মোস্তাক শরীফের গল্প: অপেক্ষা

ছায়া ঘনাচ্ছে। বাড়ির পশ্চিমসীমানার শেষ নারকেল গাছটির মাথার ওপর দিয়ে অপসৃয়মান সূর্যের পশ্চাৎগতির সাথে মিল রেখে, উঠানের কোনা-কানাচকে থোক থোক ধূসরতায় ভরে দিয়ে, এখানে-ওখানে সারাদিন ঘাপটি মেরে থাকা নৈঃশব্দকে আরো প্রগাঢ় ও স্বয়ম্ভু করে ছায়া ক্রমশ ঘনাচ্ছে।


সেই দুপুর থেকে বারান্দায় স্থির হয়ে বসে আছেন নাসিমুল হক; এমনই স্থির যে ভালোমতো ঠাহর না করলে তিনি জেগে আছেন না ঘুমিয়ে, এমনকি বেঁচে আছেন নাকি মরে সেটিও বোঝা কঠিন। যে পত্রিকাটি তাঁর বুকের ওপর আলাগোছে পড়ে আছে সেটিও আজকের নয়, অন্তত এক সপ্তাহের পুরনো। হকার শেষ কবে এসেছে? ঐ এক সপ্তাহই হবে। তারপর একে একে আসা বন্ধ করেছে প্রতিদিন সন্ধ্যায় দাবা খেলতে আসা পাশের বাড়ির বশির, মাঝেমাঝেই জানালায় উঁকি দিয়ে ‘কেমন আছেন চাচা?’ বলে চমকে দেয়া মুহিবুল্লা, রাজনীতি এবং বিবিধ প্রসঙ্গে আড্ডা দিতে আসা প্রতিবেশি জামাল মোল্লা এবং সবশেষে রহিমা ,যার সযত্ন তত্ত্বাবধানে গেল একটা বছর ধরে আছেন তিনি।

আপাতত আর আসবে না, এটা জানানোর জন্য যেদিন শেষবার এল, সম্ভবত তিন কি চারদিন আগে হবে সেটা - বড় কুণ্ঠিত ছিল রহিমা। ‘চাচা মিয়া আপনে তো বুঝতেই আছেন, হগলে খুব ডরাইতাছেন।ঝন্টুর বাপ কইল, এর মইদ্যে বাড়ির বাইর হওনের কাম নাই। আমি বাজারঘাট কইরা দিয়া গেলাম, ফিরিজে রাইন্দা রাইখা গেলাম। ঝামেলা মিটলে আবার আসমু ...’

নাসিমুল হক কিছু মনে করেননি। বহুদিন হলো, মনে করাকরি ব্যাপারটা ছেড়ে দিয়েছেন তিনি। পৃথিবী নামের এই বিশাল গ্রহে বসবাসকারী সমস্ত মানুষের ওপর থেকে দাবি তুলে নিয়েছেন। বেঁচে থাকা নিজের দুই সন্তানের ওপর থেকেও। তাঁর ছেলে, জাহিদ, দীর্ঘদিন ধরে প্রবাসী। ছেলের সঙ্গে কথাবার্তা এত কম হয় যে সে এখন কোন দেশে সেটাও ঠিক মনে নেই নাসিমুল হকের। শেষবার কোত্থেকে যেন ফোন করেছিল? স্পেন? নাকি জার্মানি? ফোন করলেও মিনিটখানেকের বেশি কথা বলে না জাহিদ। যেন প্রচ- তাড়া আছে, একটু দেরি হলেই ভীষণ ক্ষতি হয়ে যাবে। মেয়ে মিলি আছে স্কটল্যান্ডে। ঘর সংসার নিয়ে সে-ও ব্যস্ত খুব, তবু প্রতি মাসে নিয়ম করে একবার ফোন দেয়। দু-তিন মাস পরপর ব্যাংকে টাকাও পাঠায়। ছেলে-মেয়ে দুজন কখনোই অতটা ঘনিষ্ঠ ছিল না তাঁর, মায়ের সঙ্গেই মাখামাখি বেশি ছিল। সাবেরার মৃত্যুর পর, বিশেষ করে ছেলে মেয়ে দুজনেই দেশ ছাড়ার পর বাবার সঙ্গে সম্পর্কের সূত্রটা ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়েছে। মাঝে মাঝে, কোনো ঝিম ধরা দুপুরে উঠানভর্তি ছড়িয়ে থাকা রোদের দিকে তাকিয়ে নাসিমুল হক বোঝার চেষ্টা করেন, অপত্য স্নেহ জিনিসটা আসলে কী। এবং তখন তাঁর মনে পড়ে যায় রাশেদের কথা ,তাঁর প্রথম সন্তান মাত্র চার বছর বয়সে যাকে হারাতে হয়েছিল। ¯্রফে দু-দিনের জ্বর, ডাক্তারও দেখানোর সুযোগ পাননি সেভাবে। তাঁর মনে পড়ে, মৃত সন্তানকে কোলে করে পাথরের মতো বসে থাকা সাবেরার কথা, কী দুঃসহ কষ্টে কেটেছিল তাঁদের দুজনের দিন। সারা দিন, অনেক সময় সারা রাত স্থির হয়ে বসে থাকত সাবেরা। হাজারবার ডাকলেও সাড়া মিলত না। তিনি ভেবেছিলেন আর কখনোই স্বাভাবিক হবে না সাবেরা। তবে রাশেদের মৃত্যুর বছরদুয়েকের মধ্যেই, জামিলের জন্মের পর ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে শুরু করে সাবেরা। তারপর মিলি এলো, একসময় যেন দূরাগত স্বপ্নের মতো মিলিয়ে গেল রাশেদের স্মৃতি। আসলে যায়নি, মনের গহন কোনো কোণে নিরিবিলি অপেক্ষায় ছিল, এখন বয়সের ভারে ন্যুব্জ পিতার ভাবনার অলিন্দ থেকে মাঝেমাঝেই বেরিয়ে আসে, ফোকলা দাঁত বের করে হেসে বলে: বাবা! তারপর আবার মিলিয়ে যায় কোথায় যেন।

মাঝেমধ্যে, মধ্যরাতে অকস্মাৎ ঘুম ভেঙে বা মধ্যদুপুরের নির্জনতায় বহুদিন আগে হারিয়ে ফেলা ছেলের সাথে একা একা কথা বলেন নাসিমুল হক। কখনওবা সেই আলাপচারিতায় যোগ দেয় সাবেরাও। তখন আর সময়গুলো মোটেই পাথরের মতো ভারি ঠেকে না। নাসিমুল হক ঠিক জানেনও না, জীবননদীর ওপারে হারিয়ে যাওয়া স্ত্রী ও সন্তানের সঙ্গে ঠিক কী কথা বলেন তিনি; হয়তো কোনো কথাই বলেন না, কেবল মুখোমুখি বসে থাকেন তিনজন, এবং সময় পেরিয়ে যায়, নৈঃশব্দ্যের আঙরাখায় মোড়া ধূসর সময়।

উঠোনের পশ্চিমপ্রান্ত থেকে একটা ঘুঘু ডাকল। তিনি ঘাড় ঘুরিয়ে পাখিটাকে দেখার চেষ্টা করলেন। মুহূর্তের জন্য চোখেও পড়ল। ফ্যাকাসে লালচে পিঠ, পায়ের পাতা লাল আর নখগুলো বাদামি; সম্ভবত তিলা ঘুঘু বলে এগুলোকে। বহুবার তাঁর বাড়ির আনাচে কানাচে ঘুরতে দেখেছেন পাখিগুলোকে। পাখিটির প্রতি এক ধরনের কৃতজ্ঞতা বোধ করলেন তিনি, তাঁর এই নির্জনবাসের সময়ে অন্য সবার মতো তাঁকে ভুলে যায়নি বলে।

দুপুর পার করে একবার ইজিচেয়ার ছেড়ে উঠেছিলেন নাসিমুল হক। সত্তর পেরিয়ে গেছে বয়স, অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো আর নিয়ন্ত্রণে নেই, সামান্য চলাফেরাতেই ক্লান্তি আসে। যদিও ডায়াবেটিস নেই, পনের-বিশ বছর আগে বাইপাস সার্জারি হয়েছে, একটা মাইল্ড স্ট্রোকও হয়ে গেছে বছরছয়েক আগে। এখনও যে বেঁচে আছেন এটাই ভাগ্য। নাকি দুর্ভাগ্য?

ক্লান্ত শরীরটাকে টেনে রান্নাঘরে গিয়ে ফ্রিজ খুলেছিলেন। অনেকদিন ধরে ঘড়ঘড় শব্দ করছে যন্ত্রটা, কখন বন্ধ হয়ে যায় কে জানে। ফ্রিজ খুলে একটা বাটির মধ্যে খানিকটা করলাভাজি পড়ে থাকতে দেখেছিলেন। চুলায় ভাত চাপানোর কষ্ট করতে ইচ্ছে হয়নি, ফের বারান্দায় গিয়ে বসেছিলেন। কিছুক্ষণ বসে থাকতেই খিদের বোধটা ভোঁতা হয়ে গিয়েছিল। ঘোলা দৃষ্টিতে উঠানের দিকে তাকিয়ে বসে থেকেছিলেন, ঠিক পাথরের মতো, আর ঘুঘুটা কিছুক্ষণ পরপর একঘেয়ে স্বরে ডেকেই যাচ্ছিল।

দিনের আলো ক্রমশ ম্রিয়মান হতে হতে বিকেলের দিকে এগোচ্ছিল। উঠানের শেষ মাথায় একটা টিউবওয়েল; নষ্ট, বহুদিন ধরেই। নাসিমুল হকের চট করে মনে পড়ে গেল টিউবওয়েলটা যেদিন বসানো হচ্ছিল সেদিনের কথা। সাবেরা তখনও বেঁচে, একটা মোড়ায় বসে টিউবওয়েল বসানো দেখছিলেন সাবেরা, পাশেই দাঁড়িয়ে কাজ তদারক করছিলেন নাসিমুল হক।

দেখতে দেখতে হঠাৎ মুচকি হেসে সাবেরা বলেছিলেন, ‘আমি কতদিন এ পানি খেতে পারব কে জানে!’

নাসিমুল হক চুপচাপ স্ত্রীর দিকে তাকিয়েছিলেন। সাবেরার ক্যান্সার ধরা পড়েছে বেশিদিন হয়নি তখন, সবে কেমোথেরাপি শুরু হয়েছে। ডাক্তার প্রচুর আশার কথা শোনাচ্ছিলেন, তারপরও, ভেতরে ভেতরে কোথাও যেন শূন্য বোধ করতে শুরু করেছিলেন নাসিমুল হক। গলায় জোর ফুটিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘বহুদিন খেতে পারবে। আজেবাজে চিন্তা করবে না, বুঝেছ?’

সাবেরা কী ভেবেছিলেন কে জানে। স্বামীর দিকে তাকিয়ে দুর্বোধ্য একটা হাসি দিয়েছিলেন।

তার ঠিক এক মাস পর মারা গিয়েছিলেন সাবেরা। আগের দিন কেমো দিয়েছিলেন, সেদিন সকাল থেকেই জ্বর, আর অস্থিরতা। ডাক্তারকে ফোন করেছিলেন নাসিমুল হক। এমনটা হতে পারে, বরাভয়ের ভঙ্গিতে বলেছিলেন ডাক্তার। খেয়াল রাখতে বলেছিলেন, বেশি খারাপ লাগলে বলেছিলেন হাসপাতালে নিয়ে আসতে। সে সুযোগ অবশ্য সাবেরা দেননি। বিকেলের দিকে বিছানায় শুয়েই স্বামীকে ডাকলেন, তড়িঘড়ি করে ছুটে এসেছিলেন নাসিমুল হক। তাঁর হাতদুটো চেপে ধরেছিলেন সাবেরা, চোখে কিসের যেন তীব্র আকুতি।

‘খারাপ লাগছে? পানি খাবে?’ উৎকণ্ঠিত স্বরে বলেছিলেন নাসিমুল হক।

উপরে নিচে মাথা নেড়েছিলেন সাবেরা, তারপর, কেমন যেন ঘোলা হয়ে এল তাঁর চোখদুটো। স্বামীর হাতদুটো আরো শক্ত করে চেপে ধরলেন, তারপর ধীরে ধীরে আলগা হয়ে এল সে চাপ। বুকের ভেতর থেকে গভীর, তীব্র এক আর্তনাদ উঠে আসতে শুরু করেছিলে নাসিমুল হকের। বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেছিলেন, ঠিক দিনের আলো নিভে যাওয়ার মতোই সাবেরার চেহারা থেকে কীভাবে বিদায় নিচ্ছে সমস্ত আলো, এবং জীবন।

আজ, এতদিন পর, নষ্ট হয়ে যাওয়া টিউবওয়েলটার দিকে তাকিয়ে ফের যেন পাশে সাবেরার অস্তিত্ব অনুভব করলেন নাসিমুল হক। মনে হলো, সাবেরা যেন বসে আছেন অদূরেই, মোড়ায়, আর তাঁর মতোই ঘোরগ্রস্ত চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছেন নষ্ট টিউবওয়েল, আর একহারা নারকেল গাছের মাথার ওপর দিয়ে ধীরে ধীরে হারিয়ে যাওয়া সূর্যের আলো।

ঘাড় ঘুরিয়ে বারান্দার দেয়ালঘড়িটার দিকে তাকালেন তিনি, চারটা বাজে। খিদের অনুভূতিটা ফিরে আসছে আবার। সকালে দু-টুকরো পাউরুটি খেয়েছেন, সঙ্গে এক কাপ চা। রান্নার অভ্যাস নেই তাঁর, তবে অনায়াসেই একটু ভাত ফুটিয়ে নেয়া যায়, সঙ্গে ডিম ভাজি আর ডাল। কিন্তু এটুকু করতেও ইচ্ছে করছে না। মনে হচ্ছে, কী আসে যায় এক বেলা না খেলে? মরে তো আর যাবেন না ... কিম্বা, মরে গেলেই বা কী আসে যায়!

রোগটির কথা প্রথম শুনেছিলেন বশিরের কাছে। মাসখানেক আগে, দাবার চাল দিতে দিতে বশির বলছিল কীভাবে রহস্যময় এক ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে দেশ থেকে দেশে, উজাড় করে দিচ্ছে লোকালয়। ‘ওভার-এইজ্ড মানুষেরাই সবচেয়ে বিপদে আছে,’ বলেছিল বশির, ‘তাঁদের ইমিউন সিস্টেম দুর্বল হওয়ায় ভাইরাসের আক্রমণে করার কিছু থাকে না।’ তারপরই, বোধহয় নাসিমুল হককে অভয় দেয়ার জন্য যোগ করেছিল, ‘অবশ্য ডায়াবেটিস, হাঁপানি বা এ ধরনের রোগ থাকলেই বেশি ভয়ের কথা। আপনি একটু সাবধানে থাকবেন। তাহলেই হবে।’

তারপর আরও অনেক কথাই বলল বশির, তার কতটুকু সঠিক আর কতটুকু গুজব বোঝার উপায় নেই। ভাইরাসটি পশুবাহিত, মানুষের নানা অন্যায় ও অনাচারের কারণেই এটির আগমন, কোথায় গ্রামের পর গ্রাম মরে সাফ হয়ে গিয়েছে, আবার কোথায় ভাইরাসের সংস্পর্শে আসার পরও কারও কিছ্ইু হয়নি এরকম অনেক উদাহরণ দিল বশির। এমনিতেই কথা বলতে পছন্দ করে সে, সেদিন যেন গল্পের ঝাঁপি খুলে বসেছিল। শুনতে শুনতে বারবার অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিলেন নাসিমুল হক। মনে হচ্ছিল পরাবাস্তব কোনো গল্প শুনছিলেন। এ-ও সম্ভব? এই একুশ শতকে? যখন গোটা পৃথিবী দাপিয়ে বেড়াচ্ছে মানুষ, সমস্ত অসম্ভবের পায়ে পরিয়ে দিচ্ছে পরাভবের শেকল, এবং সমস্ত গল্পকথা আর কিংবদন্তী পালিয়ে বাঁচছে পৃথিবীর সীমানা পেরিয়ে?

কিন্তু অস্বীকার করার উপায়ওতো নেই। পত্রিকা আর টেলিভিশন খুললেই চোখে পড়ছে ভীতসন্ত্রস্ত, অসহায় মানুষের মুখ। পত্রিকায়, টেলিভিশনের পর্দায় এসব খবর এবং ছবি দেখতে দেখতে নাসিমুল হকের মনে হয়, পৃথিবীর এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত পর্যন্ত পরাক্রান্ত এক সাইরেনের মতো ছড়িয়ে পড়ছে তীব্র এক চিৎকার, যেটি ক্রমশ রূপ নিচ্ছে আর্তনাদে, দাঁত-নখ বের করে অমোঘ নিয়তির মতো এগিয়ে আসা শ্বাপদের সামনে অসহায় শিকারের আর্তনাদ।

কাল থেকে কাশিটা বেড়েছে, সঙ্গে কি একটু শ্বাসকষ্টও? পত্রিকায় পড়েছেন, জ্বর, শুকনো কাশি আর শ্বাসকষ্ট হচ্ছে এই ভাইরাস সংক্রমণের প্রধান উপসর্গ। কপালে হাত দিয়ে দেখলেন। একটু কি গরম বোধ হচ্ছে? আনমনে হাসলেন নাসিমুল হক। রোগটা হয়ে গেলে মন্দ হয় না। বয়ে বেড়ানোর জন্য জীবনটাকে বড় বেশি গুরুভার মনে হচ্ছে অনেকদিন ধরে। ইদানিং আয়নার সামনে দাঁড়ালে ঝুলে পড়া চোয়াল আর শিথিল চিবুকের যে মানুষটিকে চোখে পড়ে, বড় অচেনা ঠেকে তাকে, মনে হয় অন্য কোনো মানুষের শরীরকে বহন করে চলেছেন তিনি, এবং, নিতান্ত অনিচ্ছাসত্ত্বেও, তার সঙ্গেই কাটাতে হচ্ছে প্রতিটি মুহূর্ত।

মিলি ফোন করেছিল কাল রাতে। উদ্বিগ্ন গলায় বর্ণনা করেছিল কীভাবে সে যে শহরে থাকে সেখানকার মানুষ নিজেদের বন্দি করে রেখেছে ঘরের মধ্যে। একান্ত প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বের হচ্ছে না কেউ। ‘রীতিমতো দম বন্ধ হয়ে আসছে আব্বা। কোনোদিন ভাবিনি এমন পরিস্থিতি হতে পারে। তোমাদের জামাই তো আমার থেকেও প্যানিক্ড। পারলে ঘরের মধ্যেই মাস্ক পরে ঘুরে।’ হড়বড় করে আরো অনেক কথাই বলেছিল মিলি। সম্ভব হলে একেবারেই বাড়ির বাইরে বেরোতে মানা করেছিল। ভাইরাস আতঙ্কের বহু আগেই বাড়ির বাইরে বেরোনো বহু আগেই বন্ধ করে দিয়েছেন নাসিমুল হক, তবে সেকথা মিলিকে বলা হয়নি, বলার সুযোগ পাননি, তার আগেই ফোন রেখে দিয়েছিল সে।

পত্রিকায় দেখেছেন, আতঙ্কিত মানুষ বাজার খালি করে চাল-ডাল-তেল-আটা যা পারে তাই কিনে মজুদ করছে। চালসহ নিত্যপণ্যের দাম এরই মধ্যে উর্ধ্বমুখী। শেষ কবে চাল কেনা হয়েছে মনে করার চেষ্টা করলেন। এক মাস? নাকি তারও আগে? একবার গিয়ে দেখা যায় কতটুকু আছে, কিন্তু ভেতর থেকে কোনো তাগাদা অনুভব করলেন না। পৃথিবীর সমস্ত অবসাদ যেন এসে ভর করেছে শরীরে। কতটুকু খাবার আছে, কীভাবে চলবে এ ধরনের কোনো কৌতূহল অনুভব করছেন না। মনে হচ্ছে, পৃথিবীর মধ্যে থেকেও, সমস্ত ডামাডোল থেকে দূরে, নির্মোহ দর্শকের মতো সব কিছু দেখছেন তিনি। যেন কোটি কোটি মানুষের এই আর্তি, এই মহা আতঙ্ক কিছুই তাঁকে স্পর্শ করছে না।

আজ বিকেলটা বড় বেশি নির্জন, বড় বেশি নিঃশব্দ। উপজেলা শহর থেকে খানিকটা দূরে, জেলামুখী রাস্তার ধারে কাঠাদশেক নিয়ে এই বাড়িটা। আশির দশকে, তিনি যখন পিডব্লিউডিতে চাকরি করেন তখনই টাকা জমিয়ে কেনা। ততদিনে ছেলে ও মেয়ে দুজনেই বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে। ভেবেছিলেন সাবেরাকে নিয়ে নিশ্চিন্তে অবসর জীবনটা কাটিয়ে দেবেন। সাবেরার মৃত্যু বিশাল একটা ধাক্কা হয়ে এসেছিল তাই, ছেলে আর মেয়েতো বলেছিলই, তিনি নিজেও ভেবেছিলেন, ছয় রুমের এই বাড়িতে একা একা থাকা সম্ভব হবে না। কিন্তু সময় সবকিছুকেই সহজ করে দেয়। সাবেরা চলে গেছে কত বছর? ছয়? নাকি সাত? খুব একটা সমস্যা তো হয়নি! তবে এখনও কোনোদিন, সন্ধ্যার মুখে যখন একা একা বারান্দায় বসেন, এবং উত্তর দিক থেকে জোরে একটা হাওয়া দেয়, তখন ন্যাড়া ধানক্ষেত আর বিরান মাঠ থেকে কে জানে কিসের একটা হু-হু শব্দ ভেসে আসে, তখন মনে হয় সাবেরা পাশেই বসে আছে, আলতো করে তার হাত ধরা আছে হাতে। মাঝে মাঝে স্ত্রীর সাথে কথাও বলেন নাসিমুল হক, অনেকটা স্বগতোক্তির মতো করে; নির্দিষ্ট কিছু নয়, মনের মধ্যে যা আসে তাই। সারাদিন কী করলেন, আজ কেমন রোদ পড়ল, কাল বৃষ্টি হতে পারে কিনা এইসব। জানেন, কেউ শুনলে ভাববে একা থাকতে থাকতে অস্বাভাবিকতা ভর করছে তাঁর ওপর, হয়ত বা পাগল হয়ে যাচ্ছেন। এ নিয়ে ভেবে অবশ্য সময় নষ্ট করেন না নাসিমুল হক। সাবেরার সঙ্গে কথা বলার সময় কয়েক মুহূর্তের জন্য হলেও মনে হয়, এখনও আছে সাবেরা, পাশেই আছে। এ উপলব্ধিটা সারাদিনের খাঁ খাঁ নিঃসঙ্গতার মধ্যে খানিকটা হলেও স্বস্তির বোধ এনে দেয়। এজন্য সন্ধ্যার এই মুহূর্তগুলো ভীষণ প্রিয় তাঁর।

আজ সন্ধ্যার মুখে মুখেই বিদ্যুৎ চলে গেছে। অন্ধকারে ঠায় বসে থাকতে থাকতে নিজেকেও অন্ধকারেরই অংশ বলে মনে হচ্ছে। সকালের পর থেকে এক বিন্দু পানিও যে খাননি সে অনুভূতিটাই হচ্ছে না। মনে হচ্ছে খাবার ছাড়াই ভালো আছেন। চারপাশ বড় বেশি নিঃশব্দ আজ। অন্যান্য দিন বিদ্যুৎ চলে গেলে আশেপাশের বাড়ি থেকে বাচ্চারা বেরিয়ে আসে। রাস্তায় হৈ হল্লা করে। আজ কোথাও কেউ নেই। ভীষণ ছোট, আর নেহাতই তুচ্ছ একটা ভাইরাস দুনিয়ার সব মানুষকে স্তব্ধ করে দিয়েছে। ভয়ে সিঁটিয়ে আছে সবাই। দরজা জানালা বন্ধ করে নিজেদের বন্দি করে রেখেছে ঘরের মধ্যে। অবিশ্বাস্য!

‘কে ভেবেছিল এমনটা হতে পারে, বলো তো!’ নিকশ অন্ধকারে চোখ রেখে নিচুগলায় সাবেরার উদ্দেশে বললেন নাসিমুল হক। ‘যদি কোনো গল্পের বইতে পড়তাম তাহলেওতো বিশ্বাস করতাম না। ভাবতাম লেখকের কল্পনার দৌড় বাড়াবাড়ি রকমের বেশি।’ খানিকক্ষণ চুপ করে থাকলেন তিনি, তারপর ফের মুখ খুললেন, ‘মনে আছে আমাদের বিয়ের পর প্রথম যেবার বেড়াতে গেলাম? সীতাকু-ে? ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ দেখলাম পাহাড়ের ওপর তুমি আর আমি ছাড়া আর কেউ নেই। মনে আছে কী বলেছিলে তুমি? এমন নির্জনতা, দম বন্ধ করে দিতে চায়! আমার কিন্তু দারুণ লেগেছিল সেই নির্জনতা। সাবেরা, তোমার সেই দম বন্ধ করা নির্জনতা ফিরে এসেছে এই সন্ধ্যায়। তুমি থাকলে নিশ্চয়ই অবাক বিস্ময়ে বলতে, সবাই এত চুপচাপ কেন? নিস্তব্ধতা পছন্দ ছিল না তোমার। আমার কিন্তু, সেই বিকেলবেলার মতোই, বেশ ভালোই লাগছে।

উত্তুরে হাওয়ার বেগ বেড়েছে, সঙ্গে সেই রহস্যময় শব্দ। নাসিমুল হকের মনে হলো, এই শব্দের সঙ্গে মিশে আছে সাবেরার কণ্ঠস্বরও। কিছু একটা যেন বলতে চাইছে তাঁকে। কান পেতে শোনার চেষ্টা করলেন নাসিমুল হক।

বিদ্যুৎ কি আজ আর আসবে না?

কাল রাতে টেলিভিশনে দেখেছেন, কোন দেশে যেন হাসপাতালে লাশের স্তূপ জমেছে, সৎকারের লোক পাওয়া যাচ্ছে না। কেউ কি ভেবেছিল এমন প্রলয় আসবে পৃথিবীতে? এত তাড়াতাড়ি?

নাসিমুল হক জানেন, যদিও বাইরের কারো সংস্পর্শে আসার সম্ভাবনা আপাতত নেই তাঁর, তারপরও, কোনো কারণে যদি ভাইরাসটা আক্রমণ করেই বসে, তাহলে নিঃশব্দে, এবং নিঃসঙ্গভাবে মরে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই তাঁর। কেমন হবে সে মৃত্যু? ভাবার চেষ্টা করলেন তিনি। কাশিটা বাড়বে, সঙ্গে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর, তারপর একসময় শুরু হবে শ্বাসকষ্ট। সেটি তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকবে। একসময় আর নিঃশ্বাস নিতে পারবেন না, মনে হবে বুকের ওপর চেপে বসতে চাইছে ভয়ঙ্কর এক পাথর, ক্রমশ বাড়বে সে পাথরের চাপ। তারপর একসময় সমস্ত পৃথিবী অন্ধকার হয়ে আসবে, এবং সেই প্রবল প্রগাঢ় অন্ধকারের কাছে নিজেকে সমর্পণ করবেন তিনি ...

আসলেই এভাবে ঘটবেতো ব্যাপারটা? নাকি আরো দুঃসহ, আরো ভয়ঙ্কর হবে অভিজ্ঞতাটি? চলে যাওয়ার সময় সাবেরার চেহারাটি কেমন হয়েছিল মনে করার চেষ্টা করলেন তিনি। সেই ঘোলা, ব্যাকুল দৃষ্টির আড়ালে আর কী ছিল সাবেরার চেহারায়? হতাশা? অসহায়ত্ব? আর্তি?

জোর করে ভাবনাটা থেকে মনকে অন্য দিকে ফেরানোর চেষ্টা করলেন নাসিমুল হক। এখনও কিছু চাল অবশিষ্ট থাকার কথা, রান্নাঘরে একবার গিয়ে দেখা যায় কতটুকু আছে। কিন্তু পাহাড়ের মতো এক অবসন্নতা যেন ভর করেছে শরীরে, একবারের জন্যও উঠতে ইচ্ছে হচ্ছে না।

রাত বাড়ছে, সেই সঙ্গে বাড়ছে উত্তুরে হাওয়ার দাপট। আশেপাশের বাড়িগুলো থেকে যে দু-চারটি শব্দ শোনা যাচ্ছিল সেগুলোও এখন থেমে গেছে। ক্রমশ জেঁকে বসা অন্ধকারে নিজের হাতটিও এখন আর দেখা যাচ্ছে না। নাসিমুল হক বসে রইলেন। যেন ঘনায়মান এই অন্ধকার এবং প্রগাঢ় নৈঃশব্দের ওপারে কী আছে তা দেখার জন্য অন্য সবার মতো অপেক্ষায় আছেন তিনিও।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ

  1. মনোমুগ্ধকর গল্প। মুহূর্তের মধ্যে গল্পে হারিয়ে গিয়েছিলাম।

    উত্তরমুছুন