ফজল হাসানের অনুবাদে চার ফিলিস্তিনি লেখকের গল্প

 

সে তার পা নিজ হাতে বহন করেছে
মুল: আলম জেদান

সেদিন ছিল ২০০৯ সালের ১৪ জানুয়ারি। টেলিফোনে যখন রিং হয়, তখন সে কাজে ছিল। ইজরায়েলি সৈন্যরা গাজা শহরের আল-মাক্কুসি উঁচু ভবনের বাসিন্দাদের ঘেরাও করেছিল এবং কেউ তাদের উদ্ধার করবে, এমন আশায় পুরো ভবনের বাসিন্দারা মরিয়া হয়ে উঠেছিল। তখন আমার ভাই জাবালইয়ার অগ্নি নির্বাপক অফিসের দায়িত্বে ছিল, কিন্তু তার কাছে অনুরোধ এসেছিল অন্য জায়গা থেকে। তাকে একটা সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল; হয় ভবনের বাসিন্দাদের জীবন বাঁচাবে, নতুবা অফিসে তার টেবিলের পিছনে বসে নিহতদের সংবাদের জন্য অপেক্ষা করবে। সে জীবন বাঁচাতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।

আমার ভাই মোহাম্মদ মা ছাড়া বড় হয়েছে। তার বয়স যখন নয় বছর, তখন মা মারা যান। এখন মোহাম্মদের বয়স আটাশ বছর। একসময় সে ছিল হাস্যরসাত্মক, ভবঘুরে ... মাঝে মাঝে ভীষণ বিরক্তিকরও ছিল। কিন্তু সে অবশ্যই একজন মানুষ ছিল। তার একটা মাথা, দুই পা, দুই হাত এবং একজন স্ত্রী ছিল। মোহাম্মদের জীবনের একমাত্র ভালোবাসা ছিল তার স্ত্রী। বিয়ে করার আগে আমার ভাই মধ্যরাতে (যখন কেউ দেখবে না) হবু স্ত্রীকে ফোন করতো। তার জন্য মাসের শেষে অনেক বেশি ফোনের বিল পরিশোধ করতে রীতিমতো আমার বাবাকে বাধ্য করা হতো।

কুড়ি বছর বয়সে মোহাম্মদ বিয়ে করে, তখন তার স্ত্রীর বয়স পনের। কিন্তু তাদের কোন সন্তানাদি নেই। সবচেয়ে খারাপ বিষয় যা মোহাম্মদের হৃদয়কে ভেঙেচুরে তছনছ করে দেয়, তাহলো সে যখন দেখে একই সময়ে যারা বিয়ে করেছিল, তাদের ছেলেমেয়ে আছে। সিভিল ডিফেন্স টিমে যোগদান করার আগে সে একজন দর্জি ছিল। তার আয় সে কাপড়চোপড় এবং সিগারেটের পেছনে ব্যয় করতো। স্ত্রীকে অথবা বা ঘনিষ্ট বন্ধুদের নিয়ে সারা রাত বাইরে কাটাতো। বাবা প্রায়ই আমার ভাইয়ের ওপর রুষ্ট হতেন। অথচ একসময় বাবা নিজেও খুব দুষ্ট ছিলেন। বাবার সঙ্গে মোহাম্মদের কখনই ভালো সম্পর্ক ছিল না।

তারপর একদিন মোহাম্মদ সিভিল ডিফেন্সে চাকুরী লাভ করে এবং তখন থেকেই তার জীবন অনেক বদলে যায়।

যে রাতে ইজরায়েলি কর্তৃপক্ষ ‘অপারেশন কাস্ট লীড’১ আগ্রাসন চালিয়েছিল, সেই দুর্ভাগ্যজনক রাতে মোহাম্মদ ফোন কল পেয়ে দলবল নিয়ে উদ্ধার কাজে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তবে সময়ের স্বল্পতার জন্য সে অগ্নি নির্বাপক অফিসের নিকটতম সহকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেনি। গাজা স্ট্রিপের বেশির ভাগ এলাকায় যোগাযোগের কোন লাইন সচল ছিল না। গাজা প্রদেশের উত্তর-পশ্চিম এলাকায় অবস্থিত চৌদ্দ তলা ভবনে ইজরায়েলিরা বোমা বর্ষণ করেছে। মোহাম্মদ অগ্নি নির্বাপক গাড়ি চালিয়েছিল এবং তার রূপালি রঙের নতুন পোশাক পড়ে রীতিমতো তড়িঘড়ি করে ভবনে পৌঁছে। দলের লোকজন ভবনের সপ্তম তলার আগুন নিভায় এবং তারপর তারা জলদি করে এগারোতম তলার বাসিন্দাদের উদ্ধার করতে যায়। একজন পুরুষ এবং একজন মহিলা সিমেন্টের মেঝের ওপর পড়েছিল, কিন্তু যে সময় সেখানে উদ্ধার কর্মীরা পৌঁছেছে, তার আগেই সেই দু’জন মারা যায়। মোহাম্মদ এবং তার দু’জন সহকর্মী, হোশাম এবং বাহা, মৃতদেহ ঢেকে দেয় এবং সেখান থেকে সরিয়ে নেয়।

‘আচমকা বিদ্যু চলে যায়,’ মোহাম্মদ স্মরণ করতে পারে। ‘আমি বুঝতে পারিনি কি ঘটেছে। কিছু সময়ের জন্য ভেবেছিলাম আমি বেঁচে আছি, নাকি মরে গেছি। বাবাকে মনে পড়েছিল। আমি চাইনি শত্রু হিসেবে আমার জীবন এভাবে শেষ হোক। বাবাকে খুশি করার জন্য আমি আরেকটা দিন বাঁচতে চাই। আমি দাঁড়াতে চেষ্টা করি, কিন্তু পারিনি। আমি বুঝতে পেরেছি যে, আমার পা জখম হয়েছে। কিছুক্ষণ পরে আমি শুনতে পেয়েছি একজন প্যারামেডিক চিৎকার করছে এবং জানতে চেয়েছে কেউ জীবিত ছিল কি না। আমি তাকে জোর দিয়ে অনুরোধ করেছি যে, সে যেন একটা খাঁটিয়া নিয়ে আসে, কিন্তু সে আমার কথা শোনেনি। আমি খুব রেগে গিয়েছিলাম। আমার পা দেওয়ালে আঘাত করছিল, তাই আমি নিচে থেকে সেটা ধরে রেখেছি। দুই তলা নিচে পারামেডিক আমার জন্য খাঁটিয়া নিয়ে এসেছিল। তারপর প্যারামেডিকের আরো লোকজন আসে এবং আমাকে খাঁটিয়ায় তুলে অ্যাম্বুলেন্সে নিয়ে যায় ।

শুভ্র বসনে দেবদূতরা। মোহাম্মদ ভুলে গেছে যে, সে আহত। সে ভেবেছিল স্বর্গে আছে, কিন্তু তার সেই ভাবনা ছিল ভুল। বরং সে আল-শিফা হাসপাতালের জরুরী বিভাগে শুয়ে আছে। তার কাছে ডাক্তাররাই দেবদূত। সে কল্পনায় যে লাল ফল এবং তরল পর্দাথ দেখেছিল, আসলে তা ছিল তার নিজের এবং বন্ধুদের রক্ত।

মোহাম্মদ অল্প সময়ের মধ্যেই উপলব্ধি করেছে যে, তার আহত পা কেটে ফেলা হয়েছে। তার কাছে মনে হয়েছে সেখানেই জীবনের সমাপ্তি। আগে সে যেই মানুষ ছিল, এখন থেকে তা থাকবে না। ইজরায়েলি সৈন্যদের বোমা হামলায় তিনজন সহকর্মী এবং একজন ক্যামেরাম্যান আহত হয়েছে। একটা বাচ্চা ছেলে ও একটা বাচ্চা মেয়ের বাবা হোশাম আল-খোলি তার ডান পা হারিয়েছে। অন্যদিকে বাহা আল-তৌলি তার উভয় পা হারিয়েছে। মোহাম্মদের স্বীকার করতেই হবে যে, সে এখন থেকে একজন প্রতিবন্ধী ছাড়া আর কিছুই নয়। লোকজন করুণার দৃষ্টিতে দেখবে এবং তারপর সহানুভূতির সঙ্গে মিষ্টি কথা বলবে। এটা সে পছন্দ করেনি। সে এই জীবন চায়নি।

আমার মনে আছে, আমাদের বড় বোন হাসপাতালে মোহাম্মদের বিছানার পাশে বসেছিলেন এবং তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন আর দোয়া করছিলেন যেন সে সুস্থ হয়ে ওঠে। একমাত্র মোহাম্মদের বিড়াল তার মুখে হাসি ফোটাতে পেরেছিল। আমার ভাই বিড়াল অত্যন্ত ভালোবাসে এবং সে তার বিড়ালকে হাসপাতালে নিয়ে আসার জন্য বলেছিল। টমটম তাকে কয়েক বার দেখতে গিয়েছিল।

হাসপাতালে ঔষধপত্রের স্বল্পতা এবং আহত অনেক লোকের আগমনের জন্য মোহাম্মদের যে ধরনের চিকিৎসার প্রয়োজন ছিল, তা সে পায়নি। তাই তাকে অন্যত্র মিশরীয় এক হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল। ‘অপারেশন কাস্ট লীড’-এর সময়ে ফিলিস্তিনি আহতদের জন্য রাফাহর সীমান্ত খোলা ছিল। সেখানে সে চার মাস কাটিয়েছে। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার সময় কর্তৃপক্ষ উপহার হিসেবে তাকে একটা কৃত্রিম পা দিয়েছে। আমি কখনই তাকে সেই কৃত্রিম পা ব্যবহার করতে দেখিনি। বরং সে ক্রাচ ব্যবহার করেছে।

মোহাম্মদ যখন বাড়ি ফিরে আসে, তখন সে বারবার নিজেকে জিজ্ঞেস করেছে কেন ইজরায়েলিরা তাকে হত্যা করেনি এবং কেন সবকিছু শেষ করে দেয়নি। কিন্তু তারপর তার মনে পরে সেই মুহূর্তের কথা, যখন সে তার পা হাতে বহন করেছে। মানুষের জীবন বাঁচানোর চেষ্টার জন্য সে মোটেও অনুতপ্ত নয়।

আমার ভাই সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, ইজরায়েলিরা তার সঙ্গে যাই করুক না কেন, সে মোহাম্মদ হিসেবে বেঁচে থাকবে। সে সিভিল ডিফেন্স ডিপার্টমেন্টে যোগ দিতে চায়, কিন্তু কর্তৃপক্ষ তাকে যোগ্য হিসেবে গণনা করেনি। তার মনের জোর নিয়ে কোন অসুবিধা নেই, তারপরও কর্তৃপক্ষ তাকে আগের চাকুরীতে ফিরে যেতে দেয়নি।

মোহাম্মদ অল্প সময়ের মধ্যে সোফা বানানোর কাজ শেখার জন্য ছয় মাসের কোর্সে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পায়। সে সুযোগটা হাতছাড়া করেনি, বরং রীতিমতো লুফে নিয়েছে। সে তার জীবন থেকে ‘প্রতিবন্ধী’ শব্দটি মুছে ফেলতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল। দর্জির কাজে সে তার দক্ষতা ব্যবহার করে এবং সে তার ছোট বাড়িতে সোফা তৈরি করতে শুরু করেছিল। সবাই তার কাজ পছন্দ করতো। জীবনে প্রথমবারের মত আমার বাবা মোহাম্মদের জন্য গর্ব অনুভব করেন। মনে হচ্ছে যে, আমার বাবা সত্যিই তার ছেলের কাছ থেকে একটা জিনিসই চেয়েছিলেন এবং তা ছিল স্বপ্নদ্রষ্টা, বিশ্বাসী আর একজন অর্জনকারী। মোহাম্মদ এখন গাজার একটি বড় আসবাবপত্র কোম্পানিতে কাজ করে। অবশ্যই নিজের একটি কোম্পানি স্থাপন করা মোহাম্মদের আরেকটি স্বপ্ন ।

এত বড় আঘাত সত্ত্বেও এবং সেই বিপদের পর মোহাম্মদ বেঁচে আছে, সে এখনো একজন মানুষ।

এবং হ্যাঁ, তার এক মাথা, এক পা আর দুই হাত আছে।
 
-------------


[পাদটীকা: মূল গল্পে ‘অপারেশন কাস্ট লীড’-এর ব্যাখ্যা নেই, কিন্তু পাঠক/পাঠিকাদের সুবিধার্থে দেওয়া হলো - অনুবাদক। 

‘অপারেশন কাস্ট লীড’, যা ‘গাজা গণহত্যা’ নামে পরিচিত, গাজা ভূখণ্ডে (স্ট্রিপে) ফিলিস্তিনি আধা-সামরিক বাহিনী এবং ইজরায়েল প্রতিরক্ষা বাহিনীর মধ্যে তিন সপ্তাহ (২৭ ডিসেম্বর ২০০৮ - ১৮ জানুয়ারি ২০০৯) সশস্ত্র যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। ইজরায়েলি এবং ফিলিস্তিনিদের মধ্যে সেই সামরিক হামলার হিংস্রতা নজিরবিহীন এবং প্রায় ১৪০০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে, যাদের বেশীর ভাগই ছিল বেসামরিক নাগরিক।]

লেখক পরিচিতি: ফিলিস্তিনের নতুন প্রজন্মের প্রতিভাবান ছোটগল্প লেখক, সম্পাদক এবং ফ্রিল্যান্স অনুবাদক আলম জেদানের জন্ম গাজার জাবালইয়া শরণার্থী শিবিরে, ১৯৯০ সালে। তাঁর আসল নিবাস আল-মাসমিয়া আল-কাবিরাহ গ্রামে। তিনি ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব গাজা থেকে পেশাদারী অনুবাদে উচ্চতর ডিপ্লোমা এবং আরবী ভাষায় ব্যাচেলার ডিগ্রী অর্জণ করেন। তিনি আরবী, ইংরেজি এবং হিব্রু ভাষায় পারদর্শী। তাঁর একাধিক গল্প ‘We Are Not Numbers’ ওয়েবসাইটে (https://wearenotnumbers.org) প্রকাশিত হয়েছে।

গল্পসূত্র: ‘সে তার পা হাতে বহন করেছে’ গল্পটি আলম জেদানের ইংরেজিতে ‘হি ক্যারিড হিজ লেগ ইন হিজ হ্যান্ড’ গল্পের অনুবাদ। গল্পটি ‘We Are Not Numbers’ ওয়েবসাইটে (https://wearenotnumbers.org) ২০১৫ সালের ৭ জুন প্রকাশিত হয় এবং সেখান থেকে নেওয়া হয়েছে।
 
-------------------
 

 

লকডাউনে এক রাত

মূল: ইসরা মোহাম্মেদ জামাল


আকাশ ভরা অসংখ্য তারা এবং আকাশের বুকে ভেসে আছে প্রায় পরিপূর্ণ একখানি চাঁদ। বাতাস এতটাই আর্দ্র যে, আমার মনে হচ্ছিল আমি ছুরি দিয়ে কাটতে পারি। আমি কিছুক্ষণের জন্য এই মনোমুগ্ধকর দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে থাকি। একটা খুবই ছোট তারা মিটমিট করে জ্বলছিল এবং দ্রুত গতিতে নড়াচড়া করছিল। একটু পরেই সেই তারাটির পতন হয় এবং নিমিষে হারিয়ে যায়।

আমার মনে হয়েছিল ওটা একটা যাত্রীবাহী বিমান, ইজরায়েলি বিমান নয় এবং আমি চেয়েছিলাম খসে পড়া তারাটি   যাত্রীদের একজন হোক। 

আমার বয়স চৌত্রিশ বছর, আমি কখনো উড়োজাহাজে চড়িনি। আমি আশ্চার্যান্বিত হয়ে ভাবছি। আকাশে উঠতে কেমন লাগে? জানালা দিয়ে আমার অনেক নিচের পৃথিবীটা দেখতে কেমন লাগবে? আমি আশা করি, তখন ইজরায়েলি অবরোধ থেকে মুক্ত হবো এবং একদিন এই অভিজ্ঞতা অর্জন করবো।

‏বিদ্যুৎ চলে গেছে - পুনরায়, যথারীতি। আক্ষরিক অর্থে মনে হচ্ছে যে, তীব্র গরমে আমার বাড়ির ভেতরটা এক্ষুণি ফুটতে শুরু করবে। আমার সাত জনের পরিবার (আমার স্বামী এবং পাঁচ সন্তান, যাদের বয়স বারো থেকে চার বছর)। বিদ্যুৎ এবং পাখা ঘুরতে থাকলেও তারা কেউ গরম সহ্য করতে পারে না। জ্বালানী আমদানির ওপর ইজরায়েলি নিষেধাজ্ঞার কারণে আমরা দিনে মাত্র চার ঘন্টার জন্য বিদ্যুৎ পাই, অর্থাৎ মোদ্দা কথা হলো এই স্বল্প সময়ে আমরা সাধারণত বৈদ্যুতিক পাখা চালাতে পারি না। মনে হয় পুরো বাড়ি একটা উনুন। এছাড়া বাড়িতে পর্যাপ্ত পানি থাকে না। তাই যখনই আমরা গোসল করে সতেজ হতে চাই, তখন সেটাও করতে পারি না।

সুতরাং আমরা বাইরের বাগানে সময় কাটাই, সূর্যমুখী বীজ চিবিয়ে খাই এবং গাজা এলাকা জুড়ে কোভিড-১৯ এর জন্য ইতিবাচক পরীক্ষা করা ক্রমবর্ধমান মানুষের সংখ্যা নিয়ে খোশগল্প করি।

সেদিন বিকেলে আমরা এমন এক ব্যক্তির হৃদয়বিদারক সংবাদ পড়েছিলাম, যিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে কাজ করেন এবং বর্তমানে তিনি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। তিনি ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেন, ‘আমি ইজরায়েলি যুদ্ধ এবং গাজায় অবরোধের সবচেয়ে খারাপ দিনগুলোতে কাজ করেছি এবং আমি অন্যদের সাহায্য করার ঝুঁকি নিতে কখনও দ্বিধা করিনি।' এখন ভদ্রলোক একটা কোয়ারেন্টাইন কেন্দ্রে বন্দী হয়ে আছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন যে, এই ভাইরাসে সংক্রমিত লোকজনের কাছ থেকে তিনি অভিযোগ শুনেছেন এবং ভেবেছিলেন তারা বাড়াবাড়ি করেছে। কিন্তু এখন তিনি আবিষ্কার করেছেন যে, লোকগুলো সঠিক ছিল । ভদ্রলোক আরো লিখেছেন, কোয়ারেন্টাইন কেন্দ্রের কক্ষগুলো ছোট এবং সেই জায়গার খাবার খারাপ।

তবে সবচেয়ে খারাপ দিক হলো যে, ভদ্রলোকের ছোট্ট ছেলেটাও পরীক্ষায় ধরা পড়েছে যে, সে ভাইরাসে আক্রান্ত। আমরা ছেলেটির একটি ভিডিও দেখেছি (আমার মনে হয়েছে ওর বয়স প্রায় ছয় বছর)। ছেলেটির পড়নে শর্টস, গায়ে টি-শার্ট এবং পিঠে একটি ছোট ব্যাকপ্যাক। অ্যাম্বুলেন্সের দিকে হেঁটে যাওয়ার সময় সে কাঁদছিল। সেই সময় আমরা একজন মহিলারও কান্না শুনতে পেয়েছি। আমার মনে হয়েছে, তিনি ছেলেটির মা। একজন লোকের কণ্ঠস্বর ছেলেটিকে বললো, ‘তুমি তোমার বাবার কাছে যাচ্ছো।’ আমরা ছেলেটির কথা এবং সেখানে সে কি ধরণের পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে, তাই নিয়ে ভাবতে থাকি।

পর্যাপ্ত সরবরাহ কিংবা কোয়ারেন্টাইনের কেন্দ্র ছাড়াই ভাইরাস সমগ্র গাজায় ছড়িয়ে পড়ছে। আমি বাচ্চাদের মনে ভয় ঢোকাতে চাই না। তাই এসব চিন্তা আমি নিজের মধ্যে জমিয়ে রাখি। কিন্তু আমরা কেউই ক্রমবর্ধমান দুঃসংবাদের আতঙ্ক লুকাতে পারি না। ইতোমধ্যে আমরা খোঁজখবর নিতে শুরু করেছি যে, কীভাবে স্কুলে বাচ্চাদের পড়ালেখা শেখানো হবে। তার কারণ লকডাউনের জন্য আমার ছেলেমেয়েরা ক্লাসে যেতে পারে না।

‏অবশেষে রাত দশটায় বিদ্যুৎ ফিরে আসে এবং প্রতিটি ঘরে আলো জ্বলে ওঠে। হঠাৎ এই বৈপরীত্য মনে হয় বাতি দিয়ে সাজানো বড়দিনের বৃক্ষ জ্বালানোর মতো।

ছেলেমেয়েরা ঘুমানোর আগে গোসল করার জন্য ঘরে যায়। আমার দুই মেয়ে জোরে চিৎকার করে, আমি প্রথমে গোসল করবো! তারা যেন পানি অপচয় না করে, তা তদারকি করার জন্য আমি তাদের পেছনে লেগে থাকি। প্রত্যেককে গোসল করার জন্য সর্বোচ্চ পাঁচ মিনিট সময় নির্ধারণ করে আমি দরজার পিছনে দাঁড়িয়ে আমার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে থাকি। প্রথম মেয়েটি খুবই ভাগ্যবান, কারণ সে বিদ্যুৎ বিঘ্নিত না করেই গোসল করে । কিন্তু দ্বিতীয়জন গোসল করার সময় হঠাৎ বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সে চিৎকার করে ডাকে, ‘মা!’ আমি আমাদের একটা মোবাইল ফোন নিয়ে বাতি জ্বালাই । সৌভাগ্যবশত, তখনও মোবাইলে খানিকটা চার্জ ছিল। সে খুব দ্রুত গোসল শেষ করে বেরিয়ে আসে।  অন্য বাচ্চারা ফ্যানের নিচে শুয়ে পুনরায় বিদ্যুৎ আসার অপেক্ষায় থাকে।

পরের দিন সকাল আটটায় সেই দুই মেয়ে আমার শোবার ঘরে এসে অভিযোগ করে, কি গরম আবহাওয়া; রাত অনেক দীর্ঘ ছিল। রাত দু’টোয় পাখা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল এবং ঘুটঘুটে অন্ধকারে আমি জেগে উঠি। এটা খুবই ভীতিকর ছিল যে যখন তুমি হঠাৎ আমার হাতে হাত দিলে, দু’জনের মধ্যে বড় বোন ছোট বোনকে বললো। আমরা বড়টাকে নিয়ে হাসাহাসি করি। আমি বললাম, তুমি জানো তোমার বোন তোমার পাশে ঘুমায়! এটা ভীতিকর কেন? আমার মেয়ে উত্তরে বললো, আমি জানি না; আমি ভেবেছিলাম ওটা একটা ভূত, নাকি ওরকম একটা কিছু। আমি তাকে আশ্বস্ত করে বলি: বাস্তব জগতে এরকম কিছু নেই।

‏আমি বুঝতে পারি যে, বর্তমানে কোভিড-১৯ কোয়ারেন্টাইন একটি বৈশ্বিক বিষয় এবং প্রতিরক্ষামূলক পদক্ষেপ অনুসরণ করা প্রয়োজন। কিন্তু ঘনঘন হাত ধোওয়া এবং এই গ্রীষ্মের ভ্যাপসা গরমে আমাদের গোসল করার জন্য অন্তত পানি থাকা উচিত। এছাড়া আমাদের বৈদ্যুতিক পাখারও দরকার এবং আমরা জানতে চাই সারা বিশ্বে কোথায় কি ঘটনা ঘটছে। এখন আমার ছেলেমেয়েরা স্কুলে যাচ্ছে না। তাই লেখাপড়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার জন্য কম্পিউটারের মাধ্যমে শিক্ষকের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ থাকা জরুরী। আমাদের কেন এভাবে অত্যাচার করার অনুমতি ইজরায়েলকে দেওয়া হয়েছে?

আমি সবসময় ভাবি আমার সন্তানদের ভবিষ্যৎ কি হবে। আগামিতে তারা আর কী ধরনের বিপর্যয়ের সাক্ষী হবে? এই কঠিন দুনিয়ায় তাদের নিয়ে আসা কী ভুল হয়েছে? নাকি অত্যাচারী এবং অন্যায়ভাবে ক্ষমতা দখলের সামনে নীরব থাকা পৃথিবীর ভুল? আমি বিভ্রান্ত এবং খেই হারিয়ে ফেলেছি।

পুনশ্চ: এখন কি অদ্ভূত আশীর্বাদ! ইজরায়েল জ্বালানী আমদানির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছে এবং আমরা অতিরিক্ত চার ঘন্টা বিদ্যুৎ পাচ্ছি। তবে দুঃখের বিষয় হলো যে, ‘মাত্র’ আট ঘন্টার ঘাটতির জন্য আমাদের হয়ত কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। গাজায় মৌলিক অধিকার অনুকূল বলে মনে হয়।

লেখক পরিচিতি: ইসরা মোহাম্মেদ জামাল অধিকৃত ফিলিস্তিনি শহর গাজা-ভিত্তিক একজন নারী লেখক । তাঁর জন্ম ১৯৮৬ সালে। তিনি ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব গাজা থেকে ইংরেজি সাহিত্যে গ্র্যাজুয়েশন লাভ করেন । পরবর্তীতে তিনি ইংরেজি ভাষার শিক্ষয়িত্রী হিসেবে কর্মরত ছিলেন । ভাষার মাধ্যমে নিজেকে প্রকাশ করার প্রবল আসক্তি রয়েছে তাঁর । ইতোমধ্যে তাঁর বেশ কয়েকটি ছোটগল্প পাঠমহলে সমাদৃত হয়েছে । বর্তমানে তিনি গাজার দক্ষিণাঞ্চলের রাফাহ শহরে সপরিবারে বসবাস করেন ।

গল্পসূত্র: ‘লকডাউনে এক রাত’ ইসরা মোহাম্মেদ জামালের ইংরেজিতে ‘অ্যা নাইট ইন লকডাউন’ ছোটগল্পের অনুবাদ। গল্পটি ‘We Are Not Numbers’ ওয়েবসাইটে (https://wearenotnumbers.org) ২০২০ সালের ৮ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত হয় এবং সেখান থেকে নেওয়া হয়েছে।
 
----------------


তাঁর মুখে হাসি

মূল: শিখা হেলাওয়ি 


এক মাস আগে শেষ বারের মতো আমাদের মহল্লায় বিমান হামলার সময় একটা বোমা এসে আমাদের রাস্তায় পড়ে। বিস্ফোরিত বোমার অংশ গিয়ে আঘাত করে পাখি-মানব আবু আল-তিরের ঘরের ছাদে। প্রতিবার বোমা হামলার সময় তিনি খাঁচায় বন্দি পাখিদের শান্ত করতে যান। তখন পাখিরা তাঁর মাথার ঝুড়ি থেকে শস্যদানা খুটে খায়। সেদিনও তিনি তাই করেছেন। কিন্তু সেদিন বোমার আঘাতে পাখির খাঁচাটি সম্পূর্ণ চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। সব জায়গায় পাখির ছিন্নভিন্ন দেহ, ঝরা পালক এবং রক্ত ছড়িয়ে ছিঁটিয়ে পড়েছিল। কিন্তু আমরা তাঁকে, এমনকি তাঁর মস্তকও খুঁজে পাইনি। একজন পড়শি খুবই সাদামাটা ভাবে মন্তব্য করেছে, ‘তিনি অনেক আগেই তাঁর মস্তক হারিয়েছেন, যেদিন থেকে তিনি মানুষের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে পাখিদের সঙ্গে কথা বলা শুরু করেছেন।’

আবু আল-তির আমার সঙ্গেও কথা বলেছেন, অথবা (নির্দিষ্ট করে বলতে হয়) তাঁর সঙ্গে আমি কথা বলা বন্ধ করিনি এবং তিনি অত্যন্ত কম কথা বলেছেন। যখন তিনি খাঁচার পাখিগুলোকে খাবার দিতেন এবং ওদের বিষ্টা পরিস্কার করতেন, তখন তাকে হ্যালো বলার জন্য আমি ছাদে যেতাম। তবে তিনি আমার দিকে কদাচিৎ মনোযোগ দিতেন। আমি তাঁর কুশলাদি জিজ্ঞেস করতাম এবং তারপর দৈনন্দিন যুদ্ধের পরিস্থিতি এবং আমার ভয়-আতঙ্ক নিয়ে তাঁর সঙ্গে গল্প করতাম।

‘সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো যে, ভয় যেন গা শিরশির করে হৃদয় ও আত্মার মধ্যে প্রবেশ না করে। ভয় হলো যুদ্ধের দানব। ভয় যখন গা শিরশির করে আত্মার মধ্যে প্রবেশ করে, তখন পুরোটাই দখল করে নেয়। সেই সময় দেখার চোখও তেমনই হয় ওঠে,’ খাঁচার ভেতর থেকে পাখিদের বিষ্ঠা বের করে আনার সময় তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছেন। কিন্তু আমি ভীত ছিলাম। আসলে আমার ভয়ের কারণ ছিল জনমানবহীন পথঘাট, বিষণ্ণ পানশালা, প্রয়াতদের মুখমণ্ডল এবং মৃতদের হাসি।

আয়নায় আমার প্রতিবিম্ব দেখে আমি ভয় পেয়েছি। কেননা প্রতিবিম্বটি আমার মুখমণ্ডলের বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলেছে। আমি যখন তাঁর কাছে আমার প্রয়াত বন্ধু-বান্ধবদের গল্প বলি, তখন তিনি বলেন, ‘চলো, যারা বেঁচে আছে, তাদের তালিকা তৈরি করি।’ নিরাপত্তা চেকপয়েন্টে আমার আতঙ্কিত হওয়ার ঘটনা বলার সময় তিনি আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলেছেন, ‘সামরিক চেকপয়েন্টের কথা ভুলে যাও এবং ভয়ের সকল বাঁধা অতিক্রম করো।’ আমি আমার নতুন বান্ধবীর কথা বলার সময় তিনি বলেছেন, ‘তুমি মিথ্যা বলছো । আমি এখনও তোমার চোখের গভীরে প্রথমজনকে দেখতে পাচ্ছি।’

আমার মুখের জন্য হাসির মুখোশ তৈরি করার আগে এসব কথাবার্তা হয়েছিল।

তিন বছর ধরে চলমান যুদ্ধের এক সকালে আমি আবিষ্কার করেছি যে, আগের বছর গুলোতে আমার মুখে যে ধরনের হাসি প্রস্ফুটিত হতো, তা এখন আর আমাকে মেনে চলে না। এখন আমার মুখের পেশী প্রসারিত এবং ঠোঁট আলাদা, অথচ সেই অভিব্যক্তি মোটেও হাসির মতো লাগে না। একধরণের সঙ্কর অভিব্যক্তি, যা আমার মুখমণ্ডলে স্থির হয়ে আটকে থাকা ভয়ার্ত ভাবের সঙ্গে মোটেও যায় না।

আমাকে অনেকটা বিষণ্ণ ক্লাউনের মত দেখাচ্ছিল।

নিজের জন্য আমি আমার মতো দেখতে একটা নমনীয় মুখোশ বানিয়েছি, যার মাঝখানে নিশ্চল হাসি। অনন্ত হাসির সঙ্গে একটি নিষ্প্রাণ মুখোশ।

আমি কথা শুরু করার আগে আবু আল-তির, যিনি কদাচিৎ আমাকে খেয়াল করতেন, বলেন, ‘মুখোশের আড়ালে মুখ ঢেকে আমার সঙ্গে কথা বলো না, হে পুরুষ! তোমাকে হাস্যকর এবং শোচনীয় দেখাচ্ছে।'

আমি মুখোশ খুলে ফেলি এবং আমার আসল অবয়ব বেরিয়ে আসে, যা যুদ্ধের প্রতি থুথু ফেলা এবং ভয়কে উপহাস করার মতো। আমি গান করি, নাচি এবং ছাদের কিনারে দাঁড়িয়ে উড়ে যাওয়ার ভঙ্গিতে দু’হাত প্রসারিত করি। আমি নিচের ধ্বংসস্তূপের দিকে তাকাই এবং অনবরত হাসতে থাকি, যতক্ষণ না পর্যন্ত আমার চোখ অশ্রুতে ভিজে ওঠে।

আবু আল-তির আমার দিকে ঘুরে দাঁড়ান এবং বলেন, ‘একদিন আমরা এসব ধ্বংসস্তূপকে অতিক্রম করতে পারবো, যদি মন থেকে ভয়কে দূর করতে পারি।’

আমি ঘরে ফিরে যাওয়ার জন্য আবু আল-তিরের বাড়ির সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে যাই। অবহেলিত কোণা থেকে গুটিশুটি পায়ে ভয় বেরিয়ে আসে এবং আমাকে অনুসরণ করে। ভয় আমার এতটাই কাছে ছিল যে, একসময় আমার কাঁধ প্রায় স্পর্শ করেছিল। আমি হাস্যোজ্জ্বল মুখোশ নামিয়ে রাখি এবং চাকার মতো ঘুরে তাঁর দিকে এগিয়ে যাই। তিনি নির্দিষ্ট জায়গাতেই ছিলেন, কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে সরু গলির অন্ধকারের ভেতর অদৃশ্য হয়ে যান।

আমি আবু আল-তিরের ভাগ্যের উপর নির্ভরশীল নই। দিনগুলো ছিল একই ধরনের, শুধু একজন পাগলের উপস্থিতি ছিল না। যুদ্ধ একই ছিল এবং তখনও অবশিষ্ট ক্ষতের স্বাদ নিচ্ছিল। এছাড়া মানুষজন পরিচয়হীন অবয়বের চতুর্দিকে চলাফেরা করছিল।

কিছু অজানা চাহিদা পূরণ করার জন্য আমি খাঁচা মেরামত করা আরম্ভ করি, যতক্ষণ না পর্যন্ত পুনরায় বিমান হামলা পার্শ্ববর্তী এলাকায় আঘাত হানতে শুরু করে।

আমি হাস্যোজ্জ্বল মুখোশ পড়ি এবং এক বোতল ‘অ্যারাক’ নিয়ে ছাদে যাই। আমি খাঁচার ভেতর প্রবেশ করি, যেখানে হত্যাযজ্ঞের কবল থেকে বেঁচে যাওয়া একটা ঘুঘু ছাড়া আর কিছুই ছিল না। মাঝে মাঝে পাখিটি আমার মাথায় ঠোকর দেয় এবং অন্য সময় আমার গ্লাস থেকে ‘অ্যারাক’ পান করে।

‘এসো, নিঃসঙ্গ ঘুঘু। তোমাকে আমার সর্বশেষ বান্ধবীর খবরাখবর শোনাই।’

ডানা ঝাপটিয়ে পাখিটি দৃষ্টির সীমানা ছাড়িয়ে উড়ে চলে যায়।

আমি মুখোশ খুলি এবং তড়িৎ বেগে ধ্বংসস্তূপের উপর উঠে দাঁড়াই।

আমি দৃষ্টির সীমানায় আবু আল-তিরকে আবিষ্কার করি। দালানের ভুগর্ভস্থ থেকে তিনি বিচ্ছিন্ন মস্তক নিয়ে উঠে আসছেন।
-----------------
 
[পাদটীকা: মূল গল্পে ‘অ্যারাক’-এর ব্যাখ্যা নেই, কিন্তু পাঠকের সুবিধার্থে দেওয়া হলো। অ্যারাক হচ্ছে পশ্চিম এশিয়ার, বিশেষ করে পূর্ব ভূমধ্যসাগর এলাকা, সিরিয়া, ইজরায়েল, ফিলিস্তিন, জর্ডান এবং লেবানন, একধরনের ঐতিহ্যবাহী মদিরা, যা আপেল এবং মৌরি থেকে উৎপন্ন করা হয় - অনুবাদক ।]

লেখক পরিচিতি: প্যালেস্টাইনের ছোটগল্প লেখক, কবি এবং শিক্ষিকা শিখা হেলাওয়ি (পুরো নাম শিখা হুসেইন হেলাওয়ি) হাইফার সন্নিকটে এক বেদুঈন গ্রামে ১৯৬৮ সালে জন্মগ্রহণ করেন। হাইফার নাজারেথ নানস্ হাই স্কুলে পড়াশুনা সমাপ্ত করে তিনি তেল আবিব ইউনিভার্সিটি থেকে আরবী ও হিব্রু ভাষায় বিএ এবং আরবী ও ইসলামিক স্টাডিজে এমএ ডিগ্রী অর্জণ করেন। পরবর্তীতে তিনি পিএইডি শুরু করেন, কিন্তু ছেলের অসুস্থতার জন্য শেষপর্যন্ত সম্পন্ন করতে পারেননি।

ছেলের অসুস্থতা শিখা হেলাওয়ির জীবন পাল্টে দেয়। অসুস্থ ছেলের সেবা-শুশ্রুষার  সময় তিনি একঘেয়েমীর জীবন থেকে খানিকটা মুক্তির আশায় সাহিত্য জগতে প্রবেশ করেন। তখন তাঁর বয়স ছিল ছেচল্লিশ বছর। তিনি আরবীতে লেখালেখি করেন। এ পর্য্ন্ত তাঁর চারটি ছোটগল্প সংকলন প্রকাশিত হয়েছে। এগুলো হলো Sayidat El-Atma (The Ladies of Twilight, 2015), Kharij Al-Fesool (Outside Seasons, ২০১৫), Al-Nawafidh Kotob Radi’a (Windows are Bad Books, ২০১৬) এবং Al-Talabiyya C345 (The Order C345, ২০১৮)। উল্লেখ্য, ‘Order C345’ গল্পগ্রন্থটি ২০১৯ সালে ‘Almultaga Prize for Arabic Short Story’ পুরস্কার লাভ করে। Kharij Al-Foosul Ta’alamtu Attayaran (Outside the Seasons I Learned to Fly) তাঁর একমাত্র প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ। তিনি কবিতার জন্য ইজরায়েলের সম্মানিত ‘Teva Prize’ লাভ করেন। সম্প্রতি তাঁর কবিতা Consequence Magazine, Boston Review এবং Billingham Review-তে ছাপা হয়েছে। এ পর্যন্ত তাঁর সাহিত্যকর্ম ইংরেজি, জার্মান, ফরাসী এবং বুলগেরীয় ভাষায় অনূদিত হয়েছে। বিগত কুড়ি বছর ধরে তিনি পূর্ব জেরুজালেমের রামালা শহরের জাফায় অবস্থিত টেরা সান্টা মাধ্যমিক স্কুলে শিক্ষকতা করছেন।

গল্পসূত্র: ‘তাঁর মুখে হাসি’ গল্পটি শিখা হেলাওয়ির ইংরেজিতে ‘অ্যা স্মাইল ইন হিজ ফেইস’ গল্পের অনুবাদ। গল্পটি আরবী থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেন রাফায়েল কোহেন এবং ‘Order C345’ ছোটগল্প সংকলনে অন্তর্ভুক্ত। পরবর্তীতে ২০২০ সালের গ্রীষ্ম সংখ্যা বৃটেনের ‘Banipal’ ম্যাগাজিনে পুনঃপ্রকাশিত হয় এবং সেখান থেকে নেওয়া হয়েছে। 
 
---------------- 


 

নিচ থেকে

মূল: রাওয়ান ইয়াঘি 



আমি আদৌ বুঝতে পারিনি আমার চোখ খোলা ছিল কিনা।

একটা বড় ধরনের ঝক্কি-ঝামেলার পর সবকিছু এতটাই শান্ত মনে হচ্ছিল যে, আমার মুখ ঢেকে থাকা ধূলিকণা আমি ঠাহর করতে পেরেছিলাম এবং একমাত্র অংশ যা আমি অনুভব করতে সক্ষম হয়েছিলাম। আমি অনুভব করেছিলাম আমার নিঃশ্বাস ঘরের মেঝের ইটের ওপর আঘাত করছে। আমার শরীরের চারপাশে থাকা সবকিছুর মধ্যে বাতাস তার নিজস্ব পথ খুঁজে পেয়েছে । তখন আমি শুধু নিস্তব্ধতা শুনতে পেয়েছি।

আমার হাত কাঠের বিছানার নিচে কোথাও আটকে ছিল। আমার পায়ের আঙ্গুল, পা, আমার চুল – সবকিছু অচল করে রাখা হয়েছিল এবং শাস্তি আরোপ করা হয়েছিল যেন সেগুলো কিছুতেই নড়াচড়া করতে না পারে। আমি ভয় পেয়েছিলাম। আমার জীবনের সব আনন্দদায়ক ঘটনার কথা স্মরণ করার জন্য আমি দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করেছি। কারণ ভয় পাওয়ার সময় আমি যেন এ ধরনের কাজ করি। মা একবার আমাকে সেই পরামর্শই দিয়েছিলেন। যদিও ভয় পাওয়ার সংখ্যা ছিল খুবই কম: আমার বড় ভাইয়ের বিয়ের বিশাল অনুষ্ঠান, হজ্ব থেকে আমার জন্য একটি গানের পুতুল নিয়ে দাদীর ফিরে আসা, গত ঈদে আমি যখন সবচেয়ে বড় উপহার পেয়েছি এবং আমার মা সদ্য ভূমিষ্ট এক শিশু নিয়ে বাড়িতে ফিরে আসেন। আমি আশ্চার্যান্বিত হয়েছি যে, শিশুর উপস্থিতি আমার জন্য সুখের ঘটনা ছিল কিনা। কিন্তু আমি স্পষ্ট দেখতে পেয়েছি, সেই ছোট্ট শিশুর দিকে তাকালে আমার বাবা-মার চোখমুখ আনন্দে উজ্জ্বল হতো।

আমার নিঃশ্বাস কঠিন ভাবে আমার মুখমণ্ডলে ফিরে আসে, যেন আমাকে সান্ত্বনা দিতে পারে। অভয় দিয়ে আমাকে বলে যে, সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। তা সত্ত্বেও এক মিনিট পরে আমি কাঁদতে শুরু করি। আর তখনই উপলব্ধি করি আমার চোখ বন্ধ এবং আমি ভেজা চোখের পাতা অনুভব করি। এটা কোন বিষয় নয়; কেননা একবার চোখের পাতা খুলে পুনরায় বন্ধ করাটা মোটামুটি একই রকম কাজ ছিল। আমি এত কেঁদেছি যে আমার মুখের ধূলিকণার সঙ্গে চোখের পানি মুখের কিনারায় কাদার মত হয়ে গেছে এবং আমি তা অনুভব করতে পেরেছি। নিশ্চয়ই আমার ভেতর রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। কেননা আমার বুকে একধরনের তীব্র ব্যথা শুরু হয় এবং ব্যথাটা কান্নার সঙ্গে বেড়ে যাচ্ছিল। ব্যথা থামানোর জন্য আমি নড়াচড়া করার চেষ্টা করি।

আমি বুঝতে পারি যে, শরীরের পেশীর শুধু এক জায়গায় খুব তীক্ষ্ণ, অত্যন্ত শক্তিশালী একটা কিছু গায়ের চামড়ার মধ্যে ঢুকে স্থির হয়ে আছে। আমি কান্না থামাই এবং অপেক্ষা করি।

আমার রক্তক্ষরণ হচ্ছে।

লেখক পরিচিতি: প্যালেস্টাইনের নারী লেখক ও সাংবাদিক রাওয়ান ইয়াঘির জন্ম গাজায়, ১৯৯৪ সালে। তাঁর পরিবার আল মাসমিয়া আল কাবিরা থেকে এসে গাজায় বসতি স্থাপন করেন। রাওয়ান ইয়াঘি গাজায় বেড়ে ওঠেন এবং সেখানেই তিনি ছোটগল্প লেখা শুরু করেন। তাঁর ছোটগল্প ‘গাজা রাইটস ব্যাক’ এবং বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী ‘প্যালেস্টাইন +১০০’ সংকলনে প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া তাঁর লেখা ‘দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস’, ‘দ্য লিংক’ এবং ‘মন্ডোওয়েইস’-এ নিয়মিত প্রকাশিত হয়। তাঁর নিজস্ব ব্লগ আছে। তিনি গাজার ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে ইংরেজি সাহিত্যে ডিগ্রী এবং ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জেসাস কলেজ থেকে ইতালীয় এবং ভাষাবিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রী অর্জণ করেন। পরবর্তীতে ‘ক্রেইগ নিউমার্ক গ্রাজুয়েট স্কুল অফ জার্নালিজম’-এ সাংবাদিকতায় পড়াশুনা করার জন্য ফুলব্রাইট অনুদান নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে গমন করেন। বর্তমানে তিনি নিউ ইয়র্কে বসবাস করছেন।

গল্পসূত্র: ‘নিচ থেকে’ গল্পটি ‘ফ্রম বিনীথ্’ গল্পের অনুবাদ। রেফাত অ্যালারীর (Refaat Alareer) সম্পাদিত ও ২০১৪ সালে প্রকাশিত ‘Gaza Writes Back: Short Stories from Young Writers in Gaza, Palestine’ ছোটগল্প সংকলনে অন্তর্ভুক্ত এবং সেখান থেকে নেয়া হয়েছে । উল্লেখ্য, ‘নিচ থেকে’ গল্পটি ২০১০ সালে ‘Mondo Award’ লাভ করে।
 --------------
 

অনুবাদক পরিচিতি:
ফজল হাসান
গল্পলেখক। অনুবাদক। ছড়াকার
ফজল হাসান সাহিত্যিক ছদ্মনাম। পোশাকী নাম: ডঃ আফজাল হোসেন।
বাংলাদেশের জাতীয় দৈনিকের সাহিত্য সাময়িকী, সাপ্তাহিক ও পাক্ষিক ম্যাগাজিন এবং দেশ-বিদেশের অনলাইন ম্যাগাজিনে লেখালেখি করেন।
প্রকাশিত মৌলিক ছোটোগল্প সংকলন: 'চন্দ্রপুকুর' ও 'কতোটা পথ পেরোলে তবে'
'আফগানিস্তানের শ্রেষ্ঠ গল্প' এবং ইরানের শ্রেষ্ঠ গল্প(অনুবাদ)। ২০০৬ সালে প্রিয় অস্ট্রেলিয়া অনলাইন ম্যাগাজিন থেকে 'প্রিয় লেখক পুরস্কার' এবং'বাসভূমি পুরস্কার পেয়েছেন। পেশাগত জীবনে তিনি অস্ট্রেলিয়ার কেন্দ্রীয় সরকারের উচ্চপদস্হ কর্মচারী হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ