ভাষান্তর : বিকাশ গণ চৌধুরী
মওজি কে বর-কিনার রওয়দ অজ়মিয়ান-এ-মা
উত্তাল শত ঢেউ রওনা করে নিজের ভিতর থেকে
যে ঢেউটি পেয়েছে কিনার আমাদের অন্তর থেকে
― নাজ়িরি নিশাপুরি
And with such luck and loss
I shall content myself
Till tides of turning time may toss
Such fishers on the shelf
-- George Gascoigne
দারুণ ভালোবেসে আমাকে আট বছর নিজের সঙ্গে রেখে আমার বাবা, আমার পাতানো বাবা, অবশেষে আমার জন্য অন্য একটা জায়গা খুঁজতে বাধ্য হলো। এটায় তার কোনো দোষ ছিল না, আমারও না।
তার সঙ্গে কয়েকটা দিন নিশ্চিন্তে কাটালে আমার তোতলামো সেরে যাবে এ বিশ্বাস তার ছিল। তিনিও ভাবেননি, আমিও আশা করিনি এখানকার লোকেরা আমাকে নিয়ে মজা করবে যেমন কিনা পাগলদের নিয়ে লোকে করে। বাজারে অন্য লোকের কথা থেকে লোকে আমার কথা বেশি কৌতুহল নিয়ে শুনত, আর আমার কথায় মজার কিছু থাক বা না থাক তারা সবসময়ই তা শুনে হাসত। কয়েকদিনের মধ্যে আমার আবস্থা এত খারাপ হলো যে শুধু বাজারে নয় বাড়িতেও যখনই আমি কথা বলতে যেতাম শব্দগুলো আমার দাঁত, ঠোঁটের আর তালুর সঙ্গে জড়িয়ে গিয়ে যেভাবে তীর ছুঁয়ে ঢেঊ ফিরে যায় সেভাবেই ফিরে যেত। আমার জিভ এমনভাবে শক্ত হয়ে যেত যে আমার গলা ফুলে উঠত, একটা প্রচন্ড চাপ যেন আমার গলা আর বুকে আক্রমণ করে আমাকে দমবন্ধ করে মারার ভয় দেখাত। দম বন্ধ হয়ে আসার আগে আমি বাক্য অসম্পূর্ণ রাখতে বাধ্য হতাম, তারপর দম নিয়ে আবার প্রথম থেকে শুরু করতাম। আর এরকম সময় আমার বাবা বলত, “তোর এটা বলা হয়ে গেছে, পরেরটা বল।” যদি কখনও আমাকে তিনি বকতেন তো এজন্যই বকতেন। কিন্তু আমার সমস্যা ছিল কোথায় যে শেষ করেছিলাম কিছুতেই সেটা মনে করতে পারতাম না, আমাকে প্রথম থেকেই শুরু করতে হতো। কখনও কখনও বাবা আমাকে ধ্যৈর্য ধরে শুনতো, আর অন্য সময় হাতটা তুলে বলতো, “ঠিক আছে, ঠিক আছে, এবার থাম।”
কিন্তু আমি মাঝখান থেকে শুরু করতে পারতাম না, আবার শেষ না করেও ছাড়তে পারতাম না। উত্তেজিত হয়ে পড়তাম। শেষমেশ উনি চলে যেতেন আর আমি নিজে নিজেই তুতলে যেতাম। তখন আমাকে দেখলে কেউ হয়তো পাগল মনে করত।
আমার বাজারে ঘুরে বেড়াতে খুব ভালো লাগত, লোকেদের জটলায় বসে থাকতে ভালো লাগত। যদিও সব শব্দের আমি মানে বুঝতাম না, তবুও খুব মন দিয়ে লোকজনের কথা শুনতাম আর মনে মনে সেগুলো বারবার আউড়াতাম। মাঝে মাঝে অস্বস্তি হতো, তবুও আমার খুব ভালো লাগত। এখানকার লোকজন আমাকে অপছন্দ করত না, আর সবচে’ বড়ো কথা আমার বাবা আমাকে খুব স্নেহ করত আর আমার সব দরকার-আদরকারের দিকে নজর রাখত।
কিছুদিন ধরে বাবাকে উদ্বিগ্ন মনে হচ্ছিল। একটা নতুন ব্যাপার শুরু হলো, বাবা আমার সঙ্গে অনেকক্ষণ ধরে কথা বলা শুরু করলেন। আমাকে এমন সব প্রশ্ন করতে লাগলেন যেগুলোর উত্তর খুব বড়ো হবে, তারপর আমাকে কোনরকম বাধা না দিয়ে খুব মন দিয়ে আমার কথা শুনতে লাগলেন। যখন আমি ক্লান্ত হয়ে হাঁপাতে শুরু করতাম, উনি ধৈর্য ধরে আমার কথা শুরুর অপেক্ষা করতেন, আর পুরো সময়টা সমান মনযোগ দিয়ে শুনতেন। আমার মনে হতো এই উনি আমাকে বকবেন আর আমার জিভ গিঁট পাকাতে শুরু করত, কিন্তু উনি কিছু না বলে শুধুই আমার দিকে তাকিয়ে থাকতেন।
মাত্র তিনদিনেই মনে হতে লাগল আমার জিভটা যেন কিছুটা গিঁট ছাড়াতে পেরেছে। আমার বুকের ওপর থেকে যেন একটা ভার উঠে গেল, আর আমি সেই দিনটার স্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম যেদিন আমিও অন্য সবার মতো সহজে, সাবলীলভাবে কথা বলতে পারছি। ভিতরে ভিতরে আমি সবার সঙ্গে যা যা ভাগ করে নিতে চাই তা এক জায়গায় করতে শুরু করে দিলাম। কিন্তু চতুর্থ দিন আমার বাবা আমাকে ডেকে তার কাছে বসতে বললেন। অনেকক্ষণ এলোমেলো বকে চললেন, তারপর চুপ করে গেলেন। আমি তার কাছ থেকে একটা প্রশ্নের অপেক্ষা করছিলাম, কিন্তু হঠাৎই উনি বলে বসলেন, “পরশু তোমার নতুন মা আসছেন”।
আমার মুখে আনন্দের উদ্ভাস দেখে তিনি যেন সমস্যায় পড়লেন, তারপর ধীরে ধীরে বললেন, “তোর কথা শুনলে তোর নতুন মা পাগল হয়ে যাবে। ও মরে যাবে।”
পরের দিন আমার সব জিনিষপত্র বাঁধাছাঁধা হলো। আমি কিছু জিজ্ঞেসা করার আগেই বাবা আমার হাত ধরে বলল, “চল।”
যেতে যেতে বাবা আমার সঙ্গে একটা কথাও বললো না। কিন্তু রাস্তায় একজন জিজ্ঞেস করায় বললো, “জাহাজ ওকে চেয়েছিল।” তারপর তারা দু’জনেই জাহাজকে নিয়ে কথা বলতে শুরু করল।
আমিও জাহাজকে চিনতাম। যখন আমি প্রথম বাবার সঙ্গে থাকতে এলাম, জাহাজ তখন মেলায়, বাজারে জোকারের মতো অঙ্গভঙ্গি করে পেট চালাত। ও ওর পিঠে একটা গোলাপী পাল বেঁধে রাখত। এজন্যই মনে হয় লোকে ওকে জাহাজ বলে ডাকত। অথবা ওর নাম জাহাজ ছিল বলেই হয়তো ও পিঠে পাল বেঁধে ঘুরে বেড়াত। জোরে বাতাস দিলে গোলাপি পালটা ফুলে উঠত, আর মনে হতো ওটার টানে জাহাজ এগিয়ে চলেছে। ও নিপুণভাবে ঝড়ে-পড়া জাহাজের নকল করত, আর মুখে আওয়াজ তুলে সবাইকে বিশ্বাস করিয়ে ছাড়ত রাগী বাতাস, গর্জন করতে থাকা সব ঢেউ আর জোরে ঘুরতে থাকা ঘূর্ণি, ঘূর্ণির শুন্যতা। এমনকি পালের পতপত আওয়াজ, সব। সব আওয়াজ ও স্পষ্টভাবে আলাদা আলাদা করে মুখে মুখে করত। বাঁধাধরা হলেও ছোটো-বড়ো সব বাচ্চাদের মধ্যে এই অভিনয় খুব জনপ্রিয় ছিল, যদিও জোরে বাতাস উঠলে তবেই ও এসব করত। বাতাস থমকে থাকলে বাচ্চা দর্শকরা যেন আরও আনন্দে থাকত, ওরা চিৎকার করতে থাকত,“তামাক, তামাক।”
আমি কখনও কাউকে জাহাজের মতো তামাক খেতে দেখিনি। ও সব কিসিমের তামাক, যতভাবে ধোঁয়া বার করে খাওয়া সম্ভব ততভাবে খেত, আর বাতাস যখন স্থির থাকত তখন ও ওই ধোঁয়ার কুণ্ডলী দিয়ে এমন সব কায়দা দেখাত যে দর্শকরা তাদের চোখকে বিশ্বাস করতে পারত না। কয়েকটা ধোঁয়ার কুণ্ডলী ছেড়ে ও একটু পিছনে সরে আসত, তারপর বাতাসে ওর হাত আর কব্জি এমনভাবে নাড়ত যেন নরম মাটি দিয়ে কোন ভাস্কর্য বানাচ্ছে। আর সত্যিসত্যি সেই ধোঁয়ার কুণ্ডলী একটা আকার নিত, ঠিক একটা ভাস্কর্যের মতো, আর সেটা কিছুক্ষণ বাতাসে ঝুলে থাকত। ওর কয়েকটা খেলা বাচ্চাদের দেখার অনুমতি ছিল না। সেগুলো দেখার জন্য আমরা সামনের থেকে দু’ তিন সারি পিছনে দর্শকদের ভীড়ের মধ্যে গিয়ে লুকিয়ে দাঁড়াতাম, আর যারা দূরে দাঁড়িয়ে থাকত তারা উড়ে যাওয়া পাল আর দর্শকদের হাসি শুনে বুঝত যে জাহাজ খেলা দেখাচ্ছে।
যদ্দিনে আমার বাবার কাছে আসার এক বছর হলো তদ্দিনে জাহাজের গলার স্বর একদম নষ্ট হয়ে গেছে। প্রচণ্ড কাশিতে ও কাবু। ওর খেলায় ওকে নানারকম গলার আওয়াজ করতে হতো, কিন্তু এখন মুখ খুললেই এমন কাশির দমক শুরু হতো যে মাঝে মাঝে কথা শেষ করার জন্য ওকে আমারই মতো অনেকটা সময় দিতে হতো। এতে ওর দৈনন্দিন খেলা দেখানোই শুধু বন্ধ হয়ে গেল না, ও আমাদের গ্রামে আসা একেবারে বন্ধ করে দিল, তাই প্রথম বছরের পর আমি ওকে আর দেখিনি।
আমরা রাস্তায় অনেক বস্তি আর ঘাট পেরিয়ে এলাম। সব জায়গাতেই আমার বাবার চেনা লোক, আর সবাইকে উনি বলে চলেছেন যে জাহাজ আমাকে চেয়ে পাঠিয়েছে। আমি বুঝে পাচ্ছিলাম না এটার মানে কী, কিন্তু কোন প্রশ্ন করিনি। মনেমনে বাবার ওপর ভীষণ রেগে যাচ্ছিলাম। তার থেকে দূরে যেতে আমার একদম ভালো লাগছিল না। আর আমার বাবারও মন ভালো ছিল না। তাকে দেখে নিদেনপক্ষে এটা মনে হচ্ছিল না যে তিনি বাড়িতে নতুন বৌ আনতে চলেছেন।
অবশেষে আমরা একটা নোংরা বস্তিতে এসে পৌঁছলাম। এখানকার লোকেরা সব কাচের কারিগর। অল্প কয়েকটাই বাড়ি, কিন্তু প্রত্যেকটাতেই কাচ গলাবার চুল্লী, আর প্রত্যেকটা বাড়ির খড়ের চাল থেকে মাথা বের করা ঝাঁঝালো ধোঁয়া বার হবার কদাকার সব চিমনি। পুরু ছ্যাতলা পড়া সব দেয়াল, গলি আর গাছ। লোকজনেরর জামাকাপড়, কুকুর বেড়ালদের লোম সব ধোঁয়ায় কালো। এখানেও দেখলাম কয়েকজন বাবাকে চেনে। একজন তো আমাদের তার সঙ্গে খানাপিনা করতেও ডাকল।
একটা দুঃসহ বোঝা আমার ওপর চেপে বসল। বাবা আমার মুখের দিকে সস্নেহে তাকাল, তারপর এই যাত্রাপথে প্রথমবার আমাকে কিছু বলল।
“লোকেরা এখানে বুড়ো হয় না।”
আমি কিছু বুঝতে পারলাম না। চারপাশের হেঁটে যাওয়া মানুষজনকে দেখতে লাগলাম, আর সত্যি কোন বয়স্ক লোককেই দেখতে পেলাম না। বাবা বলল, “ধোঁয়া সবাইকে খেয়ে ফেলে।”
আমি জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলাম, “তবে ওরা কেন এখানে থাকে?” কিন্তু মনে হলো প্রশ্ন করা বেকার, তাই আমি বাবা যেদিকে যাচ্ছে সেদিকেই হাঁটতে লাগলাম।
একটু পরে বাবা বলল, “জাহাজও কাচের কাজ জানে।” ও এখানেই জন্মেছে।
হঠাৎ করে আমি উঠে দাঁড়ালাম। নিমেষে আমার জিভে অনেকগুলো গিঁট পড়ে গেল, কিন্তু আমি আর চুপ করে থাকতে পারলাম না। আমাকে কি একটা বাজারী জোকারের সঙ্গে এই ঝাঁঝালো কালো ধোঁয়াভরা অসভ্য বস্তিতে থাকতে হবে ? যতই সময় লাগুক এই প্রশ্নটা আমায় জিজ্ঞেস করতেই হবে। যদিও আমাকে আশ্বস্ত করার ভঙ্গীতে বাবা ইশারায় আমাকে তার পাশে বসতে বলে বলল, “জাহাজ অনেকদিন আগে এখান থেকে চলে গেছে।”
আমি হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। যতক্ষণ জাহাজ এই বস্তিতে থাকছে না ততক্ষণ জাহাজের সঙ্গে যেকোনো জায়গায় আমি থাকতে রাজি। এরপর বাবা বলল: “ও এখন ঘাটে থাকে।” তারপর সেদিকে আঙুল তুলে দেখাল। “ওই, ও-ই শীশাঘাটে।”
সেই কষ্টের অনুভূতিটা ফিরে এল। বাবা জানতো না যে ইতিমধ্যেই তাঁর বাড়িতে যাঁরা আসতো তাদের কাছ থেকে আমি শীশাঘাট সম্পর্কে জেনে গেছি। আমি জানতাম বড়ো ঝিলটার ঘাটগুলোর মধ্যে এটারই সবচেয়ে বেশি নাম, তবে সবথেকে কম লোক এখানে বাস করে, আর বিবি নামের এক ভয়ঙ্কর মহিলা এর একমাত্র মালিক, এক কুখ্যাত ডাকাতের মাশুকা –– কিংবা হয়তো ডাকাত নয়, বাগী ছিল লোকটা –– আর মহিলা পরে তাঁর বৌ হয়েছিল। আসলে, একবার এই শীশাঘাটে আসার সময় ওর গতিবিধির কথা সরকারি লোকেদের খবরিরা নিমকহারামি করে জানিয়ে দিলে ওরা ওকে এই ঘাটেই মেরে ফেলে। এই একটা অবাক করা ঘটনা পরিস্থিতিটাকে একদম পালটে দেয়; পুরো ঘাটটাই বিবিকে দিয়ে দেওয়া হয়। ও তখন একটা বিশাল নৌকোয় নিজের বাসা বসিয়ে নিল, যেটা এখন ঝিলের মধ্যেই নোঙর করা থাকে। ও কিছু একটা ব্যবসা চালায় যার কারণে যখন তখন লোকজন এই ঘাটে আসে। অন্যথায় এই ঘাটে আসা নিষেধ। আর কেউ সে সাহস করেও না। সব্বাই বিবিকে ভয় পায়।
জাহাজ কী করে শীশাঘাটে এল ? আমারও কি বিবির সাথে দেখা হবে ? উনি কি আমার সঙ্গে কথা বলবেন ? আমাকে কি তাঁর সব প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে ? আমাকে কথা বলতে দেখলে কি উনি রেগে যাবেন ? এসব প্রশ্ন আর সেসবের কাল্পনিক উত্তর নিয়ে এমন মগ্ন ছিলাম যে শীশাপট্টি ফেলে যে এগিয়ে গেছি তা খেয়ালই হয়নি। বাবার গলায়, “আমরা পৌঁছে গেছি”, শুনে আমি চমকে উঠলাম।
বড়ো ঝিলের এটাই সম্ভবত সবথেকে শুনশান এলাকা। ঊষর জমির ধার ঘেঁষে কাদাজল বহুদূর অবধি ছড়িয়ে গেছে, অনেক দূরে আর একটা পাড় দেখা যাচ্ছে। আমাদের ডানদিকে, জল থেকে একটু দূরে একটা বিশাল নৌকো ঝিলের দৃশ্য আড়াল করে দিচ্ছে। হয়তো একসময় ওটা কাঠের গুঁড়ি বয়ে নিয়ে আসতো। সেইসব কাঠের গুঁড়ি দিয়েই হয়তো পাটাতনের ওপরের এইসব ছোট বড়ো ঘরগুলো বানানো হয়েছে। পাটাতনের সবকটা কাঠই আলগা, আর ওর থেকে একটা হালকা ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ বেরোচ্ছে যেন একটা বিশাল দৈত্য নীচু গলায় প্রতিবাদ জানাচ্ছে। পাড়ে একটা নীচু লম্বা দেওয়াল মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। কাছে দাঁড়িয়ে আছে চারটে কি পাঁচটা বিশাল বিশাল ফাটধরা রুগ্ন মাচা, আর তার কাছেই মাটিতে খাওয়া কয়েকটা ছাতাধরা বাঁশ।
আমার মনে হলো একদিন এ জায়গাটা নিশ্চয়ই খুব জমজমাট ছিল। ঘাট বলে কথা, কিন্তু সেসব গিয়ে এখন শুধু ঝিলের ধারের ডেবে যাওয়া মাটিতে জমা ছোট্ট একটা ঝিলের জলে ভরা ডোবার ওপর পাশের বাড়িটার ছাদের ঝুলে বেরিয়ে থাকা একটা ছাউনি। বাড়িটার পিছনে, একটু ওপরে, কাঠ মাটি দিয়ে বানানো একটা ছিরিছাঁদহীন বাড়ি, দেখে মনে হয় ওটার মালিক ওটা বানানোর সময় ঠিক করে উঠতে পারেনি ওটা কাঠ দিয়ে বানাবে না মাটি দিয়ে, এইসব ভাবতে ভাবতেই বাড়ি তৈরি শেষ হয়ে গেছিল। তবে ছাঊনিটা পুরোটাই কাঠের। ছাদের মাথার ঠিক মধ্যিখানে একটা ছোট গোলাপি পাল মাথা তুলে হাওয়ায় পতপত করে উড়ছিল।
আমার বাবা আগে এখানে এসেছে। বাবা আমার হাতটা খপ করে ধরে দ্রুত ঢাল বেয়ে নেমে, পাঁচটা মাটির সিঁড়ি বেয়ে উঠে বাড়িটার দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। ঘরের মেঝেতে বসে জাহাজ ধোঁয়া গিলছিল। আমরা ঘরে ঢুকে বসলাম।
“তাহলে তুমি পৌঁছেই গেলে বলো, তাই না ?” বাবাকে একথা বলেই ও কাশতে শুরু করল।
এই আট বছরে ও অনেকটা বুড়ো হয়ে গেছে। ওর চোখের গভীর ম্লান চাউনি আর ঠোঁটের কালো দাগ দেখে মনে হচ্ছিল ওগুলো দু’টো আলাদা আলাদা ভাটিতে চুবিয়ে রং করা হয়েছে। ওর থেকে থেকে মাথা দোলানো দেখে মনে হচ্ছিল ও যেন কোনোকিছুতে সায় দিচ্ছে। এই মাথা নাড়ার মধ্যেই ও ওর ম্লান চোখ দু’টো দিয়ে আমায় দেখে নিয়ে বলল, “বড়ো হয়ে গেছে!”
“আট বছর হলো...”, বাবা বলল।
আমরা অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইলাম। আমার সন্দেহ হচ্ছিল ওরা ইশারায় কথা বলছিল, কিন্তু ওরা কেউ কারোর দিকে তাকাচ্ছিল না। হঠাৎ করে আমার বাবা উঠে দাঁড়াল। আমিও ওর সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ালাম। জাহাজ মাথা তুলে বাবার দিকে তাকিয়ে বলল, “আর একটু বসবে না ?”
“অনেক কাজ বাকি”, বাবা বলল। “কিছুই ব্যবস্থা করা হয়নি।”
জাহাজ মাথা নাড়ল, যেন মেনে নিল। বাবা বেরিয়ে মাটির সিঁড়িগুলো পেরিয়ে মাথাটা ঘোরাল, তারপর ফিরে এসে আমায় দু’ হাতে জড়িয়ে ধরল।
আমরা ওভাবে অনেকক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম, তারপর বাবা বলল, “তোর যদি এখানে ভালো না লাগে তো জাহাজকে বলিস। আমি এসে নিয়ে যাব।”
জাহাজ বাবার চলার রাস্তার দিকে মাথাটা হেলাল, আর বাবা সেই রাস্তা ধরে সিঁড়ি দিয়ে নেমে চলে গেল।
জাহাজের কাশির শব্দে আমি জাহাজের দিকে ফিরলাম। তামাকে কয়েকটা দ্রুত টান, শ্বাস নেবার তুমুল চেষ্টা করে ও উঠে দাঁড়াল, তারপর আমার হাত ধরে বাড়ির বাইরে এল। আমরা ওখানে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম, জাহাজ ঝিলটাকে দেখতে থাকলো। তারপর আমরা মাটির সিঁড়িটার দিকে ফিরলাম, কিন্তু জাহাজ প্রথম ধাপটাতেই থমকে দাঁড়াল। বলে উঠল, “না, প্রথমে, বিবি।”
যতক্ষণ না নৌকাটার কাছে আসা গেল ততক্ষণ আমরা ঝিলটার পাড় ধরে হাঁটলাম। সাবধানে টাল সামলাতে সামলাতে দু’টো জোড়া দেওয়া কাঠের তক্তার পাটার ওপর দিয়ে গিয়ে শেষে আমরা একটা সিঁড়ির নীচে পৌঁছোলাম, তারপর সিঁড়ি বেয়ে চড়লাম নৌকায়। সামনের একটা ছোট ঘরের দরজায় খসখসে কাপড়ের একটা পর্দা। দু’রঙা একটা বিড়াল ঝিঁমোতে ঝিঁমোতে আধ খোলা চোখে আমাদের দেখতে লাগল। আমি জাহাজের থেকে অনেক পা পিছনে থেমে দাঁড়িয়ে রইলাম।
জাহাজের প্রথম গলা খাঁকরিতে পর্দাটা একপাশে সরে গয়ে বিবি বেরিয়ে এল। ওকে দেখেই আমায় ভয় ভয় করতে লাগল, কিন্তু মহিলার বেঢপ শরীর দেখে, তিনি যে কখনও কারুর মাশুকা ছিলেনএই ভাবনায় ভয়ের থেকেও বেশি অবাক হয়ে গেছিলাম। তিনি জাহাজকে দেখলেন, তারপর আমাকে।
“তোমার ছেলে এল ?”
“এইমাত্র এল।”
বিবি আমাকে আপাদমস্তক কয়েকবার দেখল, তারপর বলল, “ওকে তো মনমরা দেখাচ্ছে।”
জাহাজ কিছু বলতে পারলো না, আমিও না। চুপচাপ কিছুক্ষণ গেল। আমি বিবির দিকে তাকিয়েই রইলাম। উনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “সাঁতার জানো ?”
মাথা নাড়লাম।
“জলে ভয় করে ?”
মাথা নাড়লাম।
“খুব ?”
“হ্যাঁ, খুব,” ইশারায় জানালাম।
উনি বললেন, “পাওয়াই উচিৎ”, আমি যেন ওর বুকের ভিতরে থাকা কথাটাকেই বললাম।
আমি ঝিলের বিশাল বিস্তার দেখতে লাগলাম। থমকে থাকা বাতাসে সেই ঘোলা জল মনে হচ্ছিল পুরোপুরি থেমে আছে। আমি বিবির দিকে চোখ ঘোরালাম। উনি তখনও আমার দিকে তাকিয়ে। তারপর উনি জাহাজের দিকে ফিরলেন, ও তখন বিবির দিকে তামাক খাবার যোগাড়যন্ত্র এগিয়ে দিচ্ছিল। ওরা কিছুক্ষণ ধোঁয়া খেতে খেতে টাকাপয়সা নিয়ে কথা বলতে লাগল। এরমধ্যে কোথা থেকে যেন একটা বাদামী কুকুর এসে আমাকে শুঁকে চলে গেল। বিড়ালটা, যেটা আমায় দেখছিল, কুকুরটাকে দেখে লেজ খাঁড়া করে পিঠ বেঁকিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে পর্দার পিছনে পিছু হঠল।
আমি ঘুরে ঘুরে বিবিকে দেখিছিলাম। শক্তপোক্ত শরীরের বিশাল এক মহিলা, যেন ওনার নৌকার থেকেও বড়ো। পাশাপাশি এটাও মনে হচ্ছিল উনি যেন ওনার নৌকার মতোই ধীরে ধীরে ভেঙ্গে ভেঙ্গে যাচ্ছেন। অন্তত ওনাকে দেখে, ওনার গলা শুনে, যদিও আমি ভালো করে শুনতে পাচ্ছিলাম না, আমার এরকমই মনে হচ্ছিল। হঠাৎ উনি কথার মাঝখানে কথা থামিয়ে, গলা তুলে ডাকলেন, “পরীয়া!”
একটা মেয়ের হাসির আওয়াজ যেন জলে ভেসে আমাদের দিকে আসতে লাগল। জাহাজ আমার হাত ধরে টেনে পাটার ওপর দাঁড় করিয়ে দিল। বিবির আওয়াজ শুনলাম, “জাহাজ, ওর যত্ন নিও”। আবারও বললো, “ও এত মনমরা।”
উনি এমনভাবে কথাটা বললেন যে আমি ভাবতে শুরু করে দিলাম যে আমি সত্যিই মনমরা।
যদিও আমার মনমরা থাকার কোন কারণই ছিল না। যখন জাহাজ আমাকে আমার থাকার জায়গা দেখাল তখন আমি বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না যে ঘোলা ঝিলের জল আর ঊষর জমির মাঝে এই শুনশান ঘাটের এই একটা বেঢপ বাড়িতে এরকম একটা জায়গা হতে পারে। আমার আরামের সব ব্যাবস্থাই করা ছিল। বেশিরভাগই কাচের জিনিসপত্র দিয়ে ঘরটা খুব সুন্দর করে সাজানো। ঘরের দরজা জানালায়ও কাচ বসানো। জাহাজ যে এরকমভাবে একটা জায়গা বানিয়ে তুলতে পারে তা দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। ভাবছিলাম নিশ্চয়ই কেউ ওকে এব্যাপারে সাহায্য করেছিল, অথবা এই ঘরসাজানোর বিদ্যেয় কোনো তালিম দিয়েছিল। দেখে মনে হচ্ছিল সেদিনই অনেকগুলো জিনিস কিনে আনা হয়েছে। সন্দেহ হচ্ছে অনেকগুলো জিনিস এখান থেকে সরানো হয়েছে, আর তা আমি আসার আগেই, মনে হয় অনেক আগে কেউ এখানে থাকতো।
যেখানে থাকব সেই জায়গাটা দেখে নেওয়ার পর মনে হলো পুরো শীশাঘাটটাই যেন দেখা হয়ে গেল। কিন্তু পরের দিন দেখা পেলাম পরীয়ার।
আমার এখন অবাক লাগে বাবার বাড়িতে যারা শীশাঘাট নিয়ে কথা বলত তাদের মধ্যে একজনও কেন বিবির মেয়ের কথা বলেনি। যেদিন শীশাঘাটে প্রথম এলাম সেদিনই আমি নামটা প্রথম শুনলাম, নৌকা থেকে বিবি ওকে ডাকছিল। ওদিন আমি নানান ভাবনায় এতটাই বিহ্বল হয়ে পড়েছিলাম যে পরীয়া কে সেটা ভেবে অবাকও হতে পারিনি। পরের দিন সকালে, কারো একটা হাসির আওয়াজ পেলাম। তারপর একটা কন্ঠস্বর,“জাহাজ, তোমার ছেলে কই, দেখি।”
জাহাজ লাফিয়ে পড়ে আমার হাতটা ধরল।
“বিবির মেয়ে,” আমাকে ঘর থেক বার করতে করতে ও বলল।
প্রায় পঁচিশ গজ দূর থেকে পরীয়াকে দেখলাম, ঝিলের জলে একটু একটু দোল খাওয়া লম্বা সরু একটা নৌকার ওপর সোজা টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শরীরে এক হালকা দোলা দিয়ে ও আমাদের বাড়ির দিকে আসছিল। আরেকটা ছোট্ট মোচড়ে নৌকাটা আরও কাছে চলে এল। এগিয়ে, থেমে ও নৌকেটাকে বাড়ির ছাউনিটার তলায় নিয়ে এল।
“ও ?”, চোখ মটকে ও জাহাজকে প্রশ্নটা করল।
এই মেয়ে বিবির, বিবি কারো মাশুকা ছিল এই ভাবনা ভেবেছিলাম বলে হতভম্ব হয়ে গেলাম। ওকে ভালভাবে দেখার চেষ্টা করছিলাম, কিন্তু ওই-ই আমাকে মাথা থেকে পা পর্যন্ত খুঁটিয়ে দেখছিল।
জাহাজকে বলল, “ওকে তো খুব একটা মনমরা দেখছি না।” তারপর আমার দিকে ফিরে বলল, “তোমাকে মোটেও মনমরা দেখাচ্ছে না।”
একটু বিরক্ত হয়ে আমি বলার চেষ্টা করলাম, “আমি কখন বললাম যে আমি মনমরা ?” কিন্তু যা হলো আমি তুতলে গেলাম।
পরীয়া হাসতে হাসতে বলল, “ও জাহাজ, ও কি সত্যিসত্যি...” এরপর ও জোরেজোরে হাসতে লাগলো, যতক্ষণ না নৌকা থেকে বিবির গর্জন শোনা গেল--
“পরীয়া, ওকে বিরক্ত কোরো না।”
“কেন,” পরীয়া গলা তুলে শুধোল, “ও মনমরা বলে ?”
“পরীয়া”, জাহাজ বলে উঠল, “তুমি ওর সঙ্গে মজা করছ।”
“মজা করব কেন ?” এই বলে ও আবার হাসতে আরম্ভ করল।
আমার অস্বস্তি শুরু হলো, যেন ফাঁদে পড়ে গেছি, আর তখনই ও জিজ্ঞেস করল, “তোমার নতুন মা’কে দেখেছ ?”
“না, দেখিনি,” আমি মাথা নেড়ে জানালাম।
“তুমি দেখতে চাও না ?”
উত্তর না দিয়ে আমি অন্যদিকে তাকিয়ে রইলাম।
ও আবার বলল, “তুমি চাও না ?”
এবার আমার মাথা এমনভাবে নড়ল যে যার মানে ‘হ্যাঁ’ ‘না’ দু’টোই হতে পারে। মনে পড়ল আজতো আমার নতুন মায়ের আমাদের পুরনো বাড়িতে আসার কথা, কিংবা হয়তো এতক্ষণে এসেই পড়েছে।
বাবা বলেছিল উনি আমাকে কথা বলতে দেখলে রেগে যাবেন। আমি দেখার চেষ্টা করছিলাম যে আমি কথা বলছি আর উনি রেগে যাচ্ছেন। আমার মনে পড়ছিল গতকাল এই সময়ে আমি আমাদের পুরনো বাড়িতেই ছিলাম, আর সেই স্মৃতি যেন অনেক দূর অতীত থেকে আমার কাছে আসছিল। আট সেকেন্ডে আমি আমার আটটা বছর পেরিয়ে এলাম। তারপর জাহাজের বাড়িতে আমাকে ছেড়ে যাবার আগে আমাকে বাবার জড়িয়ে ধরার দৃশ্যটি আমার মনে পড়ল । এখন আমি আগের থেকেও বেশি করে বুঝতে পারি যে বাবা আমাকে কত গভীরভাবে ভালোবাসে।
“জাহাজও তোমাকে খুব ভালোবাসবে,” পরীয়ার গলার আওয়াজ আমাকে চমকে দিল।
ওর কথা আমি ভুলেই গিয়েছিলাম, কিন্তু ও তো আমাকে এতক্ষণ দেখেই গিয়েছে। টাল সামলাতে সামলাতে হেঁটে হেঁটে ও নৌকাটার অন্যদিকে চলে গেল। শরীরের একটা ছোট্ট মোচড়ে ওর পিঠ আমাদের বাড়িটার দিকে হয়ে গেল আর পায়ের একটা হালকা ঠেলায় নৌকাটা এগিয়ে গেল আর আস্তে আস্তে ও আমাদের থেকে পিছলে দূরে চলে গেল। আমি অনুভব করলাম আমার চোখের সামনে যেন একটা কুহক ঘটে গেল।
নিজের মনেই বললাম,“যদি বিবি ওকে ডাক না দিত, তবে আমি হয়তো ওকে এই ঝিলের আত্মা বলেই ভাবতাম।”
যদি ও এই ঝিলের আত্মা নাও হয়, তবুও ও অবশ্যই এক বিস্ময়, কারণ ও জলের নীচে জন্মেছে, আর ওর পা কখনও পৃথিবীর মাটি স্পর্শ করেনি।
পরীয়া চলে যাবার পর জাহাজ আমাকে বলল, বিবি ওর বাপ-দাদাদের কাছ থেকে নৌকাটা পেয়েছিল। সে কবেকার কথা তা এই এত্ত বড়ো ঝিলের কেউই বলতে পারে না। বিবি কিন্তু এই ঝিল থেকে বহু দূরে থাকত, যেখানে ওর খসম, সেই ডাকাত, কিংবা যাই-ই হোক, লুকিয়ে দেখা করতে যেত। যখন পরীয়া জন্মাবে তখন ওর খসম বিবিকে একটা দাই সঙ্গে দিয়ে এই নৌকাটায় তুলে দিল। একদিন জাহাজ শুনতে পেল বিবি যন্ত্রণার চোটে কাঁদছে। হঠাৎ, বিবির গলার স্বর বদলে গেল। কয়েকজন সরকারি লোক এসে বিবিকে ওর খসম কোথায় আছে না আছে তা নিয়ে প্রশ্ন করছে। বিবি ওদের কিচ্ছুটি বলছে না, তাই ওরা বিবিকে বারবার জলে চুবিয়ে চেপে ধরে রাখতে লাগল, আর এরকম একটা লম্বা চোবানোর ঘটনাটার মধ্যেই পরীয়া জন্মাল।
জাহাজের কথায়, “আমি পরিষ্কার দেখলাম বিবিকে যেখানে ডোবানো হয়েছে সেখান থেকে বুদ্বুদ উঠে আসছে, আর সেই বুদ্বুদের মধ্যে থেকে পরীয়ার মাথাটা উঠে এল। ওর কান্নার আওয়াজ শোনা গেল।”
সরকারি লোকগুলো বুঝতে পারল যে ব্যথা নিয়ে বিবি মিথ্যে বলছিল না। ওরা চলে গেল, কিন্তু নজরদারি চলতেই লাগল। একদিন, পরীয়ার বাবা যেদিন ঘাটে এল, যেমনটা ও আসবে বলে ওরা ভেবেছিল। ওরা নৌকাটা ঘিরে ফেললে ও পালাবার চেষ্টা করল, কিন্তু চোট পেয়ে ঝিলের জলে পড়ে ডুবে গেল।
সেদিন থেকেই বিবি নৌকটাকেই নিজের আর মেয়ের আস্তানা বানিয়ে ফেলল। বিবি মাঝেসাঝে কোন কাজে বেরলেও পরীয়াকে কখনোই ও ডাঙ্গায় পা রাখতে দেয়নি। ও ওর ছোট একটা শালতিতে করে ঝিলের জলে ঘুরে বেড়ায় আর নয়তো মায়ের বড়ো নৌকায় এসে থাকে। কেন ? বিবির কি কোনো সংকল্প আছে ? না কি কারো সঙ্গে কোনো শর্ত ? কেউ জানে না পরীয়া কতদিন ঝিলের জলে পাক কাটতে থাকবে, আর কখনও ওর পা মাটি ছোঁবে কিনা!
শীশাঘাটে আমার একবছর হলো, এই একবছরে আমি প্রত্যেকটা ঋতুর আসাযাওয়ার সাক্ষী রইলাম, আর প্রত্যেকটা ঋতুতে দেখলাম পরীয়ার নৌকা জলে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ও-ই ছিল আমার একমাত্র বিনোদন। আমার আস্তানার বাইরের দরজাটা একটা ন্যাড়া জমির দিকে খুলত, অনেক দূরে শীশাপট্টির লোকদের বাড়ির ধোঁয়াটে বাড়িঘরের পাশ দিয়ে মেছুয়াপট্টি দেখা যেত। মরা মাছের কারণে আমি ওদের থেকে দূরে দূরে থাকতাম। মেছুয়ারা সবসময় ওদের কাজে ব্যস্ত থাকত। আমাকে ওদের কোন দরকারেই লাগতো না, আমারও ওদের কোনো দরকার ছিল না।
মাঠের শেষে আরও কয়েকটা ঘাট ছিল, কয়েকটা বড়ো বড়ো মেছুয়াপট্টিও। কয়েকটা ঘাটে অনেক কাজকর্ম হতো, কিন্তু এক দু’বার ওখানে গিয়ে দেখেছি যে আমি যে জাহাজের পাতানো ছেলে এ কথাটা আমার আগেই ওখানে পৌঁছে গেছে। তাই, এখানে-ওখানে, সব পোড়ো জায়গায় ঘুরে বেড়ানো আর কিছু খাপছাড়া জিনিস দেখে আনন্দ পাওয়া ছাড়া বেশিরভাগ সময়ই আমি ঘরের চালাটার নিচেই বসে থাকতাম। জাহাজও দৌড়াদৌড়ি করে ওর খবর দেওয়া- নেওয়ার কাজ শেষ করে তামাক-টামাক নিয়ে এখানে এসে বসত, আর নানান গল্প বলত। মনে রাখবার মতোই সব গল্প, কিন্তু কীভাবে যেন আমি সেসব ভুলে যেতাম। তবে আমার মনে আছে, যখন গল্প বলে ও আমার মনোযোগ টানতে পারতো না তখন খুব রেগে যেত, এমনকি পাগলপারা হয়ে যেভাবে ওর নাটক করে বলা অভ্যাস সেভাবে বলতে থাকত। তারপর শুরু হতো ওর কাশির দমক, আর গল্পে যেটুকুও বা আগ্রহ জাগতো সেটাও সঙ্গেসঙ্গে নষ্ট হয়ে যেত।
শুরুতে, আমার মনে হতো শীশাঘাটের সঙ্গে বাইরের পৃথিবীর কোনো সম্পর্ক নেই, আর ঝিলের এইদিকটা অনাদিকাল থেকেই পোড়ো একটা জমি। যদিও তা নয়। এটা সত্যি, আমি আগেও শুনেছিলাম, যে বিবির অনুমতি ছাড়া কেউ এখানে পা-ও রাখতে পারে না। আমার ধারণা ছিল বিবি কখনও কাউকে এখানে ঢুকতে দেয় না, কিন্তু একবার জাহাজের বাসা থেকে আমি খেয়াল করেছি বিশেষ কয়েকটা দিনে মেছুয়ারা এখানে তাদের জাল আর নৌকা নিয়ে জড়ো হয়। কখনও তো ওরা এতজন আসে যে মনে হয় জলের ওপর ছোটখাটো একটা মেলা বসে গেছে। চালার নীচে যেখনটায বসি সেখনটায় বসে আমি মেছুয়াদের ডাকাডাকি, উঁচু গলার হাঁকডাক কে কোন দিকে যাবে এসব শুনি। ওদের হাঁকডাকের মধ্যে দিয়ে ছাঁকতে ছাঁকতে এখন ওখান থেকে পরীয়ার হাসির আওয়াজ আসে। কখনও মনে হয় ওরা পরীয়াকে কোনকিছু করতে বাধা দিচ্ছে। মাঝেসাঝে শুনতে পেতাম একটা বুড়ো মেছুয়া পরীয়াকে বকছে, যদিও দিলখোলা হাসি চলতেই থাকত। তারপর নৌকা থেকে বিবির গলা ভেসে আসতো : “পরীয়া, ওদের কাজ করতে দাও!” উত্তরে পরীয়া হেসে উঠত, আর মেছুয়ারা বিবিকে ওকে কিছু বলতে বারণ করতো।
ওই দিনগুলোয়, আর অন্য দিনগুলোতেও, পরীয়া সকাল সকাল ঘাটে চলে আসত। এসে চালাটার সামনে ওর নৌকার ওপর দাঁড়িয়ে থাকত, জাহাজের সঙ্গে গল্প করত, তারপর আমাকে চালা থেকে বেরিয়ে আসতে বলত। জাহাজ বাইরে কোথাও গেলে ও আমার সঙ্গে গল্প করত। আমাকে ওর কুকুর আর বিড়ালের গল্প বলত, বিবি কেন ওকে আগের দিন বকেছিল সেসব বলত।
কখনও কখনও হঠাৎ করে আমাকে এমন প্রশ্ন করে বসত যে আমি মাথা নেড়ে উত্তর না দিয়ে কথা বলতে যেতাম, আর এতে ও এমন হাসত যাতে বিবি ওকে বকা দেয় আর ও একমোচড়ে ঝিলের অনেক দূর চলে যেতে পারে। বিকেলে, বিবি ওকে ঊঁচু গলায় ডাকে আর দেখা যায় পরীয়ার ছোট্ট শালতি নৌকার দিকে আসছে। তারপর নৌকা থেকে ভেসে আসত পরীয়ার হাসি আর বিবির রাগ। শেষ বিকেলে ও আবার বেরিয়ে ঘাটের সামনে এসে থামত। জাহাজ বাড়ি না থাকলে ও ওর খবর নিত। হাসার জন্য জাহাজের কিছু না কিছু ও ঠিক খুঁজে নিত, হয় ওর তামাক খাওয়া, নয় ওর অগোছালো পোষাক, নয় ওর বাড়ির ওপরের পাল।
একদিন আমার সঙ্গে কথা বলতে বলতে আমার সন্দেহ হলো আর কিছুক্ষণের মধ্যে নিশ্চিতও হলাম যে অনেকদিন আগে বাজারে জাহাজ যেসব খেলা দেখাত ও তার কিছুই দেখেনি, এমনকি সে সম্বন্ধে শোনেওনি। সেদিন, সেই-ই প্রথম আমি ধীরে সুস্থে কিছু বলার চেষ্টা করলাম, যাতে করে আমি ওকে জাহাজের বাঁধাধরা ভাঁড়ামোর কথা বলতে পারি। শেষ দিকে আমার বাবা ঠিক যেভাবে আমার কথা শুনতে শুরু করেছিল ঠিক সেইভাবে অনেকক্ষণ না হেসে ও খুব মন দিয়ে আমার সব কথা শুনল।
আর তখনই জাহাজ চালার নীচ থেকে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বেরিয়ে এল, আর পরীয়াকে আমি যা বলার চেষ্টা করছিলাম তা থেকে ছুটি দিল। জাহাজ ওর দু’তিনটে ছোটো ছোটো মজা দেখিয়ে দিল। আমার কাছে ওগুলো ওর আগের অভিনয়ের খুব করুণ নকল বলে মনে হলো, কিন্তু পরীয়া এত জোরে জোরে হাসল যে ওর নৌকাটা দুলতে শুরু করল। ও চাইছিল আরও হোক, কিন্তু জাহাজের এমন কাশি উঠল যে ও দমই নিতে পারছিল না। পরীয়া ওটা থামার অপেক্ষা করছিল, কিন্তু জাহাজ ওকে ইশারায় চলে যেতে বলল। নৌকা ঘোরাতে ঘোরাতে ও বলল, “জাহাজ, জাহাজ তুমি বিবিকেও হাসিয়ে ছাড়বে।”
পরদিন সকালে ও যেমন আসে তার থেকেও আগে চালার নীচে এল, কিন্তু জাহাজ কোথাও কেটে পড়েছিল। ও আমাকে জাহাজকে নিয়ে কথা বলতে শুরু করল আর জাহাজের ভাঁড়ামোর বর্ণনা দিতে লাগলো, যেন আমি গতকালের আগে কোনদিন জাহাজের ভাঁড়ামো দেখিনি, প্রকৃতপক্ষে আমি যেন ও ব্যাপারে কিছু জানিই না। আমি কিছুক্ষণ ওর কথা শুনলাম, তারপর ওকে বলার চেষ্টা করলাম যে জাহাজ বাজারের ভিতর দিয়ে পিঠে একটা পাল বেঁধে হাঁটতো, আর ভিড়ের সামনে কিভাবে জাহাজ ডোবে তাই দেখাত। কিন্তু কথায় বা ইশারায় আমি কিছুই বলতে পারলাম না। শেষমেশ, চুপ মেরে গেলাম।
মনে মনে বললাম, “কাল, যেভাবেই হোক কাল আমি বলব।” দৃষ্টির বাইরে চলে যাওয়া অবধি পরীয়াকে দেখতে থাকলাম।
“কাল,” আবার আমি মনে মনে বললাম, “যেভাবে হোক।”
সেইদিন সন্ধেয় বাবা ঘাটে এল। এই এক বছরে উনি আমার আসার আগের আট বছরে জাহাজ যত বুড়ো হয়েছিল তার থেকেও বেশি বুড়ো হয়ে গেছে মনে হলো। ওর হাঁটা থেমে থেমে যাচ্ছিল। প্রায় কোলে করার মতো করেই ওকে ধরে নিয়ে জাহাজ ওর পাশেপাশে হাঁটছিল।
দেখার সঙ্গে সঙ্গেই বাবা আমাকে কোলে টেনে নিল। শেষে জাহাজ আমাকে ছাড়িয়ে তাঁকে নিয়ে বসাল।
ফিরে কাশির দমক শুরু হবার আগে আমার দিকে ঘুরে, জাহাজ বলল, “তোর নতুন মা মরে গেছে।”
আমার আর বাবার কোনো কথা হলো না। উনি আসার একটু পর জাহাজ ওকে নিয়ে কোথায় যেন গেল আর তারপর রাতে একাই ফিরে এল। আমি সবেমাত্র শুয়েছি। ওর রাতের তামাকটা খেয়ে জাহাজ ঘুমিয়ে পড়ল, আর আমি ভেবেই পেলাম না বাবা কিভাবে এত তাড়াতাড়ি এত বুড়ো হয়ে গেল। ভাবছিলাম আমার নতুন মা আমাকে না দেখে, আমার উপর রাগ না করেই মরে গেল। তারপর আমার মনে পড়ল কিভাবে এই একটা বছর আমি শীশাঘাটে কাটিয়ে দিলাম, মনে পড়ল প্রথম প্রথম এই টানা অভঙ্গুর নৈঃশব্দ্যে কি বিরক্তই না হতাম। আর এখন মনে হয় জায়গাটা আওয়াজেই ভরপুর। শীশাপট্টির মজুরদের, মেছুয়াদের, অন্যসব ঘাটের হালকা হাঁকডাক। ঝিলের ওপর জলের পাখিগুলোর ডাকাডাকি। তবে আমি কখনও ওসবে নজর দিইনি। কিন্তু যখনই কানটা একটু খাঁড়া করি, শুনতে পাই, পাড়ের দিকে ঢেউ এসে থমকে যাবার শব্দ, পাড় ছুঁয়ে জল ফিরে যাবার শব্দ, বিবির নৌকার পাটাতনের হালকা ক্যাঁচক্যাঁচ।
আমি সিদ্ধান্তে পৌঁছাই যে শীশাঘাটই আমার জন্য একমাত্র জায়গা, যেখানে থাকবার জন্য আমি জন্মেছি। “আগামীকাল সকালে, জাহাজকে এটা বলব”, নিজেকে এ কথা বলে ঘুমিয়ে পড়লাম।
সকালে যথারীতি জাহাজের কাশির আওয়াজে চোখ খুলে গেল। তারপর পরীয়ার গলাও পেলাম। অন্যদিনের মতো ওরা গল্প করছে। জাহাজ ঘরের ভিতরে যেখানে বসে আছে ওখান থেকে পরীয়ার নৌকো দেখতে পাচ্ছে না বলে কাশতে কাশতে জোরে জোরে কথা বলে চলেছে।
আমি উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। পরীয়া ওর নৌকার মাঝখানটাতে দাঁড়িয়ে ছিল। আরও কিছুক্ষণ বিবিকে নিয়ে জাহাজের সঙ্গে কথা বলার পর ও হেঁটে হেঁটে নৌকার অন্যদিকে গেল। আর নৌকাটা ওর পায়ের নাড়ায় অর্ধবৃত্তাকারে ঘুরে গেল, এখন পরীয়ার পিঠ আমাদের চালার দিকে ঘোরানো।
এই প্রথম আমি পরীয়াকে ভালো করে দেখলাম, আর বিবি যে ওর মা এটা ভেবে আগের থেকেও বেশি আশ্চর্য হলাম। সেই মুহূর্তে পরীয়ার শরীরের মোচড়ে নৌকাটা চালাঘরটা থেকে সরে গেল। তারপর একটু দুলে থেমে গেল। পরীয়া ওর সামনের ঝিলের বিস্তার দেখতে লাগল। নৌকাটা আবার হালকা দুলে উঠল, কিন্তু পরীয়া শরীর টানটান করে টাল সামলালো। প্রায় অদৃশ্য এক পায়ের চাপে নৌকাটা ধীরে অর্ধবৃত্তাকারে ঘুরে গেল।
আমি পরীয়ার মাথা থেকে পা অবধি দেখতে পেলাম, ও ধনুকের মতো দাঁড়িয়ে। আমার ভয় হচ্ছিল, আমি এমনভাবে তাকিয়ে আছি দেখলে ও না আবার রাগ করে, যাই হোক ও আমার দিকে না তাকিয়ে ঘাটের স্থির জলের দিকে এমনভাবে তাকিয়ে ছিল যেন জীবনে এই প্রথমবার তা দেখছে। তারপর, পা গুনেগুনে ও নৌকার যে দিকটা চালাঘরটা কাছে সেদিকে এল। জলের ওপর ঝুঁকে দেখতে লাগল, তারপর উঠে দাঁড়িয়ে এক ঝাঁকুনিতে শরীরটাকে সোজা করে খুব শান্তভাবে যেভাবে কেঊ মাটিতে পা রাখে সেভাবে জলের ওপর পা রাখল। তারপর আরেকটা পা নৌকা থেকে নামল। একপা এগিয়ে গেল, তারপর আরেক পা।
ও জলের ওপর হাঁটছে! বিস্ময়ে আমি হতবাক হয়ে গেলাম, ভয় মেশানো এক বিস্ময়। আমি জাহাজের দিকে ফিরে তাকালাম, ও একটু দূরে বসে তামাক টানছে, তারপর আবার ঝিলের দিকে তাকালাম। পরীয়ার শূন্য নৌকা আর আমাদের চালাঘরের মধ্যে শুধুই জল, গোল গোল করে জলের বৃত্ত ছড়িয়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পরে সেই বৃত্ত থেকে পরীয়ার মাথা উঠে এল। ও বারবার হাতের পাতা দিয়ে জলে এমনভাবে চাপড়াতে লাগল যেন ও জলতলটাকে আঁকড়ে ধরতে চাইছে। জল ছিটকে উঠছে আর জাহাজের গলা শোনা যাচ্ছে, “পরীয়া, জল নিয়ে বোকার মতো খেলো না।”
তারপর এক নাকভরা ধোঁয়ায় ওর গলা ধরে এল, আর ও দ্বিগুণ জোরে কাশতে লাগল। ওকে আমি একঝলক দেখলাম। ওর দম আটকে আসছে-- ওর সাহায্য দরকার। আবার ঝিলের দিকে তাকালাম। আদুড় জলের ওপর নতুন বৃত্তরা ছড়িয়ে পড়ছে।
পরীয়া আবার উঠল, তারপর তলিয়ে যেতে লাগল, ওর সঙ্গে আমার চোখাচোখি হলো।
আমি লাফিয়ে চিৎকার করে উঠলাম, “জাহাজ !” আমার জিভ জড়িয়ে যেতে লাগল।
আমি লাফ দিয়ে বুড়ো মানুষটার দিকে গেলাম। ওর কাশিটা বন্ধ হলো, কিন্তু ওর শ্বাস ঘড়ঘড় করছিল। ও একহাতে বুক মালিশ করছিল আরেক হাতে চোখ ডলছিল। ঝড়ের বেগে সিঁড়ি বেয়ে উঠে আমি ওর হাতদু’টো ধরে জোর ঝাঁকুনি দিলাম।
ম্লান চোখে ও আমার চোখের দিকে চাইল, তারপর ঝলসে উঠল ওর চোখ, আমার মনে হলো ওর হাত থেকে যেন শিকার করা পাখি উড়ে গেছে। চালাঘরের ধূলো উড়িয়ে জাহাজ ঝিলের কিনারে গিয়ে দাঁড়াল।
পরীয়ার নৌকো গোটা একটা বৃত্ত এঁকে ফেলেছে। জাহাজ নৌকাটার দিকে তাকাল, তারপর জলের দিকে। তারপর অপরিচিত এক ভাষায় শরীরের সমস্ত জোর এক করে চিৎকার করে উঠল। আমি শুনলাম বিবিও ওরকমই একটা ডাক ছাড়ল। তারপর দূর, দূর থেকে সেই ডাক ফিরে ফিরে এল। বিবি শুধোল, “কার কপাল পুড়ল ?”
“পরীয়া!” জাহাজ এত জোরে বলল যে সামনের জল কেঁপে উঠল।
কাছে দূরে অন্যদের গলাতেও জাহাজের আর্তচিৎকার বারবার ঘুরতে লাগল। মেছুয়ারা, কেউ খালি হাতে, কেউ আবার জাল নিয়ে নানান দিক থেকে ঘাটের দিকে আসতে লাগল। চালা-ঘরটার কাছাকাছি আসবার আগেই অনেকে জলে নেমে গেল। জাহাজ যখন ওদের হাত দিয়ে জায়গাটা দেখিয়ে দিচ্ছিল তখন বাঁদিক থেকে একটা জল ছেটানোর শব্দ শোনা গেল। দেখলাম একটা কুকুর বড়ো নৌকাটায় ঝাঁপাঝাঁপি করে দৌড়চ্ছে, আর ছাদ থেকে দু’টো বেড়াল পিঠ বেঁকিয়ে ওটার দিকে চেয়ে আছে। তারপর দেখলাম বিবিকে, জল কেটে এগিয়ে আসছে, প্রায় উদোম, যেন মানুষখেকো কাঁটাওয়ালা একটা মাছ। ডুব দিয়ে বিবি নৌকোটার অন্যদিকে এল। কয়েকটা মেছুয়াকে কিছু একটা দেখিয়ে আবার ডুব দিল।
অন্যঘাটের মেছুয়াদের দেখলাম আমাদের দিকে আসছে। ওদের কেউকেঊ নৌকো থেকে ঝাঁপ দিয়ে তাদের নৌকোর আগে আগে আসতে লাগল। চালাঘর আর পরীয়ার নৌকোটার মাঝখানের জলে সর্বত্র বুদ্বুদ উঠতে লাগল। ভীড় বাড়তে লাগল, পাড় ধরেও। সর্বত্র হৈচৈ আর তোলপাড়। সর্বত্র কথা, কিন্তু কে কাকে কী বলছে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। জল ঝাপটানোর ভীষণ আওয়াজ সমস্ত সময়চেতনাকে ধূসর করে দিচ্ছিল। অবশেষে একটা জোর আওয়াজ ছড়িয়ে পড়ল। শোরগোল চরমে উঠে হঠাৎই যেন নিভে গেল। জলে যারা সাঁতার কাটছিল তারা নিঃশব্দে, আস্তে আস্তে এক জায়গায় জড়ো হলো। সবাই চুপ, শুধু নৌকা থেকে কুকুরটা ভৌ ভৌ করে যাচ্ছে। সেই মুহূর্তে মনে হলো আমার হাতটা যেন লোহা-চাপায় দুমড়ে যাচ্ছে। জাহাজ আমার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল।
আমায় হাত নেড়ে বলল, “চলে যা।”
আমি বুঝতে পারছিলাম না জাহাজ আমাকে কোথায় যেতে বলছে। ও আমাকে টানতে টানতে বাড়ির ভিতর নিয়ে গেল। পিছন ফিরে আমি ঝিলের দিকে তাকাবার চেষ্টা করলাম, কিন্তু ও আমার হাতটা ধরে টানতেই থাকল। ওর দিকে তাকালাম। ওর দৃষ্টি যেন আমার মুখে আটকে গেছে। আবার বলে উঠল, “যা...আ...”
আমরা বাড়ির খিড়কি দরজায় এলাম। জাহাজ দরজাটা খুলল। সামনে পোড়ো জমি। প্রথমে বলল, “ওরা ওকে পেয়েছে।” আর তারপরই তাড়াহুড়ো করে সেই জমির দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, “খুব তাড়াতাড়ি শীশাপট্টিতে চলে যা। ওখানে কাউকে পেয়ে যাবি যে তোকে এখান থেকে বাইরে নিয়ে যাবে। তেমন কাউকে না পেলে যাকে হোক আমার নাম বলবি।”
একটা রুমালে বেঁধে কিছু টাকা জাহাজ আমার পকেটে গুঁজে দিল। ওকে আমার অনেক কিছু জিজ্ঞেস করার ছিল, আর আমি এখান থেকে যেতেও চাই না, কিন্তু ও বলল, “একমাত্র তুই-ই ওকে ডুবতে দেখেছিস। সবাই তোকেই জিজ্ঞেসাবাদ করবে। সবচে’ বেশি করবে বিবি। তুই কি তার উত্তর দিতে পারবি?”
আমার চোখে সেই দৃশ্য ভেসে উঠল ― অনেক লোকজন, কানে মাকড়ি পরা সব মেছুয়া, হাতে বালা পরা সব মাঝি- মাল্লা, নানান ঘাটের লোকজন ― সবাই আমাকে ঘিরে দু’তিন সারে একটা বৃত্ত তৈরি করেছে, সব দিক থেকে প্রশ্ন উড়ে আসছে, বিবি আমার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে আছে... যখন বিবি আমার দিকে এগোল তখন সবাই চুপ ...
আমাকে কাঁপতে দেখে জাহাজ বলল, “কী হয়েছিল বল তো। কোনোকিছু... ও কি জলে পড়ে গেছিল ?”
“না,” আমি কোনোমতে বলতে পারলাম।
“তাহলে, কিভাবে এটা হলো ?” জাহাজ জিজ্ঞেস করল। “ও কি ঝাঁপ দিয়েছিল ?”
বললাম, “না,” আর সেটা মাথা নেড়েও জানালাম।
জাহাজ আমাকে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলল, “কিছু বল, তাড়াতাড়ি!”
আমি জানতাম আমি জিভ নেড়ে কিছু বলতে পারবো না, তাই আমি হাত নেড়ে বোঝাতে চাইলাম যে পরীয়া জলের ওপর দিয়ে হাঁটার চেষ্টা করছিল। যদিও আমার হাত দু’টোও বারবার থেমে থেমে যাচ্ছিল। আমি বুঝতে পারছিলাম যে আমার অঙ্গভঙ্গীগুলোও তুতলে যাচ্ছে, আর সেগুলো দিয়েও আর কিছু বোঝানো যাচ্ছে না।
চাপা গলায় জাহাজ বলল, “ও জলের ওপর হাঁটছিল ?”
অনেক কষ্টে বললাম, “হ্যাঁ।”
“আর ও নীচে চলে গেল ?”
“হ্যাঁ।”
“বিবির দিকে মুখ করে ছিল ?”
“না।”
“তাহলে, কোনদিকে মুখ করে ছিল ? ও কি আমাদের দিকে আসছিল ?”
“হ্যাঁ,” আমি নেড়ে জানালাম।
জাহাজ মাথা নীচু করল আর আমার চোখের সামনে আরও বুড়ো হয়ে গেল।
বলে চলল, “আমি ওকে প্রতিদিন দেখতাম...” ― শব্দগুলো কাশি মেখে বেরিয়ে এল ― “কিন্তু আমি কোনদিন খেয়ালই করিনি বড়ো হতে হতে ওকে দেখতে কেমন হয়েছিল।”
আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে জাহাজের আরো বুড়ো হয়ে যাওয়া দেখছিলাম।
আমার কাঁধে হাত রেখে ও বলল, “ঠিক আছে, যা! ওদের আমি যা হোক কিছু একটা বলে দেবো। তুই কাউকে কিচ্ছুটি বলিস না।”
ভাবলাম, কাউকে আমি কী বলব ? ঘাট থেকে সরে যাওয়া আমার মনোযোগ আবার ঘাটের দিকে ফিরে গেল। কিন্তু জাহাজ আমাকে আদর করে ঘুরিয়ে খোলা মাঠের দিকে ঠেলে দিল।
যখন মাঠে শেষ প্রান্তে পৌঁছে ওর দিকে ফিরলাম, ও বলল, “কাল তোর বাবা তোকে নিতে এসেছিল। আমি ওকে আরো কয়েকটা দিন অপেক্ষা করতে বলেছিলাম।”
আবার ও একটু কাশল। দরজার খোবলা দু’টো ধরে আস্তে আস্তে পিছন ফিরতে লাগল।
দরজাটা বন্ধ হবার আগেই আমি ঘুরে হাঁটতে শুরু করলাম। পনের পা গেছি শুনলাম জাহাজ আমার নাম ধরে ডাকছে। ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখলাম ও আমার দিকে থেমে থেমে আসছে। ওকে দেখে মনে হলো ও যেন হাওয়ায় পাল ভাঙা একটা জাহাজকে নকল করতে করতে আসছে। কাছে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল। অনেকক্ষণ ওভাবেই রইল। তারপর আমাকে ছেড়ে ফিরে গেল।
“জাহাজ!” ঘাট থেকে বিবির বিলাপ শুনতে পেলাম।
শেষবারের মতো বুড়ো ভাঁড়ের দৃষ্টি আমাকে চেয়ে দেখল, আমি ঘুরে হাঁটতে লাগলাম।
লেখক পরিচিতি
নাইয়ার মাসুদ
উর্দুভাষী কথাসাহিত্যিক ভারতের লখনৌ শহরে জন্মেছেন ১৯৩৬ সালে। । লখনৌ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্সি ভাষার অধ্যাপক। কাফকার লেখার অনুবাদক। এছাড়া ফার্সি সাহিত্যেরও অনুবাদক। Essence of Camphorএবং Snake Catcher তাঁর বিখ্যাত গল্পের সংকলন। ভারতের সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার পেয়েছেন।
নাইয়ার মাসুদ
উর্দুভাষী কথাসাহিত্যিক ভারতের লখনৌ শহরে জন্মেছেন ১৯৩৬ সালে। । লখনৌ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্সি ভাষার অধ্যাপক। কাফকার লেখার অনুবাদক। এছাড়া ফার্সি সাহিত্যেরও অনুবাদক। Essence of Camphorএবং Snake Catcher তাঁর বিখ্যাত গল্পের সংকলন। ভারতের সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার পেয়েছেন।
_____________________________________
অনুবাদকের নোট:
এই গল্পটি বাঙ্গালোর থেকে প্রকাশিত ‘সৌঘাত’ পত্রিকায় ১০ মার্চ, ১৯৯৬-য়ে প্রথম প্রকাশিত হয় এবং পরের বছর ১৯৯৭ সালে ‘কথা’ পুরস্কার পায়।
গল্পের প্রথমে থাকা নাজ়িরি নিশাপুরি’র রচনাটির খসড়া তর্জমা নীলাঞ্জন হাজরা’র।
― বিকাশ গণ চৌধুরী
0 মন্তব্যসমূহ