মার্গারেট অ্যাটউড্‌'এর গল্প : বাথরুমে যুদ্ধ


অনুবাদ : ঝর্না বিশ্বাস 


সোমবার 

বিকেল গড়াতেই মেয়েটা পুরনো জায়গা ছেড়ে নতুনটায় এলো। এই বাসা বদলের কাজে খুব বেশি ঝামেলা হলো না: মোটামুটি দুটো স্যুটকেসে যাবতীয় জিনিস ভরে নিজেই বয়ে নিয়ে গেল নতুন বাসায়। নতুন বাসাটা পুরনোর থেকে প্রায় তিন ব্লক দূরে। এসবের মধ্যে মাত্র দু বার তাকে বিশ্রাম নিতে হলো। বয়সের তুলনায় এখনও শক্তপোক্ত সে। একজন ভদ্রলোক সাহায্যের জন্য এগিয়ে এলেও অচেনা মানুষ তাই না করে দিল। 

মনে হলো তাঁর এরকম চলে যাওয়াতে জার্মান মহিলাটি বেশ খুশি হয়েছেন। তিনি বরাবরই তাকে কিছুটা সন্দেহের চোখে দেখতেন। পায়ে চটি গলিয়ে উনি যখন কাঠের গাড়িবারান্দায় দাঁড়াতেন, তখন চোখ থাকত এদিকেই। হাত দুটো ভাঁজ করে রাখতেন মেদবহুল পেটের উপরে। এখানে সোয়েটারটা গিঁট দিয়ে বাঁধেন। আর সব সময়ের মতো রোজকার সুতির পোশাকের নীচ থেকে এক ইঞ্চি ঝুলে থাকত তার ভেতরে পরা ফতুয়াটাও। আমি, প্রথম থেকেই ঐ জার্মান মহিলাকে অপছন্দ করতাম। ঘরে আগোছালো জিনিসপত্র দেখতে দেখতে বিরক্ত হয়ে উঠেছিলাম (যদিও উনি সামান্য চেষ্টা করতেন সেগুলো গুছিয়ে রাখার, কিন্তু কোনও কাজেই নিখুঁত ছিলেন না)। পরে অবশ্য সন্দেহ হলো -- ওনার নজর থাকে সেই চিঠিটায় যার খামে একটা চটচটে আঙুলের ছাপ পড়েছে। তখনো বেশ ঠাণ্ডা রয়েছে — এ সময় ডাকহরকরাদের পক্ষেও বিনা দস্তানায় চিঠি বিলি করাটা খুব কষ্টকর। নতুন জায়গায় এসে বাড়িওয়ালির বদলে এক বাড়িওয়ালা পাওয়া গেল। সব মিলিয়ে পছন্দ হয়ে গেল আমার। 

সেখানে পৌঁছতেই এক বয়স্ক লোকের হাত থেকে ঘরের চাবিটা পেল সে। তিনি নীচ তলার সামনের ঘরটায় থাকতেন। দরজায় ঘন্টা বাজাতে বেরিয়ে এলেন। বললেন, এই মুহুর্তে বাড়িওয়ালা নেই। তবে আপনার আসার কথা বলে গেছেন। এক মাথা পাকা চুলের ওই বয়স্ক লোকটার মিষ্টি হাসি দেখে বেশ পরোপকারী মনে হচ্ছিল। একেকটা স্যুটকেস এক এক বারে নিয়ে সরু সিঁড়ি ধরে দোতলায় উঠে গেল সে। সারাটা দিন গেল তার ঘর গুছোতেই। পুরনো বাসার চাইতে এটা তুলনামূলক ভাবে ছোট হলেও পরিষ্কার। তাকওয়ালা আলমারিতে কিছু কাপড় রেখে বাকিটা ড্রয়ার সহ ডেস্কে গুছিয়ে রাখল। রান্নাঘরে বাসনপত্রের জন্য আলাদা কোনো তাক ছিল না, তাই এরই এক ড্রয়ারে সসপ্যান, কাপ, প্লেট, ছুরি, কাঁটা চামচ, চামচ ও কফি-পটের জায়গা করা হলো। সেখানেই একটা ছোট টেবিল ছিল, ঠিক হলো অন্তত খাবার সময় টি-পট টা ওখানে রাখা যেতে পারে। বেশ কারুকার্যময় ছিল ওটা। 

এরপর সে বিছানায় চাদর পাতল। কম্বল বাড়িওয়ালা দিয়েছেন। ঘরটা উত্তর দিকে হওয়াতে খুব ঠান্ডা। ভাগ্যক্রমে একটা ইলেকট্রিক হিটার ছিল ঘরে। এই উষ্ণ ভাবটা বেশ লাগে। যদিও তাপমাত্রার হেরফের নিয়ে তেমন মাথা ঘামাই নি কখনও। উপরিপাওনা হিসেবে ঘরের লাগোয়া একটা বাথরুম আছে, এতে সুবিধাই হবে। 

নোটবুকটা রাখব টেবিলে টি-পটের পাশেই। 

আর কাল তাকে অবশ্যই কিছু মুদিখানার জিনিস কিনতে বেরোতে হবে। কিন্তু এখন সে বিছানায়, বিছানায় যাবে। 



মঙ্গলবার 

সকালে গড়াগড়ি দিয়ে আরেকটু ঘুমিয়ে নিতে চাইছিল সে। ঘড়ি দেখলাম। ওর সাথে একমত ছিলাম যে এখানকার গদিটা পুরনো বাসার তুলনায় পাতলা ও শক্ত, বেশ শক্ত। এদিকে ন’টা বেজে গেছে দেখে বলতেই হলো এবার ওঠো আর অ্যালার্ম বন্ধ করো। 

সামনের সিঁড়ি দিয়ে কেউ গুটিপায়ে বাথরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। তখনই আবিষ্কার করলাম দেওয়ালটা বেশি পুরু না আর বাইরের সমস্ত আওয়াজ স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। ভেতরের লোকটার একটানা কাশিতে আবারও পাশ ফিরে শুতে চাইছিল সে। এরপর সেখান থেকে থুথু আর জলের ক্রমাগত শব্দ আসতে থাকল। মনে হচ্ছিল ভেতরে কে আমি জানি : নীচ তলার সেই বয়স্ক লোকটিই হবেন। নিশ্চয়ই ওনার খুব সর্দিকাশি হয়েছে। প্রায় আধঘন্টা উনি বাথরুমে থাকলেন, টানা অনেকটা সময়; আর মাঝে মাঝেই ভিন্ন রকমের আওয়াজ। বাথরুমের লাগোয়া ঘরের অসুবিধেটা তখন টের পেলাম, আর বুঝতে পারলাম এই জন্যই বাড়িওয়ালা এত সস্তায় ভাড়াটা দিয়েছেন। 

শেষমেশ তাকে ওঠানো গেল আর জানলা বন্ধ করলাম (বাইরের তাজা হাওয়া শরীরের জন্য খুব ভালো, কিন্তু সে এটা মানত না) এরপর হিটার চালানো হলো। সে আবারও বিছানার দিকে এগোতে চাইলে বললাম, জামাকাপড় পরে তৈরী হয়ে নাও কেনাকাটা আছে, ঘরে খাওয়ার মতো কিছু নেই। যদিও এরপর সে বাথরুমে ঢুকলো, তাও তাড়ায় আছে বলে মনে হলো না। ভেবেছিলাম বাথরুম আজ পরিষ্কার পাওয়া যাবে, কারণ সকালেই বেসিন শুদ্ধ সব সাফ করা হয়েছে। গরম জলেরও এখানে কোনো অসুবিধা নেই। 

বাথরুম থেকে বেরিয়ে সে গায়ে কোট জড়ালো আর জুতো পরে নিলো। জানলায় ঝোড়ো হাওয়ার সাথে বরফকুচি পড়ছে দেখে স্কার্ফ নিতে বললাম। পার্স উঠিয়ে বেরোতেই তালা দেওয়া হলো। বাথরুমের দরজাটা বন্ধই ছিল; এখন ওপর থেকে এক চিলতে আলো দেখা যাচ্ছে। সিঁড়ির নীচ অবধি পৌঁছতেই দেখি হলঘরে বয়স্ক লোকটা বড় দরজার সামনে রাখা অন্ধকার টেবিলে কিছু চিঠি বাছাই করছেন। তার পরনে তোয়ালে জড়ানো যার নীচে ডোরাকাটা পায়জামাতে সরু গোড়ালি দেখা যাচ্ছে, আর পায়ে ঘরে পরার মেরুন চামড়ার চটি। মিষ্টি হেসে উনি সুপ্রভাত জানালেন। মাথে নীচু করে তাকেও একবার হেসে নিতে হলো। 

সামনের দরজা দিয়ে বেরোতেই সে পকেট থেকে দস্তানা দুটো বার করে পরে নিল। তারপর খুব সাবধানে গাড়িবারান্দার সিঁড়ি ধরে নেমে এলো যেখানে কাঠের উপর বরফ জমে আছে। আগেও লক্ষ্য করেছি সিঁড়ি ধরে ওঠার চাইতে নামাটা বেশি বিপদজ্জনক। 

রাস্তা ধরে এগোতে গিয়ে মনে পড়লো এখানে একটা দোকান ছিল আগে। আশে পাশের বাসাগুলো দেখে খুব ভালো লাগছিল: লাল ইঁটের, বেশির ভাগ দোতলা, যেখানে ভেতরে একটা করে ঘর আর বাইরে জোড়া বারান্দা। যদিও পুরনো জায়গার বাসাগুলো এর চাইতে বড় ছিল। মনে হলো, এ রাস্তায় আমি এসেছি (পুরনো জায়গা থেকে এটা খুব একটা দূরে না), কিন্তু প্রথমবার এই জায়গা খুব নিজের মতো লাগলো। মনে হলো, এ এক নতুন সাম্রাজ্য যেন, যেখানে খেয়াল খুশিমত চলতে পারি। এখানকার সমস্ত গাছ আমার। অলিগলি সব আমার। যখন বরফ গলতে শুরু করবে, গাছ ভরে যাবে ফুলে ফুলে, আর রুক্ষ পৃথিবী ও নতুন পাতাতে লাগবে সেই ছোঁয়া, ঝর্নার জলও এসে মিশে যাবে নদী ও নালায় – সেই সবই হবে আমারই। 

এরপর মূখ্য রাস্তার দিকে সে ঘুরে গেল যেখানে গাড়ি চলাচল প্রচুর। এভাবে এক এক ব্লক করে তিন ব্লক পেরোতেই দোকানটায় এসে পৌঁছল। পুরনো জায়গার কাছাকাছি অবশ্য আরেকটা দোকান আছে, কিন্তু এটায় কখনও আসিনি। 

কাচের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল সে। তারপর একটু চিন্তায়; কি নিলে ভালো হয়, তারওয়ালা বাস্কেট নাকি ট্রলি!...পরে অবশ্য বুঝতে পারল ট্রলিটাই সহজ হবে, বাস্কেট বইতে গেলে ভারী। আমিও বললাম, অত কিছু যখন কেনার নেই বাস্কেট নিলেই হয়। অবশেষে তাই করলো সে। 

আমিও নজর রাখছিলাম ঠিক কত খরচ হচ্ছে। মাংসের টুকরো ও মাশরুম নিতে চাইছিল সাথে অলিভ, পাই আর পর্ক রোস্ট। পুরনো স্বভাব থেকে সে এখনও বেরোতে পারেনি। তারপর আমি বলাতে সস্তা ও পুষ্টিকর কিছু দেখতে থাকল। এখন মাসের মাঝামাঝি চলছে, সরকারী চেকটাও সময়মত হাতে পাওয়া যাবে না। আর বাড়ি ভাড়া দেওয়ার পর বাকি খরচের জন্যেও যে খুব একটা বড় অঙ্কের টাকা থাকবে তাও না। সাথে এটাও মনে করাতে হবে যে কার্ডে বাড়ির ঠিকানাটার এখনও বদল হয়নি। সসেজ একদম অপছন্দের, তাও ছ টার একটা প্যাকেট নিতে বললাম। এতে প্রচুর প্রোটিন আর পয়সাও ভালো মত উসুল হয়ে যাবে। সে পাউরুটি ও মাখন নিলো (আমি বাদ দিয়েছিলাম মার্জারিন) আর এক কোয়ার্ট দুধ ও কটা স্যুপের প্যাকেট, এই ঠান্ডার দিনে এগুলো দারুন সঙ্গ দেয়, আরো কিছু খুচরো জিনিস বলতে যা নেওয়া হলো চা পাতা, ডিম ও কয়েকটা ছোট টিন,বেক্‌ড বিন্‌সের। আইস্ক্রীম নেওয়ার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু তার বদলে ফ্রোজেন মটর নিলাম। 

বেরোনোর কাউন্টারে মেয়েটাকে অল্প বিরক্তিতে দেখা গেলো কারণ কিছু জিনিস আগে দাঁড়িয়ে থাকা মহিলার সাথে অদলবদল হয়ে গেছে। যদিও সন্দেহ হচ্ছিল এসব সে ইচ্ছাকৃত করেছে। এর চাইতে আরেকটু হেঁটে পুরনো দোকানটায় গেলে কি ভালো হত না? 

সব কিছু ঠিকঠাক এনে দুধ, ডিম আর মটরের প্যাকেটগুলো ফ্রিজে রাখতে সে গেল নীচতলার হলঘরে। একটা অদ্ভুত বাজে গন্ধ ছিল ফ্রিজটায়। বাড়িওয়ালাকে এটা পরিষ্কারের জন্য বলতে হবে। তারপর ওপরে এসে বাথরুম থেকে জল এনে নিজের জন্য এক কাপ কফি একমুখো বার্নারের হটপ্লেটে বসিয়ে দিল (কফি স্যুটেকেসে আনা হয়েছিল চিনি, নুন আর গোল মরিচের সাথে) আর তারপর পাউরুটিতে মাখন দিয়ে খেতে শুরু করল। যখন সে খাচ্ছিল, ঠিক তখনই বাথরুমে কেউ ঢুকলেন; কিন্তু এই সময় বয়স্ক লোকটি নয়, ইনি এক মহিলা। একা একাই কথা বলছিলেন; যদিও দুটো স্বর স্পষ্ট আলাদা করতে পারছিলাম। একটা ভারী ও ঝগরুটে মতন আর অন্যটা ফিসফিসে কিন্তু কৌতুহলী। দেওয়াল পাতলা হলেও আন্দাজ করা একটু মুশকিল ছিল ভেতরে কি কথা বলে চলেছেন। 

উনি বেরোতেই কাপ আর চামচ বাথরুমের বেসিন থেকে ধুয়ে নিলো সে। তারপর ঘুম। আমারও মনে হলো আজ এতটা হাঁটার পর এটার খুব দরকার। রাতে খাবার সময় ঘুম ভাঙল। একটা বি্নসের ক্যান খুলে বসতেই ঠিক করলাম চেক হাতে এলে ক্যান ওপেনার কেনা যেতে পারে। 

সব কিছুর শেষে এবার বাইবেল নিয়ে বসব (ঘরের আলোটা যেমন চেয়েছিলাম তেমনই আছে) তারপর শুতে যাওয়া। 

নোট: কাল তাকে অবশ্যই একবার স্নানে যেতে হবে। 



বুধবার 

রোজকার মতো শুরু হলো আজকের দিনটাও। ঠিক ন’টায় সেই বয়স্ক লোকটি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বাথরুমে ঢুকতেই আমার ঘুম ভাঙল। উনি ভয়ঙ্কর কাশিতে ভুগছিলেন। আওয়াজটা এমন যেন বমি হয়ে যাবে। এখন উপায় বলতে একটাই নিজের বিছানাটা একটু ঘুরিয়ে নিতে হবে যাতে মাথা দেওয়াল থেকে দূরে থাকে। কিন্তু ঘরের যা আকার তাতে এটাই একমাত্র জায়গা। সত্যিই খুব বিরক্তির একটানা এভাবে কাশি শুনতে থাকা। ওনার এমন হতে থাকলে ভেতরের সব কিছুই উগড়ে দেবেন মনে হচ্ছিলো। এর জন্য আমার এখন খারাপ লাগছে। যদিও আজ সকালে উনি বাথরুমে আধ ঘন্টা সময় নিয়েছেন। 

এরপর সে ঘুম থেকে উঠল আর তৈরী হয়ে নীচে ফ্রিজ থেকে দুধ নিতে নামলো। বয়স্ক লোকটা হলঘরের টেবিলে কিছু চিঠিপত্র গুছিয়ে রেখেছিলেন: যার প্রত্যেক কোণে একটা করে চিঠি আর মধ্যিখানে একটা। যদিও আজ তাকে মনে করাতেই হবে কার্ডে ঠিকানার যেন বদল করে নেয়। 

সকালে বেশ ক বার সেই দু রকম স্বরের মহিলা বাথরুমে গেলেন। উনি সম্ভবত বালতি বা সসপ্যানের জল ফেলতে বারবার বেসিনে যাচ্ছিলেন। আবারও সেই উঁচু স্বর আর রুক্ষ ফিসফিসানি শুনতে পেলাম। একা একা কথা বলা বাজে অভ্যাস। দুপুরে খাবার পর কাপ প্লেট ধুতে গিয়ে ড্রেনে একটা আলুর খোসা চোখে পড়ল। 

বিকেলে তাকে বললাম এবার অবশ্যই স্নানে যাও। বাথরুম ঠান্ডা, তাই সে কথার কোনও গুরুত্ব দিল না, আমিও একটানা বলে গেলাম পরিচ্ছন্নতা শরীরের জন্য কতটা দরকার। সে ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে বাথটবের পাশে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল, কিছুটা আমাকে বোঝাতেই। পরে দেখলাম ড্রেনে চুল আর সুতোর মত কিছু জমা হয়ে আছে। 

পুরনো বাসায় একজনই আমার বাথরুম ব্যবহার করত, কাজের মেয়েটা তার মোজাগুলো ধুয়ে মেলে দিত তোয়ালের র‍্যাকে। অন্য কারো সাথে বাথরুম ভাগ করে নেওয়াটা খুব অস্বস্তিকর। সে সবসময় চাইত বাথরুমের সিট যেন পরিষ্কার থাকে আর একই বেসিনে অপরিচিত কেউ এসে দাঁত মেজে যাবে এতেও রাজি ছিলাম না। যদিও ভাবতে চেষ্টা করতাম একদিন নিজস্ব বাথরুম হবে, তাও মন মানত না। এখন তাকে এক বোতল এন্টিসেপ্টিক দিতে হবে কারণ আগেরটা শেষ হয়ে এসেছে। 

জল গরম ছিল তাই স্নান ভালো হলো কিন্তু যেমন চাইছিলাম তেমন না। দরজার বাইরে তখন বেশ ক জনের আসা যাওয়া টের পাচ্ছিলাম। সবচেয়ে সুবিধার হত যদি বাড়িওয়ালা আরেকটা বাথরুমের ব্যবস্থা করে দিতেন, নীচে এমন একটা জায়গাও আছে। 

বাথটব ব্যবহারের পর এবার পরিষ্কার করতে হবে। এজন্য বাড়িওয়ালা স্পঞ্জ আর পরিষ্কার করার লিক্যুইডও দিয়েছেন যা দেখে বোঝা যায় ভালোই বুদ্ধি আছে ওনার। আজও অন্তর্বাসটি ধুয়ে সে ইলেকট্রিক হিটারের কাছাকাছি শুকোনোর জন্য মেলে দিল। 



বৃহস্পতিবার 

সকাল থেকে বৃষ্টি পড়ছে, জানলা দিয়ে দেখলাম পেছনের উঠোনে বরফ গলতে শুরু করেছে। এমন আবহাওয়া থাকলে মাখনটা আবার ফ্রিজে রাখতে যেতে হবে; যদিও তাকের অল্প ঠান্ডায় এখন বেশ চলে যাচ্ছে। 

এদিকে বয়স্ক লোকটাকে আর সহ্য করা যাচ্ছিল না। বাথরুমের কার্যকলাপ দেখে বিরক্তি শুরু হয়ে গেছিল। মনে হচ্ছিল, এ বাড়িতে আমার থাকাটা উনি চান না: চেষ্টা করছেন যাতে ছেড়ে চলে যাই। এই সময় উনি কুলকুচি সেরে এক অদ্ভুত আওয়াজ করলেন। এগুলো ইচ্ছাকৃত মনে হলো, যাতে বেশিদিন আর সহ্য করতে না পারি। এখন শান্তিতে একটা ঘুম দরকার। যদিও এমন কান্ডগুলো উনি দূরে নিজের ঘরে গিয়েও করতে পারতেন। 

বাড়িওয়ালার উদ্দেশ্যে একটা চিরকুট লিখলাম যাতে ফ্রিজের গন্ধ নিয়ে বলা আছে। কিন্তু পরে সেটা আর টেবিলে পাওয়া গেল না। ফ্রিজও সেই একই রকম অপরিষ্কার। কিছু মানুষকে বোঝা সত্যি খুব মুশকিল। 

দু রকম স্বরের মহিলাকে বেশ তাড়াহুড়ায় মনে হলো। তিনি আজ স্নান করলেন। ওনাকে দেখে দু জন ভিন্ন মানুষ ভাবতে শুরু করেছিলাম, ভেতর থেকে জলেরও আওয়াজ আসছে; কিন্তু একজনেরই পায়ের ছাপ চোখে পড়ল আসা ও যাওয়ার সময়। ভেতরের ফিসফিস আরো জোরালো ও কর্কশ হলো আর অন্যটার মাথামুন্ডু বোঝা গেল না। 

খাবার জিনিস এখন কম হতে শুরু করেছে। আজ মটর আর দুধ শেষ হলো। খুব তাড়াতাড়ি আবার ঐ দোকানে যেতে হবে, তবে সেইদিন, যেদিন বৃষ্টি থাকবে না। পায়ের জুতো জোড়াও তেমন ভালো না; আর এতে দুজনেই একমত যে ভিজে পায়ে থাকাটা শরীরের জন্য মোটেই সুখকর নয়। 



শুক্রবার 

আজ সিঁড়িতে বয়স্ক লোকটাকে পাশ কেটে চলে গেল সে। সকাল ন’টায় ওই মহত্‌ কার্যটি সারার পর, উনি এক বিকট হাসি দিলেন, যা দেখে মনে হলো আমি যে বাথরুমের পাশের ঘরে থাকি তা উনি জানেনই না (যদিও নীচে হলঘরে যাওয়াটা নিশ্চয়ই শুনেছিলেন)। ওনার এমন বোকা বোকা হাসির পেছনে কোনও কু বুদ্ধি মনে হচ্ছিল। উলটে হাসি না দেওয়াই ভালো তাই সে এক প্রকার রাগেই মুখ ঘুরিয়ে নিল। ওনাকে আর কিছুতেই প্রশ্রয় দেওয়া যায় না। 

একটা রান্না করা ম্যাকারনি দেখলাম ড্রেনে আটকে আছে। এটা নির্ঘাত ওই দুই স্বরের মহিলার কাজ। যদিও উনি ভিনদেশী তাও মোটেই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন নন। 



শনিবার 

দুপুরে খাবার আগেই সে দোকানে গেলো। সূর্য এই সময়টায় মাথার ঠিক ওপরে তাই স্কার্ফের দরকার পড়লো না। রাস্তাতেও বরফ পুরো সাফ তবে বসন্ত আসার আগে একবার ঝড় হতে পারে। হেঁটে যেতে যেতে বয়স্ক লোকটার কথা মনে পড়লো। যা ব্যবস্থা করার খুব তাড়াতাড়ি করতে হবে। বাড়িওয়ালাকে এ খবর জানিয়ে লাভ নেই: তাকে ঠিক বিশ্বাস করা যায় না। ফ্রিজ এখনও পরিষ্কার হয়নি। আবার ওতে মাখন রাখতে হলে নির্ঘাত গন্ধ হবে। জানলার নীচ দিয়ে এখন ভালোই ঠান্ডা আসে, আপাতত তাতেই কাজ চলুক। 

দুধ ও সসেজ প্যাকেটের সাথে একটা টুনা মাছের টিন নেওয়া হলো (যদিও শেষটায় খরচ হলো বেশি)। আরো কিছু জিনিস বলতে এক চতুর্থ পাউন্ড চিজ ও এক প্যাকেট ব্রাউন রাইস। প্রতিটাই ভিটামিনে ভরপুর। চেক হাতে এলে সে কিছু কমলালেবু কিনতে পারবে। এবার অন্য কাউন্টার হয়ে সে বেরিয়ে এলো যাতে আগের মত আর অসুবিধা না হয়। 

ভাবছিলাম, ওনার সঙ্গে সামনাসামনি কথা বলে লাভ নেই। খারাপ লাগতে পারে অথবা এমন ভাব দেখাবেন যে বুঝতেই পারছেন না কিছু বা বাথরুমে গিয়ে কি করেন বা করবেন তা নিয়ে বলার অধিকার কারো নেই। কিছু অপ্রীতিকর উত্তর দেবেন ও আবারও সেই একই কাজ করবেন প্রতিটা সকালে। সময় নিয়ে ভাবতে গিয়ে দেখলাম উনি ভীষণ রকম তা মেনে চলেন। এতেই যদি কিছু বিঘ্ন ঘটানো যায় তাহলে কেমন হয়? বাড়ির বাকিদের কাছেও সকাল ন’টা থেকে সাড়ে ন’টা এই আধঘন্টা সময় ওনার একার; আর ন’টার আগে কেউ বাথরুমে যেতেই চান না। তবে এই ব্যাপারটা যে আমি জানি সেটা ওনাকেও জানানো দরকার, তাহলে এখান থেকে আমাকে বার করাটা ওনার জন্য বেশ মুশকিলের হয়ে যাবে। 

সিঁড়ি দিয়ে ওপরে ওঠার সময় লক্ষ্য করলাম সামনের জানলা দিয়ে উনি বাইরেটা দেখছেন। তাহলে কি আমার চলাফেরা অনুসরণ করছেন? আজ বিকেলে দু রকম স্বরের মহিলার সম্বন্ধেও কিছু জানতে হবে। বিকেলের দিকে উনি বাথরুমে ঢুকলেন ও খুব জোরে জলের শব্দ আসতে থাকল ভেতর থেকে। আমি দুটো স্বর আলাদা করতে চাইলেও মিশে যাচ্ছিল। বাইরে অপেক্ষায় ছিলাম, ভাবটা এমন যেন যেই চাবি ঘোরানো হবে দরজা খুলে দিও। কথা মতই কাজ হলো। বেরোতেই আমরা মুখোমুখি হলাম। বুঝতে পারলাম, এই সময় ভেতরে দু জন মহিলা ছিলেন। ফিসফিস স্বরের মহিলা বেশ বয়স্ক আর ছিপছিপে যার ছোট চোখগুলো যেন মস্তিষ্কের অন্ধকার কোটরে ঢুকে আছে। আদ্যপ্রান্ত কম্বল জড়িয়ে তিনি যখন বেরোলেন তখন অন্যজন তাকে ধরে নিয়ে এলেন; ওনার পা ও ফাটা গোড়ালিটা বারবার কম্বলে আটকে যাচ্ছিল। আমাকে দেখে একটু বিরক্তি প্রকাশ করলেন। গোল ও বোকা বোকা মুখের অন্যজন শারীরিক ভাবে ভারী আর বেশ জোর আছে মনে হলো। উনি চৌকাঠে দাঁড়িয়ে থাকলেন ততক্ষণ, যতক্ষণ না বয়স্ক মহিলাটি তাকে হাত নাড়িয়ে কিছু ইশারা করছেন। তারপর ওনাকে নিয়ে আস্তে আস্তে হলঘরের দিকে এগোলেন। বয়স্ক মহিলার মাথা ওনার কাঁধের ওপর শোয়ানো ছিল, এক অদ্ভুত গোঙানির শব্দে দু জন হলঘরে অদৃশ্য হলেন। 

দরজা বন্ধ করতেই মনে হলো সে একটু অস্বস্তিতে যেন, আরাম করতে বললাম। ওকে এভাবে দেখতে আমারও ভালোলাগে না। 

রাতে খাওয়ার পর আবারও বয়স্ক লোকটার কথা মনে পড়ছিল। যদিও তাড়াতাড়ি উঠে গেলাম যাতে চার্চের ঘড়িতে ঘন্টার শব্দটা স্পষ্ট শুনতে পাই। এতে অ্যালার্ম সেট করলাম। 



রবিবার 

ন’টা বাজতে কুড়ি মিনিট আগেই আমার অ্যালার্ম বাজল। বিছানা থেকে নামার গড়িমড়সিতেই পাঁচ থেকে দশ মিনিট চলে যায়। সে গাউন গলিয়ে চটি পরে বেরিয়ে এলো যেটা গত রাতেই চেয়ারে গুছিয়ে রেখেছি। এরপর জানলা বন্ধ করে সাথে নিলো সব কিছু : সাবান, টুথব্রাশ, তোয়ালে, নেইল ব্রাশ, নোটবুক, এন্টিসেপ্টিকের শিশি, ঘরের চাবি ও ঘড়িটাও। ন’টার ঠিক দশ মিনিট বাকি থাকতেই ঘর থেকে বেরিয়ে তালা দিল সে আর বাথরুমে ঢুকে চাবিটাও ঝুলিয়ে রাখল তালার সাথে। প্রথমেই বাথটব পরিষ্কার আর জীবানুমুক্ত করে কল চালিয়ে দিল তা ভর্তি হতে। ভেবেই আনন্দ হচ্ছিল যে জলের একটানা শব্দ বাড়ির সমস্ত আওয়াজকে তখন ছাপিয়ে গেছিল। বাইরের লোকের এতে কিছুটি করার নেই। মনে হলো এ বাথরুম এখন আমার একার। এখানেই আমার রাজত্ব; যখন খুশি যেমন খুশি বেরোতে পারি, ঢুকতে পারি। এটাই একমাত্র জায়গা যেখানে আমি একেবারে নিরাপদ। 

ঘড়ি ও নোটবুকটা মেঝেতে রেখে ঈষদুষ্ণ জলে নিজেকে এলিয়ে দিল সে। এই সময় কারো বিরক্ত করা বারণ। 

ন’টায় হলঘর থেকে আসা অনবরত পায়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। আওয়াজটা দরজার বাইরে এসে শান্ত হচ্ছিল আবার পিছিয়ে যাচ্ছিল, ও আবার আসছিল। ঘড়িও ক্রমশ ঘুরে চলেছে। আমিও ভেতর থেকে জল ছপাছপ শব্দ করতে থাকলাম। আবারও ন’টা কুড়িতে সেই পদক্ষেপ এদিক ওদিক হতেই থাকল। তারপর উনি দরজায় টোকা দিলেন। কিছু বলতে বারণ করেছিলাম; তাই মুখের ওপর হাতটা চেপে হাসি বন্ধ করার চেষ্টা করছিল সে। 

দরজার আওয়াজ এবার খুব জোরে হলো। হাতুরী পেটানো শব্দ যেন, উনি বেশ চিত্‌কার করে বললেন, “আমায় ভেতরে যেতে হবে।” পাগলের মত হাবভাব করছিলেন উনি। দেখতে পেলাম ডোরাকাটা পায়জামাতে তোয়ালে জড়ানো দুটো সরু পা আর সেই মেরুন চটিটা। 

সাড়ে ন’টা নাগাদ এসব বন্ধ হলো। অদ্ভুত ভারী গলায় উনি নীচে নেমে গেলেন। যেন রীতিমত দৌঁড়চ্ছেন। সে ভেতর থেকে হাসছিল আর সারা গায়ে জল ছিটিয়ে নিল আরো। শরীরের ওপর যেন যথেষ্ট সচেতনতা। 

দু তিনটে সিঁড়ি ভেঙে নীচে যেতেই সেই বিকট শব্দটা এক আশ্চর্য নীরবতায় পরিনত হলো। শুনতে পেলাম অন্য দরজাগুলো এক এক করে খুলে যাচ্ছে। 

সেই মুহুর্তে বাথটব থেকে বেরিয়ে আসার জন্য তৈরী ছিল সে, আমি আরেকটু থাকতে বললাম। এরপর জলে ভাসতে ভাসতে একটানা চোখ পড়ে গেল পায়ের গোলাপী পাতা দুটো। জানতাম, বাথরুমের দরজাটা এখন বন্ধ করা আছে। 

এই সময় আমার জয় হলো। 





একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ

  1. অপূর্ব। লেখার গতি এবং ভাব বিন্যাস এতই সুন্দর সাবলীল যে মনেই হচ্ছিল না কোন অনুবাদ পড়ছি। ঝরঝরে স্বচ্ছ আবেশের অনুভব পেলাম। খুব সুন্দর অনুবাদ। শুভেচ্ছা এবং শুভকামনা রইলো অনুবাদক/লেখক 'ঝর্না বিশ্বাস' এর প্রতি।

    উত্তরমুছুন