ওয়াতানাবে অন'এর গল্প: পিতৃহারা

 

বাংলায় রূপান্তর: দোলা সেন

সকালে ঘুম ভাঙতেই বাবার দিকে চোখ গেল। আমার মাথার কাছের বেসিনটার সামনে দাঁড়িয়ে দাড়ি কামাচ্ছে। যাক, অনেকদিন বাদে দাড়িটা ক্ষুরের ছোঁয়া পেল। হাওয়ায় পর্দাটা ওড়ায়, ঝলমলে রোদ্দুর আমার বাবার গালে আলোছায়ার আলপনা এঁকে দিচ্ছিল। শুয়ে শুয়েই বললাম,

- কি সুন্দর দিন, না বাবা?

- সুন্দর আবহাওয়া! আর না গড়িয়ে চটপট তৈরি হয়ে নে তো। আজ তোকে বন্দর দেখাতে নিয়ে যাব।

বলতে বলতে বাবা নিখুঁতভাবে দাড়ির শেষ ডগাটাকেও কামিয়ে ফেলছিল। আমি খুশিতে প্রায় নেচে উঠলাম।

- সত্যি বলছ? কিন্তু তুমি হঠাৎ দাড়ি কামাচ্ছ কেন বাবা?

- দাড়ি থাকলে আমাকে তোর বাবা মনে হয় যে। তুই কি বলিস?

বাবা আমার মুখের কাছে মুখ এনে একটু জিভ ভেঙিয়ে দিল।

- কি যে বলছ ছাই, কিছুই তো বুঝছি না।

- হুম। তা ব্যাপারটা হলো গিয়ে, দাড়িটা না থাকলে আমাকে একটু কমবয়েসী দেখায়। ঠিক বাবার মতো দেখায় না। ভাবছি তোকে নিয়ে বন্দরে যাব, আর সেখানেই তোকে ছেড়ে দিয়ে আসব। ভালো বুদ্ধি কিনা বল?

- উঃ, যত্তসব মিছে কথা!

বলতে বলতে আমি বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লাম। বাবা আমায় চটপট তৈরি করে দিচ্ছিল। ফ্লানেল কাপড়ের নতুন জামা!

বাবাও তৈরি হলো। দর্জি দিয়ে বানানো নতুন পোষাক, লাল নেকটাই! বাবার স্ট্র হ্যাটটায় কি মিষ্টি গন্ধ! আমি এটা আগে দেখিনি। তারপর আমরা বেরিয়ে পড়লাম। বেগনে গোলাপী রঙের ভোরের আলো মাখা চারপাশের বাড়ির লোকজন সম্ভবতঃ তখনো ঘুমের দেশে।

বাবা লম্বা ওয়াকিং স্টিকটা এদিক ওদিক ঘোরাতে ঘোরাতে চলছিল। রাস্তাটা এখন নির্জন। আমরা রেলওয়ে স্টেশনের দিকে যাচ্ছিলাম। বাবা বলছিল.

- কারো সঙ্গে দেখা না হলেই বাঁচি।

- কেন বাবা?

বাবা আমার কথার জবাব দিল না। বরং নিজের মনেই বকবক করতে লাগল –

- ছেলে ব্যাপাটা সবচাইতে বাজে। বাবা আর ছেলের বয়েসের তফাত হলো গে মোটে দশ বছর! আমার সহ্যের সীমা পেরিয়ে যাচ্ছে!

- কেন বাবা?

আমি বাবার দিকে চাইলাম। কিন্তু বাবা যেন আমার কথা শুনতেই পেল না। কোনো উত্তর না দিয়ে নিজের মনেই হাসল। আমার কেমন ভয় করছিল। আমি বাবার গা ঘেঁষে চলতে চাইছিলাম। কিন্তু বাবা আমায় সহজ ভাবেই ঠেলে সরিয়ে দিল। তারপর অদ্ভুত শান্ত গলায় বলল.

- এতো কাছে আসিস না। লোকে ভাববে আমরা দুই ভাই। আমার সেটা মোটেও ভালো লাগবে না।

আমি রাগের চোটে মুখ বেঁকালাম। চোখের আগুনে বাবার পরিষ্কার কামানো মুখ আর লাল নেকটাইটাকে ছাই করে দিতে চাইলাম।

কয়লার ইঞ্জিনওয়ালা ট্রেনটা এল। আমরা চড়ে বসলাম। বাবা বাইরের দিকে তাকিয়ে শহরটাকে মিলিয়ে যেতে দেখছিল, আর ‘একটি যুবকের স্বপ্ন’ গানটা শিস দিয়ে গাইছিল। আর আমার মনে হচ্ছিল দুজনের মধ্যে একটা শীতল দূরত্ব তৈরি হচ্ছে। আমি উদ্বিগ্নভাবে জানতে চাইলাম,

- আমরা কি সত্যিই বন্দর দেখতে যাচ্ছি?

- হ্যাঁ। হয়তো একটাতে চড়তেও পারি...

কথা বলতে বলতেই বাবা, বুকপকেট থেকে একটা উজ্জ্বল বেগুনি রুমাল বের করে একটা চশমা মুছতে শুরু করল। টরটয়েজ গ্লাস! দামী চশমার পিছনের চোখদুটিতে কোনো অপরাধবোধ ছিল না। রুমাল থেকে আসা কোটি কোলোনের গন্ধে আমার দম বন্ধ লাগছিল। চশমা পরে বাবাকে পুরোই অন্যরকম দেখাচ্ছিল।

- বাবা, তুমি চশমা পরলে কেন?

এইবারে বাবা সত্যি ক্ষেপে লাল হয়ে উঠল।

- বাবা! হাঁদা ছেলে কোথাকার! তোর কেন মনে হলো যে, আমি তোর বাবা? আরেকবার বাবা বলে ডেকে দেখ, তোকে আমি কী করি!

- .............তখন... হঠাৎ আমার মনে হলো, এই লোকটা ..... এই উচ্ছে খাওয়া মুখ নিয়ে বসে থাকা লোকটা আমার সত্যিকারের বাবা নয়। আজ সকালে ঘুম থেকে উঠে এই লোকটাকে আমি বোধহয় বাবা বলে ভুল করেছিলাম। এর সঙ্গে আমার সম্পর্কটা রহস্যে মোড়া। এই যে লোকটাকে আমি বাবা বলি, সে আসলে আমার চেয়ে মোটে দশ বছরের বড়ো! যে কেউ বলবে এই সম্পর্কটা স্বাভাবিক নয়, সত্যি নয়।

আমার শরীর খারাপ লাগছিল। একমাত্র আমাকে বাদ দিয়ে সবকিছুই সংশয়ে ভরা। আমি বিভ্রান্ত মুখে বসে রইলাম।

- অমন মুখ করিস না তো! কান্নাকাটি শুরু করলে, আমি কিন্তু তোকে ট্রেনেই ফেলে দিয়ে চলে যাব।

বাবা খুব রুক্ষ্মভাবে কথাটা বলল বটে, কিন্তু তারপরেই আমাকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করতে থাকল।

- ঠাট্টা করছিলাম রে বাবা। তুই কি সত্যিই ভাবলি, আমি এমন কিছু করতে পারি? আসলে তুই যে আমায় বিদায় জানাতে আসতে পেরেছিস, তাতে আমি খুশি হয়েছি।

বাবা হাসছিল। আর বাড়ি ছেড়ে আসার জন্য আমার খুব আফসোস হচ্ছিল। কিন্তু এখন আর আমার কিই বা করার আছে? আমি জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখতে চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু চোখের জলে তা ঝাপসা হয়ে যাচ্ছিল।

বন্দর স্টেশনে পৌঁছে বাবা স্টেশন অ্যাটেন্ডেন্টকে ডাকল। সে দুটো বড় বড় লাল চামড়ার সুটকেস নিয়ে এল। আমি একটা সুটকেস নিয়ে গাড়িতে উঠলাম। আমরা জেটির দিকে যাচ্ছিলাম। পুরো রাস্তাটা আমি ভাবতে ভাবতে চললাম যে, এগুলো কখন কেনা হলো! সুটকেসের নেমপ্লেটের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, সেখানে কিছুই লেখা নেই। বাবা হাতের টুপিটা দোলাচ্ছিল। গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখছিল। লাল নেকটাই হাওয়ায় পতপত করে উড়ছিল। বাবার মুখটা কি বিচ্ছিরি রকমের ধূর্ত আর দয়ামায়াহীন! আমার ছোট্ট বুকটা হতাশায় ভরে উঠল। আমি মুখ ফিরিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকলাম।

বন্দরের গেটে বড় বড় করে লেখা ছিল – “এস এস সাকুসোনিয়া সকাল সাতটায় ছাড়বে।“ আমার বাবা দুহাতে দুটো সুটকেস টানতে টানতে এস এস সাকুনিয়ার দিকে রওনা হলো। আমি জেটিতে দাঁড়িয়ে জাহাজের কালো লোহার গায়ের দিকে তাকিয়ে রইলাম। একটু পরে জাহাজ থেকে ঘন্টা বাজল আর মোটা চিমনিটা থেকে বাষ্প বের হতে থাকল।

জাহাজের ডেক থেকে আমার বাবা হাসিমুখে আমাকে চিৎকার করে বলল -

- সবকিছুর জন্য ধন্যবাদ রে! ভালো থাকিস। নিজের যত্ন নিস।

আমি সব আওয়াজ ছাপিয়ে চেঁচিয়ে বললাম – তুমিও ভালো থেকো!

জাহাজটা বন্দর ছেড়ে চলল। আমার বাবা ডেক থেকে তার নতুন হ্যাট দুলিয়ে আমাকে বিদায় জানাচ্ছিল। আমিও প্রাণপণে আমার কাপড়ের টুপিটা নাড়তে থাকলাম।

তারপর আমি জেটির এককোণে বসেই থাকি। সারাদিন সমুদ্রের হাওয়া আমায় ঘিরে থাকে। অবশেষে নীল জামা, নীল বোতামওয়ালা এক কাস্টমস অফিসার এসে আমার কাঁধে হাত রাখে।

- কি ব্যাপার? জলে ঝাঁপ দিয়ে মরার বুদ্ধি করছ না তো?

আর, এতক্ষণ পরে, আমি ভীষণ দুঃখে ভেসে গেলাম। ফোঁপানি শুরু হলো।

- আরে আরে! এভাবে নয়। কাঁদলে কোনো ফল হয় না। বলো, কি হয়েছে?

- আমার বাবা.... আমার বাবা হারিয়ে গেছে!

তারপর কিভাবে আমার বাবা আমাকে বোকা বানিয়েছে, সে সব খুলে বললাম। অফিসারটি জানতে চাইল -

- তোমার বাবাকে কেমন দেখতে?

- বলছি.... চেষ্টা করছি, দাঁড়াও। হ্যাঁ জানো, আমার বাবাকে না, এই, তোমার মতোই দেখতে। বাবারও কোনো দাড়ি নেই। পরিষ্কার কামানো মুখ। সত্যি বলছি, ঠিক তোমার মতোই।

আমি কেঁদে ফেললাম। অফিসারটি হতাশভাবে তার সদ্য কামানো গালে হাত বোলাল।

- আমার বাবা। কামানো দাড়ি, মাথায় স্ট্র হ্যাট, চোখে টরটয়েজের চশমা (যেটা সে মাঝে মাঝে পড়ে), লাল নেকটাই। একজন ভদ্রলোকের মতোই চেহারা।

দয়ালু কাস্টমস অফিসারটি সব বর্ণনা লিখে নিচ্ছিল। সে সেটা এস এস সাকুসোনিয়ার পরের বন্দরের অনুসন্ধান অফিসে পাঠিয়ে দিল। একমাত্র লাল নেকটাই ছাড়া বর্ণনাটায় এমন কিছু ছিল না, যা থেকে তাকে জনতার মধ্যে থেকে শনাক্ত করা যায়।

আর ঠিক এইভাবেই আমার বাবা আমাকে ছেড়ে চলে গেল। এরপর আমাকে একদম একা একা, অসহ্য জীবন কাটাতে হবে। তবু, যতই শক্ত হোক না কেন চেনা, আমি তার মুখটি মনে রাখব সবসময় – সে দাড়িসুদ্ধই হোক, অথবা দাড়িছাড়া।


মূলগল্প: Losing My Father by Watanabe On, English translation by Hamish Smith


লেখক পরিচিতি:

ওয়াতানাবে অন একজন প্রতিভাবান জাপানী লেখক। জন্ম ২৬ শে আগস্ট, ১৯০২। মৃত্যু ১০ই ফেব্রুয়ারি,১৯৩০। স্বল্প জীবনেই তিনি তাঁর প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গেছেন। খুব সামান্য কথায় গভীর ভাবপ্রকাশে তিনি সিদ্ধহস্ত ছিলেন।



অনুবাদক পরিচিতি:
দোলা সেন
গল্পকার। অনুবাদক
আসানসোলে থাকেন

 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2 মন্তব্যসমূহ