আচ্ছা, তো আমি প্রত্যেকের গল্প মন দিয়ে শুনলাম শুরু থেকে, এবং আমার মনে হয় যে গল্পগুলো শোনা হলো তা দুটি শ্রেণীতে রাখা যেতে পারে, একদিকে সেই গল্প যে গল্প জীবিত মানুষের জগৎ, আর অন্যদিকে মৃত্যুর জগৎ। এছাড়াও এমন একটা শক্তি আছে যা এই দুটি জগতের মধ্যে আসা-যাওয়া করে। ভূত-প্রেত এই শ্রেণীতেই পরে। দ্বিতীয় শ্রেণীর গল্পে পরাবাস্তব, পূর্বাভাস ও ভবিষ্যৎবাণী করার ক্ষমতা যুক্ত থাকে।
আপনাদের সব গল্পই এই দুই শ্রেণীর সঙ্গে যুক্ত। আসলে আপনাদের সমস্ত অনুভবই এই দুই শ্রেণীতে রাখা যেতে পারে। আমার বলার অর্থ এই যে যাঁরা ভূত দেখতে পান তাঁরা কেবল ভূতই দেখেন, তাঁর কখনও কোনও অলৌকিক পূর্বাভাস হয় না। আর অন্যদিকে যাঁদের এইরকম পূর্বাভাস হয় তিনি কখনও ভূত দেখতে পান না। আমি জানি না এইরকমই কেন হয়! হয়তো এটা এমন যে ভিন্ন ধরনের কথায় আপনি বেশি উৎসাহ পান এবং অনেক গভীরে যেতে পারেন বলে...এটাই আমার মনে হয়। কিছু মানুষ আছেন এই দুই শ্রেণীর মধ্যে পড়েন না, উদাহরণ হিসেবে আমাকেই দেখুন না ....আমি আমার তিরিশ বছর বয়সে কখনও ভূত দেখিনি! না আমার কোনও পূর্বাভাস হয়েছে না কোনও ভবিষ্যৎ বাণী করার কোনো স্বপ্ন এসেছে। একবার আমি আমার বন্ধুদের সঙ্গে লিফটে ছিলাম তাঁরা প্রতিজ্ঞা করে বললেন যে আমাদের সঙ্গে লিফটে প্রেতাত্মা ছিল, কিন্তু আশ্চর্য এই যে আমি তার কিছুই দেখিনি ! ওঁরা আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলল যে আমার পাশে অস্পষ্ট আকৃতির একজন মহিলা ছিল। কিন্তু বাস্তবে আমাদের সঙ্গে কোনও মহিলা ছিলোই না। অন্তত আমি তো কোনও আকৃতি দেখিনি। আমি ও আমার দুই বন্ধু ওই লিফটে ছিলাম, আমি মজা করছি তা নয়, আর আমার দুই বন্ধু এমন ছিল না যে তাঁরা আমাকে বোকা বানানোর জন্য মিথ্যা বলবে। তো এই পুরো বিষয়টা সামান্য বিষয় ছিল না এটা বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু আসল কথা হচ্ছে আমি কখনোই ভূত দেখিনি । কিন্তু একবার হয়েছিল , শুধু একবার... যখন আমার যথার্থই ভয় হয়েছিল...যেন আমার হৃদপিণ্ড স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। এই ঘটনা ঘটেছিল আজ থেকে দশবছরেরও বেশ আগে, কিন্তু এ বিষয়ে আমি কাউকে কিছুই বলিনি কেননা এটা বলতে গেলেও আমি ভয় পেতাম, আমার মনে হয়েছিল এটা বর্ণনা করার পর দ্বিতীয়বার এ ঘটনা ঘটবে, এই জন্য আমি এতদিন চুপ করে থেকেছি । কিন্তু আজ রাতে আপনারা সবাই নিজের নিজের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা শুনিয়েছেন, তাই অতিথি হিসেবে আমার কর্তব্য যে আমিও আমার এমনই এক ভয়ভয় অনুভব আপনাদের শোনাই...কিন্তু দয়া করে হাততালি দেবেন না কেউ, এবং এটা মনে রাখবেন বিষয়টা মোটেও সহজ ছিল না এখন যেমন আপনাদের এটা বলছি । ...তো শুরু করছি, সেই , আমার ভয়াবহ অভিজ্ঞতা। ১৯৬০ সাল... এ-সময়ের শেষের দিকে ছাত্র আন্দোলন ছিল তারুণ্যে ভরপুর। এটা সেই সময় যখন আমি আমার বিদ্যালয়ের শিক্ষা শেষ করে ফেলেছি। আর আমি হিপ্পি সম্প্রদায়ভুক্ত ছিলাম, তাই সে কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ার জন্য ভর্তি হই নি। ফলে আমি জাপানে ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন জায়গায় উপযুক্ত শ্রমিকের কাজ করতে থাকি। এটাতেই আমার মন বসে গিয়েছিল। আমার এটাই বিশ্বাস হয়েছিল যে বেঁচে থাকার জন্য সহজ উপায় হচ্ছে শ্রমিকের কাজ নেওয়া...তোমাকে পরিশ্রমই করতে হবে। আমার মনে হয় আপনারা আমাকে বোকা বলবেন। আমি বেশ মনে করতে পারি আমি একটা দারুণ আনন্দের জীবন কাটাচ্ছিলাম। এবং আমার নির্বাচন ভুল ছিল, না ঠিক, তা আমি জানি না । কিন্তু আবার যদি সুযোগ আসে আমি ওই জীবনকেই নির্বাচন করব। সমগ্র দেশ ঘুরে বেড়াবার সময় আমার দ্বিতীয় বছর বসন্তের সময় একটা বিদ্যালয়ের রাতে পাহারাদার হিসেবে কাজ পাই। এই বিদ্যালয়টি ছিল নীগিটা নামে একটি ছোটো শহরে। গ্রীষ্মের সময় শ্রমিকের কাজ করে আমি বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম আর এই জন্য আমি খুব সহজ একটা কাজ করতে চাইছিলাম। রাতেরবেলা পাহারাদার হিসেবে কাজ করার জন্য তেমন কিছু করতে হয় না। দিনের বেলা স্কুলের পরিচারক ঘরে শুয়ে পড়তাম আর রাতে কেবল দু'বার আমাকে সমস্ত স্কুল ঘুরে দেখতে হতো যে সব ঠিক আছে কিনা। বাকি সময় আমি গান শুনতাম, লাইব্রেরিতে গিয়ে পড়তাম, কিংবা জিমে গিয়ে একাই বাস্কেটবল খেলতাম। কোনো স্কুলে সারারাত একা থাকা তেমন খারাপ কিছু না তো... আমি কি ভয়ে ভয়ে থাকতাম ভাবছেন ? একেবারেই না... যখন আপনি আঠারো বা উনিশ বছরের একজন যুবক তখন আপনার কোনো বিষয়ে তেমন পরোয়া থাকে না। কেননা তারুণ্যের একটা স্পর্ধা যেকোনো দেশে সবসময়ই একইরকম। আমার মনে হয় না যে আপনারা কেউ রাতে পাহারাদারের কাজ করছেন কখনও ... আর এই জন্য আপনাদের রাতের পাহারাদারের কাজ কী, সেটা জানিয়ে দেওয়া উচিত। আপনাকে পাহারাদারের জন্য স্কুলে দু'বার রাতে ঘুরে দেখতে হয়, একবার ন'টার সময়...দ্বিতীয়বার তিনটের সময়, এটাই আপনার কাজ । যে স্কুলে আমাকে কাজ করতে হতো সেটা তিনতলা বিল্ডিং ছিল, কুড়িটির মতো ঘর ছিল, কিন্তু খুব বড় স্কুল তা নয় , যদিও আলাদা করে সঙ্গীত শিক্ষার জন্য একটা ঘর ছিল, এছাড়া ছিল কলা বিভাগের জন্য একটা স্টুডিও ও বিজ্ঞানের জন্য ল্যাবরেটরি। আর শিক্ষকদের বসার জন্য একটা বড় হলঘর এবং প্রধান শিক্ষকের একটা ঘর, একটা কফি সপ, একটা প্রেক্ষাগৃহ আর একটা ব্যায়ামের জন্য জিম। রাতে এই সমস্ত ঘুরে ঘুরে দেখা আমার কাজ ছিল, যখন আমি রাতে স্কুলে ঘুরে বেড়াচ্ছি সঙ্গে সঙ্গে একটি কাগজে ফাঁকা ঘরে আমাকে টিক মার্ক করতে হয়, শিক্ষকদের ঘর ঠিক আছে, ল্যাবরেটরি ঠিক আছে, আমার মনে হয় পরিচারকঘরে বিছানায় বসে বসেও এই টিক দেওয়া কাজটি করতে পারতাম। ফলে আমি এই দু'বার ঘুরে দেখার হ্যাপা থেকে মুক্তি পেতাম, কিন্তু আমি তেমন দায়িত্বহীন নই আর তা ছাড়া স্কুলটা ঘুরে দেখার জন্য বেশি সময় লাগে না। আর যদি কেউ স্কুলে চুরি করতে আসে? সেক্ষেত্রে আমাকেই তো এর জবাব দিতে হবে, তাই না ? যাই হোক রাতে একবার ন'টাই আর দ্বিতীয়বার তিনটেই পুরো স্কুলটা আমাকে ঘুরে দেখতে হতো। এই সময় আমার বাঁ হাত একটা টর্চ ,আর ডান হাতে বাঁশের তরোয়াল থাকতো। আমি আমার স্কুলের দিনগুলোতে তরোয়াল চালানো শিখেছি। এখন যদি কোনো আক্রমনকারীকে তাড়ানোর কথা ওঠে সেক্ষেত্রে আমি বলতে পারি আমার যথেষ্ট যোগ্যতা আছে সেটা করার। যদি কোনো পেয়াশাদার আক্রমণকারী হয় তা হলেও আমি ঘাবড়াতাম না এটা নিশ্চিত করে বলা যায় । আর এটা মনে রাখবেন, যে সে-সময় আমি যুবক ছিলাম। আজকে যদি এমন কোনো ঘটনা ঘটে তাহলে আমি সেখান থেকে পালিয়ে আসব এটাই বাস্তব। যাইহোক এই ঘটনা অক্টোবর মাসের এক ঝড়ের রাতের ঘটনা। বছরের এই সময়টা ছিল বেশ স্যাঁতস্যাঁতে। সন্ধের দিকে মাছির উৎপাত শুরু হয়ে যায়। আমার বেশ মনে আছে মাছি তাড়ানোর জন্য অনেকগুলো ম্যাট ব্যবহার করি যাতে ওরা বাইরে চলে যায়।
আর ঝড়ো হওয়ার দাপট এমন ছিল যেন কেউ সারারাত ধরে চিৎকার করছে। স্কুলে ঢোকার দরজাটা ভাঙা ছিল তাই খটখট শব্দ হচ্ছিল। আমি ভাবলাম দরজাটা ঠিক করে দিই কিন্তু বাইরে খুব অন্ধকার ছিল তাই সারারাত দরজাটা শব্দ করে যাচ্ছিল। সেইদিন রাত ন'টায় ঘুরে দেখার সময় সবই ঠিক ছিল। আমি কাগজের টিক মার্ক দিয়ে রেখেছিলাম। ঘরগুলোর দরজা তালা দেওয়া ছিল। আর সব জিনিস ঠিকঠাক ছিল কোথাও কোনো অস্বাভাবিকত্ব ছিল না। আমি আবার পরিচারকরের ঘরে এলাম যেখানে তিনটের সময় ওঠার জন্য এলার্ম দিয়ে রেখেছিলাম, আর বিছানায় শুয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার ঘুম চলে আসে। তিনটের সময় এলার্ম বাজার সঙ্গে সঙ্গে আমি জেগে গেলাম, কিন্তু আমার একটা কিছু অস্বাভাবিক অনুভব হচ্ছিল অথচ আমি আপনাদের ঠিক বোঝাতে পারছি না। কিন্তু কোথাও একটা অন্যরকম মনে হচ্ছিল আমার, কেননা ওঠার ইচ্ছা একেবারেই হচ্ছিল না। যেন কোনো একটা কিছু আমাকে বিছানা থেকে উঠতে দিচ্ছিল না । সাধারণত আমি লাফিয়ে বিছানা থেকে উঠে যাই ,সেইজন্য আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। শেষমেষ নিজেকে ধাক্কা দিয়ে ওঠাতে হলো যাতে আমি তিনটের সময় ঘুরে ঘুরে দেখবার জন্য বাইরে যেতে পারি। বাইরে দরজাটা হওয়ায় শব্দ করছিল তখনও, কিন্তু সেই শব্দ আগের থেকে আলাদা মনে হচ্ছিল। কোথাও একটা অস্বাভাবিক কিছু হচ্ছে এটা তখন আরও চেপে বসল আমার মধ্যে । বাইরে যাওয়ার ইচ্ছা না থাকা সত্তেও আমি ভাবলাম...আমি ঠিক করে নিলাম যাই হবে হোক আমাকে আমার কাজ করতে যেতেই হবে। যদি আপনি নিজের কর্তব্য থেকে একবার সরে আসেন তাহলে বারবার আপনি আপনার কর্তব্য থেকে সরে আসতে চাইবেন, এটাই হয় । আর আমি এই পরিস্থিতিতে পড়তে চাই না। আর তাই আমি আমার টর্চ আর বাঁশের তরোয়াল নিয়ে স্কুলে ঘুরে দেখবার জন্য বেরিয়ে পড়ি। এই রাতটা বেশ অস্বাভাবিক হয়ে উঠছিল আমার কাছে। রাত যত বাড়তে থাকে ঝড়ের দাপট বেড়ে যাচ্ছিল। আর হওয়ার সতেজতা কমে যাচ্ছিল। আমার শরীরের বিভিন্ন জায়গায় চুলকাচ্ছিল কোনো কিছুর দিকে মন দেওয়ার মতো পরিস্থিতি আমার তখন ছিল না। আমার পক্ষে অসম্ভব হয়ে উঠছিল ওই পরিস্থিতি। আমি প্রথমে জিম তারপর প্রেক্ষাগৃহ এবং দরজার দিকে যাওয়ার জন্য মনস্থির করি। ওখানে সবকিছুই ঠিক ছিল। দরজার একটা ভাঙা পাল্লা এমন এলোমেলোভাবে অস্তিত্বের জাহির করছিল আর বুকফাটা শব্দ করছিল যেন ও পাগল হয়ে গিয়েছে। এমনভাবে শব্দ হচ্ছিল চারপাশে যেন অস্বাভাবিক কিছু হচ্ছে তখন ফলে ভয় লাগছিল আমার। কিন্তু বিশ্বাস করুন স্কুলের ভেতর সবকিছুই স্বাভাবিক ছিল। আমি সূচীতে যেমন টিক দিতে হবে সেটা তেমনই করে রাখছিলাম। কিন্তু আমার মনে হচ্ছিল কিছু না কিছু হচ্ছে কোথাও। কিন্তু বাস্তবে এমন কিছুই ঘটে নি যে আমি অবাস্তব বলতে পারি। নিশ্চিন্ত হয়ে আমি পরিচারকের ঘরের দিকে ফিরে যাচ্ছিলাম। আমার দেখার মধ্যে ল্যাবরেটরিই দেখা বাকি ছিল। এই ল্যাবরেটরি স্কুলের পূর্বদিকে কফি সপের পাশেই ছিল।
পরিচারকের ঘরটি ঠিক তার উল্টোদিকে পড়ে, এর অর্থ ফিরে আসার সময় স্কুলের লম্বা গলিটি পেরিয়েযেতে হবে। যেখানে অসম্ভব অন্ধকার, যখন আকাশ পরিষ্কার থাকে চাঁদের আলোয় কিছুটা আলোকিত হতো। কিন্তু যখন তা হয় না তখন সেখানে কিছুই দেখা যায় না। সেই রাতে রাস্তা দেখার জন্য টর্চের সাহায্য নিতে হলো, আসলে আবহাওয়া দপ্তরের সতর্কতা ছিল ওই সময় একটা ঘূর্ণিঝড় আসবে। সেই কারণে চাঁদ দেখা যাচ্ছিল না। বাইরে আকাশে তখন মেঘের গর্জন হচ্ছিল। নীচে ভয়ভয় হাওয়ার শব্দ, আমি আর অপেক্ষা না করে দ্রুত ওই গলি পেরিয়ে যাচ্ছিলাম। আমার জুতোর রবারের ঘর্ষণের ফলে নিস্তব্ধতায় মধ্যে ঘাসের মধ্যে একটা অস্বাভাবিক শব্দ হচ্ছিল,ওই গলিপথটা সবুজ ঘাসে ভরে ছিল আজও মনে আছে। স্কুলের প্রবেশ পথের দরজা অর্ধেক গলিপথ পার করার পর আসে। আর যখন আমি তা পেরিয়ে যাচ্ছিলাম তখম আমার মনের ভেতর থেকে কেউ বলে উঠল : 'ওটা কি ছিল?' আমার মনে হলো অন্ধকারে আমি কিছু একটা দেখলাম.. আমি ভয় পেয়ে গেলাম, আমার মাথা ও কানের পাশ দিয়ে ঘাম গড়িয়ে পড়ছে মনে হলো, তরোয়ালের হাতলটা শক্ত করে ধরলাম আর সেদিকে ঘুরলাম যেদিকে আমি কিছু একটা দেখেছিলাম। আমি টর্চ ফেললাম জুতো রাখবার দেওয়ালে 'ওঃ এই কথা' আসলে ওখানে একটা আয়না রাখা ছিল, যেখানে আমার প্রতিবিম্বটা দেখা যাচ্ছিল। কিন্তু গতকাল রাতে তো ওখানে কোনো আয়না ছিল না! তারমানে দিনের বেলা কেউ এখানে আয়না রেখে গেছে ? 'হে ভগবান কী ভয় না পেয়েছিলাম' যেমন আমি বললাম ওটা একটা আয়না ছিল আয়নার মধ্যে আমার প্রতিবিম্ব ছিল এটা দেখে আমার মনে কিছুটা স্বস্তি এলো। কিন্তু একই সঙ্গে আমার ভয় পেয়ে যাওয়া বেশ বোকামি মনে হলো। 'তো এই ছিল ব্যাপার' 'আমি নিজেকেই বলি কি বোকামিই না ছিল। আমি টর্চ টা নামিয়ে পকেট থেকে সিগেরেট বার করে ধরাই.. আর আয়নার সামনে নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকাই, বাইরের একটা আলো আয়না পর্যন্ত আসছিল, আমার পিছনে ভাঙা দরজাটা একইরকম শব্দ করছিল। সিগারেটের কিছুটা টান দেওয়ার পর আমার নজরে এলো আয়নায় যে প্রতিবিম্ব দেখা যাচ্ছিল সেটা কিন্তু আমার নয়! বাইরে থেকে যদিও আমার মতো লাগছিল, কিন্তু সেটা কখনোই আমার নয় , না তা নয় ,আসলে ওটা আমিই, কিন্তু আমি নই ..অন্য কেউ, হ্যাঁ সেটা অন্য কেউ, যেটা হওয়া উচিত ছিল না। আমি বুঝতে পারছি না এই কথা আপনাকে কীভাবে বোঝাব। আমার ওইসময় কেমন যেন মনে হচ্ছিল, এটা বর্ণনা করা অসম্ভব ব্যাপার, যেটা আমি বুঝতে পেরেছি যে ওই প্রতিবিম্ব অন্য কেউ যে আমাকে ঘৃণা করত। ওর ভিতরে ঘৃণা অন্ধকার সমুদ্রে যেন ভেসে থাকা হিমখণ্ড, এতটাই ঘৃণা যা কখনোই কেউ মুছে দিতে পারেনি। আমি কেমন যেন অনেকক্ষণ দাঁড়িয়েই ছিলাম ওখানে। আমার আঙ্গুল থেকে সিগারেট মাটিতে পড়ে যায়, আয়নাতে থাকা সিগেরেটও একই সঙ্গে মাটিতে পড়ে যায়, আমরা একে অপরকে দেখতে থাকি, আমার মনে হলো কেউ আমার হাত পা বেঁধে দিয়েছে আর আমি নড়তেও পারছিলাম না। অবশেষে ওর হাত নড়ল, ওর ডান হাতের আঙ্গুল ওর ঠোঁট ছুঁলো, আর পোকার মতো ওই আঙ্গুল ওর শরীরের দিকে এগিয়ে যেতে লাগল...হঠাৎ আমি অনুভব করলাম , আমার আঙ্গুলও একইরকম করছিল। যে প্রতিবিম্ব ছিল আয়নাতে যেন ও আমার শরীরের দখল নিচ্ছিল, ভেতর থেকে সমস্ত শক্তি দিয়ে আমি চিৎকার করি, আর আমাকে আটকে রাখা শেকলগুলো যেন ছিঁড়ে গেল। আমি তরোয়াল তুলে ওই আয়নার মধ্যে আঘাত করি তখন আয়নার টুকরো হয়ে যাওয়া কাঁচের শব্দ শুনতে পেলাম । আমি আমার ঘরের দিকে প্রায় দিশেহারা হয়ে ছুটতে থাকি কিন্তু পিছন ফিরে দেখিনি। ঘরে পৌঁছে ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিই আর বিছানার মধ্যে ঢুকে পড়ি। মাটিতে জলন্ত সিগারেট পড়ে যাওয়ায় চিন্তা হচ্ছিল কিন্তু ওখানে তো আর আমি যাচ্ছি না। বাইরে ঝড়ো হওয়ার প্রচন্ড শব্দ হচ্ছিল। ভাঙা দরজাটা একইরকম শব্দ করেছিল, আমি নিশ্চিত যে আপনারা এই গল্পের শেষটা আন্দাজ করতে পেরেছেন। আসলে ওখানে কোনও আয়না ছিলই না সূর্যোদয় হওয়ার আগেই ঘূর্ণিঝরের দাপট চলে গিয়েছিল। ঝড় থেমে গিয়েছিল, আর বাইরে একটা দিন বেরিয়ে এসেছিল। আমি স্কুলের মেইন গেটের সামনে যাই, আঙ্গুল থেকে পড়ে যাওয়া সিগারেটের টুকরো তখনও ওখানেই পড়ে ছিল আমার ভাঙা তরোয়ালও ওখানেই পড়ে ছিল। কিন্তু ওখানে কোনো আয়না ছিল না, ভাঙা কাচের টুকরোও পড়ে ছিল না, পরে খোঁজ খবর করার পর জানা যায় যে ওখানে কেউ কোনো আয়না রাখেনি । আমি ওখানে যা দেখি সেটা ভূত ছিল না, ওটা আমিই ছিলাম। আমি এটা কখনোই ভুলব না যে ওই রাতে আমি কতটা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। যখনই এটা আমার মনে আসে তখন আমার মনে হয় বিশ্বে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর হচ্ছে আমাদের নিজেরই রূপ। এ-বিষয়ে আপনার কি মনে হয় ? আপনি দেখে থাকবেন আমার এই ঘরে একটিও আয়না নেই। আয়না ছাড়া এতদিন কাটিয়ে দিয়েছি বিশ্বাস করুন এটা একটা সত্যি ঘটনা।
কিন্তু এটা তো বিশ্বাস করবেন যে একটা আয়না না থাকায় দাড়ি কামানো খুব সহজ কাজ নয় ।
--------------
মূল গল্প: The Mirror by Haruki Murakami
অনুবাদক(বাংলা) পরিচিতি:
শুভ চক্রবর্তী
অনুবাদক।
কলকাতায় থাকেন
0 মন্তব্যসমূহ