আমাকে পয়সা দেবে?' অবাক হয় ভাসিয়ার বাবা, 'আমি তো তোমার আত্মীয় নই, কেউ নই। ও আমি নিজেই ব্যবস্থা করে ফেলব। তুমি তো জানই কীভাবে। আমাদের ট্রেড ইউনিয়ন রয়েছে, সমবায়, কাজ কত কী আছে। এখান থেকে, ওখান থেকে।'
'আমিও তাতে যোগ করব,' ইঞ্জিন চালক অনুরোধ করে, 'তোমার ছেলে আমাকে সাহায্য করেছিল। আমিও তেমনি. ওই যে ওখানে বসে আছে। ভাসিয়ার দিকে তাকিয়ে নরম হাসি দিয়ে সম্ভাষণ জানায় ইঞ্জিন চালক।
'হ্যালো,' উত্তর দেয় ভাসিয়া।
'আজ পর্যন্ত আমি আমার জীবনে একটি কুকুর ছাড়া আর কোন দুর্ঘটনায় পড়ি নি,' বলে চালক, এই ঘটনা আমাকে তাড়া করে ফিরবে যদি না আমি গরুটির জন্যে কিছু না দিই।'
'তুমি কী করে বোনাস পাবে?' ভাসিয়া চালককে জিজ্ঞেস করে, 'তুমি তো খুব বাজে ভাবে চালাও!'
'আজকাল আমি একটু ভালোভাবেই চালাচ্ছি,' ইঞ্জিন চালক স্মিত হেসে ভাসিয়াকে বলে, 'শিখছি |'
ভাসিয়া জানতে চাইল, 'তুমি কি বাড়তি আরেকটি বালুর বাক্স রেখেছ ট্রেনে ?'
'রেখেছি , তবে ছোট বাক্সটিকে বদলে আমরা বড় একটি বাক্সে করে নিয়েছি,' উত্তর দেয় চালক।
'এটা বুঝতে তোমাদের সময় লাগল,' একটু রাগ করে বলল ভাসিয়া।
এ সময় প্রধান গার্ড এসে চালককে একটি কাগজ ধরিয়ে দেয়, কাগজটিতে ট্রেনটি মাঝ পথে কেন থামল তার কারণটি সে লিখেছে।
পরের দিন ভাসিয়ার বাবা মৃত গরুটির দেহসহ সমস্ত মাংস জেলা সমবায় সমিতির কাছে বিক্রি করে দেয়। যারা কিনল একটি গাড়িতে সব তুলে তারা নিয়ে গেল। ভাসিয়া আর বাবাও ওদের সাথে গাড়িতে করে শহরে গিয়েছিল। ওর বাবা চাইছিল মাংস বিক্রির টাকাটা নিয়ে আসতে আর ভাসিয়া আসা করছিল শহরের দোকান থেকে কতগুলি পড়ার বই কেনার। একটি রাত এবং পরের দিন আধ বেলা পর্যন্ত ওরা শহরেই কাটিয়ে দিল। এটা সেটা নানা কিছু কিনে দুপুরের খাবার খেয়ে ঘরে ফেরার পথ ধরেছিল ওরা দুজন।
ওদের ফেরার পথ সমবায় ক্ষেতের মধ্যেই পরেছিল যেখানে ছিল ভাসিয়ার ইশকুল। ফার্মে পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধ্যা হয়ে এল । ভাসিয়া সে রাতে ইশকুলের তত্ত্বাবধায়কের কাছে ইশকুলেই থেকে যায় জাতে ভোরে উঠে আবার শুধোশুধি ইশকুলের পথ না মাড়াতে হয়। বাবা একাই ঘরে ফিরলেন।
ভাসিয়ার ইশকুলে পরদিন সকাল থেকে তাদের প্রথম সাময়িক পরীক্ষা শুরু হল। ছাত্রদের জন্যে একটি রচনা লিখতে দেওয়া হয়েছে। রচনার বিষয়বস্তু হচ্ছে, “আমি কিভাবে বেঁচে থেকে আমার মাতৃভূমির সেবার জন্যে কাজ করে যাবো।”
ভাসিয়া তার পরীক্ষার খাতায় লিখেছিল, 'আমি এখনো জানিনা, আমি কীভাবে বেঁচে থাকব। আমার কোনো ধারণাই নেই এ বিষয়ে। আমাদের একটি গরু ছিল। আমাদের সাথেই সে থাকত। আমি, আমার মা বাবা প্রতিদিন তার দুধ খেতাম। সেই গরুটির একটি ছোট্ট সুন্দর বাছুরও ছিল। বাছুরটিও আমাদের মত তার মা গরুটির দুধ খেত। আমরা তিনজন এবং বাছুরটি মিলে চারজন তার দুধ খাওয়ার পরেও অনেক দুধ থাকত। চাষের কাজে আমরা গরুটিকে ব্যবহার করতাম। তাছাড়া অনেক সময় দরকারি ভারি জিনিসপত্র বহনের কাজও করত সে। একদিন তার ছেলে, তার প্রিয় সন্তানটিকে মাংসের জন্যে কসাইয়ের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হল। কসাই বাছুরটিকে জবাই করে তার মাংস বিক্রি করে দিল। লোকে বাছুরটির সুস্বাদু মাংস খেয়ে ফেলল। বাছুর হারিয়ে মা গরুটি অসুখী এবং মন খুব খারাপ করে ঘুরে বেড়াত। এবং শিগগীরই একদিন ট্রেনের নীচ পড়ে সে মারা গেল। মা গরুটির মাংসও খেয়ে ফেলা হল। কেননা তারা ছিল কেবলই গরু। এখন আর কিছু নেই। গরুটি আমাদের সবকিছু দিয়ে দিয়েছিল, তার দুধ, তার প্রিয় ছেলে, তার মাংস, চামড়া, তার নাড়িভুড়িসহ হাড় মজ্জা সবকিছু। সে ছিল খুবই দয়ালু। আমি সব সময় তাকে মনে রাখব এবং কখনো তাকে ভুলে যাব না।'
ভাসিয়া যখন ঘরে ফিরে আসে, তখন গোধূলি সন্ধ্যারাগে রক্তিম। ওর বাবাও রেল লাইন থেকে ঘরে ফিরেছে। বাবা ভাসিয়ার মাকে একশ রুবেলের দুটি নোট দেখাল, একটা তামাকের কৌটার ভেতরে সেই ইঞ্জিন চালক এগুলো তার জন্যে ছুঁড়ে দিয়েছে।
-------------------------------------
1 মন্তব্যসমূহ
আন্দ্রেই প্লাতোনভ এর গল্প এই প্রথম পড়া হলো। এক কথায় মুগ্ধ
উত্তরমুছুন! আর অনুবাদও প্রাঞ্জল। খুব ভালো লেগেছে।