হারুকি মুরাকামি'র গল্প : স্যামসা ইন লাভ


(হারুকি মুরাকামি পোস্ট মডার্ন সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ একজন লেখক। তাঁর লেখা গল্প, উপন্যাস ও প্রবন্ধ পাঠক-সমালোচক মহলে সমানভাবে প্রশংসিত। তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাসগুলো হলো নরওয়েজিয়ান উড, কাফকা অন্য দ্য শোর, দি উইন্ড-আপ বার্ড ক্রনিক্যাল, কিলিং কমেনডেটর ইত্যাদি। 

‘স্যামসা ইন লাভ’ গল্পটা দ্য নিউ ইয়র্কার পত্রিকায় ২০১৩ সালের অক্টোবর মাসে প্রথম প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে তা ‘মেন উইদাউট উইমেন’ গল্পগ্রন্থে স্থান পেয়েছ।)


স্যামসা ইন লাভ 
হারুকি মুরাকামি
অনুবাদ : আলভী আহমেদ


সে ঘুম থেকে জেগে উঠল। 

বুঝতে পারল, একধরনের পরিবর্তন এসেছে তার মধ্যে। সে এখন গ্রেগর স্যামসা। 

বিছানায় পিঠটা লাগিয়ে সে ছাদের দিকে তাকাল। তার চোখে আলোটা একটু একটু করে সয়ে আসছে। সে দেখল, একটা প্রাচীন ছাদ তার দিকে তাকিয়ে আছে। কোনো এক কালে হয়তোবা ছাদে রং করা হয়েছে। সাদা রং। কিন্তু ধুলো-ময়লা জমে সে রং এখন অনেকটাই বদলে গেছে। দুধ নষ্ট হয়ে গেলে যে রং হয় সে রকম হয়েছে দেখতে। 

তার ঠিক বাঁ পাশে একটা জানালা। পর্দা নেই। ঘরে কোনো আসবাবপত্র নেই। আলমিরা, চেয়ার, টেবিল কিছু নেই। একটা শুধু বিছানা, তোশক বিছানো। চাদর, বালিশ, কম্বল কিছু নেই। 

মেঝেটা কাঠের। কার্পেট নেই। সম্ভবত ঘরটাকে একটা শোবার ঘর হিসেবে ব্যবহার করা হয়। 

স্যামসা বুঝতে পারল না সে ঠিক কোথায় আছে। তার কী করা উচিত। মনের গভীরে সে শুধু এটুকুই জানত, সে এখন মানবজাতির এক সদস্য। তার নাম গ্রেগর স্যামসা। কিন্তু এটা সে কীভাবে জানল? সে যখন ঘুমিয়ে ছিল, কেউ কি তার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে গেছে! 

এগুলো নিয়ে ভাবতে শুরু করার সঙ্গে সঙ্গেই মনে হলো, তার মাথায় প্রচণ্ড যন্ত্রণা। যেন অসংখ্য মশা একসঙ্গে মাথার ভেতর গুনগুন করে চলেছে। সে সব চিন্তাভাবনা বাদ দিল। 

তবে যা-ই হোক না কেন, তাকে নিজের শরীর ঠিক রাখতে হবে। এভাবে ছাদের দিকে তাকিয়ে অনন্তকাল শুয়ে থাকা সম্ভব না। আর এভাবে সে অনেকটাই অরক্ষিত। কেউ যদি আক্রমণ করে বসে সে কি নিজেকে রক্ষা করতে পারবে? বিশেষ করে কোনো শিকারি পাখি যার বড় বড় ধারালো নখ? সে ভয় পেয়ে গেল। 

যে করেই হোক তাকে শরীর নাড়াতে হবে। প্রথম চেষ্টা হিসেবে সে আঙুলগুলো নাড়ানোর চেষ্টা করল। দুই হাত মিলিয়ে দশটা আঙুল। প্রতিটি আঙুলে আবার কিছু জোড়া আছে, যেগুলো সম্ভবত নাড়ানোর কাজে ব্যবহার হবে। 

সে শরীরে কোনো শক্তি পেল না। মনে হলো পুরো শরীরটা অসাড় হয়ে গেছে। বেশ কয়েকবার চেষ্টা করল সে। এরপর চোখ বন্ধ করল। মনের সব শক্তি এক করে আঙুলগুলো নাড়ানোর চেষ্টা করল। এবার পেরেছে। এরপর একটু একটু করে শিখতে লাগল, আঙুলগুলোকে কীভাবে কাজে লাগানো যায়। হঠাৎই সে তার শরীরে একটা তীব্র ব্যথা টের পেল। একটা দুঃসহ ব্যথা তার পুরো চেতনাকে গ্রাস করে ফেলছিল। 

কিছুক্ষণ পর সে বুঝতে পারল, যেটাকে ব্যথা বলে ভাবছিল সেটা আসলে ক্ষুধা। এক প্রবল ক্ষুধা। এ ধরনের অনুভূতি তার কাছে একটু নতুন। মনে হচ্ছিল এক সপ্তাহ ধরে কিছু খায়নি। পেটটাকে তার শরীরের কেন্দ্র মনে হলো এবং সেই কেন্দ্রে ভয়াবহ এক শূন্যতা অনুভব করল। প্রচণ্ড ক্ষুধায় সে পাগলের মতো হয়ে গেছে। 

সহ্য করতে না পেরে স্যামসা তার কনুই দুটোকে তোশকের ওপর ভর দিয়ে উঠবার চেষ্টা করল। মেরুদণ্ডে প্রচণ্ড ব্যথা বোধ হলো। কিন্তু সে দমে গেল না। সর্বশক্তি দিয়ে সে চেষ্টা করল এবং অবশেষে বিছানায় উঠে বসল। 

নিজের নেংটা শরীরটার দিকে তাকাল সে। কী বিশ্রী, কদাকার! এই দুর্বল শরীর নিয়ে সে কী করে বেঁচে থাকবে? পাতলা সাদা চামড়া, ভেতর দিয়ে নীল রঙের কিছু একটা দেখা যাচ্ছে। এগুলোকে সম্ভবত শিরা বলে। শরীরের কেন্দ্রবিন্দু, যেখানে প্রচণ্ড ক্ষুধা, সেই পেট কী রকম অরক্ষিত! দুই ঊরুর মাঝে কী রকম হাস্যকর একটা যৌনাঙ্গ ঝুলে আছে! শুকনো আর দীর্ঘ তার হাত-পা। শুধু দুটো করে। দুটো করে হাত-পা দিয়ে সে কীভাবে চলবে! আরও বেশি হাত-পা থাকলে কী ক্ষতি হতো! 

সে হাত দিয়ে নিজের ঘাড়, মাথা, মাথার ওপরের চুলগুলো অনুভব করল। সে আবিষ্কার করল দুটো বিশ্রী রকমের কান ঝুলে আছে, যেন এক জোড়া সামুদ্রিক শামুক। 

এই প্রাণীটাই কি আসলে সে! 

যখন তাকে শত্রু আক্রমণ করবে কী করে সে বাঁচবে? নিজেকে রক্ষা করবে কী দিয়ে? তার শরীরের ওপরে কোনো খোলস নেই, যেটা দিয়ে সে আক্রমণ ঠেকাতে পারে। আবার অন্যকে আক্রমণ করবার জন্য তার শরীরে কোনো অস্ত্র নেই। তাকে কেন এ রকম একটা অদ্ভুত প্রাণীতে পরিণত করা হলো? একটা মাছে রূপান্তর করা যেতে পারত তাকে, একটা সূর্যমুখী ফুলও সে হতে পারত। কিন্তু তার বদলে সে হয়েছে একজন মানুষ। তার নাম গ্রেগর স্যামসা। 

সে আলতো করে মেঝেতে পা ছোঁয়াল। ঠান্ডা কাঠের মেঝে। নিজের দুটো পায়ে দাঁড়াবার চেষ্টা করল। কোনোভাবেই ভারসাম্য পাচ্ছিল না। দুটো মাত্র পা সম্বল করে আদৌ দাঁড়ানো যায় কি না তার জানা নেই। কিন্তু সে চেষ্টা চালিয়ে গেল। অবশেষে দুটো পায়ের ওপর নিজের ভারসাম্য রাখতে পারল। এভাবেই বিছানাটাকে ধরে, নিজেকে ব্যালান্স করে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। মাথাটাকে তার প্রচণ্ড ভারী মনে হচ্ছে। গভীরভাবে শ্বাস নিল সে। নিজের যৌনাঙ্গের দিকে চোখ গেল। প্রবল মানসিক চাপে সেটা যেন চুপসে আছে। গভীরভাবে শ্বাস নিয়ে সে নতুন করে শুরু করবার প্রস্তুতি নিল। 

এবার হাঁটা শেখার পালা। 

দুপায়ের ওপর ভর দিয়ে নিশ্চয়ই মানুষ নামের এই অদ্ভুত জীব হেঁটে থাকে। সুতরাং তাকে সেভাবেই চেষ্টা করতে হবে। একবার ডান একবার বামদুপায়ের ওপর ভর দিয়ে সে সামনে এগোনোর চেষ্টা করল। এক নিদারুণ অত্যাচার! কোনোমতে সে হাত দিয়ে দেয়ালটা স্পর্শ করল। দেয়াল ধরে নিজের ব্যালান্স ঠিক করে আবার সামনে বাড়ল। 

ক্ষুধার প্রচণ্ড তাড়নাই তাকে হাঁটতে শেখাল। একটা বিষয় সে বেশ বুঝতে পারছিল। এই যে ঘর, এই ঘরে চিরটাকাল শুয়ে থাকলে কেউ তাকে খাবার দেবে না। নিজের খাবার নিজেকেই খুঁজে বের করতে হবে। অথবা মরে যেতে হবে। 

হাঁটি হাঁটি পা পা করে হেলতে দুলতে সে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। তার কাছে সময় দেখবার কিছু ছিল না। কিন্তু মনে হলো এই কাজটুকু করতে সে অনন্তকাল ব্যয় করে ফেলেছে। সে বুঝে পেল না তার এত অসুবিধা কী করে হচ্ছে? তাহলে কি সে শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী? বিকলাঙ্গ? 

দরজার হাতল ধরে টান দিল সামনের দিকে। ধাক্কা দিল। কিছুই হলো না। তারপর সে দরজার হাতলটাকে ডান দিকে ঘুরিয়ে টান দিল। মৃদু শব্দ করে খুলে গেল সেটি। আস্তে করে মাথাটা বের করে বাইরের দিকে তাকাল। 

একটা হলঘর। জনশূন্য। সে তার বাম পা দরজার বাইরে বের করল। শরীরের ওপরের অংশকে অনেক কষ্টে সামনের দিকে এগোনোর জন্য চাপ দিল। দেয়ালে হাত, ভারসাম্য রাখছে। আস্তে আস্তে সে করিডরে বেরিয়ে এল। 

হলঘরে সব মিলিয়ে চারটা দরজা। দরজাগুলো হুবহু একই রকম দেখতে। দরজাগুলোর ওপারে কী আছে জানতে তার খুব ইচ্ছে হচ্ছে। দরজার ওপাশে গেলে হয়তো পুরো রহস্যের জট খুলবে। 

কিন্তু তার পেটে প্রচণ্ড ক্ষুধা। খাবার খুঁজে বের করাটা তার জন্য এখন সবচেয়ে বড় কাজ। 

এবং অবাক করা ব্যাপার, তার মাথার মধ্যে হুট করে একটা অনুভূতি হচ্ছে। মনে হচ্ছে সে জানে কোথায় গেলে খাবার পাবে। আসলে সেটা ছিল খাবারের গন্ধ। 

সে খাবারের গন্ধ পেয়েছিল। রান্না করা খাবার। বাতাসে খাবারের গন্ধ যেন উড়ে উড়ে আসছে, তার দিকে আসছে। সে আবিষ্কার করল তার মুখ ভরে গেছে তরলে, মানব সম্প্রদায় যাকে ‘লালা’ বলে অভিহিত করে। 

সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় সে নিজের ভাগ্যকে আরেকবার দোষারোপ করল। আজ সে মানুষ না হয়ে যদি মাছ অথবা সূর্যমুখী ফুল হতো, তাহলে এভাবে সিঁড়ি দিয়ে তাকে নামতে হতো না। 

একটা-দুটো করে সিঁড়ি বেয়ে সতেরোটা ধাপ সে পার হলো। এরপর শরীরের সমস্ত শক্তি এক করে সে সোজা হলো। যেদিক থেকে গন্ধটা আসছে, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে সেদিকে এগিয়ে গেল। 

একটা টেবিল। দেখতে ডিমের মতো, ওভাল শেপ। খাবারগুলো তার ওপরে সাজানো। এখনো গরম ভাপ উঠছে। চারটা চেয়ার, কিন্তু কেউ বসে নেই। একটা কাচের ফুলদানি। তার ভেতরে বারোটা পদ্ম ভাসছে। ন্যাপকিন আর কাঁটাচামচ সাজিয়ে রাখা। দেখে মনে হয় না কেউ সেগুলো স্পর্শ করেছে। হয়তো, কয়েকজন মানুষ এখানে খেতে বসেছিল। এ সময় হঠাৎ করে কোনো ঘটনা ঘটে। তারা দ্রুত এ জায়গাটা থেকে চলে যায়। কী ঘটেছিল? আসলে ওরা কেনই বা গেল? কোথায় গেল? নাকি তাদের জোর করে কোথাও নিয়ে যাওয়া হয়েছে? আচ্ছা তারা কি আবার ফিরে আসবে? বিষয়গুলো নিয়ে স্যামসা ভাবতে পারত। কিন্তু তার পেটে প্রচণ্ড ক্ষুধা। সবচেয়ে কাছের চেয়ারটিতে বসে সে খালি হাত দিয়ে যতটুকু সম্ভব খাবার মুখের ভেতরে পুরতে লাগল। পাশেই ন্যাপকিন, ছুরি, কাঁটাচামচ। এগুলো সে ছুঁয়েও দেখল না। পাউরুটিটাকে ছিন্নভিন্ন করে খেয়ে ফেলল। জ্যাম অথবা বাটার কিছুরই তার প্রয়োজন ছিল না। সেদ্ধ ডিমগুলো এত দ্রুততার সঙ্গে সে পেটে চালান করল যে খোসা ছাড়াতে পর্যন্ত ভুলে গেল। মুঠোভর্তি গরম আলুর ভর্তা নিল। আঙুল দিয়ে তুলল আচার। সেগুলোকে একসঙ্গে মুখে দিল। স্বাদ তার কাছে মোটেই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। টক-ঝাল-মিষ্টি সবকিছুই তার কাছে সমান। কেবল একটি জিনিসই গুরুত্বপূর্ণ তার কাছে। তা হলো শরীরের প্রচণ্ড ক্ষুধা, সে ক্ষুধা মেটাতে হবে। 

খাওয়া শেষ করে স্যামসা যখন ঠান্ডা হয়ে বসল, তখন টেবিলে আর কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। ডাইনিং টেবিলের ওপরে যেন ঝড় বয়ে গেছে। যেন রাস্তার কিছু কাক উড়ে এসে টেবিলটাতে বসে ইচ্ছেমতো খাবারগুলো সাবাড় করে আবার উড়ে চলে গেছে। ফুলদানিতে রাখা পদ্মফুলগুলো শুধু ওরা খেতে পারেনি। 

চেয়ারে বেশ কিছুক্ষণ বসে রইল সে। হাতটাকে টেবিলের ওপর রেখে মাথাটা ছোঁয়াল। একটু যেন তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে সে এখন। গভীরভাবে তার শ্বাস বইতে শুরু করল। তার পাকস্থলীর ভেতরে খাবারগুলো হজম হচ্ছিল। ক্রমশ জোয়ারের মতো একটা অনুভূতি শরীরটাকে গ্রাস করল। সেটার নাম তৃপ্তি। 

টেবিলের ওপর একটা পাত্র আছে।। ভেতরে কিছু পানীয়। পানীয়টা সে একটা সিরামিকের কাপে ঢালল। কফির তীব্র গন্ধ তাকে কিছু একটা মনে করিয়ে দিচ্ছে। যেন এই ব্যাপারটা তার জীবনে আগে কখনো ঘটেছে। এর নাম স্মৃতি। 

হঠাৎ ঠান্ডা লাগতে শুরু করল তার। ক্ষুধার জ্বালায় এতক্ষণ সেটা অনুভব করেনি। তার অনুভূতিজুড়ে ছিল ক্ষুধা। ক্ষুধা মিটে যাবার পর ঠান্ডার অনুভূতিটা গ্রাস করল তাকে। ফায়ারপ্লেসের আগুন নিভে গেছে। হিটারগুলো অন করা নেই। সবচেয়ে বড় কথা, তার শরীরে কোনো কাপড় নেই, যেটা তাকে উষ্ণতা দিতে পারে। 

সে বুঝতে পারল শরীরে কিছু একটা কাপড় থাকা উচিত। হঠাৎ কেউ এসে পড়তে পারে বাড়িতে। তখন শরীরে কাপড় থাকাটা খুব জরুরি। কেউ হয়তো হুট করে দরজায় নক করবে। তখন? অথবা, সকালে খাবার না খেয়ে যে লোকগুলো বেরিয়ে গিয়েছিল তারাও যেকোনো সময় ফিরে আসতে পারে। তারা এসে তাকে নেংটো অবস্থায় দেখতে পেলে! 

সবকিছুই সে নিজে নিজে বুঝতে পারছে এখন। কিন্তু কীভাবে তার মাথায় এগুলো আসছে, সে সম্পর্কে তার কোনো ধারণা নেই। সে শুধু বুঝতে পারছে কাজটি করা উচিত। তার মাথার ভেতরে সম্ভবত স্মৃতির কিছু মেঘ আছে। এই মেঘ থেকেই সে ধারণাগুলো পাচ্ছে। 

সে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল। এখন সে দুই পায়ের ওপর দাঁড়াতে এবং হাঁটতে পারে। হলরুমে একটা ছাতা রাখার স্ট্যান্ড ছিল। সেটা থেকে কয়েকটা লাঠি ঝুলছে। সে ওক কাঠের তৈরি একটা লাঠি টেনে বের করল। এটাকে সে হাঁটার সময় অবলম্বন হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে। তাছাড়া একটা আত্মরক্ষার অস্ত্রও হতে পারে লাঠি। কোনো পাখি যদি তাকে আক্রমণ করে এটা দিয়ে সে আত্মরক্ষা করতে পারবে। স্যামসা জানালার কাছে গেল। এবং পর্দার ফাঁক দিয়ে বাইরে তাকাল। 

বাসাটা রাস্তার ঠিক পাশে। খুব বড় রাস্তা নয়। বেশি লোক চলাফেরা করছে না। তবে যা-ই হোক, সে খেয়াল করল রাস্তা দিয়ে চলাচল করা প্রতিটা মানুষের শরীরেই পোশাক আছে। বিভিন্ন রঙের, বিভিন্ন ফ্যাশনের। ছেলেদের পোশাক আর মেয়েদের পোশাক আলাদা। চামড়ার কিছু একটা, সম্ভবত জুতা, হ্যাঁ জুতা দিয়ে তাদের পা-গুলো মোড়ানো। অনেক ছেলে ও মেয়ের মাথাতেই টুপি। সবচেয়ে আশ্চর্য ব্যাপার, তাদের দেখে মনে হচ্ছে না, দুই পায়ের ওপর হাঁটা কঠিন কোনো ব্যাপার। সে নিজের যৌনাঙ্গের দিকে তাকাল। তারপর আবার রাস্তার মানুষগুলোকে দেখল। সবার যৌনাঙ্গ কাপড় দিয়ে ঢাকা। সে নিশ্চিত হলো তার শরীরটাকে ঢাকবার জন্য কিছু একটা দরকার, খুবই দরকার। 

সে ভয়ে ভয়ে রাস্তার দিকে আরেকবার তাকাল। দেখল তাকে আক্রমণ করতে পারে এমন কোনো পাখি সেখানে বসে আছে কি না। সে রকম কিছু তার চোখে পড়ল না। 

নিচতলায় হলঘর ছাড়াও আছে ডাইনিং রুম, রান্নাঘর এবং লিভিং রুম। কিন্তু সেখানে সে পোশাকজাতীয় কিছু পেল না। তার মানে দাঁড়াচ্ছে, কাপড়চোপড় নিশ্চয়ই অন্য কোথাও রাখা আছে। সম্ভবত, দোতলার কোনো ঘরে। 

লাঠিতে ভর দিয়ে স্যামসা সিঁড়ির কাছে এল এবং ওপরে উঠতে শুরু করল। নিচে নামার চেয়ে ওপরে ওঠা যেন একটু সহজ। রেলিং ধরে সতেরোটা ধাপ দ্রুততার সঙ্গে সে পার হলো। কোনো ধরনের ব্যথা-বেদনা বা ভয় তাকে স্পর্শ করল না। 

তার ভাগ্য ভালো। দোতলার কোনো দরজাই তালাবদ্ধ নয়। হাতলে ডান দিকে মোচড় দিতেই খুলে যাচ্ছে। 

মোট ঘর চারটা। একটা ঘরে তার ঘুম ভেঙেছে। বাকি তিনটা ঘরে অনেক আসবাবপত্র। বিছানায় পরিষ্কার চাদর, ড্রেসিং টেবিল, ডেস্ক, ছাদ থেকে ঝোলানো বাতি, মেঝেতে কার্পেট, বুকশেলফে সুন্দর করে সাজানো বই। দেয়ালে পেইন্টিং। কাচের ফুলদানি। জানালায় পর্দা। বিছানাগুলো দেখে বোঝা যায়, সেখানে নিয়মিত কেউ ঘুমায়। বালিশে মাথার ছাপ লেগে আছে। 

সবচেয়ে বড় যে ঘরটা, সে ঘরের আলমিরা খুলে তার সাইজের একটি ড্রেসিং গাউন খুঁজে পেল স্যামসা। মনে হলো এটা সে গায়ে চাপাতে পারবে। আসলে অন্য জামাকাপড়গুলো কীভাবে পরতে হয়, তা সে জানত না। অনেকগুলো করে বোতাম। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো, সে কিছুতেই বুঝতে পারছে না জামার সামনের দিক কোনটা আর পেছনের দিক কোনটা, ওপরের দিক কোনটা বা নিচের দিক কোনটা। সে তুলনায় ড্রেসিং গাউনটা খুব সাদাসিধে ধরনের। ওটার নরম কাপড়, তার চামড়ার ওপরে বেশ আরামদায়ক মনে হলো। এমনকি গাউনের সঙ্গে ম্যাচ করে এক জোড়া স্যান্ডেল সে খুঁজে পেল। 

গাউনটা পরতে শেষ চেষ্টা করল। কয়েকবার ভুল করার পর সে নিজের নেংটো শরীরের ওপরে গাউনটা চাপাল। কী করে যেন ফিতাটাও বেঁধে ফেলল। 

এই অবস্থাটা নিশ্চয়ই আগের চেয়ে ভালো। কিন্তু, তার এখনো শীত লাগছে। তবে সে যতক্ষণ ঘরের ভেতর আছে, ততক্ষণ সে নিশ্চিন্ত। ঘরটা সামান্য উষ্ণ। ঘরের মধ্যে থাকার আরেকটা সুবিধা হচ্ছে, কোনো শিকারি পাখি তাকে আক্রমণ করতে পারবে না। 

কলবেল বাজল। 

স্যামসা তখন বিছানায় শুয়ে ছিল। সবচেয়ে বড় ঘরের সবচেয়ে বড় বিছানাটাতে। তার গায়ে কম্বল। শরীরে আরামদায়ক উষ্ণতা। মনে হচ্ছিল সে একটা ডিমের ভেতরে ঘুমিয়ে আছে। কলবেল যেন তাকে স্বপ্ন থেকে বাস্তবে নিয়ে এল। 

বিছানা থেকে নিজেকে টেনে তুলল সে। গাউনটাকে শরীরের সঙ্গে বোঁধে। স্যান্ডেল পরল। লাঠিটা আঁকড়ে ধরে রেলিংয়ে হাত দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নামতে লাগল। এবার তার কাছে নামাটা কঠিন বলে মনে হলো না। তার পরও পড়ে যাবার আশঙ্কা তার মন থেকে একেবারে যায়নি। পায়ের দিকে খেয়াল রেখে ধীরে ধীরে নামল। পুরো সময়টা কলবেল বেজে চলল। যেন দরজার ওপাশে প্রচণ্ড ধৈর্যহীন এক মানুষ। দরজা খোলার কৌশল সে আগেই শিখেছিল। হাতলটা ঘুরিয়ে ডান দিকে মোচড় দিল। ব্যস, খুলে গেল। 

একটা মেয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল। ছোটখাটো গড়ন। স্যামসা ভেবে অবাক হলো, মেয়েটা কী করে কলবেলের নাগাল পেল। বেলটা একটু উঁচুতে। মেয়েটার হাত সে পর্যন্ত যাবার কথা না। মেয়েটাকে ভালোভাবে দেখল সে। এবং তার ভুল বুঝতে পারল। মেয়েটা আসলে ছোটখাটো নয়। তার পিঠটা একটু ঝুঁকে আছে সামনের দিকে। এজন্যই তাকে ছোটখাটো লাগছে। না হলে তার শরীরের কাঠামো অন্যদের মতোই স্বাভাবিক। 

মেয়েটার পরনে একটা ঢিলেঢালা স্কার্ট। ওপরে জ্যাকেট। গলায় একটা সুতি কাপড়ের স্কার্ফ প্যাঁচানো। চুলগুলো গাঢ় বাদামি রঙের, রাবার ব্যান্ড দিয়ে চুড়ো করে বাঁধা। বয়স মেরেকেটে একুশ। চোখ দুটো বড় বড়। এবং ঠোঁটটা একদিকে একটু বাঁকা। ঠিক যেন আকাশে একফালি চাঁদ উঠেছে। 

‘এটা কি গ্রেগর স্যামসার বাসা?’ মেয়েটা বলল। 

কথাটা বলার সময় মেয়েটা শরীরে একটা মোচড় দিল। যেন একটা ঢেউ উঠল। প্রবল ভূমিকম্পের সময় পৃথিবীতে এমন ঢেউ ওঠে। 

স্যামসা একটাবার ভাবল, যেহেতু তার নাম স্যামসা, সুতরাং এটা তারই বাসা হবার কথা। 

‘সম্ভবত।’ 

মনে হলো উত্তরে মেয়েটা সন্তুষ্ট নয়। 

‘সম্ভবত! এটা আসলেই গ্রেগর স্যামসার বাসা কি না সে ব্যাপারে আপনি নিশ্চিত নন?’ 

‘আমি এটুকু জানি, আমার নাম গ্রেগর স্যামসা,’ যতদূর সম্ভব স্বাভাবিক স্বরে সে বলল, ‘পৃথিবীর অন্য কোনো বিষয়ে নিশ্চিত না হলেওএই একটা বিষয়ে আমি নিশ্চিত, আমার নাম গ্রেগর স্যামসা।’ 

মেয়েটাকে দ্বিধান্বিত মনে হলো। দ্বিধা ঝেড়ে সে বলল, ‘ওকে। তাহলে আসুন, আমরা কাজ শুরু করি।’ 

মেয়েটা নিচু হয়ে একটা কাপড়ের ব্যাগ তুলল। কালো রঙের ভারী একটা ব্যাগ। ব্যাগের কয়েকটা জায়গা ছেঁড়া। তালি মারা। 

সে বাসার ভেতরে ঢুকে গেল। স্যামসা তার পেছনে দরজাটা বন্ধ করল। 

মেয়েটার দ্বিধা যেন কাটছেই না। সম্ভবত স্যামসার গাউন এবং পায়ের স্যান্ডেল, এই দুটোর মধ্যে কিছু একটা ছিল, যা তার মনে সন্দেহ জাগাচ্ছে। 

‘সম্ভবত, আপনাকে আমি ঘুম থেকে জাগালাম’, শীতল কণ্ঠে মেয়েটা বলল। 

‘অসুবিধে নেই। মানুষ ঘুমায় জেগে ওঠার জন্যই। আমার চেহারার জন্য আমি দুঃখিত। আসলে আমি নিজেও বুঝতে পারছি, আমার পোশাক-আশাক ঠিক নেই। এর পেছনে কিছু কারণ আছে। আপনি চাইলে আমি ব্যাখ্যা করতে পারি।’ 

‘বাদ দিন। আমরা বরং মূল প্রসঙ্গে যাই। সেই দরজাটা কোথায়?’ 

‘দরজা?’ 

‘হ্যাঁ। যে দরজার তালা ভেঙে গেছে। আর সেটা মেরামত করার জন্য আমাকে আসতে বলা হয়েছে।’ 

‘আমি ঠিক জানি না। সম্ভবত, দোতলার কোনো একটা ঘরের দরজা হবে।’ 

মেয়েটা সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাল। ‘আবারো সম্ভবত?’ 

তালা সম্পর্কে নিজের এই অজ্ঞতা স্যামসাকে প্রচণ্ড বিব্রত করল। গলা খাঁকারি দিয়ে সে নিজের ভেতর আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে কথা বলার চেষ্টা করল। কিন্তু, মুখ দিয়ে একটা শব্দও বের হলো না। 

‘মিস্টার স্যামসা, আপনার বাসায় কি অন্য কেউ আছে? মানে, আপনার বাবা-মা, বা সিনিয়র কেউ? আমার মনে হয়, তাদের সাথে কথা বলতে পারলে আমার জন্য সুবিধা হতো।’ 

‘তারা সম্ভবত বাইরে গেছে। আমি ঘুমিয়ে ছিলাম। জেগে ওঠার পর তাদের আর দেখিনি।’ 

‘আবারো সম্ভবত?’ 

‘বললাম তো, ঘুম থেকে ওঠার পরে আমি দেখতে পাই, বাসায় কেউ নেই। সুতরাং, সম্ভবত বলা ছাড়া স্পষ্টভাবে আমার আর কিছুই বলার নেই।’ 

‘অদ্ভুত। আপনাদের কিন্তু জানিয়েছিলাম আমরা আজ আসব তালা ঠিক করতে।’ 

‘আমি খুবই দুঃখিত।’ 

মেয়েটা স্যামসার দিকে তাকাল। হাতের লাঠিটার দিকে তার নজর গেল। লাঠিটায় ভর করে সে দাঁড়িয়ে আছে। 

‘আপনার পায়ে কি কোনো সমস্যা আছে?’ 

‘হ্যাঁ, একটু আছে বোধ হয়।’ 

মেয়েটার শরীর আবার একবার মুচড়ে উঠল। স্যামসার কোনো ধারণা নেই এই মোচড়ের কী উদ্দেশ্য হতে পারে। 

‘ঠিক আছে, চলুন। দোতলার দরজাগুলো দেখে আসি। এসেছি যখন কষ্ট করে না দেখে তো আর যাব না। তবে আপনারা আরেকটু দায়িত্বশীল হলেও পারতেন। কত পথ পাড়ি দিয়ে আমাকে এখানে আসতে হয়েছে জানেন? কী ভয়ংকর সব উঁচু-নিচু রাস্তা, ব্রিজ এগুলো পার হয়ে এসেছি। জীবনের কত ঝুঁকি ছিল সেটা জানেন? এখন এত কষ্ট করে এসে যদি শুনতে হয়, কোন দরজার তালা ভাঙা সে ব্যাপারে আপনি নিশ্চিত নন, ভালো লাগবে?’ 

স্যামসা মাথা নিচু করে রইল। 

‘এসেই যখন পড়েছি, চলে তো যেতে পারি না। কাজটা করেই যেতে হবে। পরে আবার আসব, সেটা আমার জন্য আরও কষ্টকর হবে।’ 

ভয়ংকর সব উঁচু-নিচু রাস্তা বলতে মেয়েটা কী বোঝাতে চাইছে স্যামসা বোঝার চেষ্টা করল। তাছাড়া পথটুকু পাড়ি দিতে তার কিসের ঝুঁকি ছিল, সেটাও তার জানতে ইচ্ছে হচ্ছে। কিন্তু সে কোনো প্রশ্ন করার সাহস পেল না। 

মেয়েটা নিচু হয়ে তার কালো ভারী ব্যাগটা টেনে নিল। এবং সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে লাগল। স্যামসা তাকে অনুসরণ করল। রেলিংয়ের ওপর হাত দিয়ে আস্তে আস্তে উঠল। 

দোতলার হলঘরে দাঁড়িয়ে মেয়েটা চারদিকে তাকাল। 

‘সম্ভবত এই চারটে দরজার একটা। রাইট?’ 

‘বোধ হয়।’ 

‘চলুন। আমরা হলঘরের শেষ প্রান্তে ওই যে বাম দিকের দরজা, ওটা দিয়ে শুরু করি।’ 

এটা হলো সেই ঘরের দরজা, যে ঘরে স্যামসা সকালে ঘুম থেকে জেগেছিল। 

মেয়েটা দরজার দিকে এগিয়ে গেল। দরজার হাতলটাকে ডানে মোচড় দিল। ভেতরে ঘরটা আগের মতোই আছে। খালি তোশকসহ বিছানাটাকে আরও বিবর্ণ মনে হচ্ছিল। 

সে মেঝেতে আসন গেড়ে বসে আছে এখন। তার কালো ব্যাগের ভেতর থেকে বেরিয়ে এল একটা সাদা ফ্লানেল কাপড়। সেটাকে সে মেঝের ওপর বিছিয়ে দিল। বিভিন্ন সাইজের অনেক টুল বের করে, সেগুলোকে সতর্কতার সঙ্গে কাপড়ের ওপর সাজাল। 

মাঝারি সাইজের একটা টুল হাতে তুলে নিল সে। সেটাকে দক্ষ হাতে তালার ভেতরে ঢোকাল। তার চোখ দুটো সরু হয়ে আসছে। বিভিন্ন কোণ থেকে সে চেষ্টা করে যাচ্ছে। সামান্য শব্দেই তার কান খাড়া হয়ে উঠছে। এরপর একটা সরু তার হাতে তুলে নিল। তারটা তালার ভেতরে ঢোকাল। তার মুখ গম্ভীর হয়ে আসছে। 

‘আপনার কাছে কি এই তালার চাবি হবে?’ সে স্যামসাকে জিজ্ঞাসা করল। 

‘এর চাবি কোথায় আছে সে সম্পর্কে আমার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই।’ 

‘মিস্টার স্যামসা, আপনি কি জানেন আপনি খুবই বিরক্তিকর একটা লোক? পৃথিবীর অধিকাংশ বিষয় সম্পর্কেই আপনার কোনো ধারণা নেই।’ 

এরপর সে স্যামসাকে পুরোপুরি অগ্রাহ্য করে একটি স্ক্রু ড্রাইভার বের করল এবং তালাটিকে দরজা থেকে খোলার চেষ্টা করল। তার সব নড়াচড়াই ধীরগতির, কিছুটা সতর্ক। শরীরটা মাঝেমধ্যে মোচড় দিচ্ছে। কেন দিচ্ছে, কে জানে? হয়তো দীর্ঘশ্বাস ফেলার জন্য। 

স্যামসা তার ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে দেখছিল। মেয়েটার শরীর যতবার বেঁকে যাচ্ছে, সে নিজের ভেতরে একটা অদ্ভুত অনুভূতি টের পাচ্ছে। সে গরম অনুভব করছে। নিজেই টের পাচ্ছিল, তার নিঃশ্বাস গরম হয়ে উঠছে। শরীর অদ্ভুতভাবে সাড়া দিচ্ছে। মুখ শুকিয়ে যাচ্ছে, দুই ঊরুর মাঝখানে ঝুলে থাকা লিঙ্গটা প্রসারিত ও শক্ত হয়ে যাচ্ছে। তলপেটের ঠিক নিচে তার গাউনটা একটু ফুলে উঠল। 

দরজা থেকে তালা খোলার পর মেয়েটা জানালার পাশে গেল। জানালা দিয়ে আসা আলোয় তালাটার ভেতরে দেখার চেষ্টা করছে সে এখন। তার দিয়ে সেটার ভেতরে নাড়াচাড়া করছে। পুরো সময়টাই তাকে অসম্ভব বিরক্ত মনে হলো। সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্যামসার দিকে তাকাল। 

‘হ্যাঁ, এটাই সেই তালা যেটা আপনারা ঠিক করবার জন্য ডেকেছেন। এটা ভাঙা।’ 

‘বাহ্্ খুঁজে পেয়ে গেছেন! ভালো, বেশ ভালো।’ 

‘মোটেই ভালো না। তালার ভেতরটা ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। এখানে বসে এটা ঠিক করব, এ রকম কোনো উপায় নেই। এটা একটা বিশেষ ধরনের তালা। এটাকে আমার সঙ্গে করে নিয়ে যেতে হবে। আমি নিজে নিজে এটা মেরামত করতে পারব না। আমার বাবা অথবা বড় ভাই হয়তো পারবে। আমি মাত্র কাজ শেখা শুরু করেছি। তালার ছোটখাটো সমস্যা আমি ঠিক করতে পারি। এই সমস্যাটা অনেক বড়।’ 

‘ও’, স্যামসা বলল। 

এই তথ্যটা সে জেনে গেল, মেয়েটার একজন বাবা এবং বড় ভাই আছে। এদের পুরো পরিবার তালা সারাইয়ের কাজ করে। তালার কারিগর। 

‘আসলে হয়েছে কি, আমার এক ভাইয়ের আসার কথা ছিল আজ। আমার বড় ভাই। কিন্তু শহরে খুব গোলমাল হচ্ছে, জানেন তো? শক্ত-সমর্থ পুরুষদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে। তাই সে বাড়ি থেকে বের হতে সাহস করেনি। আমাকে পাঠিয়েছে। পুরো শহরে চেকপোস্ট। কিন্তু আমি অবাক হচ্ছি, তালাটা এমন অদ্ভুতভাবে ভাঙল কী করে? কেউ একজন কোনো বিশেষ যন্ত্র দিয়ে এটার ভেতরে গর্ত করেছে। এর জন্য বেশ পরিশ্রম করতে হয়েছে তাকে। সে কেন এই কাজটি করল তার কোনো ব্যাখ্যা আমি খুঁজে পাচ্ছি না।’ 

কথাটা বলতে বলতে শরীরে একটা মোচড় দিল। তার দুই হাত এমনভাবে নড়ে উঠল যেন কোনো সাঁতারু নদীতে সাঁতার কাটছে। স্যামসা টের পেল, মেয়েটার এই বিশেষ ভঙ্গি তার শরীরে উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে। 

‘আমি কি আপনাকে একটা প্রশ্ন করতে পারি?’ স্যামসা বলল। 

‘প্রশ্ন? করতে পারেন,’ মেয়েটা কপালের ওপর থেকে চুল সরিয়ে বলল। 

‘কিছুক্ষণ পরপর আপনার শরীরটা একটু মুচড়ে উঠছে। এটার কারণ কী?’ 

মেয়েটা কিছুক্ষণ ভাবল। তারপর বলল, ‘আপনি কি বলতে চাচ্ছেন, এভাবে?’ বলে সে শরীরে আরেকটি মোচড় দিল। 

‘হ্যাঁ, এভাবে।’ 

মেয়েটার মুখ অপমানে কালো হয়ে গেল। তবু সে বলতে শুরু করল, ‘আমি যে অন্তর্বাসটা পরি, সেটি আমার শরীরে ফিট করে না। “অন্তর্বাস” কী জিনিস জানেন তো? এটা হচ্ছে ব্রা, ব্র্রেসিয়ার। শরীর মুচড়ে ব্রেসিয়ারটাকে যে জায়গায় থাকবার কথা, সে জায়গায় ফিরিয়ে আনি।’ 

‘ব্রেসিয়ার?’ 

‘হ্যাঁ ব্রেসিয়ার। আপনি কি বলতে চাচ্ছেন, আপনি জানেন না সেটা কী জিনিস? নাকি একটা কুঁজো মেয়ে ব্রেসিয়ার পরেছে, এটাই আপনার কাছে অদ্ভুত লাগছে। আপনি কি মনে করেন, আমার মতো অসুন্দর, কুঁজো একটা মেয়ে যে, তার ব্রেসিয়ার ব্যবহার করবার অধিকারটুকুও নেই?’ 

‘কুঁজো?’ স্যামসা বলল। 

কুঁজো শব্দটা তার স্মৃতির শূন্যতার ভেতর সে হাতড়ে খুঁজে বের করতে চেষ্টা করল। সে কি আগে শুনেছে এই শব্দটা? 

‘শোনেন, যেসব মেয়ে কুঁজো, তাদেরও স্তন আছে। অন্য মেয়েদের যেমন থাকে, ঠিক তেমন। সেগুলোর জন্য আমাদেরও ব্রেসিয়ার পরতে হয়। গাভির মতো ঝুলন্ত দুধ নিয়ে আমরা চলাফেরা করতে পারি না। কারণ, কুঁজো হলেও আমরা মানুষ, গাভি নই।’ 

‘নিশ্চয়ই।’ স্যামসা কোনোমতে বলল। 

‘কিন্তু সমস্যাটা কি জানেন? কুঁজো মেয়েদের জন্য আলাদাভাবে কোনো ব্রেসিয়ার ডিজাইন করা হয় না। ফলে কী হয়, এগুলো আলগা হয়ে যায়। আমাদের শরীরের গঠন স্বাভাবিক মেয়েদের চেয়ে একটু আলাদা। বুঝতে পেরেছেন? ব্রেসিয়ার আমাদের স্তন থেকে একটু সরে যায়, তখন শরীরে মোচড় দিয়ে সেটাকে আগের জায়গায় ফিরিয়ে আনতে হয়।’ 

মেয়েটা একটু থামল। তারপর তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল, ‘এ কারণেই আপনি আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। পেছন থেকে পুরো ব্যাপারটা আপনাকে এক ধরনের আনন্দ দিচ্ছিল। পৈশাচিক আনন্দ।’ 

‘বিশ্বাস করেন, কখনো না। আমি শুধু জানতে চাচ্ছিলাম, আপনি এটা কেন করেন? আমি এত কিছু জানতাম না। প্লিজ আমার কথা বিশ্বাস করেন।’ 

কথাটা বলতে বলতেই স্যামসা নিজের মাথার ভেতরে একধরনের সিদ্ধান্তে উপনীত হলো। ব্রেসিয়ার বা অন্তর্বাস হলো একধরনের পোশাক, যা স্তনজোড়াকে নিজের জায়গায় রাখে। সেগুলোকে ঝুলতে দেয় না। আর কুঁজো হলো, যার শরীরের গঠন এই মেয়েটার মতো এবং ব্রেসিয়ারে যার স্তন ঠিকভাবে আঁটে না। সে অবাক হয়ে ভাবল, এই পৃথিবীতে তার কত কিছুই না শেখার আছে! 

মেয়েটা হুট করে খেয়াল করল, স্যামসার গাউনটার দুই ঊরুর মাঝখানটা ফুলে আছে। বেশ দৃষ্টিকটুভাবে ফুলে আছে। 

‘এর মানে কী?’ 

‘কিসের?’ 

মেয়েটা স্যামসার উঁচু হয়ে থাকা লিঙ্গের দিকে দেখাল। 

স্যামসা বুঝতে পারল জিনিসটার এভাবে থাকাটা ঠিক নয়। এটা অমার্জিত একটা ব্যাপার। লিঙ্গের উত্থান, বিশেষ করে এই মেয়েটির সামনে, এক ধরনের অপরাধ। 

‘বুঝতে পেরেছি। আপনি ভাবছেন, একটা কুঁজো মেয়েকে বাসায় একা পেয়েছি। এখন তার সঙ্গে বিছানায় যাব। আপনার মাথায় এটা খেলা করছে, তাই না? সেক্স করার জন্য পাগল হয়ে গেছেন।’ 

‘সেক্স?’ স্যামসার মাথায় আর একটা নতুন শব্দ চলে এল, যার অর্থ সে জানে না। 

‘আপনি ভেবেছেন, কুঁজো মেয়েমানুষ। এমনিতেই একটু সামনের দিকে ঝুঁকে থাকে। সে হাঁটু গেড়ে একটু সামনে ঝুঁকে থাকবে আর আপনি পেছন দিক থেকে আপনার ওই শক্ত হয়ে ওঠা বিশ্রী জিনিসটা ঢুকিয়ে দেবেন। ঠিক না? বিশ্বাস করেন, আপনার মতো বিকৃত মস্তিষ্কের মানুষ পৃথিবীতে অনেক আছে, যারা মনে করে আমাদের খুব সহজেই পাওয়া যায়। কারণ, আমরা কুঁজো। কিন্তু শোনেন, আমি জানিয়ে দিচ্ছি, এত সহজে আমাকে পাবেন না।’ 

‘আমি সত্যিই খুব লজ্জিত। আমি জানি না, কী করে আপনার মনে দুঃখ দিলাম। কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমি সত্যিই দুঃখিত। কোনো একটা কারণে নিশ্চয়ই আমি আপনার মন খারাপের কারণ হয়েছি। সে জন্য আমি মাফ চাচ্ছি। কিন্তু বিশ্বাস করুন, আপনার কোনো অপকার আমি করতে চাইনি। সম্ভবত, আমি অসুস্থ এবং অনেক বিষয় আমি বুঝতে পারছি না। সে কারণেই এই ভুল-বোঝাবুঝি।’ 

মেয়েটা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। একটু ভাবল। 

সে বলল, ‘ঠিক আছে। আমি আপনার ব্যাপারটা বোধ হয় কিছুটা বুঝতে পারছি। আপনি সম্ভবত একটু বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী। ঠিক না? তবে আপনার পুরুষাঙ্গটা আসলেই বিশাল আকার ধারণ করেছে। এটা দৃষ্টিকটু।’ 

‘আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত। আমার বেপরোয়া পুরুষাঙ্গের তরফ থেকে আপনার কাছে মাফ চাইছি।’ 

‘থাক বাদ দিন,’ সে নরম কণ্ঠে বলল, ‘ছোটবেলা থেকেই মেয়েদের এ সমস্যাগুলো ফেস করতে হয়। আপনি জানেন, বাড়িতে আমার চারটা অপদার্থ ভাই আছে? আমি যখন খুব ছোট ছিলাম, মজা করে তারা আমাকে তাদের বিশাল লিঙ্গ দেখাত।’ 

‘আমি দুঃখিত,’ স্যামসা আবারো বলল। 

মেয়েটা হাঁটু গেড়ে নিচু হয়ে তার সরঞ্জামগুলো ব্যাগের ভেতর তুলল। ভাঙা তালাটা ফ্লানেলের কাপড়ে মুড়িয়ে ব্যাগে ঢোকাল। 

‘তাহলে তালাটা আমি বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছি। আপনার বাবা-মাকে বলবেন, আমরা ওটা মেরামত করব। অথবা যদি মেরামত করতে না পারি, তাহলে বদলে দেব। একটু সময় লাগতে পারে। তাদের বলতে ভুলবেন না। ঠিক আছে? মনে রাখতে পারবেন আমার কথাগুলো?’ 

‘পারব।’ 

মেয়েটা ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে নামতে শুরু করল। স্যামসা তাকে অনুসরণ করছে। তার হূৎস্পন্দন দ্রুত হলো। বেয়াড়া পুরুষাঙ্গটা আরও শক্ত হয়ে যাচ্ছে, সে বুঝতে পারল। তার গাউনের ওপর দিয়ে চাপ দিয়ে সে সেটাকে নিচে নামাতে চাইল। কিন্তু কোনোভাবেই সেটা আগের অবস্থায় ফিরে আসছে না। 

‘আমি আপনাকে আগেই বলেছি, আমার এক ভাই আসার কথা ছিল আজ,’ দরজায় পৌঁছানোর পর মেয়েটা বলল। 

‘কিন্তু রাস্তায় আজ ব্যারিকেড। সেনাবাহিনী মার্চ করছে প্রাগ শহরে। ট্যাংক নেমেছে শয়ে শয়ে। লোকজন কাউকে দেখলেই গ্রেফতার করছে। এ কারণেই আমাদের পরিবারের ছেলেরা কেউ বের হয়নি। একবার যদি তাদের অ্যারেস্ট করা হয়, বলা যায় না, হয়তো কোনো দিন আর ছাড়বে না। তাই আমি বের হয়েছি। একটা কুঁজো মেয়েকে হয়তো কেউই খেয়াল করবে না।’ 

স্যামসা বুঝতে পারছে যে তার কিছু বলার আছে। কিন্তু কী বলবে সেটা বুঝে উঠতে পারছিল না। 

‘আমাদের কি আর কখনো দেখা হতে পারে?’ 

‘আপনি কি আমাকে আবার দেখতে চান?’ 

‘চাই। আমি আপনাকে বারবার দেখতে চাই।’ 

‘যখন দেখা হবে, তখন আপনার লিঙ্গ আবারো ফুলে উঠবে। আপনি আবারো বিব্রত হবেন, সেই ঝুঁকি কি আপনি নেবেন?’ 

স্যামসা ফুলে ওঠা পুরুষাঙ্গের দিকে তাকাল। তারপর বলল, ‘আমি জানি না, বিষয়টাকে আমি ঠিক কী করে ব্যাখ্যা করব। তবে বিশ্বাস করুন, আমার ভেতরে যে অনুভূতি সেটার সঙ্গে আমার ফুলে ওঠা লিঙ্গের কোনো সম্পর্ক নেই। এটা সম্ভবত আমার হূদয়ঘটিত কোনো সমস্যা।’ 

‘আপনি একদম বাচ্চাদের মতো কথা বলছেন। হূদয়ঘটিত সমস্যা। খুবই নতুন একটা দৃষ্টিভঙ্গিতে আপনি বিষয়টাকে দেখছেন। এর আগে কারও কাছ থেকেই আমি এ রকমটা শুনিনি।’ 

‘সত্যি বলছি।’ 

‘ঈশ্বরের দিব্যি দিয়ে বলুন। সত্যি? হূদয়ঘটিত সমস্যা?’ 

‘সত্যি। ঈশ্বরের দিব্যি।’ 

যদিও স্যামসা জানে না, ঈশ্বর কী রকম বস্তু। এটাও তার শব্দভান্ডারে নতুন। তবে সে এটা বুঝতে পারল, ঈশ্বর হলো এমন একজন যার দিব্যি দেওয়া চলে। 

মেয়েটার চোখে-মুখে একটা গভীর দৃষ্টি দেখা গেল। মনে হলো সে অনেক দূর থেকে তাকিয়ে আছে। 

‘সত্যি, আপনি আমাকে আবার দেখতে চান?’ 

‘চাই।’ 

‘দেখা হলে কী করব আমরা?’ 

‘কথা বলব দুজন।’ 

‘কী বিষয়ে?’ 

‘অনেক অনেক বিষয়ে।’ 

‘শুধুই কি কথা বলব?’ 

‘আমি আপনার কাছ থেকে অনেক কিছু জানতে চাই।’ 

‘কী জানতে চান?’ 

‘এই পৃথিবীর কথা। আপনার কথা, আমার কথা। আপনার প্রতি আমার অনুভূতির কথা। মনে হয়, অনেক কিছু নিয়েই আমাদের কথা বলার প্রয়োজন আছে। অনেক কিছু নিয়েই আমাদের কথা বাকি রয়ে গেছে।’ 

মেয়েটা ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল। তারপর বলল, ‘আপনাকে দেখলেই বোঝা যায়, বাবা-মা আপনাকে অনেক যত্ন করে বড় করেছে। আমার মনে হয় না তারা আমার মতো একটা কুঁজো মেয়ের সাথে আপনাকে জড়াতে দেখলে খুশি হবে। তার চেয়েও বড় কথা, আমাদের প্রাগ শহরটা বিদেশি সৈন্য দিয়ে ভরে আছে। সামনে কী হতে যাচ্ছে, কেউ জানে না। এই শহরে আদৌ কোনো মানবিক জায়গা হয়তো থাকবে না।’ 

স্যামসার ভবিষ্যৎ নিয়ে কোনো ভাবনা ছিল না। ভবিষ্যৎ কেন, বর্তমান ও অতীত নিয়ে ভেবেও সে কোনো কূলকিনারা পাবে না। কোনটা ঠিক, কোনটা বেঠিক সে কিছুই জানে না। পোশাক পরতে পারাটাও তার কাছে ছিল একটা জটিল বিষয়। 

মেয়েটা বলল, ‘যা-ই হোক, আমি কয়েক দিন পর এখানে আবার আসব। আমরা যদি তালাটা ঠিক করতে পারি, তবে ওটাকে নিয়ে আসব। আর যদি ঠিক না-ও করতে পারি, তা-ও আসতে হবে তালাটা ফিরিয়ে দিতে। অবশ্য আপনাকে সার্ভিস চার্জ দিতে হবে। আপনি যদি তখন এখানে থাকেন, আমাদের আবার দেখা হবে। সে সময়, আমরা অনেকক্ষণ কথা বলতে পারব কি না আমি জানি না। কিন্তু আমি যদি আপনি হতাম, তাহলে অন্তত বাবা-মার সামনে আমার ওই ফুঁসে ওঠা পুরুষাঙ্গটা লুকিয়ে রাখতাম। এর জন্য এক ধরনের আন্ডারওয়্যার ব্যবহার করতাম। এ ধরনের জিনিস প্রদর্শন করে আপনি কখনো হাততালি পাবেন না।’ 

স্যামসা বুঝতে পারছিল না কী বলবে। তারপরও সে মাথা নেড়ে একমত হলো। 

‘খুবই অদ্ভুত, না? আমাদের চারপাশের সবকিছু ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। বিদেশি সৈন্য আমাদের মেরে ফেলছে। তারপরও কিছু লোক আছে, যারা একটা ভাঙা তালা নিয়ে চিন্তিত। আবার এমন কিছু মানুষ আছে, যারা দায়িত্ব নিয়ে সেই ভাঙা তালাগুলো মেরামত করতে আসে। জীবনের ঝুঁকি থাকলেও আসে।’ 

মেয়েটা একটু থামল। তারপর মাথা তুলে আবার সামনের দিকে তাকাল। ‘আপনি কি আমাকে বলবেন, দোতলার ওই ঘরটাতে আসলে কী ঘটেছে? কেন আপনার বাবা-মা দরজায় এত বড় একটা তালা লাগিয়েছিলেন? একটা বিছানা ছাড়া আর কিছুই ছিল না ঘরে। তালা ভাঙার পর তারা এত উদ্বিগ্ন হয়েছিলেন কেন? ঘরের ভেতরে কাউকে আটকে রাখা হয়েছিল? কাকে আটকে রাখা হয়েছিল? কেন?’ 

স্যামসা ভাবল, যদি কাউকে ওখানে আটকে রাখা হয়ে থাকে, তাহলে সেটা অবশ্যই সে নিজে। কিন্তু তার বাবা-মা তাকে কেন আটকে রেখেছিল? 

‘আমার ধারণা এ বিষয়ে আপনাকে জিজ্ঞাসা করে কোনো লাভ নেই। ঠিক আছে। আমাকে এখন যেতে হবে। দেরি হয়ে গেলে, আমার পরিবারের বাকি সবাই আবার আমাকে নিয়ে চিন্তায় পড়বে। আমার জন্য দোয়া করবেন যেন নিরাপদে বাড়ি পৌঁছাতে পারি। সৈন্যরা যেন আমার মতো কুঁজো একটা মেয়ের দিকে নজর না দেয়।’ 

‘আমি আপনার জন্য দোয়া করব।’ স্যামসা বলল। যদিও তার কোনো ধারণা ছিল না দোয়া ব্যাপারটা ঠিক কী জিনিস। 

মেয়েটা তার কালো রঙের ব্যাগটা তুলে নিল। 

‘আবার নিশ্চয়ই আমাদের দেখা হবে?’ স্যামসা শেষবারের মতো তাকে জিজ্ঞেস করল। 

‘আপনাকে ভাবতে হবে। আপনি যদি কাউকে অনেক বেশি ভাবেন, তাহলে তার সাথে নিশ্চয়ই দেখা হবে।’ 

‘বাইরের পাখিগুলোর দিকে খেয়াল রাখবেন। আপনাকে হয়তো ঠুকরে খেয়ে ফেলবে।’ 

মেয়েটা স্যামসার দিকে তাকাল। যেমন করে মানুষ কোনো অবুঝ শিশুর দিকে তাকায়। তারপর রাস্তার দিকে এগিয়ে গেল। 

স্যামসা পর্দার ফাঁক দিয়ে দেখল মেয়েটা কুঁজো শরীরটা নিয়ে খুব দ্রুততার সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছে। সে আবিষ্কার করল, তার যৌনাঙ্গ এখন আর স্ফীত নেই। আগের মতো নরম এবং সংকুচিত অবস্থায় ফিরে গেছে। দুপায়ের মধ্যে ঝুলছে সেটা, যেন একটা অপাপবিদ্ধ ফল। তার অণ্ডকোষ গর্তের ভেতর ঢুকে গেছে। গাউনটা শরীরে ঠিকভাবে চাপিয়ে সে ডাইনিং টেবিলে বসল এবং ঠান্ডা কফির বাকিটুকু খেয়ে ফেলল এক চুমুকে। 

এটা যাদের বাড়ি, তারা অন্য কোথাও গেছে। সে তাদের পরিচয় জানে না। তবে অনুমান করে নিতে পারে, তারা তার পরিবার ছিল। হঠাৎ নিশ্চয়ই কিছু একটা ঘটেছে যে কারণে তাদের চলে যেতে হয়েছে। সম্ভবত তারা আর কখনো ফিরে আসবে না। 

‘পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে’এই কথাটার কী অর্থ হতে পারে? এ সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই স্যামসার। সৈন্য, চেকপোস্ট, কামান, উঁচু-নিচু রাস্তা, ঈশ্বর সবকিছুই তার কাছে অসম্ভব রহস্যময় বলে মনে হলো। 

তার কাছে এখন শুধু একটাই সত্য আছে। তা হলো, সে কুঁজো মেয়েটাকে আবার দেখতে চায়। তার মুখোমুখি বসে গল্প করতে চায়, পৃথিবীর ধাঁধাগুলো একসঙ্গে সমাধান করতে চায়। মেয়েটি কীভাবে শরীরটাকে মোচড় দেয়, সেই গোপন রহস্য জানতে চায়। সম্ভব হলে, সে তার হাত দিয়ে মেয়েটার শরীর স্পর্শ করবে। সম্ভব হলে তাকে পাশে রেখে সে হাঁটবে, পৃথিবীর ধুলোমাখা পথ মাড়াবে। 

মেয়েটার ভাবনায় তার শরীরটা আবার গরম হয়ে উঠল। 

ঠিক তখনই তার মনে হলো মানবজনম খুব একটা খারাপ নয়। তার আর সূর্যমুখী ফুল অথবা মাছ অথবা অন্য কিছু হতে ইচ্ছে হলো না। একটা মানুষ হতে পেরে সে যথেষ্ট আনন্দ বোধ করল। 

চোখ বন্ধ করে স্যামসা অনেকক্ষণ বসে রইল। তারপর উঠে দাঁড়াল। তাকে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মনে হচ্ছে এখন। হাতের লাঠিটা শক্তভাবে আঁকড়ে ধরে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল। 

সে দোতলায় ফিরে যাবে এবং সেখানে অনেক কিছু শিখবে। কীভাবে ঠিকঠাক পোশাক পরতে হয়, সেটা দিয়ে শুরু করবে। অন্তত এখন থেকে এটাই হবে তার পরবর্তী লক্ষ্য। 

পৃথিবীর পাঠশালা তার জন্য অপেক্ষা করছে। 

সে শিখবে।





অনুবাদক পরিচিতি
আলভী আহমেদ
ঢাকায় থাকেন।
চলচ্চিত্রকার। অনুবাদক। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

3 মন্তব্যসমূহ