গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ'এর গল্প : শ্রীমতী ফোর্বসের আনন্দঘন নিদানকাল



অনুবাদ : অমিতাভ রায়

বিকেলবেলায় আমরা দু'ভাই বাড়ি ফিরে আসা মাত্রই নজরে এল সদর দরজার ফ্রেমে গাঁথা রয়েছে সাপের মতো একটা বিশাল সামুদ্রিক প্রাণী। গলায় পেরেক মেরে সেটাকে ক্রুশের মতো দরজা লটকে দেওয়া হয়েছে। কালো রঙের উজ্জ্বল চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে আর ফাঁক হয়ে থাকা চোয়ালের ভিতর দেখা যাচ্ছে করাতের মতো ধারালো দাঁত। মনে হচ্ছিল বিষয়টা যেন জিপসিদের কোনও ভেলকির খেলা। আমার বয়স তখন বছর নয়েক। বিচিত্র প্রাণীটিকে দেখে আমার তো ভয়ে গলা শুকিয়ে কাঠ। আমার থেকে দু'বছরের ছোট ভাইটা ভয়ের চোটে তাড়াহুড়ো করে অক্সিজেন ট্যাংক, মুখোশ আর সাঁতার কাটার ডানা ফেলে দিয়ে চিৎকার করতে করতে দৌড় লাগাল। জেটি থেকে বাড়ি পর্যন্ত ছড়িয়ে থাকা শান বাঁধানো রাস্তাটা পেরিয়ে শ্রীমতি ফোর্বস তখন আকাবাঁকা সিঁড়ি দিয়ে উঠছিলেন। ভাইয়ের চিৎকার কানে আসায় উদ্বিগ্ন হয়ে তিনি হাঁপাতে হাঁপাতে আমাদের কাছে এলেন। তারপর দরজায় ক্রশবিদ্ধ প্রাণীটিকে দেখে বুঝতে পারলেন আমাদের ভয়ের কারণ। তিনি সবসময় বলতেন দু'ভাই যখন একসঙ্গে থাকে তখন তাদের একজন কোনও অন্যায় করলে দায়িত্ব দুজনেরই উপর বর্তায়। সেই কারণে ছোট ভাইয়ের চিৎকারের জন্যে আমাদের দুজনেরই বকুনি প্রাপ্য। আমাদের আচরণে আত্মসংযমের অভাব ফুটে ওঠায় দুজনকেই বকুনি দিলেন। ইংরেজিতে নয়, জার্মান ভাষায়। অথচ এটা কিন্তু তার চুক্তি শর্তবিরোধী। হয়তো তিনি নিজেও খুব ভয় পেয়েছিলেন এবং তা স্বীকার করতে চাইছিলেন না । অবশ্য পরমুহুর্তেই নিজেকে সামলে নিয়ে স্বমূর্তি ধারণ করলেন তিনি। কাঠখোট্টা ইংরেজিতে দিদিমণিসুলভ বিশেষ ভঙ্গিতে বললেন,--‘এটা সমুদ্রের পাঁকালমাছ। এগুলোকে বলে,—বানমাছ। এটার গ্রিক নাম মুরেনা হেলেনা। কারণ প্রাচীন গ্রিকরা একে পবিত্র প্রাণী বলে মনে করত।' 

হঠৎ শিশলের ঝোঁপের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল ওরেস্তো। স্থানীয় ছেলে ওরেস্তো আমাদের সাঁতার কাটা শেখাত। মুখে ডুবুরিরমুখোশ, সাঁতারের কস্ট্যুম আর কোমরের চওড়া বেল্টে আটকানো বিভিন্ন মাপের ছ’টি ছুরি। প্রয়োজনে সমসামনি লড়াই করে মাছ শিকারের জন্য এগুলো খুব দরকারি। এছাড়া অন্য কোনও উপায়ে শিকারের কথা সে কল্পনাও করতে পারে না। বছর বিশেকের ওরেস্তোর বেশির ভাগ সময় মাটির বদলে কাটত অস্থির জলের তলায়। ফলে সবসময়ই সারা শরীরে গ্রিজ মেখে তেলতেলে করে রাখা ওরেস্তোকে কোনও সামুদ্রিক প্রাণী বলেই মনে হতো। 

প্রথমবার ওকে দেখে শ্রীমতী ফোর্বস আমাদের মা-বাবাকে বলেছিলেন যে ওর থেকে বেশি সুন্দর কাউকে কল্পনাই করা মুশকিল। কিন্তু তাই বলে ওরেস্তোও তার কঠিন নিয়মের শাসন থেকে রেহাই পায়নি। মুরেনা নামের পবিত্র প্রাণীটিকে অর্থাৎ বানমাছটাকে শুধুমাত্র বাচ্চাদের ভয় দেখানোর জন্যে দরজায় টাঙিয়ে রাখার অপবাধে তাকে ইতালিয়ান ভাষায় যথেষ্ট গালি খেতে হয়। প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীটিকে দরজা থেকে খুলে ফেলতে বলে শ্রীমতী ফোর্বস আমাদের নৈশভোজের পোশাক পরে নিতে বললেন।

এতটুকুও ভুল না করে তাঁর নির্দেশ পালন করে আমরা ফিরে এলাম। শ্রীমতী ফোর্বসের শাসনের দু'সপ্তাহ কাটতে না কাটতেই আমরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছিলাম বেঁচে থাকা কী কঠিন। অন্ধকার স্নানঘবে স্নান করতে করতে আমার মনে হলো ভাই তখনও মারেনা সম্পর্কে ভেবে চলেছে। ও বলল—'মানুষের মতো চোখ'। সম্মতি জানালেও ওকে বোঝালাম উল্টোটাই সত্যি এবং কায়দা করে প্রসঙ্গ পালটিয়ে স্নান সেরে নিলাম। আমার সঙ্গে আসবে বলে রান্নাঘর থেকে বেরোবার মুহুর্তেও আমায় একটু দাঁড়াতে বলল।

‘এখনও দিনের আলো রয়েছে',—আমি বললাম । জানালার পর্দা টেনে দিলাম। অগস্টের মাঝামাঝি।

চাঁদের স্নিগ্ধ আলো চরাচরব্যাপী ছড়িয়ে পড়ায় জানালা দিয়ে দ্বীপের শেষতম প্রান্ত পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। ওদিকে সূর্যও যেন আকাশে থমকে গিয়েছে।

‘সে কারণে নয়, ভয় লাগতে পারে ভেবে আমার ভয় করছে’,--ভাইয়ের মন্তব্য।

খেতে যাওয়ার সময় কিন্তু ওকে বেশ শান্তই মনে হলো। খাবার টেবিলে যথাযথ আচরণ করার জন্যে শ্রীমতী ফোর্বস বিশেষ অভিনন্দন জানালেন ওকে। ওর সাপ্তাহিক প্রগতিপত্রে এর জন্যে জুড়ে দিলেন বাড়তি দু'নম্বর। দেরি হয়ে যাওয়ায় হাঁপাতে হাঁপাতে শেষ মুহুর্তে খাবার ঘরে পৌঁছানোর জন্যে আমার দু'নম্বর কাটা গেল। পঞ্চাশ পয়েন্ট জমলে পুংডিংএর পরিমাণ দ্বিগুণ হওয়ার কথা। কিন্তু আমরা কেউই পনেরো পয়েন্টের বেশি জমাতে পারিনি। সত্যি সত্যিই শ্রীমতী ফোর্বসের তৈরি পুডিংএর মতো সুস্বাদু খাবার খাওয়ার সুযোগ আর কখনও হয়নি।

রাতের খাওয়া শুরু করার আগে খালি প্লেট সামনে রেখে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে আমরা প্রার্থনা করতাম। শ্রীমতী ফোর্বস ক্যাথলিক না হওয়া সত্ত্বেও চাকরির শর্ত অনুসারে দিনে দু'বার আমাদের প্রার্থনা করাবার কথা। সেজন্যে তিনি শিখেও নেন প্রার্থনা পদ্ধতি। প্রার্থনা শেষ করার পর আমরা তিনজন একসঙ্গে খেতে বসতাম। আমাদের চালচলনের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমরা দম বন্ধ করে বসে থাকতাম। সবকিছু ঠিকঠাক মনে হওয়ার পর ঘণ্টা বাজাতেন তিনি। ঘণ্টাধ্বনি শুনেই আমাদের রাঁধুনি ফুলভিয়া ফ্লামিনিয়া একঘেঁয়ে বিনের স্যুপ নিয়ে খাবার ঘরে প্রবেশ করত।

প্রথম দিকে মা বাবার সঙ্গে থাকার সময় খাবার সময়টা ছিল উৎসবের মতো। ফুলভিয়া ফ্লামিনিয়া রীতিমতো হইচই করে খাবার পরিবেশন করত। সেই পরিবেশনের মধ্যে এমন একটা অগোছলো ভাব জড়িয়ে ছিল যা আমাদের জীবনের মাধুর্য বাড়িয়ে দিত। একেবারে শেষে সে-ও বসে পড়ত আমাদের সঙ্গে আর প্রত্যেকের প্লেট থেকে একটু একটু করে কিছু তুলে নিয়ে তার খাওয়া শেষ করত। কিন্তু যেদিন থেকে শ্রীমতী ফোর্বস আমাদের ভাগ্যনিয়ন্তা হয়ে এলেন সেদিন থেকে ফুলভিয়া ফ্লামিনিয়ার ওপর নেমে এল নিচ্ছিদ্র নীরবতা। খাবার পরিবেশনের সময় সসপ্যানের ফুটন্ত জলে বুদবুদ কাটার আওয়াজ পর্যন্ত শোনা যেত। চেয়ারে পিঠ ঠেকিয়ে মেরুদণ্ড সোজা করে টানটান হয়ে বসে চোয়ালের ডানদিক দিয়ে দশবার এবং বাঁদিক দিয়ে দশবার চিবিয়ে প্রতিটি গ্রাস খাবার খেতে হতো। নাগরিক শিষ্টতার পাঠ শেখানোর সময় কঠিন প্রকৃতির বিগত যৌবনা মহিলাটি অন্তর্ভেদী দৃষ্টি দিয়ে আমাদের বিদ্ধ করতেন। ঠিক যেন রবিবার গির্জায় গিয়ে প্রার্থনা করার মতো ব্যাপার। তবে একটাই পার্থক্য--খাবার টেবিলে কেউ গান গাইত না।

মুরেনা হেলেনা, মানে বানমাছটা দরজায় টাঙানো অবস্থায় যেদিন আমরা দেখি সেদিনই শ্রীমতী ফোর্বস আমাদের দেশাত্মবোধ সম্পর্কে শিক্ষা দিচ্ছিলেন। এমন সময় স্যুপ পরিবেশনের পরে ফুলভিয়া ফ্লামিনিয়া কাঠকয়লায় ঝলসানো মাছের টুকরো হাতে করে খাবার টেবিলে উপস্থিত হয়ে গুরুগম্ভীর আবহাওয়াটাকে লঘু করে দিল। ওর ঘরে ঢোকার ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছিল ও যেন হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে এল। মাছের চমৎকার গন্ধটা ক্যারিবিয়ান এলাকায় অবস্থিত আমাদের গুয়াকামায়াল-এর বাড়ির কথা মনে করিয়ে দিল। ওখানেই স্থলচর প্রাণী ও পাখির মাংসের বদলে মাছের দিকে আমার ঝোঁক বাড়ে। আমার ভাই কিন্তু পরখ না করে খাবারটা খেতে আপত্তি জানিয়ে বলল,-‘এটা আমার পছন্দ নয়।'

শ্রীমতী ফোর্বস তাঁর শিষ্টাচারের পাঠ থামিয়ে বললেন,--‘না খেলে জানবে কী করে? আগে খেয়ে তো দেখ।'

চোখের ইশারায় রাঁধুনিকে সতর্ক করার আগেই সে বলে ফেলল,--“বাছা বানমাছ হলো পৃথিবীর সেরা। খেয়েই দেখো না একবার।'

শ্রীমতী ফোর্বস শান্ত স্বরে এবং সহানুভূতিহীন ভঙ্গিতে আমাদের বলতে শুরু করলেন,--‘প্রাচীনকালে বানমাছ ছিল রাজারাজড়াদের খাবার। এই মাছ খেলে অস্বাভাবিক রকমের সাহস সঞ্চারিত হতো বলে যোদ্ধারা বানমাছ নিয়ে রীতিমতো লড়াই করত।’ এবার তিনি বলতে শুরু করলেন এই ক'দিনে বহুবার বলা সেই আপ্তবাক্য,--‘সুরুচি কোনও জন্মগত গুণ নয়। আবার যে কোনও বয়সে তা আয়ত্ত্বও করা যায় না। একমাত্র ছোটবেলাতেই তা শেখানো যায়।' সুতরাং বানমাছ খেতে না চাওয়ার কোনও যুক্তিসঙ্গত কারণ থাকতে পারে না। কোনও কিছু না জেনেই আমি কেন যে বানমাছ খেয়েছিলাম, এই প্রশ্ন চিরকাল রয়ে গেছে আমার মনে। বানমাছ খেতে শুরু করলেও দরজার ফ্রেমে লটকে থাকা মোলায়েম এবং বিষণ্ন চেহারার প্রাণীটির স্মৃতি ভীষণভাবে আমার খাওয়ায় বাধ সাধছিল। আমার ভাই অনেক কষ্টে প্রথম গ্রাসটি মুখে তুললেও সহ্য করতে না পেরে, সঙ্গে সঙ্গেই বমি করে ফেলল।

‘তাড়াতাড়ি ওদিকে যাও',--স্নানঘরের দিকে আঙুল উঁচিয়ে নিষ্পৃহভাবে বললেন শ্রীমতী ফোর্বস। ‘ভালো করে হাত-মুখ ধুয়ে আবার খেতে এসো।'

ভাইয়ের জন্যে আমার ভীষণ চিন্তা হচ্ছিল। সন্ধ্যার প্রথম ছায়াঘন অন্ধকারে পুরো বাড়ি পেরিয়ে স্নানঘরে গিয়ে ধোয়াধুয়ির জন্যে একা একা সময় কাটানো যে কিরকম ভয়ংকর তা আমার অজানা নয়। কিন্তু ভাই ধোয়ামোছার কাজটা চটপট সেরে জামা পালটিয়ে চলে এল। ওকে একটু ফ্যাকাশে লাগছিল। কোনও এক অজানা আশঙ্কায় বেচারি বেশ বিচলিত। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে শ্রীমতী ফোর্বসের কড়া নজর এড়িয়ে ও চেয়ারে বসে পড়ল। শ্রীমতী ফোর্বস মাছের এক টুকরো কেটে নিয়ে আমাদেরও তাকে অনুসরণ করতে বললেন। অতি কষ্টে দ্বিতীয় গ্রাসটাও মুখে তুললাম। ভাই তো আর ছুঁয়েও দেখল না ।

‘আমি খাব না',—ও এত দৃঢ়তার সঙ্গে আপত্তি জানাল যে শ্রীমতী ফোর্বস আর অগ্রাহ্য করতে পারলেন না।

শ্রীমতী ফোর্বস রায় দিলেন,--‘ঠিক আছে, ডেসার্টও পাবে না।'

ভাইয়ের দৃঢ়তায় আমিও সাহস সঞ্চয় করলাম। খাওয়া শেষ হয়ে গেলে যেভাবে প্লেটের ওপর কাটা আর ছুরি আড়াআড়ি করে রাখতে হয় বলে শ্রীমতী ফোর্বস শিখিয়েছিলেন, সেভাবেই কাটা আর ছুরি রেখে বললাম,--‘আমিও ডেসার্ট খাব না।'

‘তোমাদের টিভি দেখতে দেওয়া হবে না'—তিনি হুমকি দিলেন।

‘আমরা টিভি দেখব না’--জবাবে আমি বললাম।

শ্রীমতী ফোর্বস টেবিলের ওপর ন্যাপকিন রাখলেন। তিনজনেই প্রার্থনার জন্যে উঠে দাঁড়ালাম। প্রার্থনা শেষ হলে আমাদের তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়তে বললেন। কারণ, তাঁর খাওয়া শেষ হতে সময় লাগবে। আমাদের জমা হওয়া সব পয়েন্ট বাতিল হয়ে গেল। কুড়ি পয়েন্টের লক্ষ্য অনেক দূরে, একেবারে আমাদের নাগালের বাইরে চলে গেল। ক্রিম টার্ট, ভ্যানিলা পাই অথবা প্লাম প্যাস্ট্রির মতো সুস্বাদু ডেসার্ট খাবার সুযোগ আমাদের জীবন থেকে হারিয়ে গেল। কারণ, কুড়ি পয়েন্ট পেরোতে না পারলে এসব ডেসার্ট খাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করা যায় না।

আসলে একদিন না একদিন শ্রীমতী ফোর্বসের সঙ্গে সংঘাতটা অবশ্যম্ভাবী ছিল! সিসিলির প্রত্যন্ত দক্ষিণের পানতেলারিয়া দ্বীপে স্বাধীনভাবে গরমের ছুটি কাটানোর জন্যে আমরা পুরো এক বছর উন্মুখ হয়ে অপেক্ষা করছিলাম। মা-বাবা প্রথম মাসটায় আমাদের সঙ্গে ছিলেন। রৌদ্রস্নাত আগ্নেয়শিলার উপত্যকা, শাশ্বত সাগর, ইটের গাঁথনি পর্যন্ত পুরু চুনের আস্তরণ দেওয়া রঙিন ঘরবাড়ি এখনও স্বপ্নের মতো মনে পড়ে। বাতাসবিহীন রাতে জানালা দিয়ে দেখা যেত আফ্রিকার লাইটহাউস থেকে ভেসে আসা আলোকরশ্মির কাটাকুটি খেলা। দ্বীপের চারদিকে লুকোনো গভীর খাদে বাবার সঙ্গে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে আমরা আবিষ্কার করেছিলাম দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ডুবে যাওয়া সার দিয়ে সাজানো একগুচ্ছ টর্পেডো। সেখান থেকে প্রায় এক মিটার উঁচুতে প্রস্তরীভূত মালা পরানো একটা গ্রিক ঘরানার কুঁজোও উদ্ধার করেছিলাম, যার তলায় তলানি হিসেবে পড়েছিল বহু পুরোনো খানিকটা বিষাক্ত মদ। আমরা যে জমা জলে স্নান করছিলাম তা থেকে ধোঁয়া বেরোচ্ছিল। জলটা এত ঘন যেন তার উপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া যায়। 

অবশ্য ওখানে আমাদের সবচেয়ে বড় আবিষ্কার,--ফুলভিয়া ফ্লামিনিয়া। সুখী বিশপের মতো দেখতে ফুলভিয়া ফ্লামিনিয়াকে সবসময় ঘিরে থাকত একদল ঘুমকাতুরে বিড়াল। ওগুলো তার চলাফেরায় অনবরত বাধা সৃষ্টি করত। তার মতে বিশেষ কোনও প্রীতির জন্যে নয়, ইঁদুরের হামলা থেকে বাঁচার জন্যেই বিড়ালগুলোকে সহ্য করতে হয়। রাতের দিকে মা-বাবা টিভিতে বড়দের অনুষ্ঠান দেখতে বসার পর ফুলভিয়া ফ্লামিনিয়া আমাদের নিয়ে যেত তার বাড়িতে। দুটো বাড়ির মধ্যে দূরত্ব একশো মিটারের থেকেও কম। নিজের বাড়িতে বসে সুদুর তিউনিসিয়ার প্রান্তর থেকে ভেসে আসা বাতাসের গুঞ্জন থেকে গানের সুর আর কান্নার ধ্বনি ফুলভিয়া ফ্লামিনিয়া চিনতে শিখিয়েছিল আমাদের। 

ফুলভিয়ার স্বামী বয়সে তার থেকে অনেক ছোট। দ্বীপের অপর প্রান্তে গ্রীষ্মাবকাশ কাটাতে আসা পর্যটকদের হোটেলে কাজ করার জন্যে ফুলভিয়ার স্বামী বেশি রাতে শুধু ঘুমোবার জন্যে বাড়ি ফিরত। খানিকটা দূরে নিজের মা বাবার সঙ্গে থাকত ওরেস্তো। সদ্য ধরে আনা বড় বড় চিংড়ি আর অন্যান্য মাছ ঝুড়িতে করে ও নিয়মিত রাতের বেলায় নিয়ে এসে ফুলভিয়াদের রান্নাঘরে রেখে যেত, যাতে পরের দিন সকালে ফুলভিয়ার স্বামী সেগুলো হোটেলে বিক্রি করতে পারে। তারপর ওর ডুবুরির মুখোশের টর্চ জ্বালিয়ে পাহাড়ি ধেড়ে ইঁদুর শিকার করতে আমাদের নিয়ে যেত। খরগোশের মতো বড় বড় ইঁদুরগুলো রান্নাঘরের এঁটোকাটা খেতে আসত। অনেক সময়ই মা-বাবা ঘুমিয়ে পড়ার পর আমরা বাড়ি ফিরতাম। উঠোনে ফেলে রাখা খাবারের উচ্ছিষ্ট নিয়ে ইঁদুরদের কামড়াকামড়ির শব্দে আমাদের পক্ষে নিশ্চিন্তে ঘুমোনো কষ্টকর হত। এইসব অসুবিধাকে আমাদের সুখকর গরমের ছুটির এক মোহময় উপকরণ হিসেবে মেনে নিয়েছিলাম।

আমাদের জন্যে জার্মান গভর্নেস রাখার সিদ্ধান্ত একমাত্র বাবার পক্ষেই নেওয়া সম্ভব। ক্যারিবিয়ান এলাকার লেখক হিসেবে তিনি যতটা বড়াই করতেন তার ততটা প্রতিভা ছিল না। আমার ধারণা, ইয়োরোপের গৌরবের তলানি নিয়ে মোহাচ্ছন্ন আমার বাবা সবসময় তাঁর লেখায় ও নিজের জীবনে স্বকীয়তার পরিচয় স্বীকার করতে কুণ্ঠিত বোধ করতেন। আর ছেলেদের মন থেকে নিজের অতীতের সব চিহ্ন মুছে ফেলার এক অলীক বাসনা তিনি পোষণ করতেন। গুয়াহিরা-র মালভূমি এলাকায় ভ্রাম্যমাণ শিক্ষিকার কাজ করার জন্যে আমাদের মা নিজেকে অকিঞ্চিৎকর মনে করতেন। ফলে স্বামীর যে কোনও সিদ্ধান্তকেই অভ্রান্ত ও সকলের মঙ্গলের জন্যে বলে মনে করতেন তিনি। সুতরাং জার্মানির ডর্টমুন্ড প্রদেশের এক সার্জেন্টের হাতে আমাদের কী অবস্থা হতে পারে, এমন প্রশ্ন তাদের মাথায় আসেনি। ইয়োরোপীয় সমাজে বস্তাপচা আদবকায়দা জোর করে রপ্ত করানোর ফলে আমাদের অবস্থা কেমন হবে সে সম্পর্কে কোনও চিন্তা-ভাবনা না করে মা-বাবা রওনা দিলেন আজিয়ান সাগরের দ্বীপমালার উদ্দেশ্যে। ওখানে তখন চল্লিশজন লেখকের উপস্থিতিতে পাঁচ সপ্তাহব্যাপী এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়েছিল।

পালেরমো থেকে জুলাই মাসের শেষ শনিবারের ফেরি নৌকায় চড়ে শ্রীমতী ফোর্বস এসে পৌঁছোলেন। প্রথম দর্শনেই বোঝা গেল আমাদের উৎসবের দিন শেষ। পায়ে ফৌজি বুটজুতো, দুপুরের প্রচণ্ড গরমে গলাবন্ধ পোশাক পরিহিত শ্রীমতী ফোর্বসের মাথায় চাপানো ফেল্ট টুপির নিচে ছেলেদের মতো ছোট ছোট করে কাটা চুল আর গায়ে বাঁদরের পেচ্ছাপের গন্ধ। বাবা আগেই বলেছিলেন, ‘ইয়োরোপীয়দের গা থেকে গরমকালে এরকম গন্ধ বেরোয়। এটা সভ্যতার গন্ধ।' পরনে পরিচ্ছন্ন ফৌজি পোশাক থাকলেও শ্রীমতী ফোর্বস কিন্তু নিতান্তই নোংরা। আমাদের বয়স একটু বেশি হলে এবং তাঁর হৃদয়ে একটু স্নেহ-দয়া-মায়া থাকলে এত কিছু সত্ত্বেও তাঁর জন্যে আমরা কিঞ্চিৎ করুণা করতে পারতাম। তবে তাঁর আসার মুহুর্তে সবকিছুই পালটে গেল। 

গরম শুরুর সময়েই ভেবে রেখেছিলাম দিনে ঘণ্টা ছয়েক করে সাগরে কাটাব। শ্রীমতী ফোর্বস তা এক ঘণ্টায় নামিয়ে আনলেন। অর্থাৎ প্রতিদিন যে সময়টা সমুদ্রে কাটানোর ইচ্ছা ছিল তা তিনি ছ’ দিনে ভাগ করে দিলেন। মা-বাবা যখন আমাদের সঙ্গে ছিলেন তখন আমরা বহুক্ষণ ধরে সাঁতার কাটতাম। শুধু একটা ছুরি হাতে নিয়ে দুঃসাহস আর কৌশলকে হাতিয়ার করে কালি আর রক্তে ঘোলাটে হয়ে যাওয়া অক্টোপাসদের মুখোমুখি হয়ে ওরেস্তো যে সব কাণ্ডকারখানা ঘটাত তা আমরা অবাক বিস্ময়ে দেখতাম। বেলা এগারোটা নাগাদ ও মোটরবোট চালিয়ে আসত। কিন্তু শ্রীমতী ফোর্বস জলের তলায় সাঁতার শেখার জন্যে ওকে বাড়তি এক মুহূর্তও আমাদের সঙ্গে থাকতে দিতেন না। বাড়ির পরিচারিকার সঙ্গে মেলামেশা একেবারেই অনুচিত বলে রাতে ফুলভিয়া ফ্লামিনিয়ার বাড়িতে যাওয়াও নিষিদ্ধ হয়ে গেল। ইঁদুর শিকার করে হল্লা করার সময়টা নির্ধারিত হয়ে গেল শেকসপিয়রের রচনার বিশ্লেষণমূলক পাঠের জন্যে। অন্যের বাগানের আমগাছ থেকে আম চুরি বা গুয়াকামাল-এর রাস্তায় ঢিল ছুঁড়ে কুকুর মারার কাজে অভ্যস্ত আমাদের দু'ভাইয়ের পক্ষে শ্রীমতী ফোর্বসের আরোপ করা নিয়মানুবর্তিতা থেকে যন্ত্রণাপূর্ণ অন্য কিছু কল্পনা করা একেবারেই অসম্ভব হয়ে পড়ল।

তবে কিছুদিনের মধ্যেই আমরা লক্ষ করলাম শ্রীমতী ফোর্বস আমাদের বিষয়ে যতখানি কড়া নিজের সম্বন্ধে কিন্তু মোটেও তেমন নন। এটা বুঝে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের ওপর তাঁর কর্তৃত্বের ফাটল ধরতে শুরু করল। ওরেস্তো যখন জলের নিচে আমাদের ডুব সাঁতার শেখাত সেইসময় বেলাভূমিতে রঙিন ছাতার তলায় বসে ফৌজি পোশাক পরিহিত শ্রীমতী ফোর্বস পড়তেন শিলারের প্রেমসংগীত। তারপরে দুপুরে খাওয়ার সময়টুকু ছাড় দিয়ে ঘণ্টার পর ঘন্টা একনাগাড়ে তিনি ভদ্রসমাজের শিষ্টাচার সম্পর্কে ভাষণ দিয়ে যেতেন।

মোটরবোটে চড়িয়ে হোটেলের লাগোয়া পর্যটকদের দোকানগুলোয় নিয়ে যাওয়ার জন্যে একদিন ওরেস্তোকে অনুরোধ করলেন শ্রীমতী ফোর্বস্। সিলমাছের চামড়ার মতো কালো এবং ঘন ঘন রং বদলায় এমন একটা সাঁতারের পোশাক হাতে করে ফিরে এলেন তিনি। অবিশ্যি ওটা পরে তিনি কোনওদিনই জলে নামেননি। বালুকাবেলায় তিনি যখন রৌদ্রস্নান করতেন আমরা তখন সাঁতার কাটতাম। গা না ধুয়েই সরাসরি তোয়ালে দিয়ে ঘাম মুছতেন। সেইজন্যেই দিন তিনেকের মধ্যেই তাঁকে সেদ্ধ করা চিংড়িমাছের মতো দেখাত। তাঁর শরীর থেকে ছড়িয়ে পড়া সভ্যতার উৎকট গন্ধে আমাদের প্রায় দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম।

রাতে তাঁর ঘুম হত না। যেদিন থেকে তিনি আমাদের দেখাশোনার দায়িত্ব নিয়েছিলেন সেদিন থেকেই আমাদের মনে হতো অন্ধকার বাড়িতে কেউ যেন হাত দোলাতে দোলাতে হেঁটে বেড়াচ্ছে। ফুলভিয়া ফ্লামিনিয়ার কাছ থেকে অনেকবার শোনা জলে ডুবে মরে যাওয়া মানুষের প্রেতাত্মারা ঘুরে বেড়াচ্ছে ভেবে আমার ভাই ভয়ে আঁতকে উঠত। তবে কয়েকদিনের মধ্যেই আমরা আবিষ্কার করলাম রাতের চলমান প্রাণীটি শ্রীমতী ফোর্বস ছাড়া অন্য কেউ নয়। রাতে তিনি সত্যি সত্যিই এক নিঃসঙ্গ মহিলার জীবনযাপন করতেন। রাতের কার্যকলাপ নিশ্চয়ই তাঁর দিনের সত্ত্বার কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল না।

একদিন ভোরবেলায় নজরে এল তিনি রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে অপূর্ব ডেসার্ট তৈরি করছেন। তার পরনে ছোটখাটো একটা রাতপোশাক। সারাটা শরীর, এমনকি মুখ পর্যন্ত পাউডারে মাখামাখি। এক গেলাস পোর্ত মদে চুমুক দিতে দিতে তিনি এমন মনোবিকার প্রকাশ করছিলেন যা দেখলে তার অপর সত্ত্বা নিশ্চয়ই শিউরে উঠত। এই দৃশ্যটা দেখার পরেই জানতে পারলাম আমাদের ঘুমোতে পাঠিয়ে দিয়ে তিনি কিন্তু নিজের বিছানায় যান না। লুকিয়ে চলে যেতেন সাঁতার কাটতে বা গভীর রাত পর্যন্ত নিজের তৈরি ফ্রুট পাই তারিয়ে তারিয়ে খেতে খেতে টিভিটাকে শব্দহীন করে দিয়ে দেখতেন প্রাপ্তবয়স্কদের চ্যানেল। বিশেষ অনুষ্ঠানের জন্যে বাবা যে সব মদের বোতল সযত্নে সরিয়ে রাখতেন সেগুলি থেকেও মদ্যপান করতে তিনি ছাড় দিতেন না। কৃচ্ছসাধন এবং সংযম সম্বন্ধে তাঁর নিজের দেওয়া উপদেশের বিরুদ্ধাচারী এক অবাধ্য অনুভূতির তাড়না প্রতিহত করার জন্যে তাঁকে অবিরাম লড়াই চালাতে হত। পরে নিজের ঘরে বসে একা একা কথা বলতেও দেখা যেত তাকে। সুরেলা জার্মান ভাষায় তিনি ‘ডি ইয়ুংফ্রাউ ফন ওরলীন্স’-এর অংশ বিশেষ বারবার আবৃত্তি করতেন। 

কোনও কোনও দিন ভোরের আলো ফুটে ওঠার সময় পর্যন্ত তাঁর গান শোনা যেত। বিছানায় শুয়ে তাঁর ফুঁফিয়ে ফুঁফিয়ে কান্নার আওয়াজও পাওয়া যেত। সেইসব সকালে প্রাতরাশের সময় যখন তিনি খাওয়ার টেবিলে এসে বসতেন তখন তাঁর চোখ-মুখ ফুলে থাকত। তাঁর মুখের আদল এইভাবে উত্তরোত্তর করুণ হতে লাগল আর বাড়তে থাকল তাঁর শাসনের কড়াকড়ি। তখনকার মতো অসুখী আমরা আর কখনও বোধ করিনি। মেনে নিয়েছিলাম যে শেষ দিন পর্যন্ত তাঁকে সহ্য করতে হবে। কারণ, আমরা যাই করি না কেন শেষ পর্যন্ত তাঁর কথাই টিকে যাবে। তবে আমার ভাইয়ের একগুঁয়ে জেদি স্বভাবের জন্যে প্রায়ই লেগে যেত ওদের খটাখটি। সবমিলিয়ে অসহনীয় হয়ে উঠল আমাদের গ্রীষ্মাবকাশ। বানমাছের ঘটনাটায় আমাদের সঙ্গে শ্রীমতী ফোর্বসের সংঘাত পৌছে গেল চরম সীমায়। সেদিন রাতে নিস্তব্ধ বাড়িতে তাঁর বিরামহীন পদচারণার শব্দ শুনতে শুনতে মনের মধ্যে জমে থাকা যাবতীয় ঘৃণা প্রকাশ করে বসল আমার ভাই।

সে বলল,-“আমি ওকে খুন করব।’

ওর এই সিদ্ধান্তে আমি যতটা না অবাক হলাম তার থেকেও অনেক বেশি আশ্চর্য হলাম এই ভেবে যে নৈশভোজ পর্ব চুকে যাওয়ার পর থেকে আমিও হেলাফেলা করে এই কথাটা নিয়েই চিন্তা করছিলাম। তবুও মুখে আমার ভাইকে নিরস্ত করার চেষ্টা করে বললাম, ‘তোমার মাথা কেটে নেবে।'

উত্তরে ও জানাল,--‘সিসিলিতে গিলোটিন নেই। তাছাড়া হত্যাকারীকে কেউ চিনতে পারবে না।’

সমুদ্র থেকে উদ্ধার করে আনা কুঁজোটার কথা ও ভাবছিল। যার মধ্যে তখনও ছিল বিষাক্ত মদের অবশেষ। বিষের চরিত্র বিশ্লেষণের জন্যে বাবা কুঁজোটা সাবধানে সরিয়ে রেখেছিলেন। তাঁর মতে পুরোনো হয়ে গেলেই মদ বিষিয়ে যেতে পারে না। শ্রীমতী ফোর্বসকে হত্যা করার জন্যে এই মদ ব্যবহার করা হলে কেউ সন্দেহ করবে না যে দুর্ঘটনা বা আত্মহত্যা জনিত কারণে মৃত্যুটা ঘটেনি। অতিরিক্ত রাত্রি জাগরণের ফলে ক্লান্ত হয়ে শ্রীমতী ফোর্বস ঘুমিয়ে পড়ার পরে একদিন ভোরবেলায় আমরা কুঁজোটা থেকে বিষাক্ত মদের তলানি মিশিয়ে দিলাম বাবার বিশেষ মদের বোতলে। পরে জানা যায় যে-পরিমাণ বিষাক্ত মদের তলানি মিশিয়ে দেওয়া হয়েছিল তা একটা ঘোড়ার মৃত্যুর পক্ষে যথেষ্ট। 

ঠিক ন'টা বাজার সঙ্গে সঙ্গেই শ্রীমতী ফোর্বস প্রাতরাশ হিসেবে পরিবেশন করলেন ছোট ছোট মিষ্টি রুটি। ফুলভিয়া ফ্লামিনিয়া খুব ভোরে ওগুলো ওভেনে তৈরি করে রেখে গিয়েছিল। বোতলে বিষাক্ত মদ মিশিয়ে দেওয়ার দিন দুই পরে হতাশ হয়ে ভাই আমায় দেখাল আলমারিতে রাখা বোতলটা তখনও ছোঁয়া হয়নি। এটা কোনও এক শুক্রবারের কথা। সপ্তাহান্তেও অবস্থার কোনও পরিবর্তন হলো না। মঙ্গলবার রাতে টিভিতে অশ্লীল অনুষ্ঠান দেখতে দেখতে শ্রীমতী ফোর্বস বিষাক্ত মদের বোতলের অর্ধেকটা শেষ করে দিলেন।

বুধবার সকালে অন্যান্য দিনের মতো ঠিকসময়েই প্রাতরাশের জন্যে চলে এলেন খাবার টেবিলে। অন্যদিনের মতোই মুখচোখে অনিদ্রার ছাপ। চশমার পুরু কাচের ভেতর দিয়ে দেখা যাচ্ছিল সদা উদ্বিগ্ন এক জোড়া চোখ। রুটির ঝুড়িতে রাখা জার্মানির ডাকটিকিট সাঁটা একটা খাম দেখে তার চোখ দুটো আরও উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল। কফি খেতে খেতে চিঠি পড়তে শুরু করলেন। যদিও এমনটা করতে বহুবার বারণ করেছিলেন আমাদের। পড়ার সময় চিঠিতে লেখা শব্দের থেকে বিচ্ছুরিত আলোর ঝলক তাঁর মুখের ওপর খেলে যাচ্ছিল। চিঠি পড়া শেষ হলে খাম থেকে ডাকটিকিটগুলো ছিড়ে নিয়ে রুটির ঝুড়িতে রেখে দিলেন। ওগুলো ফুলভিয়া ফ্লামিনিয়ার স্বামীর জন্যে রাখা হলো। 

সকালের বিরূপ অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও জলের তলায় অভিযানের জন্যে আমাদের সঙ্গে বেরোলেন। জলের তলায় সাঁতরাতে সাঁতরাতে অগভীর এলাকায় পৌঁছানোর পর অক্সিজেনের ট্যাঙ্কে টান পড়তে শুরু করল। শিষ্টাচারের পাঠ ছাড়াই সেদিন আমরা বাড়ি ফিরে এলাম। সারাটা দিনই কুমারী ফোর্বস ফুরফুরে মেজাজে ছিলেন। আর নৈশভোজের সময় তো তাকে আগের থেকেও চনমনে মনে হচ্ছিল। আমার ভাই আর হতাশা চেপে রাখতে পারছিল না। খাওয়া শুরুর নির্দেশ পাওয়া মাত্রই আপত্তিজনক ভঙ্গি করে ও সরিয়ে রাখল বিনের স্যুপ। ‘এসব বাজে জিনিস আমি খাই না।'

খাওয়ার টেবিলে যেন বোমা ফাটল। আবহাওয়া হালকা না হওয়া পর্যন্ত শ্রীমতী ফোর্বসের মুখ ফ্যাকাশে আর ঠোঁট শক্ত হয়ে থাকল। তার চশমার কাচ কান্নায় ঝাপসা হতে শুরু করল। চোখ থেকে চশমা নামিয়ে নিয়ে ন্যাপকিন দিয়ে মুছে রেখে দিলেন টেবিলের ওপর। তারপর অসম্মানজনক পরাজয়ের তিক্ততা প্রকাশ করে বললেন,-‘-তোমাদের যা ইচ্ছা, তা-ই করো।'

সন্ধে সাতটা নাগাদ তিনি নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে দিলেন। প্রায় মাঝ রাতে আমাদের নজরে এল তিনি আধখানা চকোলেট আর বিষাক্ত মদের বোতলটা নিয়ে খাওয়ার ঘরের থেকে বেরিয়ে চলেছেন নিজের ঘরের দিকে। তিনি হয়তো ভেবেছিলেন আমরা ঘুমিয়ে পড়েছি। তার পরনে কিশোরীদের মতো ছোটখাটো রাতপোশাক। বোতলে তখনও আঙুল চারেক বিষাক্ত মদ রয়েছে। তার জন্যে করুণাবশত আমার হৃৎকম্প শুরু হলো। ‘বেচারি শ্রীমতী ফোর্বস'--নিজের অজান্তেই আমি বলে ফেললাম।

আমার ভাইও নিশ্চিন্ত হয়ে নিঃশ্বাস নিতে পারছিল না। সে বলে উঠল,--‘আজ রাতে মারা না গেলে আমাদের অবস্থা কাহিল হয়ে যাবে।’

সারা রাত ধরে তিনি আপন মনে উন্মাদের মতো অনেক কথা বলে গেলেন। উচ্চ কণ্ঠে আবৃত্তি করে গেলেন শিলারের কবিতা আর সবশেষে তারস্বরে চিৎকার করে সারা বাড়ি মাতিয়ে তুললেন। এরপর এল গভীর নিঃশ্বাসের শব্দ, যা কোনও দিশাহীন নৌকোর তীক্ষ্ণ হুইসলের মতো একটানা বাজার পর আস্তে আস্তে বিলীন হয়ে গেল। রাত্রি জাগরণ এবং মানসিক টানাপোড়েনের ক্লান্তি সকালে ঘুম থেকে ওঠার পরেও আমরা কাটিয়ে উঠতে পারিনি। খড়খড়ির ফাঁক দিয়ে আসা সূর্যের তীব্র রশ্মি যেন ছুরির ফলার মতো আমাদের গায়ে এসে বিঁধছে। আর চারপাশের হালচাল দেখে মনে হচ্ছে ঘরটা কোনও পুকুরের তলায় তলিয়ে গেছে। তখনই প্রথম লক্ষ করলাম দশটা বাজতে চলেছে এবং শ্রীমতী ফোর্বস আমাদের ঘুম ভাঙাতে আসেননি। আটটা নাগাদ স্নানঘর বা মুখ ধোয়ার বেসিনে জল পড়ার আওয়াজ আমাদের কানে আসেনি। ঘোড়ার নাল লাগানো বুট জুতো বা ক্রীতদাস কারবারিদের মতো হাতের তালু দিয়ে দরজায় তিনবার সশব্দে চাপড় মারার আওয়াজও শোনা যায়নি। নিঃশ্বাস বন্ধ করে আমার ভাই দেওয়ালে কান ঠেকিয়ে পাশের ঘরের সাড়াশব্দ শোনার চেষ্টা করছে। পরীক্ষা শেষ করার পর নিঃশ্বাস ফেলে ও উল্লসিত হয়ে বলল,--‘যা চাইছিলাম, ঠিক তাই। সমুদ্র ছাড়া আর কোনও কিছুর শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না।’

এগারোটার একটু আগে নিজেরাই আমাদের প্রাতরাশ তৈরি করে খেয়ে নিলাম। একপাল বিড়াল নিয়ে ফুলভিয়া ফ্লামিনিয়া আমাদের বাড়ি-ঘর-দোর পরিষ্কার করতে আসার আগেই আমরা দু'ভাই দুটো করে অক্সিজেন ট্যাঙ্ক নিয়ে সমুদ্রের ধারে রওনা দিলাম। সঙ্গে নেওয়া হলো আরও দুটো বাড়তি ট্যাঙ্ক। ওরেস্তো তখন জেটিতে বসে সদ্য ধরে আনা একটা পাঁচ-ছ’ পাউন্ড ওজনের বিশাল মাছকে কেটেকুটে নাড়িভুড়ি পরিষ্কার করতে ব্যস্ত। ওরেস্তোকে জানালাম যে আমরা বেলা এগারোটা পর্যন্ত শ্রীমতী ফোর্বসের ঘুম ভাঙার জন্যে অপেক্ষা করে নিজেরাই সমুদ্রের দিকে রওনা দিয়েছি। ওরেস্তোকে আরও বললাম যে গতরাতে খাওয়ার টেবিলে বসে তিনি অঝোরধারায় কাঁদছিলেন। সেই কারণেই হয়তো তার ভালো ঘুম হয়নি এবং তিনি বিশ্রাম নিতে চাইছেন। আমাদের ধারণাকে কোনও গুরুত্ব না দিয়ে ওরেস্তো এক ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে আমাদের সঙ্গে জলের তলায় তোলপাড় করে বেড়ালো। তারপর আমাদের জল থেকে উঠে পড়ার নির্দেশ দিয়ে নিজে ছোট মোটর বোট চড়ে মাছ বিক্রি করতে চলে গেল পর্যটকদের হোটেলের দিকে। বাঁধের আড়ালে তার অদৃশ্য না হওয়া পর্যন্ত আমরা পাথরের সিঁড়ি থেকে হাত নেড়ে তাকে বিদায় জানাতে থাকলাম যাতে সে ভাবে আমরা বাড়ি ফিরে যাওয়ার জন্যে প্রস্তুত। সে অদৃশ্য হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কারও অনুমতির অপেক্ষা না করে অক্সিজেন ট্যাঙ্ক পিঠে লাগিয়ে নিয়ে আমরা আবার সাঁতার কাটতে শুরু করে দিলাম।

মেঘলা দিন, দিগন্তে কালো মেঘের আড়ালে বজ্র নির্ঘোষ। শান্ত ও স্বচ্ছ সমুদ্র নিজের আলোয় উদ্ভাসিত। পানতেলারিয়ার লাইটহাউস পর্যন্ত জলের ওপর সাঁতার কেটে ডানদিকে একশো মিটারের মতো বাঁক নিয়ে হিসেব করে জলের তল ডুব দিলাম যেখানে গ্রীষ্মের সূচনালগ্নে একগুচ্ছ জঙ্গি টর্পেডো দেখা গিয়েছিল। উজ্জ্বল হলুদ রঙের ছ'টি টর্পেডো। তাদের ক্রমিক সংখ্যাগুলোও অবিকৃত। নিখুঁত শৃঙ্খলায় টর্পেডোগুলি এমনভাবে পরপর সাজানো ছিল যা নিজে থেকে ঘটতে পারে বলে মনে হলো না। এবার জলমগ্ন সেই শহরের সন্ধানে লাইটহাউসের চারপাশে সাঁতরে বেড়ালাম। ফুলভিয়া ফ্লামিনিয়া অনেক আগ্রহ নিয়ে এই শহরটার কথা আমাদের বলেছিল। অবিশ্যি শেষ পর্যন্ত শহরটার কোনও হদিশ পাওয়া গেল না। ঘণ্টা দুয়েক বাদে যখন মনে হলো আর নতুন কোনও রহস্য উদঘাটনের কাজ বাকি নেই তখন শেষবারের মতো অক্সিজেন ট্যাঙ্কে নিঃশ্বাস নিয়ে জল থেকে উঠে এলাম।

আমাদের সাঁতার কাটার সময় গরমকালের স্বাভাবিক ঝড় ওঠায় সমুদ্র অশান্ত হয়ে পড়ে। একঝাক পাখি হিংস্র চিৎকার করতে করতে মাংসের লোভে সমুদ্রের তীরে ভেসে আসা মৃতপ্রায় মাছগুলির ওপর চক্রাকারে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। শ্রীমতী ফোর্বস সঙ্গে না থাকায় জীবনকে মনে হচ্ছিল রীতিমতো সুন্দব আর বিকেলের ঢলে পড়া সূর্যালোককে লাগছিল একেবারে নতুন। এতকিছু সত্ত্বেও বাঁধের সিঁড়ি দিয়ে কষ্ট করে উপরে ওঠার পর নজরে এল বাড়ির সামনে অনেক লোকের ভিড় আর সদরের সামনে দাড়িয়ে আছে দু'টো পুলিশের গাড়ি। ঠিক তখনই খেয়াল হলো আমরা কী করেছি। আমার ভাই তো ভয়ে কাঁপতে শুরু করল। ও ফিরে যেতে চাইল। ‘আমি ভেতরে ঢুকব না’,--ও বলল।

আমার মাথাও যে ঠিকমতো কাজ করছিল তা নয়। তবে একটা বিষয় পরিষ্কার বুঝতে পারছিলাম যে বাড়ির ভেতরে গিয়ে আমাদের মৃতদেহটা দেখা দরকার যাতে আমাদের কেউ সন্দেহ না করে। | ‘ব্যাপারটাকে সহজভাবে মেনে নেওয়া দরকার’,--আমি পরামর্শ দিই। ‘বড় করে নিঃশ্বাস নে আর একটা কথা খেয়াল রাখিস যে এ ব্যাপারে আমরা কিছুই জানি না।'

আমাদের দিকে কেউ তাকাল না। দরজার সামনে অক্সিজেন ট্যাঙ্ক, ডুবুরির মুখোশ এবং সাঁতার কাটার যাবতীয় সাজসরঞ্জাম নামিয়ে রেখে পাশের করিডর দিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। ক্যাম্পখাটের পাশে মেঝেতে বসে দু'জন সৈন্য সিগারেট খাচ্ছে। পিছনের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে একটা অ্যাম্বুলেন্স আর বন্দুক হাতে কয়েকজন সৈন্য। বসার ঘরের দেওয়ালের পাশে পাড়ার মহিলারা সমবেত হয়ে দক্ষিণ ইতালির নিজস্ব উপভাষায় প্রার্থনা করে চলেছেন আর তাদের স্বামীরা এমন কোনও বিষয় নিয়ে উত্তেজিত আলোচনা করছিলেন যা এই মৃত্যুর সঙ্গে যুক্ত নয়। ভাইয়ের হিমশীতল হাত শক্ত করে চেপে ধরে পিছনের দরজা দিয়ে ঢুকলাম বাড়ির ভেতর। আমাদের শোওয়ার ঘরের দরজা তখনও খোলা। আর ঘরের ভেতরের অবস্থা সকালে আমরা যেমন রেখে গিয়েছিলাম ঠিক তেমনি রয়েছে। পরের ঘরটাই শ্রীমতী ফোর্বসের। খোলা দরজার সামনে পাহারায় রয়েছে একজন বন্দুকধারী সৈন্য। ভয়ে ভয়ে দুরু দুরু বক্ষে ঘরটার ভেতরে উঁকি মারতে যাওয়ার ঠিক আগের মুহুর্তে ফুলভিয়া ফ্লামিনিয়া রান্নাঘর থেকে বিদ্যুতের মতো ছিটকে বেরিয়ে এসে ভয়ার্ত চিৎকার করে দরজাটা বন্ধ করে দিল।

“ভগবানের দোহাই, এই দৃশ্য দেখো না।’

ততক্ষণে বেলা গড়িয়ে প্রায় সন্ধে হতে চলেছে। ক্ষণেকের জন্যে সেদিন যা দেখেছিলাম সারা জীবনেও তা ভুলতে পারিনি। দু'জন সরকারি কর্মচারী একটা ফিতে দিয়ে খাট থেকে দেওয়ালের দূরত্ব মাপছিলেন আর একজন লোক পেশাদার ফোটোগ্রাফারের মতো কালো কাপড়ের ভেতর মাথা গলিয়ে ছবি তুলছিলেন। লণ্ডভণ্ড বিছানায় শ্রীমতী ফোর্বকে দেখা গেল না। তাঁকে বিছানা থেকে টেনে মেঝেতে নামানো হয়েছে। অজস্র ছুরির আঘাতে ক্ষতবিক্ষত তার নগ্ন শরীরের চারদিকে ছড়িয়ে থাকা শুকনো রক্তে লাল হয়ে গেছে ঘরের মেঝে। প্রচণ্ড উন্মাদনায় কেউ তাকে ছুরি দিয়ে সাতাশবার মারাত্মক আঘাত করেছিল। অতৃপ্ত প্রেমই যে এই হত্যাকাণ্ডের মূল কারণ, তা সকলের কাছে স্পষ্ট। সম্পূর্ণ সচেতন অবস্থায় কোনওরকম চিৎকার বা কান্নার আওয়াজ না করে, সৈনিকের মতো সুন্দর কণ্ঠে শিলারের কবিতা আবৃত্তি করতে করতে এই গ্রীষ্মকালে এটাই যেন তাঁর সুখের অনিবার্য প্রাপ্তি এমন কিছু ভেবে নিয়ে তীব্র আকুতিতে ফোর্বস্ মেনে নিয়েছিলেন চূড়ান্ত আঘাত।


মূল শিরোনাম : El verano feliz de la señora Forbes

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ