অনুবাদ : এলহাম হোসেন
[নাদিন গোর্ডিমার (১৯২৩-২০১৪) দক্ষিণ আফ্রিকার অত্যন্ত প্রভাবশালী লেখিকা। সাহিত্যে নোবেল পান ১৯৯১ সালে। বুকার পেয়েছেন ১৯৭৪ সালে। দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবৈষম্য, রাজনৈতিক শোষণ-নিপীড়ন, মনস্তাত্বিক টানাপোড়েন, প্রেম ও রাজনীতি তাঁর লেখার বিষয়বস্তু। বর্ণবৈষম্যের বিরূদ্ধে সংগ্রাম করেছেন আজীবন। আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসে যোগ দিয়েছেন লেখকের দায়বদ্ধতার তাগিদে। নেলসন মান্ডেলার সাথে রাজনীতি করেছেন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। সারা জীবন লিখেছেন মানুষের কল্যাণার্থে। নিম্নোক্ত গল্পটি তাঁর 'Country Lovers’’ গল্পের বঙ্গানুবাদ।]

খামারের বাচ্চারা যখন ছোট থাকে, তখন ওরা একসঙ্গে খেলাধুলা করে। কিন্তু শ্বেতকায় বাচ্চারা স্কুলে যাওয়া শুরু করা মাত্রই ওরা আর একসঙ্গে খেলাধুলা করে না। ছুটির দিনগুলোতেও না। যদিও কৃষ্ণাঙ্গ বাচ্চারা একটু-আধটু লেখাপড়ার সুযোগ পায়, কিন্তু প্রতি বছরই তাদের গ্রেড কমতে থাকে। সেগুলোতে আবার শ্বেতকায় বাচ্চারা উৎড়ে যায়। শিশুতোষ শব্দভাণ্ডার যেমন, বাঁধ, ছোট ছোট পাহাড়, ভুট্টার ক্ষেত, চারণভূমি ইত্যাদিকে সাদা বাচ্চারা বোর্ডিং স্কুল ও আন্ত:স্কুেলর খেলাধুলা এবং সিনেমায় অভিযানের কাহিনী দেখে দেখে শিখে ফেলে। এই প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো বার বা তের বছর বয়সের মধ্যেই তারা ধরে ফেলে। এই সময়ের মধ্যে কৃষ্ণাঙ্গ বাচ্চারা শুধু গায়ে-গতরেই বাড়ে আর তাদের পুরাতন খেলার সঙ্গীদের ‘মিসাস’ বা ‘ছোট মালিক’ বলে সম্বোধন করতে শেখে।
সমস্যাটা হলো, পলাস আইসেনডিক কেন জানি বোঝেই না যে, থিবেদী খামারের অনেক বাচ্চাদের মধ্যে এমন একজন গ্রাম্যমেয়ে যাকে তার বোনের পুরাতন পোশাক পরিহিত অবস্থায় ভালই দেখায়। তার বোর্ডিং স্কুলের শুরুর দিনগুলোতে সে থিবেদীর জন্য তার কাঠের কাজের ক্লাসে তৈরি করা আল্পনা আঁকা কাঠের বাক্স আনত। গোপনে এনে দিত, কারণ ওই খামারের অন্য কাউকে কিছু দেওয়ার জন্য তার কাছে কিছইু ছিল না। স্কুলে যাওয়ার পূর্বে সেও তাকে সরু ধুসর পিতলের তার ও তার বাবার ক্ষেতের ধুসর সাদা রেড়ি বীজ দিয়ে তৈরি করা ব্রেসলেট উপহার দিতো। (যখন তারা একসঙ্গে খেলতো, তখন সে পলাসকে খেলনা জোয়ালে লাগানোর জন্য কাদা দিয়ে খেলনা ষাঁড় তৈরি করতে শিখিয়ে দেয়।) প্লেটল্যান্ডের শহরগুলোর মতই স্কুলের বাচ্চাদের মধ্যেও ঘড়ির ফিতার পাশাপাশি হাতির লোমের ব্রেসলেট পড়ার উন্মাদনা ছিল। বন্ধুরা তার উপহারের প্রশংসা করে নিজেদের জন্যও একটা করে চাইতো। সে বলতো, তার বাবার খামারের স্থানীয় কর্মচারীরা এটি তৈরি করে। সে চেষ্টা করবে তাদের দেওয়ার জন্য।
তার বয়স যখন ষোল, তখনই সে ছয় ফুট লম্বা, চারপাশ দাঁপিয়ে বেড়ায়, আর ‘সিস্টার’ স্কুলের মেয়েদের সঙ্গে নর্দন-কুর্দন করে কাটায়। সেই বয়সেই সে তার বাপের বয়সী ধনাঢ্য কৃষকদের মেয়েদের উত্যক্ত করতে শিখে ফেলল। ফষ্টিনষ্টি করার কৌশলও রপ্ত করে ফেলল। যেদিন সে তার বাবা-মার সঙ্গে এক বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়েছিল, সেদিন এক মেয়ের সঙ্গে তার মোলাকাত হলো। মেয়েটা তাকে একটা বন্ধ ঘরে তার সঙ্গে ফষ্টিনষ্টি করার সুযোগ করে দিলো। প্রেমে পড়লে সচরাচর সবাই এমনটা করে থাকে।
শৈশব অতিক্রম করার পর শহরে গেল। ফেরার সময় সেখান থেকে কৃষ্ণকলি থিবেদীর জন্য লাল প্লাস্টিকের বেল্ট এবং গিলটি করা কানের দুল আনতো। থিবেদি ওর বাবাকে বলতো, কাজের পুরস্কার স্বরূপ গৃহকর্ত্রী ওকে এগুলো দিয়েছে। এ কথা সত্য যে, মাঝে মাঝে কাজের জন্য খামার বাড়িতে ওর ডাক পড়ে। খোঁয়ারের মেয়েদের ও বলেছে, ওর একজন নাগর আছে। কেউ তাকে চেনে না। সে দূরের খামারে থাকে। এ কথা শুনে কেউ কেউ দাঁত খিচিয়ে হাসে, কেউ বা তাকে উত্যক্ত করে, আবার কেউ কেউ প্রশংসাও করে। খামারে নজাবুলো নামে এক ছেলে থাকতো। সে বলতো, তার ইচ্ছা হয় ওকে বেল্ট এবং কানের দুল কিনে দিতে।
যখন কৃষকের ছেলেটা ছুটিতে বাড়ি আসতো, তখন থিবেদী ওর বন্ধু-বান্ধবদের ফাঁকি দিয়ে অনেক দূরে গিয়ে ঘুরে আড্ডা দিত। সে একা হাঁটতে বেরোত, ঘটা করে নয়। যে যার ইচ্ছামতো ঘুরতে বের হতো। দূর থেকেই সে বুঝতে পারতো, ঐতো থিবেদী। থিবেদী জানতো যে, কুকুরটা তাকে দেখে ঘেউ ঘেউ করবে না। দূরে শুকিয়ে যাওয়া নদীবক্ষে যেখানে পাঁচ-ছয় বছর আগেও সে একটা গুইসাপ ধরেছিল, সেখানে তারা এখন পাশাপাশি বসে থাকে। সে তাকে পরিভ্রমকের গল্প শোনায়। স্কুলের গল্প, স্কুলে শাস্তির গল্প । অতিরঞ্জিত করে । স্কুলের প্রতি তার অনিহারও অতিরঞ্জিত কল্পচিত্র আঁকে। ও থিবেদীকে মিডলবার্গ শহরের গল্প শোনায়, যা সে আদতে দেখেইনি। থিবেদির বলার তেমন কিছুই থাকত না, তবে মনোযোগী শ্রোতার মত প্রশ্ন করে যেত। কথা বলার সময় তার আশপাশের ক্ষয়িষ্ণু মাটি থেকে গজে ওঠা আগাছাগুলো হ্যাচকা টানে উপড়ে তুলে মোচড়াতো। জায়গাটা বাচ্চাদের খেলাধুলার জন্য চমৎকার। পঁচা, পিঁপড়ে খাওয়া গাছ থেকে শুরু করে বুনো অ্যাসপ্যারাগাসের ঝোপও আছে গাছের গুঁড়ির ফাঁকে ফাঁকে। বৃদ্ধের রসহীন মুখম-লের মত শুকিয়ে যাওয়া, কুঁকড়ে যাওয়া ক্যাকটাস গাছগুলো আগামী বর্ষার অপেক্ষায় আছে। ও বার বার সুঁচালো কাঠি দিয়ে কাঁটাযুক্ত নাশপাতিটাতে খোঁচাতো আর গল্প শুনতো। পলাস যা বলতো তাতেই ও হাসতো। মাঝে মাঝে দুই হাঁটুর মাঝখানে মাথা নুয়ে পড়তো। তখন সে খালি পায়ের নিচে ভেজা সোদা মাটির সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগি করতো। যখন ও খামারে থাকতো, তখন ধুলো থেকে পা দুটোকে রক্ষা করার জন্য একজোড়া সাদা সেন্ডেল পড়তো। তবে নদীর ধারে বেড়ানোর সময় স্যান্ডেলগুলো খুলে রাখতো।
গ্রীষ্মের খুব তপ্ত দুপুরে যখন নদীতে জলের ধারা বইতো, তখন ও শৈশবের মতোই কোমর পর্যন্ত গভীর জলে নেমে হাটতো। তার আগে পোশাক ভাঁজ করে আলতোভাবে প্যান্টের মধ্যে ঢুকাতো। যেসব স্কুল পড়–য়া মেয়ের সঙ্গে সে জলাধারে বা পুলে সাঁতার কাটতে যেত তারা বিকিনি পড়তো। কিন্তু তাদের পেট ও উরুর চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্য তখন তার মনে তেমন অনুভূতি জাগাতো না, যেমনটা এখন করে। যখন থিবেদী তীরে এসে ওর পাশে বসতো তখন ওর পায়ের পেছনের দিকে জমে থাকা বিন্দু বিন্দু জল থেকে মাটির ঘ্রাণ আসতো। ওরা একে অপরের মধ্যে কোন সংকোচ ছিল না। সবসময়ই ওরা একে অপরকে বুঝতো। স্টোররুমের গোপন অভিসারের সময় সে ওর সঙ্গে আগে যা করতো, এখনও তাই করে। তবে এখন এটা বেশ জমে। সে অবাক হয়। থিবেদীও এতে অবাক হয়। সে তার কৃষ্ণ মুখম-লে প্রশান্তির ছায়া দেখে, ডাগর কালো চোখে মৃদু জলের ঝলক দেখে। সে ওকে মনোযোগ দিয়ে পরখ করে। যখন ওরা কাঁদার তৈরি ষাঁড়গুলো গাদাগাদি করে রাখে, তখন সে ওকে স্কুলের সপ্তাহান্তের শাস্তির গল্প বলে।
গ্রীষ্মের ছুটির দিনগুলোতে ওরা নদীর ধারে বেড়াতে যেত। দিনের আলো নিভে যাওয়ার ঠিক প্রাক্কালে ওদের সাক্ষাত হতো। আর রাত নামলে বাড়ি ফিরত। থিবেদী ফিরে আসতো তার মায়ের কুঠিরে আর ও ফিরত খামার বাড়িতে রাতের খাবারের সময়। পলাস আর ওকে স্কুল বা শহর সম্বন্ধে কিছু বলতো না। সেও আর প্রশ্ন করতো না। আগে সে প্রত্যেকবার দেখা হলেই তাকে গল্প শোনাতো। দুই-একবার খুব সকালে চড়াতে নিয়ে যাওয়া গরুগুলোর হাম্মা হাম্মা ডাক ওদের বিরক্ত করতো, আলাদা করে দিত। না বলা কথার স্বীকৃতি স্বরূপ ওরা খুব ঘনিষ্ঠভাবে একে অপরের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতো।
পলাস স্কুলে জনপ্রিয় ছিল। প্রথমে দ্বিতীয়, পরে প্রথম সারির ফুটবল টিমের সদস্য ছিল ও। ‘সিস্টার’ স্কুলের প্রধান মেয়েটা তার প্রেমে পড়েছিল। কিন্তু সে ওকে বিশেষ একটা পাত্তা দিত না। তবে কালো ফিতে দিয়ে বাঁধা তার উজ্জ্বল, দীর্ঘ চুল যেমনটা শনিবারের বিকেলের সিনেমায় দেখে, সে বেশ পছন্দ করতো। দশ বছর বয়স থেকে ও ট্রাক্টর ও খামারের অন্যান্য গাড়ি চালাতে পারতো। আঠার বছর বয়সে ড্রাইভিং লাইসেন্সও পেয়ে গেছে। গত বছর ওর স্কুল জীবনের শেষ ছুটির দিনগুলোতে খামার থেকে বিশ কিলোমিটার দূরে সিনেমা দেখতে এবং নর্দন-কুর্দন করতে মেয়েদের গাড়িতে করে নিয়ে গিয়েছিল। ততোদিনে তার বোনদের বিয়ে-শাদী শেষ। সপ্তাহান্তে মেয়েদের এবং নাতি-নাতনিদের দেখতে যাওয়ার সময় তার বাবা-মা খামারের ভার তার ওপর দিয়ে যেত।
শনিবার বিকেলে থিবেদী যখন কৃষক ও তার স্ত্রীকে গাড়ি চালিয়ে যেতে দেখল, তখন তাদের মার্সিডিসের পেছনের অংশ সদ্য জবাই করা হাঁস-মুরগি ও শাক-সবজিতে ভরা ছিল। সে জানত এটি তার বাবার কাজেরই অংশ। সে এও জানত যে, তার নদীর ধারে আসার দরকার নেই। বরং বাড়িতেই থাকতে হবে। বাড়িটা পুরাতন। আর দেয়ালগুলো তাপসহনীয় করার জন্য পুরু করে বানানো হয়েছে। রান্নাঘরটা সব সময় সরগরম থাকে। চাকর-বাকর, খাদ্যসম্ভার, ভবঘুরে কুকুর, বিড়াল, চুলোর ওপর ফুটতে থাকা পাতিল, ইস্ত্রি করার জন্য স্তুপ করে রাখা কাপড়-চোপড়, শহর থেকে গৃহকর্ত্রী কর্তৃক আনা ডিপফ্রিজ, তেলাপোকা আকৃষ্টকারী সোলোমী আর প্লাস্টিকের পাত্র গিজ গিজ করছে এখানে। কিন্তু নাদুস-নুদুস পা যুক্ত ডাইনিং টেবিলটাসহ ডাইনিং রুমটাতে বিদঘুঁটে বাসি স্যুপ আর টমেটো সসের গুমোট গন্ধে দম বন্ধ হয়ে আসে। বৈঠকখানার পর্দাটা নামানো, আর টিভিটাও বন্ধ। বাবা-মার ঘরে তালা, আর যে ঘরে মেয়েরা ঘুমিয়েছিল তার বিছানায় প্লাস্টিকের আলোয়ান পাতা। সে যে প্লাস্টিকের আলোয়ানের ওপর কৃষকের ছেলের সঙ্গে সারারাত কাটিয়েছিল, এটি সেগুলোর একটি। বাড়ির যেসব চাকর-বাকর তাকে চেনে, তারা এসে পড়ার আগেই ভোরে তাকে কেটে পড়তে হবে। সে তার বিছানায় সময় কাটিয়েছে-- এটি জেনে ফেললে ঝামেলা আছে। বিষয়টা বেশ কয়েকবার খতিয়ে দেখে স্কুলের স্পোর্টসে জেতা সিলভারের কাপগুলোর সারির পেছন দিয়ে কেটে পড়লো।
যখন থিবেদীর বয়স আঠার আর কৃষকের ছেলের বয়স উনিশ, তখনো সে ভেটেনারী কলেজে ঢোকেনি। কাজ করত তার বাবার সঙ্গেই। সে-সময় তরুণ নজাবুলো তার বাবার কাছে থিবেদীকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। তার বাবা-মা মেয়ের বাবা-মার সঙ্গে দেখা করে দেনমোহরের ব্যাপারটা ঠিক করে গরুর পরিবর্তে টাকা দিয়ে। সে-সময়ের প্রথা এটা । ছেলের বাবাকে মেয়ের বাবা-মাকে টাকা দিতে হতো। তার কোনো গরু ছিল না। সে আইসেন্ডার ফার্মে গতর খাটাতো। তার বাবার মতোই। প্রতিভাবান তরুণ। কীভাবে ইট গাঁথতে হয় তা বুড়ো আইসেন্ডিক তাকে শিখিয়েছিল। আশপাশের ছোটখাটো নির্মাণ কাজেও তাকে সে লাগিয়েছিল। থিবেদী পলাসকে বলেনি যে, তার বাবা-মা তার বিয়ে ঠিক করেছে। ভেটেনারী কলেজে প্রথম সাময়িকীর জন্য গ্রাম ছাড়ার পূর্বেও সে তাকে বলেনি যে, তার সন্তান জন্ম নিতে চলেছে। নজাবুলোর সঙ্গে বিয়ের দুই মাসের মাথায় সে একটি কন্যা সন্তানের জন্ম দেয়। ওদের আচারের মধ্যে বিয়ের আগে গর্ভবতী হওয়া এবং বিয়ের পরেই সন্তান জন্ম দেয়া অসম্মানের কিছু নয়, এতে বরং মেয়েটির সন্তান ধারণের সক্ষমতারই পরীক্ষা হয়। নজাবুলো এরপরও তাকে ভালোবাসে। কিন্তু বাচ্চাটি দেখতে শীর্ণ এবং দ্রুতই সে অন্যান্য আফ্রিকী বাচ্চা-কাচ্চার মতো কৃষ্ণাঙ্গ হয়ে উঠছিলো না। জন্মের সময়ই এর মাথায় ছিল সোজা সোজা ফেঁসোর মতো চুল। এগুলো যেন উষর মরুভূমিতে কিছু বীজের অস্তিত্বের জানান দিচ্ছিল যা পরে আগাছায় রূপ নেবে। অনাকর্ষণীয় চোখ দুটো ধুসর হলুদাভ। নজাবুলোর গায়ের রং অনুজ্জ্বল, অসচ্ছ এবং কফির মতো। একে সবসময় কালোই বলা হয়। বিন্দু বিন্দু জলের ফোটা জমে থাকা থিবেদীর পায়ের রংও ঝিনুকের খোলের মতো নীল। থিবেদীর মুখমণ্ডলের রংও একই। সেখানে সাদার মধ্যে ডাগর কালো চোখ সব কিছুকে হার মানায়।
নজাবুলো কোনো অভিযোগ করে না। খামারের কাজের মজুরি দিয়ে সে ভারতীয় দোকান থেকে আর্দ্রতা নিরোধক কাগজে মোড়ানো প্যাকেটে গোলাপী প্লাস্টিকের বাথটাব, ছয়টা ন্যাপকিন, একগুচ্ছ সেফটিপিন, সেলাই করা জ্যাকেট, টুপি, পশমের জুতা, এক সেট পোশাক আর জনসন বেবী পাউডার কিনেছে থিবেদীর সন্তানের জন্য।
দুই সপ্তাহ পর পলাস আইসেন্ডিক ছুটি কাটাতে ভেটেনারী কলেজ থেকে ফিরে আসে। মায়ের হাতের শৈশবের স্মৃতি মাখা এক গ্লাস টাটকা দুধ খায়। বাড়ির গৃহকর্মীর সঙ্গে মায়ের কথোপকোথনে জানতে পাওে যে, থিবেদীর সন্তান হয়েছে এবং ওর জায়গায় অন্য কারো কথা উনি ভাবছেন।
শৈশব থেকে এই প্রথম সে ওদের বাড়িতে আসলো। তখন বেলা ১১টা। লোকজন কাজে লেগে পড়েছে। তড়িঘড়ি করে সে তার চারপাশটা দেখে নিলো। মহিলারাও মুখ ফিরিয়ে নিলো। কেউ বলতে চাইলো না থিবেদী কোথায়, নজাবুলো পশ্চিমা ধাঁচের টিনের চিমনি ও কাঁচের জানালা বিশিষ্ট যে বাড়ি বানিয়েছে, তার ভেতর থেকে থিবেদী ধীর পায়ে বেরিয়ে এলো। বাড়ির দেয়ালগুলো কাঁচা ইটের তৈরি। বাবা-মার উপস্থিতিতে যেমন দু’হাত একত্রিত করে সম্মান প্রদর্শনে সে অভ্যস্ত, ঠিক সেভাবেই সে ওকে অভিবাদন জানালো। দরজার চৌকাঠের সামনে মাথা নুইয়ে পলাস ভেতরে প্রবেশ করলো। সে বললো, ‘আমি দেখতে চাই। দেখাও।’
আলোতে এসে ওর মুখোমুখি দাঁড়ানোর আগেই সে পীঠ থেকে বোঝাটা নামিয়ে রাখল। একপাশে নজাবুলোর চেক কম্বল বিছানো লোহার বিছানা, আরেক পাশে ছোট্ট কাঠের টেবিল। ওখানে খাবার-দাবারের পাত্রের মাঝে একটি গোলাপী প্লাস্টিকের মাদুর পাতা। এই দুয়ের মাঝখানে মুদির জিনিসপত্র রাখার আরামদায়ক কম্বলের তৈরি থলে থেকে বের করে গাটরিটা হাতে নিয়ে দাঁড়ালো থিবেদী। বাচ্চাটা ঘুমিয়ে ছিল। মুখে থুথুর বুদবুদ নিয়ে সে তার বন্ধ, মলিন, নধর ছোট মুখটা বের করলো। মাকড়শার মতো গোলাপী হাতগুলো নড়ছিল। পশমের তৈরি টুপিটা খুললো। আর ঘর্ষ বিদ্যুতের ধর্মানুযায়ী তার চুলগুলো সোজা দাঁড়িয়ে গেলো। এখানে সেখানে সোনালী কেশগুচ্ছ দৃশ্যমান হলো। সে কিছুই বললো না। ছোটবেলায় যেভাবে তাকাতো এবার সে সেভাবেই তার দিকে তাকালো। ছোটবেলায় বাচ্চাকাচ্চার দল খেলার সময় ক্ষেতের ফসল পদদলিত করে নষ্ট করলে তাদের মধ্যে শ্বেতকায় ও কৃষকের ছেলে হিসেবে সে-ই ক্ষেতের মালিকের সঙ্গে মধ্যস্থতা করতো। এক আঙ্গুল দিয়ে গালে আঁচড় কেটে ও সুড়সুড়ি দিয়ে তার ঘুম জড়ানো মুখে বিরক্ত করতো থিবেদী। ধীরে ধীরে চোখ খুলে দেখতো কিছুই নেই। তারপর আবার ঘুম। আবার জেগে উঠতো। এবার আর চোখ ছোট করে নয়, তার ধুসর হলুদাভ চোখে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থাকতো।
অশ্রু, ক্রোধ ও করুণার সঙ্গে তার যুদ্ধ চললো। থিবেদী তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিতে পারলো না। বললো, ‘তুমি ওকে বাড়িতে আনোনি?’
থিবেদী মাথা নাড়লো।
‘কখনই না?’
আবার সে মাথা নাড়লো।
‘ওকে বের করবে না। ভেতরেই রাখ। তুমি ওকে অন্য কোথাও নিয়ে যেতে পার না? অবশ্যই অন্য কাউকে দিয়ে দাও—”
থিবেদী তার সঙ্গে দরজা পর্যন্ত গেল।
সে বলল, ‘আমি দেখছি, কী করা যায়। আমি জানি না।’
তারপর বললো, ‘মনে হচ্ছে, আত্মহত্যা করে ফেলি।’
থিবেদীর চোখ জ্বলজ্বল করে উঠলো। অশ্রুতে দৃষ্টি গাঢ় হয়ে উঠলো। মুহূর্তের জন্য সেই অতীতের অনুভূতি ফিরে আসলো যা ওরা উপভোগ করতো নদীর পাড়ে ঘুরে বেড়ানার সময়।
ও বেরিয়ে গেল।
দুইদিন পর। যখন ওর বাপ-মা একদিনের জন্য খামারের বাইরে গেল, তখন সে আবার এসে হাজির। গ্রীষ্মের সময় মহিলারা সাধারণত জমি নিড়ানোর জন্য ক্ষেতেই থাকে। শুধু বৃদ্ধরা কুঁড়েঘরের বাইরে মাছি আর রোদের মধ্যে বসে থাকে। থিবেদী তাকে ভেতরে আসতে বলেনি। বাচ্চার স্বাস্থ্যও ভালো যাচ্ছিল না। ওর ডায়রিয়া হয়েছিল। সে জানতে চাইলো, ওর খাবার কোথায়। সে বলল, ‘বাচ্চা আমার বুকের দুধই খায়।’ সে নজাবুলোর বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করলো। যেখানে বাচ্চাটা শুয়ে ছিল, ঠিক সেখানে। থিবেদী তার পেছন পেছন গেল না। দরজার বাইরেই দাঁড়িয়ে রইলো। এক বৃদ্ধার দিকে তাকিয়ে রইলো। বৃদ্ধা আত্মভোলা হয়ে নিজে নিজে বিড় বিড় করছে আর হাস-মুরগিগুলোর সঙ্গে ঘ্যানর ঘ্যানর করছে। আর ওগুলো বুড়িটাকে পাত্তাই দিচ্ছে না।
তার মনে হলো, ঘরের মধ্যে ঘোঁত ঘোঁত শব্দ শুনলো। ভাবলো, বাচ্চাটা পেটভরে খেয়ে ঘোঁত ঘোঁত শব্দ করে ঘুমাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর, কতক্ষণ হবে তা সে জানে না, পলাস ঘর থেকে বেরিয়ে এসে তার বাড়ির দিকে ধীর পদক্ষেপে চলে গেল।
রাতের বেলা বাচ্চাটাকে কিছুই খাওয়ানো হয়নি। যদিও সে নজাবুলোকে বার বার বলেছে যে, বাচ্চাটা ঘুমোচ্ছে, তবুও সকালবেলা নজাবুলো নিজের চোখেই দেখলো, বাচ্চাটা আর বেঁচে নেই।
সে তাকে বলে-কয়ে, আলিঙ্গন করে সান্ত¦না দিলো। থিবেদী কাঁদলো না। শুধুই দরজার কাছে বসে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। মরা মুরগির বাচ্চার পাগুলোর মতই তার হাতগুলো হিম-ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছিল।
কৃষকরা শ্রমিকদের যে নিষ্পাদপ তৃণভূমি দিয়েছে কবরস্থান হিসেবে ব্যবহার করার জন্য, সেখানেই নজাবুলো বাচ্চাটাকে কবর দেয়। কিছু মাটির পি- রাখা হলো কবরটাকে চিহ্নিত করার জন্য। কিছু রাখা হলো পাথরগুলো ঢেকে দেয়ার জন্য, আর কাঠের টুকরো দিয়ে একটা ক্রস বানিয়ে দেয়া হলো। কিন্তু ক্রস পুঁতে দেয়ার আগেই পুলিশ এসে হাজির। ওরা কবর খুঁড়ে বাচ্চাটার মৃতদেহ নিয়ে চলে গেল। কোনো একজন শ্রমিক বা কোনো একজন মহিলা পুলিশের কাছে অভিযোগ করেছে যে, বাচ্চাটা সূস্থই ছিল, কিন্তু ওই কৃষকের ছেলে আসার পরই হঠাৎ করে বাচ্চাটা মারা যায়। প্যাথলজির পরীক্ষায় দেখা গেল, বাচ্চার মৃত্যুর কারণ হলো তার নাড়ী-ভুড়ির ক্ষতিসাধন, যা স্বাভাবিক মৃত্যুর ক্ষেত্রে হওয়ার কথা নয়।
পলাস যে শহরের স্কুলে পড়তো থিবেদী সেখানে প্রথমবারের মতো গেল। পলাসের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ গঠনের প্রস্তুতি চলছে তাতে সাক্ষ্য দিতে। সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে উম্মত্তভাবে কেঁদে-কেটে সে বললো, হ্যাঁ হ্যাঁ (গিল্টি করা দুল কানে ঝুলিয়ে) আমি অভিযুক্তকে বাচ্চাটার মুখে তরল কিছু একটা পুরে দিতে দেখেছি। সে বলেই চললো, ‘কাউকে কিছু বললে সে তাকে গুলি করবে বলে ভয় দেখিয়েছে।’
একই শহরে এক বছরেরও বেশি সময় পর মামলার বিচার কাজ শুরু হলো। এবার সদ্যজাত সন্তান পিঠে নিয়ে থিবেদী আদালতে হাজির হলো। গিল্টি করা কানের দুল পড়েছে সে। শান্ত। বললো, তার বাড়িতে ওই সাদা চামড়ার লোকটা আসলে কী করেছে, তা সে দেখেনি।
পলাস আইসেন্ডিক বললো, সে বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিল বটে কিন্তু বাচ্চাটাকে সে বিষ খাওয়ায়নি। এই দু’জনের মধ্যে যে প্রেম ছিল বা যৌন-সম্পর্ক ছিলো, সে ব্যাপারে মামলার বাদী আর কোনো বাদ-প্রতিবাদ করলো না। ওই বাচ্চাটা যে এই অভিযুক্তের, সে-ব্যাপারে কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণও হাজির করতে পারলো না।
বিচারক অভিযুক্তকে বললেন, তার ব্যাপারে জোরালো সন্দেহ আছে কিন্তু সে যে অপরাধ সংঘটিত করেছে সে-ব্যাপারে যথেষ্ট প্রমাণ নেই। আদালত মেয়েটার সাক্ষ্য নিতে পারে না, কারণ হয় সে বিচার চলাকালে না হয় প্রাথমিক তদন্তকালে মিথ্যা বিবৃতি দিয়েছে। আদালতের মনে হয়েছে, এই অপরাধে তারও সংশ্লিষ্টতা আছে। কিন্তু সেখানেও সাক্ষ্য-প্রমাণ অপর্যাপ্ত।
বিচারক মেয়েটার স্বামীর প্রশংসা করলো (সে রবিবারের জন্য কেনা একটা ধূসর-হলুদাভ টুপি পড়ে আদালতে বসেছিল), কারণ সে তার স্ত্রীকে ত্যাগ করেনি, এমনকি ‘তার সীমিত সামর্থ্যরে মধ্যেই হতভাগ্য বাচ্চাটার জন্য কাপড়-চোপড়ের ব্যবস্থা করেছিল।’
বিবাদীর ব্যাপারে আদালতের রায়, ‘সে নির্দোষ।’
তরুণ শ্বেতকায় যুবক সংবাদকর্মী ও সাধারণ মানুষের তরফ থেকে অভিনন্দন গ্রহণ করলো না। তার মায়ের ওভারকোটে মুখ লুকিয়ে ফটোগ্রাফারদের চোখ ফাঁকি দিয়ে আদালত থেকে বেরিয়ে গেল। তার বাবা সংবাদকর্মীদের বললো, ‘আমি আমার এলাকায় মাথা উঁচু করে চলার চেষ্টা করে যাবো।’
‘সানডে’ পত্রিকা, যা ওর নামের বানান নানানভাবে লেখে, মেয়েটির সাক্ষাৎকার নিলো। ওর ছবির নিচেই ওর উক্তিটি উদ্ধৃত করলো এভাবে--
‘ওটা আমাদের ছেলেবেলার ব্যাপার ছিলো। আমাদের মধ্যে এখন আর দেখা-সাক্ষাৎ নেই।’
0 মন্তব্যসমূহ