বাংলা তরজমা : বিপ্লব বিশ্বাস
[ রশোমন ছিল জাপানের প্রাচীন রাজধানী কিয়োটোর বৃহত্তম তোরণদ্বার যা চওড়ায় ১০৬ফুট আর গভীরতায় ২৬ ফুট। এর মাথায় ছিল লম্বা অনুভূমিক দণ্ড ; পাথুরে দেওয়াল ছিল ৭৫ ফুট উঁচু। এটি নির্মিত হয়েছিল ৭৮৯ সালে ( ভিন্ন তথ্যানুযায়ী ৭৯৪ সাল) যখন জাপানের রাজধানী কিয়োটোতে স্থানান্তরিত হয়। পশ্চিম কিয়োটোর পতনের পর এই তোরণ ভেঙে পড়ে, নানান জায়গায় ফাট ধরে আর এ জায়গা হয়ে পড়ে চোর ডাকাতদের গোপন ডেরা আর অবশ্যই দাবিহীন, পরিত্যক্ত মড়া ফেলার জায়গা। ]
সেই সন্ধ্যায় জাঁকিয়ে ঠান্ডা পড়েছিল। এক সামুরাই যোদ্ধার চাকর রশোমনের নিচে দাঁড়িয়েছিল,বৃষ্টি থামার অপেক্ষায়।
সেই চওড়া তোরণদ্বারের নিচে আর কেউ ছিল না। দ্বারের মোটা থামের ওপর থেকে গাঢ় লাল - সোনালি বার্নিশ খাপছাড়াভাবে চটে গেছে আর সেখানে ঝুলে আছে একটা বাদুড়। যেহেতু রশোমনের অবস্থান সুজাকু অ্যাভেন্যুতে, অন্ততপক্ষে আরও কিছু মানুষ, হোগলার টুপি - পরা বা অভিজাত মানুষের ঢঙে পাগড়ি মাথায়, আশা করা গিয়েছিল সেখানে ঝড়বৃষ্টি থামার অপেক্ষায় থাকবে। কিন্তু এই একজন ছাড়া কাছাকাছি আর কেউ ছিল না।
বছরকয় যাবৎ কিয়োটো শহরের ওপর দিয়ে নানান দুর্যোগ, ভূমিকম্প, ঘূর্ণিঝড়, আগুন লেগেই ছিল আর তাতেই দারুণ ক্ষতিগ্রস্ত সে। পুরনো আখ্যান ঘাঁটলে দেখা যায় যে বুদ্ধমূর্তি ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বস্তুর ভাঙা টুকরো যে সবের গা থেকে সোনালি, রুপোলি কাঠের তৈরি পাতা সব উপড়ে গেছে, সে সমস্ত রাস্তার ধারে জড়ো করা থাকত জ্বালানি হিসেবে বিক্রির জন্য। কিয়োটোর এমন দুরবস্থায় রশোমনের সারাসুরির প্রশ্নই ছিল না। আর এই বিপর্যস্ত অবস্থার সুযোগ নিয়ে খেঁকশিয়াল বা অপরাপর বন্যপ্রাণী তোরণের ধ্বংসাবশেষে তাদের আস্তানা বানিয়েছিল ; চোর ডাকাতের দলও জবরদস্ত ডেরা খুঁজে পেয়েছিল। ঘটনাচক্রে এখানে দাবিহীন মড়া এনে ফেলে যাওয়াও নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছিল। অন্ধকার ঘনিয়ে এলে জায়গাটা এমন ভূতুড়ে হয়ে পড়ত যে কেউই আসতে সাহস পেত না।
হঠাৎ কোথা থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে কাক উড়ে আসত সেখানে। দিনের ভাগে এই কা কা রবের পাখিরা তোরণের মাথার দণ্ডটাকে ঘিরে ডেকে চলত। মাথার ওপরের আকাশ সূর্যাস্তের আভায় লাল হয়ে এলে তাদের দেখে মনে হত প্রচুর তিল তোরণের আড়াআড়ি ছুঁড়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ওইদিন কোনও কাক দেখা গেল না, হয়তো সন্ধ্যা অনেকটা গড়িয়ে গেছে তাই। এখানে সেখানে পাথরের সিঁড়ি ভেঙে পড়ছিল আর সে সবের ফোকরে দ্রুত বেড়ে ওঠা ঘাস গজাচ্ছিল আর ছোপ ছোপ কাকের গুয়ে পাকানো ছিল জায়গাটা। নীল রঙের কিমোনো পরা চাকরটি উচ্চতম সাত নং সিঁড়িতে বসেছিল ; ফাঁকা দৃষ্টিতে অবিরাম বৃষ্টিপাত দেখে যাচ্ছিল। এমন সময় নিজের ডান গালে এক বড় ফুসকুড়ির দিকে তার মনোযোগ গেল।
যেমনটা বলা হয়েছিল, চাকরটি বৃষ্টি ছাড়ার অপেক্ষায় ছিল। কিন্তু বৃষ্টি থামলে কী করবে সে ব্যাপারে তার কোনও নির্দিষ্ট পরিকল্পনা ছিল না। সাধারণভাবে অবশ্য প্রভুর বাড়িতেই ফিরে যাওয়ার কথা তার কিন্তু সেখান থেকে তো তাকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, খানিকটা আগেই। কিয়োটো শহরের সম্পন্ন ভাব দ্রুত পড়ে গেছে আর তার সামুরাই মনিব পড়তি অবস্থার কারণে তাকে কাজ থেকে বরখাস্ত করেছে - সে যার সেবা করেছে বহু বছর ধরে। এভাবে বৃষ্টিতে আটকে সে হতবুদ্ধি হয়ে বুঝতে পারছে না, কোথায় যাবে! আর তার এই অসহায়তায় এই বাজে আবহাওয়ার কিছু করারও নেই তেমন। বৃষ্টি থামার কোনও লক্ষণ নেই। সে গভীর ভাবনায় ডুবে যাচ্ছে, কালকে কীভাবে চলবে,আর তার অসহায়, অসংলগ্ন ভাবনাসব এক অশান্ত, অপ্রতিরোধ্য দুর্ভাগ্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। লক্ষ্যহীন ভাবে সে সুজাকু অ্যাভেন্যুর এই অবিরল বৃষ্টিপাতের টুপটাপ শব্দ শুনতে থাকে।
এরমধ্যে এই অঝোর ধারা রশোমনকে জোরালো ঢঙে ছেয়ে ফেলেছে, দূর থেকেও তার প্রবল আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। মাথা উঁচিয়ে সে দেখল, এক ভারী কালো মেঘ তোরণের ছাদ থেকে বেরিয়ে আসা টালির আগাজুড়ে আটকে আছে।
এই অসহায় অবস্থার কারণে তার সামনে খারাপ বা ভালো কোনও বিকল্পই প্রায় নেই। যদি সৎপথে বাঁচতে চায় তাহলে না খেয়ে মরে পড়ে থাকতে হবে এই সুজাকু অ্যাভেন্যুর নিকাশি- নালার মধ্যে বা এই দেওয়ালের পাশে। তখন তার শব তোরণের কাছে এনে রাস্তার কুকুরের মতো ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হবে। আর সে যদি চুরিচামারি করতে মনস্থ করে... তার অস্থির মন এভাবে ঘুরপথে বারংবার ভেবে সিদ্ধান্তে এল যে সে চোরই হবে। কিন্তু প্রায়ই সন্দিহান হতে থাকল সে। যদিও সে দৃঢ়বদ্ধ যে তার সামনে আর কোনও রাস্তা নেই তবু্ও চুরি করেই খেতে হবে, এই সিদ্ধান্তকে সমর্থন করার মতো যথেষ্ট সাহস সে জোটাতে পারল না।
জোর কয়েকটি হাঁচি দিয়ে সে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল। কিয়োটোর এই সান্ধ্য ঠান্ডায় সে একটা গরম চুল্লির জন্য হাঁকপাঁক করছিল। সন্ধ্যার বাতাস তোরণের থাম জুড়ে গর্জন করে যাচ্ছে। যে বাদুড়টা সোনালি বার্নিশ করা থামে ঝুলছিল সেও বেপাত্তা।
গলা নিচু করে লোকটা তোরণের চারপাশ দেখতে থাকল আর তার পরনে যে নীল কিমোনোটা পাতলা অন্তর্বাসের ওপর পরেছিল সেটার কাঁধের কাপড় টেনে তুলল। রাতটা সেখানেই কাটাবে ঠিক করল সে, যদি ঝড়বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা পেতে কোনও নির্জন কোণ খুঁজে পায়। সে একটা চওড়া সোনালি বার্নিশের সিঁড়িপথ দেখতে পেল যা তোরণের টাওয়ারের দিকে গেছে। সেখানে মৃতেরা ছাড়া আর কারোর থাকার কথা নয়, যদি আদৌ কেউ থেকে থাকে। তাই শরীরে ঝোলানো তরবারিটি যাতে খাপ- ছাড়া না হয় সে ব্যাপারে সতর্ক হয়ে সে সিঁড়ির নিচের ধাপে পা রাখল।
সেকেন্ডকয় পর সিঁড়ির মাঝপথে এসে সে ওপরে একটা চলাচল লক্ষ করল। শ্বাস আটকে রেখে আর টাওয়ারপানে উঠে যাওয়া চওড়া সিঁড়ির মাঝে বিড়াল- পায়ে সে কাঁপ মেরে অপেক্ষা আর লক্ষ করতে লাগল। টাওয়ারের ওপরের দিক থেকে একটা মৃদু আলোর রেখা দেখা যাচ্ছে যা আলতোভাবে তার ডান গালে পড়ছে। এই গালেই সেই পূযভরা লাল ফুসকুড়িটা আছে যা ঠিক তার খোঁচা খোঁচা জুলপির নিচে দৃশ্যমান। সে আশা করেছিল, শুধু মৃতেরাই এই টাওয়ারের ভিতর থাকবে, কিন্তু কয়েক পা উঠতে না উঠতেই ওপরে আগুন দেখতে পেল সে যার আশপাশে কেউ যেন হাঁটাচলা করছে। একটা ম্যাটমেটে হলদে কাঁপা কাঁপা আলো দেখল যা ছাদ থেকে ঝুলতে থাকা মাকড়সার জালকে ভৌতিকঢঙে আলোকিত করছে। এই রশোমনে আলো জ্বালছে সে কেমন লোক... এই ঝোড়ো আবহাওয়ায়! এই অচেনা, এই অশুভ সংকেত তাকে ভয় পাইয়ে দিল।
টিকটিকির মতো চুপচাপ এই চাকরটি গুটিসুটি মেরে খাড়া সিঁড়ি বেয়ে একদম ওপরে উঠে গেল। চার হাত- পায়ে ভর দিয়ে আর যতটা সম্ভব গলা বাড়িয়ে সে ভীরুর মতো টাওয়ারের ভিতরে উঁকি মারল। গুজবের রেশ ধরে সে মেঝেতে কয়েকটি মৃতদেহ ছড়িয়ে - ছিটিয়ে পড়ে থাকতে দেখল। মৃদু আলোতে সে সব ঠিক গুণে উঠতে পারল না। শুধু দেখতে পেল, কয়েকটি মড়া উলঙ্গ আর কয়েকটি কাপড় -ঢাকা। তাদের মধ্যে আবার কয়েকটি মহিলার আর সবগুলোই মেঝেতে অলস পড়ে আছে, তাদের হাঁ- মুখ খোলা কিংবা হাতগুলো ছড়ানো, মাটির পুতুলের মতো, প্রাণের কোনও স্পন্দন নেই। তাদের এই চিরকালিক নির্বাক অবস্থা দেখে কারও সন্দেহ হতেই পারে, এরা কখনও বেঁচে ছিল তো! তাদের কাঁধ, বক্ষদেশ আর ধড় মৃদু আলোয় ঝুলে আছে ; দেহের অন্যান্য অংশ ছায়ার মাঝে হারিয়ে গেছে। এইসব গলাপচা শবদেহের অসহ্য দুর্গন্ধে স্বাভাবিকভাবেই তার হাত নাকে উঠে এল।
পরক্ষণেই সেই হাত নেমে এল আর সে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকল। নজরে পড়ল এক পিশাচমূর্তি যা একটা মড়ার ওপর ঝুঁকে আছে। দেখে মনে হয় এক বুড়ি, শুকনো চেহারা, চুল শাদা, দেখতে ঠিক সন্ন্যাসিনীদের মতো। ডান হাতে একটা পাইনকাঠের মশাল নিয়ে সে একটা মড়ার মুখে উঁকি মারছে যার মাথাভর্তি লম্বা কালো চুল।
কৌতূহলের চাইতে প্রচণ্ড ভয়ে আঁকড়ে গিয়ে সে কিছুক্ষণের জন্য শ্বাস নিতে ভুলে গেল। তার মনে হল, শরীরের সঙ্গে মাথার চুলও যেন খাড়া হয়ে গেছে। আতঙ্কগ্রস্ত সে দেখছে, বুড়ি মশালটা মেঝেতে দুই তক্তার ফাঁকে গুঁজে হাতদুটো মড়াটার মাথায় রাখল ; তারপর একে একে তার লম্বা চুল ছিঁড়তে লাগল যেমনভাবে বানর তার সন্তানের মাথা থেকে উকুন তোলে। এভাবে সহজেই চুল-সব উপড়ে আসছিল।
এভাবে চুল উপড়ে আসতে দেখে লোকটার ভিতর থেকে ভয় উবে গিয়ে বুড়ির প্রতি চরম ঘৃণা জন্মাল। এমনকি তা ঘৃণাকেও ছাড়িয়ে গেল, সমস্ত অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে এক অপার বিতৃষ্ণা জন্মাল তার মধ্যে। এই মুহূর্তে কেউ যদি প্রশ্ন তুলত যে সে না খেয়ে মরবে নাকি চুরিটুরি করে বাঁঁচবে - কিছুক্ষণ আগে যে প্রশ্ন তাকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছিল - তাহলে সে মৃত্যুকে বেছে নিতে ইতস্তত করবে না। মন্দ কাজের প্রতি তার ঘৃণা ওই মেঝেতে বুড়ির গুঁজে রাখা পাইন কাঠের মশালের মতো অকস্মাৎ জ্বলে উঠল।
সে বুঝতে পারছিল না, বুড়ি কেন এভাবে মড়ার মাথা থেকে চুল ছিঁড়ছে! সঙ্গে সঙ্গে এটাও বুঝতে পারছে না বুড়ির এই কাজ কীভাবে গণ্য করবে - ভালো না মন্দ। কিন্তু তার দৃষ্টিতে , এই ঝোড়ো রাতে রশোমন তোরণে এভাবে মড়ার মাথা থেকে চুল ছিঁড়ে নেওয়া ক্ষমাহীন অপরাধ। অবশ্যই এটা তার কখনওই মনে হয়নি যে কিছুক্ষণ আগেই সে চোর হতে চেয়েছিল।
এরপর পায়ের তাকতে ভর করে সে সিঁড়ি থেকে উঠে হাতে তরবারিটি নিয়ে বড় বড় পা ফেলে ওই জঘন্য বুড়িটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। ডাইনিটা ঘুরে দাঁড়াল, চোখভরা আতঙ্ক, কাঁপতে কাঁপতে মেঝে থেকে লাফিয়ে উঠল। কয়েক মুহূর্তের জন্য সে থামল, নিজেকে গুছিয়ে নিল আর জোর চিৎকার দিয়ে সিঁড়িপানে ঝাঁপিয়ে পড়ল।
'শয়তানি! পালাচ্ছিস কোথায়? ' লোকটা চেঁচিয়ে উঠল, তাকে পেরিয়ে পালিয়ে যেতে চেষ্টা করছিল বলে সেই ডাইনির পথ আটকে দাঁড়াল। তবু্ও বুড়ি আঁচড়ে- হিঁচড়ে পালাতে চাইল। তাকে আটকাতে পেছনে ঠেলে দিল লোকটা... দুজনেই ঠেলাঠেলি করতে করতে মড়াগুলোর মাঝে পড়ে গিয়ে হাতড়ে বেড়াতে লাগল। ব্যাপারটা কখনওই সন্দেহের মধ্যে ছিল না। এক মুহূর্তের মধ্যে লোকটা বুড়ির হাত নাগালে পেয়ে তা মুচড়ে দিল আর জোর করে মেঝেতে বসাল। তার হাতদুটো অস্থিচর্মসার, মুরগির পায়ের নলিতে যেটুকু মাংস থাকে তার চেয়ে বেশি কিছু নেই। যেইমাত্র বুড়িকে মেঝেতে বসানো গেল সে তার তরবারির রুপোলি - শাদা প্রান্তদেশ বুড়ির নাকের ডগায় ঠুসে দিল। বুড়ি নিশ্চুপ। সে খিঁচুনি দিয়ে কাঁপতে লাগল আর চোখদুটো এমনভাবে বিস্ফারিত হল যেন কোটর থেকে বেরিয়ে আসবে। সে ফ্যাসফেসে শব্দ করে হাঁফাচ্ছিল। এই বেচারার জীবনটা যেন এখন তারই। এই ভাবনা লোকটার ফুটন্ত রাগে জল ঢেলে দিল আর তার মধ্যে এক শান্ত অহংকার ও তৃপ্তি বয়ে আনল। বুড়িকে আগাপাশতলা পরখ করে কিছুটা শান্ত- স্বরে সে বলল : 'দেখ, আমি উচ্চ পুলিশ কমিশনার অফিসের কোনও অফিসার নই। আমি এক অচেনা লোক যে হঠাৎ করেই এই রশোমন তোরণের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। আমি তোমাকে বেঁধে রাখব না বা তোমার বিরুদ্ধে কিছু করবও না ; কিন্তু তোমাকে বলতে হবে এখানে উঠে তুমি কী করছ? '
বুড়িটা তার বিস্ফারিত চোখদুটো মেলে তাকে গভীরভাবে নিরীক্ষণ করতে লাগল, সে চোখে যেন শিকারি পাখির তীক্ষ্ণ লাল দৃষ্টি। সে ঠোঁট নাড়ল যা তার নাকের মধ্যে কুঁচকে ঢুকে আছে যেন সে কিছু চিবুচ্ছে। তার ছুঁচলো কণ্ঠা পাতলা গলদেশে ওঠানামা করছে। তারপর কাকের কা কা ডাকের মতো একটা হাঁপানো শব্দ তার গলা থেকে বেরিয়ে এল :
' আমি চুল ছিঁড়ি... টেনে ছিঁড়ি...তা দিয়ে পরচুলা বানাব বলে। '
বুড়ির এই উত্তরে তাদের অপ্রত্যাশিত সাক্ষাতে যত অচেনা বিষয় ছিল তা সব দূর হয়ে এক নিরাশার জন্ম দিল। হঠাৎই তাকে মনে হল লোকটার পায়ের নিচে পড়ে থাকা এক কম্পমান বৃদ্ধা। পিশাচিনী নয় একদম : সামান্য এক ডাইনি যে মড়ার মাথা থেকে চুল জোগাড় করে পরচুলা বানায় বিক্রির জন্য, সামান্য খুদকুঁড়ো জোটানোর তাগিদে। এক শীতল অবজ্ঞা লোকটাকে গ্রাস করল। ভয় উবে গিয়ে আগের ঘৃণা তার মধ্যে ফিরে এল। এইসব মনোভাবের আঁচ অবশ্যই বুড়ি পেয়েছে। বেচারা তখনও তার উপড়ে নেওয়া চুলগোছা হাতে ধরে ভাঙা খসখসে গলায় যা বিড়বিড়িয়ে বলল তা হল :
' হ্যাঁ, সত্যিই তো মড়ার মাথা থেকে চুল ছিঁড়ে পরচুলা বানানো তোমার কাছে চরম খারাপ কাজ বলে মনে হতেই পারে, কিন্তু এইসব মড়াদের এর চেয়ে বেশি কিছু পাওয়ার নেই। এই মেয়েটা যার সুন্দর কালো চুল টেনে ছিঁড়ছিলাম, গার্ড ব্যারাকে কেটে রাখা সাপের শুকনো মাংস শুঁটকি মাছ বলে বিক্রি করত। যদি সে প্লেগে না মারা যেত তাহলে এখনও তা-ই বেচত। পাহারাদাররা ওর কাছ থেকে মাংস কিনতে পছন্দ করত আর বলত যে ওর বেচা মাছ দারুণ সুস্বাদু। মেয়েটি যা করত তা ভুল হতে পারে না কেননা যদি তা না করত সে অনাহারে মারা যেত। এ ছাড়া কোনও রাস্তা ছিল না। যদি সে জানতে পারত যে আমাকেও বাঁচার জন্য এই কাজ করতে হচ্ছে, সে হয়তো কিছুই মনে করত না। '
লোকটা তরবারি খাপে ভরে দিল আর তার হাতলে বাঁ হাতটা রেখে মন দিয়ে বুড়ির কথাগুলি শুনল। ডান হাত দিয়ে গালের বড় ফুসকুড়িটা ছুঁয়ে দেখল। বুড়ির কথা শুনতে শুনতে তার মনে একজাতীয় সাহস গজালো - কিছু আগে রশোমন তোরণের নিচে বসে থাকার সময় যা তার ছিল না। যে সাহসে ভর করে এই বুড়িকে কবজায় এনেছিল তার বিপরীতে এক অদ্ভুত শক্তি তাকে চালনা করতে লাগল। সে না খেয়ে মরবে না চোর বনে যাবে সে বিষয়ে তার আর বিস্ময়ের কিছু থাকল না। অনাহার তার মন থেকে এতটাই দূরে যে সেটাই যেন শেষ ভাবনা যা তার ভিতরে প্রবেশ করেছিল।
'তুমি ঠিক বলছ? ' বুড়ির বলা শেষ হলে লোকটা বিদ্রুপের সুরে জানতে চাইল। ফুসকুড়ি থেকে ডান হাতটা সরিয়ে আর সামনে ঝুঁকে সে বুড়ির ঘাড় ধরে তীক্ষ্ণ স্বরে বলল : ' তাহলে আমি যদি তোমার কিছু জোর করে ছিনিয়ে নিই, সেটা ঠিক কাজই হবে। আর তা না করলে তো আমাকে উপোস থাকতে হবে। '
এই বলে লোকটা বুড়ির পরনের কাপড় ছিঁড়ে তাকে জোর লাথি কষিয়ে মড়াগুলোর ওপর ঠেলে ফেলে দিল যখন বুড়ি তার পা আঁকড়ে ধরতে আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগল। পাঁচ পা এগিয়েই লোকটা তখন সিঁড়ির একদম উঁচুতে। বুড়ির যে হলদে কাপড়চোপড় সে ছিঁড়ে নিয়েছে তা তার বগলের নিচে আর তারপর চোখের পলক পড়তে না পড়তেই সে খাড়া সিঁড়ি বেয়ে ঝটিতি নেমে রাতের চাপচাপ অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। তার নেমে যাওয়ার ধপধপ শব্দ যেন ফাঁপা টাওয়ারের বুকে আঘাত হানছিল, তারপর তা থেমেও গেল।
কিছুক্ষণ বাদে সেই ডাইনি শবদেহের ওপর থেকে নিজেকে টেনে তুলল। গজগজ আর আর্তনাদ করতে করতে সে তখনও তার মশালের কাঁপা কাঁপা আলোয় হামাগুড়ি মেরে সিঁড়ির মাথায় পৌঁছে গেল আর তার মুখের ওপর যে ধূসর চুলের রাশি ঝুলে ছিল তার ফাঁক দিয়ে উঁকি মেরে মশালের আলো ফেলে সিঁড়ির সবচেয়ে নিচের ধাপটির দিকে উঁকি মারল।
এর বাইরে শুধুই অন্ধকার... জ্ঞানহীন এবং অজ্ঞাত।
-------------------
আকুতাগাওয়া রাইউনোসুকে (১৮৯২-১৯২৭) এর জন্ম টোকিওর এক মধ্যবিত্ত পরিবারে। টোকিও ইমপেরিয়াল বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যে পড়াশুনা করেছেন। মাত্র ৩৫ বছর বয়সে আত্মহত্যা করেন। তাকে জাপানী ছোটগল্পের জনক হিসেবে গণ্য করা হয়। তার নামে জাপানের সাহিত্য পুরস্কার আকুতাগাওয়া প্রদান করা হয়।
0 মন্তব্যসমূহ