অনুবাদঃ মোহাম্মদ আসাদুল্লাহ
শুরু থেকেই আমরা প্রস্তুত ছিলাম। আমরা এও জানতাম আমাদের কি করতে হবে। কারণ, ওটাকে আমরা প্রত্যেকেই অন্তত একশত বার করে দেখেছিলাম। শহরের মানুষেরা কাজে যাচ্ছিল। হঠাৎ টেলিভিশনের চলমান অনুষ্ঠানগুলো বন্ধ হয়ে গেল। মানুষেরা ভিড় থেকে উপরের দিকে তাকাল। ছোট্ট একটি বালিকা আকাশের দিকে আঙুল তুলল। বিস্ময়ে সবার মুখ হা হয়ে গেল। কুকুরগুলো সমস্বরে চিৎকার করতে লাগল। পথচারীদের হাত থেকে বাজার করার থলিগুলো রাস্তার উপরে পড়ে গেল। দেখা গেল আকাশের ভেতর থেকে সেটি এগিয়ে আসছে।
শেষ পর্যন্ত ঘটনাটি ঘটেছিল। আমরা সবাই জানতাম ঘটবেই। সুতরাং ভয় ও ঔৎসুক্যের মধ্যেও আমরা নিশ্চিত শান্তভাব খুঁজে পেয়েছিলাম। পারস্পারিক বোঝাপড়া অনুভব করেছিলাম। এগুলোই সেই মূহুর্তে আমাদের প্রয়োজন ছিল।
খবরটি প্রচার করা হয়েছিল সকাল দশটার পরে। টেলিভিশনের সংবাদ পাঠিকাদেরকে আমরা যেরকম আশা করেছিলাম, সেরকমই দেখাচ্ছিল। তাদের জরুরী ভাব এবং মাথার চুলগুলো সুবিন্যস্ত ছিল। আবেগে তাদের কাঁধগুলো মৃদু কাঁপছিল। তারা ভয়ের কথা শোনানোর সাথে সাথে আমাদেরকে আশ্বস্ত করছিলেন এই বলে যে, সবকিছুই নিয়ন্ত্রণে আছে। কারণ তারাও ঘটনাটি ঘটার অপেক্ষায় ছিলেন।
বিষয়টি ছিল তর্কাতীত, কিন্তু মীমাংসাহীন। কিছু একটা আমাদের আকাশমণ্ডলের দিকে ছুটে আসছিল। বিশাল বেগে। পেন্টাগনও ঘনিষ্ঠভাবে বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছিল। আমাদেরকে বলা হচ্ছিল শান্ত থাকতে। ঘরের ভেতরে থাকতে। এবং পরবর্তী নির্দেশাবলীর জন্যে অপেক্ষা করতে। আমাদের কেউ কেউ তাৎক্ষণিকভাবে কাজ ছেড়ে বাড়ির দিকে ছুটেছিল। অন্যেরা টেলিভিশন, রেডিও, কম্পিউটারের পাশে নিবিড় হয়ে বসেছিল। আমরা সবাই মোবাইল ফোনে কথা বলছিলাম। জানালা দিয়ে দেখতে পাচ্ছিলাম অন্য জানালার ভেতর থেকেও সবাই আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। সারা সকাল ধরে আমরা খবরগুলো অনুসরণ করেছিলাম। ভীষণ মনোযোগ সহকারে। শিশুরা যেমনকরে অন্ধকারে বিদ্যুৎ চমকানোর আওয়াজ শুনে থাকে।
জিনিসটা ছিল আমাদের অচেনা। বিজ্ঞানীরা ওটার প্রকৃতি নিরূপণ করতে সক্ষম হননি। শুধু সতর্কতা অবলম্বন করতে বলা হয়েছিল। এবং ভয় না পেতে। আমরা সকলেই উদ্বিগ্ন ছিলাম। আমাদের শরীরের ভেতর দিয়ে তা প্রবাহিত হচ্ছিল। ইঁদুরের মতো। আমরা সকলেই দেখতে চাচ্ছিলাম জিনিসটাকে। তা যাই হোক না কেন তা। সেটি আমাদের দিকেই এগিয়ে আসছিল। আমাদেরকে পছন্দ করে। আকাশের অন্যপিঠ হতে।
বলা হচ্ছিল যে, আমাদের শহর হলো সেটার সম্ভাব্য অবতরণস্থল। টেলিভিশন ক্রুরা দলে দলে আগমন করছিল। আমরা ভাবছিলাম কোথায় ওটা অবতরণ করতে পারে। রাজহাঁসের পুকুর ও পাবলিক পার্কের করাতকলের মধ্যবর্তী স্থানে? নাকি মলের পাশের সেই বিশাল মাঠটিতে, যেখানে নতুন করে খনন কাজ চলছে পুরাতন ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের উপরে নতুন ডিপার্টমেন্টাল স্টোর নির্মাণ করার জন্যে? নাকি মূল সড়কের উপরে? নাকি Mangione’s Pizza and Café উপরের দ্বিতীয় ফ্লোরের এপার্টমেন্টগুলোর উপরে? এমনও হতে পারে যে, মহাসড়কের উপরে আছড়ে পড়তে পারে। তখন আঠার চাকার গাড়িগুলো উল্টে যাবে। বিশাল বিশাল ফুটপাথগুলো তিনকোণা হয়ে উপরের দিকে উঠে যাবে। গাড়িগুলো হঠাত দিক বদলে সিঁড়ির পাশের রেলিং টপকে বাঁধের উপরে আছড়ে পড়বে।
দুপুরের কিছু আগে সেটি আকাশের ভেতরে দেখা গেল। অনেকেই তখন লাঞ্চ করছিলাম। অন্যেরা বাইরে চলে গিয়ে রাস্তা ও ফুটপাতের উপরে দাঁড়িয়েছিল। নিশ্চলভাবে আকাশের দিকে তাকিয়ে। তাদের প্রবল চিৎকার চেঁচামেচি, আকাশের দিকে হাত তোলা ও অগোছালো অঙ্গভঙ্গি দেখা যাচ্ছিল।
নিশ্চিভাবেই আকাশের ভেতরে কিছু একটা জ্বলছিল। গ্রীষ্মের নীল আকাশের ভেতরে। ধিকিধিকি করে। আমরা সবাই সেটাকে স্পষ্ট দেখতে পেয়েছিলাম। অফিসের সেক্রেটারিরা জানালার দিকে দৌড়ে গিয়েছিল। দোকানদাররা ক্যাশ রেজিস্টার ফেলে দ্রুত বাইরে ছুটে গিয়েছিল। কমলা রঙের হ্যাট পরা রাস্তার নির্মাণকর্মীরা পিচের উপর থেকে উপরের দিকে তাকিয়েছিল। দূরবর্তী সেই আলোর আভাটি তিন হতে চার মিনিটকাল স্থায়ী হয়েছিল। তারপর বড় হচ্ছিল। যতক্ষণ পর্যন্ত না তা বাসস্থানের মত বড় ও স্থির হয়। তারপর হঠাৎ করে পুরো আকাশ সোনালী বিন্দুতে ভরে গিয়েছিল, এবং সেটা আমাদের দিকে নেমে আসছিল। মসৃণ পরাগ ও হলুদ ধূলি হিসেবে ছাদের ঢালুতে জমা হচ্ছিল। আমাদের জামার হাতাগুলোকে ও গাড়িগুলোর উপরিভাগকে ঢেকে দিয়েছিল। আমরা বুঝতেই পারছিলাম না এর অর্থ কি হতে পারে।
তের মিনিট ধরে এই হলুদ ধূলিকণাগুলো বর্ষিত হয়েছিল। এই সময়ে আমরা আকাশ দেখতে পাচ্ছিলাম না। তারপর সেটা শেষ হয়ে গেলে সূর্য দেখা দিয়েছিল। আকাশ নীল বর্ণ ধারণ করেছিল। এই পুরো সময়ে আমাদেরকে বলা হয়েছিল ঘরের ভেতরে অবস্থান করতে। সতর্ক থাকতে। পৃথিবীর বাইরে হতে আসা পদার্থগুলো স্পর্শ না করতে। কিন্তু সেটা এতই দ্রুত ঘটে গিয়েছিল যে, আমাদের বেশীর ভাগের জামা ও মাথার উপরে হলুদের আস্তরণ জমে গিয়েছিল।
শেষ পর্যন্ত আমরা আশার বাণী শুনতে পেয়েছিলাম। প্রাথমিক পরীক্ষায় জানা গিয়েছিল যে, কণাগুলো বিষাক্ত নয়। যদিও হলুদ ধুলোগুলোর প্রকৃতি তখনো অজানাই রয়ে গিয়েছিল। পশুরা সেগুলো খেয়ে ফেলেছিল। তাদের ভেতরে কোন বিশেষ উপসর্গ পরিলক্ষিত হয়নি। আমাদেরকে বলা হয়েছিল সেগুলো থেকে দূরে থাকতে। আরও নিরীক্ষার ফলাফলের জন্যে অপেক্ষা করতে। এই সময়ে সেগুলো আমাদের লন, ফুটপাত ও বাসস্থানের সামনে ছড়িয়ে যাচ্ছিল। ম্যাপল গাছ ও টেলিফোনের খুঁটিগুলোকে ঢেকে ফেলেছিল। আমাদেরকে মনে করিয়ে দিয়েছিল প্রথম তুষারপাতের পর সকালবেলায় ভ্রমণের কথা।
ঝুল বারান্দা থেকে আমরা দেখতে পাচ্ছিলাম সুইপারদেরকে ধীরে ধীরে রাস্তার উপরে উঠে আসতে। বিশাল বিশাল কনটেইনারে সেগুলো ভরে নিয়ে তারা চলে যাচ্ছিল। আমরা জলসেচন পাইপ দিয়ে বাসস্থানের সামনের ঘাস, বারান্দার আসবাবপত্র ও ফ্রন্ট ওয়াকগুলো পরিষ্কার করেছিলাম। তারপর আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকে আরও খবরের অপেক্ষা করছিলাম। বিভিন্ন খবরে শুনতে পাচ্ছিলাম যে, পদার্থগুলো এককোষী প্রাণী। এটা জানার পর আমরা হতাশ হয়ে যাচ্ছিলাম।
আমরা চেয়েছিলাম, আমরা চেয়েছিলাম –। জানতাম না যে আমরা কি চেয়েছিলাম। আমরা চেয়েছিলাম রক্ত। গুঁড়িয়ে যাওয়া হাড় ও নিদারুণ যন্ত্রণা। আমরা চেয়েছিলাম বিল্ডিংগুলো ভেঙে পড়ুক সড়কের উপরে। গাড়িগুলো আগুনের উজ্জ্বল শিখা হয়ে বিস্ফোরিত হোক। আমরা চেয়েছিলাম আমাদেরই দৈত্যাকার রূপ। দেখতে চেয়েছিলাম খড়ের মত সরু লম্বা গলার উপরে আমাদের মস্তক। আমরা দেখতে চেয়েছিলাম মৃত্যুর পরোয়ানা হাতে নিষ্ঠুর দয়াহীন রোবট। আমরা চেয়েছিলাম দয়ালু ও কোমল মনের ঈশ্বরদেরকে দেখতে। চেয়েছিলাম ধ্বংসস্তুপের উপরে তারা গৌরবোজ্জ্বল যুগের সূচনা করবেন। চেয়েছিলাম একই সাথে ভয় ও আনন্দ। অথবা এধরনের কিছু। আমরা কখনই হলুদ ধূলিকণা চাইনি। আমরা চেয়েছিলাম বাইরের জগত থেকে কেউ আমাদেরকে আক্রমণ করুক।
সেদিন বিকেলের মধ্যেই আমরা জানতে পেরেছিলাম যে, আমাদের বিজ্ঞানীরা সবাই এটাকে জীবন্ত জীব হিসেবে মেনে নিয়েছেন। নমুনাগুলোকে উড়োজাহাজে করে তারা বোস্টন, ওয়াশিংটন, ডিসি’তে পাঠিয়েছিল। বলা হয়েছিল যে, এগুলো এক-কোষী জীব। এগুলো ক্ষতিকর নয়। আমাদেরকে নিষেধ করা হয়েছিল কোনকিছুকে স্পর্শ না করতে। জানালাগুলোকে বন্ধ রাখতে। সবার হাত ধুয়ে ফেলতে। এই কোষগুলো বাইনারি ফিশন পদ্ধতিতে বংশ বৃদ্ধি করে। তবে সংখ্যাবৃদ্ধি করা ছাড়া তারা কিছুই করে না।
পরেরদিন সকালে আমরা হলুদ ধূলিতে ঢাকা এক পৃথিবীতে জেগে উঠেছিলাম। কাঁটাতারের বেড়ার উপরে, টেলিফোন পোলের ক্রসবারের উপরে ধুলিগুলো জমে ছিল। হলুদ রাস্তাগুলোর উপরে কাল টায়ারের ছাপ দেখা গিয়েছিল। পাখিরা পাখা ঝেড়ে হলুদ গুড়াগুলোকে ছড়াচ্ছিল। আবার রাস্তার সুইপাররা এসেছিল। হোসপাইপ থেকে লন ও ড্রাইভওয়ের উপরে জলের ছিটা দিয়ে হলুদ কুয়াশা সৃষ্টি করেছিল। সেগুলোর নীচ থেকে কাল ও সবুজ খুঁচিয়ে বের করেছিল। মাত্র এক ঘন্টার মধ্যেই ড্রাইভওয়ে ও লনগুলো দেখতে হয়েছিল হলুদ প্রান্তরের মতো। হলুদের রেখা ক্যাবললাইন ও টেলিফোনের তার ধরে দিগন্ত পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল।
জানা গিয়েছিল এই এককোষী জীবগুলো মাইক্রো-অরগানিজম। দেখতে রড-আকৃতির। সালোক-সংশ্লেষণ (photosynthesis) পদ্ধতিতে তারা নিজেদের পুষ্টিসাধন করে থাকে। এই এককোষী জীবকে টেস্ট টিউবের ভেতরে রাখলে উজ্জলভাবে জ্বলতে থাকে। নিজেদেরকে তারা দ্রুত বিভক্ত করে। একটা টিউবকে তারা চল্লিশ মিনিটের ভেতরে ভরে ফেলে। এভাবে ছয় ঘন্টা সময়ের ভেতরে সেটিকে পূর্ণ আলোতে উজ্জ্বল করে দেয়। এই জীবকে আমাদের পরিচিত ক্লাসিফিকেশন সিস্টেমে ফেলা যায় না। যদিও তাদেরকে কিছুটা নীল-সবুজ- শেওলার (blue-green algae) মতো লাগে। তবে কোন প্রমাণই পাওয়া যায়নি যে, তারা মানুষ বা পশুদের কোন ক্ষতি করতে সক্ষম।
আমাদেরকে যারা আক্রমণ করেছিও তারা আসলে কিছুই ছিল না। শূন্যতা ও জড় ধূলি ছাড়া। শুধুমাত্র দ্রুত বংশবৃদ্ধি করতে পারা ছাড়া তাদের আর কোন বৈশিষ্টই ছিল না। তারা আমাদেরকে ঘৃণা করতো না। আমাদের হাতে ধ্বংসপ্রাপ্ত হতে চাইতো না। আমাদের বন্দিজীবন ও অপমানও তারা চাইতো না। এমনকি তারা আমাদেরকে কোন বিপদ থেকেও রক্ষা করতে বা আমাদেরকে অমর জীবনের গোপন কথা শিক্ষা দিতে চাইতো না। তারা চাইতো শুধুমাত্র সংখ্যায় বাড়তে। ভবিষ্যতে হয়ত আমরা এই প্রাচীন ধরণের শত্রুর বিস্তারকে রোধ করতে এবং এক সময়ে সম্পূর্ণরূপে তাদেরকে বিনাশ করতে সমর্থ হতাম। অথবা ব্যর্থও হতে পারতাম। সেক্ষেত্রে আমাদের শহর এক সময়ে তাদের ক্রমবর্ধমান ভয়ঙ্কর সংখ্যার নীচে বিলীন হয়ে যেতো।
প্রতিদিনের রিপোর্ট অনুসরণ করে আমাদের ভেতরে একটা অনুভূতির জন্ম নিচ্ছিল। সেটা হলো আমাদের এমনকিছু করা উচিৎ, যা আমাদেরকে বীরপুরুষে পরিণত করবে। আমাদেরকে রোমাঞ্চকর অনুভূতি দেবে। আমাদের হিংস্রতাকে পরিস্ফুট করে তুলবে। নিয়তির মতো। আমরা নিজেদেরকে কল্পনা করতাম কাত থাকা ধ্বংসপ্রাপ্ত কোন স্পেসশীপের চারদিকে অপেক্ষমাণ অভিযাত্রী হিসেবে। অপেক্ষা করতাম সেটার দরজা খুলে যাওয়ার জন্যে। কল্পনা করতাম যে, আমরা আমাদের সন্তানদের রক্ষা করবো কর্ষিকার (tentacles) আস্ফালন দিয়ে। জানালার ভেতর থেকে সেগুলো নাচছিল।
বাস্তবে আমরা আমাদের ফ্রন্টওয়াকগুলো ঝাড়ু দিতাম। বারান্দাগুলো হোসপাইপের পানি দিয়ে ভেজাতাম। আমাদের জুতো ও স্নিকারগুলোকে প্রদর্শন করতাম। আক্রমণকারীরা আমাদের গৃহের ভেতরে প্রবেশ করতো। টানা শেড ও বন্ধ পর্দা থাকা স্বত্বেও তারা টেবিল ও উইন্ডোসিলের উপরে ঘন আবরণ সৃষ্টি করতো। আমাদের ফ্ল্যাট-স্ক্রিন টেলিভিশন এবং তাকে রাখা ডিভিডির উপরে জমে থাকতো।
জানালার ভেতর দিয়ে আমরা দেখতে পেতাম হলুদ ধূলিতে সবকিছুই ঢেকে আছে। মনে হতো ফসলের মাঠের উপরের দোলায়মান মৃদু ঢেউ। বুঝতে পারতাম যে, সেগুলো ক্রমশ ফুলে উঠছে। ভেজা পাউরুটির মতো। এখানে-সেখানে সূর্যের আলো পড়তো। আমাদেরকে সেগুলো গমক্ষেতের কথা মনে করিয়ে দিতো। বিষয়টা ছিল খুবই প্রশান্তিকর।
খবরটি প্রচার করা হয়েছিল সকাল দশটার পরে। টেলিভিশনের সংবাদ পাঠিকাদেরকে আমরা যেরকম আশা করেছিলাম, সেরকমই দেখাচ্ছিল। তাদের জরুরী ভাব এবং মাথার চুলগুলো সুবিন্যস্ত ছিল। আবেগে তাদের কাঁধগুলো মৃদু কাঁপছিল। তারা ভয়ের কথা শোনানোর সাথে সাথে আমাদেরকে আশ্বস্ত করছিলেন এই বলে যে, সবকিছুই নিয়ন্ত্রণে আছে। কারণ তারাও ঘটনাটি ঘটার অপেক্ষায় ছিলেন।
বিষয়টি ছিল তর্কাতীত, কিন্তু মীমাংসাহীন। কিছু একটা আমাদের আকাশমণ্ডলের দিকে ছুটে আসছিল। বিশাল বেগে। পেন্টাগনও ঘনিষ্ঠভাবে বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছিল। আমাদেরকে বলা হচ্ছিল শান্ত থাকতে। ঘরের ভেতরে থাকতে। এবং পরবর্তী নির্দেশাবলীর জন্যে অপেক্ষা করতে। আমাদের কেউ কেউ তাৎক্ষণিকভাবে কাজ ছেড়ে বাড়ির দিকে ছুটেছিল। অন্যেরা টেলিভিশন, রেডিও, কম্পিউটারের পাশে নিবিড় হয়ে বসেছিল। আমরা সবাই মোবাইল ফোনে কথা বলছিলাম। জানালা দিয়ে দেখতে পাচ্ছিলাম অন্য জানালার ভেতর থেকেও সবাই আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। সারা সকাল ধরে আমরা খবরগুলো অনুসরণ করেছিলাম। ভীষণ মনোযোগ সহকারে। শিশুরা যেমনকরে অন্ধকারে বিদ্যুৎ চমকানোর আওয়াজ শুনে থাকে।
জিনিসটা ছিল আমাদের অচেনা। বিজ্ঞানীরা ওটার প্রকৃতি নিরূপণ করতে সক্ষম হননি। শুধু সতর্কতা অবলম্বন করতে বলা হয়েছিল। এবং ভয় না পেতে। আমরা সকলেই উদ্বিগ্ন ছিলাম। আমাদের শরীরের ভেতর দিয়ে তা প্রবাহিত হচ্ছিল। ইঁদুরের মতো। আমরা সকলেই দেখতে চাচ্ছিলাম জিনিসটাকে। তা যাই হোক না কেন তা। সেটি আমাদের দিকেই এগিয়ে আসছিল। আমাদেরকে পছন্দ করে। আকাশের অন্যপিঠ হতে।
বলা হচ্ছিল যে, আমাদের শহর হলো সেটার সম্ভাব্য অবতরণস্থল। টেলিভিশন ক্রুরা দলে দলে আগমন করছিল। আমরা ভাবছিলাম কোথায় ওটা অবতরণ করতে পারে। রাজহাঁসের পুকুর ও পাবলিক পার্কের করাতকলের মধ্যবর্তী স্থানে? নাকি মলের পাশের সেই বিশাল মাঠটিতে, যেখানে নতুন করে খনন কাজ চলছে পুরাতন ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের উপরে নতুন ডিপার্টমেন্টাল স্টোর নির্মাণ করার জন্যে? নাকি মূল সড়কের উপরে? নাকি Mangione’s Pizza and Café উপরের দ্বিতীয় ফ্লোরের এপার্টমেন্টগুলোর উপরে? এমনও হতে পারে যে, মহাসড়কের উপরে আছড়ে পড়তে পারে। তখন আঠার চাকার গাড়িগুলো উল্টে যাবে। বিশাল বিশাল ফুটপাথগুলো তিনকোণা হয়ে উপরের দিকে উঠে যাবে। গাড়িগুলো হঠাত দিক বদলে সিঁড়ির পাশের রেলিং টপকে বাঁধের উপরে আছড়ে পড়বে।
দুপুরের কিছু আগে সেটি আকাশের ভেতরে দেখা গেল। অনেকেই তখন লাঞ্চ করছিলাম। অন্যেরা বাইরে চলে গিয়ে রাস্তা ও ফুটপাতের উপরে দাঁড়িয়েছিল। নিশ্চলভাবে আকাশের দিকে তাকিয়ে। তাদের প্রবল চিৎকার চেঁচামেচি, আকাশের দিকে হাত তোলা ও অগোছালো অঙ্গভঙ্গি দেখা যাচ্ছিল।
নিশ্চিভাবেই আকাশের ভেতরে কিছু একটা জ্বলছিল। গ্রীষ্মের নীল আকাশের ভেতরে। ধিকিধিকি করে। আমরা সবাই সেটাকে স্পষ্ট দেখতে পেয়েছিলাম। অফিসের সেক্রেটারিরা জানালার দিকে দৌড়ে গিয়েছিল। দোকানদাররা ক্যাশ রেজিস্টার ফেলে দ্রুত বাইরে ছুটে গিয়েছিল। কমলা রঙের হ্যাট পরা রাস্তার নির্মাণকর্মীরা পিচের উপর থেকে উপরের দিকে তাকিয়েছিল। দূরবর্তী সেই আলোর আভাটি তিন হতে চার মিনিটকাল স্থায়ী হয়েছিল। তারপর বড় হচ্ছিল। যতক্ষণ পর্যন্ত না তা বাসস্থানের মত বড় ও স্থির হয়। তারপর হঠাৎ করে পুরো আকাশ সোনালী বিন্দুতে ভরে গিয়েছিল, এবং সেটা আমাদের দিকে নেমে আসছিল। মসৃণ পরাগ ও হলুদ ধূলি হিসেবে ছাদের ঢালুতে জমা হচ্ছিল। আমাদের জামার হাতাগুলোকে ও গাড়িগুলোর উপরিভাগকে ঢেকে দিয়েছিল। আমরা বুঝতেই পারছিলাম না এর অর্থ কি হতে পারে।
তের মিনিট ধরে এই হলুদ ধূলিকণাগুলো বর্ষিত হয়েছিল। এই সময়ে আমরা আকাশ দেখতে পাচ্ছিলাম না। তারপর সেটা শেষ হয়ে গেলে সূর্য দেখা দিয়েছিল। আকাশ নীল বর্ণ ধারণ করেছিল। এই পুরো সময়ে আমাদেরকে বলা হয়েছিল ঘরের ভেতরে অবস্থান করতে। সতর্ক থাকতে। পৃথিবীর বাইরে হতে আসা পদার্থগুলো স্পর্শ না করতে। কিন্তু সেটা এতই দ্রুত ঘটে গিয়েছিল যে, আমাদের বেশীর ভাগের জামা ও মাথার উপরে হলুদের আস্তরণ জমে গিয়েছিল।
শেষ পর্যন্ত আমরা আশার বাণী শুনতে পেয়েছিলাম। প্রাথমিক পরীক্ষায় জানা গিয়েছিল যে, কণাগুলো বিষাক্ত নয়। যদিও হলুদ ধুলোগুলোর প্রকৃতি তখনো অজানাই রয়ে গিয়েছিল। পশুরা সেগুলো খেয়ে ফেলেছিল। তাদের ভেতরে কোন বিশেষ উপসর্গ পরিলক্ষিত হয়নি। আমাদেরকে বলা হয়েছিল সেগুলো থেকে দূরে থাকতে। আরও নিরীক্ষার ফলাফলের জন্যে অপেক্ষা করতে। এই সময়ে সেগুলো আমাদের লন, ফুটপাত ও বাসস্থানের সামনে ছড়িয়ে যাচ্ছিল। ম্যাপল গাছ ও টেলিফোনের খুঁটিগুলোকে ঢেকে ফেলেছিল। আমাদেরকে মনে করিয়ে দিয়েছিল প্রথম তুষারপাতের পর সকালবেলায় ভ্রমণের কথা।
ঝুল বারান্দা থেকে আমরা দেখতে পাচ্ছিলাম সুইপারদেরকে ধীরে ধীরে রাস্তার উপরে উঠে আসতে। বিশাল বিশাল কনটেইনারে সেগুলো ভরে নিয়ে তারা চলে যাচ্ছিল। আমরা জলসেচন পাইপ দিয়ে বাসস্থানের সামনের ঘাস, বারান্দার আসবাবপত্র ও ফ্রন্ট ওয়াকগুলো পরিষ্কার করেছিলাম। তারপর আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকে আরও খবরের অপেক্ষা করছিলাম। বিভিন্ন খবরে শুনতে পাচ্ছিলাম যে, পদার্থগুলো এককোষী প্রাণী। এটা জানার পর আমরা হতাশ হয়ে যাচ্ছিলাম।
আমরা চেয়েছিলাম, আমরা চেয়েছিলাম –। জানতাম না যে আমরা কি চেয়েছিলাম। আমরা চেয়েছিলাম রক্ত। গুঁড়িয়ে যাওয়া হাড় ও নিদারুণ যন্ত্রণা। আমরা চেয়েছিলাম বিল্ডিংগুলো ভেঙে পড়ুক সড়কের উপরে। গাড়িগুলো আগুনের উজ্জ্বল শিখা হয়ে বিস্ফোরিত হোক। আমরা চেয়েছিলাম আমাদেরই দৈত্যাকার রূপ। দেখতে চেয়েছিলাম খড়ের মত সরু লম্বা গলার উপরে আমাদের মস্তক। আমরা দেখতে চেয়েছিলাম মৃত্যুর পরোয়ানা হাতে নিষ্ঠুর দয়াহীন রোবট। আমরা চেয়েছিলাম দয়ালু ও কোমল মনের ঈশ্বরদেরকে দেখতে। চেয়েছিলাম ধ্বংসস্তুপের উপরে তারা গৌরবোজ্জ্বল যুগের সূচনা করবেন। চেয়েছিলাম একই সাথে ভয় ও আনন্দ। অথবা এধরনের কিছু। আমরা কখনই হলুদ ধূলিকণা চাইনি। আমরা চেয়েছিলাম বাইরের জগত থেকে কেউ আমাদেরকে আক্রমণ করুক।
সেদিন বিকেলের মধ্যেই আমরা জানতে পেরেছিলাম যে, আমাদের বিজ্ঞানীরা সবাই এটাকে জীবন্ত জীব হিসেবে মেনে নিয়েছেন। নমুনাগুলোকে উড়োজাহাজে করে তারা বোস্টন, ওয়াশিংটন, ডিসি’তে পাঠিয়েছিল। বলা হয়েছিল যে, এগুলো এক-কোষী জীব। এগুলো ক্ষতিকর নয়। আমাদেরকে নিষেধ করা হয়েছিল কোনকিছুকে স্পর্শ না করতে। জানালাগুলোকে বন্ধ রাখতে। সবার হাত ধুয়ে ফেলতে। এই কোষগুলো বাইনারি ফিশন পদ্ধতিতে বংশ বৃদ্ধি করে। তবে সংখ্যাবৃদ্ধি করা ছাড়া তারা কিছুই করে না।
পরেরদিন সকালে আমরা হলুদ ধূলিতে ঢাকা এক পৃথিবীতে জেগে উঠেছিলাম। কাঁটাতারের বেড়ার উপরে, টেলিফোন পোলের ক্রসবারের উপরে ধুলিগুলো জমে ছিল। হলুদ রাস্তাগুলোর উপরে কাল টায়ারের ছাপ দেখা গিয়েছিল। পাখিরা পাখা ঝেড়ে হলুদ গুড়াগুলোকে ছড়াচ্ছিল। আবার রাস্তার সুইপাররা এসেছিল। হোসপাইপ থেকে লন ও ড্রাইভওয়ের উপরে জলের ছিটা দিয়ে হলুদ কুয়াশা সৃষ্টি করেছিল। সেগুলোর নীচ থেকে কাল ও সবুজ খুঁচিয়ে বের করেছিল। মাত্র এক ঘন্টার মধ্যেই ড্রাইভওয়ে ও লনগুলো দেখতে হয়েছিল হলুদ প্রান্তরের মতো। হলুদের রেখা ক্যাবললাইন ও টেলিফোনের তার ধরে দিগন্ত পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল।
জানা গিয়েছিল এই এককোষী জীবগুলো মাইক্রো-অরগানিজম। দেখতে রড-আকৃতির। সালোক-সংশ্লেষণ (photosynthesis) পদ্ধতিতে তারা নিজেদের পুষ্টিসাধন করে থাকে। এই এককোষী জীবকে টেস্ট টিউবের ভেতরে রাখলে উজ্জলভাবে জ্বলতে থাকে। নিজেদেরকে তারা দ্রুত বিভক্ত করে। একটা টিউবকে তারা চল্লিশ মিনিটের ভেতরে ভরে ফেলে। এভাবে ছয় ঘন্টা সময়ের ভেতরে সেটিকে পূর্ণ আলোতে উজ্জ্বল করে দেয়। এই জীবকে আমাদের পরিচিত ক্লাসিফিকেশন সিস্টেমে ফেলা যায় না। যদিও তাদেরকে কিছুটা নীল-সবুজ- শেওলার (blue-green algae) মতো লাগে। তবে কোন প্রমাণই পাওয়া যায়নি যে, তারা মানুষ বা পশুদের কোন ক্ষতি করতে সক্ষম।
আমাদেরকে যারা আক্রমণ করেছিও তারা আসলে কিছুই ছিল না। শূন্যতা ও জড় ধূলি ছাড়া। শুধুমাত্র দ্রুত বংশবৃদ্ধি করতে পারা ছাড়া তাদের আর কোন বৈশিষ্টই ছিল না। তারা আমাদেরকে ঘৃণা করতো না। আমাদের হাতে ধ্বংসপ্রাপ্ত হতে চাইতো না। আমাদের বন্দিজীবন ও অপমানও তারা চাইতো না। এমনকি তারা আমাদেরকে কোন বিপদ থেকেও রক্ষা করতে বা আমাদেরকে অমর জীবনের গোপন কথা শিক্ষা দিতে চাইতো না। তারা চাইতো শুধুমাত্র সংখ্যায় বাড়তে। ভবিষ্যতে হয়ত আমরা এই প্রাচীন ধরণের শত্রুর বিস্তারকে রোধ করতে এবং এক সময়ে সম্পূর্ণরূপে তাদেরকে বিনাশ করতে সমর্থ হতাম। অথবা ব্যর্থও হতে পারতাম। সেক্ষেত্রে আমাদের শহর এক সময়ে তাদের ক্রমবর্ধমান ভয়ঙ্কর সংখ্যার নীচে বিলীন হয়ে যেতো।
প্রতিদিনের রিপোর্ট অনুসরণ করে আমাদের ভেতরে একটা অনুভূতির জন্ম নিচ্ছিল। সেটা হলো আমাদের এমনকিছু করা উচিৎ, যা আমাদেরকে বীরপুরুষে পরিণত করবে। আমাদেরকে রোমাঞ্চকর অনুভূতি দেবে। আমাদের হিংস্রতাকে পরিস্ফুট করে তুলবে। নিয়তির মতো। আমরা নিজেদেরকে কল্পনা করতাম কাত থাকা ধ্বংসপ্রাপ্ত কোন স্পেসশীপের চারদিকে অপেক্ষমাণ অভিযাত্রী হিসেবে। অপেক্ষা করতাম সেটার দরজা খুলে যাওয়ার জন্যে। কল্পনা করতাম যে, আমরা আমাদের সন্তানদের রক্ষা করবো কর্ষিকার (tentacles) আস্ফালন দিয়ে। জানালার ভেতর থেকে সেগুলো নাচছিল।
বাস্তবে আমরা আমাদের ফ্রন্টওয়াকগুলো ঝাড়ু দিতাম। বারান্দাগুলো হোসপাইপের পানি দিয়ে ভেজাতাম। আমাদের জুতো ও স্নিকারগুলোকে প্রদর্শন করতাম। আক্রমণকারীরা আমাদের গৃহের ভেতরে প্রবেশ করতো। টানা শেড ও বন্ধ পর্দা থাকা স্বত্বেও তারা টেবিল ও উইন্ডোসিলের উপরে ঘন আবরণ সৃষ্টি করতো। আমাদের ফ্ল্যাট-স্ক্রিন টেলিভিশন এবং তাকে রাখা ডিভিডির উপরে জমে থাকতো।
জানালার ভেতর দিয়ে আমরা দেখতে পেতাম হলুদ ধূলিতে সবকিছুই ঢেকে আছে। মনে হতো ফসলের মাঠের উপরের দোলায়মান মৃদু ঢেউ। বুঝতে পারতাম যে, সেগুলো ক্রমশ ফুলে উঠছে। ভেজা পাউরুটির মতো। এখানে-সেখানে সূর্যের আলো পড়তো। আমাদেরকে সেগুলো গমক্ষেতের কথা মনে করিয়ে দিতো। বিষয়টা ছিল খুবই প্রশান্তিকর।
--------------
0 মন্তব্যসমূহ