এদুয়ারদো গালেয়ানো'এর দশটি অনুগল্প


মূল স্প্যানিস ভাষা থেকে অনুবাদ : জয়া চৌধুরী 

লেখক পরিচিতি
উরুগুয়ের প্রখ্যাত সাংবাদিক, কথাসাহিত্যিক  এদুয়ার্দো গালেয়ানো জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে। তাঁর বিখ্যাত বইয়ের নাম--Las venas abiertas de América Latina and Memoria del fuego। ২০১৫ খ্রিস্টাবে তিনি মারা যান।



১. বিপদ

শ্রীমতি ‘ভা’-এর পা দুটি নগ্ন। 
শ্রীমতি ‘লো’ হলেন ঢেঁকিকল বা দোলনা। তিনি স্বর্গ ও নরকের মধ্যে ক্রমাগত চলাচল করেন। 
শ্রীমতি ‘বা’ এক বদ্ধ বৃত্ত। তিনি তোমার গলা চেপে দম আটকে রাখেন। 
শ্রীমতি ‘সা’ অসভ্যের মতন গর্ভবতী। 

--- ভালো বাসার সবকটা অক্ষরই বিপজ্জনক বলে পরীক্ষা করে দেখেছে রোমি দিয়াজ পেরেরা। সব
অক্ষরগুলো যখন মুখ দিয়ে বের হয় মেয়েটা তখন শূন্যে তার ছবি আঁকা দেখে। 


২. গরীবি

সংখ্যাতত্ত্ব বলে দুনিয়ায় অনেক গরীব আছে। 
কিন্তু বাস্তবে তার সংখ্যা আরও অনেক বেশি। 

অল্পবয়সী গবেষক কাতালিনা আলভারেস ইনসুয়া এটি গোণার জন্য বেশ কার্যকরী একটি ফরমূলা বের করেছিল। সে বলেছিল- “গরীব হল তারা যারা দোর বন্ধ করে রাখে।” 

যখন এই কথাটা সে বলেছিল তখন তার বয়স ছিল তিন। সেটাই তো দুনিয়াকে উঁকি দিয়ে দেখবার ও তাকে পর্যবেক্ষণ করার সবচেয়ে সঠিক বয়স। 
বিপদ

৩.  শরীরের ওপরের জানালা 

গির্জা বলে- শরীর হল পাপ। 
বিজ্ঞান বলে- শরীর হল যন্ত্র। 
বিজ্ঞাপন বলে- শরীর হল বাণিজ্য। 

শরীর বলে- আমি এক উৎসব। 


৪.আয়না

রোদে পুড়ছে সূর্য। রাত যে ছায়াটা ফেলে রেখে গিয়েছিল তার বাকী ছায়াটা বয়ে নিয়ে যাচ্ছে সে। প্রতিটি দরজা নোংরা, ঘোড়ার গাড়ি জড় হয়েছে তার সামনে, বাতাসে কফ কাশি মাখা ঢিবির মত মাকড়সা ঝুলছে। 

মেলোড্রামার রাস্তা দিয়ে হাঁটছে পেরেক। লোকজন তাকে গ্রামে পাগল বলেই ভাবে । হাতে একটা আয়না ধরা আর বুক ঢিপ ঢিপ করা ভয় নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে সে। আয়না থেকে চোখ সরাচ্ছে না। 

-- কি করছিস পেরেক? 

শত্রুদের নিয়ন্ত্রণ করতে করতে সে বলল- এখানেই আছি। 


৫. খেলোয়াড় 

সেটা ৬৭ সালের কোন এক রবিবার ছিল। এক ধ্রুপদী রবিবার । সান্তা ফে ক্লাব চ্যাম্পিয়নশিপ ম্যাচটা নিশ্চিত করল এল মিওনারিও-র বিরুদ্ধে। বোগোতার গোটা শহরটা চৌমাথায় এসে জড় হল। স্টেডিয়ামের বাইরে এমন কেউ ছিল না যারা চিৎকার ও মারামারি শুনে প্যারালিটিক বা অন্ধ হয়ে যায় নি। 

ম্যাচটা ড্র হয়ে শেষ হচ্ছিল। ম্যাচের অষ্ট আশি মিনিটে এল সান্তাফের খেলোয়াড় ওমার লোরেন্সো দেভান্নি বক্সের মধ্যে পড়ে যায়। রেফারি পেনাল্টির বাঁশি বাজান। দেভান্নি উঠে দাঁড়ায়, হতচকিত। ওটা আসলে একটা ভুল ছিল। কেউ তাকে স্পর্শ করে নি। সে নিজেই পড়ে গিয়েছিল কারণ তার গোড়ালি মুচকে গেছিল। 

সান্তাফের খেলোয়াড়েরা গোলপোষ্ট পর্যন্ত এগিয়ে যায়। তেকাঠির মধ্যে ফাঁসিকাঠ, পুরোহিত গোলকিপার সামনে দাঁড়িয়ে গোল পাহারা দিচ্ছে, গোটা স্টেডিয়াম গর্জে উঠছে, গোলকিপার নিচু হয়ে দাঁড়াল। 

তারপর সাদা পেনাল্টি বিন্দুতে বল বসাল দেভান্নি, বলে বুক ভরা দম নিয়ে প্রাণপণে লাথি মারল অনেক বাইরে। বহু দূরে 


 ৬. পৃথিবী

কলম্বিয়ার সমুদ্রতীরে নেগুয়া বলে এক মফঃস্বল এলাকার একটা লোক ওই উঁচু আকাশে চড়তে পেরেছিল। 

ফেরার সময় সে গল্প করেছিল। বলেছিল যে- সেই উঁচু থেকে নিচের দিকে, মানুষের দিকে চেয়ে, জীবনের দিকে চেয়ে তার দর্শন হয়েছিল। আগুনের একটা ছোট্ট সমুদ্রের ওপর সে দর্শন। 

বাদবাকি মানুষগুলোর মাঝখানে প্রত্যেকটা মানুষ তার নিজের আলোয় ঝলমল করত। কোন দুটো উনুন একরকম ছিল না। বড় আগুন ছিল আবার বাচ্চা আগুনও ছিল, সবকটা রঙের আগুনই ছিল। পবিত্র অগ্নি পুরুষ ছিলেন যিনি ঝড় সম্বন্ধে কিছুই জানতেন না। আর পাগল অগ্নিপুরুষ এর মধ্যে বাতাস থাকত, আর সেজন্যই চারদিকে ফুলকি ছড়িয়ে দিতেন। 

কিছু কিছু আগুন ছিল বাতুল আগুন, ঝলমলও করত না, পুড়তও না। কিন্তু অন্যেরা জীবনটাকে এমন জয়ের সঙ্গে পোড়াত যে চোখ পিটপিট না করে কেউ সেগুলোর দিকে তাকাতে পারত না। যে কাছে এগিয়ে আসত সেই পুড়ে মরত। 
  

৭.  সৃষ্টি

মেয়েটা আর ছেলেটা স্বপ্ন দেখছিল যে ঈশ্বর স্বপ্ন দেখছেন। স্বপ্ন দেখতে দেখতে তিনি গান গাইছিলেন আর ঝুমঝুমি নাড়াচ্ছিলেন। তামাকের ধোঁয়ায় ঢেকে নিজেকে বেশ সুখী সুখী লাগছিল ওঁর তবে একটু সন্দেহ আর রহস্যও নাড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছিল ওঁকে। 

মাকিরিতারে উপজাতির লোকেরা ( ভেনেজুয়েলার আদিম অধিবাসী) জানে ভগবান যদি খাবারের স্বপ্ন দেখেন তাহলে গাছে প্রচুর ফল হয় আর তিনি তা খেতেও দেন। ভগবান যদি জীবনের স্বপ্ন দেখেন তাহলে বাচ্চাকাচ্চার জন্ম হয়। 

মেয়েটা আর ছেলেটা স্বপ্ন দেখছিল যে ভগবানের স্বপ্নে একটা বিশাল চকচকে ডিম আবির্ভূত হল। ডিমটার ভেতরে ওরা নাচছিল, গাইছিল আর সশস্ত্র গোলমাল করচ্ছিল। কারণ জন্মাবার জন্য ওরা পাগল হয়ে উঠেছিল। ওরা স্বপ্ন দেখছিল যে ঈশ্বর লোকটার স্বপ্নে সন্দেহ আর রহস্যের চেয়ে আনন্দের শক্তি বেশি ছিল; আর তিনি স্বপ্ন দেখতে দেখতে সৃষ্টি করছিলেন। সেসময় গান গাইতে গাইতে বলছিলেন- 

এই ডিম ভেঙে ফেললাম। নারী জন্মাল। পুরুষ জন্মাল। ওরা দুজনে এজসঙ্গে জন্মাবে ও মরবে। কিন্তু নতুন করে ফের জন্মাবে, আবার ওরা মারা যাবে। জন্ম নেবে ফের একবার। কখনো জন্ম নেওয়া ছাড়বে না। কারণ মৃত্যু তো মিথ্যা। 


৮.আগমন 

পিলার আর দালিয়েল ওয়েনবারগের ছেলে সি সাইড ড্রাইভে দীক্ষিত হয়েছিল। আর দীক্ষা নেবার সময় ওরা তাকে শিখিয়েছিল পবিত্র কিছু বাণী। 

সে একটি শঙ্খ পেয়েছিল- 
তুমি যাতে জলকে ভালবাসতে শেখো সেইজন্য বন্দী পাখির খাঁচা খুলে দিয়েছিল - 
- তুমি যাতে বাতাসকে ভালবাসতে শেখো সেইজন্য জেরেনিয়াম ফুল দিয়েছিল তারা। 
তুমি যাতে পৃথিবীকে ভালবাসতে শেখো আর তোমাকে একটা বন্ধ বোতল দিয়েছিল 

ওটা খুলো না কখনো, যাতে তুমি রহস্যকে ভালবাসতে শেখো। 
  

৯.  রঙ 

পাখিদের ডানার পালকগুলো ছিল সাদা রঙের, পশুদের চামড়ার রঙও ছিল সাদা। 

নীল রঙেরা হল এখন তারাই কেউ যারা হ্রদে স্নান করেছিল যেখানে কোনো নদীর মুখই খোলা ছিল না। কোন নদী জন্মই নেয় নি। 


লাল রঙেরা হল তারা, যারা উত্থিত হয়েছিল কাদিউয়েউ উপজাতির একটা বাচ্চা ছেলে হুড়মুড় করে পড়ে যে রক্তের হ্রদ বানিয়েছিল সেখান থেকেই। তাদের গায়ের চামড়া ছিল মাটি রঙের যারা কাদায় গড়াগড়ি খেয়েছিল। যারা নেভানো উনুনের ভেতরে উষ্ণতা খুঁজেছিল ছাইয়ের লোকেরা ছিল তারাই । সবুজ রঙেরা হল তারা যারা গাছের পাতায় গায়ে নিজেদের গা ঘষেছিল, আর সাদা রঙেরা হল ওই ওরা যারা শান্ত হয়ে থেকেছিল। 


১০. বাচ্চারা

দিনের পরে দিন বাচ্চাদের বাচ্চা হওয়ার অধিকার অস্বীকার করা হয়। ওই আইনের কর্মসূচী গুলোকে ঠাট্টা করা হয়। রোজকার জীবনে ওদের অভিজ্ঞতা ভাগ করে ওরা। দুনিয়া ধনী শিশুদের সঙ্গে এমন ব্যবহার করে যাতে তারা নিজেরাই অর্থবিশেষ। যাতে তারা নিজেরাই অর্থের মত ব্যবহার করে। দুনিয়া গরীব শিশুদের সঙ্গে এমন আচরণ করে যেন তারা নোংরা বিশেষ। আর যারা মাঝামাঝি, যারা ধনীও না গরীবও না তাদের আবার পা আটকানো টেলিভিশন সেট এর সঙ্গে, যাতে তারা খুব ছোট বয়স থেকে এটাকে তাদের নিয়তি বলে ভাবে। বন্দী জীবন তাদের। যারা শিশু হয়ে শিশু থাকতে পারে তাদের জীবনে প্রচুর জাদু প্রচুর সৌভাগ্য ঝরে পড়ে।




অনুবাদক পরিচিতি
জয়া চৌধুরী
অনুবাদক, গল্পকার।
কোলকাতায় থাকেন। স্প্যানিস ভাষার শিক্ষক। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2 মন্তব্যসমূহ