অনুবাদ : উৎপল দাশগুপ্ত
মেলানির ব্রেকফাস্টের ট্রে পাঠিয়ে দিয়ে, স্কারলেট প্রিসিকে মিসেজ় মীডের কাছে পাঠাল। তারপর ওয়েডকে নিয়ে নিজে ব্রেকফাস্ট করতে বসল। তখনই অনুভব করল যে ওর একটুও খিদে নেই। মেলানির বাচ্চা হবার সময় এগিয়ে আসার মানসিক দুশ্চিন্তা আর কামানের আওয়াজ শোনার জন্য কান খাড়া করে রাখার চেষ্টায়, খাবার ইচ্ছেটাই চলে গেল। হৃদস্পন্দন কখনও স্বাভাবিক আবার কখনও এত দ্রুত চলতে লাগল, আর পেটের মধ্যে কেমন একটা গুলিয়ে ওঠা ভাব। খাবারটা গলা দিয়ে নামতেই চাইছিল না – খাবার আর কফি এত বিস্বাদ আগে কখনোই লাগেনি। চিনি আর দুধের সরের অভাবে, কফিটা খুব তেতো লাগছিল, জোয়ারের দানা দিয়ে মিষ্টি করার চেষ্টা করেও স্বাদটা ভাল করা যাচ্ছিল না। একটু চেষ্টা করে, কাপটা সরিয়ে রাখল। ইয়াঙ্কিদের ঘেন্না করার একটা বিশেষ কারণ হল, ওদের জন্য ওকে সত্যিকারের কফি আর চিনি আর তার ওপর পুরু করে দুধের সর থেকে বঞ্চিত থাকতে হচ্ছে।
ওয়েড শান্ত ভাবেই খাচ্ছিল, অন্যদিনের মত এই বিস্বাদ খাবারের জন্য কোনরকম অভিযোগ না করেই। চামচে করে স্কারলেট ওর মুখের মধ্যে খাবার ঢুকিয়ে দিচ্ছিল, আর ও চুপচাপ জল দিয়ে গিলে ফেলছিল। বড় বড় বাদামি চোখ মেলে বার বার মায়ের দিকে তাকাচ্ছিল। শিশুসুলভ বিহ্বল চাউনি থেকে ওর মনের ভেতরে জমে থাকা আতঙ্ক ফুটে উঠছিল। খাওয়া হয়ে গেলে স্কারলেট ওকে বাড়ির পেছনের উঠোনে খেলার জন্য পাঠিয়ে দিল। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে দৌড়ে ঘরের পেছনে ওর খেলার জায়গায় ছুটে চলে গেল।
স্কারলেট সিঁড়ির নীচে খানিকটা দোলাচল মন নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ওপরে উঠে গিয়ে মেলানির পাশে বসে গল্প করে আসন্ন অগ্নিপরীক্ষা থেকে ওর মন ঘুরিয়ে রাখা দরকার। কিন্তু ওর কেমন যেন অসহায় বোধ হল। এত দিন পড়ে থাকতে, আজই কি না মেলানির বাচ্চা হওয়ার দরকার পড়ল! আর এত দিন থাকতে আজই কি না ওকে মরে যাবার কথা বলতে হল!
সিঁড়ির শেষ ধাপে বসে পড়ে মনে মনে নিজেকে একটু শান্ত করে নিতে চাইল। কাল লড়াইতে কি হল সেটা ভাববার চেষ্টা করল, আজকের লড়াইতে কি হতে চলেছে – সেটাও। ঘরের এত কাছে এত বড় একটা যুদ্ধ চলছে – অথচ কিছুই জানা যাচ্ছে না! পীচট্রী খাঁড়ির যুদ্ধের তুলনায় শহরের একেবারে শেষপ্রান্তের এই নীরবতা – কি আশ্চর্য না! আন্ট পিটির বাড়ি অ্যাটলান্টা শহরের উত্তর দিকে প্রায় শেষ সীমানায়, আর যুদ্ধ চলছে দক্ষিণ দিকে। কুচকাওয়াজ করে সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে যাবার আওয়াজ নেই, অ্যাম্বুলেন্সের আওয়াজ নেই, আহত সৈন্যদের হেঁটে হেঁটে ফেরার আওয়াজ নেই। তাহলে কি এই সব এখন শহরের দক্ষিণ দিকেই ঘটছে? ভাগ্য ভাল, ও এখন ওখানে নেই। যদি মীডস আর মেরিওয়েদার বাদে অন্যরা পীচট্রীরএই উত্তর দিক ছেড়ে পালিয়ে না যেতেন! নিজেকে খুব পরিত্যক্ত আর একা লাগল। আঙ্কল পীটার থাকলে অন্তত হেডকোয়ার্টারে গিয়ে খবর নিয়ে আসতে পারত! মেলানি ভাল থাকলে, ও নিজেই এখনি শহরে গিয়ে খবর নিয়ে আসতে পারত। মিসেজ় মীড না আসা পর্যন্ত ও এখান থেকে নড়তে পারবে না। মিসেজ় মীড! কিন্তু উনি এখনও এলেন না কেন? আর প্রিসি? সেই বা কোথায় গেল?
উঠে বাইরে এসে সামনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে অধৈর্যভাবে ওঁদের প্রতীক্ষা করতে লাগল। মীডদের বাড়ি রাস্তার মোড় থেকে ঘুরে গিয়ে একটা ছায়াঘেরা কোনে। ও কাউকেই দেখতে পেল না। অনেক পরে প্রিসিকে দেখতে পেল। কিন্তু একলা আসছে। স্কার্টটাকে এদিক ওদিক ঘুরিয়ে কেমন লাগে দেখতে দেখতে।
“আরে তুই তো কেঁচোর থেকেও আস্তে আস্তে হাঁটছিস,” প্রিসি গেট খলতেই স্কারলেট ধমক লাগাল। মিসেজ় মীড কি বললেন? কখন এখানে আসবেন?”
“উনি বাড়ি ছিলেন না,” প্রিসি জবাব দিল।
“কোথায় গেছেন? বাড়ি কখন ফিরবেন?”
“ব্যাপার হল ম্যাডাম,” কথাগুলোকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেবার জন্য খুব সময় নিয়ে বলল, “কুকির কাছে শুনলাম মিসেজ় মীড সকাল হতে না হতেই বেরিয়ে গেছেন। ওঁর ছেলে মিস্টার ফিল মীড গুলি লেগে গুরুতর আহত হয়েছেন। তাই বুড়ো ট্যালবট আর বেটসিকে নিয়ে ঘোড়ার গাড়ি করে ওঁকে বাড়ি আনতে গেছেন। কুকি বলল যে আঘাত বেশ গুরুতর – মিসেজ় মীড আজ এখানে এসে উঠতে পারবেন না।”
স্কারলেট হতবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইল। মনে হল ওকে খুব করে নেড়ে দেয়। খারাপ খবর আনতে পারলে এই নীগ্রোগুলো খুব খুশি হয়।
“ঠিক আছে – বোকার মত সময় নষ্ট করিস না। তুই মিসেজ় মেরিওয়েদারের কাছে গিয়ে ওঁকে আসতে বল, কিংবা ওঁর ম্যামিকে পাঠাতে বল।”
“ওঁরাও নেই, মিস স্কারলেট। ফেরার পথে ওঁর ম্যামির সাথে গল্প করার জন্য ওখানে থেমেছিলাম। বাড়ি তালাবন্ধ। ওঁরা কোথাও গেছেন। মনে হয় হাসপাতালে।”
“ও, এই জন্যই তোর এত দেরি হল! কতবার তোকে বলেছি না, তোকে কোথাও পাঠালে কারো সাথে গল্প করার জন্য কোথাও দাঁড়াবি না! এখন ___”
বলতে বলতে চুপ করে গেল। শহরে আর কে এমন আছে যে ওদের সাহায্য করতে পারে? মিসেজ় এলসিংএর নাম মনে এল। উনি অবশ্য ওকে একেবারে দুচক্ষে দেখতে পারেন না, কিন্তু মেলানিকে খুবই ভালবাসেন।
“তুই বরং মিসেজ় এলসিংএর কাছে যা। গুছিয়ে সব ব্যাপারটা বলে ওঁকে এখানে আসতে অনুরোধ কর্। আর একটা কথা মনে রাখ। মিস মেলির বাচ্চা আসার সময় হয়ে গেছে। তাই তোকে ওর যে কোন সময় দরকার পড়তে পারে। তাই যাবি আর সোজা ফিরে আসবি, বুঝলি?”
“আচ্ছা ম্যাডাম,” বলে ঘুরে দাঁড়িয়ে খুব হেলতে দুলতে চলতে শুরু করল।
“তাড়াতাড়ি যা, কুঁড়ে কোথাকার!”
“হ্যা ম্যাডাম।”
প্রিসি গতি বাড়াতেই স্কারলেট ঘরে ফিরে এল। ওপর তলায় মেলানির ঘরে যাবার আগে আবার একটু দ্বিধা করল। মিসেজ় মীড কেন আসতে পারলেন না সেটা ওকে বোঝাতে হবে। ফিল মীডের গুরুতর আঘাত পাওয়ার খবরে ও হয়ত মুষড়ে পড়বে। নাহ্ ওকে অন্য কিছু বানিয়ে বলতে হবে।
মেলানির ঘরে ঢুকে দেখল ব্রেকফাস্ট ট্রে যেমনকার তেমন পড়ে আছে, মেলানি ছুঁয়েও দেখেনি। এক পাশ ফিরে শুয়ে আছে, ওর মুখ ফ্যাকাসে।
“মিসেজ় মীডকে হাসপাতালে চলে যেতে হয়েছে,” স্কারলেট বলল। তবে মিসেজ় এলসিং আসছেন। তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে?”
“খুব একটা না,” মেলানি মিথ্যে করে বলল। “আচ্ছা স্কারলেট ওয়েডের জন্ম হতে কতক্ষণ লেগেছিল?”
“কোন সময়ই লাগেনি,” স্কারলেট মুখে একটা উচ্ছ্বল ভাব ফুটিয়ে বলল, যদিও মনের মধ্যে উচ্ছ্বলতার কোন অনুভুতিই ওর ছিল না। “আমি তো উঠোনে ছিলাম। ঘরে চলে আসবার সময়ই পাইনি। ম্যামি বলেছিল – ঠিক নীগ্রোদের যেমন হয়ে থাকে – এটা নাকি খুবই লজ্জার কথা !’
“আমারও যেন নীগ্রোদের মতই তাড়াতাড়ি হয়ে যায়,” বলে মেলানি ম্লান হাসবার চেষ্টা করল, কিন্তু ব্যথায় মুখটা কুঁকড়ে গেল পরের মুহুর্তেই।
স্কারলেট মেলানির ক্ষীণ শরীরের দিকে তাকিয়ে খুব একটা ভরসা পেল না, তবু মুখে সাহস জুগিয়ে বলল, “ওটা এমন কিছু চিন্তার ব্যাপার না।”
“আমিও জানি – ব্যাপারটা এমন কিছু না – আসলে – আসলে আমি একটু ভীতু কিনা! মিসেজ় এলসিং এখুনি আসছেন তো?”
“হ্যা এসে পড়লেন বলে,” স্কারলেট বলে উঠল। “যাই নীচে গিয়ে স্পঞ্জ আর জল নিয়ে আসি। তোমাকে একটু মুছিয়ে দিই। আজ যা গরম!”
জল ভরতে যত বেশি সময় লাগানো যায় স্কারলেট লাগাল। দুমিনিট পর পর সামনের দরজার কাছে দৌড়ে গিয়ে প্রিসি ফিরল কিনা দেখতে লাগল। কিন্তু প্রিসির দেখা নেই। অগত্যা ও জল নিয়ে ওপরতলায় চলে গেল, মেলানির ঘামে ভেজা শরীর স্পঞ্জ দিয়ে মুছিয়ে দিল। তারপর ওর লম্বা চুল চিরুনি দিয়ে আঁচড়ে দিল।
প্রায় এক ঘন্টা বাদে নীগ্রো পা ঘসটে চলা্র আওয়াজ পেল। জানলা দিয়ে দেখল প্রিসি খুব মন্থর গতিতে ফিরছে। সেই আগের মত এদিক ওদিক ঘাড় হেলিয়ে, স্কার্ট দুলিয়ে – যেন এক ঘর দর্শকের সামনে ও কিছু পরিবেশনে ব্যস্ত।
“একদিন আমি ওটাকে খুব কসে চাবুক লাগাব,” স্কারলেট খুব হিংস্রভাবে ভাবল, তারপর ওর মুখোমুখি হবার জন্য সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেল।
“মিস এলসিং হাসপাতালে চলে গেছেন। কুকি বলল আজ ভোরবেলার ট্রেনে অনেক জখম সৈন্য এসেছে। কুকি স্যুপ তৈরি করছে ওখানে নিয়ে যাবার জন্য। ও বলল ----“
“চুলোয় যাক ও কি বলল,” স্কারলেট বাধা দিয়ে বলল – ওর বুক ঢিপ ঢিপ করতে শুরু করেছে। “একটা পরিষ্কার অ্যাপ্রন পরে নে – কারণ তোকে হাসপাতালে যেতে হবে। তোকে ডঃ মীডকে দেবার জন্য একটা চিরকুট লিখে দিচ্ছি। আর উনি না থাকলে ওটা ডঃ জোন্স বা অন্য কোন ডাক্তারকে দিবি। আর এবার যপদি তাড়াতাড়ি না করিস তো আমি তোর চামড়া খুলে নেব, মনে রাখিস!”
“আচ্ছা ম্যাডাম।”
“আর এদের কাউকে লড়াইতে কি হচ্ছে জিজ্ঞেস করবি। ওঁরা যদি কিছু বলতে না পারেন, তাহলে ডিপোতে গিয়ে ইঞ্জিনিয়াররা যাঁরা জখম সৈন্যদের নিয়ে এসেছেন, তাঁদের জিজ্ঞেস করবে। জেনে নিবি লড়াইটা জোন্সবোরো কিংবা তার ধারেকাছে হচ্ছে কি না।”
“হে ভগবান, মিস স্কারলেট!” প্রিসির কালো চোখে মুখে হঠাৎ ভয়। “ইয়াঙ্কিরা টারায় চলে এসেছে, সত্যি?”
“আমার জানা নেই। তোকে খবর নিতে বলছি।”
“হে ভগবান, মিস স্কারলেট! তাহলে ওরা মায়ের কি অবস্থা করবে?”
এই বলে প্রিসি চেঁচিয়ে কান্নাকাটি জুড়ে দিল। তাতে স্কারলেটের মনেও অস্বস্তি বেড়ে গেল।
“এই চুপ! চেঁচাস না। মিস মেলানি শুনতে পেয়ে যাবে। যা অ্যাপ্রন বদলে নে- তাড়াতাড়ি!”
তাড়া খেয়ে প্রিসি বাড়ির পেছন দিকে চলে গেল। স্কারলেট তখন তাড়াহুড়ো করে জেরাল্ডের শেষ চিঠির এক কোনে একটা নোট লিখল – এটাই বাড়িতে অবশিষ্ট একমাত্র কাগজ। ওর লেখা নোটটা যাতে সবথেকে ওপরে থাকে, সেই ভাবে ভাঁজ করতে গিয়ে ওর জেরাল্ডের লেখাটা চোখে পড়ল – ‘তোমার মা – টাইফয়েড – কোন অবস্থাতেই – বাড়ি আসবে না __” ও প্রায় ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেলল। মেলানির জন্য না হলে – এই মুহুর্তেই ও বাড়ি চলে যেত – যদি পুরো রাস্তা হেঁটে যেতে হত – তবুও।
এক হাতে চিঠিটা শক্ত করে ধরে, প্রিসি দুলকি চালে বেরিয়ে যেতেই স্কারলেট ওপর তলায় ফিরে গেল, মিসেজ় এলসিং-এর না আসার কারণ হিসেবে একটা বিশ্বাসযোগ্য মিথ্যে মেলানিকে কি বলা যেতে পারে ভাবতে ভাবতে। অবশ্য মেলানি কিছু জানতে চাইল না। চিৎ হয়ে বিছানায় শুয়ে – ওকে খুব শান্ত আর মিষ্টি দেখাচ্ছে। স্কারলেট একটু নিশ্চিন্ত বোধ করল।
ও পাশে বসে পড়ে এলোমেলো কথা চালাতে শুরু করল। কিন্তু টারার কথা আর ইয়াঙ্কিদের চিন্তা নিষ্ঠুরভাবে মনে এসে ভিড় করতে লাগল। এলেনের কথা মনে হতে লাগল – আর ইয়াঙ্কিদের অ্যাটলান্টায় এসে খুন, বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া এই সব কথা। তার মধ্যেই দূর থেকে ভেসে আসা মৃদু গর্জন যখনই ওর কানে ঢুকছিল, তখনই এক রাশ ভয় ওর মনকে আচ্ছন্ন করে ফেলছিল। একটু পরেই ও কথা বলার উৎসাহ হারিয়ে ফেলল। জানলার বাইরে নিস্তব্ধ ঊষ্ণ রাস্তার দিকে আর নিষ্কম্প গাছ আর পাতার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। মেলানিও চুপচাপ ছিল। শুধু মাঝে মাঝেই যন্ত্রণায় ও কুঁকড়ে উঠছিল।
প্রত্যেকবার ব্যথাটা অনুভব করার পরে বলে উঠছিল, “তেমন কিছু ব্যথা নয়, সত্যি বলছি।” স্কারলেট জানত ও মিথ্যে কথা বলছে। মনে মনে ভাবল মুখ বুজে সহ্য করার থেকে ও যদি চেঁচামেচি করত তাহলেই একটু হালকা মনে হত। বুঝতে পারছিল মেলানির জন্য ওর দুঃখ পাওয়া উচিত, কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও মনের মধ্যে একটুকুও সহানুভূতি জাগিয়ে তুলতে পারল না। নিজের দুঃখই ওকে কাতর করে ফেলেছিল। একবার মেলানির ব্যথাজর্জর মুখের দিকে তাকিয়ে স্কারলেটের হঠাৎ মনে হল এত লোক পড়ে থাকতে ওকেই কেন এই মুহুর্তে মেলানির সঙ্গে থাকতে হচ্ছে যখন কিনা মেলানির সাথে কোনো ব্যাপারেই ওর মিল নেই, বলতে গেলে ও মেলানিকে ঘৃণাই করে এমনকি ও মরে গেলেই ও খুশি হয়! হয়ত আজ দিন ফোরানোর আগেই ওর ইচ্ছেপূরণ হয়ে যাবে! একথা মনে হতেই ওর মন যুক্তিহীন একটা ভয়ে ছেয়ে গেল। কাউকে অভিশাপ দেওয়ার মতই, কারও মৃত্যু কামনা করাও পাপ। অভিশাপ ফিরে আসে, ম্যামি বলে থাকে। তাড়াতাড়ি করে ও প্রার্থনা করতে লাগল, যেন মেলানির মৃত্যু না হয়, আর তারপরেই, ওর সঙ্গে এলোমেলো কথা বলতে শুরু করল, কি বলছে কিছু না ভেবেই। শেষমেশ মেলানি নিজের ঊষ্ণ হাত স্কারলেটের কব্জির ওপর রাখল।
“কথা বলার জন্য অত ব্যস্ত হোয়ো না সোনা। আমি জানি তুমি কতটা চিন্তায় আছ। আমি তোমাকে এত কষ্ট দিচ্ছি – আমার এত খারাপ লাগছে, কি বলব!”
স্কারলেট চুপ করে গেল, কিন্তু নিশ্চিন্ত মনে বসে থাকতে পারছিল না। ডাক্তার কিংবা প্রিসি যদি ঠিক সময়ে এসে না পৌঁছাতে পারে তাহলে ও কি করবে? জানলার ধারে গিয়ে একবার রাস্তার দিকে তাকিয়ে আবার ফিরে এসে বসে পড়ল। তারপর আবার উঠে ঘরের অন্য দিকের জানলার বাইরে তাকাল।
দেখতে দেখতে ঘন্টা দুয়েক কেটে গেল। সূর্য মাথার ওপরে উঠতেই, দুপুরে গরমের হল্কা চলতে লাগল। হাওয়ার চলাচল নেই। গাছের একটা পাতাও নড়ছে না। মেলানির ব্যথাও ক্রমে বেড়ে চলেছে। ওর লম্বা চুল ভিজে স্যাঁতস্যাঁত করছে। শরীরের ঘামে ভেজা জায়গাগুলোতে ওর গাউনটা সেঁটে গিয়েছে। স্কারলেট নীরবে ওর মুখে স্পঞ্জ করে দিল, কিন্তু মনে মনে ভয় ক্রমাগতই বেড়ে চলেছে। হে ভগবার, বাচ্চাটা যদি ডাক্তার আসার আগেই চলে আসে! কি করে সামলাবে ও? ধাত্রীর কাজে ও তো নিরেট মূর্খ। এরকমই একটা সঙ্কটকালীন পরিস্থিতির ভয় ও গত কয়েক সপ্তাহ ধরেই করে এসেছে। যদি একান্তই কোন ডাক্তার না পাওয়া যায়, ও প্রিসির ওপরই ভরসা রাখছে। ধাত্রীর কাজ প্রিসি ভালই জানে। সেটা তো ও নিজের মুখেই বলেছে কতবার। কিন্তু প্রিসি কোথায়? এখনও এলো না কেন? ডাক্তারই বা এলেন না কেন? আবার জানলার কাছে ছুটে গিয়ে দেখল। একটু কান পেতে শুনল। এটা কি ওর মনের ভুল না কি সত্যি, অনেক দূরে যেন কামানের গর্জনের আওয়াজ পাওয়া গেল, তারপরেই আবার মিলিয়ে গেল! যদি আরও দূরে হয়, তার মানে লড়াই এখন জোন্সবোরোর কাছে আর তার মানে ---
অবশেষে ও প্রিসিকে দেখতে পেল। রাস্তা ধরে তাড়াতাড়ি আসছে। ও জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দিল। প্রিসি মুখ তুলে ওকে দেখতে পেয়ে মুখ খুলে চেঁচাতে গেল। ওর কালো মুখে আতঙ্কের ছাপ দেখে ওর মনে হল চেঁচিয়ে কোন দুঃসংবাদ দিলেই মেলানি ভয় পেয়ে যাবে। ও ঠোঁটে আঙ্গুল দিয়ে ওকে চুপ থাকতে বলে জানলার কাছ থেকে সরে এল।
“তোমার জন্য একটু ঠাণ্ডা জল নিয়ে আসি,” মেলানির কালি পড়া চোখের দিকে তাকিয়ে একটু হাসি টেনে এনে বলল। দরজাটা আস্তে করে টেনে দিয়ে ও তাড়াতাড়ি ঘরে ছেড়ে বেরিয়ে গেল।
প্রিসপাচ্ছিল।হলে শেষ ধাপে বসে হাঁপাচ্ছিল।
“মিস স্কারলেট, ওরা জোন্সবোরতে লড়াই করছে! ওরা বলল, আমাদের লোকেরা হেরে যাচ্ছে। হে ভগবান! মিস স্কারলেট, মা আর পোকের কি হবে? হে ভগবান! মিস স্কারলেট! ইয়াঙ্কিরা এখানে এসে পড়লে আমাদের কি হবে? হে ভগবান ____”
স্কারলেট হাত দিয়ে ওর মুখটা চেপে ধরল।
“দোহাই তোর! একটু চুপ কর!”
সত্যিই তো ইয়াঙ্কিরা এসে পড়লে ওদের কি হবে – টারার কি হবে? জোর করে ও মন থেকে চিন্তাটাকে দূরে সরিয়ে দিয়ে আশু সঙ্কটের কথা ভাবতে শুরু করল। ওই সব চিন্তা বেশিক্ষণ করলে ও প্রিসির মতই চেঁচিয়ে উঠবে।
“ডঃ মীড কোথায়? কখন আসবেন?
“আমি ওঁর দেখা পাইনি, মিস স্কারলেট।”
“কি বললি!”
“না ম্যাম, উনি হাসপাতালে নেই। মিস মেরিওয়েদার কিংবা মিস এলসিংও ওখানে ছিলেন না। একটা লোক আমাকে বললেন যে ডাক্তার কারশেডে জোন্সবোরো থেকে আসা জখম সৈন্যদের সাথে রয়েছেন। কিন্তু কারশেডে ওঁর কাছে যেতে আমার ভয় করল, মিস স্কারলেট – ওখানে লোকজন মারা যাচ্ছে – মরা লোক দেখতে আমার ভয় করে ___”
“আর অন্য ডাক্তাররা?”
“দিব্বি কেটে বলছি, মিস স্কারলেট, আপনার লেখা ওই চিঠিটা আমি কোনও ডাক্তারকে পড়াতে পারিনি। ওঁরা হাসপাতালে পাগলের মত কাজ করে চলেছেন। একজন ডাক্তার আমাকে দেখে বললেন, ‘চুলোয় যা তুই! খবর্দার তুই আমাকে বাচ্চা বাচ্চা করে বিরক্ত করবি না! দেখছিস না এখানে কত লোক মরতে বসেছে! তোর সাথে হাত লাগাবার জন্য অন্য কোনও মেয়েকে ডেকে নে।’ তারপর আপনার কথা মত আমি খবর জানতে চলে গেলাম। ওরা বলল যে জোন্সবোরোতে লড়াই চলছে আর ___”
“ডঃ মীড ডিপোতে আছেন বললি না?”
“হ্যা ম্যাম। উনি ___”
“এখন যা বলছি শোন। আমি ডঃ মীডকে আনতে চললাম। আমি চাই যে তুই মিস মেলানির পাশে বসে থাকবে আর ও যে রকম বলবে সেরকম করবে। তুই যদি মুখ ফসকে একবারও কোথায় যুদ্ধ চলছে সেটা ওকে বলার চেষ্টা করিস, তাহলে আমি তোকে বিক্রি করে ছাড়বই! আর অন্য ডাক্তাররাও যে আসতে পারবেন না, সেটাও বলবি না। শুনতে পেয়েছিস?”
“হ্যা ম্যাম।”
“নে চোখ মুছে ফেল, আর এক বালতি জল নিয়ে ওপরে যা। ওর গা মুছিয়ে দে। বলবে যে আমি ডঃ মীডকে আনতে গেছি।”
“ওঁর কি সময় এগিয়ে এসেছে?”
“জানি না। তবে মনে হয় তাই। কিন্তু আমি ঠিক জানিনা। তোরই তো জানার কথা। যা ওপরে যা।”
স্কারলেট ওর চওড়া স্ট্র-হ্যাটটা টেবিলের ওপর থেকে তুলে নিয়ে মাথার ওপর বসিয়ে চেপে দিল। আয়নায় দেখে খোলা চুলগুলো ওপরে ঠেলে দিল, কিন্তু নিজের চেহারার দিকে আর নজর দিল না। ভয়ের একটা শীতল অনুভুতি পেটের ভেতর থেকে উঠে বাইরে ছড়িয়ে পড়ছিল। গালে ঠাণ্ডা আঙ্গুলের স্পর্শ লাগল, কিন্তু ভেতরে ভেতরে ঘেমে যাচ্ছিল। তাড়াহুড় করে বাড়ি থেকে রোদ্দুরে বেরিয়ে পড়ল। রোদের তাপ প্রচণ্ড। পীচট্রী স্ট্রীট দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে গরমে ওর কপাল দপ দপ করতে লাগল। দূর থেকে অনেকের কথার আওয়াজ আর চীৎকার ভেসে আসছে। যখন লেডেন হাউসটা দেখতে পেল, তখন ও রীতিমত হাঁপাচ্ছে। পোশাকটা টাইট করে বাঁধা থাকা সত্ত্বেও ও চলার গতি কম করেনি। এবারে আওয়াজটা আরও অনেক বেশি জোরে পাওয়া গেল।
লেডেন হাউস থেকে ফাইভ পয়েন্ট পর্যন্ত রাস্তায় একটা উইয়ের ঢিবি তখন তখনই গুঁড়িয়ে যাওয়ার জন্য ব্যস্ততা। নীগ্রোরা ভয়ে রাস্তার ওপর দৌড়াদৌড়ি করছে। বারান্দায় সাদা শিশুদের দিকে নজর দেবার না থাকায় কান্নাকাটি জুড়ে দিয়েছে। রাস্তা জুড়ে সেনাবাহিনীর ওয়াগন আর অ্যাম্বুলেন্স ভর্তি জখম লোক আর গাড়ির ওপর ডাঁই করা জিনিসপত্র আর আসবাবপত্র। পাশের রাস্তা দিয়ে ঘোর-সওয়ারীরা পড়ি কি মরি করে হুডের হেডকোয়ার্টারের দিকে ছুটে চলেছে। বনেল হউসের সামনে বুরো অ্যামোস ঘোড়ার লাগাম হাতে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। স্কারলেটকে দেখে খুশি হয়ে অভিবাদন জানাল।
“আপনি এখনও যাননি, মিস স্কারলেট? আমরা এখন যাচ্ছি। বুড়ি মিস জিনিসপত্র গোছাচ্ছেন।”
“যাচ্ছ? কোথায়?”
“ভগবান জানেন, মিস! কোথাও না কোথাও! ইয়াঙ্কিরা এসে পড়ল বলে!”
বিদায় না নিয়েই ও এগিয়ে গেল। ইয়াঙ্কিরা এসে পড়ল বলে! পেসলি চ্যাপেলের কাছে এসে একবার দম নেবার জন্য দাঁড়াল। বুকের উথাল-পাতালকে একটু সামলে নেবার জন্য। শান্ত না হতে পারলে ও নিশ্চিত অজ্ঞান হয়ে পড়বে। ল্যাম্পপোস্ট ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে একজন অফিসারকে ঘোড়ায় চড়ে ফাইভ পয়েন্টের দিকে ছুটে যেতে দেখল। তাৎক্ষণিক এক তাড়নায় ও রাস্তা পেরিয়ে ছুটে গিয়ে ওঁকে হাত দেখাল।
“এই যে শুনছেন! একটু থামুন প্লীজ!”
এমন অতর্কিতে ওঁকে লাগামের রাশ টানতে হল যে ঘোড়াটা টাল সামলাতে না পেরে ্পেছনে ধাক্কা খেল। অফিসারের চোখেমুখে ক্লান্তির ছাপ সুস্পষ্ট। তবুও তিনি সঙ্গে সঙ্গে মাথা থেকে শতছিন্ন হ্যাটটা একটানে খুলে নিলেন।
“হ্যা ম্যাডাম?”
“আমাকে বলুন তো, এটা কি সত্যি? ইয়াঙ্কিরা কি এসে পড়েছে?”
“ঠিকই বলছেন।”
“আপনি কি জেনে বলছেন?”
হ্যা, ম্যাডাম। আমি জেনেই বলছি। আধঘন্টা আগে হেডকোয়ার্টারে খবর এসে পৌঁছেছে – জোন্সবোরোতে লড়াই চলছে।”
“জোন্সবোরোতে? সত্যি বলছেন?”
“সত্যি বলছি। আর মন ভোলানো মিথ্যে বলে কোন লাভ নেই ম্যাডাম। খবরটা এসেছে জেনারাল হার্ডির কাছ থেকে, আর ওতে বলা হয়েছেঃ ‘আমি যুদ্ধে হেরে গেছি। এখন আমি পুরোদমে পশ্চাদাপসরণ করছি।’
“হে ঈশ্বর!”
ক্লান্ত মানুষটা মুখ নিচু করে রেখেছিলেন। সেখানে কোন আবেগই প্রকাশ পাচ্ছিল না। আবার লাগাম তুলে নিয়ে যাবার জন্য প্রস্তুত হলেন।
“স্যর, এক মিনিট। আমরা কি করব?”
“ম্যাডাম, আমি বলতে পারছি না। খুব শীগগিরই সেনাবাহিনী অ্যাটলান্টা খালি করা শুরু করবে।”
“আমাদের ইয়াঙ্কিদের হাতে ছেড়ে দিয়ে ওরা চলে যাবে?”
“আমার তো সেরকমই মনে হচ্ছে।”
ছাড়া পেয়ে ঘোড়াটা যেন লাফাতে লাফাতে এগিয়ে গেল। এক হাঁটু লাল ধুলো নিয়ে স্কারলেট রাস্তার মাঝখানে একা দাঁড়িয়ে রইল।
ইয়াঙ্কিরা এসে পড়েছে। সেনাবাহিনী চলে যাচ্ছে। ইয়াঙ্কিরা এসে পড়েছে! ও কি করবে? ও কোথায় পালিয়ে যাবে? না, ও পালিয়ে যেতে পারবে না। মেলানি বিছানায় পড়ে আছে, বাচ্চার হবার জন্য। কেন যে মেয়েদের বাচ্চা হয়? মেলানি না হলে ওয়েড আর প্রিসিকে নিয়ে ও জঙ্গলে লুকিয়ে পড়ত। ইয়াঙ্কিরা ও্দের কখনোই খুঁজে পেত না। কিন্তু মেলানিকে তো ও জঙ্গলে নিয়ে যেতে পারবে না। অন্তত এখন তো নয়ই। যদি বাচ্চাটা আগেই হয়ে যেত – গতকালও – তাহলেও অন্তত একটা অ্যাম্বুলেন্সে করে ওদের কোথাও গোপন জায়গায় লুকিয়ে ফেলতে পারত। কিন্তু এখন – ওকে ডঃ মীডকে পেতেই হবে আর বাড়ি নিয়ে যেতে হবে। হয়ত উনি বাচ্চাটা তাড়াতাড়ি হইয়ে দিতে পারবেন।
আবার ও পোশাক সামলে রাস্তা দিয়ে দৌড়াতে লাগল। পায়ে তালে তালে মনের মধ্যে “ইয়াঙ্কিরা এসে পড়েছে! ইয়াঙ্কিরা এসে পড়েছে!” এই কথাগুলো অনুরণিত হতে থাকল। ফাইভ পয়েন্ট লোকে লোকারণ্য। লোকজন কিছু না দেখেই এদিক ওদিক ছোটাছুটি করছে। ওয়াগন, অ্যাম্বুলেন্স, বলদটানা গাড়ি আর ঘোড়ার গাড়ি ভর্তি জখম সৈন্যে পথ জুড়ে রয়েছে। চারদিকে সমুদ্রের গর্জনের মত আওয়াজ উঠছে।
হঠাৎ একটা অদ্ভুত বেমানান দৃশ্য ওর চোখে পড়ল। রেলপথের দিক থেকে এক দঙ্গল মহিলা কাঁধে করে হ্যাম নিয়ে আসছে। ওদের পাশে পাশে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা গরম আখের রসের বালতি নিয়ে টলমল পদক্ষেপে চলছে। কম বয়সী ছেলেরা আলু আর শস্যের বস্তা টানতে টানতে নিয়ে আসছে। একজন বৃদ্ধ ভদ্রলোক ময়দার একটা ছোট্ট পিপে ঠেলাগাড়িতে চাপিয়ে খুব কষ্টেসৃষ্টে টেনে নিয়ে চলেছেন। কালো, সাদা, মহিলা, পুরুষেরা সবাই খুব ক্লান্তি সহকারে খাবারের বাক্স আর বস্তা নিয়ে চলেছে – এত খাবার স্কারলেট গত এক বছরে চোখে দেখেনি। হঠাৎ জনতা রাস্তার দুদিকে সরেগিয়ে একটা ঘোড়ার গাড়ি যাবার জায়গা করে দিল। মিসেজ় এলসিং-এর আভিজাত্যপূর্ণ কিন্থু ভঙ্গুর চেহারা দেখা গেল – নিজের ভিক্টোরিয়ার সামনের দিকে লাগাম হাতে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। মাথায় হ্যাট নেই। মুখটা ফ্যাঁকাসে, লম্বা বাদামি চুল পিঠের ওপর নেমে এসেছে। ঘোড়াকে খুব জোরে জোরে চাবুক কষাচ্ছেন। গাড়ির পেছনের বসার জায়গায় মেলিসি – ওঁর ম্যামি – লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছে। ওর এক হাতে বেকনের চর্বি লাগানো দিকটা ধরা আর অন্য হাত আর দু’পা দিয়ে মেঝেতে চারদিকে ছড়িয়ে থাকা বাক্স আর বস্তা কোনমতে সামলে রেখেছে। একটা শুকনো মটরশুঁটির বস্তা ফেটে গিয়ে রাস্তার চারধারে গড়িয়ে পড়ছে। স্কারলেট ওঁর দিকে তাকিয়ে চেঁচাল। কিন্তু চারদিকের কোলাহলে ওর কথা উনি শুনতে না পেয়ে গাড়ি নিয়ে এগিয়ে গেলেন।
প্রথমে ও বুঝতেই পারছিল না এসব কি হচ্ছে – তারপর মনে পড়ল যে কমিসারির গুদাম রেলপথের ধার দিয়েই রয়েছে। বুঝতে পারল ইয়াঙ্কিরা চলে আসার আগেই ওই গুদাম খুলে দেওয়া হয়েছে যাতে যেটুকু আছে সেটা বাঁচানো যায়।
ভিড়ের ভেতর দিয়ে রাস্তা করে ও তাড়াতাড়ি এগিয়ে ফাইভ পয়েন্টের খোলা জায়গায় এল। তারপর যত দূর সম্ভব পা চালিয়ে ডিপোর দিকে চলল। অ্যাম্বুলেন্সের জট আর ধুলোর ঝড়ের মধ্যে দিয়ে ডাক্তারদের আর স্ট্রেচার-বাহকদের নীচু হয়ে তাড়াতাড়ি রুগী তোলা নামানোয় ব্যস্ত দেখতে পেল। হে ভগবান, যেন আমি তাড়াতাড়ি ডঃ মীডকে খুঁজে বের করতে পারি! অ্যাটলান্টা হোটেলের বাঁকটাতে পৌঁছে ও ডিপোর আশেপাশের আর রেলপথের দৃশ্য ভাল করে দেখার সুযোগ পেল। একটা দৃশ্য দেখে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে গেল।
প্রখর রৌদ্রের মধ্যে রেলপথের ধারে কারশেডের তলায় গাদাগাদি করে কাতারে কাতারে জখম মানুষকে শুইয়ে রাখা হয়েছে। কেউ কেউ একদম নড়াচড়া করছে না আবার কেউ কেউ রোউদ্রের তাপ সহ্য না করতে পেরে মোচড় দিয়ে উঠছে আর আর্তনাদ করছে। লোকগুলোর ওপর মাছি ভনভন করছে। মুখের ওপর আর ক্ষতস্থানের রক্তের ওপর বসছে। চারদিকে শুধু রক্ত আর নোংরা ব্যান্ডেজের ছড়াছড়ি। স্ট্রেচার বাহকরা যাকে তুলে নিচ্ছে সে যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে উঠছে। চারদিকে শুধু রক্ত আর ঘামের গন্ধে ওর গা বমি বমি করতে লাগল। অ্যাম্বুলেন্সের লোকেরা ছোটাছুটি করতে করতে মাঝে মাঝে আহত লোকগুলোকে মাড়িয়ে চলে যাচ্ছে। উপায় নেই, কারণ এমন গাদাগাদি করে ওদের শুইয়ে রাখা হয়েছে যে চলার পথই নেই। যাদের ওপর দিয়ে ওরা চলে যাচ্ছে তারা অবিচলভাবে নিজেদের পালার প্রতীক্ষা করছে।
গা গুলিয়ে উঠতেই একটু পিছিয়ে এল স্কারলেট, হাত দিয়ে নাকে চাপা দিল, মনে হল যেন বমি হয়ে যাবে। কি করে এগোবে? হাসপাতালে জখম লোক কম দেখেনি। খাঁড়ির লড়াইয়ের পরে আন্ট পিটির লনেও অনেক জখম লোককে পড়ে থাকতে দেখেছে। কিন্তু এরকম বীভৎস অবস্থা কখনও দেখেনি। গনগনে রোদের তলায় এমন বীভৎস রক্তাক্ত, পুতিগন্ধময় জখম লোক আগে দেখতে হয়নি। যেন এক দুঃসহ ব্যথা যন্ত্রনা আর আর্তনাদের নরক। আর তাড়া! এই ছোট .... ছোট ... ইয়াঙ্কিরা এসে পড়ল বলে! ইয়াঙ্কিরা ধরে ফেলল বলে!
তারপর একটু সাহস সঞ্চয় করে, ওদের মধ্য দিয়ে এগিয়ে গেল। দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের ভিড়ে নজর চালিয়ে ডঃ মীডের খোঁজ করতে লাগল। একটু পরেই বুঝতে পারল ব্যাপারটা বেশ কঠিন। একটু খেয়াল না করলেই, বেচারা কোন শুয়ে থাকা সৈন্যকে মাড়িয়ে দেবে। স্কার্টটা দুহাতে একটু তুলে ধরে স্মনে কতগুলো মানুষের জটলা দেখে সাবধানে এগিয়ে গেল। ওঁরা স্ট্রেচার-বাহকদের নির্চেশ দিচ্ছিলেন।
যেতে যেতে কেউ একজন উত্তপ্ত হাত দিয়ে ওর স্কার্টটা চেপে ধরে গুঙিয়ে বলল, “ম্যাডাম – একটু জল! দোহাই ম্যাডাম একটু জল! ভগবানের দোহাই – একটু জল!”
স্কার্টটা লোকটার হাত থেকে ছাড়াতে গিয়ে ওর ঘাম বেরিয়ে গেল। যদি এদের কোনও একজনকেও মাড়িয়ে দেয় তাহলে ও চীৎকার করে অজ্ঞান হয়ে যাবে। মৃতের পাহাড় পেরিয়ে ও চলল – যারা চোখ উলটে পড়ে আছে – যাদের পেটের কাছে রক্ত জমাট বেঁধে আছে – অনেকের দাড়িতে রক্ত শুকিয়ে গিয়ে শক্ত হয়ে গেছে, অনেকের ভাঙ্গা চোয়াল থেকে অস্ফূট গোঙানি ভেসে আসছে, নিশ্চয়ই “জল, জল” বলে চলেছে!
ডঃ মীডকে আর একটুক্ষণের মধ্যে খুঁজে না পেলে ও চিন্তায় পাগল হয়ে যাবে। একটা গাড়ি রাখবার ছাউনির তলায় কিছু লোককে দেখতে পেয়ে ও যত জোরে পারে চিৎকার করে ডাকলঃ
“ডঃ মীড! ডঃ মীড কি ওখানে আছেন?”
জটলার থেকে একজন মানুষ বেরিয়ে এসে ওর দিকে তাকালেন। ডাক্তার। গায়ে কোট নেই। শার্টের হাতা ঘাড় অবধি গুটিয়ে রাখা। একজন কসাইয়ের থেকেও নোংরা লাগছে ওঁর শার্ট আর প্যান্ট। এমনকে ওঁর ধূসর দাড়িতেও রক্ত মাখামাখি। ক্লান্তির ভারে মুখটা থম থম করছে। সঙ্গে নিষ্ফল রাগ আর বেদনা। ফ্যাঁকাসে গাল বেয়ে ঘাম ঝরে পড়ছে। কিন্তু কথা বললেন খুব শান্ত স্বরে।
“ঈশ্বর করুণাময় যে তুমি এখানে এসেছ। প্রত্যেকে হাতই আমার কাজে আসবে।”
এক মুহুর্তের জন্য ও বিহ্বল হয়ে ওঁর দিকে তাকাল। নিরাশায় স্কার্টটা থেকে হাত ছেড়ে দিল। একজন জখম সৈন্যের ময়লা মুখের ওপর পড়ল সেটা। লোকটা দূর্বল ভাবে মাথা নাড়িয়ে কাপড়ের ভাজগুলোর থেকে মুখটা সরানোর চেষ্টা করতে লাগল। ডাক্তার কি বলতে চাইছেন? অ্যাম্বুলেন্স থেকে শুকনো ধুলো উড়ে এসে ওর মুখে পড়ল। নাকের মধ্যে পচা গন্ধ ভেসে এল।
“তাড়াতাড়ি কর সোনা! এখানে চলে এস।”
আবার স্কার্টটা দুহাতে তুলে ধরে, ফেলে রাখা শরীরগুলো ডিঙিয়ে যত তাড়াতাড়ি পারল ডাক্তারের কাছে চলে গেল। ওঁর বাহুতে হাত রেখে দেখল, ক্লান্তি আর দূর্ভাবনায় সেটা কাঁপছে, কিন্তু মুখে তার ছাপ নেই।
“ওহ ডাক্তার, আপনার আসার দরকার। মেলানির বাচ্চা হবে!”
উনি এমন ভাবে ওর মুখের দিকে তাকালেন যে মনে হল ওঁর মাথায় কিছুই ঢোকেনি। ওর পায়ের কাছে জলের বোতলের ওপর মাথা রেখে শুয়ে থাকা এক ব্যক্তি ওর কথা শুনে অমায়িক ভাবে তাকাল।
“সেটা ওরাই দেখে নেবে,” বলে হাসল।
স্কারলেট ওর দিকে তাকালই না। ও ডাক্তারের বাহু ধরে ঝাঁকানি দিল।
“মেলানির কথা বলছি। ডাক্তারবাবু – বাচ্চা, আপনাকে আসতেই হবে। ও – মানে – !” না এটা ভদ্রতা বা মার্জিত রুচি মেনে কথা বলার সময় নয়, কিন্তু কি ভাবে এতগুলো লোকের সামনে কথাটা বলবে ভেবে পেল না।
“ব্যথা খুব বেড়ে গেছে। দয়া করে চলুন ডাক্তারবাবু!”
“বাচ্চা হবে? হে ভগবান!”, ডক্টর হুঙ্কার দিলেন। হঠাৎ ওঁর মুখে ঘৃণা আর বিরক্তিতে কুঁচকে গেল। ঠিক স্কারলেটের ওপর নয়, বিশেষ কারও প্রতি নয় – বরং সারা পৃথিবীর দিকে যেখানে এরকম ব্যাপারও ঘটতে পারে। “তুমি কি পাগল হয়েছ? আমি এদের ছেড়ে যেতে পারব না। এরা শয়ে শয়ে লোক মরতে বসেছে। একটা বাচ্চার জন্ম হবে বলে আমি এদের ছেড়ে চলে যাব? কোন মহিলাকে ডেকে নাও তোমাকে সাহায্য করার জন্য। আমার স্ত্রীকে বল।”
ও বলতে যাচ্ছিল কেন মিসেজ় মীড আসতে পারবেন না, তারপর আর বলল না। উনি জানেনই না যে ওঁর ছেলেও জখম হয়েছে! যদি উনি জানতে পারেন তাহলেও কি উনি এদের ছেড়ে যাবেন না, স্কারলেট মনে মনে ভাবল। তারপরেই মনে হল যদি ফিল মৃত্যুমুখেও থাকে তাহলেও ডাক্তার এদের ছেড়ে যাবেন না, যাতে উনি কেবল একজনের বদলে অনেককে সাহায্য করতে পারেন।
“না ডাক্তারবাবু আপনাকে আসতেই হবে। আপনিই বলেছিলেন, ওর বিপদের সম্ভাবনা রয়েছে ____” এই সব অস্বস্তিকর কথাবার্তা – সে কি ওর মুখ দিয়েই বেরোচ্ছে – এতগুলো লোকের সামনে যারা ব্যথায় যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে – তাও আবার রীতিমত চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে রোদের হলকার মধ্যে দাঁড়িয়ে– স্কারলেট কিছুতেই বিশ্বাস করতেই পারছিল না। “আপনি না গেলে ও বাঁচবে না!”
খুব রুক্ষভাবে ওর হাতটা কাঁধের ওপর থেকে সরিয়ে দিলেন। কথা বললেন এমনভাবে যেন ওর কথা উনি শুনতেই পাননি – যেন ও কি বলছে সেটা যেন ওঁর জানাই নেই।
“মরে যাবার কথা বলছে? হ্যা, ওরা সবাই মরে যাবে – এই এখানে যত লোক দেখছ। কোন ব্যান্ডেজ নেই, কোন ওষুধ নেই, কুইনিন নেই, ক্লোরোফর্ম নেই। হে ভগবান শুধু যদি একটু মর্ফিয়া পেতাম – কেবল অবস্থা যাদের সব থেকে খারাপ – তাদের জন্য। শুধু একটু ক্লোরোফর্ম। হে ভগবান! ইয়াঙ্কিরা নিপাত যাক! নিপাত যাক ইয়াঙ্কিরা!”
“ওদের নরকে যেতে দিন ডাক্তারবাবু!” মাটিতে পড়ে থাকা লোকটি বলল – দাড়ির ভেতর দিয়ে ওর দাঁত দেখা যাচ্ছে।
স্কারলেট ভয়ে কাঁপতে শুরু করল আর চোখে জল এসে গেল। ডাক্তারবাবু ওর সাথে আসছেন না। মেলানি মরে যাবে, আর ও চেয়েছিল মেলানি যেন মরে যায়। ডাক্তারবাবু আসছেন না।
ঈশ্বরের দোহাই, ডাক্তারবাবু, দয়া করুন!”
ডঃ মীড ঠোঁট কামড়ে ধরলেন। চোয়াল একটু শক্ত হয়ে উঠল। তারপর আবার শান্ত হয়ে গেলেন।
লক্ষ্মী মেয়ে, আমি চেষ্টা করব। কিন্তু কথা দিতে পারছি না। তবে চেষ্টা করব। যখন এই লোকগুলোর একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। ইয়াঙ্কিরা আসছে আর সৈন্যদল শহর ছেড়ে যাচ্ছে। এই সব জখম লোকদের দিয়ে কি করতে পারবে – আমি জানি না। কোনও ট্রেনও নেই। ম্যাকন লাইন দখল হয়ে গেছে .... তবুও আমি চেষ্টা করব। এখন পালাও। আমাকে ব্যতিব্যস্ত কোরো না। বাচ্চা হওয়ানোয় এমন কিছু হাতি ঘোড়া নেই। শুধু কর্ডটাকে বেঁধে দিতে হবে ____”
একজন আর্দালি এসে ওঁকে ধরতেই উনি ঘুরে গেলেন। তারপর এদিক ওদিকে আঙ্গুল দেখিয়ে কি করতে হবে তার নির্দেশ দিতে লাগলেন। মাটিতে শুয়ে থাকা লোকটা স্কারলেটকে নিবিড়ভাবে দেখতে লাগল। স্কারলেট ফিরে চলল, ডাক্তার ওর কথা বেমালুম ভুলে গেছেন।
জখম লোকদের মাঝখান দিয়ে তাড়াতাড়ি রাস্তা করে নিয়ে ও আবার পীচট্রী স্ট্রীটে ফিরে এল। ডাক্তারবাবু আসছেন না। যা কিছু করার ওকে নিজেকেই করতে হবে। তবু ভাগ্য ভাল যে প্রিসি ধাত্রীর কাজ ভাল করেই জানে। রোদের তেজে ওর মাথা ধরে গেছে, ঘামে ভিজে ওর জামাকাপড় সপসপ করে গায়ে সেঁটে গেছে। মাথা কোনও কাজ করছে না, পাদুটোও। যেন কোনও দুঃস্বপ্নের মধ্যে ও দৌড়াতে চাইছে, কিন্তু পারছে না। বাড়ি পৌঁছাতে কতখানি হাঁটতে হবে ভেবেই মনে হল সে পথ যেন অন্তহীন।
“ইয়াঙ্কিরা আসছে” কথাটা আবার মনের মধ্যে তালে তালে ভাসতে লাগল। বুক দুরুদুরু করে উঠল, পায়ে যেন আবার নতুন করে জোর পেল। ফাইভ পয়েন্টের ভিড়ে ও মিশে গেল। এখন ভিড় এতই বেশি যে ফুটপাথে উঠে হাটার জো নেই। অতত্যা ও রাস্তা ধরেই কোনমতে এগোতে লাগল। ধুলোমাখা, ঘামে ভেজা, ক্লান্ত সৈন্যরা যাচ্ছে। হাজারে হাজারে, মুখে দাড়ির জঙ্গল, গায়ে ময়লা এঁটে বসা, কাঁধে বন্দুক ঝোলানো – ওরা রাস্তা ধরে তাড়াতাড়ি এগিয়ে যাচ্ছে। কামান গড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, হাড় জিরজিরে খচ্চরগুলোকে পাতলা চামড়ার চাবুক চালিয়ে খেদিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ছেঁড়া তেরপলে ঢাকা কমিসারি ওয়াগনগুলো এবড়ো-খেবড়ো রাস্তা দিয়ে লাফাতে লাফাতে চলছে। অগুনতি অশ্বারোহী একের পর এক ধুলো উড়িয়ে ছুটে চলেছে। স্কারলেট আগে কখনও এত সৈন্য একসাথে দেখেনি। দূর হটো! তফাৎ যাও! জওয়ানরা শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছে!
ত্বরিতগতিতে সারবেঁধে চলা জওয়ানদের ধাক্কায় ও ফুটপাথের ভিড়ের মধ্যে ছিটকে পড়ল। শস্যদানা থেকে তৈরি সস্তার হুইস্কির গন্ধ ওর নাকেএসে লাগল। ডিক্যাটুর স্ট্রীটের কাছে এই জনসমুদ্রে মুখে রঙ-চঙ মাখা জমকালো পোশাক পরা অনেক মহিলাও মিশে রয়েছে। ফলে কেমন যেন বেমানান একটা ছুটি ছুটি ভাব। অনেকেই মাতাল অবস্থায় রয়েছে, আর যেসব সৈন্যের বাহুবন্ধনে ওরা লেপটে আছে তাদের নেশা আরও চড়া। এরই মধ্যে এক ঝলক একটা লাল-চুলো মাথা নজরে এল – বেল ওয়াটলিং নামে সেই আজব চিড়িয়া একজন একহাতওয়ালা সৈন্যকে জড়িয়ে ধরে তীক্ষ্ণস্বরে মাতালের মত হেসে চলেছে।
কোনক্রমে জনসমুদ্র ঠেলে জায়গা করে ফাইভ পয়েন্টের বলক পেরিয়ে এল তখন ভিড় একটু হালকা হয়েছে। পোশাক দুহাতে সামলে নিয়ে ও ছুটতে শুরু করল। ওয়েসলে চ্যাপেলের কাছে যখন পৌছাল, তখন ওর দম ফেটে যাবার জোগাড়, মাথা ঘুরছে আর গাটা গুলিয়ে উঠছে। গির্জার সিঁড়ির একটা ধাপের ওপর বসে পড়ে দুহাতে মাথাটা চেপে ধরে শ্বাসপ্রশ্বাস একটু স্বাভাবিক হতে দিল। যদি ও পেটভরে একটা গভীর শ্বাস নেবার সুযোগ পেত! যদি বুকের ধড়ফড় একটু কমত! এই পাগল শহরে এমন একজন যদি থাকত যার ওপর ও নির্ভর করতে পারত!
সারা জীবনে ওকে তো নিজে হাতে কুটোটাও নাড়তে হয়নি! সব সময়ই কেউ না কেউ ওর কাজ করে দেবার জন্য পাশে থাকত। ওর দেখভাল করার জন্য থাকত। ওকে আশ্রয় আর নিরাপত্তা দেবার জন্য থাকত। ওর সব রকম আবদার মেটাত। বিশ্বাস করতে মন চায় না যে ও এই রকম একটা পরিস্থিতিতে কি করে পড়ল! একজনও বন্ধু নেই, প্রতিবেশী নেই যে ওকে সাহায্য করতে পারে! অথচ কত বন্ধুই না ছিল, কত প্রতিবেশী আর হুকুম তামিল করার জন্য কত দাসদাসী! আর এখন – যখন সব থেকে বেশি প্রয়োজন – কেউ নেই! বিশ্বাস করতে মন চায় না যে ও এতটা একা, এতটা অসহায়, বাড়ি থেকে এতটা দূরে!
বাড়ি! ইয়াঙ্কিরা থাকুক চাই নাই থাকুক, যদি ও বাড়িতে থাকত! এলেন অসুস্থ থাকলেও যদি ও বাড়িতে থাকত! এলেনের মায়াবী মুখটা দেখতে পাবার জন্য ও ব্যাকুল হয়ে উঠল। ম্যামির শক্ত সামর্থ্য হাতটা যদি ওকে বেষ্টন করে থাকত! আহা!
অবশ শরীর নিয়ে দু’পায়ের ওপর আবার উঠে দাঁড়াল, চলতে শুরু করল। বাড়ির সামনে এসে দেখল ওয়েড বাইরের গেট ধরে দোল খাচ্ছে। মা কে দেখতে পেয়েই ময়লা লাগা থ্যাঁতলানো একটা আঙ্গুল দেখিয়ে মুখ কাচুমাচু করে কেঁদে ফেলল।
“ব্যথা লেগেছে,” ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলল। “ব্যথা লেগেছে।”
“চুপ! চুপ! চুপ! নইলে আমি কিন্তু মারব। যাও পেছনের উঠোনে চলে যাও আর মাটি দিয়ে খেলা কর। ওখান থেকে একদম কোথাও যাবে না।”
“ওয়েডের খিদে পেয়েছে,” ও ফোঁপাতে লাগল। তারপর ব্যথা লাগা আঙ্গুলটা মুখে পুরে দিল।
“এখন আমি কিছু করতে পারব না। তুমি পেছনের উঠোনে চলে যাও আর ____”
ওপরে মুখ তুলে তাকাতেই দেখল প্রিসি ওপরের ঘরের জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে রয়েছে – মুখ ভরা ভয় আর দুশ্চিন্তা। স্কারলেটকে দেখেই অবশ্য একমুহুর্তে সব উধাও হয়ে গেল। স্কারলেট ইশারায় ওকে নীচে নেমে আসতে বলে ঘরে ঢুকল। কি ঠাণ্ডা হলের ভেতরটা। বনেটটা খুলে ফেলে টেবিলের ওপর ছুঁড়ে দিল। হাত দিয়ে কপালের ঘাম মুছে ফেলল। ওপরের দরজা খোলার শব্দ হতেই একটা মৃদু গোঙানির আওয়াজ পেল – যেন অসহ্য যন্ত্রণার ভেতর থেকে উঠে আসছে। প্রিসি এক সঙ্গে তিন তিন ধাপ সিঁড়ি লাফিয়ে লাফিয়ে নেমে এল।
“ডাক্তার এসেছেন?”
“না উনি আসতে পারবেন না।”
“হে ভগবান, মিস স্কারলেট! মিস মেলির অবস্থা খুব খারাপ!”
“ডাক্তার আসতে পারবেন না। কেউই আসতে পারবেন না। তোকেই প্রসব করাতে হবে। আমি তোকে সাহায্য করব।”
প্রিসির মুখ ঝুলে পড়ল। ওর মুখ দিয়ে কোন কথা বেরোলো না। আড়চোখে স্কারলেটের দিকে তাকিয়ে পা টেনে পাতলা শরীরটা মুচড়ে ফেলল।
“ওরকম হাঁদার মত তাকাস না,” স্কারলেট ওর ভাবভঙ্গী দেখে রেগে গেল। “তোর হল টা কি?”
প্রিসি সিঁড়ির কয়ে ধাপ ওপরে উঠে গেল।
“হে ভগবান, মিস স্কারলেট ___” ওর দুচোখে ভয় আর লজ্জা।
“বল্।”
“ভগবানের দোহাই মিস স্কারলেট – একজন ডাক্তার আমাদের খুব দরকার! আমি – মিস স্কারলেট – আমি প্রসব করানোর ব্যাপারে কিছুই জানি না! মা আমাকে কখনও ওখানে যেতে দেয়নি।”
স্কারলেটের মনে হল যেন ওর নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গেল। রেগে যাবার আগের মুহুর্তে ভয় ওকে একেবারে গ্রাস করে ফেলল। প্রিসি পালিয়ে যাবার চেষ্টা করতেই স্কারলেট ওকে ধরে ফেলল।
“রাম মিথ্যুক – কি বলতে চাস তুই? তুই সব সময় আমাকে বলে এসেছিস যে বাচ্চা হওয়ানোর ব্যাপারে তুই সব জানিস! সত্যিটা আসলে কি? তোকে বলতেই হবে!” ওকে ঝাঁকাতে লাগল যতক্ষণ না ওর কোঁকড়া চুলওয়ালা মাথাটা মাতালের মত দুলতে লাগল।
“মিথ্যে বলেছিলাম, মিস স্কারলেট! জানি না কেমন করে এমন মিথ্যে বললাম। একটা বাচ্চা হওয়া দেখে ফেলেছিলাম – তাই মা আমাকে খুব বকে দিয়েছিল।”
স্কারলেট ওর দিকে কটমট করে তাকাল, প্রিসি ভয় সিঁটিয়ে নিজেকে ছাড়ানোর চেহটা করতে লাগল। সত্যিটা মেনে নিতে এক মুহুর্তের জন্য ওর মনে দ্বিধা দেখা গেল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যখন বুঝতে পারল যে ধাত্রীবিদ্যায় ওর থেকে প্রিসির জ্ঞান কোন অংশেই বেশি নয়, তখন ও রাগে জ্বলে উঠল। জীবনে কোন দাস-দাসীর গায়ে ও কখনও হাত তোলেনি, কিন্তু এখন ওর ক্লান্ত হাতে যত জোর ছিল তাই দিয়ে ওই কালো গালে সপাটে একটা চড় কষিয়ে দিল। প্রিসি উচ্চৈঃস্বরে কেঁদে উঠল – ব্যথার থেকেও বেশি ভয়ে – স্কারলেটের হাত ছাড়িয়ে নেবার জন্য ছটফট করতে লাগল।
ওর চেঁচিয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে দোতলা থেকে আসা মৃদু গোঙানি বন্ধ হয়ে গেল। তারপর মেলানির দুর্বল কাঁপা কাঁপা গলা পাওয়া গেল, “স্কারলেট নাকি? একবার এস, প্লীজ়!”
স্কারলেট প্রিসির হাত ছেড়ে দিতেই মেয়েটা ঘ্যানঘ্যান করতে করতে সিঁড়ির ওপর বসে পড়ল। স্কারলেট এক সেকেণ্ড দম নিল। গোঙানির আওয়াজ – যেটা বন্ধ হয়েছিল – সেটা আবার শুরু হয়ে গেছে। স্কারলেটের মনে হল ওর কাঁধে কেউ বিশাল ভারী একটা জোয়াল লাগিয়ে দিয়েছে। এক পা এগোলেই ও সেই ভারটা যেন বুঝতে পারবে।
মনে করার চেষ্টা করল ওয়েডের জন্মের সময় এলেন আর ম্যামি ওর জন্য কি কি করেছিলেন। কিন্তু সেই সময় ব্যথার মধ্যে সে সব কথা আর ওঁদের গতিবিধি যেটুকু দেখেছিল সবই যেন কেমন ধোঁয়াশার মত মনে হল। কিছু কিছু ব্যাপার ওর অবশ্য মনে পড়ল, আর সেটা মনে আসতেই প্রিসিকে দৃঢ়স্বরে নির্দেশ দিয়ে দিল।
“স্টোভ জ্বালিয়ে কেতলিতে জল গরম বসিয়ে দে। বাড়িতে যত তোয়ালে পাবি সব নিয়ে আয়। আর সুতোর গুলিটা নিয়ে আসবি। কাঁচিটাও নিয়ে আসবি। এটা পাচ্ছিনা, ওটা পাচ্ছিনা এসব আমি একদম শুনতে চাইনা। ওগুলো তাড়াতাড়ি নিয়ে আয়। নে পা চালিয়ে যা!”
প্রিসিকে টেনে মেঝে থেকে তুলে ধাক্কা দিয়ে রান্নাঘরের দিকে পাঠিয়ে দিল। নিজেকে একটু সামলে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে লাগল। প্রিসি আর ও মিলেই যে মেলানির বাচ্চা প্রসব করাবে, সেটা বলাটাই শক্ত।
--চলমান
0 মন্তব্যসমূহ