মুরিয়েল স্পার্ক'এর গল্প : অলৌকিক দেবদূত

অনুবাদ : বিপ্লব বিশ্বাস

ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাতের খাড়া চূড়ায় যেখানে জাম্বেসি নদী আঘাতে ছড়িয়ে গেছে তার চার মাইল দক্ষিণে ক্রেমারের একটি পেট্রল পাম্প আছে। আর আছে কয়েকটি ভাড়া দেবার মতো ঘর যা সে ভিক্টোরিয়ার পর্যটকদের দেয় যখন আশপাশের হোটেলগুলি ভরে যায়। সেইসব হোটেলে কোনও খালি ঘর না থাকায় আমাকে সেই ক্রিসমাস সপ্তাহে ক্রেমারের ওখানে পাঠিয়ে দেওয়া হল।
সেখানে গিয়ে দেখলাম ক্রেমার এক বিশাল দলা পাকানো মার্সিডিজ গাড়িতে স্টার্ট দেবার চেষ্টা করছে -- তার কর্গেট - লোহার তৈরি গ্যারাজের বাইরে ; প্রথম দর্শনেই মনে হল সে কঙ্গোর এক বেলজিয়ান। তার চেহারায় উত্তর দক্ষিণ দু দিকেরই ছাপ আছে, পাতলা চুল আর ক্যানভাস রঙের গায়ের চামড়া। পরে সে আমাকে বলল যে তার বাবা জার্মান আর মা চিলের বাসিন্দা। তার গ্যারাজের দরজার ওপরে ' এস ক্রেমার ' লেখা পরিচিতির চাইতে এই তথ্যটি জেনে আমার মনে হল যে তার কথা আগে শুনেছি। 

ছিটেফোঁটা বৃষ্টি আর ডিসেম্বরের অসহ্য গরম। ক্রিসমাসের আগের তৃতীয় রাতে ঘরের বাইরে গাড়িবারান্দায় বসে মশারির মতো তারের ভাঙা বেড়ার ফাঁক দিয়ে দূরের বিদ্যুৎ- চমকানি দেখছিলাম। যখন বহুক্ষণ আবহাওয়া অত্যধিক গরম থাকে, জীবনের স্বাভাবিক হইহল্লায় কিছু একটা যেন ঘটে যায়। রোজকার স্বাভাবিক আওয়াজের ভার যেন কম পড়ে যায় ; এমন শোনায় যেন কেউ কণ্ঠরোধ করেছে। সেই রাতে ক্রিসমাসের সময় যেসব গুবরে পোকা বের হয় তারা প্রতিটি গাড়িবারান্দায় একটানা জোর শব্দে উলটে পড়েছে দেখে মনে হল তারা যেন যথেষ্টই আঘাত সইতে পারে। ওদের একটিকে পড়তে দেখলাম আর চকিতে তার গোত্তা খাওয়ার আওয়াজ আমার কানে ঢুকল। 

ঝোপের মাঝ থেকে ভেসে আসা ছোটোখাটো বুনো পশুদের আওয়াজও যেন গলা টিপে আটকে রাখা হয়েছে। আসলে ঝোপ থেকে আসা সব রকমের আওয়াজ এক সঙ্গে না থামা পর্যন্ত, চিতাবাঘ এলে যেমনটি তারা প্রায়ই করে , আমি জানতেই পারতাম না সেখানে আদৌ কোনও শব্দ হচ্ছিল। এই সাধারণ কণ্ঠরুদ্ধ গুঞ্জন চেপে দিয়ে দূর গাড়িবারান্দায় ক্রেমারের সান্ধ্য পার্টির তোড়জোড় চলছে। উত্তাপের হলকায় প্রতিটি শব্দ ভেঙে ভেঙে যাচ্ছিল। গ্লাসগুলো থেকে যে টুংটাং আওয়াজ উঠছিল তা যেন কাচ - জাতীয় কিছুর নয়, টিস্যু কাগজে মোড়া বোতলের। কখনও কখনও মুহূর্তের জন্য একটা তীক্ষ্ণ বা কঁককঁক আওয়াজ অসাড় ঢঙে শূন্যে ভেসে আছে কিন্তু এসব অবাস্তব শব্দ যা দূরদেশ থেকে ভেসে আসছে, যেন সেসব লন্ডনের কুয়াশা ভেদ করে দেখা পকেট - টর্চ। 

যে গাড়িবারান্দায় বসেছিলাম ক্রেমার তার শেষপ্রান্তে এসে আমাকে তার পার্টিতে যোগ দিতে বলল। তাতে যে আমি খুশিই হব, সে কথা তাকে বুঝিয়ে দিলাম যদিও একা বসে থাকতে আমার ভালোই লাগছিল। তাপের মাত্রা এতটাই নাছোড় আর তীব্র যে আমার ইচ্ছেসব উবে যাচ্ছিল। 
বেতের আরাম- চেয়ারে পাঁচজন বসে সোডা- বরফ মেশানো হুইস্কি খাচ্ছে আর নোনতা চীনেবাদাম চিবোচ্ছে। বিনোদন পার্টির এক লালচুলো সদস্যকে চিনতে পারলাম যে লিভিংস্টোন থেকে এসেছে, কিছুদিন আগেই ইংল্যান্ডে ছিল ; আর বুলাওয়ায়ো থেকে আসা ক্রেমারের দুই ভাড়াটে --- এক তামাক- চাষি আর তার স্ত্রী, তাদেরও চিনতে পারলাম। সেই অঞ্চলের রীতি অনুসারে তাদের নামের প্রথম অংশ দিয়ে পরিচিত করানো হল। ছোটোখাটো কালো চৌকোমুখ আর শারীরিক গড়নের ম্যানি সম্ভবত ইস্টকোস্টের পর্তুগিজ। ফ্যানি নামের মহিলাটি ঘষা খেয়ে উঠে যাওয়া বেতের চেয়ারের টুকরো ছিঁড়ছে আর মদের গ্লাসটা যখন তুলছে তার হাত খানিক কাঁপছে -- তাতে কব্জির ব্রেসলেটে রুনুঝুনু আওয়াজ উঠছে। মহিলার বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি ; পরিচ্ছন্ন, পরিচর্যায় উত্তম। তার ধূসর চুল, নীল প্রলেপ দেওয়া -- এমনভাবে বাঁধা যে ম্যালেরিয়ায় কুঁচকে যাওয়া মুখের ওপর ঝালরের মতো ঝুলছে। 

গ্রামের দিকে অপরিচিত অবস্থায় সময় কাটানোর চলতি নিয়মে আমি ওই তামাকচাষীদের সঙ্গে সেইসব পরিচিতদের নামটাম বিনিময় করতে লাগলাম যারা, আমরা যেখানে বসেছিলাম তার ছশো মাইল বেড়ের মধ্যে বাস করে ; আমরা উভয়েই চিনি এমন মানুষের নামে তালিকা কমিয়ে এনে কথালাপ চলতে লাগল। সেই ট্রুপ - সদস্য লুসাকা আর লিভিংস্টোনের মাঝামাঝি অঞ্চলের খবরাখবর দিল। এরমধ্যে ক্রেমার, ফ্যানি আর ম্যানি নিজেদের মধ্যে এক তর্ক জুড়ে দিল যেখানে ফ্যানিই যুক্তিপূর্ণভাবে এগিয়ে ছিল। 

মনে হচ্ছিল, ক্রিসমাসের ঠিক আগে কোনও নাটক বা গানের কনসার্ট হতে চলেছে যাতে এরা তিনজনই অংশ নেবে। কয়েকবারই ' দেবদূতের ট্রুপ ', ' মেষপালকেরা ', ' হাস্যকর দাম ' আর ' আমার মেয়েরা ' কথাগুলি কানে এল যা কিনা এই তর্কাতর্কির মূল শব্দসব বলে মনে হল। হঠাৎই বিনোদন পার্টির সেই সদস্য একজনের নাম উল্লেখ করায় ফ্যানি মাঝপথে কথা থামিয়ে আমাদের দিকে ঘুরল। ' সে আমার মেয়েদের একজন ', ফ্যানি বলল, ' আমি তাকে তিনবছর ধরে শিখিয়েছি। ' ম্যানি এবার যাওয়ার জন্য উঠল এবং ফ্যানি তার পেছন ধরার আগেই হাতব্যাগ থেকে একটা কার্ড বের করে দুই নখের মাঝে রেখে আমার দিকে বাড়িয়ে দিল। 

' তোমার কোনও বন্ধু যদি আগ্রহী হয়... ', অস্পষ্ট ঢঙে ফ্যানি বলল। সে ম্যানির সঙ্গে চলে গেলে কার্ডটি দেখলাম যেখানে নদীর চার মাইল ওপরের একটি ঠিকানা লেখা -- ম্যাম লা ফ্যানফার্লো ( প্যারি, লন্ডন), নাচ প্রশিক্ষিকা। ব্যালে, বলরুম। প্রয়োজনে যান - ব্যবস্থা থাকবে। পরদিন ক্রেমারের সঙ্গে দেখা হল। সে তখনও তার মার্সিডিজের সমস্যা খুঁজে পেতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ' তুমিই কি সেই মানুষ যার সম্পর্কে বোদলেয়ার লিখেছিলেন? ', তাকে জিজ্ঞেস করলাম। সে আমাকে ছাপিয়ে একটা ফাঁকা রংচটা ঘাসজমির দিকে একভাবে তাকাল যেখানে ধৈর্যশীল চেষ্টাতেও বনবাদাড় গড়ে তোলা যায়নি। এবার বলল, ' হ্যাঁ, কিন্তু তোমার এটা মনে হল কেন?' ' ফ্যানির দেওয়া কার্ডে ফ্যানফার্লো নামটি দেখে ', আমি বললাম, ' তুমি কি তাকে প্যারিতে চিনতে না? ' ' ও, হ্যাঁ, ' ক্রেমার বলল, ' কিন্তু সে সব দিন ফুরিয়ে গেছে। সে ম্যানুয়েলা দ্য মন্তাভার্দ অর্থাৎ ম্যানিকে বিয়ে করেছে। এখানে প্রায় কুড়ি বছর হল বাস করছে। তার একটা কাফিরের দোকান আছে। ' 

আমার তখন মনে পড়ল, রোমান্টিক যুগে কবিতা লেখা আর প্রেমপত্র লেখার মধ্যে ক্রেমার দোল খেয়ে আনন্দ পেত ; আর এইসব অভ্যাসের সঙ্গে বাস করেও পেত অপার সন্তুষ্টি । তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ' তুমি কি লেখালিখি ছেড়ে দিয়েছ?' ' কেরিয়ার হিসেবে যদি বলো তাহলে বলব, হ্যাঁ ', সে উত্তর দিল। ' এটা ছিল একজাতীয় মোহ যার থেকে মুক্তি পেয়ে আমি খুশিই হয়েছি। ' এরপর সে তার মার্সিডিজের বনেটে ঘুষি মেরে বলল, ' মহত্তম সাহিত্য উপলক্ষ্যজাত সৃষ্টি, এক সামান্য অনুচিন্তা।' ফের সে ওই খাঁ খাঁ ঘাসজমির দিকে আড়াআড়ি তাকাল যেখানে সবার অলক্ষে এক মেটে রঙের ঝুঁটিওয়ালা লওরি পাখি যাকে তার ' চলে যাও ' ডাক শুনে চেনা যায়, এখন ডাকছে সেই চেনা ডাকে। ' জীবনই,'ক্রেমার বলতে থাকে, ' হল গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।' ' তুমি কি আনুষ্ঠানিক কবিতা লেখো, ' আমি জানতে চাই। সে বলল, ' যখন কোনও উপলক্ষ তা দাবি করে। ' ' কার্যত এই সবে জিশুর জন্মতিথি উপলক্ষে একটি মুখোশ- নাটক লিখেছি। ক্রিসমাসের আগে সেই নাটক আমরা করব। ' এই বলে সে তার গ্যারাজের দিকে আঙুল তুলে দেখাল যেখানে জনাকয় স্থানীয় মানুষ পেট্রলের ক্যান আর টায়ার অন্যত্র সরানোর কাজ করছে। 

নাটকের অভিনেতা বা দর্শক কোনওটাই না হওয়ায় তারা সময় নিয়েই ওই কাজটি করছে। এক গাদা ভাঁজ করা সিট পাশে এক জায়গায় জড়ো করে রাখল। পরে ক্রিসমাসের আগের দিন সকালে জলপ্রপাত থেকে ফিরে দেখলাম একদল স্থানীয় লোক গ্যারাজের বাইরে ক্রেমারের সঙ্গে ঝগড়া বাধিয়ে দিয়েছে, মাঝপথে কীসব হলফ - টলফ করছে, চিৎকার করে। এক হাতে ক্রেমার এক গোমড়ামুখোর আস্তিন টেনে ধরেছে, অন্য হাত নেড়ে সে উত্তপ্ত বাতাস বিষয়ে তার গালাগালির বর্ণনা দিচ্ছে। জনাকয় পেশাদার লোককে স্টেজ বাঁধার কাজে পাঠানো হয়েছে, আর এরা তাদের তৃতীয় মানের ইংরেজি জ্ঞান, ধুয়ে পরিষ্কার করা মুখ আর সাদা খসখসে কাপড়ের হাফপ্যান্ট পরে সরল ঢঙে ক্রেমারের মোটা কম্বল - পোশাকের ছেলেদের উস্কানি দিয়ে যাচ্ছে। শেষ মুহূর্তে ক্রেমার ' পুলিশ' উচ্চারণে মোক্ষম ঝেড়ে ওদের সবাইকে কাজে পাঠাতে পারল যদিও তখনও তারা একে অপরের দিকে ড্রামের মতো আওয়াজ তুলে কী সব বলছিল। 

আড়াআড়ি তক্তায় পেরেক মেরে প্যাকিং বাক্স দিয়ে তৈরি মঞ্চ বাড়িটার পেছন দিকে বসানো হল যেখানে একটা দরজা দিয়ে চত্বর, গোপন কক্ষ আর স্থানীয় বাসিন্দাদের কুঁড়েঘরে পৌঁছে যাওয়া যায়। সরকারি কালো কম্বল এক সার ঝুলিয়ে দরজা আর মঞ্চের মাঝখানের ফাঁকা জায়গাটা আড়াল করা হয়েছে ; আর এটাই হল সাজঘর। আমি সন্ধ্যায় সেখানে এসে আলোকসজ্জা, মেক - আপ আর দেবদূতদের পাখনা পিন দিয়ে আটকানোর কাজে সাহায্য করব বলে কথা দিলাম। 

ফ্যানফার্লোর নাচের ছাত্রীদের নাচ ও জিশুর ক্যারোলের সঙ্গে একটি দেবদূত কোরাস অনুষ্ঠান করার কথা, যখন সে নিজে ভার্জিন মেরি রূপে একটা প্রতিনিধিত্বমূলক ব্যালে উপহার দেবে। ভাঙা ভাঙা ইংরিজির কারণে তার স্বামীকে এক বাকহীন মেষপালকের ভূমিকা দেওয়া হয়েছে আর তাকে সাহায্য করার জন্য আরও তিন মেষপালককে বাছা হয়েছে ওই একই কারণে। ক্রেমারের অভিনয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কেননা তারই লম্বা বক্তব্য আছে, প্রথম সেরাফ ( উচ্চস্তরীয় দেবদূত) হিসাবে। এটা ধরে নেওয়া হয়েছিল, যেহেতু সে-ই মুখোশ নাটকটি লিখেছে, তাই তার পক্ষেই এর বেশির ভাগ অংশ অভিনয় করে দেখানো সর্বোত্তম ; কিন্তু আমি দেখলাম, মহড়ার সময় প্রযোজনা ব্যয়ের ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা হচ্ছে কেননা ফ্যানি চাইছে তার মেয়েদের অভিনয়ের উপযুক্ত তথা বিস্তারিত দৃশ্য উপস্থাপনের ব্যবস্থা করা হোক। 

আটটা নাগাদ অভিনয় শুরু হওয়ার কথা। সাতটা পনেরো নাগাদ মঞ্চের পেছনে গিয়ে দেখলাম দেবদূতেরা নানান রঙের কোঁচকানো কাগজের পাখনা সহ ব্যালে পোশাকে জড়ো হয়েছে। ফ্যানফার্লো একটা লম্বা সাদা স্বচ্ছ স্কার্ট পরেছে যাতে রুপোর সেলাইকাজ আছে। ক্রেমারকে দেখতে পেয়ে তিন প্রাজ্ঞ মেজাই -এর দাঁড়ি সাঁটাতে হাত লাগালাম। 

ক্রেমার রোমানদের আলখাল্লার মতো একটা পোশাক পরেছিল যা মোটা মশারির সুতোয় বোনা কিন্তু তা তার পরনের সাদা হাফপ্যান্টটা ঢেকে দিতে পারে তেমন মোটা নয়। সে অনেক আগেই মুখের সাজগোজ সেরে নিয়েছে যা প্রচণ্ড তাপে মুখজুড়ে গলে গলে পড়ছে। ' এইসব মুহূর্তে নিজেকে খুব তেজি মনে হয়, ' সে বলল, ' আমি আমার শুরুর কথাগুলি অভ্যেস করে নিই। ' এই বলে সে মঞ্চে উঠে পাঠ আওড়াতে লেগে গেল। হইচই করা শিশুদের গলা ছাপিয়ে ক্রেমারের ছন্দোবদ্ধ কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম এবং আমি ফ্যানফার্লোর মেয়েদের মুখের মেক - আপে সাহায্য করতে মনস্থ করলাম। এ কাজ অসম্ভব মনে হল। মুখে মাখানোর রঙের স্টিকগুলি হাতে নিতে না নিতেই গলে যাচ্ছে। প্রকৃতই অস্বাভাবিক উষ্ণ হাওয়া। ' দরজা খুলে দাও ' বলে জোর চিৎকার করে উঠল ফ্যানফার্লো। পেছনের দরজা খুলে দেওয়া হলে একদল উৎসুক স্থানীয় বাসিন্দা প্রবেশপথে হুড়োহুড়ি জুড়ে দিল। ফ্যানফার্লো তাদের হটানোর হুকুম দিলে আমি তা এড়িয়ে এগোলাম কেননা ঠান্ডা বাতাসের ছোঁয়া পেতে বাড়িটার সামনের দিকে যেতেই হত। 

মঞ্চে উঠে তা পেরিয়ে যেতেই বুঝলাম আমার ডান দিক থেকে প্রচণ্ড তাপ ছড়াচ্ছে। ঘুরে দেখলাম ক্রেমার চিৎকার করে কাউকে কিছু বলছে ঠিক যেমন সকালে স্থানীয় লোকেদের সঙ্গে করছিল, সেই একই ভঙ্গিতে। কিন্তু তাপপ্রবাহের ফলে সে এগোতে পারছে না। আর এই তাপের কারণে আমিও প্রথমে বুঝতে পারিনি কাকে ক্রেমার বকাঝকা করছে ; এ এমন উষ্ণ প্রবাহ যে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। কিন্তু যতই আমি দূরে মঞ্চের সামনের দিকে এগোলাম, কী সেখানে দাঁড়িয়ে তা দেখলাম। তা এক জীবন্ত শরীর। সবচেয়ে লক্ষণীয় বিষয় হল তার দৃঢ় স্থিরতা। মানুষকে চোখে দেখার যে প্রচলিত আকৃতি - সূত্র তাকে মানছে না এই অবয়ব ; তাই তার দিকে এগোই বা তার থেকে সরে আসি, তার আকারের কোনও পরিবর্তন হয় না ; এবং সর্বতোভাবে জীবনের অন্যান্য রূপের মতো না হয়ে তার ছিল পরিপূর্ণ দৃষ্টি। 

তার শরীরের কোনও অংশই কোনওরূপ প্রক্রিয়ার মাঝ দিয়ে যাচ্ছিল না। জীবিত বস্তুর যে সব সাধারণ লক্ষণ থাকে তেমন কোনও বিভ্রান্তি বা আলোড়ন - এই দেহরেখায় দেখতে পেলাম না ; আর এটাও তার সৌন্দর্যের রীতি। পুরো মাথাতেই যেন চোখ বসানো, চোখের নিচের হাড় অব্দি প্রসারিত। মাথার পিছনে দুটি মাংসল পাখনা যা মাঝেমধ্যে ভাঁজ করে চোখের ওপর এনে ফেলছে, দুঃসহ তপ্ত নকশা বানাচ্ছে যেন। গলা বলতে কিছু নেই। আর একজোড়া পাখনা, বাঁকানো, শক্তপোক্ত - কাঁধের নিচ থেকে বেরিয়েছে। তৃতীয় জোড়া পায়ের ডিম থেকে - গোটা শরীরটাকে তুলে ধরে রেখেছে যেন। পায়ের পাতা এতটাই দুর্বল মনে হল যা এই বিশাল বপু-ভার কিছুতেই সহ্য করতে পারবে না।

আফ্রিকায় বসবাসকারী ইউরোপিয়রা অদ্ভুত কিছু দেখলেই অসংযত ঢঙে দক্ষিণ আফ্রিকায় চালু ফানাগোলা জাতীয় মিশ্র অশুদ্ধ ভাষায় কথা বলে। ক্রেমার চিৎকার করে ' হাম্বা ' বললে তার মানে দাঁড়ায় ' চলে যাও '। ' তোমার চেঁচামেচি থামিয়ে মঞ্চ থেকে নেমে যাও ', শান্তভাবে বলে ওঠে জ্যান্ত শরীর। ' তুমি কোন নচ্ছার হে? ', প্রচণ্ড উত্তাপে হাঁসফাঁস করতে করতে ক্রেমার জানতে চায়। উত্তর আসে, ' ওই যে স্বর্গে থাকে, এক উচ্চশ্রেণির দেবদূত ; এটুকুই জেনে রাখো। ' ' ওসব অন্য কাউকে বোলো, ' হাঁফাতে হাঁফাতে ক্রেমার বলে। ' আমাকে কি বোকাসোকা ঠেকছে? ' ' আমি করব। না, আর কোনও সেরাফ নয়, ' এই সেরাফ বলল। সেরাফের থেকে নির্গত তাপ সেখানে ছড়িয়ে পড়ছিল। ক্রেমারের মুখের রং - সাজ গলে গিয়ে চোখে ঢুকছিল আর সে জালের পোশাকে তা মুছে নিচ্ছিল। পেছনের দিকে খানিক কম উত্তপ্ত জায়গায় সরে গিয়ে সে চেঁচিয়ে বলল, ' মাত্র একবারের জন্য। ' ' ঠিকই তাই, ' সেরাফ বলল। ' এই প্রযোজনা আমার, ' ক্রেমার বলেই চলল। ' কবে থেকে? ', সেরাফ জানতে চাইল। ' শুরু থেকেই', ক্রেমার তার দিকে শ্বাস ছেড়ে বলল। ' ঠিক আছে, এটা কিন্তু শুরু থেকেই আমার শো, এবং শুরুটাই সবার আগে শুরু হয়েছিল। ' ক্রেমার এবার উত্তপ্ত মঞ্চ থেকে নেমে এসে সেরাফের পোশাক চেপে ধরে নখ দিয়ে ছিঁড়ে ফেলল। তারপর বলল, ' শোনো তুমি যে আসল সেরাফ সে ব্যাপারে কোনও অস্বাভাবিকতা আমি উপলব্ধি করতে পারছি না।' ' তাই!,' সেরাফ বলল। 

এরমধ্যে তাপপ্রবাহ আমাকে সামনের প্রবেশপথে ঠেলে দিয়েছে। সেখানে ক্রেমারকে দেখতে পেলাম। বেশ কিছু স্থানীয় লোকজনও জড়ো হয়েছিল। দর্শকরা গাড়ি করে আসতে শুরু করেছে আর বাকি অভিনেতারা বাড়িটার পেছনের দিক থেকে ঘুরে এল। সেরাফ - নির্গত তাপ - তীব্রতায় বাড়িটার ভেতরে বেশিদূর দেখা যাচ্ছিল না। সেখানে ঢোকাও যাচ্ছে না। ক্রেমার দরজার কাছ থেকেই সেরাফকে তার বাগাড়ম্বর শুনিয়ে যাচ্ছে আর নতুন আগন্তুকদের মধ্যে ফাটকা জাতীয় অনুমান চলছে যে এই উদ্ভুত সমস্যা কোন পরিচিত শ্রেণির মধ্যে পড়বে -- স্থানীয় বাসিন্দা, ব্রিটিশ সরকারের নীতি নাকি চিতাবাঘ। 

' এটা আমার স্টেজ ', ক্রেমার চেঁচিয়ে বলল, ' আর এই মানুষগুলি আমার শো দেখার জন্য পয়সা দিয়ে টিকিট কেটেছে। ওরা একটি মুখোশনাটক দেখতে এসেছে।' ' যদি তাই হয়, সেরাফ বলে উঠল, আমি থেমে যাব আর ওরা এসে মুখোশনাটক দেখুক। ' আমার মুখোশনাটক,' ক্রেমার মনে করিয়ে দিল। ' ওহো না, এটা আমার, ' সেরাফ বলল। ' তোমারটা হবে না। তুমি কি এখান থেকে যাবে না আমি পুলিশ ডাকব? ', চরম অবস্থায় গিয়ে ক্রেমার বলল। ' আমার কাছে বিকল্প কিছু নেই, ' চরমতর ঢঙে এ কথা বলল সেরাফ। 

এরমধ্যেই চাউর হয়ে গেল যে গ্যারাজে একটা পাগলা চিতা ঘোরাঘুরি করছে। দর্শক যারা এসেছিল তারা তাদের গাড়ি নিরাপদ দূরত্বে রাখতে চলে গেল ; তামাক - চাষিরা চলল বন্দুক আনতে। 

একদল যুবা অভিনেতার মাথায় এল পেট্রল ঢেলে চিতাটাকে অন্ধ করে দেবে আর সেইমতো তারা দল বেঁধে কাজ করার জন্য কিছু স্থানীয় লোককে বলল পাম্প থেকে টিনের ক্যানে পেট্রল ভরে গ্যারাজ অব্দি লাইন দিয়ে আনতে। ' এটা ওকে এক জায়গায় দাঁড় করিয়ে দেবে', এক অভিনেতা বলল। ' ঠিকই বলেছ, তাই করো ', দরজার পাশ থেকে ক্রেমার বলল। ' আমি সেটা করব না, সেরাফ বলল, এতে সব আগুন ধরে যাবে। ' প্রথম দফার পেট্রল যা ছোড়া হল তা গরম হলকায় পড়ে দাউদাউ জ্বলে উঠল। বসার সিটগুলিতে প্রথম আগুন লাগল, তারপর সেই আগুনপাট বাতাস ধাতব দেওয়ালের ভেতরটা পুড়িয়ে দিল যতক্ষণ না ভেতরের পুরোটা আগুনের শিখায় শিখায় দগ্ধ হয়। ঠিক তখনই আর একদল অভিনেতা গাড়ি ভর্তি হয়ে এল আর খুব তাড়াতাড়ি স্থানীয় লোকজন নিয়ে পেট্রল ক্যানে জল ভরে আনল। আস্তে আস্তে তারা আগুন নিভিয়ে দিল। 

ফ্যানফার্লো উঁচু রাস্তায় তার দেবদূতরূপী অভিনেতাদের জড়ো করল। সে তাদের মা - বাবাকে নিশ্চিত করতে চেষ্টা করছিল আর লক্ষ রাখছিল একই সময়ে কী সব ঘটে যাচ্ছে, সেই দিকে। আবার নাচের অনুষ্ঠানটি না করতে পারার জন্য রেগে কাঁই হচ্ছিল। শক্ত একটা কিছু দিয়ে সে এক অভিনেতার পেছনে খোঁচা দিতে উদ্যত হল যার মা বাবা ইংল্যান্ডে থাকে। আগুন নিভে যাওয়ার কয়েক ঘন্টা আগের ব্যাপার এটা। যখন কর্গেট টিনের দেওয়ালগুলি ধিকিধিকি জ্বলছিল, বেঁকেচুরে গুটিয়ে যাচ্ছিল তখন সেরাফের কী হল, দেখা যাচ্ছিল না ; আবার আগুনের হলকা বন্ধ হলে সেখানে এতটাই অন্ধকার আর তাপ ছড়িয়ে পড়ল যে ধ্বংসাবশেষের গভীরে দেখা দুষ্কর হচ্ছিল। ' তোমার বীমা করা আছে? ', ক্রেমারের এক বন্ধু তাকে জিজ্ঞেস করল। ' হ্যাঁ আছে ', ক্রেমার বলল, ' আমার প্রতিটি জিনিসই বীমাকৃত, একমাত্র যেখানে ঈশ্বরের হাত আছে সেইসব ছাড়া - যেমন বজ্রপাত বা বন্যা।' ' ওর সবই বীমার অন্তর্ভুক্ত ', ক্রেমারের এই বন্ধুটি অপর এক বন্ধুকে জানাল। অনেকেই বাড়ি চলে গেছে, বাকিরাও যাচ্ছে। অভিনেতারা ' গুড কিং ওয়েনসেসলাস ' - বড়দিনের এই গান গাইতে গাইতে চলে গেল আর প্রচারক ছেলেরা ' গুড ক্রিশ্চিয়ান মেন রিজয়িস ' ক্যারলটি গাইতে গাইতে নিচু রাস্তাপানে দৌড়ে চলে গেল। 

তখন মাঝরাত আর তখনও প্রচণ্ড তাপ বইছে। তামাক চাষিরা গাড়ি চালিয়ে জলপ্রপাতের দিকে যেতে প্রস্তাব দিল যেখানে খানিক ঠান্ডা হাওয়া মিলবে। ক্রেমার আর ফ্যানফার্লো আমাদের সঙ্গে যোগ দিল। আমরা ক্রেমারের ওখান থেকে প্রধান সড়ক অব্দি খেবড়ো পথে লাফাতে লাফাতে চললাম। সেখানে দুদিকের গাড়ি-চাকা মাপে রাস্তায় আলকাতরা মাখানো নুড়ি ফেলা। আমরা জলপ্রপাতে পৌঁছনোর দু মাইল আগে থেকেই তার গর্জন শুনতে পেলাম। 

' এই মুখোশনাটক আর অন্য সব কাজ করার পর...'। এভাবে ক্রেমার বলতে গেলে ফ্যানফার্লো বাধা দিয়ে উঠল, ' ওঃ,চুপ করো। ' ঠিক তখনই গাড়ির হেডলাইটের তীব্র আলোয় আমি আবার সেই সেরাফকে দেখতে পেলাম, ঘণ্টায় প্রায় সত্তর মাইল বেগে চলেছে এবং তার ছটি পাখনার দুটি দিয়ে খুব দ্রুত টারম্যাক পথটা আঁচড়ে তুলে নিচ্ছে আর দুটি পাখনা ভাঁজ করে মুখ ঢেকে নিয়েছে, বাকি দুটি দিয়ে পা। ' ওই যে সে ', ক্রেমার বলে উঠল, ' ওকে ধরতে হবে। ' হোটেলের কাছে গাড়ি রেখে বৃষ্টি বনাঞ্চলের গভীর জঙ্গলের পথ ধরে আমরা এগোতে লাগলাম সেই দিকে যেখানে জলপ্রপাতের অবিরল ধারাপাত হচ্ছে। এ যেন জ্বরজ্বালা থেকে উঠে স্বাস্থ্য ফিরে পাওয়া, প্রচণ্ড গরমের পর পলকা বৃষ্টি। 

সেরাফ আমাদের থেকে অনেকটা এগিয়ে এবং গাছপালার ফাঁক দিয়ে সেই জায়গাটা দেখলাম যেখানে তার দেহনির্গত উত্তাপ ছড়ানো জলকে বাষ্পে পরিণত করছে। আমরা উঁচু পাহাড়ের কিনারে এলাম যেখানে আমাদের উল্টোদিকে আর একই উচ্চতা থেকে নদীর পুরো চাপ প্রবল ঝঙ্কারে গিরিসংকটের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। সেখানে সেরাফের কোনও চিহ্ন দেখা গেল না। সে কি অতল গহ্বরে কোথাও... অথবা কোথায়! তারপর লক্ষ করলাম জলপ্রপাতের চূড়ার পুরো এক মাইল জুড়ে ধাবমান জলরাশি স্বাভাবিক উচ্চতার চাইতে খানিক বেশি উঁচুতে। এটাকেই সেরাফের দেহ -তাপে তৈরি বাষ্প বলে আমার মনে হয়েছিল। আমি ঠিকই ভেবেছিলাম কেননা এই মুহূর্তে গ্রীষ্মের বজ্রপাতের ক্ষীণ ঝলকানিতে আমরা তাকে দেখলাম জাম্বেসি নদীর পিঠে চেপে উড়ে গেল -- কুমিরের মতো খেবড়ো - পাহাড়ের মাঝে বা খেবড়ো পাহাড়ের মতো দেখতে কুমিরদের ভেতরে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ