আর্নেস্ট হেমিংওয়ে'র গল্প : সুখের পিছু নিয়ে


ভাষান্তর: জ্যোতির্ময় নন্দী

সে-বছর আমরা কিউবার উপকূলের অদূরে মাসখানেকের জন্যে মার্লিন মাছ ধরার পরিকল্পনা করেছিলাম। আমাদের মাস গণনা শুরু হয়েছিলো এপ্রিলের দশ তারিখ, এবং মে মাসের দশ তারিখে পৌঁছুতে পৌঁছুতে আমরা পঁচিশটা মার্লিন ধরলাম এবং আমাদের সময়ও শেষ হয়ে গেলো। এখন আমাদের করণীয় হলো ‘কী ওয়েস্ট’-এ নিয়ে যাওয়ার জন্যে কিছু উপহার কেনা এবং অ্যানিটাকে দামী কিউবান গ্যাস দিয়ে প্রয়োজনের চেয়ে আরেকটু বেশি করে ভর্তি করা, ওটাকে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করা, আর তারপর বাড়ি ফিরে যাওয়া। কিন্তু বড় আকারের মাছগুলোর দৌঁড় এখনও শুরু হয় নি।

“আরো মাসখানেকের জন্যে নৌকোটা ভাড়া নিয়ে চেষ্টা করবেন নাকি, ক্যাপ (‘ক্যাপ্টেন’-এর সংক্ষিপ্ত রূপ: অনুবাদক)?” জোসি সাহেব জিজ্ঞেস করলেন। উনিই হলেন অ্যানিটার মালিক, এবং দৈনিক দশ ডলারে তিনি এটাকে ভাড়া দিয়ে থাকেন। ওই সময়ে প্রচলিত দৈনিক ভাড়া ছিলো পঁয়ত্রিশ ডলার। “নিতে চাইলে আমি আপনাকে দৈনিক নয় ডলারে ছেড়ে দিতে পারি।”

“ওই নয় ডলারই-বা আমি পাবো কোথায়?”

“আপনি যখন পাবেন তখন দেবেন। খাঁড়ির ওপাড়ে বেলটের স্ট্যান্ডার্ড অয়েল কোম্পানিতে আপনার একটা ভালো খাতির আছে, এবং আমরা বিল পেলে গত মাসের ভাড়ার টাকা থেকে শোধ করতে পারবো। আবহাওয়া খারাপ হয়ে পড়লে তখন আপনি কিছু লেখালেখিও করতে পারেন।”

“ঠিক আছে,” আমি বললাম, এবং আরো একটা মাস মাছ ধরে কাটালাম। বিয়াল্লিশটা মার্লিন ধরলাম আমরা এবং তখনও বড় মাছগুলো আসে নি। মরো’র কাছাকাছি একটা কালো, ভারী স্রোত আছে-- কখনো কখনো সেখানে একরের পর একর জুড়ে থাকে অসংখ্য টোপ। এ ছাড়া আছে উড়–ক্কু মাছ, যেগুলো নৌকার গলুইয়ের নিচে থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে ওঠে আর পাখিরা সারাক্ষণ তাদের ধরে ধরে খাওয়ার কাজে ব্যস্ত থাকে। কিন্তু বিশাল মার্লিনগুলোর একটাও ধরি নি আমরা, যদিও সাদা মার্লিন রোজই ধরছি আমরা, কিংবা হারাচ্ছি। একদিন তো আমরা পাঁচ-পাঁচটা মার্লিন ধরে ফেললাম।

পুরো উপকূল জুড়ে সর্বত্র আমরা খুব জনপ্রিয় ছিলাম। কারণ আমাদের ধরা মাছগুলো আমরা কেটেকুটে সবার মধ্যে বিলিয়ে দিতাম। জাহাজে মার্লিন মাছচিহ্নিত ঝান্ডা তুলে মরো ক্যাসল ছাড়িয়ে খাঁড়ি ধরে সান ফ্রান্সিসকোর জাহাজঘাটার দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময় দেখতে পেতাম, দলে দলে মানুষ ছুটতে ছুটতে ঘাটের দিকে এগিয়ে আসতে শুরু করে দিয়েছে। সে-বছর জেলেরা প্রতি পাউন্ড মার্লিন মাছ বিক্রি করছিলো আট থেকে বারো সেন্টে, এবং বাজারদর ছিলো এর দ্বিগুণ। যেদিন আমরা পাঁচটা ঝান্ডা উড়িয়ে এলাম, সেদিন লোকের ভিড় সামলাতে পুলিসকে লাঠি চালাতে হয়েছিলো। এটা ছিলো খুব বিশ্রী আর খারাপ একটা দৃশ্য। তবে সেবার ডাঙায় বছরটাও ছিলো বড় খারাপ।

“শালার পুলিস আমাদের রোজকার খদ্দেরদের তাড়িয়ে দিয়ে সব মাছ নিয়ে নিচ্ছে,” জোসি সাহেব বললেন। “জাহান্নামে যাও,” দশ পাউন্ডের একটুকরো মার্লিন নিতে নেমে আসতে থাকা একজন পুলিসকে তিনি বললেন। “এরকম কুচ্ছিত চেহারা জন্মে দেখি নি! নাম কী তোমার?”

পুলিসটা তার নাম বললো।

“এর নাম কম্প্রমিসো বইয়ে আছে, ক্যাপ?”

“নাহ্।”

কম্প্রমিসো বই হলো আমরা যাদের মাছ দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছি তাদের নাম লিখে রাখার একটা খাতা। “আগামী হপ্তায় ছোট একটা টুকরো দেয়ার জন্যে এর নাম লিখে রাখুন, ক্যাপ,” জোসে সায়েব বললেন। “এখন, বাবা পুলিস, এখান থেকে সোজা জাহান্নামে চলে যাও আর যারা আমাদের বন্ধু না তাদেরকে আচ্ছা করে পেটাওগে তো দেখি। জীবনে আমি তোমার মতো পুলিস ঢের দেখেছি। বিদেয় হও। যদি ডক পুলিস না হও, তবে তোমার লাঠি আর পিস্তল নিয়ে শিগগির এখান থেকে কেটে পড়ো।”

শেষপর্যন্ত আমরা সব মাছ কেটেকুটে খাতার লেখা অনুযায়ী ভাগজোক করে দিলাম এবং খাতাটা ফের ভরে উঠলো পরের সপ্তাহে যাদেরকে মাছ দেবো বলে কথা দিলাম তাদের নামে।

“এখন আপনি আম্বোস মুন্ডোস পর্যন্ত গিয়ে ধোয়াপাখলা করে নিন, ক্যাপ। স্নান করে নেবেন এবং আমি সেখানে আপনার সঙ্গে দেখা করবো। তারপর আমরা ফ্লোরিডিটা গিয়ে সবকিছু আলোচনা করবো। ওই শালার পুলিসটা আমার মাথা গরম করে দিয়েছে।”

“আপনিও চলুন আমার সঙ্গে গিয়ে স্নানট সেরে নেবেন।”

“না, আমি এখানেই সাফসুতরো হয়ে নিতে পারবো। আপনি আজ যেভাবে ঘেমেছেন, আমি অতটা ঘামি নি।”

তাই আমি খোয়া বাঁধানো সংক্ষিপ্ত পথটা দিয়ে আম্বুস মুন্ডোস হোটেলে পৌঁছে অভ্যর্থনা ডেস্কে খুঁজে দেখলাম, আমার নামে কোনো ডাক এসেছে কিনা। তারপর এলিভেটরে গিয়ে উঠলাম সর্বোচ্চ তলায়। আমার কামরাটি ছিলো উত্তর-পূর্ব কোণে। জানলাগুলো দিয়ে সারাদিন আয়নবায়ু প্রবাহিত হয়ে কামরাটাকে ঠান্ডা রাখতো। জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখতে পাচ্ছিলাম শহরের পুরোনো অংশের বাড়ির ছাদগুলো, আর তারপর পোতাশ্রয় ছাড়িয়ে আরো দূরে যেখানে ‘ওরিজাবা’ নামের জাহাজটা তার সবগুলো বাতি জ্বলিয়ে দিয়ে ধীরে ধীরে পোতাশ্রয় থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। সারাদিন অত মাছ নিয়ে কাজ করে আমার খুব ক্লান্ত লাগছিলো। ভাবছিলাম, শুয়ে পড়বো। কিন্তু আমি এও জানতাম, বিছানায় গা রাখার সঙ্গে সঙ্গেই হয়তো আমি ঘুমিয়ে পড়বো। তাই না শুয়ে বিছানায় বসে বসে জানলা দিয়ে দেখতে লাগলাম কেমন করে বাদুড়গুলো শিকার করছে। অবশেষে পোশাক খুলে স্নান করে ধোয়া কাপড়চোপড় পরে নিচের তলায় নামলাম। জোসি সায়েব তখন হোটেলের দরজায় অপেক্ষা করছিলেন।

“আপনি নিশ্চয় খুব ক্লান্ত, আর্নেস্ট?” উনি বললেন।

“না,” মিথ্যে করে বললাম আমি।

“আমি ক্লান্ত,” উনি বললেন। “শুধু আপনার মাছ টেনে তোলা দেখতে দেখতেই। “ওগুলো হলো আমাদের সর্বকালীন রেকর্ড থেকে মাত্র দুটো কম। সাতটা এবং অষ্টম আরো একটার চোখ।” অষ্টম মাছটার চোখ সম্পর্কে জোসি সায়েব বা আমি কেউই ভাবতে চাইতাম না, তবু ওই রেকর্ডটা আমরা সবসময় এভাবেই বলতাম।”

ওবিস্পো স্ট্রিটের ফুটপাত দিয়ে আমরা হেঁটে যাচ্ছিলাম। জোসি সায়েব রাস্তাটার পাশের সবগুলো দোকানের আলোকিত জানলার দিকে তাকাচ্ছিলেন। বাড়ি যাওয়ার সময় না হওয়া পর্যন্ত তাঁকে আমি কখনও কিছু কিনতে দেখি নি। কিন্তু দোকানে দোকানে বিক্রির জন্যে রাখা সবকিছু দেখতে তিনি খুব পছন্দ করতেন। আমরা শেষ দুটো স্টোর এবং লটারি অফিস পেরিয়ে গিয়ে পুরোনো ফ্লোরিডিটা’র দোলন দরজা টেলে ভেতরে ঢুকলাম।

“আপনি বরং বসে পড়লেই ভালো করবেন, ক্যাপ,” জোসি সায়েব বললেন।

“না, এখানে বারে দাঁড়িয়ে থাকতেই ভালো লাগছে।”

“বিয়ার,” জোসি সায়েব বললেন, “জার্মান বিয়ার। আপনি কী নিয়েছেন, ক্যাপ?”

“চিনি মেশানো বরফঠান্ডা দাইকিরি (রাম আর লেবুর রসের ককটেল: অনুবাদক)।”

কনস্তান্ত দাইকিরিটা বানানোর পর আরো দুটো বানানোর মত জিনিস মিক্সারে রয়ে গেলো। জোসি সায়েব কখন প্রসঙ্গটা তুলবেন, তার জন্যে জন্যে অপেক্ষা করছিলাম আমি। তাঁর বিয়ার এসে পৌঁছার সাথে সাথে তিনি বলতে শুরু করলেন।

“কার্লোস বললো আগামী মাসে ওদেরকে আসতেই হবে,” উনি বললেন। কার্লোস হলো আমাদের কিউবান সঙ্গী এবং একজন বিরাট বাণিজ্যভিত্তিক মার্লিন ধরিয়ে। “সে বলে অমন একটা স্রোত সে জীবনে দেখে নি এবং যখন ওরা আসে তখন এমন একটা দৃশ্যের সৃষ্টি হয় যেমনটা আমরা কথনো দেখি নি। সে বললো ওদেরকে আসতেই হবে।”

“আমাকেও সে ওকথা বলেছে।”

“আরো একটা মাস যদি আপনি চেষ্টা করেন, ক্যাপ, তবে আমি দিনে আট ডলার ভাড়া নেবো এবং স্যন্ডউইচের পেছনে আপনার টাকা নষ্ট করার বদলে বরং আপনার খাবার রান্নার কাজটাও চাইলে করে দিতে পারবো। দুপুরের খাওয়ার জন্যে আমরা খাঁড়িতে যাবো এবং সেখানেই রান্না করবো। আমরা তো সবসময়ে ওই ঢেউ খেলানো ডোরা কাটা বনিটো মাছগুলো পাচ্ছি। ওগুলো খেতে ছোট টুনা মাছের মতোই সুস্বাদু। কার্লোস বললো, টোপ কেনার জন্যে বাজারে গেলে আমাদের জন্যে সস্তায় মদ কিনে আনতে পারবে। তারপর আমরা রাতের খাবার খাবো সান ফ্রান্সিস্কো রেস্তোরাঁর পার্লা-য়। গত রাতে আমি ওখানে মাত্র পঁয়ত্রিশ সেন্ট খরচ করে খুব ভালো খেয়েছি।”

“আমি গত রাতে না খেয়ে টাকা বাঁচিয়েছি।”

“আপনাকে খেতে হবে, ক্যাপ। এজন্যেই আপনাকে আজ একটু ক্লান্ত দেখাচ্ছে।”

“জানি। কিন্তু আপনি সত্যিই আরো একমাস চেষ্টা করতে চান?”

“আরো একমাস জাহাজটার দিকপরিবর্তন না করে থাকা যাবে। বড় মাছগুলো যখন আসছে, কেন আমরা মাঝপথে ছেড়ে যাবো?”

“আপনার করার মতো আর কিছু আছে?”

“না। আপনার?”

“আপনি কি মনে করেন ওরা সত্যিই আসবে?”

“কার্লোস বলেছে ওদেরকে আসতেই হবে।”

“তারপর ধরুন আমাদের বঁড়শিতে একটা আটকালো, কিন্তু আমাদের যে-সুতো আছে তাতে ওটাকে সামলাতে পারলাম না।”

“আমাদের সামলাতেই হবে। ভালো খাওয়াদায়য়া করলে আপনি ওটার সঙ্গে চিরদিন থাকতে পারবেন। আর আমরা খাওয়াদাওয়াটা ভালোই করবো। তবে আমি অন্য একটা কথা ভাবছি।”

“কী?”

“যদি আপনি রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমোতে যান আর কোনো মৌজমস্তি না করেন, তাহলে আপনি দিনের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গেই জেগে উঠে লেখালেখি শুরু করে দিতে পারেন। সকাল আটটার মধ্যে আপনার দিনের কাজ শেষ হয়ে যেতে পারে। ততক্ষণে আমি আর কার্লোস যাত্রা শুরুর সব প্রস্তুতি সেরে রাখবো এবং আপনি শুধু জাহাজে উঠে পড়বেন।”

“ঠিক আছে,” আমি বললাম, “কোনো মৌজমস্তি করবো না।”

“ওসব মৌজমস্তি আপনাকে ক্লান্ত করে ফেলে, ক্যাপ। তবে আমি একদম করতে বলছি না, তা কিন্তু নয়। ওটা আপনি শনিবার রতের জন্যে তুলে রাখবেন।”

“বেশ,” আমি বললাম, “শুধু শনিবার রাতেই মৌজমস্তি করবো। তা এখন আমাকে কী লিখতে বলছেন।”

“সেটা আপনার ব্যাপার, ক্যাপ। আমি ওতে নাক গলাতে চাই না। আপনি যখনই লেখেন, ভালোই লেখেন।”

“আপনি কী পড়তে চান?”

“আপনি ইউরোপ বা আমাদের পশ্চিম নিয়ে বা যখন আপনি আলসেমিতে সময় কাটাচ্ছিলেন বা যুদ্ধে ছিলেন বা ওরকম সব ব্যাপার নিয়ে কিছু ভালো ছোটগল্প লিখছেন না কেন? শুধু আপনি আর আমি জানি এমন জিনিসগুলো নিয়েও তো একটা গল্প লিখতে পারেন। অ্যানিটা থেকে যা যা দেখেছি তা নিয়েও তো একটা লিখতে পারেন। তার মধ্যে আপনি অনেক মৌজমস্তির কথা ঢোকাতে পারেন যাতে গল্পটা সবার ভালো লাগে।”

“এখন থেকে মৌজমস্তিতে আমি ক্ষান্ত দিচ্ছি।”

“নিশ্চয়, ক্যাপ। কিন্তু অনেক মৌজমস্তির কথা তো আপনার স্মরণে আছে। এখন ক্ষান্ত দিলে তাতে আপনার কোনো ক্ষতি হবে না।”

“না,” আমি বললাম। “ধন্যবাদ জোসি সায়েব। কাল সকালে আমি কাজ শুরু করবো।”

“মনে হচ্ছে, নতুন নিয়মে কাজ শুরু করার আগে আপনার উচিত হবে বড় একটা রেয়ার স্টেক (স্বল্পপক্ক মাংসের পুরু ফালি: অনুবাদক) খেয়ে নেয়া, যাতে কালকে আপনি কাজ করার ইচ্ছে নিয়ে জেগে ওঠেন আর মাছ ধরার জন্যে যথেষ্ট শক্তি পান। কার্লোস বলেছে, বড় মাছগুলো এখন যেকোনো সময় এসে পড়বে। ক্যাপ, ওদের মোকাবেলার জন্যে আপনাকে এখন সর্বতোভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে।”

“আপনি কি মনে করছেন এই দাইকিরি আরেকটা নিলে আমার কোনো ক্ষতি হবে?”

“দূর, না না, ক্যাপ। ওটার মধ্যে তো শুধু রাম আর সামান্য লেবুর রস আর মারাশিনো (চেরি থেকে তৈরি একধরনের কালো মদ: অনুবাদক) ছাড়া কিছু নেই। ওতে মানুষের কোনো ক্ষতি হয় না।”

ঠিক ওই সময়ে আমাদের চেনা দুটো মেয়ে এসে পানশালায় ঢুকলো। খুব সুন্দর মেয়ে দুটো এবং সেই সন্ধ্যায় তাদেরকে একদম তরতাজা দেখাচ্ছিলো।

“সেই জেলে দুটো,” ওদের একজন স্প্যনিশে বললো।

“সাগর থেকে আসা দুজন বড়সড়, শক্তসমর্থ জেলে,” অন্য মেয়েটা বললো।

“মৌমবা,” জোসি সায়েব আমাকে বললেন।

“মৌজমস্তি বাদ,” আমি নিশ্চিত করলাম।

“তোমরা সাংকেতিক ভাষায় কথা চালাচালি করছো?” মেয়ে দুটোর একজন বললো। সে ভীষণ রকমের সুন্দর একটা মেয়ে এবং তার চেহারায় সামান্য ত্রুটি আপনার চোখে পড়বে না, যেখানে তার আগেকার কোনো বন্ধুর দক্ষিণ হস্ত তার যথেষ্ট সুন্দর নাকটার রেখার শুদ্ধতা নষ্ট করে দিয়েছে।

“ক্যাপ আর আমি কিছু দরকারি কথা বলছিলাম,” মেয়ে দুটোকে জোসি সায়েব বললেন। সঙ্গে সঙ্গেই তারা পানশালার অন্য প্রান্তে সরে গেলো। “দেখলেন, কত সহজ এটা? এসব মৌজমস্তির হাতছানি ঠেকানোর কাজটা আমি সামলাবো। আপনার কাজ হবে সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে লিখতে বসে যাওয়া এবং মাছ ধরার জন্যে গায়েগতরে ঠিক থাকা। বড় বড় মাছ। হাজার পাউন্ডের ওপরে যাবে এমনসব মাছ।”

“কাজটা আমরা বদলাবদলি করে নিই না কেন,” আমি বললাম। “আমি মৌজমস্তির দিকটা সামলাবো, আর আপনি ভোরবেলা উঠে কিছু লেখালেখি করবেন, আর হাজার পাউন্ডেরও বেশি হতে পারে এমনসব বড় বড় মাছ ধরার জন্যে গায়েগতরে ঠিক থাকবেন।”

“করতে পারলে ভালোই লাগতো, ক্যাপ,” জোসি সায়েব গম্ভীরভাবে বললেন। “কিন্তু আমাদের দুজনের মধ্যে আপনিই শুধু লিখতে পারেন। আর আমাদের দুজনের মধ্যে আপনিই বয়সে ছোট এবং মাছ ধরার কাজে পটু। আমি নৌকায় থাকছি ওটাকে আমার মতো করে চালানোর জন্যে, যাতে ইঞ্জিনটা বিগড়ে না যায়।

“জানি,” আমি বললাম। “আমিও ভালো করে লেখার চেষ্টা করবো।”

“আমি আপনাকে নিয়ে বড়াই করতে চাই,” জোসি সায়েব বললেন। “আর এ সাগরে সাঁতরে বেড়ানো ওই হতচ্ছাড়া মার্লিনগুলোর সবচেয়ে বড়টাকে ধরে সৎভাবে ওজন করে কেটেকুটে আমাদের চেনা গরিব মানুষগুলোকে দিয়ে দিতে চাই। দেশের কোনো শালার লাঠিবাজ পুলিসকে আমি একটা টুকরোও দিতে চাই না।”

“আমরা ওটা করবো।”

ঠিক তখনই পানশালার অন্য প্রান্ত থেকে মেয়ে দুটোর একটা আমাদের উদ্দেশ্যে হাত নাড়লো। রাতটা এগোচ্ছিলো মন্থর গতিতে এবং ওখানে তখন আমরা ছাড়া আর কেউ ছিলো না।

“মৌমবা,” জোসি সায়েব বললেন।

“মৌমবা,” আমিও বললাম, মন্ত্রপাঠ অনুসরণের মতো।

“কনস্তান্ত্,” জোসি সায়েব ডাক দিলেন, “আর্নেস্তোর কাছে একজন ওয়েটার পাঠাও। আমরা দুটো বড় রেয়ার স্টেকের অর্ডার দেবো।”

কনস্তান্ত্ হাসলো। তারপর আঙুল তুলে ইশারা করলো একজন ওয়েটারকে।

মেয়ে দুটোর পাশ দিয়ে আমরা যখন খাওয়ার ঘরের দিকে যাচ্ছিলাম, ওদের একজন হাত বাড়িয়ে দিলে আমি তার সঙ্গে করমর্দন করে গুরুগম্ভীরভাবে ফিসফিসিয়ে স্প্যানিশ ভাষায় বললাম, “মৌমবা।”

“হায় ভগবান,” অন্য মেয়েটা বললো। “এমন একটা বছরে এরা রাজনীতিতে নেমেছে!” তাদের যথেষ্ট প্রভাবিত এবং সামান্য ভীতও মনে হচ্ছিলো।

সকালে খাঁড়ির ওপার থেকে দিনের প্রথম আলো এসে আমাকে জাগিয়ে তুললো। উঠে একটা ছোটগল্প লিখতে শুরু করলাম, যেটা জোসি সায়েবের ভালো লাগবে বলেই আশা করছিলাম। গল্পটায় অ্যানিটা, উপকূলীয় অ ল, এবং যেসব জিনিস ঘেেটছে বলে আমরা জানি সেগুলো ছিলো। গল্পটায় আমি সাগর আর প্রতিদিন যেসব জিনিস আমরা দেখেছি, ঘ্রাণ পেয়েছি, শুনেছি এবং অনুভব করেছি সেই অনুভূতিগুলোকে ঢোকানোর চেষ্টা করছিলাম। প্রতিদিন সকালে একটু একটু করে গল্পটাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলাম, প্রতিদিন মাছ ধরতেও যাচ্ছিলাম এবং ভালোই ধরছিলাম। মাছ ধরার প্রশিক্ষণ আমি ভালোই নিয়েছিলাম। চেয়ারে বসে থাকার পরিবর্তে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমি সব মাছের দিকে নজর রাখতাম। কিন্তু বড় মাছগুলো তখনও এসে পৌঁছে নি।

একদিন একটা মার্লিন মাছকে দেখলাম বাণিজ্যিক জেলেদের একটা ডিঙ্গিনৌকা টেনে নিয়ে আসতে। নৌকাটা গলুইয়ের দিকে নুয়ে গিয়েছিলো আর মার্লিনটা লাফিয়ে লাফিয়ে জল ছিটিয়ে ছুটছিলো একটা স্পিডবোটের মতো। ছিপের সুতো ছিঁড়ে পালিয়ে গিয়েছিলো ওই মাছটা। আরেকদিন অঝোর ধারায় বৃষ্টির মধ্যে আমরা দেখলাম, চারজন মানুষ চওড়া আর গভীর আর কালচে বেগুনি রঙের একটাকে ডোঙায় তুলছে। মার্লিনটার ওজন ছিলো পাঁচশ পাউন্ড। ওটা থেকে কাটা বিশাল সব ফালি আমি পুরোনো বাজারের মার্বেল পাথরের ফলকটার ওপর রাখা অবস্থায় দেখেছি।

তারপর এক রোদে ভরা দিনে এক গভীর কালচে প্রবাহে জলটা এত স্বচ্ছ ছিলো যে, পোতাশ্রয়ের মুখে দশ ফ্যাদম গভীরে মাছের ঝাঁকগুলো পযৃন্ত পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিলো। সেদিন আমরা মরোর ঠিক বাইরেটায় আমাদের প্রথম বড় মাছটা ধরলাম। তখনকার দিনে পাল খাটানোর দ- বা দ-ধারক বলতে কিছুই ছিলো না, এবং আমি একটা রশি ঢিলে করে দিচ্ছিলাম প্রণালীতে একটা কিংফিশ ধরার আশা নিয়ে, আর ঠিক তখনই সে টোপ গিললো। মাছটা লাফিয়ে একটা ঢেউয়ের মাথায় উঠে এলো, এবং তার ঠোঁটটাকে দেখাচ্ছিলো করাত দিয়ে চিরে ফেলা একটা বিলিয়র্ড খেলার লাঠির মতো। ঠোঁটের পেছনে তার মাথাটাকে দেখাচ্ছিলো বিশাল আর তাকে দেখতে ছিলো একটা ডিঙ্গিনৌকার মতো চওড়া। তারপর সে বঁড়শির সুতোটাকে নৌকার সমান্তরালে টেনে নিয়ে আমাদের পাশ দিয়ে তীব্র বেগে চলে গেলো। হুইলটা থেকে এত দ্রুতবেগে সুতো বেরিয়ে যাচ্ছিলো যে, ওটা গরম হয়ে উঠলো। হুইলে চারশো গজ সুতো ছিলো এবং আমি অ্যানিটার গলুইয়ে যেতে যেতে তার অর্ধেকই বেরিয়ে গেলো।

নৌকার ঘরটার মাথায় আমাদের বানানো রেলিঙ চেপে ধরে ধরে আমরা কোনোমতে সেখানে গিয়ে পৌঁছলাম। আমরা এভাবে দৌঁড়ে এবং হামাগুড়ি দিয়ে সামনের ডেকে যাওয়াটা অভ্যাস করে নিয়েছিলাম। সেখান থেকে আমরা পা দিয়ে নৌকার গলুইয়ের সামনের দিকটা আঁকড়ে ধরে থাকতে পারতাম। কিন্তু অভ্যাস থাকলেও সেটা স্থানীয় কোনো একটা ছোট স্টেশানে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় পাশ দিয়ে প্রচ- বেগে একটা এক্সপ্রেস ট্রেন বেরিয়ে যাওয়ার মতো একটা বিশাল মাছ আমাদের পাশ কাটিয়ে যাওয়া অবস্থায় নয়। তার ওপর এক হাতে ধরে ছিলাম ছিপটা, যেটার মোটা গোড়াটা লাফাচ্ছিলো আর গুঁতোচ্ছিলো ওটা রাখার জন্যে বানানো হাড়িকাঠের মতো কাঠামোটাতে। অন্য হাতটা আর খালি দু পায়ে নৌকার রেলিঙে প্রাণপণে ঠেকনা দিয়ে ঠেকানোর চেষ্টা করছিলাম মাছটার প্রচ- টানে আমার সামনে জলে ছিটকে যাওয়াটা।

“ওকে গেঁথে ফেলুন, জোসি!” আমি চেঁচিয়ে বললাম। “সব সুতো নিয়ে যাচ্ছে সে।”

“গাঁথা হয়ে গেছে, ক্যাপ। ওই দেখুন!”

ততক্ষণে আমি আমার এক পায়ে চেপে আছি অ্যানিটার গলুইয়ে, এবং আরেক পায়ে আঁকড়ে রেখেছি স্টারবোর্ড নোঙরটা। কার্লোস আমার কোমর জড়িয়ে ধরে রেখেছিলো আর মাছটা আমাদের চোখের সামনে, একটু দূরে লাফাচ্ছিলো। উজ্জ্বল রোদে তাকে রূপোলি দেখাচ্ছিলো আর আমি তার দেহের পার্শ্বভাগে বেগুনি ডোরাগুলো দেখতে পাচ্ছিলাম। প্রতিবার লাফিয়ে উঠে ফের ঝপাং করে জলে পড়ার সময় সে আওয়াজ তুলছিলো খাড়া পাহাড়ের গা থেকে খসে পড়া ঘোড়ার মতো, এবং সে লাফের পর লাফ দিয়েই চলেছিলো। ছিপের হুইলটা এত গরম হয়ে উঠেছিলো যে ওটাকে ধরা যাচ্ছিলো না, এবং ওটাতে জড়ানো সুতোর স্তর ক্রমশ পাতলা থেকে আরো পাতলা হয়ে আসছিলো, অ্যানিটা পূর্ণ বেগে মাছটার পেছু নেয়া সত্ত্বেও।

“ওটা থেকে আর কিছু সুতো ছাড়িয়ে নিতে পারবেন?” জোসি সায়েবকে হেঁকে জিজ্ঞেস করলাম।

“কোনো উপায় দেখছি না,” উনি বললেন, “আপনার হুইলে আর কতটুকু বাকি আছে?”

“নেই বললেই চলে।”

“সে বড় বটে!” কার্লোস বললো, “এত বড় মার্লিন জীবনে দেখি নি! এখন বেটা যদি একটু থামতো, পানির নিচে একটু ডুব দিতো, তাহলে আমরা ওটার ওপর গিয়ে পড়তাম, আর আপনিও আপনার হুইলে অনেক সুতো আবার গুটিয়ে নিতে পারতেন।”

মাছটা তার প্রথম দৌঁড়টা দিয়েছিলো মরো ক্যাসলের অদূরে থেকে ন্যাশনাল হোটেলের উল্টোদিক পর্যন্ত। তার মানে আমরা তখন মোটামুটি ওটুকুই গিয়েছিলাম। তারপর হুইলে যখন আর কুড়ি গজ সুতোও বাকি নেই, হঠাৎ করে সে থেমে গেলো এবং আমরা তার উপর গিয়ে পড়লাম, সারাক্ষণ সুতো গোটাতে গোটাতে। আমার মনে আছে ওই সময়ে আমাদের সামনে একটু দূরে গ্রেস লাইনের একটা জাহাজ ছিলো। আমরা দেখতে পাচ্ছিলাম, কালো রঙের পাইলট বোটটা ছুটে যাচ্ছে জাহাজটার দিকে, এবং ওটা যতই এগিয়ে আসছিলো আমরা ভয় পাচ্ছিলাম তার চলার পথের ওপর গিয়ে পড়ি কিনা। তারপর আমার মনে পড়ছে ক্রমশ গতি বাড়াতে থাকা জাহাজটার দিকে চোখ রেখে ছিপের হুইলে সুতো গুটোতে গুটোতে নৌকাটার পেছনের দিকে ফিরে যাওয়ার চেষ্টার কথা। শেষপর্যন্ত জাহাজটা অবশ্য আমাদের যাত্রাপথের অনেক বাইরে দিয়েই বেরিয়ে গেলো এবং পাইলট বোটটাও আমাদের কোনো অসুবিধে করলো না।

এখন আমি চেয়ারে বসে ছিলাম এবং মাছটা সোজা আমার সামনাসামনি লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছিলো আর জলে পড়ছিলো। অতিরিক্ত ঘূর্ণনে তপ্ত হয়ে ওঠা হুইলটা ঠান্ডা করার জন্যে কার্লোস সেটাতে কিছু সমুদ্রজল ঢেলে দিলো, এবং আমার মাথায় আর কাঁধেও ঢেলে দিলো একবালতি।

“কেমন চলছে সব, ক্যাপ?” জোসি সায়েব জিজ্ঞেস করলেন।

“ভালো।”

“গলুইয়ে যাওয়ার সময় চোট পান নি তো?”

“না।”

“আচ্ছা, আপনি কি কখনো ভেবেছেন এমন একটা মাছ আছে?”

“না।”

“গ্রন্দ্, গ্রন্দ্ (মস্ত বড়),” কার্লোস সমানে চেঁচিয়ে যাচ্ছিলো। একটা শিকারসঙ্গী কুকুরের মতোই উত্তেজনায় কাঁপছিলো সে-- ভালো একটা কুকুর, যে কিনা শিকারি গুলি করার সঙ্গে সঙ্গে ছুটে গিয়ে গুলিবিদ্ধ পাখিটি কুড়িয়ে আনে। “জীবনে কক্ষণো আমি এত বড় মাছ দেখি নি। কখনো না। কখনো না। কখনো না।”

এর পর এক ঘণ্টা কুড়ি মিনিটের মতো আমরা মাছটাকে দেখি নি। স্রোত ছিলো খুবই জোরালো। সেটা আমাদেরকে টেনে নিয়ে গেলো কোজিমারের বিপরীত দিকে, প্রথম যেখানে মাছটা আওয়াজ দিয়েছিলো সেখান থেকে ছ’মাইল দূরে। আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম, কিন্তু আমার হাত আর পা তখনও ভালো অবস্থায় ছিলো। বলতে গেলে এখন আমি একটানাই সুতো গুটিয়ে চলেছিলাম, খুব সাবধানে যাতে মাছটা হঠাৎ করে কড়া টান বা ঝাঁকুনি না খায়। এখন আমি ওটাকে নাড়াতে পারছিলাম। কাজটা সহজ ছিলো না। কিন্তু সুতোটাকে টান খেয়ে ছিঁড়ে যাওয়ার ঠিক আগেকার অবস্থাটায় রাখলে এটা করতে পারা যায়।

“সে আবার ওপরে উঠে আসছে,” কার্লোস বললো। “বড় বড়গুলো মাঝে মাঝে এরকম করে, যখন ওরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই আপনি ওদের কোঁচ দিয়ে গেঁথে ফেলতে পারেন।”

জিজ্ঞেস করলাম, “সে এখন উপরে আসছে কেন?”

“সে হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছে,” কার্লোস বললো। “আর আপনিই এখন ওকে চালাচ্ছেন। অবস্থাটা সে কিছুই বুঝতে পারছে না।”

“তাকে বুঝতে দেয়ার দরকারও নেই,” আমি বললাম।

“কাটাকোটার পরও ওজন নয়শ পাউন্ডের বেশি হবে,” কার্লোস বললো।

“ওনার কানের কাছে বকবকানিটা থামাও,” জোসি সায়েব বললেন। “ওটাকে নিয়ে আপনি অন্যরকম কিছু তো করতে চান না, ক্যাপ?”

“না।”

আমরা তাকে প্রথম দেখার সঙ্গে সঙ্গেই বুঝতে পেরেছিলাম সে কত বড়। এটা যে ভয় পেয়ে যাওয়ার মতো কিছু ছিলো তা কিন্তু নয়। কিন্তু বিস্ময়ে হা করে দেয়ার মতোই। আমরা তাকে দেখলাম, বেগুনি রঙের বিশাল কাস্তের ফলার মতো তার সামনের পাখনা দুটো নিয়ে ধীর, শান্ত এবং প্রায় অনড়ভাবে ভেসে থাকতে। তারপর সে আমাদের নৌকাটা দেখতে পেলো এবং সঙ্গে সঙ্গেই ছিপের হুইল থেকে সুতো বেরিয়ে যেতে লাগলো যেন ওটাকে কোনো মোটরগাড়ির সঙ্গে বেঁধে দেয়া হয়েছে। এর পর সে লাফাতে লাফাতে ছুটে চললো উত্তর-পশ্চিমদিকে। তার প্রতিটি লাফে সমুদ্রের জল ছিটকে উঠে চারপাশে ছড়িয়ে যাচ্ছিলো।

আমাকে আবার গলুইয়ের দিকে যেতে হলো, এবং যতক্ষণ তার শব্দ শোনা গেলো আমরা তাকে ধাওয়া করে চললাম। এবার সে গেলো মরো’র প্রায় উল্টোদিকে। তখন আমি আবার কোনোমতে নৌকার হালের দিকে চলে এলাম।

“একটু পান করবেন, ক্যাপ?” জোসি সায়েব জিজ্ঞেস করলেন।

বললাম, “না। তার চেয়ে বরং কার্লোসকে বলুন হুইলটায় একটু তেল দিতে এবং দেয়ার সময় যেন তেল চলকে না পড়ে, আর আমার ওপর আরেক বালতি নোনাজল ঢেলে দিন।”

আপনাকে আরকিছু কি সত্যিই দোবো না, ক্যাপ?” জোসি সায়েব জিজ্ঞেস করলেন।

“নতুন দুটো হাত আর একটা পিঠ,” আমি বললাম। “শুয়োরের বাচ্চাটা শুরুতে যেমন ছিলো এখনো সেরকম তরতাজা। গায়ের বল একটুও পড়েছে বলে মনে হয় না।”

পরের বার আমরা তাকে দেখলাম পাক্কা দেড়ঘণ্টা পর। কোজিমার ছাড়িয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলো সে। লাফিয়ে লাফিয়ে আবার এমন জোরে সে ছুটতে লাগলো যে, টান সামলানোর জন্যে আমাকে আবার গলুইয়ে যেতে হলো। পেছনে হালের কাছে এসে যখন চেয়ারে বসার সুযোগ পেলাম, জোসি সায়েব বললেন, “ওকে এখন কেমন মনে হচ্ছে, ক্যাপ?”

“একদম একই রকম রয়ে গেছে। কিন্তু ছিপটার অবস্থা খুব খারাপ হয়ে পড়েছে।”

ছিলা পুরোপুরি টানা একটা ধনুকের মতো বেঁকে গিয়েছিলো ছিপটা। কিন্তু এখন ওঠানোর পর দেখতে পাচ্ছি, ওটা আর পুরোপুরি সোজা হচ্ছে না।

“এখনও এটা পুরোপুরি শেষ হয়ে যায় নি,” জোসি সায়েব বললেন, “এটা দিয়েই ওই ব্যাটাকে সারাজীবন আটকে রাখতে পারবেন, ক্যাপ। আপনার মাথায় আরেকটু জল ঢালবো?”

“এখন না,” আমি বললাম। “ছিপটার কথা ভাবছি আমি। মাছটার বিশাল ওজন ওটার বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে।”

ঘণ্টাখানেক পর ধীরে ধীরে ভালোই কাছিয়ে আসছিলো মাছটা। মন্থর গতিতে বড় বড় বৃত্ত বানিয়ে সে আমাদের চারপাশে ঘুরপাক খাচ্ছিলো।

“ক্লান্ত হয়ে পড়েছে সে,” কার্লোস বললো। “এখন সে সহজেই চলে আসবে। বার বার লাফানোয় তার থলেগুলো হাওয়ায় ভর্তি হয়ে গেছে। এখন সে আর পানির খুব গভীরে যেতে পারবে না।

“ছিপটা গেছে,” আমি বললাম, “ওটাকে এখন আর একদম সোজা করা যাবে না।”

কথাটা সত্য। ছিপটার আগা তখন নুয়ে গিয়ে জলকে ছুঁয়েছে। মাছটাকে ওঠাতে বা হুইলে সুতো গোটাতে যখনই ওটাকে তোলার চেষ্টা করছি, ওটার কোনো হেলদোলই হচ্ছে না। ওটা তখন আর ছিপ নেই, বরং সুতোরই একটা বাড়তি অংশ যেন। এখনও প্রতিবার ছিপটা ওঠালে কয়েক ইি সুতো গোটানো যাচ্ছিলো বটে, কিন্তু ওইটুকুনই, তার বেশি নয়। ধীর মন্থর গতিতে বৃত্ত বানিয়ে ঘুরছিলো মাছটা। বৃত্তের বাইরের প্রান্তের দিকে চলে গেলে হুইল থেকে সুতো বের করে নিয়ে যাচ্ছিলো সে। বৃত্তের ভেতরের দিকে সরে এলে আবার কিছু সুতো ফিরে পাওয়া যাচ্ছিলো। কিন্তু ছিপটা একদম বেঁকে যাওয়ায় মাছটাকে খেলানো সম্ভব হচ্ছিলো না। সত্যি বলতে গেলে, ওঠার ওপর আমার কোনো নিয়ন্ত্রণই ছিলো না।

“এটা তো খারাপ হলো, ক্যাপ,” জোসি সায়েবকে বললাম। আমরা পরস্পরকে অদলবদল করে ‘ক্যাপ’ বলে ডাকি। “সে যদি এখন জলের গভীরে গিয়ে মরতে চায় আমরা তো তাকে কখনো তুলতেই পারবো না।”

“কার্লোস বললো, সে ভেসে উঠছে। সে বলছে, ওটা লাফিয়ে লাফিয়ে এত বাতাস জমা করেছে যে এখন আর জলের গভীরে গিয়ে মরতে পারছে না। সে বলছে, বেশি লাফালে বড়গুলোর সবসময় এ অবস্থাই হয়। আমি গুণেছি-- ওটা লাফিয়েছে ছত্রিশ বার। আরো কয়েকবার আমার গুণতি থেকে বাদও পড়েছে হয় তো।”

জোসি সায়েবের মুখে এমন দীর্ঘ বক্তৃতা আগে কখনও শুনি নি, এবং শুনে আমি কথাটা সত্যি বলেই মনে করতে শুরু করেছিলাম। ঠিক তখনই বিশাল মাছটা নিচে, আরো নিচে যেতে শুরু করলো। হুইলের গায়ে দু হাত চেপে ধরে আমি ছিপটাকে কোনোমতে আটকে রাখছিলাম, সুতোটাকে রেখেছিলাম একেবারে টান টান প্রায় ছিঁড়ে যাওয়ার অবস্থায়, আর অনুভব করছিলাম সুতো বেরুতে থাকায় কিভাবে ঝাঁকুনি দিয়ে দিয়ে হুইলের ধাতব চাকা দুটো আমার আঙুলের নিচে ঘুরে যাচ্ছে।

“কত সময় গেছে?” জোসি সায়েবকে জিজ্ঞেস করলাম।

“ওর সঙ্গে আপনার কেটেছে তিন ঘণ্টা প াশ মিনিট।”

কার্লোসকে বললাম, “তুমি বোধহয় বলেছিলে, মরার জন্যে সে নিচে নামতে পারবে না।”

“হেমিংওয়ে, তাকে ওপরে উঠে আসতেই হবে। আমি জানি সে উঠে আসবেই।”

“কথাটা ওকে বলো,” আমি বললাম।

“ওনাকে খানিকটা জল খাওয়ার এনে দাও, কার্লোস,” জোসি সায়েব বললেন। “আপনি কথা বলবেন না, ক্যাপ।”

বরফঠান্ডা জলটা খেতে ভালোই লাগলো এবং খানিকটা জল আমি মুখ থেকে ছিটিয়ে দিলাম আমার দু হাতের কব্জিতে। পালের কোণা বাঁধার দড়িদড়ার ঘষায় আমার কাঁধের ছড়ে যাওয়া জায়গাগুলোতে ঘামের নুন লাগছিলো, কিন্তু রোদ এত তপ্ত ছিলো যে, রক্ত বেরুনো জায়গাগুলোতে কোনো জ্বালাই অনুভূত হচ্ছিলো না। এটা ছিলো জুলাই মাস এবং দুপেের সূর্যটা ছিলো ঠিক মাথার ওপর।

“ওনার মাথায় আরো কিছু নোনাজল দাও,” জোসি সায়েব বললেন, “একটুকরো স্পঞ্জ দিয়ে।”

ঠিক তখনই মাছটা আবার সুতো টানতে শুরু করলো। খানিকক্ষণ সে স্থিরভাবে ঝুলে রইলো; মনে হচ্ছিলো যেন মাছ না, বরং একটা ভারী, নিরেট কংক্রিটের থামকে গেঁথেছি আমাদের বঁড়শিতে। তারপর সে ধীরে ধীরে ভেসে উঠতে শুরু করলো। আমি সুতো গুটিয়ে নিচ্ছিলাম শুধুমাত্র আমার কব্জি ঘুরিয়ে, কারণ ছিপটাতে স্প্রিং বলতে কিছু আর অবশিষ্ট ছিলো না, এবং এটা একটা কাঁদুনে উইলো গাছের ডালের মতো নমনীয় হয়ে গিয়েছিলো।

মাছটা যখন জলের উপরিতল থেকে এক ফ্যাদম নিচে চলে এলো, আমরা ওটাকে দেখতে পাচ্ছিলাম-- গা ফুঁড়ে বেরিয়ে আসা বিরাট দুটো পাখনাসহ বেগুনি রঙের ডোরা কাটা লম্বা একটা ডিঙিনৌকার মতো। সে আমাদেরকে ঘিরে ধীরে ধীরে পাক খেতে লাগলো। আমি যদ্দূর সম্ভব তাকে টেনে রাখছিলাম, যাতে সে পাক খাওয়ার বৃত্তগুলো ছোট করে আনে। সুতোটাকে আমি ছিঁড়ে যাওয়ার ঠিক আগেকার চরম টান টান অবস্থায় নিয়ে এসেছিলাম, আর তখনই ছিপটা পুরোপুরি খতম হয়ে গেলো। না, কোনো তীক্ষè শব্দ করে বা হঠাৎ করে ওটা ভাঙে নি। স্রেফ নিঃশব্দে দু টুকরো হয়ে গেলো ওটা।

“বড় সুতোর বা-িলটা থেকে তিরিশ ফ্যাদমের মতো কেটে নাও,” কার্লোসকে বললাম। “আমি একে পাক খাওয়ার চক্করে ধরে রাখবো, এবং যখন সে কাছে চলে আসবে আমরা তখন যথেষ্ট সুতো পাবো নতুন সুতোর সঙ্গে গিঁট দিয়ে বেঁধে ফেলার জন্যে, এবং তখন আমি ছিপটাও বদলে নেবো।”

যেহেতু ছিপটা ভেঙে গেছে, তাই তখন আর মাছটা ধরে বিশ্বরেকর্ড করার বা কোনো রকমের রেকর্ড করারই কোনো প্রশ্ন ছিলো না। কিন্তু কথা হলো, মাছটাকে যেহেতু অনেকক্ষণ ধরে খেলিয়ে আমরা ক্লান্ত করে এনেছিলাম, তাই এখন ভারী সাজসরঞ্জামের সাহায্যে তাকে আমাদের ধরে ফেলাই উচিত। কিন্তু এক্ষেত্রে একমাত্র অসুবিধেটা ছিলো পনেরো-সুতোর লাইন সামলানোর জন্যে নিতান্তই অনুপযুক্ত বড় আর অনমনীয় ছিপটা। তবে কিনা ওটা ছিলো আমারই সমস্যা, এবং আমাকেই সেটা সমাধানের উপায় বের করতে হবে।

কার্লোস তার দু হাত ছড়িয়ে মাপ নিয়ে নিয়ে হার্ডি কোম্পানির বিরাট বান্ডিলটা থেকে সাদা ছত্রিশ-সুতো খুলে নৌকার পাটাতনে জমা করছিলো। আমি কোনোমতে ছিপের ভাঙা অকেজো টুকরোটা দিয়ে মাছটাকে ধরে রাখতে রাখতে দেখলাম, কার্লোস সুতোটা কেটে নিয়ে তার বড় একটা অংশ ছিপের তলায় লাগানো আংটাগুলোর মধ্যে দিয়ে গলিয়ে দিলো।

“ঠিক আছে, ক্যাপ,” আমি জোসি সায়েবকে বলরাম, “আপনি এখন সে পাক খেতে খেতে আরো কাছিয়ে এলে সুতোর মাথাটা ধরবেন, এবং বেশি করে ধরবেন যাতে দুটো সুতোকে দ্রুত জোড়া দিয়ে দিতে পারে। আপনি শুধু এটা আলতো হাতে সহজভাবে ধরে রাখবেন।”

মাছটা পাক খেতে খেতে অব্যাহতভাবে কাছিয়ে আসতে লাগলো, এবং জোসি সায়েব ছিপের সুতোটা এক ফুট, দু ফুট করে ধরে কার্লোসের দিকে চালান করতে লাগলেন, আর কার্লোস ওটাকে গিঁট দিয়ে জুড়তে লাগলো সাদা ছত্রিশ-সুতোটার সঙ্গে।

“সে গিঁটগুলো বেঁধে ফেলেছে, জোসি সায়েব বললেন। মাছটা যখন তার পাক খাওয়ার বৃত্তটা ক্রমশ ছোট করে আনছিলো তখনও তাঁর হাতের আঙুলের ফাঁকে প্রায় এক গজের মতো সবুজ পনেরো-সুতোর লাইনটা রয়ে গিয়েছিলো। আমি তখন আমার হাতে ধরে রাখা ছোট ছিপটা রেখে দিয়ে কর্লোসের এগিয়ে দেয়া বড় ছিপটা তুলে নিলাম।

“তুমি তৈরি হলেই কেটে দেবে,” কার্লোসকে বললাম। জোসিকে বললাম, “সুতোটা ঢিলে দিয়ে আলতো হাতে আস্তে আস্তে ছাড়–ন, ক্যাপ, আর আমি হালকা, খুব হালকাভাবে টানবো যতক্ষণ-না ওটার অস্তিত্বটা বুঝতে পারি।”

কার্লোস যখন গিঁট কেটে দিলো, আমি তখন সবুজ সুতোর লাইনটা আর মাছটার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। তারপর আমি এমন একটা আর্তনাদ শুনলাম, যেমনটা কোনো প্রকৃতিস্থ মানুষকে কখনও করতে শুনি নি। যেন সমস্ত হতাশাকে ছেঁকে নিয়ে ওই আর্তনাদ তৈরি করা হয়েছে। তারপর দেখলাম, জোসি সায়েবের আঙুলের ফাঁক দিয়ে সবুজ সুতোর লাইনটা ধীরে ধীরে গলে যেতে আর তারপর ওটাতে ক্রমে নিচে, আরো নিচে নেমে গিয়ে দৃষ্টির বাইরে চলে যেতে। কার্লোস তার বাঁধা গিঁটগুলোর ভুল একটা ফাঁস কেটে দিয়েছে। মাছটা চলে গেছে দৃষ্টিসীমার বাইরে।

“ক্যাপ,” জোসি সায়েব বললেন। তাঁকে খুব একটা সুস্থ দেখাচ্ছিলো না। তারপর তিনি তাঁর ঘড়ির দিকে তাকালেন। “চার ঘণ্টা বিশ মিনিট কেটে গেছে,” তিনি বললেন।

আমি কার্লোসকে দেখতে গেলাম। সে তখন নৌকার মাথার দিকে বসে বমি করছিলো। আমি তাকে বললাম অত মন খারাপ না করতে। বললাম, এমনটা তো যে-কারো বেলায় হতে পারে। তার সারা চেহারাটা কেমন কুঁকড়ে গিয়েছিলো আর সে এমন একটা অদ্ভুত নিচু সুরে কথা বলছিলো যে, আমি তার কথাগুলো ভালো করে শুনতে পর্যন্ত পাচ্ছিলাম না।

“সারা জীবন ধরে আমি মাছ ধরে আসছি। অথচ এমন একটা মাছ আমি কখনও দেখি নি। আর এটার বেলাতেই আমি এমন করলাম! আমি আপনার সর্বনাশ করেছি, আমারও করেছি।”

“আরে ধুৎ,” আমি তাকে বললাম, “এসব বাজে কথা কক্ষণো বলবে না। আমরা এর চেয়েও বড় আরো অনেক মাছ ধরবো।” কিন্তু আমরা আর কখনো সেটা পারি নি।

জোসি সায়েব আর আমি দাঁড়ের পাশে বসে অ্যানিটাকে ধীরে ধীরে ভেসে যেতে দিলাম। উপসাগরে সেই দিনটা ছিলো চমৎকার। একটু একটু হাওয়া বইছিলো, আর আমরা তাকিয়ে ছিলাম পেছনে পাহাড়শ্রেণী রেখে বিছিয়ে থাকা সৈকতরেখার দিকে। জোসি সায়েব আমার কাঁধে, ছিপের ঘষা খাওয়া আমার দু হাতে আর ছড়ে যাওয়া দুটো পায়ের তলায় মার্কিউরোক্রোম লাগিয়ে দিলেন। তারপর উনি দু গ্লাস টক হুইস্কি বানালেন লেবুর রস আর চিনি দিয়ে।

“কার্লোস কেমন আছে?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

“সে ভীষণ ভেঙে পড়েছে। গুটিসুটি মেরে বসে আছে ওখানে।”

“আমি তাকে বলেছি নিজেকে দোষ না দিতে।”

“নিশ্চয়। কিন্তু তবুও সে ওখানে বসে বসে নিজেকেই দোষ দিচ্ছে।”

“বড়গুলোকে এখন আপনি কতটা পছন্দ করেন?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

“এটাই আমি সবসময় করতে চেয়েছি,” জোসি সায়েব বললেন।

“তাকে কি আমি আপনার মনমতো করে সামলাতে পেরেছি, ক্যাপ?”

“কী যে বলেন! অবশ্যই পেরেছেন!”

“না। আমাকে সত্যি কথা বলুন।”

“ভাড়ার তারিখ আজ শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। এখন আপনি চাইলে আমি কিছু না নিয়েই আপনার সঙ্গে মাছ ধরবো।”

“না।”

“অমনটা হলেই ভালো হতো। আপনার মনে আছে কীভাবে ওটা ন্যাশনাল হোটেলের দিকে ছুটে চলেছিলো? অমনটা যেন সারা দুনিয়ায় আর কোথাও চোখে পড়বে না।”

“তার ব্যাপারে সব আমার মনে আছে।”

“আপনার লেখালেখিটা ভালো হচ্ছে তো, ক্যাপ? ভোরবেলায় কাজটা করা খুব কঠিন মনে হচ্ছে না তো?”

“আমি সবসময় যেমন লিখতে পারি তেমনই লিখছি।”

“আপনি এটা ধরে রাখুন। দেখবেন, সবসময়েই সবার সবকিছু ঠিকঠাক চলছে।”

“কালকে সকালে বোধহয় লেখাটা স্থগিত রাখবো।”

“কেন?”

“আমার পিঠের অবস্থা খারাপ।”

“আপনার মাথা তো ঠিক আছে, তাই না? আপনি তো আর পিঠ দিয়ে লিখবেন না!”

“আমার হাত কেটে ছড়ে গেছে।”

“আরে, তাই বলে একটা পেন্সিলও ধরতে পারবেন না? সকাল হতে হতে নিশ্চয় আপনার হাত অনেকটা ভালো হয়ে যাবে।”

“অদ্ভুত ব্যাপার হলো, পরদিন আমি ঠিক তাই করলাম এবং ভালোই লেখালেখি করলাম। তারপর আটটা নাগাদ আমরা নৌকা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম পোতাশ্রয় থেকে। এটা ছিলো আরেকটা চমৎকার দিন। আগের দিনের মতো এদিনও হালকা হাওয়া বইছিলো আর স্রোত বইছিলো মরো ক্যাসলের ধার ঘেঁষে। পরিষ্কার জলে গিয়ে পড়ার পর সেদিন আমরা বঁড়শিতে কোনো সরু সুতো বাঁধলাম না। একসময় আমরা প্রায়ই এরকম করতাম। আমাদের সত্যিই বিশাল ছিপগাছটার বঁড়শিতে একটা পাউন্ড চারেক ওজনের সেরো ম্যাকারেল মাছ গেঁথে দিলাম টোপ হিসেবে। এটা ছিলো ছত্রিশ-সুতোর লাইন বাঁধা বিরাট হুইল-সহ হার্ডি কোম্পানির সেই ভারী ছিপটা। আগের দিন কেটে ফেলা তিরিশ ফ্যাদমের লাইনটা কার্লোস আবার গিঁট দিয়ে জোড়া লাগিয়ে দিয়েছে এবং পাঁচ-ইি র হুইলটা এখন সুতোয় ভর্তি। একমাত্র সমস্যাটা হলো, ছিপটা একটুও বাঁকে না। বড় মাছ ধরার সময় ছিপ নমনীয় না হলে তা মারে মাছ শিকারিকেই, আর ঠিকমতো বাঁকলে মারে মাছকে।

কার্লোস কথা বলছিলো কেবল কেউ তার সঙ্গে কথা বললে তবেই। এখনও তার দুঃখের মধ্যে ডুবে ছিলো সে। আমার অত দুঃখ করার অবস্থা ছিলো না, কারণ আমার শরীর বড্ড ব্যথা করছিলো। অন্যদিকে জোসি সায়েবও কখনও অত দুঃখ পাওয়ার মানুষ নন।

“সারা সকাল ধরে ও কেবল তার হতচ্ছাড়া মাথাটা নেড়েই যাচ্ছে,” উনি বললেন। “ওভাবে তো সে আর মাছটাকে ফিরিয়ে আনতে পারবে না!”

জিজ্ঞেস করলাম, “আপনি কেমন বোধ করছেন, ক্যাপ?”

“ভালোই,” জোসি সায়েব বললেন। “কাল রাতে শহরতলীর দিকে গিয়ে শুধু মেয়েদের নিয়ে গড়া একটা দলের গান শুনলাম ওখানকার চত্বরে বসে। গান শুনতে শুনতে কয়েক বোতল বিয়ারও খেলাম। তারপর গেলাম ডোনোভান’স-এ। ওখানে তখন নরক গুলজার!”

“কোন্ ধরনের নরক গুলজার?” জিজ্ঞেস করলাম।

“ভালো কোনো নরক নয়। খুব খারাপ। ক্যাপ, আমি খুব খুশি যে আপনি ওখানে ছিলেন না।”

“পুরোটা একটু খুলে বলুন,” আমি বললাম। ছিপটাকে পাশের দিকে আওতার বাইরে আর উঁচুতে উঠিয়ে ধরে রেখে নৌকার দুপাশে উঠতে থাকা ঢেউয়ের ধার বরাবর বড় ম্যাকারেল মাছটাকে চলতে দিলাম আমি। কার্লোস অ্যানিটাকে চলিয়ে দিয়েছিলো কাবায়াঁসের কেল্লা ছাড়িয়ে স্রোতধারার কিনার ঘেঁষে। ছিপের ফাৎনার সাদা বেলনাকৃতি জিনিসটা নৌকার পাশ বরাবর লাফিয়ে লাফিয়ে স্রোতের সঙ্গে ভেসে যাচ্ছিলো। জোসি সায়েব তাঁর চেয়ারে বসে আরেকটা বড় ম্যাকারেল টোপ নৌকার পেছনভাগে তাঁর পাশ দিয়ে জলে ঝুলিয়ে দিলেন।

“ডোনোভান্’স্-এ একটা লোক দাবি করছিলো সে নাকি সরকারের গুপ্ত পুলিসের লোক। সে বললো, আমার চেহারাটা তার পছন্দ হয়েছে, এবং আমার জন্যে একটা উপহার হিসেবে সে ওখানে যেকোনো লোককে হত্যা করবে। আমি তাকে শান্ত করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু সে বার বার বলতেই থাকলো, আমাকে তার পছন্দ হয়েছে এবং কাউকে হত্যা করে সে তার প্রমাণ দেবে। সে ওই বিশেষ মাচাদো পুলিসদের একজন। ওই লাঠি চালানো পুলিসদের।”

“আমি ওদেরকে চিনি।”

“আমি আঁচ করেছিলাম আপনি চেনেন, ক্যাপ। যা-ই হোক, আমি কিন্তু খুশি যে আপনি কাল রাতে ওখানে ছিলেন না।”

“লোকটা তারপর কী করলো?”

“আমাকে কতটা পছন্দ করে তার প্রমাণ দিতে কাউকে মারার ইচ্ছেটা সে ক্রমাগত বলেই যেতে লাগলো, আর আমি তাকে বলে যেতে লাগলাম যে তার কোনো দরকার নেই এবং দু গ্লাস চড়িয়ে কথাটা ভুলে গেলেই ভালো। সে ওটাই করে খানিকক্ষণ ঠান্ডা হয়ে থেকে ফের ওই একই ঘ্যান ঘ্যান শুরু করছিলো।”

“লোকটা নিশ্চয় চমৎকার ছিলো।”

“ক্যাপ, সে ছিলো আস্ত একটা অপদার্থ। তার মনটাকে অন্যদিকে ঘোরানোর জন্যে আমি মাছ ধরা নিয়ে কথা বলতে চাইলাম। কিন্তু সে বললো, ‘তোমার মাছে আমি মুতে দিই। তুমি কখনো কোনো মাছ ধরোই নি। বুঝলে?’ তখন আমি বললাম, ‘ঠিক আছে মাছে মুতে দাও। এ ব্যাপারে একমত হয়ে চলো এবার দুজনে যার যার বাড়ি যাই।’ ‘জাহান্নামের বাড়িতে যাও!’ সে বললো। ‘আমি তোমার জন্যে উপহার হিসেবে একজনকে মারতে যাচ্ছি, আর তোমার মাছে মুতে দিতে। ওখানে কোনো মাছ ছিলো না। কথাটা মাথায় ঢুকেছে?’ তখন আমি তাকে শুভরাত্রি জানিয়ে দিলাম, ক্যাপ, এবং ডোনোভানকে আমার টাকাটা দিলাম। ওই পুলিসটা টাকাগুলো ধাক্কা দিয়ে বারের ওপর থেকে মেঝেয় ফেলে দিয়ে তার জুতো দিয়ে চেপে ধরলো। ‘তোমার বাড়ি জাহান্নামে যাক,’ সে বললো। ‘তুমি আমার বন্ধু এবং তোমাকে এখানেই থাকতে হবে।’ তখন আমি তাকে আবার শুভরাত জানিয়ে ডোনোভানকে বললাম, ‘ডোনোভান, তোমার টাকা মেঝেয় পড়ে যাওয়াতে আমি দুঃখিত।’ পুলিসটা যে এর পর কী করতে যাচ্ছে বুঝতে পারছিলাম না, তবে তাতে পাত্তাও দিচ্ছিলাম না। আমি বাড়ির পথে রওনা হচ্ছিলাম। কিন্তু আমি যাওয়ার জন্যে পা বাড়াতেই পুলিসটা তার কোমরের খাপ থেকে পিস্তল টেনে বের করে সেটা দিয়ে এক গোবেচারা গ্যালেশীয়কে পেটাতে শুরু করলো, যে কিনা সন্ধ্যে থেকে একবারের জন্যেও মুখ খোলে নি। কেউ পুলিসটাকে কিচ্ছু বললো না। আমিও না। আমি লজ্জিত, ক্যাপ।”

“এরকমটা আর খুব বেশিদিন চলবে না,” আমি বললাম।

“আমি সেটা জানি। কারণ এরকম চলতে পারে না। কিন্তু পুলিসটা যে বললো আমার চেহারাটা তার পছন্দ হয়েছে, সেটাই আমার সবচেয়ে খারাপ লেগেছে। আমার চেহারাটা শালার কোন্ রকমের, ক্যাপ, যে একজন পুলিস বলছে সেটা তার ভালো লাগছে?”

জোসি সায়েবের চেহারাটা আমারও বেশ লাগে। আমার জানা প্রায় সবার মুখের চেয়ে তাঁর মুখটাকেই আমি বেশি পছন্দ করি। এ চেহারাটাকে প্রশংসার চোখে দেখতে অবশ্য আমার লম্বা সময় লেগেছে, কারণ চটজলদি বা অনায়াস সাফল্যের জন্যে এ মুখ খোদাই করা হয় নি। এ মুখটা তৈরি করেছে সমুদ্র, পানশালার লাভজনক দিক, অন্য জুয়াড়িদের সঙ্গে তাসখেলা, এবং ঠান্ডা মাথায় এবং ঠিকঠাক বুদ্ধিতে নেয়া এরকম অনেক ঝুঁকিপূর্ণ উদ্যোগ। শুধুমাত্র চোখ ছাড়া ওই মুখে আর কিছুই সুন্দর না। তাঁর চোখ দুটো ছিলো আশ্চর্য সুন্দর-- সবচেয়ে পরিষ্কার আর ঝকঝকে উজ্জ্বল দিনে ভূমধ্যসাগরকে যেমন দেখায় তার চেয়েও হালকা আর অদ্ভুত এক নীল রঙের। কিন্তু তাঁর মুখটা মোটেই সুন্দর ছিলো না, এবং এখন ওটাকে দেখাচ্ছিলো ফোস্কা পড়া চামড়ার মতো।

“আপনার চেহারাটা ভালো, ক্যাপ,” আমি বললাম। “সম্ভবত ওই কুত্তির বাচ্চাটার মধ্যে শুধু এই একটাই ভালো ব্যাপার ছিলো যে, সে জিনিসটা দেখতে পেয়েছে।”

“বলছিলাম কী, এ কাজটা শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমি আর কোনো নেশার আড্ডায় যাবো না,” জোসি সায়েব বললেন। “শহরতলীর ওই চত্বরে বসে শুধু মেয়েদের নিয়ে গড়া দলটির গান শুনলেই ভালো হতো। আসরটা বেশ চমৎকার জমজমাট ছিলো। আপনি এখন কেমন বোধ করছেন, ক্যাপ?”

“খুবই খারাপ,” আমি বললাম।

“পেটব্যথা করছে না তো? যখন গলুইয়ে ছিলেন তখন আপনাকে নিয়ে খুব চিন্তা হচ্ছিলো।”

“না,” আমি বললাম। “ব্যথাটা করছে পিঠের নিচের দিকটায়।”

“হাতে আর পায়ে তেমনকিছু হয় নি এবং কাঁধে দড়াদড়ির ঘষা খেয়ে ছুলে যাওয়া জায়গাটা আমি ব্যান্ডেজ করে দিয়েছি,” জোসি সায়েব বললেন। “এখন আর অত বাজেভাবে ঘষা লাগবে না। আপনি সত্যিই ঠিকমতো কাজ করতে পারছেন তো, ক্যাপ?”

“নিশ্চয়,” আমি বললাম। “একবার লেগে পড়লে এটা একটা বাজে অভ্যাস হয়ে যায় আর ছাড়ান পাওয়া শক্ত হয়ে দাঁড়ায়।”

“আমি জানি, অভ্যাস খুব বাজে ব্যাপার,” জোসি সায়েব বললেন। আর কাজের অভ্যাসই সম্ভবত অন্য যেকোনো অভ্যাস থেকে বেশি মানুষ খুন করে। কিন্তু আপনি যখন এটা করেন তখন বাকি সারা দুনিয়াই যেন ভুলে যান।”

আমি তিরের দিকে তাকালাম। তখন একটা চুনের ভাটির পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম আমরা, সৈকতের ধার ঘেঁষে যেখানে জল ছিলো খুব গভীর এবং উপসাগরীয় স্রোত উপকূলের প্রায় কাছাকাছি দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিলো। ভাটিটা থেকে অল্প অল্প ধোঁয়া উঠছিলো এবং আমি দেখতে পাচ্ছিলাম সৈকতের পাথুরে রাস্তাটা দিয়ে একটা ট্রাক ধুলো উড়িয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। কয়েকটা পাখি উড়ে উড়ে এসে টোপের একটা টুকরোকে ঠোকরাচ্ছিলো। আর তখনই আমি শুনতে পেলাম কার্লোস চেঁচাচ্ছে, “মার্লিন! মার্লিন!”

আমরা সবাই একসঙ্গে একই সময়ে তাকে দেখতে পেলাম। জলের ভেতর তাকে খুব কালচে দেখাচ্ছিলো। আমাদের চোখের সামনেই তার ঠোঁট দুটো বেরিয়ে এলো বড় ম্যাকারেলটার পেছনে জলের মধ্যে থেকে। কুৎসিত দুটো ঠোঁট-- গোলালো আর পুরু আর বেঁটে। ঠোঁটের পেছরে তার শরীরটা তখনও জলের তলায়।

“ম্যাকারেলটা ওকে খেয়ে নিতে দিন,” কার্লোস চিৎকার করে বললো। “সে ওটা মুখে নিয়ে নিয়েছে।”

জোসি সায়েব ততক্ষণে তাঁর টোপটার সুতো গোটানো শুরু করে দিয়েছেন, আর আমি অপেক্ষা করছিলাম সুতোয় সেই টানটা পাওয়ার জন্যে। ওটা পেলে তবেই নিশ্চিত হওয়া যাবে যে মার্লিনটা সত্যিই ম্যাকারেলের টোপটা গিলেছে কিনা



--------------------------

মূল গল্প: Pursuit as Happiness by Ernest Hemingway

লেখক পরিচিতি:


মার্কিন কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, পুরো নাম-- আর্নেস্ট মিলার হেমিংওয়ে (২১ জুলাই, ১৮৯৯ - ২ জুলাই, ১৯৬১), ছিলেন বিংশ শতকের ইংরেজি তথা বিশ্ব সাহিত্যের প্রধান প্রতিভূদের একজন। ‘আইসবার্গ তত্ত্ব’ নামে পরিচিত হেমিংওয়ে’র নির্মেদ ও নিরাবেগ লিখনশৈলী এ শতাব্দীর কথাসাহিত্যে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। অন্যদিকে তাঁর রোমা প্রিয় জীবন ও ভাবমূর্তিও পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তাঁকে ’কল্পনার নায়ক’ করে তোলে। বিংশ শতাব্দীর বিশের দশকের মাঝামাঝি থেকে প াশের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত সময়ে তিনি তাঁর অধিকাংশ সাহিত্যকর্ম রচনা করেন এবং ১৯৫৪ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। জীবৎকালে তাঁর সাতটি উপন্যাস, ছয়টি ছোটগল্প সংকলন এবং দুইটি নন-ফিকশান বই প্রকাশিত হয়েছিলো। তাঁর মৃত্যুর পর আরো তিনটি উপন্যাস, চারটি ছোটগল্প সংকলন এবং তিনটি নন-ফিকশান বই প্রকাশিত হয়। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের অনেকগুলোই মার্কিন তথা বিশ্ব সাহিত্যের ধ্রুপদী বা চিরায়ত গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত।

হেমিংওয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় অঙ্গরাজ্যের ওক পার্কে জন্মগ্রহণ করেন এবং সেখানেই বেড়ে ওঠেন। উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পর তিনি কয়েক মাস দা ক্যানসাস সিটি স্টার সংবাদপত্রে প্রতিবেদক হিসেবে কাজ করেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে তিনি অ্যাম্বুলেন্স চালক হিসেবে তালিকাভুক্ত হন এবং তাঁকে ইতালীয় রণাঙ্গনে পাঠানো হয়। ১৯১৮ সালে তিনি মারাত্মক আহত হয়ে বাড়ি ফিরে আসেন। তাঁর এই যুদ্ধের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই তিনি রচনা করেন তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস ‘আ ফেয়ারওয়েল টু আর্মস’ (১৯২৯)। অবশ্য এর আগে ১৯২৬ সালে তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘দা সান অলসো রাইজেস’ প্রকাশিত হয়েছিলো।

১৯২১ সালে তিনি হ্যাডলি রিচার্ডসনকে বিয়ে করেন এবং প্যারিস চলে যান। সেখানে তিনি বিদেশি প্রতিবেদক হিসেবে কাজ করেন। এসময়ে ‘হারানো প্রজন্ম’ নামে প্রবাসী আধুনিক কবি-লেখক-শিল্পীদের গোষ্ঠীটি তাঁর ওপর প্রবাব বিস্তার করে। ১৯২৭ সালে হ্যাডলির সঙ্গে তাঁর বিবাহবিচ্ছেদের পর তিনি সাংবাদিক পলিন ফাইফারকে বিয়ে করেন। স্পেনের গৃহযুদ্ধ থেকে ফিরে আসার পর ফাইফারের সাথেও তাঁর বিবাহবিচ্ছেদ হয়। এ যুদ্ধের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি রচনা করেন ‘ফর হুম দ্য বেল টোলস’ (১৯৪০) উপন্যাসটি । ১৯৪০ সালে তিনি মার্থা গেলহর্নকে বিয়ে করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় লন্ডনে ম্যারি ওয়েলশের সাথে তাঁর সাক্ষাতের পর গেলহর্নের সাথে তাঁর বিবাহবিচ্ছেদ হয়। তিনি নরম্যান্ডি অবতরণ ও প্যারিসের স্বাধীনতার সময় উপস্থিত ছিলেন।

‘দ্য ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সী’ (১৯৫২) প্রকাশের কিছুদিন পর হেমিংওয়ে আফ্রিকায় সাফারি ভ্রমণে যান। সেখানে তিনি পরপর দুটি বিমান দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হাত থেকে একটুর জন্যে রেহাই পেয়ে যান, কিন্তু এর জের হিসেবে তাঁকে বাকি জীবনের বেশির ভাগ সময় নানা শারীকি অসুস্থায় কাটাতে হয়। ১৯৫৯ সালে তিনি আইডাহোর কেচামে একটি বাড়ি কেনেন এবং ১৯৬১ সালের মাঝামাঝি সময়ে সে-বাড়িতেই তিনি মাথায় গুলি করে আত্মহত্যা করেন।

--------------




অনুবাদক পরিচিতি
জ্যোতির্ময় নন্দী
কবি, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক




একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ