ইতালো ক্যালভিনো'র গল্প : চাঁদের মেয়েরা


অনুবাদ: আফসানা বেগম 

বাতাসের আবরণ ঢাল হয়ে চাঁদকে আগলে রাখত ঠিকই কিন্তু চাঁদ নিজেকে আবিষ্কার করত ধারাবাহিক উল্কা-বর্ষণের রাজ্যে। তা ছাড়া, ক্রমশ ক্ষয়কারী সূর্যের আলো তো আছেই। কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের থমাস গোল্ডের মতে চাঁদের উপরিভাগের পাথুরে উপাদান দিনের পর দিন উল্কার আঘাতে দুর্বল হয়ে পড়ছে। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের গিরার্ড কুইপারের মতে, চাঁদের অন্ত্যজ খনিজ থেকে নিসৃত গ্যাস হয়তবা উপগ্রহটিকে খানিকটা আলো দিয়ে থাকে, যা ঘটাতে গিয়ে তাকে ছিদ্রে ছিদ্রে ঝাঁঝরা হয়ে ঝামার মতো হয়ে যেতে হয়।

চাঁদ অনেক পুরোনো। সূত্রধর জানত যে চাঁদের সারা গায়ে ছিদ্রে ভরা আর শরীরটা ছেঁড়া ছেঁড়া, আকাশে যেন উলঙ্গ হয়ে ভাসছে। ক্ষয় হতে হতে সে তার শরীরের মাংস হারিয়ে ফেলেছে, যা আছে তা কেবল চিবিয়ে রাখা হাড়। এমনটা যে এই প্রথম হলো, তা নয়। এর চেয়েও ক্ষতিগ্রস্ত আর এর থেকেও প্রাচীন চাঁদের কথা আমার মনে আছে; এরকম বহু চাঁদকে দেখেছি আমি-- তাদেরকে জন্মাতে দেখেছি, আবার আকাশময় দাপাদাপি করতেও দেখেছি। সবশেষে টুপ করে মরে যেতে দেখেছি। খসে পড়া তারার ধাক্কায় একটা চাঁদ ফুটো হয়ে গিয়েছিল। আরেকটা তো তার নিজের শরীরের জীবন্ত আগ্নেয়গিরিতেই ধ্বংস হলো। পোখরাজ-রঙের ঘাম নিংসরণ করত আরেকটা যা তার শরীর থেকে বেরোতে না বেরোতেই বাষ্প হয়ে উড়ে যেত। তখন তার চারদিকে ঘন সবুজ মেঘের ঘের হয়ে থাকত, তারপর শুকিয়ে গেলে স্পঞ্জের মতো নরম খোলসের সৃষ্টি হতো। 

একটা চাঁদ মরে গেলে পৃথিবীর তাতে কী হয় তা আন্দাজ করা সহজ নয়। সর্বশেষ যে ঘটনাটা দেখেছি, সেটা মনে করে ব্যাপারটা বোঝানোর চেষ্টা করব। বিবর্তনের দীর্ঘ এক কাল পেরিয়ে পৃথিবী বলতে গেলে আজকের অবস্থানে পৌঁছেছে যেখানে আমরা উপস্থিত; অন্যভাবে ভাবলে, পৃথিবী সত্যি সত্যি এমন একটা অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে যেখানে জুতোর শুক্তোলার চেয়ে গাড়ি দ্রুত পুরোনো হয়। দৈনন্দিন ব্যবহারের জিনিসপত্র মানুষের হাতে বানানো হয় না বললেই চলে। এমন কিছু নেই যা কেনা-বেচা হয় না। পুরো মহাদেশজুড়ে একের পর এক শহরে উজ্জ্বল আলোর ঝলকানি। শহরগুলো প্রাচীন শহরের জায়গাতেই গড়ে উঠেছে, তবে মহাদেশের মানচিত্র বদলে গেছে। এখনকার নিউ ইয়র্ক অনেকটা সেই আগের নিউ ইয়র্কের মতো হলেও সামান্যই পরিচিত মনে হয় সবার কাছে। এই নিউ ইয়র্ক অনেক নতুন, হাজার নতুন পণ্যে সয়লাব, দূর থেকে দেখতে যেন কেবল বদলে যাওয়া টুথব্রাশ যেন। এখনকার নিউ ইয়র্ক তার নতুন ম্যানহ্যাটনকে টেনে টেনে লম্বা করছে শত শত আকাশচুম্বী অট্টালিকায়, আকাশের গায়ে তারা দাঁড়িয়ে আছে টুথব্রাশের খাড়া নাইলনের সুতোগুলোর মতো। 

এখন এই পৃথিবীতে যেখানে কিনা প্রত্যেকটি জিনিস সামান্য ভেঙে গেলে কি পুরোনো হয়ে গেলে, কোথাও ট্যাপ খেলে বা অমোচনীয় কোনো দাগ বসলে ছুঁড়ে ফেলা হয়, শূন্যস্থানে উপযুক্ত একটি বিকল্প সাজিয়ে রাখা হয়, সেখানে কেবল একটি জিনিস, একটি ছায়া এই পৃথিবীতে টিকে আছে-- তা হলো চাঁদ। আকাশে সে উলঙ্গ আর দুমড়ে মুচড়ে ধূসর হয়ে ভেসেই চলেছে। পৃথিবীর কাছে তবু যেন অচেনা, নির্দিষ্ট দূরত্বে ক্রমাগত ঝুলে থাকা চেহারাটা অবশ্য বেজায় পুরোনো। 

প্রাচীন কতকগুলো অভিব্যক্তি ছিল, যেমন, পূর্ণচন্দ্র, অর্ধচন্দ্র, তৃতীয়া তিথির চন্দ্র, যেসব আমরা মুখে মুখে বহুকাল ধরে ব্যবহার করে আসছি। কিন্তু কী করে আমরা এমন একটা আকৃতিকে পূর্ণ বলব যার মধ্যে এত ফাটা-ফুটো এত জোড়াতালি, জায়গায় জায়গায় ছিদ্র আর দেখলেই মনে হয় ভেঙেচুরে টুকরো টুকরো হয়ে তার পাথুরে ঢলসমেত আমাদের মাথার উপরে পড়বে? অথচ একবারও কেউ বলল না যে চাঁদটা ধীরে ধীরে ক্ষয়ে যাচ্ছে! যদিও ক্রমশ তা ক্ষয়প্রাপ্ত একটা পনিরের দলার মতো হয়েছে, আর বরাবর সময়ের আগেই আকাশ থেকে উধাও হয়ে গেছে। প্রতি অমাবশ্যার সময়ে আমরা যেমন সন্দেহে থাকতাম চাঁদটা আবার আসবে তো? (আমরা কি মনে করি বলা নেই কওয়া নেই চাঁদটা হুট করে উধাও হয়ে যাবে?) আর ওটা যখন আবারো আকাশে ভেসে উঠত, দেখতে মনে হতো যেন একটা চিরুনি যার দাড়গুলো খোয়া গেছে। তার দিকে তাকাতেই আমাদের চোখের পাতা কেঁপে কেঁপে বুজে যেত। 

ওটা এক দুঃখজনক দৃশ্য। আমরা ভীড়ের মধ্যে মিলিয়ে গেলাম, আমাদের হাতদুটো প্যাকেট বোঝাই জিনিস টানতে টানতে ক্লান্ত হয়ে পড়ল, দিনে-রাতে উন্মুক্ত বড়ো বড়ো বিপণীবিতান থেকে প্যাকেটগুলো আসতেই থাকল। আমরা কেবল নিয়ন সাইনগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতাম যেগুলো ক্রমশ আরো উঁচুতে উঠে গেল আর ক্রমাগত বাজারে নতুন নতুন জিনিসের আবির্ভাবের খবর বলে গেল। তারপর একদিন হুট করেই দেখলাম যে সেই জ্বলজ্বলে আলোগুলো অনুজ্জ্বল হয়ে পড়ল, যেন তারা আমাদের চোখের সামনে ক্রমশ রুগ্ন আর অবশ হলো, আমাদের মনের উপরে ফেলে গেল গভীর ছাপ। ব্যথাতুর বিস্ময়ে আমাদের মাথা থেকে দুশ্চিন্তা কিছুতেই নামল না যে প্রত্যেকটা নতুন জিনিস, বিশেষ করে প্রত্যেকটা নতুন শখের জিনিস যা আমরা কদিন আগেই কিনেছি, সেসব ওই নিভু নিভু আলোর মতোই একদিন হারিয়ে যাবে, উধাও হবে, উবে যাবে, আর আমরা কিনা সে কারণে পাগলের মতো একের পর এক জিনিস কিনে কিনে স্তূপ করার আগ্রহও হারিয়ে ফেলব-- শিল্প আর বাণিজ্যের কী ভয়ঙ্কর এক ধারাবাহিকতা। 

এটাই ছিল শুরু যখন আমরা উপগ্রহটির ক্ষয়িষ্ণু স্বভাব নিয়ে ভাবতে শুরু করেছিলাম। চাঁদ আমাদের কোনো কাজে আসছিল না, কেবলমাত্র আধামরা হয়ে আকাশে ঝুলে ছিল। নিজের ওজন হারিয়ে সে পৃথিবীর দিকে খানিকটা ঢলে পড়েছিল। সবকিছুর মধ্যে সেটাই ছিল সবচেয়ে গুরুতর সমস্যা। চাঁদ যতই পৃথিবীর দিকে এগোতে লাগল ততই নিজের চারপাশে ঘোরার গতি কমিয়ে দিল। ধীরে ধীরে এমন হলো যে আমরা তার পর্যায়গুলো পর্যন্ত ঠাওর করতে পারলাম না। এমনকি চাঁদের উপরে নির্ভরশীল আমাদের দিনপঞ্জি, মাসের ছন্দ, নামমাত্র প্রচলন হয়ে দাঁড়াল। চাঁদ তখন কাঁপতে কাঁপতে সামনে এগোত, মনে হতো এই বুঝি ভেঙেচুরে পড়বে। 

আবছা চন্দ্রালোকের ওই দিনগুলোতে মেজাজ চরমে উঠে মানুষ যা-তা করতে শুরু করল। আকাশছোঁয়া এক অট্টালিকার রেলিঙের উপরে বরাবর ঘুমের মধ্যে একজনকে চাঁদের দিকে হাত বিস্তৃত করে হাঁটতে দেখা যেত। আবার নেকড়ে বাঘে পরিণত এক মানুষ টাইম স্কয়ার বা সমুদ্রের ধারের কোনো গুদামে স্বেচ্ছায় আগুন ধরিয়ে দিয়ে অবিরাম গোঙাত। ধীরে ধীরে এসব অদ্ভুত দৃশ্য এতটাই স্বাভাবিক হয়ে গেল যে প্রত্যক্ষদর্শীকে আকর্ষণ করার ক্ষমতা হারাল। কিন্তু একদিন যখন আমি সেন্ট্রাল পার্কের বেঞ্চে সম্পূর্ণ উলঙ্গ হয়ে একটা মেয়েকে বসে থাকতে দেখলাম, আমাকে তখন দাঁড়াতেই হলো। 

অবশ্য তাকে দেখার আগে আগেই কেন যেন আমার মনে হচ্ছিল যে অস্বাভাবিক বা রহস্যময় কিছু ঘটতে যাচ্ছে। আমি যখন আমার হুড তোলা গাড়িটাতে করে সেন্ট্রাল পার্কের মাঝখানের রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলাম, আমার মনে হলো ক্রমান্বয়ে ধপ করে জ্বলে ওঠা আর নিবে যাওয়া কোনো আলো যেন আমার শরীর ছুঁয়ে গেল, টিউব লাইট জ্বালালে প্রথমে যেমন বেশ কয়েকবার খামোখা জ্বলে আর নিবে গিয়ে আবার জ্বলে ওঠে। আমার চারদিকের পরিবেশটা বাগানের মতো ছিল বটে তবে যেন চাঁদের কোনো আগ্নেয়গিরির গোলাকার জ্বালামুখের মধ্যে ডোবা অঞ্চল। উলঙ্গ মেয়েটি চাঁদের অংশবিশেষ প্রতিফলিত হওয়া একটা পুকুরের পাশে বসে ছিল। আমি হুট করে গাড়ি থামালাম। এক মুহূর্তের জন্য আমার মনে হলো আমি তাকে চিনি। গাড়ি থেকে নেমে দৌড়ে তার কাছে গেলাম। কিন্তু সেখানে পৌঁছেই পাথর হয়ে থাকলাম। নিশ্চিত হলাম আমি তাকে চিনি না; তবে আমার মনে হলো, খুব তাড়াতাড়ি তার জন্য আমাকে কিছু করতে হবে। 

বেঞ্চটার চারপাশে ঘাসের উপরে মেয়েটির জিনিসপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। তার জামা, লম্বা মোজা, জুতোজোড়ার একটা একদিকে তো আরেকটা আরেকদিকে, কানের দুল, গলার মালা আর হাতের চুড়ি, তার ছোটো ব্যাগ আর বাজারের বড়ো ব্যাগ থেকে ভিতরের জিনিসগুলো বেরিয়ে পড়ে বড়োসড়ো একটা অর্ধবৃত্ত রচনা করেছে। তা ছাড়াও, চারপাশে যে অগুনতি ব্যাগ আর জিনিস ছড়িয়ে আছে, দেখে মনে হতে পারে লাগামহীন কেনাকাটার মাঝপথে কেউ যেন তাকে ঘটা করে ডেকে আনাতে সে সমস্তকিছু হাত থেকে ফেলে দিয়েছে, তার মনে হয়েছে যে যা কিছু এই পৃথিবীর সঙ্গে তাকে কোনো সম্পর্কে বেঁধে রেখেছে তার সমস্তকিছু থেকে তার মুক্ত হওয়া দরকার। আর তারপর থেকে সে কেবল চাঁদের বৃত্তের সঙ্গে মিশে যাওয়ার অপেক্ষায় আছে। 

‘কী হয়েছে?’ বিরতিহীনভাবে বলে যেতে লাগলাম, ‘আমি কি কোনো সাহায্য করতে পারি?’ 

‘সাহায্য?’ চোখ আকাশের দিকে মেলে সে জানতে চাইল। ‘কেউ কোনো সাহায্য করতে পারবে না। কেই কিচ্ছু করতে পারবে না।’ তার কথায় এটুকু স্পষ্ট ছিল যে সে তার নিজের ব্যাপারে নয়, বলছে চাঁদকে নিয়ে। 

চাঁদটা ছিল আমাদের মাথার ঠিক উপরে, মনে হচ্ছিল তার উত্তল অংশ দিয়ে চেপে মেরে ফেলবে আমাদের, যেন একটা জং পড়া ছাদ, পনিরের গায়ের মতো ফুটোয় ভরা। ঠিক তখনই কাছের চিড়িয়াখানায় কিছু প্রাণী ডেকে উঠল। 

‘এটাই কি তাহলে শেষ?’ আমার মুখ থেকে যন্ত্রের মতো প্রশ্ন বেরিয়ে এল, আমি বলতেও পারব না কী বোঝাতে প্রশ্নটা করেছি। 

সে বলল, ‘এটা কেবল শুরু,’ কিংবা সেরকম কিছুই বলল। (সত্যি বলতে কী, ঠোঁট তেমন ফাঁক না করেই সে কথা বলছিল।) 

মেয়েটি উঠে দাঁড়াল, তারপর ঘাসের উপর দিয়ে হেঁটে গেল। তার লম্বা তামাটে রঙের চুলগুলো ঘাড়ের নীচে দুলছিল। তাকে দেখতে এতটাই এলোমেলো লাগছিল যে মনে হলো কোনো না কোনোভাবে তাকে আমার রক্ষা করা দরকার, যেন তার চারদিকে ঢালের মতো কিছু দিয়ে তাকে বাঁচাতে হবে, আমি তাই আমার হাত তার দিকে বিস্তৃত করলাম, যেন পড়ে গেলে বা কিছুর সঙ্গে ধাক্কা খেলে কোনো ক্ষতি হবার আগেই তাকে চট করে ধরে ফেলতে পারি। তবে আমার হাতের ছোঁয়া তার গায়ে লাগতে দিইনি, তার শরীর থেকে বরাবর কয়েক সেন্টিমিটার দূরে রেখেছি। আর ওভাবে তাকে অনুসরণ করতে করতে ফুলের বাগানটা যখন পেরিয়ে গেলাম, আমার মনে হলো তার চলাফেরাও যেন ঠিক আমারই মতো, যেন সে-ও হাত বাড়িয়ে ভঙ্গুর কিছু একটাকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে, যেন এমন কিছুকে সে ধরে রেখেছে যা ছেড়ে দিলেই চুর চুর হয়ে ছড়িয়ে পড়রে, আর সেটাকে সাবধানে এমন কোথাও রাখা দরকার যেখানে সেটি শান্ত আর নিরাপদভাবে থাকতে পারে, সেটা এমন কিছু যা মেয়েটি ছুঁতে পারে না, কেবল শরীরের নানান ভঙ্গিতে তাকে পথ দেখাতে পারে, সে আর কেউ নয়, চাঁদ। 

চাঁদটা যেন হারিয়ে গেল। নিজের কক্ষপথ থেকে ছিটকে সে জানতই না কোথায় গিয়ে পড়ল। চাঁদটা নিজেকে শুকনো পাতার মতো পলকা করে ছেড়ে দিল। কখনো মনে হলো হামাগুড়ি দিয়ে পৃথিবীর দিকে এগিয়ে আসছে, কখনো আবার আবার অন্য কোনোকিছুর দিকে ঘুরে ঘুরে নড়েচড়ে এগিয়ে গেল। তবে সাদাচোখে দেখলে তাকে গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ে যাচ্ছে বলেই মনে হলো। চাঁদ তার উচ্চতা হারাল এ ব্যাপারে সন্দেহ নেই। এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো ওটা যেন ওদিকের প্লাজা হোটেলের সঙ্গে টক্কর খেল। কিন্তু সত্যি সত্যি তা না করে দুটো আকাশচুম্বী ইমারতের মাঝখানের সরু জায়গাটা ধরে পিছলে কোথায় যেন উধাও হয়ে গেল। হাডসনের দিকে চাঁদকে আর কোথাও দেখা গেল না। তবে কিছু সময় পরেই শহরের অন্য প্রান্তে চাঁদটা আবারো উদয় হলো, মেঘের পিছন থেকে ফুঁড়ে বেরোল। হারলেম আর ইস্ট রিভার এলাকা চকের মতো সাদাটে আলোয় ঢেকে গেল। আর তারপর মনে হলো দাপুটে বাতাসের শক্ত একটা ধাক্কায় ওটা গড়িয়ে গড়িয়ে ব্রনঙ্কসের দিকে চলে গেল। 

‘ওই যে!’ আমি চিৎকার করে উঠলাম। ‘ওই যে ওদিকে দেখ-- ওই দেখ, থামল।’ 

‘ওটা থামবে না!’ মেয়েটা বিস্ময়ে চিৎকার করল, তরপর উলঙ্গ শরীরে খালি পায়ে ঘাসের উপর দিয়ে ছুটে চলে গেল। 

‘এই, তুমি কোথায় চললে? এভাবে ছোটাছুটি কোরো না! দাঁড়াও, থামো! এই যে, শুনতে পাচ্ছ? আমি তোমারই সঙ্গে কথা বলছি! তোমার নামটা কী বলো তো?’ 

মেয়েটা নিজের নাম চিৎকার করে জানাল, ডায়ানা বা ডিয়ানা বলল হয়ত। কিংবা এমন একটা শব্দ করল মনে হলো কারো কাছে সাহায্যের মিনতি করছে। আর তখনই সে চোখের সামনে থেকে হাওয়া হয়ে গেল। তাকে অনুসরণের জন্য আমি লাফিয়ে গাড়িতে উঠলাম। তারপর তন্ন তন্ন করে সেন্ট্রাল পার্কের গাড়ি চলার রাস্তা খুঁজে বের করারা চেষ্টায় এলোপাথারি চালাতে লাগলাম। 

গাড়ির হেডলাইটের আলো কখনো ঝোঁপঝাড়ে, কখনো ছোটো টিলায়, কখনোবা পাথুরে ঘরমতো কিছু একটার উপরে পড়তে লাগল কিন্তু ওই মেয়েটা, যার নাম হয়ত ডায়ানা, তাকে কোথাও দেখলাম না। ততক্ষণে আমি বহুদূর চলে গেছি। আমি হয়ত তাকে ছাড়িয়েই চলে এসেছি। তাই তখন গাড়ি ঘুরিয়ে যেদিক থেকে এসেছিলাম আবার সেদিকেই যেতে লাগলাম। আমার ঠিক পিছনে তখন একটা কণ্ঠস্বর বলে উঠল, ‘না, ওই যে ওইদিকে, সামনে যেতে থাকো।’ 

দেখলাম আমার গাড়ির পিছনের অংশে উলঙ্গ মেয়েটা বসে আছে, আঙুল তাক করে চাঁদের দিকে দেখাচ্ছে। 

ইচ্ছে হলো তাকে নামতে বলি, বুঝিয়ে বলি যে তাকে ওই অবস্থায় গাড়ির পিছনের অংশে বসিয়ে নিয়ে, যেখানে বসলে কিনা তাকে স্পষ্ট দেখা যায়, ওভাবে শহরের মাঝখানে দিয়ে ছুটে যাওয়া আমার পক্ষে অসম্ভব। কিন্তু চাঁদের দিকে তার ধ্যান কেন যেন কিছুতে ভাঙাতে পারলাম না। মনে হলো সামান্য হস্তক্ষেপে রাস্তার শেষ মাথায় জ্বল জ্বল করতে থাকা এই আছে এই নেই চাঁদটাকে অনুসরণ করতে থাকা তার মনোযোগে বিঘ্ন ঘটবে। আর তা ছাড়া, অদ্ভুত ব্যাপার হলো রাস্তায় পাশাপাশি চলা লোকগুলোর আচরণ দেখে মনে হচ্ছিল তারা কেউ আমার গাড়ির উপরে বসা মেয়েটিকে দেখতেই পাচ্ছে না। 

ম্যানহ্যাটনের সঙ্গে মূল ভূখ-ের সংযোগকারী ব্রিজগুলোর মধ্যে একটার উপর দিয়ে আমরা চলে গেলাম। তাই তখন জটিল আর বিস্তৃত রাস্তায় গিয়ে উঠলাম যেখানে পাশাপাশি অনেক গাড়ি চলে। আমি স্থির দৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। আমাদের দুজনকে এভাবে গাড়িতে দেখে আশেপাশের গাড়িগুলো থেকে যে হাসিঠাট্টা বা নোংরা মন্তব্য আছড়ে পড়তে পারে সেই ভয়ে আমি কোনোদিকে তাকাচ্ছিলাম না। কিন্তু তখন আমাদের গাড়িকে ছাড়িয়ে আরেকটা গাড়ি যখন সামনে চলে গেল আমি সেদিকে তাকিয়ে চমকে উঠলাম, অবাক-বিস্ময়ে দেখলাম গাড়িটার ছাদের উপরে একটা উলঙ্গ মেয়ে বসে আছে আর তার চুল পিছনের দিকে ঢেউ হয়ে উড়ছে। দু’এক মুহূর্তের জন্য ভাবলাম আমার গাড়ির যাত্রী হয়ত চলন্ত অবস্থায় লাফিয়ে অন্য গাড়িতে চলে গেছে। কিন্তু নিশ্চিত হবার জন্য পিছনের দিকে মাথা সামান্য ঘোরাতেই নিজের গাড়িতে ডায়ানার হাঁটুর অস্তিত্ব টের পেলাম, তার হাঁটুগুলো পিছনে ঠিক আমার নাকের উচ্চতায় স্থির। আর কেবল তার শরীরই একমাত্র উলঙ্গ শরীর নয় যা আমার চোখকে ধাঁধিয়ে দিচ্ছিল, তখন আমি প্রত্যেকটা গাড়ির উপরেই তার মতো উলঙ্গ শরীর দেখতে পেলাম। তারা সব বিচিত্র ভঙ্গীতে গাড়িকে আঁকড়ে ধরে আছে। অদ্ভুত ভঙ্গীমায় কেউ রেডিয়েটর থেকে ঝুলছে, কেউ ঝুলছে দরজা ধরে, দ্রুতবেগে ছোটা গাড়ির পিছনের অংশে এলিয়ে আছে কেউবা। তাদের গোলাপি কিংবা ঘন বর্ণের শরীরের উপরে সোনালি বা কালচে চুলোর গোছা অপার্থিব এক বৈপরীত্য তৈরি করেছে। প্রত্যেকটি গাড়িতেই একজন রহস্যময় যাত্রী, প্রত্যেকেই সামনের দিকে তাকিয়ে, কিছুটা ঝুঁকে নিজ নিজ চালককে কেবল চাঁদকে অনুসরণ করতে অনুরোধ করছে। 

তারা যেন বিপদগ্রস্থ চাঁদের আছর পাওয়া। আমি নিশ্চিত বিপথে যাওয়া চাঁদই তাদের ডাকছে। সব মিলে কতজন হবে তারা? আরো আরো গাড়ি নিশি পাওয়া মেয়েদের তুলে নিতে রাস্তায় নেমে এল। গাড়িগুলো রাস্তার মোড়ে জড়ো হলো, জাংশনে ছাপিয়ে গেল, শহরের যে অংশে চাঁদটা ঠেস দিয়ে স্থির হয়ে আছে বলে মনে হচ্ছিল ধীরে ধীরে সেইদিকেই এগিয়ে গেল। যেতে যেতে একসময় পুরোনো গাড়ি ফেলে রাখার একটা মাঠের সামনে আমরা হাজির হলাম। 

জায়গাটা একটা সমতল এলাকাই অংশ তবে সেখানে ছোটো ছোটো উপত্যকা, এবরোখেবড়ো টিলা, ছোটো পাহাড় আর পাহাড়ের কিছু চূড়ায় ভরা। তবে ভূমির ওরকম বৈচিত্র স্বাভাবিক উপায়ে আসেনি। পাহাড় আর টিলাগুলো গড়ে উঠেছিল স্তরে স্তরে মানুষের ফেলে যাওয়া জিনিসপত্রের চাপে। ভোগবাদী শহরটার মানুষগুলো যা যা ব্যবহার করে পুরোনো করে ফেলেছে সেসব এনে ওই নির্জন দখলবিহীন ভূমিতে ফেলে রেখে গেছে যেন ফিরে গিয়ে সঙ্গে সঙ্গে পুরোনোর জায়গায় নতুন কিছু উপভোগ করতে পারে। 

বহু বছর ধরে ভাঙাচোরা ফ্রিজ, হলদে হয়ে যাওয়া পত্রিকা, তার কেটে যাওয়া বৈদ্যুতিক বাতি স্তূপ হতে হতে পুরোনো জিনিস ফেলার জায়গাটাকে বীভৎসভাবে বাড়িয়ে তুলেছে। উঁচুনীচু আর জং পড়া অঞ্চলটিতে চাঁদ তখন এমনভাবে ঝুঁকে ছিল যে মনে হলো আাঁকা-বাঁকা ধাতব জিনিসের প্রকা- একটা ঢেউয়ের পিছনে উঁকি দিচ্ছে। নড়বড়ে, দাগপূর্ণ চাঁদ আর ধ্বংসপ্রাপ্ত জিনিস খচিত পৃথিবীর ক্ষতবিক্ষত একটা টুকরো সামনাসামনি যেন একে অপরের চেহারায় নিজের সাদৃশ্য খুঁজছে। চূর্ণ-বিচূর্ণ ব্যবহারের অযোগ্য জিনিসগুলো এমনভাবে সারি বেঁধে ধাপে ধাপে উপরের দিকে উঠে গেছে যেন কোনো অ্যাম্ফিথিয়েটার। আবার বলা চলে আগ্নেয়গিরির গায়ের সিঁড়িমতো খোদাই কিংবা সমুদ্রের দিকে ধাবমান ধাপে ধাপে নীচু হয়ে যাওয়া বালুকারাশি। চাঁদটা ঠিক ওইখানটাতেই ঝুলে ছিল। দেখে মনে হচ্ছিল গ্রহ এবং তার উপগ্রহ যেন একে অন্যের দিকে আয়না তাক করে রেখেছে। 

গাড়িগুলোর ইঞ্জিন হুট করে থেমে গেল। নিজেদের কবরস্থানের দৃশ্য ছাড়া গাড়িকে এতটা ভয়ার্ত আর কে করতে পারে! ডায়ানা গাড়ি থেকে নামল। বাকি ডায়ানারাও তাকে অনুসরণ করল। কিন্তু তাদের দেখে মনে হচ্ছিল ক্লান্ত হয়ে পড়েছে, এলোমেলো পদক্ষেপে এগোতে লাগল। এলোপাথারি পড়ে থাকা ভাঙা জিনিসের তীক্ষè ধাতব ফলাগুলো যেন তাদেরকে নিজেদের উলঙ্গ অবস্থার কথা আকস্মিক স্মরণ করিয়ে দিয়েছে তাই তারা খানিকটা আড়ষ্ট হয়ে পড়ল। শীতে কাঁপুনি ধরার মতো ভঙ্গীতে তাদের মধ্যে কেউ কেউ নিজের বাহু ভাঁজ করে স্তন ঢাকার চেষ্টা করল। ওরকম ভঙ্গী করে তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পরিত্যাক্ত জিনিসগুলোর পাহাড় বেয়ে উঠতে লাগল। তারপর চূড়ায় উঠে আরেকদিকের অ্যাম্ফিথিয়েটার বেয়ে নেমেও গেল। সেখানে উপত্যকার মাঝখানে দাঁড়িয়ে বৃত্তাকারে দাঁড়াল। বিশাল এক বৃত্ত। তারপর নিজেদের হাতদুটো উপরের দিকে মেলে দিল। 

মেয়েদের রচিত বৃত্ত আর উৎক্ষিপ্ত হাতের ভঙ্গীমায় চাঁদ হয়ত উদ্দিপ্ত হয়ে আবারো চলতে শুরু করল। মনে হলো কোত্থেকে যেন হঠাৎ কিছু শক্তি সঞ্চয় করে নড়েচড়ে উঠল। দুই হাত মেলে রাখা বৃত্তাকারে দাঁড়ানো মেয়েরা তাদের মুখ আর বুকগুলো চাঁদের দিকে তুলে ধরল। চাঁদ কি তাদের কাছে এটাই চেয়েছিল? চাঁদের কি আকাশে চলেফিরে বেড়ানোর জন্য এটুকু সাহায্যের খুবই দরকার পড়েছিল? প্রশ্নের উত্তরটা নিয়ে ভাবার মতো সময় আমি পেলাম না। কারণ ঠিক তখনই সেখানে এসে উপস্থিত হলো বিরাট এক ক্রেন। 

পৃথিবী আর আকাশের শরীর থেকে এক গাদা অশোভন আর কুৎসিত জিনিসের বোঝা কমিয়ে ফেলার দায়িত্ব সঁপে দেয়ার জন্য কর্তৃপক্ষ ভেবেচিন্তে ক্রেনটির নকসা করেছে। সেটা ছিল একটা বুল্ডোজার যার ভিতর থেকে কাঁকড়ার হাতের মতো একটা থাবা বেরিয়ে এল। শুঁয়োপোকার অসংখ্য পায়ের মতো পা দিয়ে নিঃশব্দে ঘুরে ঘুরে অবিকল কাঁকড়ার মতো শরীরটা হেলেদুলে সেটা সামনে এগোতে লাগল। আর যখন ধীর চালে ওটা জায়গামতো এসে পৌঁছল তাকে আগের চেয়েও ভয়ঙ্কর মনে হতে লাগল। সমস্ত শরীর দিয়ে বুল্ডোজারটা মাটির সঙ্গে চেপে বসে থাকল। বড়ো একটা হ্যান্ডেল নড়াচড়া করলে তার ভিতর থেকে ইয়া বড়ো হাত বেরিয়ে আকাশের গায়ে আছড়ে পড়ল। একটা ক্রেনের যে এত দীর্ঘ হাত থাকতে পারে তা না দেখলে কারো পক্ষে বিশ্বাস করা কঠিন। হাতটার সামনে আটকানো বাকসোটা খুলে তার ভিতর থেকে যেন ক্রেনের দাঁত বেরিয়ে এল। তখন ওটাকে কেবল কাঁকড়াই নয়, বরং মনে হতে লাগল হাঁ করা হাঙ্গরের মুখ। চাঁদটা তখনো ওখানেই দাঁড়িয়ে ছিল। তারপর ক্রেনটাকে দেখে এমনভাবে কেঁপে উঠল যেন পালাতে চায়। কিন্তু ক্রেনটা যেন চৌম্বকীয় আকর্ষণে তাকে টেনে ধরল। আমাদের চোখের সামনে চাঁদ থেকে সমস্ত বাতাস সে শুঁষে নিল। চাঁদটা শেষে আশ্রয় পেল ক্রেনের চোয়ালের উপরে। চোয়ালটা তীব্র শব্দে বন্ধ হতে লাগল-- কড় কড় কড়াৎ! এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো চাঁদটা যেন কেকের উপরের ক্রিমের মতো গলে যাচ্ছে, কিন্তু না, সেটা ওখানেই স্থির হয়ে থাকল। আর তারপর ক্রেনের চোয়ালের ভিতরে অর্ধেক আর চোয়ালের বাইরে অর্ধেকটা হয়ে ঝুলে থাকল। তবে চাঁদের আকৃতি বদলে হয়ে গেল চ্যাপটা, লম্বালম্বি যেটা মোটাসোটা এক সিগারেটের মতো ক্রেনের চোয়ালে আটকানো। উপর থেকে ছাইরঙা ধূলোর ঝাপটা আসতে লাগল। 

ক্রেনটা তখন চাঁদকে তার কক্ষপথ থেকে টেনেহিঁচড়ে নীচে নামিয়ে আনতে চেষ্টা করল। ক্রেনের হ্যান্ডেল পিছনের দিকে বেঁকে যাবার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করল। কিন্তু সেজন্যে দরকার অনেক বেশি শক্তি। পুরো সময়টাতে ডায়ানা আর তার দলবল বৃত্তাকারে দাঁড়িয়ে হাত উপরের দিকে মেলে রাখল, তারা যেন শক্তিশালী বৃত্ত রচনা করে সমবেত শক্তি দিয়ে কোনো শত্রুকে মোকাবেলা করতে চায়। আর ঠিক তখনই চাঁদ থেকে নেমে আসা ধোঁয়ার মতো ছাই বৃষ্টি হয়ে তাদের মুখ আর স্তনের উপরে ঝরঝর করে ছড়িয়ে গেল। ডায়ানা তখন তীক্ষè আর্তনাদ করে উঠল। 

ঠিক ওই মুহূর্তে বন্দি চাঁদটার গায়ে যেটুকু আলো অবশিষ্ট ছিল তাও গেল হারিয়ে। চাঁদ পুরোপুরি অন্ধকার হয়ে গেল, হয়ে গেল কালো আর আকার-আকৃতিহীন পাথরের এক টুকরোমাত্র। ক্রেনের চোয়ালের মধ্যে ধরা না থাকলে ওটা নির্ঘাত পৃথিবীর গায়ে আছাড় খেয়ে চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যেত। ওদিকে নীচে শ্রমিকেরা লম্বা খুঁটির মাথায় বিশাল এক ধাতব জাল টাঙিয়েছে, অন্তরীক্ষের পরিত্যাক্ত সমস্ত জিনিস সংগ্রহ করে ক্রেনটা যেন ধীরে ধীরে সেখানে ফেলতে পারে। 

চাঁদটাকে যখন কাছাকাছি আনা হলো তার সারা শরীরে ছোটোবড়ো ছিদ্র, বালুময় ট্যাপ খাওয়া টুকরো, এতটাই বিশ্রী আর অস্বচ্ছ যে তার দিকে তাকিয়ে ভাবতে অবান্তর মনে হলো, কোনো এক কালে ওই চাঁদটাই তার উজ্জ্বল প্রতিফলনে সারা আকাশকে আলোময় করে রাখত। ক্রেনের চোয়ালটা খুলে গেল। বুল্ডোজার তার শুঁয়োপোকার মতো পায়ের উপরে সামান্য কাত হয়ে নড়েচড়ে উঠল, হুট করে ওজন হারানোতে সেটা যেন বিভ্রান্ত। শ্রমিকেরা নীচে জালটা নিয়ে প্রস্তুত ছিল। জাল দিয়ে তারা চাঁদটাকে মুড়িয়ে ফেলল, চাঁদ আটকা পড়ল ধাতব জাল আর পৃথিবীর মাটির মাঝখানটাতে। চারদিক থেকে বেঁধে ফেলা পোশাকের ভিতরে চাদটা দাপাদাপি করতে লাগল। ভয়ানক উথাল পাতাল ভূমিকম্পে হাজারে হাজারে শূন্য পানীয়ের ক্যান তখন পাহাড়ের গা বেয়ে এদিকওদিকে ছিটকে পড়ল। আর তারপর সমস্তকিছু আবারো শান্ত হয়ে এল। চাঁদবিহীন আকাশটা বিশালাকৃতির বাতির আলোয় ভেসে গেল। ক্রমে কোনো না কোনোভাবে অন্ধকার সরিয়ে ফেলবার বন্দোবস্ত হয়েই গেল। 

ভোরের আলোর প্রথম কণা পরিত্যাক্ত জিনিসে ঠাসা জায়গাটা আবিষ্কার করল। হাজারো ফেলনা জিনিসের মাঝখানটাতে দুমড়ে মুচড়ে থাকা চাঁদকে তখন সেখানকার অন্যান্য সবকিছু থেকে আলাদা করা গেল না। তার রঙ আর সমস্তকিছুর রঙের মতোই, একইরকমের বিগত হয়ে যাওয়া প্রতিচ্ছবি যা আগের চেহারায় কখনো ফিরবে বলে কল্পনাও করা যায় না। গুনগুনানো একটা ক্ষীণ শব্দ চাঁদের কলঙ্কের মতো খোদাইয়ের গায়ে আর পার্থিব ভাঙাচোরা জিনিসগুলোর শরীরে ধাক্কা খেয়ে খেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে ঘুরেফিরে বাজতে লাগল। ভোরের আলোর কণাগুলো সমুদ্র প্রমাণজীবিত জিনিস উদ্ঘাটন করল যারা ধীরে ধীরে জেগে ওঠে। পেট চিরে নাড়ি-ভুঁড়ি বের করে নেয়া গাড়ি, ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন চাকা আর মোচড়ানো ধাতব টুকরোর মাঝখানে ঘুম থেকে জাগা লোমশ প্রাণীরা কিলবিল করতে লাগল। 

পরিত্যাক্ত সমস্ত জিনিসের মাঝখানে এক দঙ্গল উপেক্ষিত মানুষ থাকত-- সমাজ যাদের সামাজিকতার প্রান্তে পাঠিয়েছে, কিংবা যারা স্বেচ্ছায় সমাজ থেকে দূরত্বকে আপন ভেবেছে, নিত্যনতুন জিনিস কিনতে না কিনতেই পুরোনো তকমা লেগে যায় বলে ফেলে দিতে হবে-- এই নীতি মেনে জিনিস কেনার হিড়িকে যারা যোগ দিতে চায়নি, আর যারা ধরে নিয়েছে ফেলে দেয়া জিনিসের মধ্যেই পৃথিবীর সত্যিকারের ঐশ্বর্য লুকিয়ে আছে। চাঁদের চারদিকে কয়েক পাক ঘুরে, অ্যাম্ফিথিয়েটারের সিঁড়িগুলোয় ইচ্ছেমতো লাফিয়ে নিয়ে হাড় জিরজিরে শরীরগুলো এখানে ওখানে বসে কি দাঁড়িয়ে জিরোতে লাগল। তাদের মুখগুলোয় দাড়ির আধিক্য। চিরুনি না পড়া চুলের ঘেরাটোপে আচ্ছন্ন। আউলা ঝাউলা আর আবোলতাবোল পোশাকের এক গাদা মানুষের মাঝখানে আগের রাত থেকে বৃত্তাকারে দাঁড়িয়ে থাকল আমার উলঙ্গ ডায়ানা আর তার সঙ্গীসাথীরা। তারা একসঙ্গে এগিয়ে এল আর খুঁটির সঙ্গে আটকানো জালের বেঁধে রাখা তারগুলোর বাঁধন আলগা করতে লাগল। 

ঠিক তখনই নোঙর থেকে ফসকে যাওয়া নৌকোর মতো চাঁদটা ছলকে উঠল। মেয়েগুলোর মাথার উপরে, অ্যাম্ফিথিয়েটারের সবচেয়ে উঁচু জায়গার যেখানে কোথাও থেকে আসা শ্রমিকেরা সারি বেঁধে বসে ছিল, তারও উপরে বাতাসের মধ্যে ভেসে দুলতে লাগল। তবে চাঁদের গায়ে ধাতব জালটা জড়ানো যার কোণের তারগুলো ধরে রেখেছে ডায়ানা আর তার সঙ্গীরা। কখনো চাঁদ মেয়েদেরকে নিজের দিকে টেনে নিল, কখনো আবার মেয়েরা চাঁদটাকে। আর তারপর মেয়েরা যখন তারগুলো হাতে মুড়িয়ে উলটোদিকে দৌড়োতে লাগল, চাঁদটা উপায় না পেয়ে তাদের অনুসরণ করল। 

চাঁদটা নড়েচড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে পরিত্যাক্ত জিনিসের পাহাড়-উপত্যকায় একটা ঢেউ লেগে গেল। পুরোনো গাড়ির শরীরগুলো এমনভাবে একটার পর একটা ধাক্কা লেগে ভাঙতে লাগল যেন কোনো হারমোনিয়াম বাজছে। ভেঙে ভেঙে তারা নিজেদের মধ্যে নতুন করে সেজে নিল। খালি ক্যানগুলো হুমড়ি খেয়ে এমন ঘূর্ণীর শব্দ তুলল যেন বজ্রপাত, যদিও কার কারণে কার গায়ে ধাক্কা লাগছে বা কে ধাক্কা দিচ্ছে তা বলা কঠিন। পরিত্যাক্ত জিনিসের স্তূপ থেকে উদ্ধারকৃত চাঁদটার পিছনে ছুটতে ছুটতে জিনিসগুলো এবং যে মানুষগুলোকে সমাজ ওই কোণে ছুঁড়ে ফেলেছিল তারা প্রত্যেকে রাস্তায় উঠে এগিয়ে যেতে লাগল। ভাঙাচোরা জিনিস আর উপেক্ষিত মানুষের জন¯্রােতটি শহরের সবচেয়ে ধনীদের পাড়ার দিকে ধাবমান হলো। 

সেদিন সকালে শহরে ভোক্তাদের ধন্যবাদ জ্ঞাপনের উদ্যাপন। উৎসবটি প্রতি বছর নভেম্বরের একটি বিশেষ দিনে ফিরে ফিরে আসত। ফিরে আসত যেন উৎপাদনের দেবতাকে ক্রেতা তার কৃতজ্ঞতা জানাতে পারে, যে কিনা বিরতিহীনভাবে তাদের প্রত্যেকটি গভীর ইচ্ছা পুরণ করে। শহরের সবচেয়ে বড়ো বিপণিবিতান প্রতি বছর এ উপলক্ষ্যে একটা ফ্যাশন প্যারেডের আয়োজন করত। বেলুনের মতো বাতাসে ফোলানো অতিকায় আকৃতির উৎকটরঙা পুতুল প্যারেডে অংশ নেয় যাদের হাত-পায়ের সুতো ধরা থাকে জরি-চুমকি খচিত পোশাক পরা মেয়েদের হাতে। বাজনা বাজিয়ের দলের পিছনে পিছনে তারা যায় আর সুতো নেড়ে পুতুলের শরীর সঞ্চালন করে। সেদিনও মিছিলটি ফিফথ অ্যাভিন্যুর দিকে এগোচ্ছিল। বাতাসে ঘুরে ঘুরে কঙ্গোর উপর লাঠি পড়ছিল, বড়ো ড্রামের উপরে দুম দুম করে তাল পড়ছিল, তৃপ্ত গ্রাহকের প্রতিনিধির বেশে বিশালাকার বেলুনের দৈত্যেরা আকাশচুম্বী ইমারতগুলোর মাঝ বরাবর ধীর পায়ে এগোচ্ছিল। তারা চলছিল বাহারি টুপি মাথায় কোমর থেকে নানারকমের সুতো আর জরির ঝালর ঝোলানো ঝলমলে পোশাক পরা মেয়েদের সুতোর টান অনুযায়ী, যে মেয়েগুলো চড়ে বসে ছিল ধাতব আর পাথরের নকসা করা মোটর সাইকেলে। 

ওদিকে একই সময়ে আরো একটি কুচকাওয়াজ ম্যানহ্যাটনের রাস্তা ধরে এগোচ্ছিল। সেই ফালি ফালি হয়ে যাওয়া দলামতো চাঁদটাও আকাশে মিলিয়ে যাওয়া উঁচু ইমারতগুলোর মাঝখান দিয়ে সামনে বাড়ছিল। চাঁদটাকে টানছিল উলঙ্গ মেয়েরা, আর চাঁদের সঙ্গে আটকে ছিল অগুনতি ট্যাপ খাওয়া মোচড়ানো গাড়িসহ অসংখ্য ট্রাকের কংকাল। মিছিলটা শব্দহীন আর ক্রমবর্ধমান। সেই ভোর থেকে চাঁদের পিছনে হাঁটা এক দল মানুষের সঙ্গে দলে দলে আরো হাজার মানুষ যোগ দিল। বিভিন্ন বর্ণের মানুষেরা পরিবারসহ, এমনকি বিচিত্র বয়সের বাচ্চাদের নিয়ে মিছিলে যোগ দিল। হারলেমের আশেপাশে কৃষ্ণাঙ্গ আর পুর্তোরিকানদের এলাকা ছাড়িয়ে মিছিলটি এগিয়ে চলল। 

চাঁদের মিছিল শহরের অভিজাত এলাকার দিকে চলে গেল। তারপর ব্রডওয়ে হয়ে দ্রুত অন্য মিছিলটির সঙ্গে মিলে গেল, যে মিছিলে ফিফথ অ্যাভিন্যু জুড়ে ছিল অতিকায় পুতুলের বেলুন। 

মেডিসন স্কয়ারে মিছিলদুটো মুখোমুখি হয়েছিল। আরো পরিষ্কারভাবে বললে, দুটো মিছিল ঠিক ওইখানটায় একটিতে পরিণত হলো। পরিতৃপ্ত গ্রাহকেদের সঙ্গে চাঁদের হতশ্রী উপরিভাগের একটা সংঘর্ষ না লেগেই যায় না। ধাক্কায় গ্রাহকেরা ছিটকে রবারের পাপশের উপরে গিয়ে পড়ল। মোটরসাইলের উপরে দেখ গেল ডায়ানাদের। বিচিত্ররঙা ফিতে টেনে ধরে তারা চাঁদের গতিপথ বাতলে দিচ্ছিল। কেন যেন ডায়ানাদের সংখ্যা আগের চেয়ে দ্বিগুণ মনে হতে লাগল। মোটরসাইকেলের উপরে আগে থেকে বসে থাকা রঙবেরঙের পোশাক আর বাহারি টুপিতে সজ্জিত মেয়েরা হয়ত তাদের পোশাক-আশাক খুলে ফেলে দিয়েছে। মিছিলে অংশগ্রহণ করা মোটরসাইকেল আর গাড়িগুলোর দশাও মেয়েদের মতোই। প্যাচওলা চাকা আর জং পড়া শরীরের গাড়িগুলো চকচকে ঝিলিক মারা মোটরসাইকেলগুলোর সঙ্গে এমনভাবে মিলে গেল যে কোনটা পুরোনো আর কোনটা নতুন বোঝা মুশকিল। 

ওই ঝলমলে মিছিলের ঠিক পিছনে দোকানের শোকেসগুলো পিপড়ার বাসা আর মাকড়সার জালে ছেয়ে গেল, আকাশচুম্বী ইমারতের লিফটগুলো ঝনঝন শব্দে ভেঙে পড়তে লাগল, বিজ্ঞাপনের বিশাল পোস্টারগুলো মুহূর্তে হলদে হয়ে গেল, ফ্রিজের ভিতরে সাজিয়ে রাখা বাকসে ডিম থেকে মুরগির বাচ্চা ফুটে বেরোল-- যেন ওগুলো মুরগির বাচ্চা উৎপাদনের যন্ত্র, টেলিভিশনে আবহাওয়ার সংবাদে ঘূর্ণীঝড়ের খবর প্রচার হতে লাগল। শহরটা মুহূর্তের মধ্যে নিজেই নিজেকে ধ্বংস করে ফেলল। পরিত্যাক্ত আস্ত শহরটা নষ্ট চাঁদের শেষ যাত্রায় সঙ্গী হলো। 

শূন্য ক্যানগুলোর উপরে ড্রামের মতো শব্দ করতে করতে মিছিলটি ব্রুকলিন ব্রিজের কাছে এসে উপস্থিত হলো। ডায়ানা ড্রামের লাঠিগুলো হাতে নিয়ে উপরে তুলে ধরল। তার সঙ্গীরা হাতের ফিতেকে উপরে বাতাসের মধ্যে পাক খাইয়ে নাড়াতে লাগল। চাঁদটা শেষবারেরমতো ভয়ানক কেঁপে উঠল, তারপর ব্রিজের গ্রিলের কারুকাজ বেয়ে উপরে উঠতে লাগল। শেষে সেখান থেকে টুপ করে সমুদ্রে পড়ে গেল। পানিতে পড়ল ঠিক থান ইটের মতো। সমুদ্রে আলোড়ন তুলে উপরিভাগে প্রচুর ফেনা তৈরি করে চাঁদটা সেখানে ডুবে গেল। 

ওদিকে ফিতেগুলোকে হাত থেকে ছেড়ে না দিয়ে মেয়েরা সেগুলো শক্ত করে ধরেই ছিল। চাঁদ তাদেরকে ফিতেসমেত বাতাসে ভাসিয়ে রাখল। ব্রিজের রেলিঙের উপর দিয়ে তাদের ভাসিয়ে নদীর উপরে নিয়ে গেল। তারা প্রথমে পানির উপরে অর্ধবৃত্তাকারে কিছুক্ষণ উড়ল যেন বাতাসে ওড়া ডুবুরি, পরে ঝুপ করে পানির তলায় অদৃশ্য হয়ে গেল। 

আমরা আশেপাশে দাঁড়িয়ে বিস্ময়ে অভিভূত চোখে তাকিয়ে ছিলাম। আমাদের মধ্যে কেউ কেউ দাঁড়িয়ে ছিল ব্রুকলিন ব্রিজের উপরে, কেউবা তীরের জেটিতে। আমাদের মধ্যে অনেকেই মেয়েদের মতো করে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ার কথা ভাবছিল, তাদের পরপরই। তারা মনে মনে ভাবছিল মেয়েগুলো আগের মতোই আবার উদয় হবে। 

আমাদের বহুক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি। সমুদ্র অসংখ্য ঢেউয়ে ভরে উঠল, ঘূর্ণীর মতো ঘুরে ঘুরে বৃত্তাকারে কেপে কেঁপে ছড়িয়ে গেল। বৃত্তের কেন্দ্রে একটা দ্বীপ জেগে উঠল, দ্বীপটা পর্বতের মতো উঁচু হতে লাগল, পর্বতটা হয়ে গেল একটা বলের অর্ধেকটার মতো যেন পানির উপরে একটা গ্লোব আধাআধি ভাসছে কিংবা পানি ফুঁড়ে অর্ধেকটা বেরিয়ে এসেছে, ঠিক যেমন চাঁদ আকাশে কখনো অর্ধেক হয়ে ভাসে। আমি চাঁদের সঙ্গেই তুলনা দিচ্ছি, যদিও খানিক আগে যে চাঁদটা আমাদের চোখের সামনে পানিতে ডুবে গিয়েছিল সেটা মোটেও আমার দেখা চাঁদের মতো ছিল না। যা হোক, পানিতে ভাসা নতুন এই চাঁদটা আগের চাঁদ থেকে একেবারে আলাদারকম হবার যথেষ্ট কারণ আছে। সমুদ্র ফুঁড়ে ওঠার সময়ে ওটা সবুজের একটা আভা ছড়িয়ে রেখেছিল, আবৃত ছিল চকচকে সি-উইড দিয়ে। চারদিকে ফোয়ারার মতো পানি ছড়িয়ে যেন পান্নাখচিত এক মাঠ পানির তলদেশ থেকে ভেসে উঠল। তার উপরের স্তর বাষ্পের মতো জঙ্গলে ছাওয়া তবে সেসব গাছপালা নয়। ঝোপঝাঁড়টি দেখে মনে হলো ময়ূরের পালকে বোনা, প্রতিটি পালকে চোখের প্রতিচ্ছবি, জ্বলজ্বলে রঙ। 

পানি থেকে ফুঁড়ে ওঠা গোলকটি আকাশে ফিরে যাবার আগ পর্যন্ত ওই এলাকার চেহারাটা এমনই ছিল। মুগ্ধ হয়ে চারপাশটা দেখতে দেখতে হয়ত অনেক সূক্ষè বিষয় চোখ এড়িয়ে গেছে, আছে কেবল সজীবতা আর সবুজের সান্নিধ্যের স্মৃতি। তখন গোধূলী। আলো স্মিত হয়ে আসায় কিংবা তারতম্যের কারণে আলোছায়ার এক আলপনা তৈরি হলো। চাঁদের মাঠ আর জঙ্গলটা তখন দেখা যাচ্ছে কি যাচ্ছে না, মনে হচ্ছে পৃথিবীর অন্য সমস্ত স্নিগ্ধ সবুজ মাঠের মতোই কোনো এক স্থান বইকি। কিন্তু তারপরেও আমরা সেখানকার গাছের ডাল থেকে ঝুলন্ত বেশ কয়েকটা দোলনা দেখতে পেলাম, বাতাসের চলাচলে যারা দুলছিল। আর তারপর দেখলাম দোলনায় দুলছে সেই মেয়েগুলো যারা আমাদের পথ দেখিয়ে এখানটায় নিয়ে এসেছিল। আমি ডায়ানাকে চিনতে পারলাম। প্রশান্ত মুখে সে প্রায় শেষের দিকে বসে আছে, পালকের একটা পাঙ্খা দিয়ে নিজেকে বাতাস করছে। হতে পারে ওভাবে সে আমাকে কোনো ইশারা করছে যেন আমি সহজেই তাকে চিনে নিতে পারি। 

‘ওই যে ওরা ওখানে! ওই যে ওখানে ডায়ানা!’ আমি চিৎকার করে উঠলাম। আমার সঙ্গে বাকিরাও চিৎকার দিল। কিন্তু তাদেরকে ফিরে পাওয়ার আনন্দ একইসঙ্গে বয়ে আসা চিরতরে তাদের হারানোর ব্যথার কাছে হেরে গেল। কারণ চাঁদটা এখন ঘন অন্ধকার আকাশে ভাসবে, পৃথিবীর জলরাশি আর বিস্তৃত মাঠের উপরে যে আলো ছড়াবে তা হবে কেবলই সূর্যের দান। 

আচমকা উত্তেজনায় আমরা পাথর হয়ে গেলাম। আর তারপর মহাদেশের বুকের উপর দিয়ে, পৃথিবী আবৃত করে রাখা তৃণভূমি আর বন-জঙ্গল চিরে, পথঘাট আর শহর-বন্দরকে পায়ে ঠেলে, জীবনের সকল চিহ্ন মুছে দিয়ে আমরা ছুটে চলতে লাগলাম। হাতির মতো বিকট শব্দে চিৎকার শুরু করলাম। আমাদের শুঁড়, লম্বাটে সরু দাঁত আর অগোছালো লোম প্রবল আক্রোশে আকাশের দিকে তুলে ধরলাম। কারণ অল্প বয়সি বিলুপ্ত হাতি হলেও আমরা উপলব্ধি করেছিলাম যে এই সেই মহেন্দ্রক্ষণ যখন জীবনের সূচনা হয়। আর ঠিক তখনই এ-ও নির্ধারিত হয়ে যায় যে যা পাওয়ার জন্য হয়রান হয়ে ছুটতে থাকি তা আমরা কখনো পাব না।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ