ফারজানা সিদ্দিকা রনি'র প্রবন্ধ : অনুবাদের অনুরণনে



অবিরাম বৃষ্টিতে ভিজে কানের লতিতে মৌহূর্তিক জমে থাকা বৃষ্টির ফোঁটাকে হীরের দুল কিংবা কচি সেগুন পাতায় হাতের তালু রঞ্জিত করার দিনগুলাে সবে শেষ হয়েছে। তখন কাল্পনিক বন্ধুদের সাথেই আমার সারাবেলা কাটে। এখন অবশ্য যত সহজে তাদের ‘কাল্পনিক বন্ধু’ বলছি তখন এটা ভাবাই আমার জন্য অসম্ভব ছিল যে তাদের কোন অস্তিত্ব নেই আমার চারপাশে। কখনাে টমসয়ারের দুষ্টুমিতে হাজিরা দিতে বাধ্য, কখনাে হাকলবারি ফিন-এর গাম্ভীর্যের কাছে চুপসে থাকা, কখনো ‘দ্য চিলড্রেন অফ দ্য নিউফরেস্ট’-এর শিশু কিশােরদের সঙ্গে সহযােদ্ধা হতে আমিও প্রণোদিত। আর জুলভের্ন, শার্লক হােমসের সবগুলো অভিযানেই তাে নির্ভিক আমি উপস্থিত থাকি। দ্য প্রিন্স এ্যান্ড দ্য পপার-এর হয়রানি কিংবা অলিভার টুইস্টের দুঃখে সর্বদা কাতর; সেই দুঃখে কখনাে মনে হয় এই নিষ্ঠুর সামাজিকতার বাইরে কোনাে ব্লুলেগুন কিংবা কোরাল আইল্যান্ডে থাকতে পারলে হতাে শুধু সেইসব জায়গায় আরব্য রানীর গল্পগুলাের ভূত-পেত্নি আর মায়াবিনীরা না থাকলেই বাঁচি! তখন কোনাে কারনে বাবা ধমকালেই বাবাকে মনে হতাে মিঃ হাইড আবার যখন আদর করে কাছে টেনে নিতেন তখন মনে হতাে এই তাে বাবা ডঃ জেকিল হয়ে উঠছেন। 

আরও কিছু পরে হাতে আসে আগাথা ক্রিস্টি। সে কি উত্তেজনায় কাটে আমার সারাদিন । প্রতি মুহূর্ত অনুসন্ধানী চোখে সবকিছু দেখতে দেখতে আমি কেমন সন্দেহপ্রবণ বাতিকগ্রস্ত হয়ে পড়ি। হয়তাে বাবা সিগারেটের শেষাংশ ছাইদানীতে ফেলে মাত্র অন্যঘরে গিয়েছেন, আমি তাকে যেতে দেখিনি, ঐ ছাইদানীর হালকা ধোঁয়া নিয়েই চলে আমার নিজস্ব অনুসন্ধান, ব্যাখ্যা দেবার হাস্যকর প্রবণতা। আর এই সব অনুসন্ধানের জন্যেই টারজানের কাছ থেকে ঘ্রাণ নিয়ে দিক নির্ণয়ের প্রক্রিয়া শেখার চেষ্টা চালাই কিছুদিন এবং যথারীতি ব্যর্থ হই।

এইরকম অদ্ভুদ সব বিস্ময়কর আলােড়নের মধ্য দিয়ে যেদিন সপ্তম শ্রেণির ক্লাসে একজন শিক্ষিকা বললেন, ‘ক্লাস সেভেনে উঠলেই মেয়েদের পাখা গজায় - !’ বুঝলাম কিংবা বুঝতে বাধ্য হলাম ‘বড় হচ্ছি’। ‘বড়ত্বের ভাবনাগুলাে’ সম্ভবত সেদিন থেকেই আকর্ষণ করতে শুরু করলাে। আর এই সব ভাবনার প্রমাণ স্বরূপ মুহূর্তেই প্রথম যে ব্যাপারটা মাথায় এলাে তা হলাে- পেপারব্যাকের ছবিওয়ালা বইগুলাে বাচ্চাদের। বড়রা অদ্ভুত ছবিওয়ালা (হয়তাে বিমূর্ত চিত্রকলা) বাের্ডবাঁধাই যে বই পড়ে- আমারও এখন থেকে তা-ই পড়া উচিত। সেই হাস্যকর ভাবনায় প্রণােদিত হয়ে বইয়ের দোকানে গিয়ে বাের্ডবাঁধাই বইয়ের মধ্য থেকে একটি বইয়ের প্রচ্ছদের রঙ এবং নাম আমাকে টানলাে। বইটির প্রচ্ছদের রঙ ছিল গাঢ় নীল, নাম- ‘বিচার’, লেখক- ফ্রানৎস কাফকা, অনুবাদক- নৃপেন্দ্র স্যানাল। আমার মনে হলাে নিশ্চয়ই কোন অপরাধীর বিচার করার লােমহর্ষক কাহিনী থাকবে এ বইটিতে। মহা আগ্রহে পড়তে শুরু করি এবং দুই-তিন পৃষ্ঠা পড়ার পর মহা বিরক্তিতে রেখে দেই। কারণ ঘটনার শুরু কিংবা শেষ কিছুতাে বুঝতে পারছিলামই না, আর লোমহর্ষক কোন কাহিনী যে পরে থাকবে তারও কোন আভাস খুঁজে পাইনি। কঠিন, জটিল এক বই। মনে আছে, বইটা কিনে ছিলাম ক্লাস সেভেনে পড়ার সময় আর দীর্ঘদিন পড়ে থাকবার পর বইটা একটানে অনেকটা জেদ করে পড়ে শেষ করেছিলাম এস.এস.সি. পরীক্ষার পরের অবসরে। মাঝখানের তিন বছরের বেশিরভাগ সময়ই আমার মনে হয়েছে বইটা বিজ্ঞান বইয়ে ‘এসাে নিজে করি’র চেয়েও বেশী জটিল। আর ‘কাফকা’কে উচ্চারণ করতাম কাকফা। জটিলতার কারণে বইটাকে ভালবাসতে পারিনি সেইসঙ্গে লেখকের নামকেও। আরও পরে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্মান ১ ম বর্ষে পড়ি , হাতে এলে কাফকার ‘লেটারস টু ফেলিস’, প্রেমিকাকে লেখা চিঠির গুচ্ছ। ভয়ে ভয়ে এই সব চিঠি পড়তে শুরু করলাম, তীব্র আশঙ্কা ছিল আবার জটিলতায় পা দিচ্ছি কিন্তু পড়ে মনে হলাে, লােকটা চিঠি তো ভালােই লােখে; বই এতাে জটিল কঠিন করে লেখে কেন? ‘বিচার’ পড়বার অভিজ্ঞতা কাছের বন্ধুরা অনেকেই জানতাে, কাফকার প্রতি বিরক্তির ভাবটাও। সেই আমিই যখন তাঁর চিঠি পড়ে মুগ্ধ তখন বন্ধুরা ক্ষেপাতে শুরু করলাে ওটা আসলে ‘লেটারস টু ফারজানা’ হবে, ‘ফেলিস’ নয়! তবে কাফকার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ, তিনি আমার বড় হবার আগ্রহকে বাড়িয়ে দিয়েছেন বহুগুনে। কাফকার কাছ থেকেই প্রথম শিখেছি বড় হওয়া মানেই জীবনের জটিল মাত্রা, জটিল ভাবনা, জটিল অন্বেষণ। 

এর পরে শুরু হলাে সেই জটিল অন্বেষণের যাত্রা। এক বিকেল থেকে রাত পেরিয়ে ভাের হবার মুখে এক নিঃশ্বাসে শেষ হলাে মাক্সিম গোর্কির ‘মা’। মানে হলাে ঠিক ভাের হবার মুখে বইটা পড়া শেষ করার মধ্যেও একটা প্রতিকী ব্যাপার আছে। আমার নব্য চেতনায় সেদিনের ভাের, সেদিনের সূর্য উঠা সব কিছু ছিল জাগরণের ডাক হয়ে আসার মতাে, মনে হয়েছিলাে হাজারবার ‘কোরানশরীফ’ ‘বাইবেল’ ‘গীতা’ ‘ত্রিপিঠক’-এর পবিত্রতা নিয়ে যত উপদেশ শুনেছি জীবনে, সেদিন সেই ভােরে সূর্য ওঠার মুহূর্তে সবকিছু, অন্যসব কিছুর পবিত্রতা আমার কাছে মিথ্যে। ‘মা’-এর সংগ্রাম আর জীবনাদর্শই তখন আমার কাছে সবচেয়ে পবিত্র, সবচেয়ে সত্য। মনে আছে, সেই সত্যের দায়ভাগ থেকেই সােভিয়েত ইউনিয়নে যখন সমাজতন্ত্রের পতন হয়- বিস্ময়ে বিমূঢ়তায় কেঁদেছিলাম আমি। আরও পরে হাতে এলাে চেঙ্গিস আইত মাতভ-এর ‘পাহাড় ও স্তেপের আখ্যান’, পড়লাম- ‘জামিলা’, ‘প্রথম শিক্ষক’ আর ‘বিদায় গুলসারি’; এই প্রথম জানলাম সরব সংগ্রাম সফল হবার পরের নীরব সংগ্রামের আখ্যান। ‘প্রথম শিক্ষক’-এ দিউইশেন আর ‘বিদায় গুলসারি’র তানাবাই-এর অবিরত সংগ্রাম থেকে জন্ম নেয়া হতাশা আমাকেও গ্রাস করলাে, অনুভব করলাম জামিলার দুঃসহ যন্ত্রণা- সেই প্রথম বুঝলাম ‘গোষ্ঠী’ আমি’র চেতনায় ভাঙন ধরায় আরেক ‘আদিম নিভৃত আমি’। বুঝলাম এই আমিত্বকে বিসর্জন দেয়া কত বেশি কষ্টকর মানুষের জন্যে। হাজার বছরের আদিম আমিত্ববােধ মানুষকে ছাড়ে না কিংবা মানুষই এই বােধের নির্ভরযােগ্য বাহক হয়ে থাকতে চায় অনাদিকাল পর্যন্ত। দীর্ঘ কঠিন সংগ্রামের পরও এই বােধ ফিরে ফিরে উঁকি দেয়। যেমন ফিরে ফিরে আসে মানুষের ভালবাসার কষ্ট। শত বছর আগের বেদনা আজও বিজড়িত করে মানুষকে। নয়তাে পুরানো সেকেলে বই হিসেবে ছুঁড়ে ফেলে দেবার কথা ইভান তুর্গেনেভ-এর ‘বাবুদের বাসা’কে। কেন তা পারলাম না? কেন লাভরেৎস্কি আর লিজার অসম বয়সের প্রেমের বেদনা এতদিন পরেও আমাকে আলােড়িত করে, কেন বারবার চোখ ভিজে যায় যখন লিজা লাভরেৎস্কিকে ছেড়ে দূরের মঠে চলে যায়! আর যখন সারিবদ্ধভাবে যাবার সময়- সেবিকাদের সারিতে থাকা লিজার সাথে অপেক্ষমান লাভরেৎস্কির চোখাচোখি হয় সেই সময়কার দুঃসহ কষ্ট আজকের এই ডিশ এ্যান্টেনা, মাল্টিমিডিয়ার যান্ত্রিক সময়ের এক পাঠকের হৃদয়ে কী করে পাথর হয়ে চেপে বসে! 

ভালােবাসার জন্যে তুর্গেনেভ যেমন আমাকে বারবার কাঁদিয়েছেন তেমনি ভালােবাসার মধ্যে থেকেও প্রবল নিস্পৃহ থাকতে শিখিয়েছেন দস্তয়েফস্কি। পৃথিবীখ্যাত মহান এই দুজন লেখককে বিশ্লেষণ করতে দারুণভাবে অক্ষম বা সেই স্পর্ধাই আমার নেই কিন্তু আমার অনুভবে, ক্ষুদ্র বােধে এই মহান দুই লেখক এই ভাবেই প্রকাশিত। দস্তয়েফস্কির লেখা খুব বেশি পড়িনি তবে যে ক'খানা পড়েছি তার মধ্যে দিয়ে আবিষ্কার করেছি অসাধারণ এক নৈর্ব্যক্তিক জীবনবােধ। দস্তয়েফস্কি জীবনের তুচ্ছ ক্ষুদ্রকে জড়িয়ে রাখেন কিন্তু নিজে যেন সবসময়ই সচেতন থাকেন যে কোন বন্ধন থেকে দুরে থাকবার জন্যে। মানুষের জীবনের অদ্ভুত সব আকাঙ্ক্ষার, জটিলতার, স্বপ্নের আবর্তন ঘটে দন্তয়েফস্কির লেখায়। জীবনের প্রবহমানতার প্রশান্ত প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে। বিস্ময়কর নির্লিপ্ততার মধ্য দিয়ে লেখক এগিয়ে যান ধীর পদক্ষেপে। তার ‘বঞ্চিত লাঞ্ছিত’, ‘শাদা রাত’ ‘অভাজন’, ‘জুয়াড়ী’, এবং ‘অপরাধ এবং শাস্তি’ পড়ে এই নির্লিপ্ততা কিন্তু অসাধারণ জীবনবােধের চর্চা মনে মনে আমিও শুরু করেছিলাম। বিশেষ করে ‘বঞ্চিত লাঞ্ছিত’-এর ইভান পেত্রোভিচের জীবনাচরণ আমাকে টেনেছিলাে দারুণ ভাবে। মানুষের আচরণ কিংবা মুখ দেখে ফেরা অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল একসময়। এমনিভাবে অনুসন্ধানী চোখে একদিন আবিষ্কার করলাম ঈশ্বর আসলে নির্দিষ্ট কিছু মডেলে মানুষের মুখ বানিয়েছেন। হয়তাে তাঁর মডেল সংখ্যা একশত। এই একশত মডেলের এক একটি মডেল হয়তাে এক হাজার করে মানুষ সৃষ্টি করে পৃথিবীর এক হাজার স্থানে বসিয়ে দিয়েছেন, এই সব মডেলরা বিভিন্ন যুগে ঘুরে ফিরে পৃথিবীতে আসে। শুধু মুখেরই মিল নয়, স্বভাবেও মিল রয়েছে মডেলদের মধ্যে। আমার এ থিওরি আমি যুক্তি দিয়েও কাউকেই বিশ্বাস করাতে পারি না কিন্তু নিজে প্রবলভাবে বিশ্বাস করি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে পড়তে এসে এই বিশ্বাস আমার আরও দৃঢ় হলাে আমার শিক্ষক জনাব মুহম্মদ দানীউল হককে দেখে। ‘খােলশের লোক’ নামে চেখভের একটা ছােট উপন্যাস পড়েছিলাম- এ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসার পূর্বে। এই উপন্যাসের নায়ক ছিলেন বেলিকভ নামে এক গ্রিক ভাষার শিক্ষক। শহরে এই শিক্ষককে সবাই খুব ভয় পেত তাঁর কঠোর নিয়ম নীতিতে চলা জীবনাচরণের জন্যে। বেশ দূরত্ব রেখে তিনি মানুষের সঙ্গে মিশতেন। মনে হতাে যেন সর্বদা একটা খোলশ দিয়ে নিজেকে তিনি মানুষের কাছ থেকে আড়াল করবার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। ছাত্ররা এবং অভিভাবকরা তাকে যমের মত ভয় পেত কারণ তিনি তাদের ব্যাপারে মারাতিরিক্ত নিয়মনীতি আরােপ করতেন। চেখভ মহাশয় এই ক্ষুদ্র উপন্যাসটি লেখেন ১৮৯৮ সালে। ১৯৯৭-এর সেপ্টেম্বর থেকে আমার ৩য় বর্ষের ক্লাস শুরু এবং ভাষাবিজ্ঞানের শিক্ষক হিসেবে দানীউল স্যারের সঙ্গে ধীরে ধীরে পরিচয় হবার মধ্য দিয়ে আমি ক্রমশ বিস্মিত হতে থাকি। ১৮৯৮ এর বেলিকভ যেন ১৯৯৭ এ দানীউল স্যারের মধ্য দিয়েই ফিরে এসেছেন। আবার আশ্চর্যের বিষয় দুজনই ভাষা বিষয়ক শিক্ষক। অবশ্য ঐ উপন্যাসে বেলিকভের পতন হয়েছিল নির্মম ভাবে। আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস এবং আশা করি দানীউল সারের ওরকম কিছুই ঘটবে না কারণ তিনি বিবাহিত। বেলিকভ ছিলেন অবিবাহিত। 

যাইহােক, চেখভের কাছে শিখেছি জীবনের অমূল্য এক বিশ্বাস যে-বিশ্বাস আজীবনের বিশ্বাসের ধারাকে চ্যালেঞ্জ করে। ‘গুজবেরি’ উপন্যাস পড়তে গিয়েই জেনেছি (আমি মুখস্ত করে রেখেছি লাইন দুটো) লােকে বলে মানুষের প্রয়োজন মােটে চার হাত ভূমি। কিন্তু এই চার হাত জমির প্রয়োজন হয় শবের, মানুষের নয়। শব আর মানুষের পার্থক্য আর একবার শিখেছিলাম রবীন্দ্রনাথের কাছে ‘জীবিত ও মৃত’ গল্পে। চেখভ আর গল্পগুচ্ছ আমার এ ক্ষুদ্র জীবনে বহুবার হাসিয়েছে, কাঁদিয়েছে, ভাবিয়েছে আর খুলে দিয়েছে দেখার আর উপলব্দি করার চোখকে- এমনি ভাবে আরেকবার জীবনকে উপলব্দি করতে বাধ্য করেছিলেন তলস্তোয় ‘আন্না কারেনিনা’ এবং ‘কসাক’ পড়বার পর। তলস্তোয় দস্তয়েফস্কির মতাে করে নয়, জীবনকে আমার সামনে মেলে ধরেছিলেন সম্পূর্ণ ভিন্ন ভাবে। ‘আন্না কারেনিনা’ আমার চেতনাকে আচ্ছন্ন করেছিল দীর্ঘদিন। তবে তলস্তোয়কে জানবার অভিজ্ঞতা আমার খুবই সীমাবদ্ধ। 

ভারতের মালয়লাম ভাষার লেখক ভৈকম মুহম্মদ বশীরকে চিনেছি ‘পাতুম্মার ছাগল’ ‘নানার হাতি’ আর ‘গল্প সমগ্র’র মধ্য দিয়ে। সাধারণের মধ্য দিয়ে সূক্ষ্ম অসাধারণ কৌতুক প্রবণতায় অন্ধ কুসংস্কার, অনৈতিক সামাজিকতার, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে জীবনের গভীর অনুভূতিকে নাড়া দেয়ার অদ্ভুত এক মােলায়েম প্রক্রিয়ার চর্চায় বশীর আমাকে মুগ্ধ করেছেন। মনে হয়েছে, এমন করে জীবনকে দেখার সুযােগ আগে আর কখনাে হয়নি। আর কােন ধরনের শিথিলতা ছাড়াই এই একই জীবনবােধ তৈরি হয়েছিল ইউ. আর. অনন্তমূর্তির ‘সংস্কার’ পড়ে। রােগ হিসেবে প্লেগ বিস্তারের কারণ উদঘাটন সম্ভব কিন্তু সমাজ ও হৃদয়ে যখন প্লেগের উদ্ভব হয় তখন তার উৎস অনুসন্ধান প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। অদ্ভুত ভাবে অন্তমূর্তি এই দুইয়ের সংযােগ ঘটান ‘সংস্কার’-এ। ভারতের পাঞ্জাবি ভাষায় লেখিকা অজিত কৌর-এর ‘জিপসী নদীর ধারা’ আমাকে শিখিয়েছে নারী হয়ে ওঠার প্রক্রিয়ার চর্চাটাই অনেক বেশি জরুরি। কিংবা নারী হিসেবে সমাজের সুযােগগুলাের ব্যবহার না করে মানুষ হিসেবে গ্রহণ করার মানসিকতাটাই তাদের সম্মানজনক অবস্থানে নিয়ে যেতে পারে। এ প্রক্রিয়ায় প্রতিকূলতা থাকবেই, কিন্তু কােন ভাবেই থেমে থাকা চলবে না। সব সময় মেরুদণ্ড সোজা রাখাটাই বড় কথা। 

কিন্তু মেরুদণ্ড সােজা রাখাটা যে কখনাে প্রায় অসম্ভব, সম্মানে নয়, শরীরের আবেদনেই নিশ্চিত হয় নারীর গ্রহণযােগ্যতা- এই উপলব্দির মুখোমুখি হয়েছি গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ যখন সরলা এরিন্দারার লােমহর্ষক কাহিনী শােনান আমায়। হাজার বার ধর্ষিতা এরিন্দারার শরীর... গােটা লাতিন আমেরিকা হতে হতে এক সময় বাংলাদেশ হয়ে ওঠে। এরিন্দারা তখন নাম বদলে হয় ইয়াসমিন কিংবা শিশু তানিয়া। 

এক একটা দিন পার হতে গিয়েই মনে হয় পৃথিবীর কত বিখ্যাত মহান লেখকের বই পড়িনি। মানুষ কেন কচ্ছপের আয়ু পায় না! কত কিছু পড়া বাকি আছে। আয়ুর সমস্যা ছাড়াও ভালাে বই পড়ার সমস্যা তাে আরও আছে। চমৎকার প্রাঞ্জল অনুবাদের সমস্যা। প্রগতি প্রকাশন একসময় এ সমস্যার সমাধানে প্রধান বন্ধু ছিলাে, কিন্তু প্রগতিরও অধােগতি ঘটালাে ‘গণতান্ত্রিক সভ্য মানুষেরা’। আমাদের বাংলা একাডেমীর অনুবাদের বিভাগ এত দরিদ্র যে তার বেঁচে থাকাটাই অর্থহীন। তবুও তাদের কাছ থেকে পেয়েছি সরদার ফজলুল করিম অনূদিত ‘সক্রেটিসের জবানবন্দী’র মতাে অসাধারণ বইটি। কৈশােরের চাহিদা মিটিয়েছে সেবা প্রকাশনী। ইদানিং তাদেরও কিশাের ক্ল্যাসিক অনুবাদের ধারা খুবই ধীর গতিতে চলছে। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র কিছু অনুবাদের কাজ করেছে। ও হেনরী, এডগার এলান পাে, মোপাসাঁ, কোলরিজ-এর কিছু গল্পের অনুবাদের কালেকশন তাদের কাছ থেকে পাওয়া যায়। বাংলাদেশে অনুবাদের কাজে আরও অগ্রসর হওয়া উচিত। বিশেষ করে বাংলা সাহিত্যে শিশু-কিশােরদের জন্যে লেখার পরিমাণ খুবই কম। রায় পরিবার অর্থাৎ উপেন্দ্রকিশাের রায়, সুকুমার রায় এবং সত্যজিৎ রায়ের কবিতা, ছড়া, গল্প, গােয়েন্দা কাহিনী, দক্ষিণারঞ্জণ মিত্র মজুমদারের ঠাকুরমার ঝুলি, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়-এর কিশাের কাহিনী ইত্যাদি ছাড়া তেমন উল্লেখযােগ্য লেখা কই? 

আর এদিকে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পর কমলকুমার মজুমদার, ওয়ালীউল্লাহ্‌, অদ্বৈত মল্লবর্মণ, আবু জাফর শামসুদ্দিন, শওকত ওসমান, সৈয়দ শামসুল হক থেকে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, মাহমুদুল হক, কায়েস আহমেদ প্রমুখ পর্যন্ত এসে ধারাবাহিকতাটা যেন খুবই ধীর গতিতে চলছে। সবচেয়ে বড় সমস্যা- লেখাকে বিশ্বমানের করে তােলা। অর্থাৎ এই দশকের কোন গল্প লেখকের গল্পে যেন একই সঙ্গে তার সাহিত্যিক মান অতিক্রমের সাথে সাথে নিজস্ব সংস্কৃতিতে দাঁড়িয়ে এর গল্পকেও মােকাবেলা করতে পারে। এই জন্যে নিজের দেশে ব্যাপক সাহিত্য চর্চার পাশাপাশি প্রকরণ, বিষয় ইত্যাদি জানার জন্যে বিশেষ করে অনুভূতির আদান-প্রদানের জন্যে অনুবাদ বিশেষ ভূমিকা রাখে। 

আমার জীবনের প্রতি বসন্তে অনুবাদের লেখাগুলাে সব সময়ই কোকিলের গান হয়ে এসেছে। সেই মিষ্টি গানের পুনঃপুনঃ অনুরণনে আমি আগামি দিনগুলাে কাটিয়ে দিতে চাই। 



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ