র‍্যাচেল কাস্ক'এর গল্প : পরিণাম



অনুবাদঃ মোহাম্মদ আসাদুল্লাহ


‘জীবনের চাকা উল্টোদিকে ঘুরে গিয়েছিলো।’

সম্প্রতি আমার স্বামী ও আমি পৃথক হয়ে যাই। ফলে মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই আমাদের সারাজীবনভর গড়ে তোলা সংসার ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। পরিণত হয় জিগস (jigsaw)-ধাঁধার পৃথক করা অংশগুলো দিয়ে তৈরি স্তুপের মতো। মাঝেমধ্যেই জিগস এর ম্যাট্রিক্সগুলোকে ছবিতে শনাক্ত করা সম্ভব হয় না, যা নিয়ে শ্রেষ্ঠ জিগস তৈরিকারীরা গর্বও অনুভব করে থাকেন। তবে আমি জানি যে, ছবির পৃষ্টদেশের খাঁজগুলোতে যখন আলো পড়ে, তখন শুধুমাত্র দূর থেকেই ছবিকে সম্পূর্ণ বলে মনে হয়। কাছ থেকে নয়।

আমার ছোট মেয়ে জিগস নিয়ে খেলতে ভালোবাসে। বড় মেয়েটা জিগস পছন্দ করে না। সে তাস দিয়ে ঘর তৈরি করে। এই সময়ে সে চায় চারপাশের সবাই নিশ্চুপ ও স্থির হয়ে থাকুক। আমি এই কাজগুলোর প্রত্যেকটিকেই ভিন্ন ভিন্নভাবে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার প্রয়াস বলে মনে করি। তবে আমি এটাও বুঝতে সক্ষম যে, অসহিষ্ণুতার বিভিন্ন রকমের আকৃতি রয়েছে এবং দুই বোনের কাজের মধ্যে পদ্ধতিগত পার্থক্য থাকলেও তারা দুজনেই মূলত স্থিরতা বা স্থৈর্য অর্জন করার চেষ্টা করছে। আমি এটাও জানি যে, আমার মেয়েরা পদ্ধতিগত পার্থক্যের বিষয়টিকেই বেশী গুরুত্বের সাথেই দেখে থাকে। কারণ, তারা উভয়েই পরস্পর বিরোধী প্রবণতাকে অপছন্দ করে। প্রকৃতপক্ষে, তারা ভিন্ন ধরণের কাজ দিয়ে নিজেদের যুক্তিকে প্রতিষ্ঠা করতে চায়।

আমার ধারণা, যুক্তি হলো নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার নিমিত্তে একটি তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া। আমি অনেক সময়েই বিস্মিত হয়ে ভাবি যে, এটা আধুনিক পারিবারিক জীবনের কোন ফাঁদ কিনা, যেটার ভিত্তি নিজের আনন্দময়তা ও অপ্রতিষ্ঠিত আশাবাদ,এবং কোনক্রমেই যা ঈশ্বরবাদ বা অর্থনীতি নির্ভর নয়। বরং ভালোবাসার নীতির উপরে প্রতিষ্ঠিত, যা সত্যকে মিথ্যা হতে আলাদা করতে বেশীরভাগ সময়েই অকৃতকার্য হয়ে থাকে। এবং এই অবস্থা হতে পরিত্রাণ পেতেই মানুষের যুদ্ধের প্রয়োজন হয়ে থাকে।

আমার স্বামীর নিকট হতে আলাদা হয়ে যাবার পর প্রথমদিকের সপ্তাহগুলোতে আমি ‘নতুন বাস্তবতা’ এই শব্দগুচ্ছ শুনতে পেতাম। এটি দিয়ে পরিপার্শ্বের লোকজন আমার পরিস্থিতিকে বর্ণনা করতো। এমনভাবে, যেন তারা আমার উন্নতিকে উপস্থাপন করছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা ছিলো আমার জন্যে অবনতি। আসলে আমার জীবনের চাকা উল্টোদিকে ঘুরে গিয়েছিলো। আকস্মিকভাবে আমরা দুজনেই তখন পশ্চাতের দিকে ধাবিত হচ্ছিলাম, সামনের দিকে নয়। আমাদের যাত্রা শুরু হয়েছিলো বিশৃঙ্খলা ও ইতিহাসের দিকে; অতঃপর সেখান থেকে প্রাগৈতিহাসিক কাল অতিক্রম করে সৃষ্টির আদি, এমনকি তারও পূর্বের কালের দিকে, যখন ঈশ্বরের সৃষ্টি প্রক্রিয়াই শুরু হয়নি।

প্লেট মেঝেতে পড়ে যাবার পর ভাঙন নামের নতুন বাস্তবতার আবির্ভাব হয়। আমাকে সেই সময়ে প্রতিনিয়ত এই ধরণের নতুন নতুন বাস্তবতার সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে হচ্ছিলো। শুধু আমি নই, আমার দুই কিশোরী মেয়েকেও নতুন বাস্তবতার সংগে খাপ খাইয়ে নিতে হচ্ছিলো। তবে আমার দৃষ্টিতে সেটা নতুন কোন বাস্তবতা ছিল না। যতদূর দেখতে পেতাম, তাতে সেটা শুধুমাত্রই ভাঙন ছিলো। এই ভাঙ্গন তার সৃষ্টির পর থেকে তার উদ্দেশ্যকে ক্রমশ পূরণ করছিলো। কিন্তু পূর্ণভাবে নয়। খন্ডিত অংশ হিসেবে। আমার মনে হতো যে, খন্ডিত অংশগুলোকে পরস্পরের সাথে সেঁটে দেয়া না গেলে, সেগুলোর কোন মূল্যমানই থাকবে না।

আমার স্বামী বিশ্বাস করতেন যে, আমি তার সাথে ভয়ানক খারাপ আচরণ করেছি। তার এই বিশ্বাস থেকে তাকে নড়ানোর কোন উপায় ছিল না। তার পুরো পৃথিবীই আবর্তিত হচ্ছিলো এই চিন্তাকে কেন্দ্র করে। এটা ছিল তার ‘গল্প’। এবং বিলম্বে হলেও গল্পের প্রতি আমার একটা ঘৃণা জন্মে গিয়েছিলো। কেউ যদি আমাকে জিজ্ঞেস করতো কোন দুর্যোগের ফলে আমার জীবনের এই অধঃপতন, তবে আমি তাদেরকে উল্টো জিজ্ঞেস করতাম, তারা কি শুনতে চায়, গল্প, নাকি সত্য? ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আমি তাদেরকে বলতাম যে, আনুগত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিজ্ঞা এক্ষেত্রে ভঙ্গ করা হয়েছে।

আমি এটাও ব্যাখ্যা করতাম যে, একটা উপন্যাস লেখার সময়ে ভুল হয়ে গেলে সেটা ভেঙে পড়ে। সেটাকে আর এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না। তখন আমাদেরকে পেছনে ফিরে যেতে হয়, দেখার জন্যে যে, উপন্যাসের নকসাতে কোন ত্রুটি ছিল কিনা। ত্রুটি বা সমস্যাটা সাধারণত থাকে গল্প ও সত্যের সম্পর্কের মধ্যে। গল্পকে অবশ্যই সত্যকে মেনে চলতে হবে, সত্যের প্রতিনিধিত্ব করার জন্যে। যেমন করে পোশাক শরীরের প্রতিনিধিত্ব করে থাকে। এই সম্পর্ক যত গভীর হবে, ফলাফল তত আনন্দময় হবে। পোশাকহীন বা উলঙ্গ সত্য দুর্বল, অলাভজনক ও বীভৎস। অপরদিকে সেটাকে যদি অত্যধিক বেশভূষা করানো হয়, সেক্ষেত্রেও সেটা মিথ্যে হয়ে যাবে।

আমার জীবনের অসুবিধাগুলো সাধারণত নিহিত ছিল উপরে বর্ণিত দুই পরস্পরবিরোধীতাকে সমন্বয় করার প্রচেষ্টার মধ্যে। যেমন করে বিবাহবিচ্ছেদের সন্তান তার অভিভাবকদের মধ্যে সমন্বয় করার চেষ্টা করে থাকে। আমার নিজের সন্তানদের ক্ষেত্রে এটা তারা করতো আমার স্বামীর হাত আমার হাতের মধ্যে স্থাপন করে। যখন আমরা সবাই একত্রিত হতাম। তারা চেষ্টা করতো গল্পটিকে পুনরায় সত্যে পরিণত, অথবা সত্যকে অসত্যে রূপান্তরিত করতে। স্বামীর হাত ধরতে পেরে আমিও খুব খুশী হতাম। কিন্তু আমার স্বামী তা পছন্দ করতো না। এটা ছিল একটা আকৃতি (form), যা প্রত্যেকটি গল্পের ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সেই সময়ে জীবনের আকৃতিহীন সবকিছুই ছিল আমার মালিকানায়। একসাথে। কিন্তু বিষয়টা আমাকে তেমন কষ্ট দিতো না। এবং আমি কখনোই আলোড়িত হতাম না তার হাত ধরার জন্যে। শুধু মনে হতো যে, পৃথিবীতে হাত ধরার জন্যে অনেকগুলো অনুষ্ঠান থাকা উচিৎ।

কিছুদিন পর আমাদের সময় পেছনের দিকে যাওয়া বন্ধ করেছিল, যদিও ইতিমধ্যেই আমরা পেছনের দিকে অনেক চলে গিয়েছিলাম। এই পিছিয়ে যাওয়ার সপ্তাহগুলোতে যে বিষয়গুলো আমাদের আলাদা হয়ে যাওয়ার কারণ ছিল, সেগুলোর প্রত্যেকটিকেই জীবন থেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে ইতিহাসকে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনতে সমর্থ হয়েছিলাম আমরা। সন্তানদের ছাড়া আর কিছুই ফেলে দেয়ার জন্যে অবশিষ্ট ছিল না আমাদের, যা শুধুমাত্র বিজ্ঞানের হস্তক্ষেপেই করা সম্ভব ছিল। কিন্তু আমরা বিজ্ঞানেরও আগের সময়ে চলে গিয়েছিলাম। অনেকটা সপ্তম শতাব্দীর ব্রিটেনে, যখন পৃথিবীতে জাতিসত্ত্বার উদ্ভবই হয়নি। সেই সময়কার ইংল্যান্ড ছিল বিভিন্ন প্রকোষ্ঠে বিভক্ত একটি দেশ। আমার মনে আছে, স্কুলে পড়ার সময়ে ম্যাপে প্রাক-মধ্যযুগীয় ইংল্যান্ডের গোষ্ঠিভিত্তিক বিক্ষিপ্ততা দেখে আমি যারপরনাই বিস্মিত হতাম। ভাবতাম, কোন কেন্দ্রীয় শক্তি, রাজা, রাজধানী এবং প্রতিষ্ঠান - কোনকিছুই নেই কেন? শুধুমাত্র কয়েকটি অঞ্চলের নাম -মারসিয়া (Mercia), ওয়েসেক্স ( Wessex) প্রভৃতি কানে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হতো। এগুলোর মধ্যকার ঝগড়াঝাঁটি ও লাভক্ষতির বর্ণনা থেকে মনে হতো যে, সবাইকে সংঘবদ্ধ করার মতো কোন চালিকা শক্তিই ছিল না সেখানে। এই শক্তিকেই আমি শনাক্ত করেছিলাম পুরুষ (masculine) শক্তি হিসেবে।

আমাদের ক্লাসের ইতিহাসের শিক্ষিকা ছিলেন মিসেস লুইস। বিশাল দেহী ও কোমল মনের অধিকারিণী। অনেকটা ডিজনি’র এলিফেন্ট-ব্যালেরিনার মতো, যার মধ্যে স্থুলতার নীতি ও নারীত্ব পরস্পরের সাথে যুদ্ধ করছিলো একইসাথে বিকশিত হবার জন্যে। তার ধরণটা ছিলো প্রাক-মধ্যযুগীয়। অক্সফোর্ডে পড়ালেখা সম্পন্ন করে তিনি আমাদের মধ্যমমানের ক্যাথোলিক গার্লস স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেছিলেন। ধূসর বর্ণের পশমি ( beige) কাপড়ের পোশাকের সাথে হীল জুতা সমন্বয় করে পরতেন। দেখে মনে হতো হয়তো বা কোনোদিন তার গোলাপী শরীর ডাস্ট শীটগুলো (dust sheets) ভেদ করে মূর্তির মতো বের হয়ে আসবে। তার নাম থেকে তার সম্পর্কে আমরা আরেকটা বিষয় জানতাম। সেটা হলো তিনি বিবাহিতা ছিলেন। কিন্তু মিসেস লুইসের সাথে এগুলোর পারস্পারিক সম্পর্ক কি ছিলো, সে সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণা ছিলো না।

মিসেস লুইস আমাদেরকে বলতেন যে, মারসিয়ার রাজা ওফা (Offa of Mercia) সর্বপ্রথম একত্রিত ইংল্যান্ডের স্বপ্ন দেখেছিলেন, যা থেকে আমরা পুরুষালী উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে শনাক্ত করতে পারি। তিনি ওফা’র আল (Offa’s Dyke) নামের বিশাল একটি আর্থওয়ার্ক করেছিলেন, যেটি আমাদেরকে এখনো মনে করিয়ে দেয় যে, বিভক্তিও কোন কোন সময়ে একত্রীকরণের দিক বা পর্যায় হতে পারে। এইভাবে নিজেকে সংজ্ঞায়িত করার মাধ্যমে আমরা এটাও সংজ্ঞায়িত করতে পারি আমরা যা নই। তিনি আমাদেরকে জানিয়েছিলেন যে, ঐতিহাসিকেরা কখনোই একমত হতে পারেননি যে, ওফা’র আলটি আসলে কি কারণে নির্মান করা হয়েছিলো। ওয়েলস ( Welsh) দের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ হিসেবে, নাকি শুধুমাত্রই একটা সীমানা হিসেবে? মিসেস লুইস রাজা ওফা’র শক্তি সম্পর্কে পরস্পরবিরোধী ধারণা পোষণ করতেন। তিনি রাজার শক্তিকে অভিহিত করতেন সভ্যতার দিকে মানুষের যাত্রা বলে। আবার এটাও ভাবতেন যে, এর ফলে একটা ভীষণ ক্ষতি হয়েছিলো। তা হলো বৈচিত্রতার হ্রাস, যেখানে সৃষ্টির চেয়ে উদ্দেশ্যকেই বেশী প্রাধান্য দেয়া হয়ে থাকে।

মিসেস লুইস ব্যক্তিগতভাবে পছন্দ করতেন আর্লি স্যাক্সন পৃথিবীর (early Saxon world) ধারণাকে। এই ধারণা অনুযায়ী শক্তিকে পুনর্বিন্যাস করা সম্ভব নয়। তার মতে অন্ধকার যুগসমূহ ( Dark Ages) নিজেরাই ‘নতুন বাস্তবতা’র একটা ধরণ ছিলো। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলতেন রোমান সাম্রাজ্যের কথা, যা তার খন্ডিত অংশগুলোকে নিয়ে বিশাল একটা প্লেটের সৃষ্টি করেছিলো। অনেকেই এটাকে নিজেকে প্রতাপশালী ও সর্ববিজয়ী ভাবা একক শক্তির পরিণাম হিসেবে ভাবলেও মিসেস লুইস তা ভাবতেন না। তিনি পছন্দ করতেন জনহীন বিস্তীর্ণ পতিত ভূমি। পছন্দ করতেন সন্ন্যাসীদের আশ্রম, যেখানে নির্জনতার ভেতরে সৃষ্টিশীলতাকে লালন করা হয়। পছন্দ করতেন অতিন্দ্রিবাদী ও স্বপ্নদর্শী মানুষদের। পছন্দ করতেন প্রাচীন ধর্মের শিলালিপিগুলোকে। পছন্দ করতেন সেই সব নারীদেরকে, যারা সেই অপরিণত আকৃতিহীন শতাব্দীসমূহে নিজেদেরকে মর্যাদার স্তরে উন্নীত করেছিলেন। পছন্দ করতেন তৃনমূল বা ব্যক্তি পর্যায়ের উপলব্ধিগুলোকে, যাদেরকে ভিত্তি ধরে সভ্যতার মতো বিশাল প্রশাসন ছাড়াই ন্যায়বিচার ও বিশ্বাসের বিষয়গুলো সমাধা করা সম্ভব ছিলো।

তিনি বলতেন যে, আসল বিষয়টা হলো অন্ধকার। তা তাকে আমরা যে নামেই ডাকি না কেন। বলতেন যে, এই অন্ধকার ও বিশৃঙ্খলা শুধুমাত্র অস্বীকৃতি বা অনুপস্থিতির প্রতিনিধিত্ব করে না। তারা একইসাথে পরিণাম ও প্রস্তাবনাকে বিম্বিত করে থাকে। শব্দতত্ব অনুযায়ী ‘aftermath’ এর অর্থ হলো ‘second mowing’ বা দ্বিতীয় ছেদন, যার শাব্দিক অর্থ হলো ঘাসের দ্বিতীয় শস্য, যা মূল ফসল তুলে নেয়ার পর রোপণ ও কর্তন করা হয়ে থাকে। সভ্যতা, ক্রম, অভিপ্রায়, বিশ্বাস- এগুলো কখনোই অবিচল আরোহণের মধ্য দিয়ে সূর্যালোকিত শিখরে পৌঁছেনি। নির্মান করার পর তারা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিলো। পুনরায় তাদেরকে নির্মান করা হয়েছিলো এবং পুনরায় তারা আবার পতিত বা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিলো। ফলে যে অন্ধকার বা বিশৃঙ্খলা তাদেরকে অনুসরণ করছিলো, তাদেরও নিজস্ব অস্তিত্ব ও অখণ্ডতা ছিলো। তারাও সভ্যতার বাগদত্ত্বা ছিলো, যেমন করে ঘুম কাজের বাগদত্তা হয়ে অঙ্গাঙ্গীভাবে পরস্পরের সাথে জড়িয়ে থাকে। একইভাবে প্রকোষ্ঠময় জীবনেও একত্রিত হবার সম্ভাবনা রয়েছে, যেমন করে ঐক্যের পরমাণুতে বিভাজিত হবার সম্ভাবনা সুপ্ত হয়ে বিরাজ করে। মিসেস লিউ’র মতে প্রকোষ্ঠের বিশৃঙ্খলাময় অথচ সৃষ্টিশীলতার সম্ভাবনায় ভরপুর জীবনে বসবাস, সামাজিক অখণ্ডতাসম্পন্ন অথচ অনিবার্যভাবে ভঙ্গুর জীবন হতে শ্রেয়তর।

প্রতিদিন সকালে আমি আমার মেয়েদেরকে নিয়ে স্কুলে যাই এবং দুপুরের পর তাদেরকে নিয়ে ফিরে আসি। আমি তাদের রুমগুলো পরিষ্কার করি। তাদের কাপড় ইস্ত্রি ও রান্না করি। বিকেলের সময়টা আমরা একাকী ব্যয় করে থাকি। আমি তাদের হোমওয়ার্কগুলো করি। তাদেরকে খাবার দিই এবং বিছানায় রেখে আসি। কয়েকদিন পর তারা তাদের পিতার বাসায় যায়। তখন আমার বাসা খালি হয়ে যায়। প্রথমদিকে এই অন্তর্বর্তীকালগুলো আমার জন্যে সহ্য করা দুষ্কর ছিলো। তবে এখন এগুলোকে আমার কাছে পক্ষপাতশূন্য সময় বলেই মনে হয়। দৃঢ় কিন্তু শূন্য, যা শূন্যতার বিপরীতে একধরণের নিস্প্রভ অভিযোগের উন্মেষ ঘটায়। এই নির্জন প্রহরগুলো আমার কাছে যুদ্ধশেষের অবশেষের মতো। আমাকে দেয়ার বা আমার কাছ থেকে কিছুই পাবার নেই যাদের। আমার সকল দ্বন্দ্বের বিনিময়ে আমি এগুলো অর্জন করেছি। আমি এদের সাথে বাস করি। একটার পর একটার সাথে। হাসপাতালের খাবারের মতো গিলে ফেলি এদেরকে আমি।এভাবেই আমি নিজেকে বাঁচিয়ে রাখি। পর্যায়ক্রমে বিভক্তিগুলোর সাথে জীবনযাপন করার মধ্য দিয়ে। অসুস্থতাকে সারিয়ে তোলার জন্যে এবং পরিপূর্ণভাবে বেঁচে ওঠার জন্যে।

পৃথক হয়ে যাওয়ার অব্যবহিত পরের তিক্ত সপ্তাহগুলোতে আমার স্বামী আমাকে একজন নারীবাদী হিসেবে অভিহিত করতো। প্রবল বিতৃষ্ণার সাথে। বিশ্বাস করতো যে, আমি নই, আমাদের বিয়েতে সেই একজন নারীর ভূমিকা পালন করেছিলো, এবং আমি ছিলাম একজন উৎপীড়ক পুরুষ। তার চিন্তা অনুযায়ী বাজার করা, রান্না করা এবং স্কুল থেকে বাচ্চাদের আনা-নেয়া করার কাজগুলো একান্তভাবেই নারীদের কাজ। কিন্তু আমার কাছে তা মনে হতো না। এই কাজগুলো করার সময়ে আমার নিজেকে নারীসুলভ গুণবর্জিত বলে মনে হতো। এমনকি শৈশবেও যখন আমার মা এই কাজগুলো করতেন, তখনো তাকে আমার কাছে সুন্দর মনে হতো না। মনে হতো যে, এই কাজগুলো তার নারীত্বকে বিকশিত করার পরিবর্তে ধ্বংস করছে।

সেই সময়ে আমাদের পরিবার Suffolk countryside-এ একটি ফ্ল্যাটবাড়িতে বসবাস করতো। সেখানে মাকে দেখতাম প্রায় সারাক্ষণ টেলিফোনে কথা বলতে। কথা বলার সময়ে তার কণ্ঠস্বরের মধ্যে এক ধরণের ক্ষিপ্ততা খেয়াল করতাম আমি। তার উচ্চারিত শব্দগুচ্ছকে আমার কাছে অক্ষরবন্দী এবং হাসিকে মনে হতো মেকি। আমার সন্দেহ হতো যে, তিনি হয়তো বা অভিনেত্রীদের মতো অন্য কারো কন্ঠস্বর ব্যবহার করছেন। মনে হতো এই অগভীর চরিত্রের মহিলাটি আমার মা নন। তিনি একজন ছলনাময়ী। আমার মা অন্য কেউ, যার সাথে আমার কখনোই দেখা হয়নি। এমনকি তার কথাও কখনো শুনিনি।

একইসাথে মনে হতো যে, আমি আমার মায়ের একঘেয়েমি, আনন্দ বা বিরক্তির মধ্যেই আবর্তন করছি। আমার মোহাবিষ্ট দৃষ্টিতে তার ব্যক্তিত্বকে প্রকৃত বাসার ভেতরে অবস্থান করা অলিক কোন বাসার প্রতিবম্ব বলেই মনে হতো। আমার প্রকৃত মা কেমন, সেটা বোঝা আমার পক্ষে খুবই দুষ্কর ছিলো। কারণ, আমার প্রতি মায়ের মনোযোগ ছিলো মুহূর্তিক। তিনি কখনোই সরাসরি আমার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেন না। আমার সম্পর্কে তিনি যে ধারণা পোষণ করতেন তা সম্ভবত ছিল আমার সম্পর্কিত তার পূর্বজ্ঞান।

তিনি শুধুমাত্র যখন অন্যদের সাথে থাকতেন, তখন আমি তার সন্তান হিসেবে তাকে নৈর্ব্যক্তিকতার সাথে লক্ষ্য করতে পারতাম। কখনো কখনো তিনি তার নারী বান্ধবীদের নিয়ে লাঞ্চ করতেন। সেই সময়ে আমি আমার মায়ের পুরো মুখটা দেখতে পেতাম এবং তাকে নতুন করে আবিষ্কার করতাম। এই সময়ে আমি তাকে অন্য মহিলাদের সাথে তুলনা করে বের করতাম যে, তিনি তাদের চেয়ে ভালো, না মন্দ। দেখতাম অন্যেরা তাকে পছন্দ করে, নাকি ঈর্ষা করে নাকি তার দ্বারা প্রলুব্ধ হয়। এই সময়ে আমি তার নির্দিষ্ট কিছু অভ্যাসকেও শনাক্ত এবং তার মুখের ভাবকে অনুধাবন করতে পারতাম। এই সময়গুলোতে তার অন্যসময়ের ব্যক্তিত্ব, আমাদের বসবাসের জায়গা সবকিছুকেই আমার নিকটে দুর্বোধ্য বলে মনে হতো। সেগুলো ক্রমশ অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে আসতো শূন্য কোন পোড়োবাড়ির মতো। কিন্তু তার দরোজায় আঘাত করতেই তিনি আমাকে মৃদু বা কঠোর ভর্ৎসনা করে আমাকে সরিয়ে দিতেন। তার শরীর ছিলো বিশাল আকৃতির ও অসচেতনভাবে সর্বব্যাপী। মনে হতো যে, তিনি চতুর্দিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন। এই সময়ে তার আসল সত্তাও কিছুক্ষণের জন্যে নিজস্বতা হারিয়ে ফেলতো। ফলে মুহুর্তের জন্যে মনে হতো যে, তিনি একটা সত্যিকারের গল্প। সে গল্প ভালো বা মন্দ যেভাবেই বলা হোক না কেন।

তার বান্ধবীরাও সাধারণভাবে সবাই জননী ছিলেন। তবে সেই আলাপচারিতার সময়ে তাদের সবার ছদ্মবেশ খুলে পড়তো। মুখোস ও মেকআপের অন্তরাল থেকে তখন আমি কোন নগরের চারদিকে ছড়িয়ে থাকা উন্মুক্ত গ্রামগুলোকে দেখতে পারতাম। আমি হয়ত সেই গ্রামগুলোতে কখনোই প্রবেশ করতে পারতাম না, তবে আমি সেগুলোর উপস্থিতি বুঝতে পারতাম।আমার মায়ের একজন বান্ধবীর নাম ছিলো জেন। তিনি অন্যদের থেকে স্বতন্ত্র ছিলেন। সেই সময়ে আমি বুঝতে পারতাম না কেন, কিন্তু এখন বুঝি। কারণ ছিলো জেনের কোন সন্তান ছিলো না। তিনি ছিলেন একজন বিশালদেহী নারী, খুবই বুদ্ধিদীপ্ত, কিন্তু বিমর্ষ মুখের অধিকারিণী। যে কেউই চাইলে তার মুখ ও খোলা চোখের বিষন্নতার ভেতরে বেড়িয়ে আসতে পারতো।একবার আমার মা একটা চকোলেট কেক তৈরী করেছিলেন। তিনি চাচ্ছিলেন জেনকে কেকটির রেসিপি শিখাতে। কিন্তু জেন তাকে বলেছিলেন, “আমি যদি এই কেকটা তৈরি করি, তাহলে সেটাকে আমি এক বসাতেই খেয়ে ফেলবো।“ ইতিপূর্বে আমি কখনোই শুনিনি যে, একজন মহিলা কখনোই একটা পুরো কেক খেয়ে ফেলেছেন বা খেয়ে ফেলতে পারেন। বিষয়টাকে আমার কাছে ভারোত্তোলনের মতো বিশাল এক কীর্তির কাজ বলে মনে হয়েছিলো। কিন্তু আমি বুঝেছিলাম যে, আমার মা তার এই মন্তব্যকে পছন্দ করেননি।অস্পষ্টভাবে হলেও জেন তার বক্তব্যের মধ্য দিয়ে একটা সত্যকে ফাঁশ করে দিয়েছিলেন। সামাজিক দক্ষতার অভাব ও অজ্ঞতার কারণে তিনি তার নারীত্বের দেয়ালের একটি ফাটলকে উন্মুক্ত করেছিলেন। এবং এই ফাটলের মধ্য দিয়ে দেয়ালের অপর পাশে কি আছে তা আমি দেখতে পেয়েছিলাম।

জীবনের কিছু কিছু অংশ সম্পর্কে আমাদের কোন প্রাক-জ্ঞান (foreknowledge) থাকে না। উদাহরণ হিসেবে যুদ্ধের কথা বলা যেতে পারে। একজন সৈন্য জানে না সশস্ত্র শত্রুর সম্মুখীন হলে সে কি ধরণের আচরণ করবে। নিজের এই অংশ সম্পর্কে সে সম্পূর্ণ অজ্ঞ। সেকি বীর, নাকি কাপুরুষ? যখন মুখোমুখি হবে, তখন সে অবশ্যই জবাব দেবে। কিন্তু তার পরেও সে আগে থেকে জানে না যে, তার সাড়া কি হবে। টেলিফোনে আমার স্বামী আমাকে বলতো যে, সে সবকিছুরই অর্ধেক অংশীভাগ চায়। এমনকি সন্তানদের ক্ষেত্রেও। আমি বলতাম, না। সে বলতো, না বলতে তুমি কি বোঝাচ্ছ? আমি জানালার ভেতর দিয়ে বাগানের দিকে তাকাতাম। সেটি ছিলো কতগুলো শহুরে চতুর্ভূজের ভেতরে অবস্থিত একটি চতুর্ভুজ। ওটার সীমানা দিয়ে কয়েকটা বিড়াল ঘুরে বেড়াতো। শিকারের অন্বেষণে। বাগানটি ঝোপঝাড়ে পরিণত হয়েছিলো। এর বেডগুলো আগাছার নীচে ঢাকা পড়ে গিয়েছিলো। ঘাসগুলো চুলের মতো লম্বা হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু অগোছালো হওয়া সত্ত্বেও এর লোহার ঝাঁঝরিগুলোর আকৃতি অপরিবর্তিত ছিলো। এমনকি অন্য চতুর্ভূজগুলোও তাদের আগের আকৃতিতেই রয়ে গিয়েছিলো।

তুমি কোন মানুষকে অর্ধেক করে ভাগ করতে পারো না, আমি বলতাম।

তারা আমার সাথে অর্ধেক সময় থাকতে পারে, সে বলতো।

তারা আমার সন্তান, আমি বলতাম। আমার সত্ত্বার অংশ।

গ্রীক নাটকে মানুষের ভূমিকাকে ক্ষুদ্র করার মাধ্যমই ছিলো তার উপরে মৃত্যুকে আরোপ করা। প্রতিহিংসাপরায়ন মা, স্বার্থপর পিতা, খুনী সন্তান – এগুলোই ছিলো সেখানে গণতন্ত্র বা ন্যায়বিচারের পথে গমনাগমনের রক্তাক্ত পথ।

সন্তানরা আমার – এক সময়ে আমিও এই ধরণের আবেগের কঠোর সমালোচনাকারী ছিলাম। ভাবতাম এই ধর্মবিরুদ্ধ মতের সূত্রপাত কোথায়? তারা যদি আমার অংশই হবে, তাহলে আমাদের সমান অধিকারের বাসস্থানে এতদিন তারা কোথায় ছিল? কোথায় নিজেদেরকে লুকিয়ে রেখেছিলো?

আমার মা আদি ক্যাথলিকদের সম্পর্কে গল্প করা পছন্দ করতেন। তিনি বলতেন যে, তাদেরকে বাধ্য করা হতো নির্জনে উপাসনা এবং ঘরের মেঝেতে বাস করতে। তিনি ভাবতেন যে, বিশ্বাসকে গোপনে লালন করাই অধিকতর যুক্তিযুক্ত।

আসলে আমিই মেনে নিতে পারছিলাম না। আমার বন্ধু এলিনরকে বলেছিলাম যে, সন্তানরা শুধুই আমার। এলিনর একটা চাকুরী করতো এবং চাকুরীসূত্রে একসাথে কয়েক সপ্তাহের জন্যে তাকে পরিবারের বাইরে থাকতে হতো। তার অনুপস্থিতির সময়ে তার স্বামী তার দায়িত্বভার গ্রহণ করতো, সন্তানদের বিছানায় শুইয়ে দিতো এবং পরদিন সকালে তাদেরকে ধাত্রীর নিকটে হস্তান্তর করতো। এলিনর মুখ বাঁকা করে আমার কথায় অসম্মতি জ্ঞাপন করেছিলো। বলেছিলো যে, সন্তানদের উপরে বাবা বা মা দুজনেরই অধিকার সমান।

আমি আরেক বান্ধবী এনার সঙ্গেও এবিষয়ে কথা বলেছিলাম। এনার স্বামী দিনের অধিকাংশ সময়েই কর্মস্থলে থাকতো। এনা মোটামুটি একাই তার সন্তানদের দেখাশুনা করতো, যেমনটা আমি করতাম। সে আমাকে বলতো, হ্যা, এগুলো তোমারই সন্তান। অন্য কারো নয়। শুধু তোমাকেই তাদের প্রয়োজন। কাজেই তাদেরকেই তোমার সবচেয়ে বেশী অগ্রাধিকার দিতে হবে।

মেয়েদের সাথে আমার রক্তমাংশের সম্পর্কের ইতিহাসটিকে নির্বাসনে পাঠানো হয়েছিলো। মা হিসেবে আমাকে অস্বীকার করা হয়েছিলো। গর্ভবতী হিসেবে আমার তীর্থযাত্রা, বিস্ময় ও অপমান, সন্তান জন্মদানের দেবত্বারোপ, মাতৃত্বের কারণে আমার ব্যক্তিগত পৃথিবীর শেষপ্রান্ত পর্যন্ত পুনঃনির্মান করা – সময়ের সাথে সবকিছুই ইচ্ছায় বা ঘটনাক্রমে ভুলে গিয়েছিলো সবাই। অথচ এই অন্ধকার যুগের উপরেই পরিবার নামক সভ্যতার নির্মাণ হয়েছিলো। এই নির্জনতার আমিও ছিলাম একজন অংশীদার।

আমার নিজের মা একবার রাতের খাবারের টেবিলে কাঁদতে কাঁদতে অভিযোগ করেছিলেন যে, আমাদেরকে জন্মদানের জন্যে আমরা তাকে ধন্যবাদ দেইনি। এটা নিয়ে আমরা পরবর্তীতে কৌতুক করেছিলাম। আমাদের কাছে মনে হয়েছিলো যে, তিনি আমাদেরকে অযৌক্তিকভাবে দোষ দিয়েছিলেন। মনে হয়েছিলো আমরা নই, আমাদের পিতার উচিৎ ছিলো তাকে ধন্যবাদ দেয়া। আমাদের জন্মকালীন আকৃতি ও শরীর দেয়ার জন্যে। একইভাবে পিতাও তার সমান্তরালে নিজের অবদান রেখেছিলেন। সুতরাং মায়েরও উচিৎ ছিলো পিতার প্রতি তার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা।

ঈশ্বরের মতো আমার পিতা তার অনুপস্থিতির মাধ্যমে নিজেকে প্রকাশ করতেন। তিনি সভ্যতার ডাককে মান্য করতেন। যৌক্তিক মানুষ হিসেবে আমরা মায়ের নিকৃষ্ট ধর্মাচরন, আবেগের আতিশয্য, অতীত নির্ভরতা ও শূন্যতার বিপরীতে পিতার সংগেই জোটবদ্ধ হতাম। মায়ের চারিত্রিক বৈশিষ্টগুলোর কোন মূল বা উৎস ছিলো না। সেগুলো তার মাতৃত্ব বা নিজস্বতা – কোনটারই পরিচায়ক ছিলো না এবং সৃষ্টি হয়েছিলো এই দুটোর মিথষ্ক্রিয়া থেকে।

আমি অবশ্যই জানতাম যে, মায়ের এক সময়ে কিছু নিজস্ব বাস্তবতা ছিলো। চুলার কাছে স্থাপন করা বিয়ের ছবিতে তার তন্বী চেহারা সবসময়েই মুগ্ধকর ছিলো। সেখানে তিনি সাদা পোষাকে বেদিতে উতসর্গীকৃত বলীর মতো দাঁড়িয়েছিলেন। সরু কোমরের সস্মিত সুন্দরী হিসেবে। তার সৌন্দর্যের খোঁদাই করা রেখার মধ্যদিয়ে তার বিস্তৃত ভবিষ্যৎ সংকেতায়িত করা ছিলো। কিন্তু তার সেই সৌন্দর্য এক সময়ে অপসৃত হয়ে গিয়েছিলো পৃথিবীর তলদেশ থেকে তুলে আনা তেলের মতো। দহন শেষে যা বিলীন হয়ে যায়। কিছু কিছু সময়ে ছবিটির দিকে তাকালে আমাদের পরিবারটিকে আমার এখনো মনে হয় মায়ের সৌন্দর্যের বিচ্ছুরিত রূপ।

আমার কাছে নারীর সৌন্দর্যকে অভিবাসী মানুষের বাসস্থানের ধারণার মতো তাত্বিক বলে মনে হয়। আমার মায়ের প্রজন্ম হতে আমা পর্যন্ত সময়ে একধরনের স্থানান্তর বা অভিবাসন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছিলো। মা হয়তো আমার জন্মস্থান, কিন্তু আমার পিতা হলেন আমার জাতীয়তা। মা তার বিবাহ ও মাতৃত্বকে এমনভাবে আশা করছিলেন যাতে এর মালিকানা থাকে পুরুষের, যা তাকে নতুন দেশে আইনগত ভিত্তি দেবে। আমি তার এই ধরণের আকাঙ্ক্ষারই ফল ছিলাম, কিন্তু তিনি হতে আমি পর্যন্ত বিবর্তনকালে আমারই দায়িত্ব হয়ে উঠেছিল নিজেকে বিধিসম্মত করার। কিন্তু তার পরেও সাফল্য লাভ করার জন্যে আমার পিতার আকাংখা ও প্রচেষ্টা আমার জন্যে খুব উপযুক্ত ছিলো না। সেগুলো ছিলো অন্যদের জন্যে তৈরি করা সহজলভ্য পোষাকের মতো। তেমন আরামদায়ক না হলেও সেগুলো আমি পরিধান করতাম।

আমি পরীক্ষায় খারাপ গ্রেড পেলে বাবা অখুশী হতেন। তাকে অনুসরণ করে মা ও অখুশী হতেন। যদিও তিনি নিজেই কখনো পরীক্ষায় এ গ্রেড পাননি। আমি অক্সফোর্ডে ভর্তি হয়েছিলাম। আমার বোন ক্যামব্রিজে ভর্তি হয়েছিলো। আমাদের মতো দ্বিতীয় জেনারেশনকে মাধ্যম হিসেবে নিয়ে আমার পিতামাতা নতুন দেশে নিজেদেরকে আত্নীকরণ করতে চেয়েছিলেন।

পিতামাতার কথাবার্তা ও আচরণ সন্তানদের বেড়ে উঠার উপরে বড় ভূমিকা রাখে। কিন্তু কি ঘটে যখন তাদের দুজনের ভেতরেই আচরণ বা ভাবনাগত মিল থাকে না? পুরুষ হিসেবে বাবা আমাদেরকে কন্যা হিসেবে মূল্য দিতেন। নারী হিসেবে মা ও একই কাজ করতেন। কিন্তু মায়ের সংগে বাবার কখনোই মিলতো না। মূলত মায়ের কারণে। তার অনেক আচরণের পেছনেই কার্যকারণ থাকতো না।

আমরা একই সাথে পিতামাতা ও সময়ের সন্তান। কিন্ত বিংশ শতাব্দীর শেষ সময়েও মা আমাদেরকে অংক পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে চিন্তা করতে নিষেধ করতেন। বলতেন, অংকে ভালো করার চেয়ে একজন ভালো স্বামী খুঁজে পাওয়াও বেশী যুক্তিযুক্ত, যে ভরণপোষণের দায়িত্বভার বহন করবে। সম্ভবত তার মাও তাকে ঠিক এটাই বলেছিলেন। নারী হিসেবে মা আমাদেরকে কিছুই দান করেননি। এই ভেজাল ধরণের মূল্যবোধগুলো ছাড়া। তবে দান করেছিলেন একটি পরিত্যাক্ত বাড়ির স্মৃতি ও সৌন্দর্যের ভাবনাকে। বাড়িটা এক সময়ে বিলীন হয়ে গিয়েছিলো নতুন নতুন বাড়ি বা রাস্তাঘাট নির্মানের ফলে।

শৈশবে আমার অতিমাত্রায় সংবেদনশীল চোখে আমি মায়ের সৌন্দর্যকেই ভাবতাম নারীর সৌন্দর্য বলে। এবং সেই জায়গার আচরণবিধি বা ভাষা আমি না জানলেও এবং সেখানে বহিরাগত হলেও সেই নারীত্বের পৃথিবীতে আমি নাগরিকত্বের অধিকার পেয়েছিলাম।

তুমি তো নিজেকে নারীবাদী বলে দাবী করে থাকো, আমার স্বামী আমাকে প্রায়ই বলে থাকে। মাঝেমধ্যে আমার মনে হয় তাকে বলি, তুমিই সঠিক। আমার উচিৎ হয়নি নিজেকে নারীবাদী বলে দাবী করার। আমি খুবই দুঃখিত। একভাবে বলতে গেলে আমি সেটাই মিন করি। আসলে নারীবাদী কি? এর অর্থ কি? কেনই বা আপনি নিজেকে নারীবাদী বলে দাবী করবেন? নারীদের ভেতরে অনেকে আছেন, যারা নারীবাদ বিরোধী। আমার ধারণা একজন নারীবাদী পুরুষকে নিরামিষভোজী বলা যেতে পারে, যিনি শুধু মানবিক নীতিকে রক্ষা করছেন। কোন কোন সময়ে নারীবাদ নারীত্বের এতোটাই সমালোচনা করতে সক্ষম যে, আপনার কাছে কোন নারীবাদী নারীকে মনে হবে যে, সে নারীদেরকেই ঘৃণা করে থাকে। তাদের কোমলমতি স্বভাবের কারণে। এই নারীবাদী নারীরা নিজেদের শারীরিক ও মানসিক দাসত্বকেও ঘৃণা, এমনকি নারীদেরকে শত্রু বলেও আখ্যায়িত করে থাকে। অথচ তাদের শুধুই পুরুষদেরকে ঘৃণা করার কথা।

যাই হোক, কোন নারীবাদীকেই কখনোই অপরাধস্থলে খুঁজে পাওয়া যায় না। তাকে রান্নাঘরে, মেটারনিটি ওয়ার্ডে অথবা স্কুলের গেইটেও পাওয়া যায় না। কারণ, সে জানে যে, নারীত্ব একটি প্রতারণা বই কিছু নয়, যা অন্যেরা সৃষ্টি করেছে নিজেদের সুবিধার জন্যে। সে জানে যে, কেউ নারী হিসেবে জন্মায় না, তাকে নারী হিসেবে তৈরি করা হয়। সুতরাং সে রান্নাঘর, মেটারনিটি ওয়ার্ড হতে দূরে সরে থাকে, যেমন করে মদ্যপরা মদের বোতল থেকে দূরে থাকে। কিছু কিছু মদ্যপ আছে যারা পরিমিত সামাজিক মদ্যপান করে বলে কল্পনা করে থাকে। এরা হলো তারা, যারা এখনো খুব বেশী ব্যর্থতার চক্র অতিক্রম করেনি। একইভাবে যে নারী মনে করে যে, সে নারীত্বকে ধারণ করতে সক্ষম, সে মূলত নারীত্বের সংগে খেলা করে, যেমন করে কোন সামাজিক মদ্যপ মদ নিয়ে খেলে থাকে। সে চায় নতুন প্রতারক সেজে নতুন জাল পরিচয় নিয়ে খেলতে। এমনকি তার সাম্যের বা সমতার ধারণাও জাল হয়ে থাকে। সুতরাং সে আসলে দুই নারী অথবা অর্ধেক নারী। যদিও উভয় ক্ষেত্রেই সে দাবী করে থাকে যে, এটা করে সে আনন্দ পায়। কারণ এটা তার নিজের সিদ্ধান্ত।

সুতরাং আমি মনে করি যে, কোন নারীবাদীর উচিৎ নয় বিয়ে করা। তার উচিৎ হবে না যৌথ ব্যাংক একাউন্ট বা যৌথ নামে কোন বাড়ির মালিক হওয়া। তার উচিৎ হবে না সন্তান জন্ম দেয়ার, বিশেষ করে মেয়ে সন্তানের, যার পদবী ( surname) হবে মায়ের নামে নয়, বরং তার পিতার নামে। না, আমারই উচিৎ হয়নি নিজেকে নারীবাদী বলে ডাকার। কারণ আমি আমি যা বলেছি, তার সাথে আমার মিল নেই। ঠিক আমার মায়ের মতো। যে নারীত্ববাদ নিয়ে আমি বাস করতাম, তা ছিল মূলত পুরুষালি মূল্যবোধ যা আমার পিতা চর্চা করতেন এবং নারীত্ববাদ বিরোধী মূল্যবোধ যা আমার মা ধারণ করতেন। সুতরাং আমি নারীবাদী নই। আমি হলাম নিজেকে ঘৃণাকারী হাস্যস্পদ একজন অনুকরণকারী।

আমার পরিচিত অনেক নারীই বলে থাকে, আমি পুরুষদের কাছ থেকে কখনোই অর্থনৈতিক সহযোগিতা পাইনি। এটি একটি অবাস্তব তথ্য। নারীদের প্রত্যেকেরই অর্থের প্রতি একটা দুর্বলতা আছে। এছাড়াও নারীবাদীরা হলো সেইসব নারী যাদের ব্যক্তিত্ব একজন সাধারণ নারীর চেয়ে অধিকতর শক্তিশালী। কারণ তারা সবাই আত্নজীবনীবিদ ও নিজ জীবনের শিল্পী। যে কোন নারীর মত সে প্রাইভেট ও পাবলিক জীবনের মধ্যে সংযোগ বা ইন্টারফেস হিসেবে কাজ করে থাকে। পার্থক্য হলো নারীবাদীরা পরিস্থিতিকে কখনোই অনুকূল করার চেষ্টা করে না। বরং তাদের আপত্তি উত্থাপন করে পরিবেশকে অস্থির করে তোলে। তারা হলো সেই সব নারী, যাদের ভেতরের অংশটাই বাইরে প্রকাশিত।

আপনি যদি দীর্ঘদিন বেঁচে থাকেন, তাহলে আপনার ভেতরের সাহসিকতা ও কাপুরুষতার বিষয়গুলো স্পষ্ট হয়ে উঠবে। আমি অনেক ধরণের নারীদেরকে চিনি, যাদের মধ্যে জননী, সন্তানহীনা, বিবাহিতা, তালাকপ্রাপ্তা, সার্থক, পোষ করা, নিজের দোষ স্বীকার করা, উচ্চাকাঙ্ক্ষী, সন্তুষ্ট, নিঃস্বার্থ, হতাশাগ্রস্ত – সব ধরণের নারীই আছে। এদের কেউ কেউ স্বামীর উপরে অর্থনৈতিভাবে নির্ভরশীল নয় এবং সার্বক্ষণিক মা হিসেবে সন্তানদেরকে লালনপালন করে থাকে। জল যেমন করে রঙের সাথে মিশে যায়, তেমন করে এরাও সন্তানদের সাথে মিশে যায়। তাদের কোন অংশই তখন রংহীন থাকে না। সন্তানের আনন্দবেদনাই হয়ে উঠে তাদের আনন্দ বেদনা। সন্তানের সৌন্দর্যই হয় তাদের সৌন্দর্য। এক কথায়, সন্তানদের লালনপালন করাই হয়ে উঠে তাদের একমাত্র কাজ। এমনকি নিজেদের অস্তিত্বও তারা পরিচালিত করে থাকে সন্তানদের মধ্য দিয়ে। বিষয়টি তাদের মধ্যে এক প্রকারের চূড়ান্ত সক্ষমতার জন্ম দিয়ে থাকে।

আমার বান্ধবীদের কেউ কেউ এই ধরনের নারীদেরকে ভয়ঙ্কর ও আক্রমণাত্মক বলে মনে করে। কারণ, আমার এই বান্ধবীরা নিজস্ব পরিচয়ের বাইরেও একাধিক পরিচয় বহন করে থাকে এবং সম্ভবত তারা ভয় করে যে ঐ নারীরা তাদের বিরুদ্ধে চরম অক্ষমতার অভিযোগ উত্থাপন করতে পারে। একাধিক পরিচয় বহন করার কারণে তাদের শক্তি বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে, যাকে তারা কোন নির্দিষ্ট স্থানে কখনোই একত্রিত করতে সক্ষম নয়। ফলে তারা নিজেদের শক্তি সম্পর্কে নিশ্চিত থাকতে পারে না এবং বুঝতে পারে না যে, বাড়িতে অবস্থানকারী মা অথবা অফিসের পুরুষ সহকর্মীদের সাপেক্ষে তাদের অবস্থান কি। আমার ধারণা তাদের অনেকের মধ্যেই ইতস্তত বিক্ষিপ্ত হয়ে থাকার অনুভূতি কাজ করে থাকে।

আমার কর্মজীবি বান্ধবীদের মধ্যে কেউ কেউ তাদের মাতৃত্বের প্রাথমিক বছরগুলোতে গৃহে অবস্থান করার জন্যে সাময়িক ছুটি (domestic furlough) গ্রহণ করেছিলো। দাগী আসামীদের মতো তারা এক সময়ে হাল ছেড়ে দিয়ে আত্মসমর্পন করেছিলো এবং বলেছিলো যে, তাদের জীবন আসলেই অকার্যকর হয়ে গেছে। এদিক-সেদিক দৌড়ানো, অনুতাপবোধ, কাজের চাপ ইত্যাদির কারণে তাদের মনে হতো যে, কেন তারা সন্তান ধারণ করতে গিয়েছিলো। সুতরাং তারা এক বছর বা দুই বছরের জন্যে বাসায় অবস্থানের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো এবং নিজেদেরকে বিভক্ত করেছিলো দুই ভাগে। যেমন করে রেসিপিতে কেক মিক্সসারকে বিভক্ত করে দুটো টিনের বাক্সে রেখে দেয়া হয়। তাদের কাছে মনে হতো যে, কোন বাক্সেই তাদের পরিমাণ ঠিক নেই। যদিও তাদের স্বামীরাও কাজ করতো, একই বাসায় বাস করতো এবং সন্তানদের লালনপালন করতো, তথাপি তাদের শান্তি আসতো না। কখনো কখনো তারা মনে করতো যে, কর্মজীবি নারী হবার চেয়ে তারা কর্মজীবি পুরুষ হলেই হাওয়াই উত্তম হতো।

একজন পুরুষ সন্তানের ভালো পিতা হবার মধ্য দিয়ে নিজের লিঙ্গের প্রতি কোন অবমাননা করে না। কিন্তু একজন কর্মজীবি মা প্রতিনিয়ত নিজের কাজকে দোষারোপ করে থাকে। আসলে একজন নারী মাধ্যাকর্ষণের সাথে তার গভীর সম্পর্ককে অস্বীকার করার চেষ্টা করে থাকে। কোথাও আমি পড়েছি যে, একটি স্পেইস স্টেশন বা কৃত্তিম উপগ্রহ তার কক্ষপথে আবর্তন করার সময়ে সারাক্ষণ ধীরে ধীরে পৃথিবীর দিকে সরে আসতে থাকে। ফলে সেটিকে পুনরায় আগের স্থানে ফিরিয়ে নেয়ার জন্যে কয়েক মাস পর পর রকেট ব্যবহার করতে হয়। একইভাবে একজন নারীকে সব সময়েই অদৃশ্য কোন বায়োলজিক্যাল শক্তি তার দিকে টানতে থাকে। ফলে তার জীবন হয়ে উঠে নিরলসভাবে পুনরাবৃত্তিমূলক। কক্ষপথে নিজেকে রাখার জন্যে তার শক্তির প্রয়োজন হয়। কিন্তু কোন কারণে এক বছর যদি রকেট না আসে, তবে তার পতন হয়ে পড়ে অনিবার্য।

উদাহরণস্বরূপ, কোন একজন কর্মজীবি মা ঘরে অবস্থানকারীনি মা সম্পর্কে জানতে উৎসাহী হলে ঘরে অবস্থানকারীনি মা বলে, ঘরে অবস্থান করার বিষয়টি আমার জন্যে খুবই সৌভাগ্যের। কারণ, ঘর হলো আমার কাছে নিজস্ব পিচ ও লাইনের মতো। আর জেইমস এর বেতনই আমার জন্যে যথেষ্ট। ফলে আমাকে কোন কাজ করতে হয় না। তুমি কি কখনো কোন পুরুষ মানুষকে বলতে শুনেছো যে, প্রতিদিন অফিসে যেতে তার ভালো লাগে?

এরপরেও ঘরে অবস্থানকারীনি মা ঘরে বসে প্রচলিত গৃহকর্ম করাকে বিশেষ সুবিধা হিসেবেই প্রচার করে থাকে, আত্মরক্ষার উদ্দেশ্যে। কারণ সে চায় না যে, অন্যেরা তাকে অলস বা উচ্চাভিলাষহীন মানুষ বলে মনে করুক। একারণেই সে অংক পরীক্ষায় যখন তার মেয়ে প্রথম স্থান অধিকার করে, ক্যামব্রিজের ভর্তি পরীক্ষায় যোগ্য হয়, কিংবা একজন নিউক্লিয়ার পদার্থবিদ হয়, তখন সে আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে উঠে। এই সময়গুলোতে সেকি কখনো ইচ্ছা ইচ্ছা পোষণ করে যে, তার মেয়েও তার মতো গৃহে অবস্থান করুক কিংবা অনাদিকাল থেকে প্রচলিত জীবনযাত্রার অধিকারিণী হোক? নাকি এটাকে সে এমন একটি ধাঁধা বলে মনে করে, যেটা কেউ একজন ভবিষ্যতে সমাধান করবে? যেমন করে দূর ভবিষ্যতে বিজ্ঞানীরা ক্যান্সারের প্রতিষেধক আবিষ্কার করবে।

আমার সন্তানদের জন্মের পর তাদেরকে কোলে নিয়ে আহার করানো ও তাদের সাথে কথা বলার সময়ে আমার ভেতরে বিশাল এক ভিন্ন ধরণের সচেতনতার বোধ সৃষ্টি হয়েছিল। নিজ সম্পর্কিত আমার এই বোধটি ছিল সম্পূর্ণ নতুন ও বহিরাগত। আমার নিজ থেকে সৃষ্ট কোন বিষয় ছিলো না সেটা। অনেকটা আকস্মিকভাবে রাশিয়ান ভাষায় কথাবলার যোগ্যতা অর্জন করার মতো। এই নতুন জ্ঞান বা বোধের উৎস সম্পর্কে আমার ধারণা ছিল না। তারপরেও একে আমি নিজের অন্তর্গত বোধ বলেই ভাবতাম। উল্লেখ্য, এটা করতে গিয়ে নিজকে আমার অসৎ ও প্রতারক বলে মনে হতো। নিজেকে দ্বৈতসত্ত্বার অধিকারী বলে মনে হতো। আমার এই দ্বিতীয় কোন সত্ত্বা যমজ কোন সত্ত্বা, যা আমার মতো মনে হলেও মূলত ছিলো বাইরের কোন সত্ত্বা। এই অতিরিক্ত সত্ত্বাটি আপাতভাবে ক্ষতিকর ছিল না। তবে সেটা আমার মূল চরিত্রের রীতিনীতি হতে কিছুটা স্বাধীনতা ও সাময়িক মুক্তি চাইতো। চাইতো যে, আমি নিজেকে এমন একজন নারী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করি, যার বৈশিষ্ট নারীর মতো হবে না।

মা হিসেবে আমার নিজস্ব কিছু চরিত্রকে বিসর্জন দিতে হয়েছিলো। সেগুলো ছিলো পুরুষের মূল্যবোধ থেকে উৎসারিত। আমার বাসস্থান ও পরিবেশও একইভাবে বিবর্তিত হচ্ছিলো। এবং এর কারণে আমার এক ধরণের অভিযোজন প্রয়োজন হয়ে পড়েছিলো। কিন্তু কাদের সাথে আমার এই অভিযোজন? মনে আছে, বিয়ের প্রাথমিক দিনগুলোতে আমি পরিচিতজনদের সাথে উদ্ভট ধরণের আচরণ করতাম। ঠিক যেন কোন নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর ধর্মাচরন আমাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিলো। ফলে সাধারণ মানুষদের থেকে দূরে কোথাও চলে গিয়েছিলাম আমি। ফলে এই ধর্মাচরন বা মাতৃত্বের তীব্র অনুভূতির ভেতরে আমার পক্ষে বাস করা সম্ভব ছিলো না। কারণ, এটা আমার নিজকে প্রতিফলিত করতো না। এর সাহিত্য, ব্যবহারিক উপযোগিতা, মূল্যবোধ, নান্দনিকতা – কোনটাই আমার ছিলো না। সেটা ছিল অন্য যেকোন ধর্মের মতো, যেটার চাহিদা ছিল নিজের পরিচয়কে সম্পূর্ণভাবে তার কাছে সমর্পন করার।

ফলে কিছুটা সময় আমি কোথাও ছিলাম না। অল্পবয়সী সন্তানদের মা হিসেবে আমি ছিলাম গৃহহীন, ভাসমান এবং ভ্রমণকারীদের মতো। এই সময়ে আমার নিজের ও সন্তানদের জন্যে প্রবল অনুকম্পা অনুভব করতাম আমি। নারীত্বের সঙ্গে এই বিচ্ছিন্নতা আমার জন্যে খুবই বিপর্যয়কর ছিলো। সেটা তুলনীয় ছিল কোন পোষ্য সন্তানের সঙ্গে, যে শেষ পর্যন্ত পিতামাতাকে খুঁজে পাওয়ার পর দেখতে পায় যে, তারা তার কাছে ভালবাসাহীন আগন্তুক বই আর কিছুই নয়। ফলে মা হিসেবে নিজের অবস্থান খুঁজে না পাওয়ার কারণে নিজেকে আমার অবাঞ্ছিত মনে হতো। মনে হতো যে, নারী হিসেবে আমি আসলেই এক বহিরাগত সত্ত্বা।

সুতরাং দুটো কাজ আমি করেছিলাম আমি। প্রথমত আমি ফিরে গিয়েছিলাম আমার পুরাতন পুরুষ-প্রধান পরিচয়ে। দ্বিতীয়ত আমার স্বামীকে আমি বাধ্য করেছিলাম সন্তানদের যত্ন নিতে। সে বাধ্য হয়েছিলো আমার নারীত্বের যমজ হতে। আমার ধারণা ছিল যে, আমরা দুজনে দুটো হাইব্রিড হিসেবে একসাথে বাস করবো। এর প্রত্যেকেই হবে অর্ধেক মানব ও অর্ধেক মানবী। এটাকেই আমার কাছে সমতার ধারণা বলে মনে হয়েছিলো। এর ফলে আমার স্বামী তার আইনের চাকুরীটা ছেড়ে দিয়েছিলো এবং বিনিময়ে আমি সন্তানদের উপরে আদি মাতৃতান্ত্রিক অধিকারকে বিসর্জন দিয়েছিলাম। এগুলোকে আমি মনে করতাম নতুন ঈশ্বরদের প্রতি আমাদের প্রস্তুতিমূলক আত্মত্যাগ, যাদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষার অধীনে আমরা বাস করার আশা করেছিলাম।

দশ বছর পরে, উত্তর লন্ডনের একজন আইনজীবীর অফিসে বসে মাতৃত্বের সেই বোধকে আমার নিকটে আসলেই খুব পুরোনো ও বর্বর বলে মনে হয়েছিলো। সন্তানেরা আমার - এই ধরণের মৌলিক বুলিতে আমি তখন বিশ্বাস না করলেও, সেটা তখনো আমার মাথার ভেতরে ছিলো। আইনিজীবির কাঁচের তৈরি অফিসে দুইজন আইনজীবীর বিপরীত দিকে বসে থাকার সময়ে অতীত ভোগান্তির কারণে আমার চেহারা শীর্ণ ও ক্লিষ্ট হয়ে গিয়েছিলো। তারপরেও তাদের উপস্থিতিতে আমি নিজেকে খুবই শক্তিশালী মনে করেছিলাম এবং মাতৃত্বের প্রাচীন কুৎসিত আবেগের শিলা দিয়ে নিজেকে আবৃত করে রেখেছিলাম।

আইনিজীবীরা বলেছিলো যে, আমার কোন ধরণের অধিকারই নেই। আইন এই বিষয়সমুহে অধিকারের ভিত্তিতে কাজ করে না। এখানে কাজ করে precedent বা নজীর। সুতরাং সেখানে আদি বাস্তবতা বলে কিছু ছিলো না। সেখানে মা-বাবা বলেও কিছু ছিলো না। সেখানে ছিলো শুধুই সভ্যতা। তারা আমাকে বলেছিলো যে, সন্তানদের লালনপালনের জন্যে আমাকে বাধ্যতামূলকভাবে স্বামীকে অর্থনৈতিকভাবে সহায়তা প্রদান করতে হবে। সম্ভবত চিরকাল। কিন্তু আমার স্বামী তো একজন যোগ্য আইনজীবী, আমি তাদেরকে বলেছিলাম। অপরপক্ষে আমি একজন লেখিকা। এর মাধ্যমে আমি বোঝাতে চেয়েছিলাম যে, সে হলো একজন শক্তিমান পুরুষ এবং আমি শুধুই একজন নারী। আইনজীবীরা চোখের শীর্ণকায় ভ্রু উপরে তুলে আমার দিকে একটি ছোট্ট তিক্ত মৃদুহাসি দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, তাহলে তো তোমার স্বামী সঠিকভাবেই জানত যে, সে কি করছিলো।

গ্রীষ্মকাল আসলো আমাদের উপকুলবর্তী বসবাসের শহরে। সাথে নিয়ে আসলো রিনরিন করা সমুজ্জ্বল সূর্যালোক। ভোরে গাঙচিলগুলোর তীক্ষ্ণ কন্ঠে চেঁচামেচি পরিবেশের ভেতরে একটা উত্তেজনার ভাব এনে দিলো। এবং বিগলিত আলোতে বৃক্ষরাজির ফাঁক দিয়ে সমুদ্রের জল খেলা করতে লাগলো।ফলে আমি আর ঘুমাতে পারলাম না। আমার সমস্ত চেতনা পূর্ণ হয়ে গেলো স্বপ্নের কশেরুকা দিয়ে। অতীতের ভগ্নাংশগুলো তখন ঢেঊয়ের মতো স্ফীত ও আন্দোলিত হয়ে স্বপ্নের সেই বেলাভূমিতে এসে আছড়ে পড়তে লাগলো।

স্কুলের প্রবেশদ্বারে আমি যখনমেয়েদেরকে আনতে যেতাম, তখন অন্য মহিলারা আমার দিকে একধরনের তীর্যক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতো। যেমন করে মানুষেরা দূরের জিনিসকে অবলোকন করে থাকে। আমিও তাদেরকে দেখতাম, সাগরের বিলুপ্ত শূন্যতা থেকে। দেখতাম যে, তারা ভূমিতে বাসস্থান নির্মাণ করছে। তারা কেউই তাদের বাসস্থান ধ্বংস করেনি। তাহলে আমি কেন আমার বাসস্থান ধ্বংস করেছিলাম?

বোনের বাড়িতে তার রান্নাঘরে বসেছিলাম। সে কাপড় ভাঁজ করছিলো। আমি দেখতে পেয়েছিলাম যে, সে তার স্বামীর শার্ট ও ট্রাউজার ভাঁজ করে রাখছিলো। তাকে পুরুষদের কাপড় স্পর্শ করতে দেখে আমি প্রচন্ড রকমের ধাক্কা খেয়েছিলাম। মনে হয়েছিলো যে, সে নিষিদ্ধ কিছু একটা স্পর্শ করছিলো। তার নিষিদ্ধ জিনিস নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করার অধিকার ও সক্ষমতা আমাকে অভিভূত করে ফেলেছিলো।

আইনের ব্যাপারটা তুমি জানো, স্বামী আমাকে টেলিফোনে বললো। সে আসলে তাকে টাকা দেয়ার বিষয়ে আমার বাধ্যবাধকতার বিষয়টি আমাকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিলো।

আমি জানি আমাকে কি করতে হবে, আমি বললাম।

তুমি তো নিজেকে একজন নারীবাদী বলে ভাবো, সে পুনরায় আমাকে বললো।

আমার প্রয়োজন, একজন স্ত্রীর, একজন বিপন্ন নারীবাদী মহিলা কৌতুকের স্বরে বলে। তার কথা শুনে সবাই হাসে। কৌতুকটা হলো, একজন নারীবাদীর ভেতরে স্থিত পুরুষ-মূল্যবোধের সাধনাই তাকে নারী শোষণের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যায় এবং এটাই হলো বিড়ম্বনা। একজন নারীবাদী তার নির্বোধ কুকর্মের সহযোগী গৃহিণী নারীকে এভাবেই গালি দিয়ে থাকে। এবং তার জীবনের প্রথম নারীবাদী কার্যক্রম হয়ে থাকে নিজের গৃহিণী মাকে মুক্ত করার এবং পরিশেষে আবিষ্কার করার যে, এই মুক্তি তার মায়ের আদৌ দরকার বা আকাংখিত ছিলো না।

আমার মায়ের বেতনহীন সামাজিক পদমর্যাদা, দাসত্ব, গৃহজীবন – এগুলোকে তিনি যতটা অপছন্দ করতেন, তার চেয়ে অনেক বেশী অপছন্দ করতাম আমি। তিনি কখনোই আমাকে বলেননি যে, এগুলো তার অপছন্দের ছিলো। তারপরেও আমার প্রাপ্তবয়স্কা জীবনে আমি নিজেই একই ধরণের পরিস্থিতি পুনরায় সৃষ্টি করেছিলাম। আমি স্বামীর বেতনহীন গৃহজীবনকে ঘৃণা করতাম, যেমনটা আমি করতাম আমার মায়ের ক্ষেত্রে। এবং আমার স্বামীও আমার মায়ের মতোই ভাগ্যকে নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলো বলে দাবী করতো।

আমি গৃহজীবনকে ঘৃণা করতাম। কারণ সেটা ছিলো পরনির্ভরতার প্রতিনিধিত্বকারী। এই নির্ভরতাকে দুইজন মানুষের মধ্যকার চুক্তি হিসেবেও অভিহিত করা যেতো। আমার বাবাও আমার মায়ের উপরে নির্ভরশীল ছিলেন অনেক বিষয়ে। তিনি খাবার রান্না করতে পারতেন না। অফিস থেকে সন্তানদের দেখাশুনাও করতে পারতেন না। ফলে তারা দুজনেই ছিলেন দুই অর্ধাংশ, যা পরস্পরের সাথে মিলে একটা সমগ্র তৈরি করেছিলো। এরপরেও তারা দুজন এক রকমের ছিলেন না। বরং বলা যায় যে, তারা দুজনে মিলে একত্রিতভাবে বগিযুক্ত (compartmentalized) একক কোন মানুষে পরিণত হয়েছিলেন। ফলে আমার পিতার অর্ধাংশ আমার মায়ের অর্ধাংশের মতো না হলেও, এই পার্থক্য কখনোই নিজেদের প্রাধান্যকে স্পষ্ট করে তুলেনি।

অর্ধাংশ সম্পর্কে আমার ধারণা ছিলো কেঁচোর মতো। তুমি যদি কোন কেঁচোকে কেটে দুইভাগ করো, তারপরেও প্রতিভাগই কেঁচো হিসেবেই রয়ে যাবে। প্রতিটা খন্ডই কেঁচোর মতো করেই নিজেকে মোচড় দেবে ও রক্ষা করার চেষ্টা করবে। আমি রোজগার করার পাশাপাশি রান্নাবান্না ও ঘরদোর পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার কাজ করতাম। সন্তানদের দেখাশুনা করার জন্যে কাউকে বেতন দিতাম, এবং তাদেরকে স্কুল থেকে আনা নেয়া করতাম। আমার এই সকল কাজে স্বামী সাহায্য করতো। এই শব্দগুচ্ছই (phrase) সে ব্যবহার করতো যে, সে আমাকে সাহায্য করে। ফলে আমি রূপান্তরিত হয়েছিলাম বগিতে বিভক্ত আধুনিক কোন নারীতে (compartmentalized modern woman), যার সবকিছুই ছিলো, কিন্তু তার স্বামী তাকে সাহায্য করতো সেটা হতে। কিন্তু আমি সাহায্য চাইতাম না, আমি চাইতাম সাম্যতা। আসলে, সাহায্য করার ধারণাটিই আমাকে বিরক্ত করতো।

আমি ভাবতাম যে, কেন আমার স্বামী ও আমি একরকম হতে পারি না? কেনো সে আমার মতো বগিতে বিভক্ত (compartmentalized) হয় না? এবং আসলেই কেন নিজের সন্তানদের দেখাশুনা করা বা নিজের খাবার রান্না করা পুরুষদের জন্যে সহায়ক কর্ম হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে? আমার মতে সহায়ক কর্ম ছিলো সেটাই, যা একটা ভালো সন্তান তার মায়ের জন্যে হয়ে থাকে, এবং একজন সহায়ক ব্যক্তি ছিলো সেজন, যে তার নিজের কার্যপরিধি বা দায়িত্বের বাইরে গিয়ে কাউকে কাজ করে দেয় অনুগ্রহ বশত। আমি এটাও মনে করতাম যে, সাহায্য বিষয়টা আসলেই বিপদজনক, এর অস্তিত্ব অর্থনীতির বাইরে হবার কারণে। সাহায্যের প্রতিদান প্রদান শুধুমাত্র সম্ভব কৃতজ্ঞতা দিয়ে। সেক্ষেত্রে আমি কি আমার রোজগারের মধ্য দিয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের মতো কোনো কাজই করছিলাম না? পরিবারকে সাহায্য করার মধ্য দিয়ে আসলেই আমি কি সহায়ক কোনো ভূমিকা পালন করেছিলাম না?

সুতরাং আমার পুনর্গঠিত পৃষ্ঠদেশের নীচে আমি পুরোনো গোঁড়ামির অস্থিরতাকে অনুভব করতাম। আমরা ছিলাম শুধুমাত্র সেই মানব-মানবী, যারা সাম্যের সংগ্রামে নিজেদের পরিচ্ছদকে পরিবর্তন করেছিলো। আমরা ছিলাম শুধুই একটি ট্রান্সভ্যাসাইট দম্পত্তি (transvestite couple), যারা পরস্পরের সাথে পরিচ্ছদ বদল করেছিলো। এবং আমার স্বামীর সাথে পার্থক্য ছিলো এটাই যে, আমি নারী ও পুরুষ উভয়েরই রোল প্লে করেছিলাম; কিন্তু সে রোল প্লে করেছিলো শুধু একজনের।

একবার আমার এক মেয়ে বন্ধু আমাকে বলেছিলো যে, সে আমাদের জীবনকে প্রশংসা করে। তবে এই জীবন তার পক্ষে যাপন করা সম্ভব নয়। কারণ হিসেবে বলেছিলো যে, সে কখনোই স্বামীকে শ্রদ্ধা করবে না, যদি সে স্ত্রীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। সুতরাং আমাদের জীবন প্রশংসনীয় ছিলো একটি মাত্র কারণে। তা হলো নিজের জন্যে আমার কোন পুরুষের প্রয়োজন ছিলো না এবং আমার স্বামীরও ইচ্ছে ছিলো না স্বামী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার।

কোন কোন সময়ে নিজের সক্ষমতার বিষয়টি আমাকে ভীত-সন্ত্রস্ত করে তুলতো। মনে হতো, প্রয়োজন ছাড়াই আমি এই পৃথিবীর সাথে সংযুক্ত আছি। আপাতভাবে কাউকেই আমার দরকার নেই। সবকিছুই আমি নিজে করতে সক্ষম। এবং, আমি নিজেই নিজের দুই অর্ধাংশ। এমনকি এটাও মনে হতো যে, একাকীই আমি সম্পূর্ণতা অর্জন করেছি।

একভাবে চিন্তা করলে নারীত্বের সম্ভাবনার উঁচু কোন বিন্দুতে আমি অবস্থান করছিলাম। সবকিছুই ছিলো আমার। পরিবার হতে দূরে অবস্থান করে সরকারী কোন উঁচু পদে চাকুরীরতা কোন নারীর মতো। চাকুরীর সমান্তরালে দুইটি কিশোরী সন্তানকে লালনপালন করা ছাড়া আমার আর কিছুই করণীয় ছিল না। ‘আমার সব আছে’ এই শব্দগুচ্ছের ঐশ্বর্য ও আড়ম্বর আমার অবস্থাকে প্রতিফলিত করতো। মাতৃত্ব ও কাজ দুটোর অর্থই ছিল আমার জন্যে একটি জীবনের পরিবর্তে দুটো জীবনকে যাপন করা। বিষয়টি আমার নারীত্বের অভিজ্ঞতার ইতিহাসকে অসাধারণভাবে পরিমার্জন করেছিলো। ফলে যখনই কেউ বলতো যে, ‘আমার সব আছে’ এর অর্থ হলো ‘আমিই সবকিছু করি’, তখন তাদেরকে আমি বলতাম, অবশ্যই তুমি ঠিক বলেছো। কোনকিছুই না করে সবকিছু পাওয়া সম্ভব নয়। ‘আমার সব আছে’ হলো এমন ধরণের সাফল্য, যার পেছনে থাকে কঠোর পরিশ্রম। পাশাপাশি থাকে একটি নায়কোচিত সত্ত্বা। কিন্তু তোমরা তো জানো যে, নায়ক হলো সমাজ থেকে পৃথক হয়ে যাওয়া একাকী ও ব্যক্তিবাদী সত্ত্বা। সে হলো এমন একজন পরিব্রাজক, যিনি ‘পবিত্র থালা’র অনুসন্ধানে চিরকাল নিজেকে ব্যাপৃত রাখেন এবং অবিরত অনুসন্ধান করতে থাকেন উদ্দিষ্ট লক্ষ্যকে। এই লক্ষ্য তাকে নিজের সামর্থ সম্পর্কে পরিপূর্ণ ধারণা দিয়ে থাকে। নায়ক প্রকৃতপক্ষেই একজন একাকী ও ব্যতিক্রমী মানুষ।

সুতরাং একইসাথে আমি ছিলাম পুরুষ ও নারী। তবে সময়ের পরিক্রমায় আমার ভেতরের নারী স্বত্বা অসুস্থ হয়ে পড়েছিলো। কারণ, খুব কম সংখ্যক মানুষই তাকে মূল্য বা প্রতিদান দিতো। ফলে নিজেকে আমি অন্যদের পথ থেকে সরিয়ে রাখতাম। রান্নাঘর থেকে দূরে থাকতাম। এমনকি সন্তানদের সাথেও নির্দিষ্ট দূরত্ব রক্ষা করে চলতাম। আমাকে এগুলো করতে হতো শুধুমাত্র আমার স্বামীর নারীত্বকে সংজ্ঞায়িত করার জন্যে নয়। নিজের পুরুষ মূল্যবোধকেও পরিতুষ্ট করতে।

যৌন বৈষম্যবাদী বই (sexist book) অনুযায়ী পৃথিবীর সবচেয়ে পুরোনো চাতুর্যপূর্ণ কাজ হলো সন্তানদের নিয়ন্ত্রণের জন্যে নারীদেরকে ব্যবহার করা। কিন্তু মাতৃত্বের আবেগ ও আত্নমুগ্ধতার মধ্যে আমি আমার লেখক স্বত্বার উপরে হুমকি দেখেছিলাম। সন্তানদেরকে লালনপালন করতে গিয়ে আমি কখনোই অসুস্থ হইনি; আমি অসুস্থ হয়েছিলাম আরও গভীরতর কিছুর জন্যে। সেটা ছিলো সম্মানের অভাব, যা সন্তানদের লালন করার জন্যে মা হিসেবে আমার প্রাপ্য ছিল। আমার প্রাপ্য সেই সম্মান পেয়েছিলো আমার স্বামী। সেটা আমি নিজেই তাকে দিয়েছিলাম, অথবা সেই আমার কাছ থেকে নিয়ে নিয়েছিলো। উভয়ক্ষেত্রেই তার এই অর্জন ছিলো আমাদের কৃত ব্যবস্থাপনার কারণে। গৃহস্থালির তুচ্ছ, নিরানন্দ কাজগুলো আমাকে করতে হতো তাকে সেই সম্মানগুলো অর্জনে সহায়তা করার জন্যে। অনেকটা দৃশ্যের পশ্চাতে অবস্থান করে মঞ্চের প্রদর্শনীকে মসৃণভাবে অনুষ্ঠিত করার মতো। মোটকথা, আমি কোন পুরুষ ছিলাম না। কারণ পুরুষরা কখনোই গোলামী করে না। আবার আমি কোন নারীও ছিলাম না। ফলে, কাপড় ইস্ত্রি করা, ভ্যাট প্রতিবেদন জমা দেয়া - এই কাজগুলো কখনোই আমার কাছে সুন্দর ছিলো না। প্রকৃতপক্ষে আমার কোন কাজই আমার সত্ত্বাকে প্রতিফলিত করতো না।

স্বামীর সাথে একবার দুইদিনের জন্যে প্যারিসে গিয়েছিলাম। সেখানে গিয়ে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম ফ্রেঞ্চ কোন সেলুন থেকে চুলকাটার। এটা কি সেই কাজ নয়, যা মেয়েরা করে থাকে? আমি মেয়েলী হতে চেয়েছিলাম। চেয়েছিলাম কেউ একজন আমার হারিয়ে যাওয়া নারীত্বকে ফিরিয়ে দিক। কিন্তু একজন পুরুষ নরসুন্দর নতুন বেশ্যার মতো অস্পষ্ট চোখে হাসতে হাসতে আমার সকল চুল কেটে ফেলে দিয়েছিলো। প্যারিসের রাস্তায় ঘুরতে ঘুরতে দোকানের জানালায় আমি উদবিগ্নভাবে আমার প্রতিবিম্ব দেখেছিলাম। আমার চেহারায় কি রূপান্তর, নাকি বিকৃতি ঘটেছিলো? আমি নিশ্চিত ছিলাম না। আমার স্বামীও নিশ্চিত ছিলো না। বিষয়টিকে কাছে ভয়ানক বলে মনে হয়েছিলো। মনে হয়েছিলো যে, আমরা আমাদের পরস্পরের মধ্যে সত্য প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হয়েছি। প্রকাশ্য দিবালোকে নগরীর অজ্ঞাত রাস্তায় ঘুরতে ঘুরতে আমি বুঝতে পারছিলাম না আমার কি করা উচিৎ।

কখনো কখনো স্নানঘরে আমার সন্তানেরা কান্নাকাটি করে। নগ্নতা, বা ঈষদুষ্ণ জল, অথবা পুরনো নৈমিত্তিক কিছু তাদের আবেগের আবরণকে সরিয়ে দেয় এবং নীচের ক্ষতকে দৃশ্যমান করে তোলে। আমি বিশ্বাস করি যে, এই ক্ষতগুলো আমিই তাদেরকে দিয়েছি। সমস্ত দোষ আমারই। এটা হলো আরেকটি নায়কোচিত কাজ, যেখানে নায়ক ও ভিলেনকে পৃথকভাবে শনাক্ত করা সম্ভব নয়। আমি তাদেরকে আহত করার মধ্য দিয়েই ভালোবাসতে শিখেছি। সেই ভালোবাসাকে আমি মূর্ত ও গোপন করেছি, নিজেকে অত্যাচার করার মধ্য দিয়ে।

প্রেমময়ী মা বলতে আমরা কি বুঝি? এটা হলো সেইজন, যার ব্যক্তিস্বার্থ প্রতিস্থাপিত হয়েছে তার নিজের সন্তানদের মধ্যে। সন্তানদের কষ্ট তার ভেতরে নিজের কষ্টের চেয়ে বেশী কষ্টের সৃষ্টি করে। সে হলো ক্রুশের পাদদেশে মেরী’র মতো। ইস্টার সার্ভিসের সময়ে চার্চের ভেতরে আমি মেরীর আবেগের বর্ণনা শুনে আবেগাপ্লুত হয়েছিলাম। কারণ, যীশুকে যখন শারীরিকভাবে অত্যাচার করা হচ্ছিলো, তখন মেরী অনুভব করছিলেন যে, কেউ একজন তার হৃদপিণ্ডের ভেতরে তরবারি চালিয়ে দিয়েছে। বিষয়টা আমাকে আকৃষ্ট করেছলো একারণে যে, সেখানে মেরীর আবেগের মধ্যে একটি ছবি গেঁথে দেয়া হয়েছিলো। এবং, এই ছবির উৎপত্তি ছিলো বাইরের শীতল পৃথিবী ও পুরুষদের শারীরিক সমতল।

যেকোন ভাবেই হোক, অন্যদের থেকে মায়ের ভেতরে ব্যাথা স্থানান্তরিত হতে গিয়ে রূপান্তরিত হয় সক্রিয় হতে নিষ্ক্রিয়তে, বাস্তবতা হতে তত্ত্বীয়তে, শারীরিক হতে সংবেদনশীলতায় এবং উদ্দেশ্য থেকে মনোজগতে। এই আঘাত মৃদু হয়ে যায়, যখন সন্তানেরা কাঁদে। তারপরেও আমিই তাদের কান্নার কারণ। এবং কিছু সময়ের জন্যে এই দ্বন্দ আমাকে পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যায়। তখন মাতৃসত্ত্বাই আমার প্রধানতম পরিচয় হয়ে পড়ে। এটাকেই আমার কাছে মনে হয় কম্পার্টমেন্টালাইজড নারীর চূড়ান্ত বিবর্তন; সিজোফ্রেনিয়ার মতো এক ধরণের পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার।

শীত আসে। দিনগুলো ছোট ও বিবর্ণ হয়ে পড়ে। সাগর ফিরে যায় অজ্ঞানতার ভেতরে। শীতল রূপালী জল নুড়িতে পরিবর্তিত হয়ে যায়। নীরবে নিভৃতে। সারারাত ধরে তারারা জ্বলে, তুষারপাত হয়। সকালে রাস্তার উপরে ভাঙা আয়নার মতো ছোট ছোট বরফে জমে যাওয়া ডোবাগুলো শুয়ে থাকে। আমরা ঘন্টার পর ঘন্টা ঘুমিয়ে থাকি। অস্ত্রোপাচারের পর ক্রমশ আরোগ্যলাভ করা রোগীর মতো। এই ব্যাথা খুবই প্রবল হলেও আরোগ্যের অসারতার কারণে ব্যাথার প্রস্থান প্রায়ই অলক্ষে ঘটে যায়। তখন তুমি স্পষ্ট বুঝতে পারো যে, একটা দিন চলে গেলো। স্মৃতিতে ঔৎসুক্যের শূন্যতা রেখে। স্মৃতির সকর্ম অনুভূতিগুলোকে তখন মনে হয় অসুস্থতা থেকে সদ্য মুক্ত হওয়া কোন লোক যে, স্বচ্ছন্দে হেঁটে বেড়াচ্ছে, কিন্তু যে কখনোই পূর্বের ব্যক্তি নয়। আমার ভেতরে তখন আরেকটা প্রকোষ্ঠের সৃষ্টি হয়। ইতস্তত বিক্ষিপ্ত প্রশ্ন ও অভিজ্ঞতাগুলোকে ধারণ করার জন্যে।

শূন্যস্থান পূরণ করার জন্যে আমরা গৃহের আসবাবপত্রসমূহকে পূনর্বিন্যাস করে থাকি। আমরা খরচ বাঁচাই। ভাড়াটে নেই। মাছের জন্যে ক্ষুদ্র ফিশ ট্যাংক স্থাপন করি। মাছেরা সেখানে নিরন্তরভাবে লতাপাতার ভেতরে ঘুরপাক খেতে থাকে। দিন-রাতের সকল সময়ে।

আমার সন্তানেরা তাদের পিতার বাসস্থানে যায়। আবার ফিরে আসে। তারা আগের মতো কান্নাকাটি করে না। শুধু মন থেকে এই নতুন ব্যবস্থাপনার বিষয়ে অভিযোগ করে। তাদের মুখে পুনরায় রঙ ফিরে আসে। এক বন্ধু আসে কিছুদিন আমার সাথে থাকার জন্যে। সে মন্তব্য করে যে, আমার বাসস্থানে পুনরায় হাসির শব্দ শোনা যাচ্ছে। শীতের নির্জনতার শেষ পাখির কাকলীর মতো। তারপরেও শীত চলে যায়নি।

আমরা খ্রিস্টমাস ক্যারলে যাই এবং অন্য পরিবারগুলোকে লক্ষ্য করে দেখি। আমি মা, বাবা ও সন্তানদের দেখি। আমি তাদেরকে স্পষ্ট দেখতে পাই। এতোটাই স্পষ্ট যে, আমার মনে হয় বাইরের কোন অন্ধকারাচ্ছন্ন স্থান থেকে উজ্জ্বল আলোকিত জানালা দিয়ে তাদেরকে দেখছি। আমি সেই গল্পটিকে দেখি যেখানে পৃথিবীর পটভূমিতে তারা নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করছে। আমি ও আমার সন্তানেরা এখন আর এই গল্পের অংশ নই। আমাদের বসবাস ভিন্ন এক পৃথিবীতে। সেখানে সকলকিছুই বিপদজনকভাবে অগোছালো ও টুকরো টুকরো হয়ে আছে। এমনকি স্বাধীনতাও। পৃথিবীর অবিরত বিবর্তন হচ্ছে, কিন্তু পরিবারগুলো আগের মতোই রয়ে যাবার চেষ্টা করছে। সেগুলোকে প্রতিনিয়ত হালনাগাদ, পুনঃনির্মাণ ও আধুনিকীকরণ করা হলেও বাস্তবে তারা আগের মতোই রয়ে যাচ্ছে। ল্যান্ডস্কেপের বাড়ির দৃশ্যের মতো, যা একইসাথে বাসস্থান ও জেলখানা।

আমরা তিনজনে মিলে ক্যারল বা সংকীর্তন গাই। আমার স্মৃতির প্রাথমিক সময় হতে এই গানগুলো গেয়ে আসছি। বছরের পর বছর। প্রথমে গাইতাম ঐতিহ্য ভালোবাসে। গির্জার ভেতরের পিউ’তে (পেছনে হেলান দেয়ার সুবিধাসহ মেঝের সঙ্গে সংবদ্ধ বেঞ্চি) বসে। পরিবারের ছয় সদস্যের সাথে। পরবর্তীতে আমার যৌবনকালে, যখন আমি প্রখরভাবে নিজেকে নারীবাদী বলে ডাকতাম। তারও পরে স্ত্রী ও সন্তানদের মা হিসেবে, যখন আমার জীবনে প্রচলিত ও মৌলিক নীতিমালা, গল্প ও সত্য শত্রুর মতো আমার জীবনকে বিপন্ন করে তুলেছিলো। কর্কট রোগের মতো।

অন্য পরিবারগুলোর দিকে তাকিয়ে আমি আমাদের কলঙ্ক ও সম্মানহীনতাকে অনুভব করি। নিজেদেরকে মনে হয় বাড়িগুলোর ভেতরে অস্থায়ীভাবে পার্ক করা পরিযায়ী জিপসি ক্যারাভানগুলোর মতো। দেখি যে, আমরা ইতিমধ্যেই নিরাপত্তা ও নিশ্চয়তার কিছু কিছু উপাদানকে হারিয়ে ফেলেছি। দেখি যে, আমি এক ধরণের সম্মানকে প্রতিস্থাপিত করেছি অন্যধরণের সম্মান দিয়ে। একদল মূল্যবোধকে অন্যদল মূল্যবোধ দিয়ে। দেখি যে, আমরা পূর্বের চেয়ে অধিকতর মুক্ত। পূর্বের চেয়ে আমাদের গ্রহণ করার ক্ষমতা বেড়েছে। এই অবস্থায় পৃথিবী যদি নিজেকে উদার ও বিস্ময়কর স্থান হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করতে পারে, তাহলে আমরা তার বিস্ময়করতাকে অনুধাবন করতে সক্ষম।

সেই সকল কল্পিত আলোকিত জানালার মধ্য দিয়ে আমি লক্ষ্য করতে শুরু করলাম যে, ভেতরের লোকজনেরাও বাইরে তাকিয়ে আছে। নারীদের, স্ত্রীদের এবং মা’দেরকে দেখলাম বাইরে তাকিয়ে আছে। মনে হলো তারা খুবই সুখী, সন্তুষ্ট ও সমর্থ। তারা সুন্দর পোশাক পরে আকর্ষনীয়ভাবে তাদের পুরুষ ও সন্তানদের সাথে দাঁড়িয়ে আছে। তারপরেও তারা এদিক সেদিক তাকাচ্ছে এবং তাদের মুখগুলো নড়ছে। মনে হলো যে, কিছু একটা তারা হারিয়ে ফেলেছে অথবা খুঁজে পাচ্ছে না। আমি খুব ভালোভাবেই জানি যে, তাদের কি করা উচিৎ। কোন কোন সময়ে তাদের একজনের দৃষ্টি আমাকে অতিক্রম করে সামনের দিকে চলে যায়, এবং সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্যে আমাদের দুজনের দৃষ্টি পরস্পরের সাথে মিলিত হয়। সেই সময়ে আমি অনুভব করি যে, সে আমাকে দেখতে পাচ্ছে না। যদিও তার দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়ে আছে আমার দিকে। এর অর্থ এই নয় যে, সে আমাকে দেখতে চায় না। অথবা সে চেষ্টা করছে আমাকে না দেখার। সত্য হলো, গৃহের ভেতরটা এতোই উজ্জ্বল এবং গৃহের বাইরে এতোই অন্ধকার যে, সে বাইরে দেখতে পায় না। কিছুই দেখতে পায় না।



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ