মাহমুদ রহমান এর গল্প- সুপ্রিয় সম্মানিত কমিশনার মহোদয়



অনুবাদ: শবনম নাদিয়া

লেখক পরিচিতি :
ক্যালিফোর্নিয়া নিবাসী লেখক ও অনুবাদক মাহমুদ রহমানের জন্ম বাংলাদেশে।তার গল্প সংকলন 'কিলিং দ্য ওয়াটার' প্রকাশিত হয় ২০১০ সালে, পেঙ্গুইন বুকস, ইন্ডিয়া থেকে। ২০১২ সালে, তার অনুবাদে মাহমুদুল হকের 'কালো বরফ' উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় 'ব্ল্যাক আইস' নামে, হার্পার কলিন্স, ইন্ডিয়া থেকে। মাহমুদুল হকের ছোট গল্পসহ তার অনূদিত অন্য লেখকদের মধ্যে রয়েছেন শাহীন আখতার, আহমদ মোস্তফা কামাল, ও আফসান চৌধুরী। মাহমুদ রহমানের গল্প, প্রবন্ধ ও অনুবাদ ছাপা হয়েছে দেশে বিদেশে নানা পত্রিকা ও সংকলনে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো পেপারকাটস, ব্রুকলিন ম্যাগাজিন, স্ক্রোল ইন্ডিয়া, ঢাকা ট্রিবিউন, ওয়ার্ডস উইথআউট বর্ডার্স, ওয়ার্ল্ড লিটারেচার টুডে, এবং ওয়াসাফিরী।)

এই অংশটি তথ্য ভিত্তিক :

এপ্রিল ৩, ২০১৫ তারিখে ঢাকা ট্রিবিউনের খবর: 

গতকাল পুলিশ কর্তৃপক্ষ এই মর্মে ঘোষণা দেন যে সিনেমা, টিভি বা অন্যান্য ভিস্যুয়াল মিডিয়ায় কোন পুলিশ চরিত্র চিত্রায়ণ করতে চাইলে আগে থেকে অনুমতি নেয়া বাধ্যতামূলক। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত সহকারী কমিশনার (মিডিয়া ও জনসংযোগ) জাহাঙ্গীর আলম সরকার ঢাকা ট্রিবিউনকে বলেন যে পুলিশের নেতিবাচক বা কৌতুকপ্রদ উপস্থাপন দর্শকদের বিভ্রান্ত করে এবং ভুল বার্তা প্রদান করে। 

এর পরের অংশটি বানোয়াট গল্প। 


সুপ্রিয় সম্মানিত কমিশনার মহোদয়, 

কোন কোন মানুষের হাতের নাগালেই নানারকম লাইনঘাট ঠিক করা থাকে। আঙুল দিয়ে টুকটুক করে কয়েকটি নম্বর ঠোকা মাত্রই তারা কর্তৃপক্ষের কান বরাবর পৌঁছে যায়। বা প্রভাবশালী মানুষের সাথে সরাসরি সম্পর্ক না থাকার বোঝা যদি তাদের বহন করতে হয়, তাহলেও, প্রভাবশালীদের কাছে পৌঁছাতে পারেন, এমন লোকজন তাদের নাগালের মধ্যে আছেন।

অন্যদের, যেমন এই বিনীত বান্দার, এই সুবিধা তেমন নাই। খান্দানের এই বিষয়টি আমি ভালোই বুঝি; সাধারণ অর্থে আমি আসলে কেউ না। কিন্তু আমার একটি পরিকল্পনা আছে। এবং সেই পরিকল্পনা যদি বাস্তবায়ন করতে পারি, তাহলে একদিন আমি একজন কেউকেটা হয়ে উঠবো। এবং এমন একদিন আসবে, যখন আর আমার আপনার মতো পদস্থ কারো প্রতি এরকম আকুল আবেদন করে দরখাস্ত রচনা করতে হবে না। 

আমার আজ আপনার সহায়তা প্রয়োজন। এই চিঠি লেখার ধৃষ্টতা ক্ষমা করবেন। 

কয়েক সপ্তাহ আগে দৈনিক পত্রিকায় পড়লাম যে এখন থেকে সিনেমা, টিভি বা অন্যান্য ভিস্যুয়াল মিডিয়ায় পুলিশ চরিত্র চিত্রায়ন করতে চাইলে তা অনুমতি সাপেক্ষে করতে হবে। দুয়েক মিনিট আমি ঠিক নিশ্চিত ছিলাম না ছাপার অক্ষরে লেখা কি ভিস্যুয়াল মিডিয়ার কাতারে পড়ে কিনা। ভাবলাম, পড়ে না। নিশ্চয় আপনারা ইউটুব-এর কথা বলছেন। 

খবরটি আমাকে একটু সংকটে ফেলে দিলো। আমি মাত্রই একটি ছোট গল্প লিখে শেষ করেছি যেখানে একটি পুলিশ চরিত্র আছে--আসলে দুটি পুলিশ চরিত্র আছে। নিশ্চয় ভাবছেন, তো তাতে হলোটা কি! গল্প তো আর সিনেমা নয়, টিভি নয়, এমনকি ইউটুব-ও নয়। কিন্তু, জনাব, আমি কঠিন উচ্চাকাঙ্খা নিয়ে এই গল্পটি লিখেছি। আমি একেবারে স্থিরলক্ষ্য যে এরপর এটিকে স্ক্রিপ্ট হিসেবে পুনর্লিখন করবো। সবাই জানে যে ছোট গল্পে কোন টাকাপয়সার সম্ভাবনা নেই। ধরেন, আপনি যদি প্রথম সারির সাহিত্যিক হন, তাহলে হয়তো পত্রিকাগুলো তাদের ঈদ সংখ্যায় লেখার আমন্ত্রণ জানাবে এবং আপনার গুরুত্ব অনুযায়ী আপনি কিছু পয়সা পাবেন। আপনি অজ্ঞাতকূলশীল কেউ হলে তা আপনার দুর্ভাগ্য। কিন্তু সবাই জানে যে যারা টিভি নাটক ও সিরিয়ালের স্ক্রিপ্ট লেখে, তারা প্রচুর পয়সা বানাতে পারে। 

কিছু প্রাথমিক তথ্য দিয়ে শুরু করি। আমি জানি যে য্থায্থ তথ্যাবলী ছাড়া পুলিশের দ্বারস্থ হওয়া যায় না। আমার নাম মোহাম্মদ আমিনুর রহমান, জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর XXXXXXXXX৬৭৫৩, পিতার নাম (মৃত) লতিফুর রহমান, মাতার নাম আনোয়ারা বেগম। আমার বাড়ি উয়ারুক বাজার, উপজিলা শাহরাস্তি, জেলা চাঁদপুর। আমি ভিক্টরিয়া কলেজ, কুমিল্লা, হতে এইচ.এস.সি পাশ করার পর সেখান থেকেই বি. কম পাশ করি। এরপর আমি কুমিল্লায় টেলিটক কোম্পানিতে চাকরিজীবন শুরু করি এবং পঁচিশ বছর বয়সে বদলি হয়ে ঢাকায় আসি। ঢাকায় আসার আগে আমি সালেহা বিবিকে বিবাহ করি এবং আমরা একসাথেই এই শহরে চলে আসি। আরজতপাড়ায় আমরা একটি ফ্ল্যাটবাড়ি ভাড়া করি। আমি কাজ করি বাড্ডাতে, এবং সালেহা বিবি লালমাটিয়ার আড়ং-য়ে চাকরি করে। বর্তমানে আমাদের কোন সন্তানাদি নাই, যদিও এক্ষেত্রে অবস্থার শীঘ্রই পরিবর্তন ঘটতে চলেছে। 

যদিও আমি একজন সার্ভিস হোল্ডার, আমার প্রকৃত নেশা হলো গল্প লেখা। আগেই বলেছি, আমি টিভি এবং সিনেমার স্ক্রিপ্ট লেখক হওয়ার উচ্চাভিলাষ রাখি। এখন ছোট গল্প লিখছি। এগুলো ছাপা হওয়ার পর, আমি এই গল্পগুলোকে স্ক্রিপ্ট হিসেবে পুনর্লিখন করে টিভি চ্যানেলগুলোর কাছে ধর্ণা দেব। ততদিনে আমার ছোটখাটো ভক্তকূল তৈরী হয়ে যাবে, কারণ আমি একুশের বইমেলা হিসেব করে সামনে রেখেই আমার বইগুলো প্রকাশ করবো। আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন, সম্মানিত কমিশনার সাহেব, বর্তমান ট্রেন্ড সম্পর্কে আমি পুরোপুরি ওয়াকিফহাল এবং আমার বইয়ের প্রচারে ফেসবুক এবং টুইটারকে সর্বোচ্চ ব্যবহার করার সঙ্কল্প আমার আছে। 

তবে একমাত্র আপনার সাহায্য পেলেই এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করা সম্ভব। 

***

আপনি হয়তো আন্দাজ করতে পারছেন, অনুমোদন গ্রহণের খবরটি পড়ার পর আমার ভেতরে আবেগ-অনুভূতির কী তোলপাড় শুরু হয়ে গেল। যে গল্পটি লিখছিলাম, সেটাকে বাতিল করে নতুন আরেকটা শুরু করতে পারতাম, কিন্তু আমিতো ততক্ষনে মোটামুটি একটা খসড়া দাঁড় করিয়ে ফেলেছি। আমার প্রথম পাঠক, আমার সুপ্রিয় স্ত্রী সালেহা, গল্পটিকে উৎকৃষ্ট লেখা বলে মতামত দিয়ে দিলো। এক ছুটির দিন, টিভিতে তিন-চারটা সিরিয়াল দেখে, চেহারায় নিদারুন বিতৃষ্ণা নিয়ে সে আমার কাছে এসে বললো, "তুমি এর চেয়ে ভাল লিখতে পারবে। তুমি যে গল্পটা লিখেছো, তা টিভির এই বস্তাপচা কাহিনীর চেয়ে হাজার গুণ ভালো। " ওর প্রশংসা গুরুত্বের সাথে নেয়া উচিত। ওর হলো গিয়ে সাহিত্যের ডিগ্রি, আমারটা তো কমার্সে। এমন একটা গল্প বাতিল করে দেয়ার কোন মানে হয় না। 

তো আমি দৈনিক পত্রিকা ডিএমপি-র বরাতে সরকারি নোটিসটা কবে ছাপবে, তার অপেক্ষা করতে লাগলাম। 

অপেক্ষা করতেই থাকলাম ।
অপেক্ষা করতেই থাকলাম । 

গত কয়েক সপ্তাহে, প্রতি দুতিনদিন অন্তর, ফার্মগেট থেকে আমাদের আরজতপাড়ার বাসায় ফেরার পথে আমি পত্রিকার স্টল পর্যন্ত ঠেঙিয়ে গিয়ে, বিক্রেতা এবং তার সাঙ্গোপাঙ্গদের বিরক্তি হজম করে, প্রতিটি প্রধান বাংলা ও ইংরেজি খবরের কাগজে চোখ বোলাতাম। কোনভাবেই সরকারী নোটিশটা খুঁজে পেলাম না। টেন্ডার চেয়ে অনেক বিজ্ঞাপন দেখলাম (পুলিশ ফাঁড়ি, অফিসারদের মেস, মহিলা পুলিশদের ব্যারাক নির্মাণের দরপত্র আহবান করে), চাকরির বিজ্ঞাপন (কম্পিউটার অপারেটর, রাঁধুনি, এমনকি ভারোত্তোলক এবং গ্রিজার চেয়ে), আরো অনেক সরকারী দপ্তরের নানা ধরণের ঘোষণা দেখলাম, কিন্তু ডিএমপির কাছ থেকে যে নোটিশের আশায় ছিলাম, সেটি দেখলাম না। আরো কিছু সরকারি দপ্তর থেকে কিছু ঘোষণা ছিল --কোন কোনটির সাথে এমনকি দরখাস্তের ফরম আর নমুনা পর্যন্ত দেয়া ছিল। কিন্তু আমি যেটির অপেক্ষায় ছিলাম, সেটি বাদে।

সাত দিন ধরে দৈনিক পত্রিকা ঘাঁটাঘাঁটি করে আবার রেখে দেয়ার পর, ওই হকার তার স্টলে যাওয়ার ব্যাপারে আমার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে দিলো। তখন আমি মহাখালীতে অন্য্ এক হকারের স্টলে যাওয়া শুরু করলাম। এবারে আমাকে বহিস্কার করতে সে তিনদিন সময় নিলো। হকারদের নজরদারির প্রখরতায় আমি বেশ অবাক হয়েছি। আমি দেখতে আরো হাজারখানেক ক্রেতার মতোই; সে টের পেলো কেমন করে যে আমিই আবার তার পত্রিকা ঘাঁটতে ফেরত এসেছি? 

কিন্তু এই বেয়াদবির জন্য তাকে দোষ দেয়াটাও একটু কঠিন। আমি নিজেও তো কাস্টমার সার্ভিসে কাজ করি, মোবাইল ফোন কোম্পানিতে। আমিতো জানি কেউ দিনের পর দিন এসে আমাদের মাল হাতাতে থাকলে আমিও সহ্য করতাম না। 

কাকে দোষ দেব? মাফ করবেন, স্যার, কিন্তু হায়, আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি যে দোষ ডিএমপির ঘাড়েই পড়া উচিৎ। আমি, স্যার, যথোপযুক্ত সম্মান রেখেই বলছি। আমার ভয় হলো, আমি এটা বলাটাও পুলিশের নেতিবাচক চিত্রায়ণ হিসেবে গ্রাহ্য হতে পারে। কিন্ত, স্যার, আপনারাইতো পত্রপত্রিকায় এরকম দারুন গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশের প্রেস রিলিস দেয়ার পর, সরকারি নোটিশটির বিজ্ঞাপন দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। হ্যাঁ, আমি জানি যে মূল প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে টিভি, মিডিয়া এবং ফিল্ম কোম্পানিগুলো বরাবর চিঠি দেয়া হয়েছে। কিন্তু আমার তো এখন পর্যন্ত সেসব জায়গায় পরিচয়, সংযোগ তৈরী হয়নি, সুতরাং সেই চিঠিগুলোতে যে সব খুঁটিনাটি বিবৃত হয়েছে, তা হাতে পাওয়ার তো আমার কোন উপায় নেই। 

এই সম্পর্ক-সংযুক্তির অভাব একটা গুরুতর সমস্যা। আমার প্রিয়তমা স্ত্রী সালেহা সবসময়ই জোর দিয়ে বলেছে যে আমার লেখার পাশাপাশি আমার বিভিন্ন জায়গায় সম্পর্ক গড়ে তোলা উচিত। আজকে দুনিয়ায় যাকে বলে কিনা 'নেটওয়ার্কিং'। কিন্তু ওর আর আমার একটা মুশকিল আছে, হয়তো সেই মুশকিলের কোন আসানই নেই: আমরা মফস্বলের মানুষ। শহরে এখনো আমাদের তেমন পরিচিত লোকজন নেই। একদিন হবে, কিন্তু আমি সবসময়ই দৃঢ়তার সঙ্গে সালেহাকে বলেছি যে আগেতো কাজটা তৈরী করতে হবে। সুতরাং আমি আমার সকল উদ্যম, তেজ এবং কর্মশক্তি ঢেলে দিয়েছি গল্প লেখায়। একবার যখন উৎকৃষ্ট মাল তৈরী হয়ে যাবে, পাঠকের তারিফ পাবে, তখন নিশ্চয়ই পরিচিতি, সংযোগ আপনিই চলে আসবে। 

বারবার আমার প্রিয় স্ত্রী সালেহার কথা তোলায় আপনি বিরক্ত হওয়ার আগেই, আবারো এটা উল্লেখ করার দরকার আছে। তাৎক্ষণিক বিষয়টি হলো, একজন গল্পকার, যে গল্প লিখছে এখন, মূল উদ্দেশ্য সেটিকে টিভি সিরিয়াল বানানো, তার এখন করণীয় কী? একটা গল্প লেখার যে কঠিন পরিশ্রম, তা হাসিল করার পর, যখন তা টিভি সিরিয়াল হিসেবে পুনর্লিখন করবো, তখন যদি ডিএমপি তা বাতিল করে দেয়, তা হবে নিদারুন অপচয়। তার চেয়ে আমি গোড়াতেই আপনাদের অনুমতি নিয়ে রাখতে চাই। 

সুপ্রিয় সম্মানিত কমিশনার মহোদয়, আপনাদের ওই অফিশিয়াল চিঠি হাতে গোণা বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গকে পাঠিয়ে আপনারা আমার মতো মানুষজনের কথা বিস্মৃত হয়েছেন। আমি নিশ্চিত যে আমার মতো অবস্থায় পড়েছেন এরকম আরো লোকজন আছে। আমি বিশ্বাসই করতে পারছি না যে ডিএমপি আমাদের উপেক্ষা করবে। এ নিশ্চয় আপনাদের কার্যালয়ের কোন নিম্ন শ্রেণীর কর্মচারীর অনিচ্ছাকৃত ভ্রান্তি। নিশ্চয় তারা পত্রপত্রিকায় অফিশিয়াল নোটিশটি পাঠাতে ভুলে গেছে। হয়তো এটা কৃচ্ছতা সাধনের উদ্দেশ্যে করা হয়েছে। সেক্ষেত্রে নিশ্চয় আপনাদের প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়া ও প্রণালী মারফৎ অফিশিয়াল নোটিশটি বিতরণ করা হয়েছে। আমি ঠিক করলাম যে হকারদের আর হেনস্থা না করে একদম মূল উৎসেই চলে যাবো। আমি বরং কোন একটা থানায় গিয়ে হাজির হবো। 

***

এই বুদ্ধিটা মাথায় খেললো যখন, তখন আমি ৬ নং বাসের যাত্রী, নতুন বাজার থেকে ফার্মগেট যাচ্ছি। বাসটা গুলশান ২ দিয়ে ঘুরে যাচ্ছিল, ওই মুহূর্তে ঠিক গুলশান থানার পাশ দিয়েই। 

থানার বাইরে, রাস্তা আর ফুটপাত জুড়ে যে গাড়িগুলো দাঁড়ানো ছিল, কয়েক দশকের জমা ধুলায় ধূসরিত, সেখানে আমার চোখ আটকে গেলো। দশ বারো বছর আগে ঠিক ওইখানেই দাঁড় করানো একটা গাড়ি দেখেছিলাম, আমি হলফ করে বলতে পারি একটা গাড়ি ঠিক ওইটার মতো দেখতে। ভাবতে লাগলাম, থানার বাইরের এই গাড়িগুলোর ঘটনা কি? এটা বুঝি যে আপনাদের কাজের লাইনে কিছু গাড়ি-টাড়ি আপনাদের জব্দ করতেই হয়। কিন্তু এসব গাড়ি জনগনের চোখের আড়ালে পার্ক করে রাখা যায়, অন্য্ কোথাও এমন একটা পার্কিং লটের ব্যবস্থা কি করা যায় না? এগুলো বলতে গেলে চোখের ওপর অত্যাচার। কিন্তু এটাও বুঝি যে নগরের সৌন্দর্য বর্ধন তো আর পুলিশের দায়িত্ব নয়। স্যার, আমি নিশ্চিত যে আপনি তিরস্কার করবেন যে সত্যিই যদি এটা আমার কাছে জরুরী মনে হয়, আমার শোভনতাবোধ যদি এতটাই আক্রান্ত হয়ে থাকে, তো অন্য্ কোন দপ্তরে আমার অভিযোগ দায়ের করা উচিত। নিশ্চয় নগরীর সৌন্দর্য বর্ধনের দায়িত্বে নিয়োজিত কোন না কোন অধিদপ্তর আছে। কিন্তু স্পষ্টতই, আমাদের এই শহরে বসবাস করার পর, যে শহরে চরমভাবে না ঢুঁড়লে সৌন্দর্যের সন্ধান পাওয়া যায় না, আমার শোভনতাবোধ ততটা আক্রান্ত হয়নি। কত কিছুই তো আমরা গ্রহণ করে নেই। 

আগোরায় বাসটা থামতেই আমি লাফ দিয়ে নেমে পড়লাম। আমার হঠাৎই খেয়াল হয়েছিল যে আমরা তো থানার পাশ দিয়েই যাচ্ছি, এখানেইতো আমি এই নতুন নীতিমালার বিষয়ে খোজঁ নিতে পারি। 

গেট দিয়ে ঢুকতেই চোখে পড়লো, কি আবার, আরো কয়েক রাশি গাড়ি! গোটা কম্পাউন্ডই ধূলায় ঢাকা গাড়িতে ভর্তি। এমন কোন নিয়ম করা যায় না যে এক বা দুই বছরের মধ্যে কোন গাড়ির কেস ফয়সালা না হলে তা বিক্রি করে দেয়া হোক? 

আমি ভেতরে ঢুকে সামনের ডেস্কের দিকে এগিয়ে গেলাম। আমার সাথে উল্লিখিত সংবাদ কাটিং ছিল। (আসলে দুটি কাটিং --একটি বাংলা একটি ইংরেজি।) সে দুটি ডিউটি অফিসারকে দেখিয়ে আমি ফর্মটা চাইলাম। 

"কিসের ফর্ম?" তিনি জিজ্ঞেস করলেন। 

"এই নীতিমালা প্রণয়নের পর যে ফর্মটি প্রণয়ন করা হয়েছে, সেটি। "

তিনি সংবাদ কাটিং আবার পড়লেন এবং প্রাসঙ্গিক অংশটি আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে বললেন, "চিঠি পাঠানো হয়েছে। "

"সেটাতো বুঝলাম। কিন্তু সেতো হাতে গোণা কিছু কোম্পানি বরাবর। আর বাদবাকি আমাদের কী হবে? আমাদের বাকিদের জন্য ফর্ম কই?"

"ওরকম কোন ফর্ম তো নেই। "

"আপনি নিশ্চিত হচ্ছেন কিভাবে? প্রতিটা নীতিমালার সাথেই তো একটা না একটা ফর্ম থাকার কথা। শত শত বছরের প্রথা তো তাই বলে। জেনারেল ডাইরির তো একটা নির্দিষ্ট ফরম আছে, আছে না?" 

"হ্যাঁ। "

"দৈনিক পত্রিকা বা ম্যাগাজিন নিবন্ধনের ফর্ম আছে না?" 

"তা আছে, কিন্তু ওগুলো তো আমরা রাখি না। "

"ধরেন সেন্সর বোর্ড থেকে কোন ছবির অনুমোদন নিতে হলে তবে সেটার একটা ফর্ম আছে, আছে না?" 

"হ্যাঁ, কিন্তু সেটা তো সেন্সর বোর্ডের কাছে থাকবে। "

আমি অনড় থাকলাম যে যেহেতু এটা ডিএমপির নীতিমালা, তো পুলিশের কাছেই তো প্রাসঙ্গিক ফর্ম থাকার কথা। হয়তো এখনো তা বিতরণ করা হয়নি। উনি কি অন্য্ কাউকে জিজ্ঞেস করতে পারবেন? তিনি আমার এই প্রস্তাবে খুব একটা খুশি হলেন না এবং খানিক আদানপ্রদানের পর --মানে আমি তাকে তার কর্তব্যের কথা এবং নাগরিকদের সেবাদানে পুলিশ বাহিনীর ঘোষণার কথা মনে করিয়ে দেয়ার পর--তিনি একজনকে ভেতরে পাঠালেন খোঁজ নিতে । 

অপেক্ষা করতে করতে আমি চারদিকে চোখ বোলালাম এবং এই থানা সম্পর্কে কিছু মনে পড়ে কিনা ভাবতে লাগলাম । আমি নাছোড়বান্দার মতো দৈনিক পত্রিকা পড়ি, যদিও সালেহা জবরদস্তি করে আমাদের পত্রিকার সাবস্ক্রিপশন তিন থেকে দুইয়ে নামিয়েছে। কিন্তু কোন একদিন গল্প লেখার কাজে লাগবে এমনসব ঘটনা আমি মগজের ফাইলিং সিস্টেমে রেখে দেই । ২০০৬ সালের একটা ঘটনা আবছা মনে পড়লো, ফখরুদ্দিন-মঈনুদ্দিন তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলের কয়েক মাস আগে। 

নিকেতন আর গুলশান ১-এর কোনায় যে শুটিং ক্লাব আছে, সেখানে কিছু একটা ধ্বস্তাধ্বস্তি হয়েছিল, এবং তখন কয়েকজন পুলিশের সাথে কয়েকজন স্পোর্টসম্যান হাতাহাতি করেছিল। পত্রপত্রিকায় রিপোর্ট এসেছিল যে পুলিশ তাদেরকে বেধড়ক পিটিয়েছিলো । রিপোর্ট অনুযায়ী তাদেরকে গাছের ডাল, লাঠি, হকি স্টিক দিয়ে মারধোর করা হয়েছিল। তাদের পায়ের তালুতে, হাতে, পায়ে এবং পিঠে, এমনকি তাদের মাথাতেও আঘাত করা হয়েছিল। এ-ই ছিল পুলিশের গায়ে হাত তোলার প্রতিফল। এমনকি তাদেরকে ক্রসফায়ারে মেরে ফেলা হবে, এমন হুমকিও দেয়া হয়েছিল। সংবাদটি এমন কিছু অবাক করার মত নয়, কিন্তু একটা জিনিস আমার নজর কেড়েছিলো: হকি স্টিক। আমার কাছে এ এক বিস্ময়কর আবিষ্কার যে থানায় পুলিশবাহিনী হকি স্টিক রাখে? খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারলাম যে পুলিশবাহিনীর হকি লীগ আছে, কিন্তু থানায় হকি স্টিক রাখার কারণটা কী? কাছে ধারে এমন মাঠই বা কোথায় যেখানে তারা খেলতে পারে? তখন আমার মনে পড়লো, যে ১৯৮০র দশকে ছাত্র রাজনীতিতে গুন্ডাগিরির উত্থানের সাথে সাথে হকি স্টিক আমাদের নিত্যদিনের জবানে জায়গা করে নেয়। অদ্ভুত ব্যাপার, যে এরকম হীন ইতিহাস যে বস্তুর, তা পুলিশবাহিনীর রাজত্বে জায়গা করে নেবে। বা হয়তো এগুলো ছাত্র গুন্ডাদের কাছ থেকে বাজেয়াপ্ত করা হকি স্টিকের মজুদ মাত্র। 

তারপর আবার মনে করলাম এই থানাতেই সংঘটিত শুটারদের মারপিটের ঘটনা বিষয়ে পত্রিকার খবর। এরকম রিপোর্ট তো আসলে যে কোন চলচ্চিত্র বা টিভি নাটকের তুলনায় অনেক বেশীই 'নেতিবাচক চিত্রায়ন'। সুপ্রিয় সম্মানিত কমিশনার সাহেব, পত্রপত্রিকায় পুলিশ সম্পর্কিত খবরাখবর ছাপার পূর্বে অনুমোদন গ্রহণের একটি নীতিমালাও আপনি প্রনয়ন করতে পারেন। কিন্তু ফর্ম পূরণ, অনুমোদনের অপেক্ষা, এত কিছু প্রতিদিনের খবর প্রচারের ক্ষেত্রে অনেক বেশি সময়সাপেক্ষ হয়ে পড়তে পারে। সেক্ষেত্রে প্রতিটি পত্রিকা অফিসে একজন পুলিশ অফিসারকে অধিষ্ঠিত করে দেয়ার কথা ভাবতে পারেন। ইরাকে পেন্টাগন তাদের সেনা বাহিনীর সাথে সাংবাদিকদের embed বা সংস্থাপন করে দেয়ার নীতি গ্রহণ করে। আপনি তাদের পদ্ধতি অনুসরণ করে শুধু পরিস্থিতিটা উল্টে দিতে পারেন: মিডিয়া অফিসগুলোতে পুলিশ অফিসারদের সংস্থাপন করা। 


ডিউটি অফিসার আমাকে ইশারায় ডেকে জানালেন যে তাদের কাছে ওরকম কোন ফর্ম নেই। "আপনি পোস্ট অফিসে চেষ্টা করে দেখতে পারেন। ওরা অনেক ধরণের ফর্ম-টর্ম রাখে। "

আমি ঘড়ির দিকে তাকালাম। ওইদিন কোনভাবেই কোন পোস্ট অফিসে পৌঁছানোর মতো সময় ছিল না। 

***

অফিস টাইমে পোস্ট অফিস যাওয়ার সময় বের করতে আমার আরো হপ্তা দুয়েক লেগে গেলো। বাইরের রোদ থেকে যখন তেজগাঁ পোস্ট অফিসে ঢুকলাম, এই পুরোনো, গুহার মত ভবনটির ভেতর থাকতেই স্বস্তি বোধ হলো। কয়েক মিনিট তো ছায়া দেবে। প্রশস্ত কাউন্টারগুলোর দিকে মুখ করে দাঁড়ালাম, কিন্তু একটি জানালার পেছনেও কোন লোক দেখলাম না। ডেস্কগুলোতে বসে গোটা ছয় মানুষ কাজ করছিলো। আমি একটা জানালার সামনে দাঁড়িয়ে কারো চোখে পড়ার অপেক্ষা করতে লাগলাম। এবং অপেক্ষা করতে লাগলাম। এবং অপেক্ষা করতেই লাগলাম। ডেস্কে বসা কর্মচারীরা দুএকবার আমার দিকে চোখ তুলে তাকালেন, কিন্তু চেয়ার থেকে কেউ নড়লেন না। শেষে কয়েকবার হাত নাড়ার পর একজনের দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হলাম। বুড়ো আঙ্গুল উঁচিয়ে তিনি আমাকে একটা কোণার দিক দেখালেন। 

"ভেতরে যান।"

ভেতরে কোথায়? একমাত্র যে দরজাটা চোখে পড়লে তাতে সাইনবোর্ড লাগানো: প্রবেশ নিষেধ। আসলেই আমার ওখানে ঢোকার কথা? স্যার, আমি আইনকানুন নিয়মনীতি মেনে চলা একজন কর্তব্যপরায়ন, বাধ্যগত মানুষ। আমি কিভাবে ওই দরজা দিয়ে ভেতর ঢুকি? তখন খেয়াল করলাম কয়েকজন ওই দরজা দিয়ে ভেতর-বার করছে, যাদেরকে দেখে পোস্ট অফিসের কর্মচারী মনে হলো না। ভেতরে ঢুকতে যাচ্ছে, এমন একজনের পেছন পেছন আমিও ঢুকে পড়লাম। অন্যদের কাজ শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করার পর, একজন কর্মচারীর সাথে কথা বলার সুযোগ পেলাম। 

"ফর্ম?" তিনি জানতে চাইলেন। "কিসের ফর্ম?"

আমি তাকে পত্রিকার কাটিংগুলো দেখলাম। । 

না, তিনি এরকম কোন ফর্মের কথা শোনেননি। আর তারা কেন পুলিশের ফর্ম রাখবেন? উনি আমাকে থানায় যেতে বললেন। 

আমি বললাম থানায় গিয়েছিলাম এবং তারাই আমাকে পোস্ট অফিসে খোঁজ নিতে পাঠিয়েছেন। 

তিনি নীচু গলায় একটা গালি দিলেন। "তাহলে একমাত্র করণীয় এখন সরাসরি উচ্চ পর্যায়ের দ্বারস্থ হওয়া। আপনাকে ডিএমপি কেন্দ্রীয় দপ্তরে যেতে হবে। "

***

সম্মানিত কমিশনার মহোদয়, আমার দুর্দশা বাড়তেই লাগলো। আপনার নীতিমালা ঘোষণার প্রায় দু’মাস পার হতে চললো, কিন্তু অফিশিয়াল নোটিশ বা ফর্ম জোগাড়ের কোন উপায়ই খুঁজে পাচ্ছি না। আপনি স্পষ্টই আমার গরজটা বুঝবেন যখন জানবেন যে এর সাথে একটি সেনসিটিভ বিষয় জড়িত। মানে, ব্যাপারটা হলো যে আমার স্ত্রী সন্তানসম্ভবা এবং ঘটনার এই পর্যায়ে বাবুটির জন্মের আর মাত্র মাস চারেক বাকি। আমি জানতাম যে একবার বাবু চলে এলে, পুলিশের কাছ থেকে আমার গল্পের অনুমোদন জোগাড়ের এই প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া আমার জন্য যারপরনাই কঠিন হয়ে পড়বে। সুতরাং এই কাজটি জরুরী ভিত্তিতে আমার সারতেই হবে। 

বারবার হাতের সময় ফুরিয়ে যেতে থাকায় আমি স্থির করলাম যে একদিন ছুটি নিয়ে ডিএমপি অফিসে যাবো। হায়রে আমার কপাল। এমন দিনেই গেলাম যেদিন বিরোধী দল ডিএমপি কেন্দ্রীয় দপ্তর অভিমুখে মিছিল এবং ঘেরাওয়ের কর্মসূচি নেয়। আমি বিল্ডিংয়ের ধারেকাছেও ভিড়তে পারলাম না। ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করলাম ঘেরাও উঠিয়ে নেবে এই আশায়, কিন্তু পুলিশ আর বিরোধী দলের কর্মীরা পুরো সময় জুড়েই মুখোমুখি যুযুধান হয়ে রইলো। তারপর পুলিশ বাহিনী কাঁদুনে গ্যাস মারতেই সকলে ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলো। আমার মনে হয়েছিল যে এমনটি ঘটতে পারে সুতরাং আমি দ্রুত রমনা পার্কের দিয়ে পিছিয়ে গেছিলাম। তোপখানা রোডে একটি খাওয়ার দোকানে দুপুরের খাবার সেরে আবার ফিরলাম। তখনও বাতাসে টিয়ার গ্যাসের ঝাঁজালো গন্ধ; পকেট থেকে রুমাল বের করে নাকমুখ ঢাকতে বাধ্য হলাম। কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের মূল গেট পর্যন্ত পৌঁছাতে পারলাম কিন্তু সেখানে তখনও পুলিশ কনস্টেবলদের একটা ছোটখাটো বেষ্টনী ছিল আর তারা কিছুতেই আমাকে ভেতরে ঢুকতে দিলো না। সবাইকেই খুব সন্দিহান মনে হলো। তারা আমাকে বললো রমনা পোস্ট অফিসে যেতে। আমি বললাম যে একটি পোস্ট অফিসে গেছি এর মধ্যে, কিন্তু আমি যে ফর্মটি খুঁজছি তা শুধু ডিএমপি কার্যালয়েই থাকার কথা। কিন্তু তারা অনড়। 

এক পুলিশ অফিসার বললেন, "আমরা তো এখন ডিজিটাল। আপনি ওয়েবসাইটে চেষ্টা করে দেখেন। ওইখানে অনেক তথ্য দেয়া থাকে।"

কিন্তু, স্যার, সালেহা আর আমি আর্থিকভাবে একটু টানাটানির মধ্যে আছি এবং বাসায় ব্রডব্যান্ড সংযোগ নিতে পারিনি, যদিও আমার গল্প লেখার জন্য একটি কম্পিউটার আছে। বুঝলাম যে ইন্টারনেট ক্যাফেতে যাওয়া দরকার। ভাগ্য ভালো যে এই ক্যাফেগুলো সন্ধ্যায় এবং ছুটির দিনেও খোলা থাকে। 

সাধারণত আমি ফার্মগেটে একটা সাইবার ক্যাফেতে যাই। কিন্তু এবার গিয়ে দেখি, বিল্ডিংয়ে বিদ্যুৎ নেই। আরেকটা সাইবার ক্যাফে খুঁজলাম। শয়ে শয়ে সাইনবোর্ডের মধ্যে খুঁজে আমার উল্টা দিকে আরেকটি খুঁজে বের করলাম। সাইনবোর্ডে লেখা 'দ্বিতীয় তলা', সুতরাং সিঁড়ি খুঁজে বের করে দোতলায় উঠে গেলাম। বাঁ দিকে দেখলাম একটা দোকান, যাতে কাঁচের স্লাইডিং দরজা। ওই সাইবার ক্যাফেগুলোর একটি--যেগুলোতে উঁচু দেয়াল তুলে বুথ তৈরি করা হয়েছে। ওসব জায়গায় কী চলে, জানেনই তো। আমি নাম স্বাক্ষর করে একটা বুথে ঢুকে গেলাম।আমি যে ক্যাফেটিতে যাই, তার তুলনায় এখানকার কম্পিউটারগুলোর অবস্থা আরেকটু মাজুল। কিন্তু ইন্টারনেট সংযোগ যথেষ্ট ভালো মনে হলো। 

ব্রাউজার খুলে ডিএমপির ওয়েবসাইট খুঁজে বের করলাম। প্রতিটি মেনুতে দেয়া প্রতিটি লিংক আঁতিপাঁতি করে খুঁজলাম। কিন্তু লাভ হলো না। একমাত্র যে ফর্মটি খুঁজে পেলাম তা হলো পুলিশ ভেরিফিকেশনের জন্য। আমি এমনকি প্রেস রিলিজগুলো সব ঘেঁটে দেখলাম। কিন্তু নতুন নীতিমালা সম্পর্কিত কোন প্রেস রিলিজ দেখলাম না। তারপর বেওয়ারিশ লাশ সম্পর্কিত একটা ওয়েব পেইজে ঢুকে মন একেবারে বিক্ষিপ্ত হয়ে গেল। এ কোন জাহান্নামে পৌঁছে গেছি? এ অবিশ্বাস্যরকম করুণ এক জিনিস। পচন প্রক্রিয়ার বিভিন্ন পর্যায়ে পৌঁছে যাওয়া লাশের ছবি। কোন কোনটিতে নির্যাতনের চিহ্ন স্পষ্ট, নিশ্চিতভাবেই কোন অপরাধী দলের কাজ। জনগণের সেবক, আমাদের পুলিশ বাহিনী, এই নির্যাতন বরদাস্ত করবে না। যদ্দূর জানি নির্যাতনকে বেআইনি ঘোষণা করে এমনকি হাই কোর্টের আদেশ পর্যন্ত আছে। 

ওই ছবিগুলো আমার মন থেকে সরানো জরুরি । হয়তো অন্যমনস্কভাবে, কিংবা তা নয়, এমনিই, আমি ব্রাউজার হিস্টোরি ঘেঁটে দেখলাম। যা ধারণা করেছিলাম, আমার আগের ব্যবহারকারীরা বেশিরভাগই যৌন ব্যাপারস্যাপারের খোঁজে ছিল। দুএকটা চটি গল্প পড়লাম। আপনার বোঝা দরকার, স্যার, লাশের ওই ভয়ঙ্কর ছবিগুলো থেকে মন সরাতেই এ কাজটি করলাম। কিন্তু লেখক হিসেবে, আমাকে স্বীকার করতেই হবে, চটি লেখকদের দুয়েকজনের খুঁটিনাটি ব্যাপারে প্রখর দৃষ্টি দেখলাম। তবে সাধারণত কথোপকথনের অংশগুলো নিম্নমানের। 

***

আমার মনটা ভেঙে গেলো। অফিশিয়াল ডিএমপি নীতিমালা ও ফর্ম যে কিভাবে সংগ্রহ করবো, তা বুঝে উঠতে পারছিলাম না। শেষ পর্যন্ত আমি বুঝলাম যে আমার নিজেরই এ বাবদ দরখাস্ত করতে হবে। সে উদ্দেশ্যেই এই চিঠিখানি। নিচে আমি পুলিশ চরিত্র চিত্রায়ণে অনুমোদন দানের আবেদন করার দরখাস্তের একটি খসড়া দিচ্ছি। এটিকে ছক হিসেবে ধরে হয়তো আপনি একটি ফর্ম তৈরির ব্যবস্থা করতে পারেন (যদি এখনো ফর্মটি তৈরী না হয়ে থাকে।)


১. গল্পের নাম : ____________________________________________

২. গল্পের সারাংশ:

________________________________________________________

________________________________________________________

________________________________________________________

৩. পুলিশ চরিত্রের বিবরণ :

________________________________________________________

________________________________________________________

________________________________________________________

৪. ১ থেকে ৫-এর মধ্যে, যেখানে ১ অত্যন্ত নেতিবাচক ও ৫ অত্যন্ত ইতিবাচক, দয়া করে আপনার পুলিশ চরিত্রকে একটি মান সংখ্যা দিন : 

৫. আপনি যদি ১ থেকে ৩-এর মধ্যে নম্বর দিয়ে থাকেন, তবে ১০০ শব্দের মধ্যে আপনার উদ্দেশ্য বর্ণনা করুন। আপনার নম্বর যদি ৪ বা ৫ হয়ে থাকে, তবে ব্যাখ্যা দানের প্রয়োজন নেই। ৬ নং প্রশ্নে চলে যান। ____________________________________________________

__________________________________________________________

__________________________________________________________


৫. ১ থেকে ৫-এর মধ্যে, যেখানে ১ ‘অত্যন্ত হাস্যকর’ এবং ৫ ‘বিরক্তিকর রকমের গুরুগম্ভীর’, দয়া করে আপনার পুলিশ চরিত্রগুলোকে একটি ক্রম দিন। 

৭. আপনার নম্বর যদি ১ বা ২ হয়, অর্থাৎ হাস্যকর, তাহলে ১০০ শব্দে আপনার উদ্দেশ্য বর্ণনা করুন। দয়া করে কেতাবি ভাষা ব্যবহার করবেন না। আপনার নম্বর যদি ৪ বা ৫ হয়, অর্থাৎ মোটেই হাস্যকর নয়, তবে কেন আপনি আপনার চরিত্রগুলোকে বিরক্তিকর রকমের গুরুগম্ভীর ভাবে উপস্থাপনের প্রয়োজন বোধ করেছেন তা ব্যাখ্যা করুন। আপনার নম্বর যদি ৩ হয়ে থাকে, তাহলে আপনার দরখাস্ত সম্পূর্ণ। দয়া করে স্বাক্ষর করে আপনার নিকটস্থ থানায় জমা দিন। 

______________________________________________________________________

______________________________________________________________________

______________________________________________________________________


সম্মানিত কমিশনার মহোদয়,

আমি ধরে নিচ্ছি যে এই খসড়া ফর্মটিকে একটু ঘষামাজা করার প্রয়োজন হবে। আমি নিশ্চিত যে আপনার দপ্তরে এ কাজ করার মতো যথেষ্ট যোগ্য কর্মী আছেন। আমি এই খসড়াটি পেশ করছি স্বেচ্ছাসেবার ভাবোদ্দীপনার বশবর্তী হয়ে, আমাদের সম্মানিত পুলিশবাহিনীর প্রতি নাগরিক সমর্থনের উদাহরণ হিসেবে। আপনি একবার এই ফর্মটি অনুমোদন করে বিতরণের ব্যবস্থা করলে, আমিই পয়লা এটি পূরণ করে জমা দেবো। আমি এখনই পূরণ করে ফেলতাম, কিন্তু আপনার অনুমোদন পাবার আগে সেটা করাটা বোধহয় আমার খাটাখাটনির অপচয়ই হবে। 


বিনীত,
আপনার একান্ত বাধ্যগত, কিন্তু আপনার মতোই এ দেশের নাগরিক, 
মোঃ আ. রহমান 





শবনম নাদিয়া
অনুবাদক/ গল্পকার
আমেরিকাতে থাকেন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ