সুজ্যান ডুমেসনীল্ ওরফে মিসেস স্যামুয়েল বেকেট অথবা বেকেট স্বয়ং লিখিত গল্প : ফ





অনুবাদ: অর্ক চট্টোপাধ্যায়

['F--' গল্পটি ১৯৪৯ সালের ১৫ই জানুয়ারী Transition পত্রিকায় প্রকাশিত হয় স্যামুয়েল বেকেটের স্ত্রী সুজ্যানের নামে, যিনি তখনো তাঁর স্ত্রী ছিলেন না। অবশ্য তারা তখনও একসাথেই থাকতেন। এই গল্পটি লেখার সময় বেকেট ফরাসিতে En attendant Godot নাটকটি লিখছিলেন। গল্পটি ফরাসী থেকে ইংরেজিতে কে অনুবাদ করেছিলেন জানা যায় না কারণ পত্রিকায় অনুবাদকের নাম ছিলো না। বেকেট তাঁর জীবনীকার জেমস নোলসনকে বলেছিলেন হয়ত তিনিই এই গল্পটি অনুবাদ করে দিয়েছিলেন কিন্তু তিনি নিশ্চিত ছিলেন না। সুজ্যান পরে কখনই কোনরকম লেখালিখি করেননি এবং এই গল্পটি বিষয় এবং শৈলীর দিক থেকে বেশ বেকেটীয় হওয়ায় অনেক বেকেট-গবেষক এটিকে স্যামুয়েল বেকেটেরই লেখা বলে সন্দেহ করেছেন। লেখাটি নিজগুণেই থেকে যাক বরং, লেখকহীনভাবে। অথবা পদবির ছলনাকে আশ্রয় করে বলা যাক 'বেকেট' এই গল্পের লেখক বা লেখিকা!]


আমি দিব্ব্যি নিজের পথে যাচ্ছিলাম। লোকটা কোত্থেকে এসে সজোরে ধাক্কা মারলো ! ওরে বাবা, এবার কি হলো, সে বললে। ধাক্কার চোটে আমরা দুজনেই পড়ে গিয়েছিলাম আর আমি পড়েছিলাম ঠিক তেমনি করে যেমন এক্কেবারে শেষে এসে সবকিছু হুড়মুড়িয়ে পড়ে যায়; যখন তাদের নিজেদের জায়গা থেকে যেমন তেমন করে বিন্দুমাত্র মায়া মমতা ছাড়াই সরিয়ে দেওয়া হয়। লোকটা বুঝতে পারেনি ঠিক কি হয়েছে। আমিও পারিনি। নিশ্চত করে একটা কথাই বলতে পারি: আমি আর ও একই রাস্তায় একই সময়ে এসে পড়েছিলাম, এই আর কি! না, আরেকটা কথা নিশ্চিত করে বলা যায়: আমি ছিলাম আগে আর ও আমায় পেছন থেকে এসে ধাক্কা মেরেছিল। ও নিশ্চই মাথা নিচু করে হাটছিল এবং বেশ জোরে, অন্তত আমার থেকে জোরে তো বটেই! হয়ত চোখ বুজে এসেছিলো। খোলা থাকলে নিশ্চই আমায় দেখতে পেত সামনে, সে যতই হোক না কেন রাত, গহিন রাত। আবছা হলেও দেখতে ঠিকই পেত। কিন্তু আমার তো মনে হয় দেখতে না পেলেও ওর আমার পায়ের শব্দ শুনতে পাবার কথা ছিল! তবে এত্ত হাওয়া! আমি অবিশ্যি হাটার বেলায় শব্দ টব্দ করি না। অদ্ভূত। কিন্তু আমার তাও মনে হয় আমার অন্তত ওর পায়ের শব্দ শুনতে পাবার কথা ছিল! আমি কানে খুবই ভালো শুনি, নিয়মমাফিক। কিন্তু তাও আমি পড়ে যাওয়া অব্দি কিছুই শুনতে পাইনি। তারপর শুনতে পেলাম। আগেকার মতই, নিয়মমাফিক। হে ভগবান, এ কি হচ্ছে আমার, কথাগুলো এখনো আমার কানে বাজছে। অথছ লোকটা যে কথাগুলো চেঁচিয়ে বলেছিল তাও নয়। এক্কেবারেই না, এক্কেবারেই না। আমি ক্লান্তভাবে বললাম, আমার লাগেনি। কিছুক্ষণ সব চুপ। লোকটা বললো আপনার কি লেগেছে? না, আমার সত্যিই লাগেনি। আমি নিজেকে বেশ বুঝতে পারছিলাম। আমি গোটাটাই অক্ষত ছিলাম। হাওয়ার উল্টোদিকে উঠে দাড়ালাম, হাওয়াটা যেন উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছিলো। আমার খোলা চামড়ায় হুল ফুটছিলো। কিন্তু শরীরের অন্যান্য অংশে, মানে ঢাকা অংশে হুল ফুটছিলো না; সেখানে শুধুই ঠান্ডা লাগছিলো আর কি! আমি শরীরের গাঁটগুলোকে নাড়িয়ে চাড়িয়ে দেখে নিলাম, না, সবই নড়ছে চড়ছে সশব্দে! তখনও রাত্তির। ঐসব পেল্লাই পাহাড় আর তাদের নিকষ ছায়া, ওকেই যেন রাত্তির বলে! লোকটার সাহায্য নিয়েই উঠে দাড়ালাম কিম্বা বলা যায় ওর আমায় সাহায্য করার ইচ্ছার জোরেই উঠে দাড়ালাম। আমাকে দাঁড় করাতে গিয়ে মাঝপথে লোকটা গেলো পড়ে। আমিও। আবার। বারবার। বার বার। শেষে কিছুতেই আর দুজনে একসাথে উঠে দাড়াতে পারি না! আমি গোটাটাই অক্ষত ছিলাম, আগেও বলেছি। লোকটা ছিল না। ওর দরকারী কি যেন একটা জিনিস খোয়া গেছিলো। আমি জানি না কি, কিছু একটা যেটা নাকি ও নিজের হিপ-পকেটে রেখেছিলো বা ওর মনে হচ্ছে রেখেছিলো। লোকটা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ল। আমার অবাক লাগলো যে ওই একটা ক্ষতিতে ও অমন করছে যদিও আমার অবাক লাগাটা সহজ ছিল কারণ আমি তো আর কিছু হারাইনি নয়তো অবাক হবার কিছু ছিল না। সহজ ব্যপার। আমি আবার কি হারাবো? আমি ওকে জিনিসটা খুজতে সাহায্য করেছিলাম যথাসাধ্য। যদিও ওকে সাহায্য করাটা ঠিক আমার ক্ষমতায় ছিল না, তবুও। জিনিসটা কেমন তা আমি জানতাম না, আর ওই জমাট ঠান্ডা, নিকষ অন্ধকার আর গহীন রাত সবই আমার বিরুদ্ধে ছিলো। আমি শুনলাম লোকটা আমায় ডাকছে। অথচ আমি ওর কাছেই ছিলাম। অন্ধকারে আমরা সহজেই রাস্তা হারিয়ে ফেলি কিনা। আমি কি সত্যিই অর ততোটা কাছে ছিলাম যতোটা আমি ভাবছিলাম? আমি এখানে বলে সাড়া দিলাম, বললাম ভয় পেয়োনা। লোকটা বললো জোরে বলো, আরো জোরে, কি বলছো শুনতে পাচ্ছি না ঠিক। আমি কথা বললে কেউ শুনতে পায় না। অদ্ভূত। লোকটা এবার চেঁচালো তুমি কোথায়? আমায় ছেড়ে যেও না। আমি যেতে চাইছিলাম এমনটা নয়, মানে ওকে ছাড়া তো নয়। কিন্তু আমার যেটা মনে ধরলো তা হলো ওর এই ভাবনাটা আমার ভাবনার খুব কাছাকাছি ছিলো। রাত্তিরের চাদর ঠেলে আমি ওর দিকে এগোলাম। ওর গলা শুনে। ওর হাত উঠে এলো আমার শরীরে। ও নিজেকে শান্ত করছিলো। আমি কিছুই খুঁজে পেলাম না, ও বললো। তুমি কি কিছু খুঁজছিলে? ও বললো। কেন? জিনিসটা! ও হ্যা, জিনিসটা! ও যেন একটু থম মেরে বলল কথাটা, থাক ওটা দরকারী নয়। আহ। ও আমার হাত ধরলো আর আমরা এগিয়ে গেলাম। হতচ্ছাড়া হাওয়াটার কি যেন দুশমনি ছিলো আমাদের সাথে--রাগে আমাদের আছড়ে আছড়ে ফেলছিল এপাশ ওপাশ। কিন্তু আমরাও লড়ে গেলাম কাঁধে কাঁধ আর হাতে হাত রেখে। ঠিক যেন। ঐরকম হাওয়ার বিরুদ্ধে দাড়ানোটা সত্যিই কষ্টকর ছিলো। হাওয়াটা যেন আমাদের দুই ফালা করে দিচ্ছিলো কিন্তু না, করে দিচ্ছিলো না। হাতে হাত ধরা ছিলো শক্ত করে। আমরা দুজন একজনের মত করে এগিয়ে যাচ্ছিলাম, যেন আমরা আসলে একজনই ছিলাম আর সেইখানেতেই ফিরে গিয়েছিলাম। আমার যে হাতটা খালি ছিলো, মানে ওর হাতে ধরা ছিল না, সেটা ঠান্ডায় জমে গিয়েছিলো, ঠিক মরা মানুষের মত। এটা ঠিক যে মাঝে মাঝে একটু শান্ত হচ্ছিল হাওয়াটা, তখন আমরাও হাতগুলো খানিক আলগা করে নিচ্ছিলাম যাতে আবার শক্ত করে ধরা যায়। আর তখনই আবার আঘাত হান্ছিলো সে। এটা কি ঠিক রাস্তা ছিলো? শেষ মোড়টায় বাঁদিকে ঘুরে কি ভুল রাস্তায় এসে পড়েছিলাম? আমি আসলে ফ--এর দিকে যাচ্ছিলাম। আমরা কি ফ--এর রাস্তায় আছি?, ও শুধলো। ও বললো ও যাচ্ছে অমুক জায়গায়, সেটা ফ--এর কাছাকাছি। শেষ মোড়টার পর আমি ওকে ছাড়া আর কাউকে দেখতে পাইনি। আমি ভাবলাম, আমি আর ও, আমরা কি তবে ভুল রাস্তায় চলে এলাম, অত ব্যস্তসমস্ত একটা রাস্তায় আমরা ছাড়া আর কেউ নেই এ কেমন করে হয়? ফ--এর রাস্তা খুবই ব্যস্তসমস্ত থাকে, সে যতই এমন আবহাওয়া হোক না কেন। ওখানে থাকা কি এমনিতেও সহজ নাকি! ওদিকে সমুদ্রের হাওয়ায় আমরা তো প্রায় উড়ে যাচ্ছিলাম, লোকটা বললো, শোনো , আচ্ছা ওটা কি সমুদ্রের শব্দ? আমি ভাবলাম হয় সমুদ্রের শব্দ, নাহলে হাওয়ারই শব্দ, দূর থেকে অমন শোনাচ্ছে! আমি বললাম আমি সমুদ্র খুব ভালবাসি। এটা বলেই আমি হেসে ফেললাম। আমি মাঝে মাঝে হেসে ফেলি আর কি। ওহ আবার হাসি। ও আমাকে হাসতে বলছিলো। আবার? হাওয়াটা মনে হচ্ছে কমে আসছে ও বললো, আচ্ছা আমরা যদি ফিরে যাই, কেমন হয়? না না, এই অন্ধকারে কিছুই খুঁজে পাব না তো, আমি বললাম। রাত্তিরটা তো শেষ হবেই শেষে, ও বললো। আমাদের কি করা উচিত? আমাদের কি করা সম্ভব? আমরা চুপ, নিথর চুপ। আমি দেখলাম আমরা পেছনে ঘুরছি, আমি দেখলাম আমরা চলে যাচ্ছি। আমি। আমরা। আর আমি নিথর। চারিদিকে জমাট ঠান্ডা। আমার রক্ত গুলিয়ে এলো সেই ঠান্ডায়, আমার নিথর রক্ত। আমি ভাবলাম সবার আগে আমার কিছুটা তাপ দরকার। তুমি কি বলো, ও বললো। হায়, ও বললো আর আমি শুনলাম না। ও হয়তো এমন কথাই বললো যার ভেতর কিছুটা তাপ ছিলো, কিন্তু হায়, আমি শুনলাম না। ও বলেই চললো, বেশিক্ষণ লাগবে না, দেখো, আমি যাব আর আসব, তুমি ততক্ষণ একটু জিরিয়ে নাও। আমি বললাম, জানি না, ঠিক বুঝতে পারছি না, কিন্তু ও আমার কথা শেষ করতে দিলো না অবশ্য আমার তেমন কিছু শেষ করার ছিলোও না। রাস্তার পাশ দিয়ে যে পরিখার মত ছিলো ও তার ধারে নিয়ে গেল আমায়। ও আগে ওই পরিখার মত জায়গাটায় নামলো। তারপর আমিও ওর পেছন পেছন নেমে গেলাম। ওটার ভেতর সেধিয়ে মনে হলো, না, একটা ঠাই হয়েছে অন্তত। আমি দেওয়ালে পিঠ দিয়ে বসলাম, মাথাটা একদিকে এলিয়ে দিলাম। ও আবার দেওয়াল বেয়ে ওপরে উঠে গেলো, আমায় বলে গেলো, চিন্তা কর না, আমি যাব আর আসব। ও চলে গেলো। আমার কানে ওর পায়ের শব্দ সজোরে এসে আঘাত করতে লাগলো আর আমি মাটিতে কান পেতে শুনতে লাগলাম। যখন ওর পায়ের শব্দ আর শুনতে পেলাম না, মনে হলো ও পৌছে গেছে, এবার শুধু ফেরার অপেক্ষা। এটা ভেবে আমার বেশ আনন্দ হলো। শীতের রাতগুলো বড্ড বড়। ভোরের মিয়োনো আলোয় আমি ঘুম থেকে উঠলাম। রাস্তায় কেউ ছিলো না। আমার চোখদুটো জ্বালা করছিলো। আমি চোখ বন্ধ করলাম। আবার যখন চোখ খুললাম, দেখলাম ফ--এর বাইরের দিকের প্রথম বাড়ির ছাদগুলো চোখে পড়ছে। আগে কখনো না দেখেও আমি বুঝে গেলাম এটাই ফ--। তাহলে, আমি শেষ অব্দি পৌছে গেলাম। অথবা প্রায়।



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ