ভাষান্তর: নাহার তৃণা
মাতসুদো ইয়োজো সিমেন্ট লেপার কাজ করছিল। তার জামাকাপড় নাকমুখচোখ চুল সবকিছু সিমেন্টের আবরণে ধূসর হয়ে গেছে। তার নাকের ছিদ্র পর্যন্ত সিমেন্টে বন্ধ হয়ে হওয়ার যোগাড়, করিৎকর্মা শ্রমিক হিসেবে একমনে এত দ্রুত কাজ করছে, যে নিজের চুল আর নাকের ছিদ্র থেকে সিমেন্ট মোছার সময় পাচ্ছে না। মিনিটে দশবার থুথু দিয়ে মুখটা কোনোমতে পরিষ্কার করছে। নাকে হাত দেবার কোনো ফুরসতই পাচ্ছে না।
এগারো ঘন্টা ধরে এই অবস্থা চলছে। এরই মধ্যে নাকে জমে থাকা সিমেন্ট শক্ত হয়ে গেছে। গোটা দিনে সে মাত্র দুবার বিরতি নেয়, একবার লাঞ্চের সময় আরেকবার বিকেল তিনটায়, কিন্তু সে খাবারের জন্য সময় নষ্ট না করে মিশ্রণ যন্ত্রটা পরিষ্কারের কাজেই বেশি ব্যস্ত ছিল। এই এতক্ষণ পর মাতসুদো একটু সময় পেলো নাকে হাত দেবার, কিন্তু সে টের পেলো নাকের ছিদ্রের সিমেন্টগুলো শক্ত পাথরের মতো হয়ে গেছে।
যখন সে আবারো কাজ শুরু করতে যাচ্ছিল, তখন সিমেন্টের ব্যাগ থেকে কিছু একটা বেরিয়ে পড়লো। মাতসুদো পরিশ্রান্ত হাতে তুলে দেখে ছোট্ট একটা কাঠের বক্স।
“যাশশালা! এইটা আবার কী?” মাতসুদো সন্ধিগ্ধ চোখে দেখলো জিনিসটা। কিন্তু অত ভাবার সময় নাই। হাতে অনেক কাজ। সে তার বেলচা দিয়ে সিমেন্ট মশলাগুলো মাপন পাত্রের মধ্যে ভর্তি করে সেগুলো মিশ্রণযন্ত্রের ভেতর উপুড় করে দিতে লাগলো।
কাজের ফাঁকে ফাঁকে পাশে পড়ে থাকা ছোট্ট জিনিসটার দিকে তাকিয়ে ভাবলো, এরকম পড়ে পাওয়া জিনিস কুড়িয়ে নিতে কোনো দোষ নেই। হালকা পলকা ছোটো বাক্সটা তুলে নিয়ে তার লাঞ্চের খালি বাটির মধ্যে রাখলো।
‘দেখে তো মনে হয় না ভেতরে টাকাকড়ি বা দামী কিছু আছে!’ সিমেন্টের মশলা ভরতে ভরতে ভাবতে লাগলো সে। কিছু না থাকলে পাত্তা দিয়ে কাজ নেই ভেবে দিনের কাজ শেষ করার দিকে মন দিলো।
কাজ সেরে মাতসুদো মিশ্রণযন্ত্রের সাথে যুক্ত থাকা রাবারের নল থেকে পানি দিয়ে হাতমুখ ধুয়ে ফেললো। খিদে তৃষ্ণায় প্রাণ ওষ্ঠাগত। আগে কিছু খেয়ে নিতে হবে তারপর অন্য কথা। বিদ্যুত কেন্দ্রের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো আটটা বেজে গেছে। দক্ষিণপূর্ব দিকে ইনা পর্বতমালার তুষারাবৃত চুড়াটা অন্ধকারেও কেমন জ্বলজ্বল করছে। প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় মাতসুদোর শরীরের ঘামও জমে বরফ হয়ে গেছে। বাড়ির পথে চলতে চলতে পর্বত থেকে নেমে কিসো নদীর খরস্রোতা গর্জনের কাঁপুনি টের পেলো পায়ের তালুতে।
ধুত্তোরি মরার জীবন!! এইটার উন্নতি হওয়ার আর কোনো উপায় নাই। বউটা একের পর এক বাচ্চা বিইয়ে যাচ্ছে। তার উপর এই শীতে আরো একটা আসতেছে। সে তার ঘরে কিলবিল করতে থাকা একপাল বাচ্চার কথা ভেবে আরো বিরক্ত হয়ে উঠলো।
মনে মনে হিসাব কষলো: আমার মাসিক আয় মাত্র ১ ইয়েন। তার মধ্যে ৫০ সেন খরচ হয় দুবেলা ভাতের জন্য, ৯০ সেন লাগে জামাকাপড়ের জন্য, তার উপর বাড়িভাড়া, হেনতেন কত কিছু, শালার সংসার! জাহান্নামে যাক সব! আমার এখন একবোতল মদ খাওয়া দরকার। হঠাৎ করে তার মনে পড়ে গেল টিফিন পাত্রে রাখা বাক্সটার কথা। সিমেন্টের ধুলায় ঢাকা। সে ওটা হাতে নিয়ে প্যান্টের পেছনভাগে ঘষে ঘষে মুছে পরিষ্কার করে দেখলো বাক্সটার কোথাও কিছু লেখা নেই। পেরেক মেরে শক্ত করে এঁটে দেওয়া হয়েছে চারপাশটা।
‘শয়তানের চেলা কোথাকার! এই জিনিস এরকম পেরেক মেরে আটকে দেবার দরকার কী?’ খুলতে না পেরে মাতসুদো ক্ষেপে গিয়ে তুলে আছাড় দিল বাক্সটাকে। নাহ তাতেও কিছু হলো না। এবার পায়ের নীচে শক্ত মেঝেতে ফেলে ইচ্ছেমত নেচে কুঁদে ওটার দফারফা করার চেষ্টা করলো। অবশেষে জিনিসটা ভেঙ্গে গেল এবং সেখান থেকে ছেঁড়া একটা কাপড়ের টুকরো বেরিয়ে পড়লো। কাপড়ের টুকরোয় মোড়ানো একটা ন্যাতানো কাগজ। সেখানে কিছু কথা লেখা-
আমি এক হতভাগ্য নারী, এন. সিমেন্ট কোম্পানিতে সিমেন্ট ব্যাগ সেলাই করি। আমার প্রেমিক এখানে পাথরচূর্ণ করার শ্রমিক ছিল। অক্টোবরের ৭ তারিখ সকালে, ক্রাশ মেশিনে নুড়ি ভর্তি ব্যাগ খালি করার সময় আচমকা ভারসাম্য হারিয়ে সে মেশিনের ভেতর পড়ে যায়। সহকর্মীরা ছুটে এসে তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিল, কিন্তু তার আগেই মেশিনের চলন্ত বেল্টের টানে নুড়ির তলায় সে চাপা পড়ে। তার শরীরটা পাথরচূর্ণের সাথে মিশে গিয়ে নুড়িগুলোকে রক্তলাল করে তুলেছিল। তারপর নুড়িচূর্ণের সাথে মিশে কনভেয়ার বেল্টের মধ্য দিয়ে ফ্যাক্টরির সিমেন্ট তৈরির মেশিনের ভেতরে চলে যায়। ফ্যাক্টরির ভেতর বেল্টে করেই পাথরের টুকরোগুলো প্রচণ্ড শব্দে ঘুরতে থাকা ধাতব ইস্পাতের দানবীয় ঘুরন্ত কাঁটাওয়ালা চক্রে ঢুকে পড়ে, সেখানে নুড়িগুলোকে একেবারে মিহি করে ফেলা হয়। তারপর তীব্র তাপ প্রয়োগে সেই মিহিগুড়ো সিমেন্টে পরিণত হয়।
আমার প্রেমিকের হাড়, মাংস, আত্মা সব কিছুই মিহি ধুলোর সিমেন্টে পরিণত হয়েছিল। কেবল তার ছিন্নভিন্ন পোশাকের কয়েকটা টুকরো স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে থেকে যায়। আমি এই ছোট্ট বক্সটার ভেতর তার জামার টুকরোর মধ্যে চিঠিটা ভরে সেটা সিমেন্টের ব্যাগের মধ্যে সেলাই করে দিলাম।
আপনি কি একজন শ্রমিক? যদি তাই হয়ে থাকেন তবে দয়া করে এই চিঠির উত্তর দেবেন। অনুগ্রহ করে আমাকে জানাবেন এই ব্যাগের সিমেন্ট কোন কাজে ব্যবহৃত হবে? আমার প্রেমিক এই সিমেন্টের ব্যাগের ভেতর রয়েছে। কার প্রয়োজনে সে ব্যবহৃত হবে? আপনি কি একজন মূর্তি কারিগর? একজন স্থপতি?
আমার প্রেমিকের শরীর যদি কোনো থিয়েটার হলের প্রশস্ত বারান্দা কিংবা বিশাল কোনো বসতির বেষ্টনী দেওয়াল তৈরির কাজে ব্যবহৃত হয়, আমি সেটা কিছুতেই মেনে নিতে পারবো না। আপনি যদি শ্রমিক হয়ে থাকেন তাহলে দয়া করে ওরকম কোনো কাজে এই সিমেন্ট ব্যবহার করবেন না। কিন্তু আমার সেটা ঠেকানোর কী কোনো উপায় আছে?
না, আমার মনে হয় না আমি কিছু করতে পারবো। আসলে আমার প্রেমিক কীভাবে সমাধিস্থ হবে সেটা আমার বিবেচ্য বিষয় নয়। আপনারা যেভাবে চান তাকে ব্যবহার করবেন। যেহেতু আমার প্রেমিক একজন সৎ নিষ্ঠাবান মানুষ ছিল, মেহনতি মানুষের একজন ছিল, আশা করি ভালো কাজেই তাকে লাগানো হবে।
তবু কেন আমি আপনাকে এই বাক্সটা পাঠালাম? আমার প্রাণপ্রিয় মানুষের দেহাবশেষ উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম, কাছে দূরে যেখানেই সমাধিস্থ হোক, সেই ঠিকানাটা আমি জানতে চাই। সে ছিল ছাব্বিশে পা দেয়া তরতাজা এক তরুণ। একজন দয়ালু , সৎ এবং সুনাগরিক। আমি তাকে ভীষণ ভালোবাসতাম। সে আমাকে কতখানি বাসতো সেটা আমার জানা নেই। তার শেষকৃত্যের জন্য আমি এই কাপড়ের টুকরোটা সেলাই করে বাক্সবন্দী করেছি ! এটাই তার কফিন। তার প্রতি এটাই আমার শেষ প্রণতি।
যদি আপনি শ্রমিক হয়ে থাকেন, দয়া করে এই চিঠির উত্তর দেবেন। আমি আপনাকে তার ছিন্ন পোশাকের একটি টুকরো জড়িয়ে চিঠিটা দিলাম। সেই পোশাক যেখানে এক তরুণ, মেহনতি শ্রমিকের রক্ত আর ঘাম মিশে আছে। সেই পোশাক, যেটা পরে সে আমাকে প্রবল আবেগের সাথে জড়িয়ে ধরতো। আমি তার ছিন্ন পোশাকের বাকি অংশগুলো স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে আঁকড়ে ধরে আছি।
আপনাকে এভাবে বিরক্ত করার জন্য আমি দুঃখিত। কিন্তু দয়া করে এই চিঠির জবাব দেবেন। দয়া করে বলবেন এই সিমেন্ট কবে, কখন, কোথায় ব্যবহার করা হয়েছে। আমাকে তার ঠিকানা এবং আপনার নামধাম ইত্যাদি বিষয় জানাবেন। কাজের সময় আপনি নিজেও সতর্ক থাকুন। বিদায়।
চিঠি পড়া শেষ মাতসুদোর, ঘরের ভেতর বাচ্চাগুলো তারস্বরে চেঁচাচ্ছে; তাদের চেঁচামেচির শব্দে মেজাজ বিগড়ালেও নীরবে সেটা হজম করে নিলো। চিঠির নীচে লেখা নাম আর ঠিকানার দিকে চোখ বুলাতে বুলাতে সে নীচু হয়ে বাটিতে ঢালা পানীয়তে চুমুক দিলো।
তারপর হঠাৎই চেঁচিয়ে বলতে লাগলো ‘আমিও শেষ হয়ে যাবো, সবকিছু ভেঙ্গেচুরে ধ্বংস হয়ে যাক। তারপর কী হয় দেখি!’
‘তুমি যদি এরকম আচরণ করো, তাহলে সত্যিই সংসারটা একদিন ধ্বংস হয়ে যাবে। আমি সেটা কতদিন সহ্য করবো? এতগুলো বাচ্চা নিয়ে যাবোই বা কোথায়?’
মাতসুদো খানিক থমকালো, স্ত্রীর ফুলে থাকা পেটের দিকে তাকিয়ে ভাবলো, সাত নম্বরটা আসছে।
তারপর হঠাৎই চেঁচিয়ে বলতে লাগলো ‘আমিও শেষ হয়ে যাবো, সবকিছু ভেঙ্গেচুরে ধ্বংস হয়ে যাক। তারপর কী হয় দেখি!’
‘তুমি যদি এরকম আচরণ করো, তাহলে সত্যিই সংসারটা একদিন ধ্বংস হয়ে যাবে। আমি সেটা কতদিন সহ্য করবো? এতগুলো বাচ্চা নিয়ে যাবোই বা কোথায়?’
মাতসুদো খানিক থমকালো, স্ত্রীর ফুলে থাকা পেটের দিকে তাকিয়ে ভাবলো, সাত নম্বরটা আসছে।
-------------------------
(জানুয়ারি-১৯২৬)
মূল গল্প: Letter in a Cement Barrel by Yoshiki Hayama; Translated by M Skeels
পাদটীকা: গল্পে ব্যবহৃত সিমেন্ট ব্যারেল বদলে সিমেন্ট ব্যাগ করেছি। আশা করি তাতে মূলগল্প কাঠামোর কোনো ক্ষতিসাধন হয় নি।
লেখক পরিচিতি: জাপানী সাহিত্যিক ইয়োশিকি হায়ামা (Yoshiki Hayama ১৮৯৫-১৯৪৫) মূলত মেহনতি মানুষের জন্য লেখালেখি করে জনপ্রিয়তা ও পরিচিতি অর্জন করেছিলেন। তিনি কিছুকাল সাংবাদিকতা এবং ব্লুকলার চাকরী করলেও দীর্ঘ সময় শ্রমিকের কাজ করেছেন এবং শ্রমিক আন্দোলনের সাথে সরাসরি জড়িত ছিলেন। শ্রমিক আন্দোলনে তিনি এতটাই সরব ছিলেন যে তাঁকে জেলেও যেতে হয়েছিল। জেলে বসেই তিনি তাঁর বিখ্যাত ছোটগল্প ‘দ্য প্রস্টিটিউট(The Prostitute)' লিখেছিলেন। বামপন্থী সাহিত্য পত্রিকা ‘বুনগেই সেনশেনে’ গল্পটি প্রকাশিত হবার পর তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। জাপানী সাহিত্যে এই গল্পটিকে শ্রমজীবি শ্রেণীর জন্য নিবেদিত সাহিত্যের প্রথম উদাহরণ হিসেবে ধরা হয়। এছাড়া তিনি জাপানী কার্গো জাহাজে কর্মজীবি শ্রমিকদের দুর্বিষহ জীবনকে উপজীব্য করে লিখেছিলেন ‘মেন হু লিভ অন দ্য সি((Men Who Live on the Sea)'’ নামের একটি সুবিখ্যাত উপন্যাস। তবে মজার ব্যাপার হলো ইয়োশিকি প্রথম জীবনে মার্কসবাদী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেও পরবর্তীতে জাপানী সাম্রাজ্যবাদের একনিষ্ঠ কর্মী হয়ে পড়েছিলেন। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত সেই অবস্থানেই ছিলেন।
নাহার তৃণা
গল্পকার। অনুবাদক। প্রাবন্ধিক
শিকাগোতে থাকেন।
0 মন্তব্যসমূহ