অনুবাদ : রঞ্জনা ব্যানার্জী
মূল- Birds by Bruno Schulz
লেখক পরিচিতি : পোলিশ ভাষার বিখ্যাত লেখক, শিল্পী, সাহিত্য সমালোচক, শিক্ষক শিক্ষক ব্রুনো শুলজের জন্ম ১৮৯২ সালে। মৃত্যু ১৯৪২ সালে। তাঁর জন্ম ও মৃত্যু বর্তমান ইউক্রেইনে। এটা এক সময় পোলান্ড রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত ছিল। তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস : Sanatorium Under the Sign of the Hourglass, The Street of Crocodiles aka Cinnamon Shops আধুনিকতা, পরাবাস্তবতা ও জাদুবাস্তবতা তাঁর গল্প উপন্যাসের বৈশিষ্ট্য। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলারের গেস্টাপো বাহিনী তাকে গুলি করে মেরে ফেলে।
----------------------------------------------------------------------------
শীতের সেই ম্যাড়ম্যাড়ে দুপুরগুলো আবার ফিরে এসেছিল। কোথাও কোথাও তুষারের ছেঁড়াখোঁড়া আবরণ অতি ব্যবহারে জীর্ণ টেবিলক্লথের মতই মরচে-রঙা মাটির গা আঁকড়ে ছিল। আবার কোনো কোনো বাড়ির ছাদে তাও ছিলনা ফলত কালো কিংবা খয়েরি, খড়ের কী কাঠের, ঝুলকালির ছোপ মাখা তিনকোণা চিলেকোঠাগুলোর বিস্তীর্ণ ছাউনি, কয়লা-কালো ক্যাথেড্রালের কড়িবর্গা- সবকিছু শলার মত তিরতির কাঁপতো – যেন ওরা শীতের-হাওয়ার ক্ষয়া কালো ফুসফুস! প্রতিটি ভোরের চাদর সরিয়ে সার বেঁধে নতুন চিমনীর চুড়ো জেগে উঠতো, মনে হ’ত চিমনি নয় ওরা রাতের হিমেল হাওয়ার উড়ে আসা কোনো শয়তানের বাদ্যযন্ত্রের কালো নল যেন!
চিমনী পরিস্কারকের দল কালো কাকগুলোর হাত থেকে কোনোভাবেই নিস্তার পেতো না। প্রতি বিকেলে চার্চের আশেপাশের গাছগুলোর কালচে পাতাভর্তি শাখায় ওরা জড়ো হ’ত এবং ক্ষণে ক্ষণে ডানা ঝাপটে উড়াল দিত, আবার ফিরে এসে নিজনিজ নির্দিষ্ট শাখাতেই গেঁড়ে বসতো ফের উড়বার প্রতিক্ষায়। সন্ধ্যা নামলেই বিশাল ঝাঁক বেঁধে উড়ে যেত ওরা। তখন ওদের দেখতে ঝুলকালির দমকা স্রোত কিংবা উড়ন্ত ময়লার পাতের মত মনে হ’ত – আকাশে চমৎকার ঢেউ তুলে, অবিরাম কা-কা রবে, শেষ বিকেলের হলদে রশ্মিকে আড়াল করে উড়ে যেত ওরা।
দিনগুলো ক্রমশ ঠাণ্ডা এবং একঘেয়েমিতে ভরা গতবছরের ছাতা পড়া পাউরুটির মত জমে যাচ্ছিল। খিধে নেই তাও ভোঁতা ছুরির টানে সেই বাসি পাউরুটি কাটার মতই নির্লিপ্ততা নিয়ে এইসব দিনও গড়িয়ে যাচ্ছিল।
বাবা এইসময় বাড়ির বাইরে বেরুনো বন্ধ করে দিয়েছিলেন। উনুনগুলো জড়ো করে, উজানো আগুনের রহস্যময় শিখাকে একমনে পাঠ করতেন তিনি। চিমনীর গলার কাছে চকচকে ঝুল-চাটা শীতার্ত স্যালামান্ডারদের নোনতা, ধাতব স্বাদ এবং ধোঁয়াটে গন্ধের অভিজ্ঞানও নিতেন যেন। এছাড়া তিনি এই সময় ঘরগুলোর উঁচু অংশের ছোটোখাটো সারাইয়ের কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখতে পছন্দ করতেন। দিনের প্রায় সকল প্রহরেই তাঁকে মইয়ের উঁচু ধাপ থেকে ঝুঁকে সিলিঙের নিচে, লম্বা জানালাগুলোর কার্ণিশে, ঝোলানো বাতিগুলোর ভর কিংবা শেকলের কাছে একমনে কাজ করতে দেখা যেত। রঙ মিস্ত্রিদের রীতি মেনে ভাঁজ করা মইটার উঁচু দুই ধাপে পা রেখে, রণপায়ে দাঁড়ানোর ভঙ্গিতে তিনি তাঁর ‘পাখির চোখে দেখা’ অবস্থানটি থেকে সিলিঙের গায়ে আঁকা আকাশ, পাখি, ফুলের ছবি বেশ খুশিমনে উপভোগ করতেন।
নিত্যদিনের কেজো দায় থেকে তিনি নিজেকে ক্রমশ গুটিয়ে নিচ্ছিলেন। মা তাঁর এই নির্লিপ্ততায় একইসঙ্গে অসুখী এবং উদ্বিগ্ন ছিলেন। ব্যবসার হালহকিকত কিংবা মাসান্তের বিভিণ্ণ দায় পরিশোধের বিষয়ে মা তাঁর সঙ্গে আলাপ করতে গেলে, তিনি অন্যমনস্কভাবে শুনতেন; তাঁর উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি জুড়ে একধরণের দুশ্চিন্তার আভাস ছুঁয়ে থাকত। মাঝেমধ্যে তিনি হাত উঁচু করে সতর্ক করার ভঙ্গিতে মাকে থামিয়ে দিয়েই ঘরের কোনো কোণ লক্ষ্য করে ছুটে যেতেন। তারপরে মেঝের ফাটলগুলোর একটাতে কান পেতে দুই হাতের তর্জনী উঁচুতে তুলে তাঁর অনুসন্ধানের গুরুত্ব বোঝাতেন এবং গভীর মনোযোগ দিয়ে কিছু শুনতেন। সেই সময় আমরা কেউই বুঝতে পারিনি যে এইসব পাগলপনার উৎসে আছে অন্য কোনো চরম জটিলতা, যা তাঁর ভেতরে সকলের অগোচরে ধীরে ধীরে জমাট বাঁধছিল।
বাবার ওপর মায়ের কোনো নিয়ন্ত্রণই ছিল না বরং অ্যাডেলাকে তিনি বেশ সমীহ করতেন। অ্যাডেলার ঘর পরিষ্কার করার সময়টি তাঁর কাছে বিশেষ উৎসবের মতই গুরুত্বপূর্ণ ছিল।এই সময় তাঁর সশরীরে উপস্থিত থাকার বিষয়টি তিনি নিশ্চিত করতেন এবং দ্বিধা ও পুলকের এক মিশেল উত্তেজনায় অ্যাডেলার প্রতিটি গতিবিধি প্রত্যক্ষ করতেন। অ্যাডেলার সকল কাজের পেছনেই কোনো না কোনো গভীর প্রতিকী অর্থ খুঁজে বার করতেন তিনি। সতেজ উদ্ধত ভঙ্গিমায় এই মেয়েটি যখন তার লম্বা- হাতলযুক্ত ঝাড়ু মেঝে বরাবর ঠেলে এগোতো, সেই দৃশ্য বাবা যেন সইতে পারতেন না। এই সময় তাঁর চোখ বেয়ে দরদর করে জল গড়াতো, এক নীরব হাসি তাঁর ঠোঁট ছাপিয়ে মুখের আদল পাল্টে দিত এবং অদ্ভুত এক শিহরণে সারা শরীরে খিঁচুনি তুলে কাঁপতেন তিনি।
সুড়সুড়িতে বাবার প্রচণ্ড প্রতিক্রিয়া হ’ত। অ্যাডেলা আঙুল বাঁকা করে সুড়সুড়ি দেওয়ার ভঙ্গি করলেই বাবা প্রবল ত্রাসে এঘর থেকে ওঘরে দরজা ফাটিয়ে ছুটতেন যেন! শেষমেশ দূরতম কক্ষটির বিছানায় সটান শুয়ে পড়তেন এবং অদ্ভুতভাবে শরীর মুচড়ে হাসতে হাসতে কাহিল হয়ে যেতেন; মনে হ’ত অদৃশ্য সেই আঙুল তখনও তাঁর শরীর জুড়ে কাতুকুতু দিয়ে চলেছে। এই একটি কারণেও বাবার উপর অ্যাডেলার অসীম প্রভাব ছিল।
ঠিক এই সময়টাতেই বাবার প্রগাঢ় পশুপ্রেমের বিষয়টিও আমাদের সর্বপ্রথম নজরে আসে। শুরুতে একজন শিকারী এবং শিল্পীর দ্বৈতসত্ত্বার মিশ্র আবেগ মিশেছিল এই প্রেমে। কিংবা এটি হয়তোবা আরও গভীর কিছু - স্বজাতির প্রতি পারস্পরিক সহানুভূতিকে অন্য প্রজাতিতে বিস্তৃত করা কিংবা প্রাণের অন্য কোনো রূপের অনাবিস্কৃত শাখা নিয়ে নিরীক্ষার অংশও হতে পারে। যাইই হোক না কেন, শেষদিকে এই নিরীক্ষা এক অস্বস্তিকর, জটিল এবং অবশ্যই পাপপূর্ণ অস্বাভাবিক পরিণতির দিকে মোড় নিয়েছিল যা দিনের আলোতে উন্মোচিত না হওয়াই হয়তোবা উত্তম ছিল।
কিন্তু এর সবই শুরু হয়েছিল পাখির ডিম থেকে ছানা ফোটানোর মত নির্দোষ ঘটনা দিয়ে।
প্রচুর অর্থ ব্যয় এবং কসরত করে বাবা হামবার্গ বা হল্যান্ড কিংবা আফ্রিকার প্রাণিবিদ্যা বিষয়ক কেন্দ্রগুলো থেকে নানা ধরনের পাখির ডিম সংগ্রহ করতেন এবং এই ডিম থেকে ছানা ফোটানোর জন্যে তিনি বেলজিয়ামের অতিকায় তা-দেওয়া মুরগিদের নিয়োজিত করেছিলেন। প্রচলিত নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে এই যে বিভিণ্ণ বর্ণের এবং আকারের ছানা জন্মানোর পদ্ধতি, সেটি আমাকেও চমৎকৃত করতো। আসলেই ব্যাপারটা বেশ রোমাঞ্চকর ছিল। এইসব অদ্ভুতদর্শন প্রাণী যারা জন্মের পরপরই লোভাতুর হিসহিস শব্দ তুলে তাদের চমৎকার ঠোটজোড়ার আদি-অন্ত বিভাজনে গলার পেছনের সীমান্ত দেখিয়ে দিচ্ছে, সেই তাদের এই গিরগিটি সদৃশ নাজুক,নগ্ন, কুঁজো দেহগুলির আড়ালেই লুকিয়ে আছে ভবিষ্যতের ময়ূর, রঙিন-পাখি, বুনোহাঁস কিংবা শকুন। বাবা যখন তাঁর তুলোট সবুজ এ্যাপ্রোন গায়ে শেল্ফগুলির ধার ঘেঁষে হাঁটতেন, মনে হ’ত তিনি যেন কোনো উষ্ণ ক্যাক্টাস ঘরের মালি, যিনি শূন্য থেকে যাদুবলে এইসব অন্ধবুদবুদ সৃষ্টি করেছেন যাদের ভেতরে ধুকপুক ছন্দে প্রাণ জেগে আছে। যাদের বহিঃজগতের সঙ্গে সংযোগ ঘটছে কেবল অক্ষম উদরে খাদ্য সরবরাহের মাধ্যমে অথচ তারা এই আ-ফোটা চোখে অজ্ঞানের আঁধার নিয়ে আলোর উৎসের দিকে বেয়ে ওঠার অদম্য চেষ্টা চালাচ্ছে। কয়েক সপ্তাহ পরেই এইসব অন্ধকলি সদৃশ পদার্থ পাপড়ি মেলার মতই ফুটতো এবং তখনই এই নীরব ঘরটি তার নয়া আবাসীদের উতরোল কলরবে সরব হ’ত। সারা ঘর জুড়ে এই পাখিরা বিরাজ করতো- পর্দার সুদৃশ্য দাঁড়ে, আলমারির চালের মাথায়, ঝুলন্ত বাতিগুলোর ধাতব অবলম্বন বা প্যাঁচানো তারের শাখা আঁকড়ে ওরা জুত করে বসতো।
বাবা যখন তাঁর বিশাল ‘পক্ষীবিজ্ঞান’ বইগুলোর পাতায় নাক ডুবিয়ে ওদের রঙের ধরন নিয়ে অধ্যয়নে মগ্ন তখন মনে হ’ত রঙিন পালকের অবয়বগুলি যেন বইয়ের পাতা ছেড়ে নেমে এসেছে! আগুন-লালের ছটা, নীলকান্তমণির নীল, মরচে-সবুজ এবং রূপার সরু ফালি ঘরময় থইথই করছে। ওদের খাওয়ার সময়টাতে মেঝের দিকে তাকালে মনে হ’ত যেন ঢেউ খেলানো বহুবর্ণা মখমলি চাদর। নতুর কারো আগমনে সেই জীবন্ত কার্পেটের অপূর্ব রঙের সুতো ছিঁড়ে যেত। কিছুক্ষণ পরে টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়তো মেঝের সবখানে; তারপরে হাওয়ায় উড়তো, অবশেষে সিলিঙের কাছাকাছি উঁচু কোথাও থিতু হ’ত ওরা।
আমার একটা শকুনের কথা বিশেষভাবে মনে আছে। বিরাট দেহ, পালকবিহীন সরু গলা আর গিঁট খাওয়া কুঁচকানো মুখ ছিল ওর। বৌদ্ধ লামাদের মত ওর আচরণেও এক ধরণের স্থির সম্ভ্রান্ত ছটা ছিল যা দেখে মনে হ’ত সে এই মহান সম্প্রদায়ের নীতিরীতি মানা নিষ্ঠ ব্রহ্মচারী। শকুনটি যখন বাবার পাশে মিশরীয় শাশ্বত বিগ্রহের মত নিশ্চল বসে থাকতো তখন ওর দুই চোখের সাদা ছানিসদৃশ পর্দা পাশ থেকে টেনে মণি দুটোর উপর ঝাঁপ টেনে দিতো যেন তার একাকীত্বকে সে এই জগৎ-সংসার থেকে আগলে রাখছে। তখন তার এই প্রস্তরসদৃশ কঠিন মুখের দিকে তাকিয়ে ওকে পাখি নয়, বাবার জ্যেষ্ঠ সহোদর বলে ভ্রম হ’ত!
ওদের দুজনের শরীর এবং মাংসপেশীও যেন একই উপাদানে তৈরি ছিল; বাবার মতই ওরও শক্ত, কুঁচকানো চামড়া। তেমনই শুষ্ক অস্থিসার মুখ; গভীর, কামুক অক্ষিকোটর। এমনকি ওদের হাতের গড়নেও অদ্ভুত মিল ছিল! বাবার মতই ওরও শক্তপোক্ত অস্থিসন্ধি। বাবার পুরুষ্টু দীর্ঘ হাতের গোলাকার নখের ধারালো অংশটুকু যেন ওর তীক্ষ্ণ নখরে জুড়ে ছিল। ঘুমন্ত অবস্থায় ওর দিকে তাকালে একটা অদ্ভুত অনুভূতি আমাকে চেপে ধরতো। মনে হ’ত আমি যেন বাবার কৃশকায় মমির পাশে দাঁড়িয়ে আছি! যদিও আমরা কখনই এ নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলাপ করিনি তাও আমার বিশ্বাস মাও এই মিলের বিষয়টি লক্ষ্য করেছিলেন। তবে এটি উল্লেখ্য যে শকুনটা আমার বাবার পায়খানা ব্যবহার করতো।
ডিম ফুটে বেরুনো পাখিদের মধ্যে নতুন প্রজাতির সংখ্যা না বাড়াতে বাবা বেশ অসন্তুষ্ট ছিলেন এবং এর সমাধানকল্পে চিলেকোঠায় বিভিণ্ণ প্রজাতির পাখিদের মধ্যে বিয়ের আয়োজন করা শুরু করেছিলেন। চিলেকোঠার বাইরেও ঘটকালী চালু করার উদ্দেশ্যে আকর্ষণীয়া এবং উৎসুক কনে-পাখিদের তিনি চালের নিচের বিভিণ্ণ গর্ত এবং ফোকরে আঁটকে রাখতেন। কিছুদিনের মধ্যেই আমাদের বিশাল দোচালা ঢেউ খেলানো টালির ছাদ সত্যিকার অর্থেই পাখিদের নিবাস হয়ে উঠেছিল, যেন ছাদ নয় ‘নোয়ার নৌকো’ তাই দূর-দূরান্ত থেকে পালকযুক্ত সকল প্রাণীরা উড়ে আসছে এখানে।
তাঁর এই পাখিদের স্বর্গরাজ্য নির্মাণের প্রকল্পটি ব্যর্থ হয়েছিল তবে পাখিসমাজে আমাদের ছাদে আসার রেওয়াজটি বেশ অনেকদিন চালু ছিল; বিশেষত বসন্তকালে সারস, প্যালিকান, ময়ূর এবং নানাবিধ অতিথি পাখিদের ভিড় লেগে থাকতো এখানে। অবশ্য এই সমারোহও এক বিশাদময় ঘটনার দিকে মোড় নিয়েই শেষ হয়েছিল।
একটা সময়ে বাবাকে আমাদের ওপরতলার ঘর দুটো, যা গুদামঘর হিসেবে ব্যবহৃত হ’ত, সেইখানে স্থানান্তর করা জরুরী হয়ে পড়ে। তা সত্ত্বেও ভোর না হতেই পাখিদের তীক্ষ্ণ ধাতব কোলাহল আমরা নিচ থেকে শুনতে পেতাম। আসলে চিলেকোঠার কাঠের দেওয়াল এবং ত্রিকোণো চালের ফাঁকা অবস্থানটির কারণে এই আওয়াজের জোরালো অনুরণন হ’ত। ওদের চিৎকার চেঁচামেচি, ডানার হুটোপুটি, হাঁকডাক, বাকবাকুম, মিলনের শিৎকার সবই বেশ জোরেশোরেই আমাদের কানে পৌঁছাতো। সেইসময় বাবা কয়েক সপ্তাহ নিজেকে আমাদের দৃষ্টিসীমার আড়ালে রেখেছিলেন। কদাচিৎ তিনি নিচে নামতেন এবং প্রতিবারই আমরা লক্ষ্য করতাম তাঁকে গতবারের চেয়ে কৃশকায় এবং রুগ্ন দেখাচ্ছে। মাঝে মাঝে তিনি যেন নিজেকেই ভুলে বসতেন। অন্যমনস্কতায় আচমকা চেয়ার ছেড়ে টেবিলের ওপরে দাঁড়িয়ে যেতেন। দুই বাহু মেলে ডানার মত দোলাতেন এবং পাখির গলায় দীর্ঘ একটানা গভীর ডাক পাড়তেন। তাঁর চোখজোড়া তখন ঘোলাটে দেখাতো। খানিক পরেই নিজেই বিব্রত হতেন এবং আমাদের সঙ্গে হাসিঠাট্টায় মেতে পুরো ব্যাপারটিকে কৌতুক হিসেবে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতেন।
একদিন বসন্তকালীন ঝাড়পোঁছের সময়ে হঠাৎ করেই অ্যাডেলা উপরতলার সেই পাখির সাম্রাজ্যে পৌঁছে গিয়েছিল। ঘরের ভেতরের উৎকট গন্ধ, মেঝে, টেবিল, চেয়ার সবখানে উপচে পড়ছে পাখির বর্জ্য - অতর্কিতে এই ভয়াবহ দৃশ্য, চোকাঠের ওপারে দাঁড়ানো অ্যাডেলাকে কিছুক্ষণের জন্যে যেন কিংকর্তব্যবিমুঢ় করে দিয়েছিল। পরক্ষণেই ও সকল দ্বিধা ঝেড়ে ঘরের ভেতরের জানালার পাল্লা ঝট করে খুলে দিয়েছিল এবং ওর হাতের ঝাড়ুর লম্বা হাতলের খোঁচায় পাখিদের বিশাল স্তুপে এক লহমায় প্রাণ এনে দিয়েছিল। এই অতর্কিত হামলায় পালক, ডানা ঝড়ো মেঘের মত দিগ্বিদিক উড়ছিল; সেই সঙ্গে হুল্লোড় এবং চেঁচামেচি! সব মিলিয়ে সে এক নারকীয় তাণ্ডব যেন। এ্যাডেলাকে দেখে মনে হচ্ছিলো তীক্ষ্ণ শলাকার ঘুর্ণি তুলে, ধ্বংসের উন্মত্ততায় নৃত্যরত গ্রীকদেবী থিরমাস।আতঙ্কগ্রস্ত বাবা তাঁর দুই হাত প্রসারিত করে প্রাণপণে নিজেকে সেই পালকের ঝাঁকের সঙ্গে ভাসিয়ে উড়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন। পালকের সেই ঝড়ো মেঘেরা পাতলা হতে হতে একসময় অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল এবং শেষে কেবল রণক্লান্ত এ্যাডেলা একাই দাঁড়িয়ে হাঁপাচ্ছিল ঠিক তার পাশে আমার পর্যুদস্ত বাবা সম্পূর্ণ হার মানার অভিব্যক্তি মুখে ঝুলিয়ে অসহায় দাঁড়িয়ে ছিলেন ।
খানিক পরে বাবা নিচে নেমে এসেছিলেন। তবে তিনি তখন আর বাবা নন, এক বিধ্বস্ত মানুষ, এক নির্বাসিত রাজা, যিনি সিংহাসন এবং রাজ্য দুই’ই খুইয়ে ফেলেছেন।
অনুবাদক
রঞ্জনা ব্যানার্জী
কথাসাহিত্যিক। অনুবাদক।
কানাডাপ্রবাসী।
অনুবাদক
রঞ্জনা ব্যানার্জী
কথাসাহিত্যিক। অনুবাদক।
কানাডাপ্রবাসী।
3 মন্তব্যসমূহ
গল্পের বাবা যেন অদ্ভুত এক পক্ষিমানব। মানুষের কত বিচিত্র শখ কিংবা নেশা থাকে- তারই শিল্পীত এক রূপ দেখলাম আমরা এই গল্পে। অনুসন্ধিৎসায় তিনি বিজ্ঞানীর মতো নিবিষ্ট, কিন্তু খামখেয়ালিপনায় প্রায় উন্মাদ। সব মিলিয়ে অত্যন্ত আকর্ষণীয় চরিত্র। তাই কী হয় কী হয় করতে করতে শেষ পর্যন্ত না পড়ে পাঠকের উপায় থাকে না- সাবলিল অনুবাদ এর বড় কারণ বলে আমার মনে হয়। অনুবাদককে অসংখ্য ধন্যবাদ।
উত্তরমুছুনআপ্লুত
মুছুনআপ্লুত
উত্তরমুছুন