মাথা খারাপ হয়ে যায় মইনের । বন্ধু বান্ধব তার কবিতা পড়ে মুগ্ধ হয়। অহনা বলে, বুঝলো না বিষয়টা। এটা একটা কথা হলো? প্রথম প্রথম হাসাহাসি চলতো। দুজনের পরিচয় পর্বে তো বেশ বুঝতো কবিতা। এখন কি হয়েছে? ক্রমেই মইন চটে মনে মনে। সত্যি বোঝে না, নাকি দুষ্টুমি করে অহনা। এটাও ভাবায় তাকে। আবার ভাবে, ব্যাক্তিগত জীবনে কবিতা টেনে না আনাই ভালো। অঙ্কের ছাত্রী বৌটা। তার বিষয় নিয়ে ভালোই থাকে। থাক।
বড়োলোকের মেয়ে, একটু আল্লাদী। এই আর কি! আসলে সরল সহজ বলে বুদ্ধি কম নয় অহনার। অংকে মাথা সরস। সেদিকে মইন গোল্লা।সেটা কাটানোর জন্যই হয়তো ওকে বোকা মনে করে মইন আমোদ পায়। সামনে বলার সাহস নেই, তাই মনে মনে কচলায়। নিজেই আবার সামলে নেয়। আবার কখনও লেগেও পড়ে দুটিতে। ভুলে যায় পূর্বরাগের মিঠে মিঠে কথা। ঘুড়ি তবু কাটে না। বাঁধা থাকে নাটাইয়ে সুতোর সাথে। বেশ ভালোই আছে ওরা।
এখন আবার ন্যানো সেকেন্ডের অঙ্ক নিয়ে বই লেখছে অহনা। মহাব্যস্ত তাই নিয়ে। ফেব্রুয়ারি মাস এসেছে। বইমেলা চলছে। মইনের কবিতার বই বের হয়েছে। সেটা বিক্রিও হচ্ছে ভালো। আজকাল-এর প্রকাশক শামসুল মনির বইয়ের মোড়ক উন্মোচনের অনুষ্ঠান করলো বেশ আয়োজন করে। টিভি চ্যানেলের লোক এসে ছবি নিলো। তাতখনিক একটা সাক্ষাতকারও নিলো মইনের এক সাংবাদিক বন্ধু জহুর আলি।
এতো সবের কিছুই জানে না অহনা। সে অবশ্য আগেই বলেছিলো, ১৫ই জানুয়ারি থেকে ১৬ই ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সে কোনো দিকে মন দিতে পারবে না। ঘর সংসারের অপরিহার্য কাজ ছাড়া মইনকে সঙ্গ দেয়া যাবে না বিধায় ক্ষমাপ্রার্থী। এমনকি, ভ্যালেন্টিন্স-ডে উপলক্ষে ১৬ই ফেব্রুয়ারি টিএসসি-তে মইনের কবিতা পাঠের অনুষ্ঠানেও তার থাকার উপায় নেই। রীতিমতো বোঝাপড়ার ব্যাপার। তবু মইনের খারাপ লাগছে, বিধুমুখী বউটা পাশে না থাকার কারনে। খারাপ লাগছে অহনারও। আহা! প্রথম পরিচয়ের দিনগুলো কি ভালো ছিলো!
অহনা সত্যি ব্যাস্ত। সম্পাদনা চলছে তার বইয়ের। বোর্ডের বই বলে কথা! এইসব কাজের জন্য মানুষ ওন্দা বেড়ালের মতো ছোঁক ছোঁক করে। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পেছনে ফেলে সাধারণস্কুল শিক্ষক অহনার ভাগ্যেই ছিঁড়েছে শিকেটা। তাতে কলিজা জ্বলছে কতো জনের। ভালো পারিশ্রমিকের ব্যাপারও অনেকের হিংসের কার্ণ।
প্রকাশক শামসুল মনির ওরফে শামসু ভাই আর সাংবাদিক জহুর ভাইকে অনেক অনেক ধন্যবাদ জানিয়েছে অহনা। অনেক করেছে ওরা মইনের জন্য। তাই প্রাক ভ্যালেন্টিন সন্ধেতে মইন একটা আড্ডার আয়োজন করেছেো। সেদিন সন্ধেতে সময় দিতে পারবে অহনা। কাজ প্রায় হয়েই গেছে।
সাধারণত জানুয়ারি মাস থেকে শুরু হয় বিভিন্ন লেখক দলের বিশেষ আড্ডা অনুষ্ঠান। হোটেল বা ঢাকা ক্লাব বা গুলশান বনানী উত্তরা ক্লাবে বসে ঘনো ঘনো আড্ডার আসর। অর্থে বিত্তে যারা ওদের সমগোত্রের না, তারা পালা করে নিজেদের বাড়িতেই বন্ধুদের আড্ডায় আপ্যায়ন করে। মইনেরও দল আছে। তার কবি এবং গদ্যিক বন্ধুর পরিধিও বেশ বড়ো। তবু সবাইকে ডাকে না সে বাড়িতে। পেরে ওঠে না। খরচের চেয়ে বড়ো হলো আয়োজনের ধকল।
এবার মাত্র বিশ জনের মতো বন্ধু আসবে। ফেব্রুয়ারিতে একটা আড্ডা না হলে চলে? বরাবর সংখ্যা বেড়ে যায় আড্ডায়। কারণ অনাহুত কেউ কেউ এসেই পড়ে। আড্ডায় চারজন মহিলা লেখক আসবে। সবাই কবি। সবাই মইনের ভক্ত। নতুন যে কবিতার বই বের হয়েছে মইনের, সেটা থেকে পাঠ থাকবে আড্ডায়। একজন মহিলা কবি এবং একজন পুরুষ কবি একটা করে কবিতা পাঠ করবে। অনুষ্ঠান সাজিয়েছে জহুর ভাই। কথা আছে, উনি একজন বন্ধু আনবেন। নাম হাসনাইন মুর্শেদ। সদ্য শুরু হওয়া নতুন এক টিভি চ্যানেলের নিউজ ডেস্কের অন্যতমো কর্মকর্তা। ভালো কভারেজ পাওয়া যাবে। প্রচারের দাম আছে না?
অহনা আজকাল আর রান্না করা খাবার পরিবেশন করে না পার্টিতে। সময় পায় না রান্নার। তাছাড়া অনেক রকম দোকানও হয়েছে অর্ডার নেয়ার। বললেই দিয়ে যাবে। চাইলে খাবার পরিবেশন করবে পরিপাটি ভাবে। সবই টাকার ব্যাপার। আরাম কেনার বিষয়। শেষে সব পরিষ্কারও করে দিয়ে যাবে। রান্নার গুণ ও মান বেশ ভালো।
অহনা চেয়েছিলো পরাটা কাবাব সালাদ হবে প্রধান খাবার। পরে দই , মিষ্টি পান। শেষে গ্রিন টি। কিন্তু মইনের বন্ধুরা খাশির বিরিয়ানির ভক্ত। সাথে গলদা চিংড়ির মালাইকারি আর সালাদ। সবজি একটা থাকবে। একটা কোনায় কিছু বোতল সাজানো থাকবে। প্রেস্টিজিয়াস কর্নার।
সন্ধে হতে না হতে ফুল হাতে বন্ধুরা আসতে শুরু করলো। বসার ঘরে কার্পেট বিছিয়ে বসার ব্যাবস্থা। মইন উস্খুস করে জহুর ভাইকে না দেখে। টিভির কর্মকর্তাকে নিয়ে আসার কথা। সাথে আসবে ক্যামেরা ম্যান। কর্তাব্যাক্তির কভারেজ দেয়াই তাদের চাকরি। মইন ফোনেই দাওয়াত দিয়েছে। কবি নাবিলা কনা মইনের কবিতার বই নিয়ে বসেছে। পাঠের আগে পড়া দরকার। মলয় রায়েরও পাঠ আছে। কিন্তু সে সাজিদের সাথে চলে গেছে সেই প্রেস্টিজিয়াস কর্নারে।
হুড়মুড় করে জহুর ভাই এলেন দুজনকে সাথে নিয়ে। এই না হলে জহুর ভাই? নিয়ম ভাঙার গানেই বাজি মাত করেন সব সময়। টিভির কর্মকর্তার সাথে টিভি চ্যানেলের মালিক কলিম শাহকেও এনেছেন। নামি দামি লোক তো বটেই, বিশাল ধনী আদম। আয়ের উৎস ব্যাবসা। সংসদ সদস্য হতে চেয়েছিলেন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিশেবে। সুযোগ পেয়েছিলেনও। কিন্তু জিতে আসতে পারেন নি। বলে বেড়ান, আগের রাতেই বাক্সে ব্যালট ভরা হয়েছিলো। ইলেকশন বা সিলেকশন নয়, ডিসিশনেই কাজ হয়েছে।
এক দফা ছোটো ছোটো সামুসা আর সিঙাড়া খাওয়া হয়েছে। চা বা কফি নিচ্ছে সবাই। এসপ্রেসো আছে। কাপুচিনো আছে। ইচ্ছে হলে কেউ নিতে পারে। মহিলারা চা নিয়েছে। কফি নিতে গিয়ে থামতে হলো অহনাকে। জহুর ভাইয়ের সাথে একজন অপরিচিত মানুষ দেখে কফির জায়গা থেকে সরে আসে।
-না না ঠিক আছে, আপনি আগে নেন। নতুন ভদ্রলোক বলেন।
জহুরভাই এগিয়ে এসে পরিচয় করিয়ে দেন, অহনা, ইনি হলেন আমাদের প্রিয় কলিম শাহ ভাই। সাহিত্যের সমঝদার। আড্ডার কথা শুনে চলে এলেন।
হেসে হাত বাড়িয়ে দিলেন কলিম শাহ। অহনা মুখে মুখে বললো, স্লামালেকুম। খুব ভালো করেছেন এসে।
-স্লাঁলেকুম স্লাঁলেকুম। আমি কলিম। সপ্রতিভ মানুষ। সামলে নিলেন।
-আমি অহনা মইন।
-ও, আপনি সেই ভাগ্যবান কবিপত্নী? খুশি হলাম পরিচিত হয়ে।
-কি দেবো আপনাকে? শ্রীময়ি অহনা হাসে মিষ্টি করে।
-ব্যাস্ত হবেন না আমার জন্য। এই নেবো যাহোক কিছু।
পারফিউমের গন্ধে আমোদিত করে দিয়েছেন কলিম শাহ। একটা সময় ছিলো, ইনটিমেটের সুবাস ছড়িয়ে আভিজাত্য বোঝানো হতো। শ্যানেল তো বরাবরই উঁচু তলার সৌখিনদের সুবাস। এখন আরও কতো রকম নামের সুবাস আছে। অহনা মইন দুজনেই সুবাস মাখতে পছন্দ করে।
কি সুবাস মেখেছেন কলিম শাহ! বেশ আসর মাতানো এবং উগ্র। বয়স হয়েছে, কিন্তু খুব স্মার্ট। দেখতেও আকর্ষণীয়।
মইন এসে কলিমকে এসপ্রেসো নেয়ার কথা বললো।
-ওই কর্নারটা একটু দেখে আসি চলেন। কলিম বলেন, আসেন জহুর আমরা ঐদিকে একটু ঘুরে আসি।
হঠাৎ ঘুরে অহনার দিকে তাকিয়ে বলে, আচ্ছা, শাহজামাল চৌধুরি কি আপনাদের কেউ হন?
-আমার বাবা।
-তাই বলি, কোথায় দেখেছি আপনাকে!
-মানে? বুঝতে পারলামনা।
-বছর দশেক আগে ব্যাংকক হাসপাতালে আপনার মায়ের চিকিতসার জন্য গিয়েছিলেন কি?
-আপনি জানলেন কি করে?
-আমি তখন সেই হাসপাতালে ছোটো মেয়ের চিকিতসার জন্য ছিলাম।
-আমার মনে পড়েনা কিছু।
-আপনাকে দেখতাম মায়ের কাছে বসে দোয়ার বই পড়তে। অবিকল বাবার চেহারা। ভালো লাগতো দেখে। পাশের কেবিনটাই ছিলো আমাদের। মাঝে মাঝে ক্যান্টিনে দেখা হতো।
-এখনও মনে পড়েনা কিছু। দুঃখিত।
-না পড়ারই কথা। আমি নগণ্য মানুষ।
-এমন করে বলবেন না প্লিজ। আজ আমাদের সম্মানিত অতিথি আপনি।
-আপনার বাবার সাথে বেশ ভাব হয়ে গিয়েছিলো। আপনাকে দেখলে আপনার বাবাকে মনে পড়বেই। একেবারে কাট টু কাট ফেইস।
অহনা কথা বলে না, মাথা নামায় লজ্জায়।
-ভেবেছিলাম, যোগাযোগ রাখবো। কিন্তু ব্যাস্ত জীবনে যা হয়। আমি চলে গেলাম চট্টগ্রাম। আপনারা তো ঢাকার বাসিন্দা। তবে আপনার বাবার সাথে দেখা হয় মাঝে সাঝে রোটারি ক্লাবের বার্ষিক সভায়।
স্বল্পভাষী অহনা কথা খুঁজে পায় না। কেমন অস্বস্তি লাগতে থাকে। সময় পর্ব তার মনে আছে। বাকি অনেক কিছুই ভুলে গেছে বেমালুম। মাকে হারানোর দিশেহারা শোকে মুছে গিয়েছিলো পৃথিবী। মন খারাপ হয় তার। এমন দিনে সাজানো আড্ডার সুখি সুখি আয়োজনের জলসা থেকে কে যেনো হঠাৎ তাকে ফেলে দিলো বিষণ্ন শোকের দহে।
ওদিকে কবিতা পাঠের পর্ব শুরু হবে বলে মইনকে ডাকাডাকি শুরু হয়েছে। নাবিলা বই হাতে নিয়ে বসে আছে। অহনাকে যেতে হয় সেদিকে। মহিলাদের চা শেষ। কাপগুলো সরিয়ে রাখে ক্যাটারিং সার্ভিসের দুটো ছেলে। কলিম সাহেব তো মক্ষীরাজ হয়ে ঘুরছেন। জহুর ভাইকে ছাড়ছেন না কলিম সাহেব, না জহুর ভাই ছাড়ছেন না কলিম শাহকে, বোঝে না অহনা। সামান্য ঘোষণার ব্যাপার আছে না? আড্ডাটাই না মাটি হয়।
নাবিলার পাঠ শুরু হলো। বেশ ভালোই পড়লো। আঠারো লাইনের ছোটো কবিতা। শিরোনাম, বসন্তের পাখি।
বাহবা বাহবা নন্দলাল বলার লোক তো থাকেই আড্ডাতে। তারা খুব বাহারে বাহারে বাহা করে উঠলো। অহনা কবিতার তেমন কিছু বুঝতে পরেনি। ছন্দের কবিতা তার পছন্দ। গদ্য কবিতা একটুও ভাল লাগে না। মইনের সব কবিতাই গদ্যছন্দের। মাঝে মাঝে অনুচ্ছেদের মতো করেও কবিতা লেখে। বহুবার পড়ে চেষ্টাও করেছে ভাল লাগাতে, কিন্তু পারেনি। খারাপই লাগে মইনের কবিতার ভালো পাঠক হতে না পেরে। বিয়ের আগে কি সত্যি ভাল লাগতো মইনের কবিতা? নাকি সুন্দর মানুষটাকেই বেশি ভাল লাগতো? প্রায়ই ভাবে কথাটা অহনা।
একজন বললো, বসন্তের দূত হলো কোকিল। এখানে দোয়েল শ্যামা ফিঙে কাক চিল পর্যন্ত আছে, কোকিলের নামটা থাকলে ভাল হতো।
-কোকিল ছাড়া বসন্ত আসেনা? এক তরুণ কবি প্রশ্ন করে কথককে।
-নিশ্চয় আসে। ফুল না ফুটলেও বসন্ত আসে।
-তাহলে?
-কি তাহলে?
-কোকিলের নাম না শুনে কষ্ট পেলেন মনে হলো।
-কষ্ট পাবো কেনো? অপ্রস্তুত হয় প্রথম কথক।
আর এক তরুণ কবি বললো, কবিদের কাব্যসত্য অন্য জিনিশ।
-একটু ভেঙে বলেন ভাই। অন্য কণ্ঠশোনা গেলো।
-এই যেমন, রোদের গান, বারুদের বাগান, বেনোজলের ঘোড়া, শিশিরের স্ফুলিঙ্গ, গোধুলির করোটি, নীরবতার অট্টরোল, আঁধারের শিস, আকাশের ডমরু, ইত্যাদি শব্দগুচ্ছের মধ্যে কবিরা এমন কিছু বলতে চান, যা অন্যেরা বোঝেনা সহজে।
কেউ কেউ হেসে ওঠে তরুণ কবির গড়গড় করে শব্দগুলো বলার জন্য।
অন্য কণ্ঠ আবার বলে, একালেও জীবনানন্দ জ্বালাতন করবে?
-বলেন কি জুলু ভাই? জীবনানন্দকে ভালো না বাসলে কবি হবেন কি করে? আশিকুল হক পুটু বলে জোশের সাথে।
-আমি তো কবি নই, একটু আধটু ছড়া লেখি।
-ছড়া কি কবিতা নয়?
-কবিতা বলেই মানি। খুব সহজ কথা আমার পছন্দ। ভারি কথা, ভারি দর্শন, বিস্ময়কর রোমান্স, এসব বুঝি না বললেই চলে পোড়া ভাই।
-আমাকে আশিক বললে খুশি হবো।
-সরি, এতোকালের অভ্যেস কি না। মুখে এসে যায় ডাকটা।
-তাই বলে অনুষ্ঠানের মধ্যে?
-আপনিও তো আমাকে জুলু ভাই বলেছেন।
-আপনি আপত্তি করেননি তো!
ঝাঁকড়া চুলের একজন বললো, আহা আহা পার্সোনাল এসপার্শান হয়ে যাচ্ছে ভাই। কবিতার পাখি নিয়ে বেশ তো চলছিলো আলোচনা। পাখির সাথেই থাকেন কবি ভাইয়েরা। ওড়া যাক কিছুক্ষণ।
-আরে ভাই, জীবনানন্দ যে হওয়া যায় না, সেটা না বুঝেই অনেকে এবড়ো থেবড়ো করে দেয় কবিতার দেহ, একজন গদ্যিক বলেন কথাগুলো।
ঘরের এক কোনায় মহিলারা কলিম শাহকে নিয়ে কৌতুহলী হয়ে ওঠে। কবিতার আলোচনায় তারা যাবে একটু পরে। মলয় পড়বে রোমান্টিক কবিতা ‘ক্লিওপেট্রা’। সেখানে অংশ নিতে চায় মহিলারা। সকলেরই বেশ পছন্দ কবিতাটা। একটা দৈনিকে প্রকাশিত হয়েছিলো। তখনই সাড়া পড়ে গিয়েছিলো তাদের দলের মধ্যে।
নাবিলা নিচু স্বরে বলে, ভদ্রলোকের চোখ দুটো খুব রোমান্টিক।
-কোন ভদ্রলোক? পিকু জানতে চায়।
-কলিম সাহেবের কথা বলছি। যদিও বয়স হয়েছে।
-হয়তো ব্যাক্তিগত জীবনেও রোমান্টিক। ময়না মুচকি হেসে বলে।
-চোখ দেখে কিছু বলা অতো সহজ নয়। মলি বেশ জোর দিয়ে বলে।
-এমন মনে করার কারন? ময়না জানতে চায়।
-যেমন ধরেন লাদেন। তার সুর্মা দেয়া মায়া মায়া চোখ দেখে তাকেও তো রোমান্টিক মনে হতে পারে। কিন্তু আসলে কি তাই? মলি নাটুকে ভঙ্গিতে কথা বলে।
কোথায় কবিতার আসর, আড্ডা, কোথায় লাদেনের চোখ? নিজেরাই নিজেদের কথায় হেসে ওঠে। একটু জোরেই হাসির শব্দ হয়। আলোচনার আমেজ হালকা করে দেয় বামা কণ্ঠের হাসি। অনেকেই ফিরে তাকায় মহিলাদের দিকে। অভদ্রতার একটা সংকোচ জড়িয়ে ধরে সবাইকে।
-মেয়েরা মেয়েই হয়। জাহাঙ্গির হাসতে হাসতে বলে, এদিকে বসন্তের পাখি পালিয়ে গেছে, তার খোঁজ পেলেন না আপনারা।
-কে বলে পালিয়েছে? চারুবাক মলি উত্তর দেয়, পাখি এখনও কবিতায় বন্দী। পড়লেই উড়বে। কিন্তু আপনারা তো নিজেদের নাম নিয়ে লজ্জায় পড়েছেন। পাখিও হাসছে।
-শুনেছেন তাহলে? অবাক হয় জাহাঙ্গির।
মলয় বলে, এবার আমি কবিতাটা পড়তে চাই। মেয়েরা এগিয়ে গেলো
আলোচনার কেন্দ্রে। অনেকেই নড়ে চড়ে বসে কবিতা শোনার জন্য।
বেশ আবেগ দিয়ে মলয় পাঠ করে কবিতা। কিছুক্ষণ সবাই চুপ। রগ রগে কবিতা। কাঁচুলি, স্তন, নিতম্ব, রতি, চুম্বন, আলিঙ্গন, ইত্যাদি শব্দের স্পষ্ট ব্যাবহারে মহিলারা লাল হয়ে উঠেছে। তারপরে শেষ দুটি লাইনে গভীর হতাশার দীর্ঘশ্বাস। হঠাৎ শুনশান। চুপ সবাই। মনে হয়, মিলন শেষে ফুঁপিয়ে কাঁদছে কেউ। দীর্ঘস্বাস ফেলে বলছে, ‘জীবনের গাঢ় যাপন অলীক তো বটেই, অবশ্যই বেঁচে থাকার ঘ্রাণ থাকে অনিত্যেই’।
নাবিলা কিছু বলেন, জাহাঙ্গির বলে।
-আহা, প্রথমেই আমি কেনো জাহাঙ্গির ভাই?
-দিলি তো শশশা--, থুককু, আমেজ নষ্ট করে! মইনের এক গদ্যিক বন্ধু বলে, বেশ লাগছিলো। যদিও একটু ইয়ে, মানে...
-মদের বোতল নিয়ে কাঁদার মতো হয়ে গেলো দোস্তো, জুলু সাহেব বলে।
-দুর্বোধ্য শব্দাবলী ব্যাবহার করে কবিরা আত্মতঞ্চকতাই করে মইন ভাই।
-বেশ বলেছেন তো পুটু ভাই। জহুর ভাই বলে, তবে আমার মনে হয়, তঞ্চকতা সৃষ্টি করাও একটা কাব্য কৌশল।
-আমাকে আশিক বলবেন প্লিজ। পুটু সাহেব সিরিয়াস হন। মুখ টিপে হাসেন কেউ কেউ।
-মানুষ যেনো সহজে কবিতা বুঝতে না পারে, এই তো? পেছন থেকে একজন কথা সাহিত্যিক বলে, গদ্যে এর অবকাশ নেই।
-ঠিক বলেছেন, পাঠক রহস্যের দহে পড়ে বুঁদ হয়ে থাকে কিছুক্ষণ। না বোঝার মজাতে হারিয়ে যায় মন-প্রাণ-বাক-দৃষ্টি।
-কবিরা সেটাই চায় জহুর ভাই। তাইতো কবিতার পাঠক বেশি, লেখক বেশি, স্তাবকও বেশি।
-তা বলে গদ্যের মগ্ন পাঠক নেই, এটা ভাবার কারণ নেই কিন্তু। মলি বলে,
গদ্য লেখকরাও কবিদের সাথে পাল্লা দিয়ে অনেক আদিরসাত্মক শব্দ বাক্য লেখছে এখন।
-আরে ভাই, সাহিত্য হলো কাননের পেলব কুসুম। জোর করে ফোঁটাতে গেলে পাঁপড়ি ছিঁড়ে যায়। এটা পাল্লা পাল্লির ব্যাপার নয়। মইন, কিছু বলেন।
সবাই কথা বলছে। একের পর এক নয়। প্রায় এক সাথেই। প্রেসটিজিয়াস কর্নার থেকে উচ্চকণ্ঠ শোনা গেলো। তাদের বিষয়, লেখকদের পুরস্কারের মান। দেশে প্রচলিত সাহিত্য পুরস্কারের গুণগত এবং অর্থগতটমান কোনোটাই পছন্দ নয় কলিম সাহেবের। ক্রেস্ট এবং সম্মাননা দেয়ার ফালতু চল হয়েছে একটা, সেটা ভিক্ষার চেয়ে খারাপ। উনি আগামি বছর থেকে দুটো সাহিত্য পুরস্কার দেয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। একটা কথা সাহিত্যে, একটা কাব্যসাহিত্যে। পুরস্কারের মান হবে দশ লাখ টাকা। নাম হবে ‘কলিম সাহিত্য পুরস্কার’।
আড্ডার সবাই উচ্ছসিত হয়ে ওঠে কলিম সাহেবের কথা শুনে। বুকের ভেতর তোলপাড় ওঠে অনেকের। আহা, তাদের ভাগ্যে যদি শিকেটা ছেঁড়ে কোনোদিন! সাহিত্য চর্চা করে এইরকম একটা পুরস্কার কার না বাসনার বিষয়! কেউ কেউ বললো, সত্যি সাহিত্যের সমঝদার লোক বটে! দিলদারও।
একটা ফোন এলো অহনার। বাড়িতে অনুষ্ঠান আছে জানায় অহনা। কলিম সাহেবের কথাটাও জানায়। শুনে তার বাবা হেসে বলেছে, ভোটে হেরে এবার সাহিত্যের বাজারে পুরস্কার ছেড়ে বিখ্যাত হতে চাইছে? বাবা আরও বলেছেন, ‘শিং ভেঙে দামড়া বাছুরের দলে’ গেলে সতর্ক থাকতে হয়। মইনকে বলিস কথাটা।
-আমরা কিন্তু উনাকে আজ দাওয়াত করিনি বাবা।
-তাতে ক্ষতি নেই। ওরা জানে কোথায় ঢুঁ মারতে হয়।
-ভয় ধরিয়ে দিলে।
-কিছুটা তো বটেই। ব্যাঙ্কে কোটি কোটি টাকা ঋণের দায়ে মামলা ঝুলছে ঘাড়ের ওপর।
-কি বলছো বাবা?
-সত্যি কথা মা। জামিনে আছেন এখন। জামিনে থেকে পুরস্কার দিচ্ছেন উনি। হাসি পায় রে মা।
-ভাবতেই পারছি না বাবা।
-এখন রোটারি করছেন বড়ো ধান্দায়। টিভি চ্যানেল তো নিয়েছেনই। শুনেছি একটা দৈনিক পত্রিকাও প্রকাশ করবেন। এবং এরই মধ্যে এক রাজনৈতিক নেতাকে তার সম্পাদকও করে ফেলেছেন।
-জিনিয়াস বাবা, যাই বলো।
-হা হা হা, এইরকম জিনিয়াসের সংখ্যা বেড়েই যাচ্ছে কিনা।
জহুর সাহেব অহনাকে খুঁজতে খুঁজতে এসে আবিষ্কার করলো, সে কথা বলছে ফোনে। ভাবে, ডাকবে কিনা? কিন্তু ওদিকে তুলকালাম কাণ্ড ঘটে যাচ্ছে। কলিম সাহেব আজই তাঁর নামের দামী পুরস্কারটা ঘোষণা করে দিতে চান। স্মরণীয় করে রাখতে চান আড্ডার দিনটাকে।
-অহনা, ডাকেন জহুর সাহেব।
চকিতে ফিরে তাকায় অহনা। বলে, কিছু বলবেন?
-কেল্লা ফতে অহনা। জহুরকে একটু বেতাল মনে হলো।
-মানে কি? কিসের কেল্লা ফতে জহুর ভাই?
-আর একটা খাই দাই পার্টি কবে হবে, সে কথা বলো।
-একটু ঝেড়ে কাশেন ভাই। হাতের ফোনটা বন্ধ করতেও ভুলে যায় সে। বলে, খাবার দাবার কম পড়ে যায়নি তো! আঁতকে ওঠে অহনা।
-না না, ওসব কিছুনা।
-তাহলে? ফোন বন্ধ করে অবাক হয়ে প্রশ্ন করে।
-কলিম সাহেব আড্ডার আসরে আমাদের কবি মইনকে আগামী বছরে দশ লাখ টাকার পুরস্কারটা দেয়ার ঘোষণা করে দিয়েছেন। আজই রাত এগারোটার খবরে তা প্রচারিত হয়ে যাবে কয়েকটা টিভি চ্যানেলে। জহুর ভাই ছুটে গেলেন অন্যদিকে। খুশির সীমা নেই তাঁর।
অহনার মনে তোলপাড়। আকস্মিক প্রাপ্তির আনন্দে না আঘাতে, বুঝতে পারছেনা। ভাবছে, কলিম সাহেবের আসল পরিচয় পেলে মইন কি পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করবে? কিন্তু এইসব প্রভাবশালী মানুষকে খোদ সরকারই কিছু বলে না, মইন তো কোন ছার! তারা দুজনে আয় করেও বাড়ি গাড়ির দিকে যেতে পারেনি। টাকাটা পেলে এবার একটা ফ্ল্যাটের ডাউন পেমেন্ট করে ফেলতে হবে। স্বাচ্ছন্দ দরকার জীবনে। এখানে তো আর দুর্নীতি নেই। পুরস্কারের টাকা শতোভাগ হালাল। মইন নিশ্চয় খুশি হবে। কিন্তু কোথায় সে?
হঠাৎ কানে আসে গানের সুর। প্রেসটিজিয়াস কর্নার থেকে নাবিলা, শোয়েব আর মলয় গাইতে শুরু করেছে , মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জাগানিয়া সেই গান,
'জয় বাংলা, বাঙলার জয় ...
লেখক পরিচিতি
বেগম জাহান আরা
অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক
আধুনিক ভাষা ইন্সটিটিউট,
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
শতাধিক গ্রন্থের লেখক।
জার্মানীতে থাকেন।
লেখক পরিচিতি
বেগম জাহান আরা
অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক
আধুনিক ভাষা ইন্সটিটিউট,
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
শতাধিক গ্রন্থের লেখক।
জার্মানীতে থাকেন।
1 মন্তব্যসমূহ
খুব প্র্যাকটিক্যাল। সাবলীল ভাষা। অভিবাদন লেখকের জন্য।
উত্তরমুছুন