অনুবাদ: দিলশাদ চৌধুরী
আমি কিউশু বন্দরের একটি মার্কিন মিলিটারি ঘাটিযুক্ত শহর থেকে সদ্যই টোকিও এসেছিলাম আর থাকছিলাম ইনোকাশিরা পার্কের উত্তরে একটা কাঠের তৈরি ভবনের ছোট্ট নড়বড়ে একটা এপার্টমেন্টে কিছু বন্ধুদের সাথে। আমার এই বন্ধুরা নিজেদের শহরে বসে একটা ব্লুজ ব্যান্ড প্রতিষ্ঠা করে বড় শহরে এসেছে সাফল্যের আশায়। আমি সেখানে ড্রাম বাজাতাম কিন্তু সত্যি বলতে কিউশুর মত ছোট জায়গার একটা ব্লুজ ব্যান্ডের সাথে এগিয়ে যাবার ব্যাপারে আমার তত আবেগ ছিলোনা। আমার প্রধান উদ্দেশ্য ছিলো বাবা মায়ের থেকে দূরে যাওয়া, আর তারা এইশর্তে আমাকে একটা নির্দিষ্ট বরাদ্দসহ টোকিও পাঠাতে রাজি হলো যে আমি ওখানকার একটা প্রিপারেটরি স্কুলে ভর্তি হব। অন্য ছেলেগুলো কেউ বাস সহযোগী হিসেবে বা রেস্তোরাঁয় পরিবেশক হিসেবে কাজ করতে করতে তাদের 'বিরাট সুযোগ' এর জন্য অপেক্ষা করছিলো। আমি বাইরে কোনো কাজ করতাম না আর ওদের সাথে একত্রেই থাকতাম মূলত এইজন্য যে নিজে খুঁজে একটা ঘর জোগাড় করার চেয়ে ওদের সাথে থাকা বেশি সহজ।
ওদের পরিকল্পনা ছিলো রাতে কাজ করা, দিনে রিহার্সাল করা, বড় বড় কনসার্টে যাওয়া যাতে সঠিক লোকেদের সাথে আলাপ করা যায়, আর যখনই সম্ভব হয় রেকর্ড কোম্পানি আর প্রোডাকশন এজেন্সিগুলোতে অডিশন দেয়া। আমাদের বসবাসের শহর থেকে টোকিও আসার গভীর রাতের ট্রেনে বসে তারা প্রতিজ্ঞা করেছিলো যে ছয় মাসের মধ্যে তারা জাপানি ভাষার ব্লু'জ ব্যান্ড হিসেবে হিবিয়া পার্ক কনসার্ট সিরিজের মঞ্চে উঠবে। আমিসহ দলে বিভিন্ন পরিবেশ থেকে উঠে আসা পাঁচজন সদস্য ছিলো। দলের নেতা নাকানো বেস বাজায়, ওর বাবা একজন চাকুরিজীবী যে কিনা সদ্য অবসরে গেছে; ইয়ামাগুচি গিটার বাজায়, ও এক আমদানি- রপ্তানিকারক আর পিয়ানো শিক্ষকের ছেলে; শিমাডা অর্গান বাজায়, এক পেট্রোলপাম্প মালিকের একমাত্র ছেলে আর কাটো হলো কণ্ঠশিল্পী, বড় হয়েছে সিঙ্গেল মায়ের সাহচর্যে। আর্থিক অবস্থাও সবার আলাদা ছিলো স্বাভাবিকভাবেই --- ওদের মধ্যে নাকানো আর কাটো আগেও কমবেশি বাড়ি থেকে পালিয়েছে খুব বেশি জিনিসপত্র না নিয়েই, হয়ত একটা ফুটোন তোষক অথবা একটা বাটি আর চামচ, যেখানে শিমাডার বাবা মা ওর জন্য খাবার আর কাপড়ের একটা বাক্স পাঠিয়েছে আর প্রায় প্রতি সপ্তাহেই টাকায় ভরা রেজিস্টার্ড খাম পাঠিয়েই চলেছে। আর ইয়ামাগুচি তো একটা স্টেট অফ দা আর্ট স্টেরিও সিস্টেম আর সাথে একটা খোলা রিলের টেপডেকেরও মালিক।
কিন্তু ওরা চারজনই বাস সহযোগী আর খাবার পরিবেশক হিসেবে চাকরি নিয়েছিলো; কাটো আর শিমাডা রোপোঙ্গির ডিস্কোতে, ইয়ামাগুচি শিনজুকুর একটা লাইভ মিউজিক ক্লাবে আর নাকানো গিঞ্জার এক ক্যাবারেতে। ওদের রাতে কাজ করে দিনে রিহার্সাল করার পরিকল্পনা অবাস্তব প্রমাণিত হলো। ওরা যেখানে কাজ করতো সেই জায়গাগুলো সব সন্ধ্যা ছ'টা থেকে রাত এগারোটা অব্দি খোলা থাকতো, কিন্তু বাস সহযোগী আর পরিবেশকদের দুই তিন ঘন্টা আগেই সেখানে পৌঁছাতে হতো আর থাকতে হতো বন্ধ হবার পরেও অনেকটা সময় ; ধোয়ামোছা, বাসন পরিস্কার আর অন্যান্য খুঁটিনাটি কাজের জন্য। নাকানো, যে কিনা গিঞ্জায় কাজ করত, বাসা থেকে বের হতো দুপুর দুটোয় আর শেষ ট্রেন ধরে টলতে টলতে ফিরতো রাত দুটোয়। কাছেপিঠেও ক্যাবারে ছিলো --- এমনকি এই কিচিজোজিতেও -- কিন্তু নাকানোর বদ্ধমূল ধারণা ছিলো যে একমাত্র গিঞ্জাতেই ব্লু'জ সংগীতের ক্ষেত্রের সাথে সংযোগ স্থাপন সম্ভব। ঈশ্বর জানেন ওর মাথায় এমন ভাবনা কোথা থেকে এসেছিলো যেটা কিনা এখন পুরো তামাশার মতো শোনাচ্ছে।
দলের একমাত্র মাইক এবং এমপ্লিফায়ারটা ছিলো শিমাডার, আর আমি বাদে সবাই কিউশু থেকে নিজেদের বাদ্যযন্ত্র কিনে নিয়েছিলো। ড্রাম অনেক জায়গা দখল করে, আর আমার ড্রামটা ছিলো পুরনো ব্যবহৃত, আর ধীরে ধীরে নষ্টও হয়ে যাচ্ছিলো, তাই আমি আশ্বাস দিলাম যে আমি একটা খণ্ডকালীন চাকরি খুঁজব আর যে টাকাটা পাব তা দিয়ে নতুন এক সেট ড্রাম কিনব, যদিও আমি এখন আর কোনো ব্লু'জ ব্যান্ডের হয়ে বাজাতে চাইনা। আমি ড্রাম বাজানোর লাঠি কিনলাম আর অনুশীলনের সময়ে তাতামি ম্যাটের ওপর আঘাত করে করে ওদের সাথে যোগ দিলাম, কিন্তু পুরো ব্যাপারটাই উত্তরোত্তর অকেজো মনে হতে লাগলো। পরিবেশক আর বাস সহযোগীরা দু'সপ্তাহে একদিন ছুটি পেত, আর সবার ক্ষেত্রেই এটা পড়ত আলাদা আলাদা দিনে। আমার বন্ধুরা ফিরত মধ্যরাতের পরে আর ফিরেই আমার বানিয়ে রাখা ইন্সট্যান্ট রামেন খেয়ে নিত, তারপর, সারাদিনের অনভ্যস্ত পরিশ্রমের ক্লান্তিতে অবসন্ন হয়ে অল্পকিছু শব্দের বেশি আর কিছুই না বলে প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে গিয়ে ওদের ফুটোন তোষকে শুয়ে পড়তো। একবার মাত্র সময় যখন আমরা অনুশীলনের জন্য সবাই একত্রিত হতে পেরেছিলাম, সেই সময়টা ছিলো সকালের শেষভাগ থেকে বিকেলের শুরু অব্দি, কিন্তু তখনও আমরা আমাদের একমাত্র এমপ্লিফায়ারটিকে গিটার, অর্গান আর কণ্ঠ সবদিকে ব্যবহার করার জন্য বাগে আনতে পারলাম না। একবারই যখন আমরা স্পেনসার ডেভিস গ্রুপের 'গিম্মি সাম লাভিন' গেয়ে মোটামুটি একটা বড় ধরনের সুরের হল্লা করতে সক্ষম হলাম, আমাদের ওপরতলায় থাকা ছেলেটি আমাদের এপার্টমেন্টে এসে পুরো ফেটে পড়লো আর আমাদের ওপর চিৎকার চেঁচামেচি করে গেলো। ছেলেটা ছিলো এক তরুণ ইয়াকুজা মাফিয়া, যার চেহারায় ছিলো এক অদ্ভুত ব্লেডের মতো তীক্ষ্ণ ধার। নাকানো আর শিমাডা দুজনেই ছিলো দুর্দান্ত বকাবাজ ছেলে, এমনকি আমাদের ফেলে আসা শহরের অন্যান্য উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যেও কুখ্যাত। কিন্তু টোকিওর মত শহরে একজন আসল ইয়াকুজা মাফিয়া ওদের মুখের ওপর গালাগাল দিলেও এক্ষেত্রে ওদের কিছুই বলার জো নেই।
একমাস পেরিয়ে যাবার পরও যখন ব্লু'জ ব্যান্ডের ব্যাপারে কোনো উন্নতি দেখা গেলোনা, এক হতচ্ছাড়া নিরাশার মেঘ দানা বাঁধতে শুরু করলো। শীঘ্রই সেটা আমার দিকে কেন্দ্রীভূত হলোঃ ইয়াজাকি, কোন জন্মে গিয়ে তুমি চাকরি নেবে আর ড্রাম কিনবে, হ্যা? আমি ওদের বললাম যে আমি সিদ্ধান্ত নেয়ার চেষ্টা করছি যে আমি কি ব্যান্ডের সাথে যাব নাকি কলেজে। ব্যান্ডের জন্যই মূলত সবাই নিজেদের টাকা দিয়ে বাসা ভাড়া করে আছে, তাই আমি জানতাম ব্যান্ড ছাড়লে বাসাও ছাড়তে হবে। শিমাডার এক আত্মীয় এই জায়গাটা খুঁজে দিয়েছিলো, কিন্তু এটা সস্তা ছিলোনা, যদিও এটাতে শুধু দুটো ছোট রুম আর তার চেয়েও ছোট রান্নাঘর ছিলো, আর সাথে একটা ফ্লাশ কাজ না করা টয়লেট যেখানে গোসল করার ব্যবস্থা ছিলোনা, আর এটা ছিলো কিচিজোজি স্টেশন থেকে প্রায় বিশ মিনিটের হাঁটা দূরত্বে, তাও এটা একা থাকার খরচের তুলনায় সস্তা ছিলো। আমার কোনো উপায় ছিলোনা বাবা মাকে আবার খরচের কথা বলার, আর আঠারো বছরের বাক্সবন্দি জীবন থেকে সদ্য বেড়িয়ে আমি জানতামও না যে কীভাবে নিজের চেষ্টায় একটা থাকার ঘর জোগাড় করা যায়।
আমি স্কুলেও যাচ্ছিলাম না আর চাকরিও খুঁজছিলাম না। বেশিরভাগ দিনই আমি কান্ডার পুরনো ব্যবহৃত বইয়ের দোকানগুলোতে ঘুরে বেড়াতাম। পুরনো উপন্যাস বা কবিতা সংগ্রহ খুলে দেখতাম, তারপর ঘন্টার পর ঘন্টা জাজ কিংবা রক এন্ড রোল কফিশপগুলোতে সময় কাটাতাম।
এর মধ্যে দু'মাস কেটে গেছে, একটা ঝড়ের আভাস পাওয়া যাচ্ছিলো এবং একরাতে নাকানো আর আমার প্রায় একটা হাতাহাতি লেগেই যাচ্ছিলো যখন ও বললো যে ও একটা খাবার পরিবেশকের চাকরির খোঁজ পেয়েছে আর আমি আবেদন করতে রাজি হলাম না। ইয়ামাগুচি আমাদের মধ্যে ঢুকে বললো, "নাকানো ঠিক বলেছে, ইয়াজাকি ওর কথা রাখেনি, কিন্তু মারামারি করার কোনো মানে নেই, আমরা মারামারি করতে টোকিও আসিনি।" আসল ঝড় প্রতিহত হলো, কিন্তু ওই ঘরে ওই সময় থেকে আমার জন্য আর জায়গা ছিলোনা। সবাই চোখ দিয়ে আমায় দরজা দেখিয়ে দিলো।
রাত প্রায় দু'টো তখন। দ্যা রক ক্যাফে, যেখানে আমি প্রায়ই যেতাম, বন্ধ হয়ে গেছিলো। আর যেহেতু আমার মাসোহারা তখনো এসে পৌঁছায়নি, আমি পুরো কপর্দকশূন্য ছিলাম। জুন মাস চলছিলো, বাতাস গরম আর আর্দ্র, আর ইনোকাশিরা পার্ক একটা ধূসর রকমের কুয়াশায় আবছা হয়ে ছিলো। মানসিকভাবে আমার নিজেকে জঞ্জাল মনে হচ্ছিলো। আর এই ভেজা ভেজা ভারী বাতাস আমার ত্বকে নোংরাভাবে আটকে যাচ্ছিলো। কোথাও যাবার জায়গা না থাকায় আমি একটা শূন্য ফুটপাথের গাছের মধ্য দিয়ে পুকুরের দিকে চললাম। যুগলেরা গাছের অন্তরালের নির্জন বেঞ্চগুলোতে বসে চুমু খাচ্ছিলো, আর যখন আমি একটা হোঁচট খেলাম, নিচে শুনতে পেলাম জলপক্ষীর ডানা ঝাপটানো আর কণ্ঠভেদী চিৎকার। ওদের খোনা তীক্ষ্ণ চিৎকার আমাকে মনে করিয়ে দেয় ভ্যান মরিসনের ব্লু'জ গানের হাহাকার, আর আমি ভাবতে থাকি যে কোন দুঃখে আমি বা অন্যরা প্রথম ধাক্কাতেই এই ধরনের গান নিয়ে এগিয়ে যেতে চেয়েছি।
কিউশুর পশ্চিম তীরের এক বন্দর নগরীতে বসে আমেরিকান জিআই আর সৈনিকে পূর্ণ একটা বারে, যেখানে অনেকেই ছিলো কালো, বসে গাইতে গাইতে এটা ভাবা সহজ ছিলো যে ব্লু'জ গান কোনোভাবে সব গানের স্বর্ণচূড়ায় অধিষ্ঠান করে। জন লেনন আর মিক জ্যাগার আর বব ডিলান সবাই ব্লু'জ থেকেই উৎসরিত, ব্লু'জের সম্পর্ক সারা পৃথিবীর মানুষের সাথে, রক গানের সত্যিকারের শেকড় আর আত্মা ছিলো ব্লু'জের মধ্যে, আর যখন আমরা টোকিও এলাম, আমাদের বিশ্বাস ছিলো, এ সবকিছু আরও পরিস্কার হয়ে উঠবে। কিন্তু সত্যি বলতে এই শহরে আসার পর আমরা একবারও সরাসরি ব্লু'জ গান শুনিনি। রক ক্যাফেগুলোতে ওরা কদাচিৎ একটা ব্লু'জ গানের রেকর্ড বাজায় আর রাস্তায় বা পশ্চিম প্রবেশদ্বারের সামনের প্লাজা থেকে শিনজুকু স্টেশনে যে লোকেরা গান গায়, তারা গায় গা গোলানো অতিরিক্ত মিষ্টি সুরের যুদ্ধবিরোধী পল্লীগান। টোকিওতে কোথাও ব্লু'জের অস্তিত্বই পাওয়া যাচ্ছিলোনা। শিমাডা আর ইয়ামাগুচির দুর্দান্ত সংগ্রহ থেকে আমাদের ফালতু ঘরটায় আওয়াজ কম করে রেকর্ড শোনা একদমই তেমন ছিলোনা যেমনটা ছিলো আমাদের পুরনো নৌবাহিনীর ঘাটিযুক্ত বন্দর নগরীতে। আমার এমনটাই মনে হচ্ছিলো আর আশঙ্কা করি বাকি চারজনও কমবেশি এমনই বোধ করছে। ডিস্কোতে, লাইভ মিউজিক ক্লাবে আর ক্যাবারেতে শোনা যায় কেবল ফিলিপিনো কভার ব্যান্ড বা পপ কণ্ঠসংগীতের দল বা রসালো এনকা গায়কদের। কাটো এক পর্যায়ে বাড়ি ফিরে যাবার কথা বললো। কিন্তু নাকানোর যুক্তি --- যে তুমি মাত্র দুমাসে কিছুই বলতে পারোনা --- জিতে গেলো। আপাতপক্ষে দেখতে গেলে কিছুই অর্জন না করে আগেই বাড়ি ফিরে গেলে ব্যাপারটা লজ্জার হবে।
পুকুরটার কাছে গেলাম, আর ওটার চারপাশের পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে বুঝলাম যে দিন যত যাবে তত অবস্থা খারাপ হতে থাকবে। আমার হয় অন্য বাসা খুঁজে উঠতে হবে নইলে ড্রাম কিনতে হবে, কিন্তু দুটো ক্ষেত্রেই টাকার প্রয়োজন। আর আমি যখনই মাত্র সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে পরদিনই একটা চাকরি খুঁজব, সড়কবাতির আলোয় আমার চোখ পড়লো ওই ইয়াকুজা মাফিয়াটার চোখে যে কিনা আমাদের ওপরতলায় থাকতো। ও রাস্তার কিনারে কিছু গোল গোল ঝোঁপের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলো। আমি যেইনা মাথা নিচু করে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে উদ্যত হলাম ও আমাকে থামালো, বললো, এইযে তুমি দাঁড়াও। ওর পাশে মাটিতে একটা নীল রঙের বড় প্লাস্টিকের আবর্জনার বস্তা ছিলো আর ওর হাতে ছিলো কাজ করার দস্তানা, গায়ে একটা ঢিলাঢালা শার্ট, আর একটা ঝলমলে চেক পায়জামা যেটা ওর কাঠির মত পায়ের সঙ্গে লেপ্টে ছিলো।
"এদিকে এসো একটু সময়ের জন্য।"
ওর দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে যেতে আমি ঘুষি খাবার আশঙ্কা করছিলাম, জলদি ভেবে নিলাম যে বেশি হিংস্র ব্যাপার স্যাপার ঘটলে আমাকেও প্রতিরোধ করতে হবে।
"এটা আমি," ও বললো। "আমি তোমার ওপরতলায় থাকি, তুমি আমায় চেনো তো, তাইনা?" আমি মাথা নাড়লাম। "তোমার নাম কি?"
ইয়াকুজা মাফিয়াটার মুখে ঘাম জমে ছিলো। ওকে দেখে মনে হচ্ছিলো বয়স বিশের কোটার শেষের দিকে, চেহারাটা পকেট ছুরির সাথেই বেশি মিল খায় --- চিকন ভ্রু, তির্যক চোখ, গর্তে ঢোকা গাল, পাতলা নাক, ছোট মুখ। আমি আমার নাম বললাম।
"আচ্ছা তাই? আমার নাম তাতসুমি। আমাকে একটু সাহায্য করবে? আমরা মিলে কিছু কাজ করতে পারি।" ও গুল্মলতাগুলোর দিকে দেখালো, হাইড্রানজিয়া। "আমি তোমায় তিনশ ইয়েন দেব, না, পাঁচশ ইয়েন।"
কি করার জন্য, আমি জিজ্ঞেস করলাম, আর ইয়াকুজা মাফিয়া তাতসুমি বললো, পাতা তোলার জন্য।
"নতুন পাতাগুলো সেরা, ওগুলোকে তোলো আর এই প্লাস্টিকের বস্তায় রাখো।" আমি ওর কথামতো কাজ করলাম। কিন্তু অবাক হয়ে ভাবলাম যে ও হাইড্রানজিয়া পাতা কি কাজে ব্যবহার করবে।
"আমি এগুলোকে শুকিয়ে বিক্রি করি," ও গর্ব করে বললো। "শুকাই, গুড়ো করি, রোল করি, বিক্রি করি -- ওদের ঘ্রাণ আর স্বাদ একদম গাঁজার মতো। তুমি গাঁজা চেনোতো, তাইনা? তোমার মতো বদমাশ ছেলে?"
একজন ইয়াকুজার মুখ থেকে বদমাশ ডাকটা শুনে হাসি পেলো। আমাদের বন্দর নগরীতে আমি কয়েকবার গাঁজা টেনেছি। আমেরিকান জিআইরা সাধারণ সিগারেটের মত করেই গাঁজা খেত বিদেশিদের জন্য করা মদ্যশালাগুলোতে। তাই আমার কাছে এটা যে খারাপ কিছু এমন কোনো ধারণা আসলে কখনোই ছিলোনা। নাকানো আর অন্যরা সবসময় অভিযোগ করত যে টোকিও শহরে কোনো গাঁজাই নেই। সাধারণত তুমি যেকোনো মাদকদ্রব্য পেতে পারো যদি তুমি খোঁজার সঠিক জায়গাটা জানো, কিন্তু জনসংখ্যার তুলনায় এখানে মাদকের পরিমাণ আমাদের শহরের ধারেকাছেও না।
"আমি এটা নিজেই আবিষ্কার করেছি। এই ব্যাপারটার সবচেয়ে ভালো দিক হলো মাদক আইনের সাথে এর কোনো বিরোধ নেই, আর কেউ জানেওনা যে এটা হাইড্রানজিয়া পাতা, আর জানলেই বা কি, কেউ তো আর পুলিশকে গিয়ে অভিযোগ করতে পারবেনা, তাইনা?"
মধ্যরাতে ইনোকাশিরা পার্কে হাইড্রানজিয়া পাতা সংগ্রহ করা একরকম নিজের শহরে বসে আসল গাঁজা টানার চেয়েও বড় অপরাধ মনে হচ্ছিলো। আর দেখা গেলো এটা আমার প্রত্যাশার চেয়েও অনেক বেশি পরিশ্রমের কাজ। আমার কাজ ছিলো নতুন কচি পাতা বাছাই করে তোলা আর বস্তায় রাখা, কিন্তু এই কাজের মধ্যে এতবার নুইতে আর বাঁকা হতে হয়েছে যে সেটা আমার কোমরের পক্ষে কষ্টকর হয়ে দাঁড়ালো। আর রাতটা এতটাই গরম আর আর্দ্র ছিলো যে শীঘ্রই আমি ঘেমে একাকার হলাম। আমরা প্রথম ব্যাগটা প্রায় ভর্তি করেই ফেলেছিলাম যখন একটা সাইকেল আসার শব্দ শোনা গেলো। তাতসুমি ঝোঁপের আড়ালে লুকাতে লাফ দিলো, আমিও দেখাদেখি তাই করলাম। পরে দেখা গেলো ওটা পুলিশ নয় বরং একটা দুধ বিক্রেতা ছেলে। যখন আবার কাজে লেগে পড়লাম, বুঝলাম যে আমাদের কাজটা একদমই বেআইনী কিছু করছি এমন মনে হচ্ছেনা। কোনো অব্যক্ত স্মৃতির জ্বালায় জর্জরিত মানুষের মতো ভ্রু কুঁচকে তাতসুমি বললোঃ
"পুলিশ তোমাকে কখনোই তাদের সন্দেহ দূর করার সুযোগ দেয়না।"
এই সময়ের মধ্যে আমরা হাইড্রানজিয়া পাতা দিয়ে দুটো প্লাস্টিকের বস্তা পূর্ণ করে ফেললাম। পূর্ব আকাশ উজ্জ্বল হতে শুরু করেছে। বাসার দিকে ফিরতে ফিরতে তাতসুমি আর আমি আমাদের জীবনের কাহিনি বিনিময় করলাম। আমি ওকে বললাম যে টোকিওতে আমি আমার দ্বিতীয় মাস কাটাচ্ছি, কিউশু থেকে প্রথম বেরিয়ে। বললাম যে আমার বন্ধুরা একটা ব্লু'জ ব্যান্ড হিসেবে নাম করার চেষ্টা চালাচ্ছে আর আমি একটা চাকরি খোঁজার কথা ভাবছি। অবাক হলাম শুনে যে তাতসুমি আমার চেয়ে মাত্র তিন বছরের বড়। ও আমায় বললো যে ও মাধ্যমিক স্কুলে থাকতেই ওর সিন্ডিকেটের সাথে কাজ করা শুরু করে যাদের অফিস ছিলো শিনজুকুতে। ও আরও বললো যে আজকাল এমনকি মাফিয়া হতেও ভালো শিক্ষিত হতে হয়, বললো যে ও এক মদের দোকানের পরিচারিকার সাথে থাকে যে কিনা প্রায় ওর মায়ের বয়সী, আর ও তাকে নি-চান বলে ডাকে, ভালোবাসার ডাক যার মানে বড়বোন।
" যেখানে তোমার বন্ধুরা পুরো চটে আছে তোমার ওপর, সেখানে যাওয়া সহজ নয়। নি-চান আজ নেই এখানে, তুমি থাকতে চাও?"
তাতসুমির আর আমাদের এপার্টমেন্ট একই নকশার, কিন্তু দুটো ঘরের ভেতর একটা প্রায় ভর্তি ছিলো একটা বড় ডবল খাট এবং সুগন্ধি আর প্রসাধনের ঘ্রাণে।
দুপুরের কিছু পরে আমি ঘুম থেকে উঠলাম আর হাইড্রানজিয়ার বিড়ি বানাতে সাহায্য করলাম। তাতসুমি পাতাগুলোকে রোদে শুকায়নি। "তোমার মনে হয় আমি ওগুলোকে ছাদে দিয়ে দেব?" ও বললো আর হাসলো। ওর হাসিটা অদ্ভুত ছিলো, অন্তত আমি এমন হাসি আগে কোনোদিন দেখিনি। এটা কোনো লজ্জিত বা বিব্রত হওয়া হাসি ছিলোনা, আবার নিষ্ঠুর হাসিও ছিলোনা। মনে হলো যেন ওর মুখের পেশিগুলো হাসতে অভ্যস্ত নয় যার কারণে ওগুলো বুঝতে পারেনা যে কি করা উচিত। ও উচ্চতাপে গ্যাসের চুলায় ভাজার কড়াই বসিয়ে পাতাগুলোকে সেঁকে নিয়েছে। "সবটুকু আর্দ্রতা বের করে নিতে হবে," ও আমায় বললো, "কিন্তু পুড়িয়ে ফেলা যাবেনা। অনেক অভিজ্ঞতার দরকার হয় আসলে।" আগুন থেকে নামানোর আগে ও ওগুলোতে দিয়ে দিলো দুই বা তিন ফোটা সতেজ নিশ্বাসের তরল। "এটাই গোপন উপাদান, চুমু খাবার মতো পুদিনার ফোঁটা, যেটা এই জিনিসে পুরো তোমাদের ইম্পোর্টেড ভাব এনে দেয়।" একটা গর্বের ভঙ্গিতে ও বললো। আমার দায়িত্ব ছিলো পাতা গুড়ো করে বিড়ি বানানো, তাতসুমি আমার কাজ দেখে ভালোই মুগ্ধ হলো। "তুমি ভালোই জানো ব্যাপার স্যাপার," ও বললো।
ওই রাতে আমি ওর সাথে গেলাম জিনিসগুলো বিক্রি করতে। ও শিনজুকুর একটা পেছনদিকের রাস্তা বাছাই করলো, কনসার্ট হল আর পার্কের মাঝামাঝি। ও মাতালদের কাছেই বেঁচতে গেলো বেশিরভাগ সময়। মাতালগুলো সাধারণভাবেই ওকে হাত ইশারায় তাড়িয়ে দিলো। কিন্তু একটা যুগল, তাতসুমিকে ঢিলা শার্ট পরে ওদের দিকে আসতে দেখেই ঘুরে আতিপাতি করে দৌড় দিলো। আমাদের কাছে একটা ঝোলা ব্যাগে হাজারের কাছাকাছি বিড়ি ছিলো, সেলোফেন কাগজে মোড়ানো দশটা করে বিড়ির বান্ডিল। কিন্তু আমরা আলাদা করেও বেঁচতে চাচ্ছিলাম, হাজার ইয়েনে একটা।
"সবসময়ই বেঁচতে এত কষ্ট হয়?" আমি জিজ্ঞেস করলাম।
"সত্যি বলতে," তাতসুমি বললো, "আমি একসঙ্গে এতগুলো বানাইনি আগে কখনোই। আমি পাঁচ/ছ'টা বিড়ি বানাতাম সময়ে সময়ে, আর তোমার মত দেখতে বড় চুলের গাধাদের কাছে বিক্রি করতাম... তো, তোমার মত গাধারা কোথায় সময় কাটায়?"
আমি প্রায়ই যেতাম এমন একটা রক ক্যাফে কাছেই ছিলো, কিন্তু আমি সন্দিহান ছিলাম যে তাতসুমিকে সেটা বলা ঠিক হবে কিনা। ওখানকার লোকজন খুশি হয়ে বিড়িপ্রতি হাজার ইয়েন দেবে ঠিকই, কিন্তু ওখানে সব ঝানু লোক। একবার যদি টের পেয়ে যায় যে জিনিসটা নকল, তাহলে আমি আর জীবনেও ওখানে ঢুকতে পারবোনা। আর যেহেতু কেউ এ জিনিস একবারের বেশি দুবার কিনবেনা তাই বুদ্ধিমানের মতো যা করা উচিত তা হলো বড় দাও মারা। যাই বিক্রি হবে আমার বিশভাগ পাবার কথা, কিন্তু আমি তাতে খুশি ছিলামনা আর তাতসুমিকে বললাম ওটা চল্লিশ করে দিতে। আমি ওকে বললাম চল্লিশ হলে আমি ওকে হিপিতে ভরা একটা জায়গায় নিয়ে যাব আর সবার সাথে আলাপও করিয়ে দেব। শেষমেশ পঁয়ত্রিশে রফা হলো। এখন দরকার দু তিনটে আসল গাঁজার বিড়ি।
"কিজন্য?" তাতসুমি জিজ্ঞেস করলো আর আমি ওকে বললাম যে আমি অন্তত চারশ বিড়ি বিক্রি করতে চাই।
"আমরা যদি অল্প লোককে বিক্রি করি আর নেশা না হয়, তাহলে ওরা সবাইকে বলে দেবে আর আমরা বাজার হারাবো। আমরা দালালদের কাছে বিক্রি করব আর তাই স্যাম্পল দরকার যাতে ওরা আমাদের বিশ্বাস করে।"
বুদ্ধিমান ছেলে, তাতসুমি বলে আর আমার গাল চাপড়ে দেয়। আমরা একটা ছোট্ট ময়লা ডিস্কোতে গিয়ে ঢুকলাম যেখানে ইয়োকোটা ঘাটির জিআইরা আর গ্রিস এবং তুরস্কের নাবিকেরা সময় কাটায়। আমরা তিনটি আসল গাঁজার বিড়ি কিনে আমাদের পরিচিত রক ক্যাফেতে ফিরে গেলাম দালালদের জন্য অপেক্ষা করতে। ভেতরে একটা পিংক ফ্লয়েডের রেকর্ড আমাদের কানের পর্দা যেন ফাটিয়ে দিলো।
"আমি থাকতে পারছিনা!" তাতসুমি আমার কানের মধ্যে চিৎকার করে বললো। "এই জায়গার গুষ্টি মারি!"
রাত ন'টা অবশ্য একটু বেশিই জলদি সময় দালালদের আসার পক্ষে, তাই আমরা ভাবলাম সিনেমা দেখে কিছুটা সময় কাটাই। রাস্তার মাথায় একটা সারারাত খোলা থাকা থিয়েটারে দ্যা লাস্ট পিকচার শো দেখানো হচ্ছিলো। তাতসুমি প্রথমে রাজি হচ্ছিলোনা, এই বলে যে ও বিদেশি কলাকুশলীদের সিনেমা পছন্দ করেনা, কিন্তু সিনেমার অর্ধেক দেখেই ও ফোপাঁতে ফোপাঁতে প্রায় নিশ্বাসই নিতে পারছিলোনা।
"এমন সিনেমা আমি কখনোই দেখিনি," ও বললো দোকানটায় বসে যেখানে রক ক্যাফেতে ফেরার আগে থেমে আমরা বিয়ার খাচ্ছিলাম। "তুমি সবসময়ই এমন সিনেমা দেখো?"
একদমই না।
"তাহলে তোমার কেমন লাগলো ওটা?"
ওটা দেখে আমার মনে হয়েছে যে আমেরিকায়ও নিঃসঙ্গ মানুষ আছে।
"এর আবার মানে কি?"
আমার শহরের আমেরিকান জিআইগুলো এত উদ্ধত ভাব দেখাতো, আমি ওকে বললাম --- বড় বড় লোক, সবসময় হাসতে থাকতো, সবসময়ই দেখে মনে হতো খুব মৌজে আছে, তাই আমি ভাবতাম সব আমেরিকানরাই বড়লোক আর সুখী।
"জানিনা তুমি কিসব অদ্ভুত কথা বলছ," তাতসুমি বললো। ও মাথা নিচু করে বসেছিলো। "কিন্তু আমার মনে হয় আমেরিকায়ও এমন মানুষ আছে যারা তাদের চেয়ে বয়সে অনেক বড় কারোর প্রেমে পড়ে যায়।"
কিছুক্ষণ ওর আর কিছুই বললোনা বরং বিয়ার খেতে খেতে যেন কিছু ভাবতে লাগলো।
তাতসুমি মদে অভ্যস্ত ছিলোনা, তিনটে বিয়ারের পর ওর পা দুলতে লাগলো। আমরা রক ক্যাফেতে ফিরে গেলাম যেখানে এখন পরিবেশ পুরোই প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছিলো। আমি ওকে ইয়োকোসুকার তিনজন দালালের একটা দলের সাথে আলাপ করিয়ে দিলাম, তাদের বললাম, ও একজন ইয়াকুজা মাফিয়া যে কিনা সেদিনই ওকিনাওয়া থেকে এসেছে। সবকিছুর মধ্যে ওরা তিনশর কাছাকাছি বিড়ি কিনলো।
"নি-চান, এই হলো ইয়াজাকি, ওর লম্বা চুল দেখে ভড়কে যেওনা, ছেলের মাথায় কিন্তু খুব বুদ্ধি।" আমরা ট্যাক্সি করে বাড়ি ফিরেছিলাম। আমার এপার্টমেন্টে আলো জ্বলতে দেখা গেলোনা আর তাতসুমিরটায় ও নি-চান বলে ডাকে ওই মহিলা চলে এসেছিলো। উনি একটা আসনে বসে রামেন খাচ্ছিলেন। সহজেই আমার কিংবা তাতসুমির মা বলে চালিয়ে দেবার মতো বয়স। উনি ব্রা পরে ছিলেন না, আর বগলের নিচ শীঘ্র কামিয়েছেন বলে মনে হয়না। উনি কিছুই বললেন না, এমনকি আমাকে দেখলেনও না, কিন্তু এই মেকাপের পুরু স্তর মাখা মহিলাকে শান্তভাবে আরেক হাতে খোলা সিগারেট নিয়ে নুডলস টানতে দেখতে দেখতে আমার মনে হলো আমি বুঝেছি যে কেন তাতসুমি দ্যা লাস্ট পিকচার শো দেখে ফোপাঁচ্ছিলো। টিমোথি বটমস, মধ্যপশ্চিম নাজানি কোথাকার একটা ছোট্ট শহরে বাস করত যে কিনা নিজের চেয়ে দ্বিগুণ বয়সী এক নিঃসঙ্গ বিবাহিত মহিলাকে বেছে নেয় তার যৌনসঙ্গী হিসেবে। শেষদৃশ্যে, সে শহর ছেড়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় আর তার পিকআপ ট্রাক চালাতে শুরু করে, কিন্তু তারপর গাড়ি ঘুরিয়ে সেই মহিলার বাড়িতে ফিরে যায়। ওই শ্রান্ত বয়ষ্ক মহিলা ছিলো আমেরিকার প্রতীক -- এমন এক আমেরিকা যে কিনা হারিয়েছে এমনকিছু যা একসময় তার ছিলো।
"নি-চান, দেখো। আমি আর ও মিলে কতগুলো টাকা কামিয়েছি।"
তাতসুমি দশ হাজার ইয়েনের নোটের একটা রোল ওর জমকালো পায়জামার পকেট থেকে বের করে মহিলার সামনে রাখলো, ওনার রামেন খাওয়া শেষ হয়ে গিয়েছিলো। নুডলস খাবার সময়কার সেই ভাবলেশহীন চেহারা নিয়েই উনি টাকাগুলো গুনতে লাগলেন।
"কোথায় গিয়েছিলে?" নাকানো জিজ্ঞেস করলো যখন আমি আমার এপার্টমেন্টে ঢুকলাম। "আমরা সবাই তোমাকে নিয়ে চিন্তায় ছিলাম। "
ওই একমাত্র জেগে ছিলো। একটা ছোট প্যান্ট আর শার্ট পরে রান্নাঘরে বসে সানটরির সবচেয়ে কমদামি হুইস্কি খাচ্ছিলো।
"আমরা সবাই বসে আজ সবকিছু আলোচনা করলাম," ও বললো। "কাটোর মা আবার অসুস্থ হয়ে পড়েছে তাই ও বাড়ি যেতে চায়। বাস্তবের মুখোমুখি হই, আমরা এমনিতেও মনে হয়না একটা আসল ব্যান্ড হয়ে উঠতে পারবো এমনভাবে জীবনযাপন করে। শিমাডা বলেছে ও ওর পরিচিত এক দলের সাথে ভ্রাম্যমাণ হিসেবে কাজ করবে, আর ইয়ামাগুচি বলেছে ও কোনো এক জাজ গিটার স্কুলে ভর্তি হবে। আর আমি, আমি এখনো কি করব সিদ্ধান্ত নেইনি, কিন্তু আমি এসবে ক্লান্ত হয়ে গেছি। হয়ত মাত্র দুমাসেই হাল ছেড়ে দেয়াটা লজ্জাজনক, কিন্তু মূলকথা এটাই বন্ধু, আমরা এক বছর ধরে এসব চালিয়ে যেতে পারি আর কোনো কূলকিনারা নাই পেতে পারি। তাই যাই হোক, আজ থেকে তিন সপ্তাহ পর, রবিবারে, আমরা পার্কে একটা ছোট্ট কনসার্টে বাজাবো। কেমন হবে ইয়াজাকি? শিমাডা বলেছে ও ধার করে ড্রাম এনে দিতে পারবে। তুমি বাজাবে, ঠিক আছে? হয়ত এই শেষবার আমাদের একত্রে বাজানোর। ইনোকাশিরা পার্কের কোণায় একটা বাইরের দিকে মুখ করা ছোট্ট মঞ্চ আছে আর তারা কনসার্টের আয়োজন করে, পল্লীগানই বেশিরভাগ, প্রতি শনিবার আর রবিবার বিকেলে। আমার একভাবে এই অনুষ্ঠানের প্রযোজকের সাথে আলাপ হয়েছে আর আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছি যে আমাদের একটা সুযোগ দেয়া যায় কিনা এবং সে বলেছে, 'অবশ্যই', ঠিক এভাবে। "
"আমি বাজাতে চাইনা," আমি বললাম। "আমি কিছু টাকার ব্যবস্থা করতে পেরেছি, তাই কাল আমি নিজের একটা ঘরের সন্ধানে যাব। কিন্তু আমি অবশ্যই তোমাদের অনুষ্ঠান দেখতে আসবো।"
আমি খুব সহজেই একটা এপার্টমেন্ট পেয়ে গেলাম, বেশি দূরে নয় আর আমি আমার অল্পকিছু জিনিসপত্র যা ছিলো ট্যাক্সি করে নিয়ে যেতে পারলাম। এটা ছিলো একটা ছোট্ট ঘর, স্রেফ সাড়ে চার ম্যাট্রিক্স, কিন্তু আমার যথেষ্ট টাকা বেঁচে গিয়েছিলো একটা স্টেরিও কেনার পক্ষে। আমার জীবনে বেশি একটা বদল এলোনা; আমি এখনও পুরনো উপন্যাস আর কবিতা সংগ্রহ কিনতে লাগলাম পুরনো বইয়ের দোকান থেকে আর ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে ওগুলোকে পড়তাম রক আর জাজ ক্যাফেতে বসে। যখন টাকা শেষ হয়ে যেত আমি হাইড্রানজিয়া ঝোঁপের সন্ধান করতাম, কিছু নকল বিড়ি বানাতাম আর আকাসাকা বা রোপোঙ্গিতে নিয়ে বেঁচতাম। আমি শিনজুকু এড়িয়ে চলতাম, কিন্তু তারপরেও একরাতে এক আকাসাকা ডিস্কোতে সেই ইয়োকোসুকার দালালদের সাথে দেখা হয়ে গেলো। মনে হয় ওরা বোঝেইনি যে গাঁজা আমরা বিক্রি করেছি সেগুলো আসল ছিলোনা যদিও। ওগুলো খুব একটা ভালো ছিলোনা, শুধু এইটুকুই বললো ওরা।
যখন সেই বড় রবিবার এলো, ইনোকাশিরা পার্কের বাইরের দিকের সেই ছোট্ট মঞ্চ পল্লীগায়কদের দ্বারা আক্রান্ত হলো আর তিনজন পল্লীগায়কের একটা দল একের পর এক প্রাণহীন বিরক্তিকর গান গাইলো। প্রায় ত্রিশজনের মত লোক বসে শুনছিলো আর তাদের হাততালি চাপা শব্দ আর অস্তিত্বহীনতার মধ্যে ওঠানামা করছিলো। যখন নাকানো আর অন্যরা বাজাতে শুরু করলো, এক বৃদ্ধ যুগল যারা কিনা কবুতরদের পাউরুটি খাওয়াচ্ছিলো, উঠে চলে গেলো, হট্টগোলের ব্যাপারে জোরে জোরে নালিশ জানিয়ে। আর মাত্র দুটো জন মায়ালের গান করার পরই ড্রামহীন ব্লু'জ গানের দলটার ভবিষ্যৎ মুখ থুবড়ে পড়লো। যদিও চারজনের সবাইকেই মনে হলো নিজেদের ভালোই উপভোগ করেছে, আর যখন ওদের সংক্ষিপ্ত পরিবেশনা শেষ হয়ে গেলো, ওরা মঞ্চের একপাশে বসে কোলা পান করতে লাগলো আর পল্লীগায়কদের নিয়ে হাসাহাসি করতে লাগলো। নাকানো আমায় দেখে হাত নাড়লো ওদের সাথে যোগ দিতে, কিন্তু আমি শুধু হাত নাড়লাম, মাথা দোলালাম, আর চলে এলাম। আমি পুকুরের চারপাশে হাঁটতে চাইছিলাম আর শীঘ্রই সেই বেঞ্চে গিয়ে বসে পড়লাম যেটা ছিলো সেই হাইড্রানজিয়া ঝোঁপের পাশে যেখান থেকে আমি আর তাতসুমি পাতা তুলেছিলাম। বর্ষাকাল শেষ হয়ে এসেছিলো, মুকুলগুলো হারিয়ে যাচ্ছিলো। ওই ধূসর ফুলগুলোর দিকে তাকিয়ে, সেই ভ্যাপসা রাতের কথা স্মরণ করে যেটা আমরা কাটিয়েছি পাতা সংগ্রহ করে, আমি হঠাৎ করে ঘৃণার মতো অনুভব করলাম দ্যা লাস্ট পিকচার শোয়ের জন্য। তাতসুমির মতো একজন মানুষকে কাঁদানোর জন্য আমি ওই সিনেমাটাকে কোনদিন ক্ষমা করবোনা।
আমি সিদ্ধান্ত নিলাম যে আমি ওর সাথে দেখা করব তাই পুরনো এপার্টমেন্ট বিল্ডিংটাতে গেলাম।
"নি-চান আছে, এসো ভেতরে।"
মহিলা কাজে যাবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন। উনি একটা ফালতু ধরনের লাল পোশাক পরেছিলেন। ওনার সম্পূর্ণ মেকাপের স্তরলেপন শেষ হয়েছিলো আর এখন উনি ওনার পায়ের নখ রাঙাচ্ছিলেন। নেলপলিশের গন্ধে বাতাস এতটাই ভারী হয়েছিলো যে নিশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছিলো। তাতসুমি ভাজার কড়াইয়ে হাইড্রানজিয়া পাতা শুকাচ্ছিলো। মহিলা আমার দিকে একবার তাকালেন কিন্তু কিছুই বললেননা। আমি চুপচাপ বসে তার লাল পলিশ লাগানো দেখতেই থাকলাম।
------------
লেখক পরিচিতি: রিও মুরাকামি একজন জাপানি ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, প্রাবন্ধিক এবং চলচ্চিত্র নির্মাতা। তার জন্ম ১৯৫২ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি, নাগাসাকির সাসেবোতে। ছাত্রাবস্থাতেই তিনি তার প্রথম উপন্যাস 'অলমোস্ট ট্রান্সপারেন্ট ব্লু' লেখেন এবং সমালোচকদের নজর কারেন। ১৯৭৬ সালে নিউকামার সাহিত্য পুরস্কার এবং একই বছরে আকুতাগাওয়া পুরস্কার লাভ করেন এই উপন্যাসের জন্য। তার উল্লেখযোগ্য আরও কিছু উপন্যাসঃ অডিশন, কয়েন লকার বেবিস, ইন দ্যা মিশো স্যুপ। এছাড়াও তিনি অসংখ্য ছোটগল্পের রচয়িতা। তার দ্যা লাস্ট পিকচার শো গল্পটি জাপানি ভাষা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেন র্যালফ ম্যাকারথি।
অনুবাদক পরিচিতি:
দিলশাদ চৌধুরী
কথাসাহিত্যিক, অনুবাদক।
বর্তমানে তুলনামূলক সাহিত্য ও সংস্কৃতি নিয়ে পড়াশোনা করছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে।
অনুবাদক পরিচিতি:
দিলশাদ চৌধুরী
কথাসাহিত্যিক, অনুবাদক।
বর্তমানে তুলনামূলক সাহিত্য ও সংস্কৃতি নিয়ে পড়াশোনা করছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে।
0 মন্তব্যসমূহ