অনুবাদ: উৎপল দাশগুপ্ত
সেদিনের দুপুরটা স্কারলেটের সারাজীবন মনে থাকবে। অসহ্য গরম, তার ওপর মাছি ভনভন করে চলেছে। মেলানিকে হাওয়া করতে থাকলেও মাছিগুলো জ্বালাতন থেকে নিষ্কৃতি নেই। দুপুরটা মনে হচ্ছিল আর ফুরোবেই না। চওড়া তালপাতার পাখা চালাতে চালাতে হাত ওর ব্যথা হয়ে গেছে। সব চেষ্টাই বৃথা। মেলানির স্যাঁতস্যাঁতে মুখ থেকে সরিয়ে দিলেই মাছির দল ভিড় করছে ওর চটচটে পায়ে আর হাঁটুতে। দুর্বল পা নাচিয়ে সেগুলো সরাতে না পেরে ক্ষীণ কণ্ঠে মেলানি বলে উঠছে, “দেখ দেখ, আবার পায়ে গিয়ে বসেছে!”
ঘরটা প্রায় অন্ধকার। আলো আর গরম থেকে নিস্তার পাবার জন্য স্কারলেট পর্দাগুলো নামিয়ে দিয়েছে। পর্দার ফাঁক আর ফুটো দিয়ে তবুও আলো ঢুকে পড়ছে। ঘরটা মনে হচ্ছে যেন এক জ্বলন্ত চুল্লী। ঘামে ভেজা জামাকাপড় শুকোনো তো দূরস্তান, নতুন করে ভিজে যাচ্ছে। প্রিসি এক কোনে গুটিসুটি মেরে বসে আছে। ঘামে ভিজে ওর গা থেকে এমন বোটকা গন্ধ বেরোচ্ছে যে স্কারলেটের ওকে ঘর থেকে বের করে দিতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু চোখের আড়াল হলেই ও পাছে চম্পট দেয়, সেটা কিছু বলতে পারছিল না। মেলানি শুয়ে শুয়ে ঘামছে – মাঝে মাঝে স্কারলেট জল দিয়ে মুছিয়ে দিচ্ছে। তার ফলে জল গড়িয়ে পড়ে বিছানার চাদরটাও ভিজে উঠেছে। ওর শরীরটা কুঁকড়ে কুঁকড়ে উঠছে – একবার ডানদিকে তো একবার বাঁদিকে।
উঠে বসার চেষ্টা করতে গিয়ে শরীরটা কুঁকড়ে গেল মেলানির। এতক্ষণ ঠোঁট কামড়ে কান্নাটাকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করায়, দাঁতের দাগ বসে গেছে। স্কারলেট আর স্নায়ুর ওপর চাপটা সহ্য করতে পারল না। হিসহিসিয়ে বলল, “দয়া করে মেলানি, আর অত সাহস দেখানোর চেষ্টা কোরো না। চেঁচিয়ে উঠতে ইচ্ছে করলে তাই ওঠো। এখানে আমরা ছাড়া আর কেউ নেই যে শুনতে পাবে!”
সাহস দেখানোর ইচ্ছে থাকুক চাই নাই থাকুক, বেলা যত বাড়তে লাগল, মেলানি কখনও মৃদুস্বরে গোঙাতে থাকল, কখনও আবার চেঁচিয়ে উঠল। যখন অসহ্য হয়ে পড়ছিল, স্কারলেট হাতে মাথা রেখে কানদুটো চেপে ধরছিল আর মনে মনে নিজের মৃত্যু কামনা করছিল। এই অসহায় যন্ত্রণা দেখার চেয়ে মরে যাওয়াই ভাল। একটা শিশুর ভূমিষ্ঠ হওয়ার জন্য এ যেন এক অনন্ত প্রতীক্ষা! এদিকে ফাইভ পয়েন্টে ইয়াঙ্কিরা সত্যি সত্যিই এসে পড়েছে!
মহিলারা যখন বাচ্চা হওয়ানো নিয়ে নিজেদের মধ্যে কানাকানি করত, কেন যে তখন সেগুলো ভাল করে শুনে রাখেনি, কে জানে? কি আফসোস! তাহলে অন্তত বোঝা যেত এখন মেলানির যে অবস্থা সেটা স্বাভাবিক না চিন্তার বিষয়। এত সময় কি লাগতে পারে? আন্ট পিটির মুখেই শোনা একটা ঘটনা আবছা মনে পড়ছে – কার জানি দু’দিন ধরে প্রসব বেদনা উঠে তারপর বাচ্চা না হয়েই বেচারা মারা গেল। যদি মেলানিরও দুদিন ধরে এরকম চলতে থাকে! কিন্তু মেলানি এত রুগ্ন! দুদিন ধরে এই ব্যথা সহ্য করা ওর পক্ষে মুশকিল। বাচ্চাটা তাড়াতাড়ি না হলে ও যে মরেই যাবে! অ্যাশলের কাছে তখন মুখ দেখাবে কেমন করে? কে জানে অ্যাশলে এখনও বেঁচে আছে কিনা! কি করে বলবে যে মেলানি মরে গেছে – ও যে কথা দিয়েছিল যে মেলানির দিকে নজর রাখবে?
যন্ত্রণা তীব্র হলে, প্রথম দিকে, মেলানি স্কারলেটের হাতটা খুব জোরে চেপে ধরবার চেষ্টা করছিল। স্কারলেটের মনে হচ্ছিল হাড়ই বোধহয় ভেঙ্গে যাবে। একটু পরে হাতটা এমন ফুলে গেল, যে ও নাড়াতেই পারছিল না। দুটো তোয়ালে গিঁট দিয়ে এক প্রান্ত খাটের সঙ্গে বেঁধে দিয়ে অন্য প্রান্ত মেলানির হাতে ধরিয়ে দিল। সেটাই ধরে, ছেড়ে, টেনে মেলানি ব্যথা সামলাতে লাগল। ফাঁদে পড়া জন্তু জানোয়াররা ছাড়া পাওয়ার জন্য যেরকম আর্তনাদ করে, সারা দুপুর ধরে মেলানির মুখ থেকে সে রকমই গোঙানির শব্দ বেরোতে লাগল। মাঝে মাঝে তোয়ালেটা ফেলে দিয়ে দুর্বলভাবে হাতে হাত ঘষে করুণ চোখে স্কারলেটের দিকে তাকিয়ে রইল।
“কথা বল, আমার সাথে কিছু কথা বল,” ফিসফিস করে মেলানি স্কারলেটকে বলতেই থাকত। স্কারলেটও হাবিজাবি কিছু বলে যেতে থাকত। একসময় মেলানি যন্ত্রণায় কাতর হয়ে আবার তোয়ালেটা তুলে নিয়ে টেনে ধরত।
গরম, হতাশা আর মাছির জ্বালায় দুপুরটা এত মন্থর গতিতে চলছিল যে স্কারলেট সকালের কথাও মনে করতে পারছিল না। ওর মনে হচ্ছিল সারা জীবন ধরেই যেন ও এই রকম গরম, হতাশা আর ঘামে ভেজা শরীর নিয়ে বসে আছে। মেলানির সাথে সাথে ওরও আর্তনাদ করে উঠতে ইচ্ছে করছিল, কিন্তু কোনও রকমে দাঁতে ঠোঁট কামড়ে ধরে নিজেকে সামলাচ্ছিল।
একটা সময় ওয়েড পা টিপে টিপে ওপরে এসে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল, “ওয়েডের খিদে পেয়েছে”। ও উঠে ওয়েডের কাছে যাচ্ছিল। মেলানি ওর হাত চেপে ধরে মিনতি করল “আমাকে ছেড়ে যেও না প্লীজ়। তুমি কাছে থাকলে তবু ব্যথাটা সহ্য করতে পারি।”
অগত্যা প্রিসিকেই নীচে পাঠাতে হল ব্রেকফাস্ট গরম করে ওকে খাইয়ে দেবার জন্য। আর মনে হল এই দুপুরের পরে নিজে আর কোনোদিনই মুখে কোনও খাবার ছোঁয়াতে পারবে না।
তাকের ওপর রাখা ঘড়িটা বন্ধ হয়ে গেছিল, তাই কটা বেজেছে ওর বোঝার কোনও উপায় নেই। আগুনের হল্কা আর আলোর তেজ কমে এসেছে। পর্দা সরিয়ে স্কারলেট আশ্চর্য হয়ে গেল। পড়ন্ত বিকেলের আকাশে সূর্যের রঙে হাল্কা লালচে আভা লেগেছে। যাক, সন্ধ্যে নামছে তাহলে! এই দুপুর তো অফুরন্ত মনে হচ্ছিল!
শহরে কি হচ্ছে কে জানে। পুরো ট্রুপ কি শহর ছেড়ে চলে গেল? বিনা লড়াইতেই? কত কম সৈন্য কনফেডারেট বাহিনীতে! তার তুলনায় শেরম্যানের বাহিনীতে লড়াই করার জন্য অগুনতি জওয়ান। ওরা কনফেডারেট জওয়ানদের মত ভুখাপেট নয়। শেরম্যানের নামটা মনে পড়লেই স্কারলেট আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে। স্বয়ং শয়তান এলেও ও এতটা ভয় পেত না। নাহ্, এসব আবোলতাবোল ভেবে কি লাভ! মেলানি জল চাইছে। ঠাণ্ডা তোয়ালে দিয়ে মাথাটা ওর মুছিয়ে দিতে হবে। মাছি তাড়ানোর জন্য বাতাস করাও দরকার।
সন্ধ্যে ঘনিয়ে এলে প্রিসি ঠিক ভূতের মত এসে ল্যাম্প জ্বালিয়ে দিল। মেলানি আরও দুর্বল বোধ করছে। বার বার অ্যাশলের নাম ধরে ডেকে ডেকে প্রলাপ বকছে। স্কারলেটের রীতিমত একঘেয়ে লাগছে। খুব ইচ্ছে হল বালিশের মধ্যে ওর মুখটা চেপে ধরে। ডাকাডাকিটা যাতে বন্ধ হয়। ডাক্তার আসতে পারবেন নিশ্চয়ই। একটু যদি তাড়াতাড়ি আসেন! প্রিসিকে ডেকে তাড়াতাড়ি মীডদের বাড়ি পাঠাল। ডঃ আর মিসেজ় মীড ফিরেছেন কিনা জানার জন্য।
“আর যদি দেখিস ডঃ মীড ফেরেন নি, তাহলে মিসেজ় মীড অথবা কুকির কাছ থেকে জেনে আসবি কি করতে হবে। ওঁদের একবারটি আসতে বলবি!”
শুনেই প্রিসি দৌড় লাগাল। জানলা দিয়ে দেখে স্কারলেট ভাবল ওই বিচ্ছুটা এত জোরে দৌড়োতে পারে সেটা ওর জানাই ছিল না। বেশ অনেকক্ষণ পরে ও ফিরল। একাই।
“ডঃ মীড এখনও ফেরেন নি। বলে পাঠিয়েছেন উনি সৈন্যদের সঙ্গে আছেন। আর – মিস স্কারলেট – মিস্টার ফিল মারা গেছেন।”
“মারা গেছে?”
“হ্যা ম্যাম,” প্রিসি বলল খুব গম্ভীরভাবে। ট্যালবট – ওদের কোচওয়ান আমাকে বলল। ওকে গুলি ____”
“ঠিক আছে – তোর ওই নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার নেই।”
“মিস মীডের দেখা পাইনি – কুকি বলল – মিসে মীড ওকে চান করাচ্ছেন – কবর দেবার জন্য – ইয়াঙ্কিরা এসে পৌঁছানোর আগেই। কুকি বলল ব্যথা যদি বেশি বাড়ে তাহলে মিস মেলির বিছানার তলায় একটা চাকু রেখে দিলেই হবে – ওই চাকুই ব্যথাটা কেটে দু’টুকরো করে ফেলবে।”
এই অভূতপূর্ব খবরটার জন্য স্কারলেটের ইচ্ছে হল ওকে কষে চড় লাগায়, কিন্তু মেলানি বড় বড় চোখ মেলে চেয়ে বলল, “সোনা – ইয়াঙ্কিরা কি এসে গেছে?”
“না,” স্কারলেট দৃঢ়ভাবে বলল। “প্রিসিটা এক নম্বর মিথ্যুক!”
“হ্যা ম্যাম – আমি সত্যিই খুব মিছে কথা বলি,” প্রিসি জোরে জোরে ঘাড় নেড়ে কথাটা স্বীকার করে নিল।
“ওরা এসে পড়েছে,” মেলানি ওদের ছল বুঝতে পেরে ফিসফিস করে বলে বালিশে মুখ গুঁজে ফেলল। ওর গলা অস্পষ্ট।
“হায় আমার অভাগা বাচ্চা! বেচারা!” তারপর অনেকক্ষণ পরে, “ওহ স্কারলেট! তুমি এখানে থেকো না। ওয়েডকে নিয়ে চলে যাও!”
এরকম একটা ইচ্ছে স্কারলেটের মনেও ঘুরঘুর করছিল। কথাটা মেলানি বলে ফেলায় ও খুব চটে গেল। তাহলে কি ওর মনের গোপন ইচ্ছেগুলো মেলানি পড়ে ফেলছে?
“বোকার মত কথা বোলো না তো। আমি মোটেই ভয় পাইনি। তুমি জান যে আমি তোমাকে ছেড়ে যাব না।”
“তোমার যাওয়াই উচিত। আমি তো মরেই যাচ্ছি!” তারপর আবার গোঙাতে শুরু করল।
***
রেলিং ধরে ধরে অন্ধকার সিঁড়ি বেয়ে স্কারলেট আস্তে আস্তে নীচে নেমে এল। খুব সাবধানে নামল – যাতে পড়ে না যায়। ক্লান্তিতে য়ার যন্ত্রণায় পা দুটো ধরে গেছে, কাঁপছে। ঘামে ভেজা পোশাকে ওর শরীরেও শিরশিরানি। নিস্তেজভাবে ও সামনের বারান্দায় এসে ধপ করে সিঁড়ির প্রথম ধাপে বসে পড়ল। একটা থামে হেলান দিয়ে কাঁপা হাতে পোশাকটা ঢিলে করে নামিয়ে দিল। নিস্পলকভাবে স্যাঁতস্যাঁতে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে রইল।
যেটা হবার ছিল সেটাই হল। মেলানি মরল না। বাচ্চাটা জন্মাল – ছেলে। বেড়ালবাচ্চার মত কুইঁ কুইঁ করতে করতে জীবনের প্রথম স্নান করে ফেলল প্রিসির হাতে। মেলানি ঘুমিয়ে পড়েছে। একটা আনাড়ি ধাত্রীর হাতে অনেক ব্যথা যন্ত্রণা সহ্য করেও ও এত নিশ্চিন্তে ঘুমোলো কীভাবে? মরে গেল না কেন? এই রকম আনাড়ি হাতে পড়লে স্কারলেট নিজে তো মরেই যেত। সব কিছু হয়ে যাবার পরে মেলানি বিড়বিড় করে কিছু বলল। এত আস্তে, যে কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে শুনতে হল। “ধন্যবাদ!” তারপরেই ঘুমিয়ে পড়ল। কি করে ঘুমোতে পারল? স্কারলেট ভুলেই গেছে যে ওয়েডের জন্মের পর ও নিজেও ঘুমিয়ে পড়েছিল। কিছুই মনে পড়ছিল না। মাথাটা কেমন খালি খালি লাগছে। খালি লাগার অনুভূতি যেন বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়েছে। দিনটার শুরু হয়েছিল নিষ্প্রাণ ভাবে। শেষও হচ্ছে একই ভাবে। থাকবে শুধু অসহ্য গরমের এক রাত, এক শরীর ক্লান্তি আর মাথা থেকে পায়ে ঘাম বেয়ে পড়ার অস্বস্তি।
এতক্ষণ ওর দীর্ঘশ্বাসে একটা লয় ছিল। এখন তার জায়গা নিয়েছে অবরুদ্ধএকটা কান্না। চোখ জ্বালা করছে। জল পড়ছে না। সমস্ত অশ্রুই কি ওর শুকিয়ে গেল? ভারী স্কার্টটা হাঁটু পর্যন্ত তুলে নিল। আবার লম্বা করে শ্বাস ছাড়ল। গরমও লাগছে, আবার ঠাণ্ডাও। ঘামে চটচটে পায়ে রাতের ঠাণ্ডা বাতাসটা খারাপ লাগছে না। এভাবে হাঁটু অবধি স্কার্ট তুলে বসে থাকতে দেখলে আন্ট পিটি কি বলতেন সেটাই ভাবছিল। যাই বলুন গিয়ে, স্কারলেট পরোয়া করে না। কোনও কিছুরই তোয়াক্কা করে না! সময় একদম থেমে গেছে। সন্ধ্যেরাত না মাঝরাত, বোঝাই যাচ্ছে না। বুঝে হবেই বা কী?
পায়ে চলার আওয়াজ পেল ওপরতলা থেকে। “হে ঈশ্বর, প্রিসিকে তিরষ্কার করুন,” মনে মনে কথাগুলো আউড়ে নিয়ে স্কারল্টে নিদ্রার কোলে ঢলে পড়ল। কতক্ষণ পরে জানে না, খেয়াল করল প্রিসি ওর পাশ বসে আদুরে গলায় অনর্গল বকবক করে চলেছে।
“আমরা কিন্তু ভালভাবেই উতরে দিয়েছি ঝামেলাটা! মা থাকলেও এর থেকে বেশি কিছু করতে পারত না!”
অন্ধকারের মধ্যেই স্কারলেট প্রিসির দিকে কটমট করে তাকাল – গালি বা ধমক লাগানোর মত শক্তি নেই – ক্লান্ত থাকায় ওর অপরাধের ফিরিস্তি শোনাতেও ইচ্ছে করল না – কিছু না জানা সত্ত্বেও মুখে বড় বড় কথা বলা – ঘাবড়ে যাওয়া – প্রয়োজনের সময় কাঁচির মত দরকারি জিনিষপত্র হারিয়ে ফেলা – বেসিনের জল বিছানার ওপর চলকে ফেলা – সদ্যোজাত শিশুকে হাত থেকে ফেলে দেওয়া! আর এখন কিনা বলতে এসেছে যে কি ভাল কাজই না করেছে!
আর ইয়াঙ্কিরা নাকি এইসব অকম্মা নিগ্রোদের মুক্ত করে দিতে চায়! ভাল কথা, করুক না!
থামে হেলান দিয়ে ও চুপচাপ বসে রইল। প্রিসি ওর মেজাজ আন্দাজ করে পা টিপে টিপে বারান্দার অন্ধকার দিকটায় সরে গেল। বেশ অনেক পরে – যখন ওর শ্বাসপ্রশ্বাস একটু স্বাভাবিক হল – আর নিজেকে একটু স্থিতিশীল মনে করল, তখন স্কারলেট দূর থেকে হালকা কথাবার্তার আওয়াজ শুনতে পেল। মনে হল উত্তরদিক থেকে অনেক পায়ের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। জওয়ানরা? আস্তে আস্তে সোজা হয়ে বসে স্কার্টটা নামিয়ে দিল – যদিও অন্ধকারে কেউ কিছুই দেখতে পাবে না। বাড়ির কাছে দিয়ে ছায়া ছায়া কয়েকজন লোকদের যেতে দেখল। কতজন আন্দাজ করতে পারল না। ও হাঁক লাগাল।
“শুনছেন?”
ছায়ার মধ্যে থেকে একজন লোক আলাদা হয়ে গিয়ে গেটের দিকে এগিয়ে এল।
“আপনারা কি চলে যাচ্ছেন? আমাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছেন?”
ছায়ামূর্তি মাথা থেকে টুপিটা নামাল। অন্ধকার থেকে শান্ত একটা স্বর ভেসে এল।
“হ্যা ম্যাডাম। আমরা সেটাই করছি। এখান থেকে মাইল খানেক উত্তরে আমরাই প্রতিরোধ বাহিনীর শেষ কয়েকজন।”
“আপনারা – মানে সৈন্যবাহিনী কি সত্যিই পিছিয়ে যাচ্ছেন?”
“হ্যা ম্যাডাম। জানেনই তো ইয়াঙ্কিরা এসে পড়েছে।”
ইয়াঙ্কিরা শেষমেশএসেই পড়ল! আর ও কিনা একেবারে ভুলেই মেরে দিয়েছিল! গলা শুকিয়ে গেল। আর কিছু বলতে পারল না। ছায়ামূর্তি এগিয়ে গিয়ে অন্যদের সাথে মিশে গেল। ওদের পদধ্বনি অন্ধকারে মিলিয়ে যেতে যেতে যেন বলতে থাকল, “ইয়াঙ্কিরা এসে পড়েছে! ইয়াঙ্কিরা এসে পড়েছে!” ওর বুকের ধুকপুকুনিতেও একই আওয়াজ উঠতে থাকল, “ইয়াঙ্কিরা এসে পড়েছে!”
“ইয়াঙ্কিরা কি এসে পড়েছে!” প্রিসি ভয়ে ভয়ে বলে ফেলে গুটিসুটি মেরে ওর কাছে ঘেঁসে এল। “ওহ্ মিস স্কারলেট! ওরা আমাদের সবাইকে মেরে ফেলবে! ওরা আমাদের পেটের মধ্যে বেয়নেট ঢুকিয়ে দেবে! ওরা ___”
“তুই চুপ করবি?” একেই ভয়ে সিঁটিয়ে আছে তার ওপর এই কথাগুলো কেউ যদি কানের কাছে বলতে থাকে তখন কেমন লাগে? নতুন করে আবার শিউরে উঠল। কি করবে এখন? কোথায় পালাবে? কার কাছে সাহায্য চাইবে? সব বন্ধুই তো ওকে ছেড়ে চলে গেছে!
হঠাৎ ওর রেট বাটলারের কথা মনে পড়ল। মনে পড়তেই খানিক শান্তি বোধ করল। আজ সকালে অসহায়ের মত যখন চারদিকে এত ছোটাছুটি করছিল, তখন ওঁর কথা কেন মনে পড়ল না! হ্যা ওঁকে ঘেন্না করে ঠিকই, কিন্তু উনি খুবই সাহসী আর চতুর। আর উনি ইয়াঙ্কিদের তোয়াক্কা করেন না। উনি তো শহরেই আছেন! একথা ঠিক যে ওঁর ওপর ও খুবই বিরক্ত, কিন্তু এরকম পরিস্থিতিতে সেটা গুরুত্ব দিলে চলবে না। আর ওঁর তো একটা ঘোড়া আর ঘোড়ার গাড়ি রয়েছে। কেন যে ওঁর কথাটা আগে মনে আসেনি! উনিই ওদের এই অভিশপ্ত জায়গা থেকে বের করে নিয়ে যেতে পারেন – সে যেখানেই হোক না কেন!
প্রিসির দিকে তাকিয়ে খুব উত্তেজিত ভাবে বলতে লাগল,
“তুই তো জানিস ক্যাপ্টেন বাটলার কোথায় থাকেন – অ্যাটলান্টা হোটেলে?”
“হ্যা ম্যাডাম। কিন্তু ___”
“ঠিক আছে – তুই এক্ষুনি ওঁর কাছে যা – বল যে আমার ওঁকে খুব দরকার। বলবি যে উনি যেন দেরি না করে চলে আসেন – আর ঘোড়া আর গাড়ি কিংবা পারলে একটা অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে যেন চলে আসেন। বাচ্চাটার কথা বলবি। বলবি যে আমি চাই উনি আমাদের এখান থেকে বের করে নিয়ে যান। যা এক্ষুনি যা, এক্ষুনি!”
সোজা হয়ে বসে ও প্রিসিকে একটু ধাক্কা লাগাল – যাতে ও তাড়াতাড়ি করে।
“হে ভগবান, মিস স্কারলেট! এরকম অন্ধকারে আমার একা যেতে ভয় করছে – ধরুন যদি ইয়াঙ্কিরা এসে আমাকে ধরে নেয়?”
“যদি দৌড়ে যাস তাহলে ঐ সৈন্যদের ধরে নিতে পারবি। ওরা তোকে ইয়াঙ্কিদের হাতে তুলে দেবে না। নে ছোট!”
“আমার খুব ভয় করছে। ধরুন – ক্যাপটেন বাটলার হোটেলে না থাকেন ____”
“তাহলে জানতে চাইবি উনি কোথায় আছেন। তোর কি একটুও বুদ্ধি নেই? হোটেলে না থাকলে ডিক্যাটুরের কোনও বারে গিয়ে ওঁর কথা জানতে চাইবি। বেল ওয়াটলিং-এর বাসায় যাবি। বোকা কোথাকার – ওঁকে খুঁজে বের কর – বুঝতে পারছিস না ওঁকে খুঁজে বের করতে না পারলে ইয়াঙ্কিরা সত্যি সত্যিই আমাদের সবাইকে ধরে নেবে!”
“মিস স্কারলেট মা যদি জানতে পারে আমি বারে আর বেশ্যাবাড়িতে গেছি তাহলে আমাকে চাবুক দিয়ে পেটাবে।”
স্কারলেট ওকে টেনে দাঁড় করাল।
“আর তুই যদি না যাস, তাহলে আমি তোকে চাবুক দিয়ে পেটাব। রাস্তায় দাঁড়িয়ে তুই ওঁর নাম ধরে চেঁচাবি – সেটা পারবি তো? নাহলে কাউকে জিজ্ঞেস করতে পারিস, উনি ভেতরে আছেন কি না? যা বলছি!”
প্রিসি তারপরেও যখন নড়তে চাইল না, তখন স্কারলেট আবার ওকে এমন ধাক্কা লাগাল যে প্রিসি সিঁড়ি থেকে উঠোনের মধ্যে প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল।
“হয় তুই যাবি, নয়ত তোকে আমি নদীর ওপারে বিক্রি করে দেব। আর কখনো তোর মায়ের দেখা পাবি না – কিংবা এমন কারুর যাকে তুই চিনিস। আর তোকে আমি খেতের মজুর হিসেবেও বিক্রি করে দেব। যা তাড়াতাড়ি!”
“হে ভগবান, মিস স্কারলেট ____”
কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওর কর্ত্রীর জেদের কাছে ওকে হার মানতেই হল। স্কারলেটের হাত ছাড়িয়ে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে গেল। গেট খোলার আওয়াজ এল। স্কারলেট চেঁচাল, “দৌড়ো, অলস কোথাকার!”
স্কারলেট ওর পদধ্বনি শুনতে পেল। আস্তে আস্তে সেই পায়ের আওয়াজ অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।
0 মন্তব্যসমূহ