আলী নূরের ধারাবাহিক স্মৃতিকথা: তুচ্ছদিনের গান- পর্ব: ৭-৯






 সাত
“আজি এ প্রভাতে রবির কর
কেমনে পশিল প্রাণের পর,
কেমনে পশিল গুহার আঁধারে প্রভাতপাখির গান!
না জানি কেন রে এতদিন পর জাগিয়া উঠিল প্রাণ। “

এই সময় আমার বাল্যজীবনের সবচেয়ে আনন্দের ঘটনাটি ঘটে। বাল্যশিক্ষা শেষ করতে না-করতেই দেখি আমি থেমে থেমে বানান না-করেই বেশ অনর্গল পড়তে পারছি। আনন্দে উত্তেজনায় আত্মহারা হয়ে গেলাম আমি। ‘প্রাণের বাসনা প্রাণের আবেগ রুধিয়া রাখিতে নারি‘ - সামনে যা পাই তাই পড়তে থাকি। একদিন মেজভাইয়ের ম্যাট্রিকের সিলেকশন থেকে জসীমউদ্দিনের ‘কবর’ কবিতাটি পড়ে অনেক কেঁদেছিলাম। আব্বা এসে জড়িয়ে ধরলেন। সবাইকে তিরস্কার করলেন এত কচি ছেলের সামনে এই সব দুঃখের কবিতা রাখার জন্য। একের পর এক পড়ে ফেললাম রবীন্দ্রনাথের ভারততীর্থ, দুই বিঘা জমি, পুরাতন ভৃত্য । যতীন্দ্র মোহন বাগচীর, অন্ধ-বধু, কাজলা দিদি। বারবার পড়তে পড়তে কয়েকদিনের মধ্যে মুখস্থ হয়ে গেল এইসব কবিতা। এখনও অনেকখানি মুখস্থ আছে। তাজু ভাইয়ের ভরা গলায় নজরুলের ‘দারিদ্র্য’ কবিতা শুনে পড়ে ফেললাম তাও। এখনও কানে বাজে তাজু ভাইয়ের উদাত্ত কন্ঠের আবৃত্তি,

বেদনা হলুদ-বৃন্ত কামনা আমার
শেফালির মত শুভ্র সুরভি বিথার
বিকশি উঠতে চাহে, তুমি হে নির্মম
দলবৃন্ত ভাঙ শাখা কাঠুরিয়া-সম।

প্রথম রেডিও শুনি কুমিল্লায় আনুদের বাড়ির পশ্চিম দিকে মতিনদের বাসায়। গাড়ির ব্যাটারি দিয়ে শুনতে হতো। প্রধানত যুদ্ধের খবরের জন্যই রেডিও শোনা হতো। অনেকে তখন নেতাজী সুভাষ বোস, হিটলার, মুসৌলিনির কণ্ঠ শুনেছেন। চার্চিলের বক্তৃতা প্রায় নিয়মিতই শোনা যেত। তখন রেডিওতে গান তেমন শোনা যেত না। আমি তা পরবর্তীকালে ১৯৫৪-৫৬ সালে বড় ভাইয়ের মনোহরপুরের বাসায় থাকার সময় পুষিয়ে নিয়েছিলাম মনের মতো করে। এই সময়ে আকাশবাণী কলকাতা থেকে প্রতি রোববারে বসতো ‘অনুরোধের আসর’ - আধুনিক গানের পসরা নিয়ে। সেই সময়ের সব গান এখনও সবাইকে দোলা দেয়। কী সুন্দর কথা, কী অপূর্ব সুর! আলপনা বন্দোপাধ্যায়, উৎপলা সেন, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র, মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, এদের এইসব রোমান্টিক গান শুনে কিশোর মন উদাসী হয়ে যেত। এই অনুরোধের আসর নিয়ে শংকরলাল ভট্টাচার্য ‘অনুরোধের আসর’ নামে একটি সুন্দর নস্ট্যালজিক বই লিখেছেন।

তখনকার দিনের গান সবাইকে আকৃষ্ট করতো তার অতি সুন্দর বাণী আর সুরের জাদুর জন্য। এর মধ্যে প্রচলিত আধুনিক সুরকে আরো একধাপ এগিয়ে নিলেন সলিল চৌধুরী। ‘সুরের এই ঝরঝর ঝরনা, হায় মরি হায় মরি হায়রে ঝরনা ঝরেরে’। সুকান্তর ‘রানার’ সবাইকে ভীষণভাবে নাড়া দিলো। গণসংগীতের ধারায় আরো বেরুলো সুকান্তর ‘অবাক পৃথিবী’, সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ‘পালকীর গান’, ‘ছিপখান তিন দাঁড়’ ইত্যাদি। হেমন্ত মুখার্জীর ‘গাঁয়ের বঁধু’ তো এক অসাধারণ সৃষ্টি । চলল মনমাতানো সব গানের ফোয়ারা। হেমন্তের ‘ধিতাং ধিতাং বোলে’, ‘শান্ত নদীটি, পটে আঁকা ছবিটি’, তরুণ বন্দোপাধ্যায়ের, ‘মাঝি তরী হেথা বাঁধবে নাকো আজকে সাঁঝে’, ‘কাজল নদীর জলে, ভরা ঢেউ ছলে ছলে প্রদীপ ভাসাও কারে স্মরিয়া’, সতীনাথের ‘আমি চলে গেলে পাষাণের বুকে লিখনা আমার নাম’, সন্ধ্যা মুখার্জীর ‘ওগো মোর গীতিময়’ এই সব অসাধারণ রোমান্টিক গান। সলীল চৌধুরীর সুরে লতা মুঙ্গেশকর গাইলেন কিছু অবিস্মরণীয় গান, ‘যারে যারে উড়ে যারে পাখি’, ‘ওগো আর কিছু তো নাই বিদায় নেবার আগে’, ‘না যেওনা রজনী এখনো বাকি’। এইসব গান তখন সবাইকে মাতিয়ে তুলেছিল। পাশাপাশি সিনেমার দাপটে এবং রেডিও সিলোনের কারণে বেশ কিছু হিন্দি গান সবার মুখে। রফি, মুকেশ, তালাত মাহমুদের জনপ্রিয় গানগুলি এই সময়েই শোনা।

গান শোনায় ক্লান্তি ছিল না আমার। চাঁটগা থাকতে খুব ছোটো ছিলাম। কোনো স্মৃতিই স্পষ্ট মনে পড়ে না মাঝে মাঝে স্মৃতির কিছু টুকরো আবছা ছবির মতো মনে ভেসে ওঠে । আমাদের বাসা, মানে ডিস্ট্রিক্ট ইঞ্জিনিয়ারের কোয়ার্টারটা ছিল কোর্ট বিল্ডিঙের পাশে জেলা বোর্ড ভবনের ঠিক উল্টোদিকে কোতোওয়ালী থানার পাশ ঘেঁষে। কিছুদূর এগোতেই পাথরঘাটা। মোড় ফেরার আগেই ছিল একটা রেকর্ডের দোকান। সামনে কাচের দেয়াল। ভেতর থেকে হিজ মাস্টার্স ভয়েস এবং কলাম্বিয়া রেকর্ডের বড়ো বড়ো পোস্টার লাগানো ছিল। আরো ছিলগোটা কতক রেকর্ড সারি করে ঝোলানো। ওখানে বাজতো, ‘উদাসী পথিক শুনেছি তোমার ব্যাকুল বাঁশীর কামনা’। আমাদের একটা সেনোলা গ্রামোফোন ছিল। রেকর্ডও ছিল বেশ কিছু। নিজেই রেকর্ড বাজিয়ে শুনতাম, । কানন দেবীর, ‘লাগুক দোলা’, ‘জানি জানি গো, ফেলে যাবে চলে, জানি জানি’, ‘ওগো সুন্দর মনের গহণে তোমার মুরতিখানি’,‘যদি আপনার মনে মাধুরী মিশায়ে এঁকে থাকো কারো ছবি’ । একটা কীর্তন শুনেছিলাম রেকর্ডে,‘আমি বন্ধুর প্রেম আগুনে পোড়া, সই লো, আমি ম’লে পোড়াইসনা তোরা’। আরো শুনতাম হলুদ লেবেলের টুউন রেকর্ডে আব্বাস উদ্দিনের ইসলামী গান। অন্ধগায়ক কে,সি, দের কীর্তন শুনেছি- ‘মথুরা নগরে প্রতি ঘরে ঘরে যাইব যোগিনী হয়ে’, ‘ছুঁয়োনা, ছুঁয়োনা বঁধু, ঐ দুরে থাকো’। সায়গলের ‘স্বপন দেখি প্রবাল দ্বীপে তুলব আমি বাড়ি’, ‘প্রেম নহে মোর মৃদু ফুলহার’, ‘নাইবা ঘুমানোর প্রিয়’। কিছু বুঝতাম কিছু বুঝতাম না, কিন্তু সুর কানে লেগে আছে আজও।

আব্বা -আম্মার সিনেমা দেখার বাতিক ছিল। বাসার সামনেই ছিল সিনেমা হল, এখন যেটি খুরশীদ মহল। আব্বা খুব মিহি ধুতি আর পাঞ্জাবী পরতেন আর হাতে থাকত একটা ছড়ি। ধুতির কোঁচাটা পাঞ্জাবীর পকেটে গুঁজে রাখতেন। মাঝে মাঝে আমাকে সঙ্গে নিতেন। তখন মুক্তি, শাপমুক্তি, ডাক্তার, শেষ উত্তর এইসব ছবির গান মনে থাকত কিন্তু ছবির কিছু মনে থাকতো না। আব্বা আম্মার সঙ্গে ঢাকায় সদরঘাটে রূপমহলে জহর গাঙ্গুলির ‘বাবলা’ ছবি দেখে কেঁদে ভাসিয়েছি। আরেকটি ছবির কথা মনে পরে সায়গল-লীলা দেশাইর ‘জীবন-মরন’। গান সব এখনও মনে আছে, ‘শুনি ডাকে মোরে ডাকে’, ‘আমি তোমায় যত শুনিয়েছিলেম গান।’

আট

ক্লাস থ্রি’তে পড়া শেষ হতে না হতেই আমরা কিছুদিনের জন্য কুমিল্লায় আস্তানা গাড়লাম সেটা ১৯৪৬ সালের দিকে। উদ্দেশ্য মিনুবু’র বিয়ের ব্যবস্থা, যা গ্রামে থেকে সম্ভব হচ্ছিল না। বাসা নেওয়া হলো আনুদের পুরানো বাড়ির পুকুরের দক্ষিণ-পাড়ে। একটা মাটির দেয়ালের ঘর। টিনের চাল। সামনে একটা ছোটোখাটো , বসার ঘর। উত্তর দিকে রান্না ঘর। এই বাড়ির বাইরে পশ্চিম দিকে খানিকটা জায়গা খালি ছিল। এখানেই মেজভাই এর পড়ার ঘর আর সামনে ব্যয়ামাগার প্রতিষ্ঠা করলেন। মানে, একজোড়া প্যারালাল বার, একজোড়া রিং, এক জোড়া মুগুড় আর এক জোড়া বুক-ডন দেওয়ার সাপোর্ট । তখনও স্বদেশী আন্দোলনের রেশ শেষ হয়নি। পাড়ায় পাড়ায় গড়ে তোলা ব্যায়ামাগার, লাঠি খেলার আখড়াগুলি সচল ছিল।

বিষ্ণুপুরের এই এলাকাকে ঠিক শহর বলা যায়না, আবার শহরতলীও নয়। বাসার পাশ দিয়ে চলে গেছে একটা লাল সুরকির পথ… ইংরেজের গোরস্থান ধরে ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিষ্টেটের বাংলো পর্য ̈ন্ত। এদিকটায় বিদ্যুৎ ছিল না। সন্ধ্যার আগেই মিউনিসিপ্যালটির লোকেরা ল্যাম্প পোষ্টের গায়ে মই লাগিয়ে ল্যাম্পে গুলোতে তেল ভরে যেত। রাস্তায় আলোর এই ব্যবস্থাই তখন যথেষ্ট ছিল । বাসার সামনেই মিউনিসিপ্যালটির একটা টিপকলও ছিল। তলাটা পাকা বাঁধানো থাকলেও দীর্ঘদিনে কলসির ঘসায় নিচে বেশ সুন্দর কলসি বসাবার মতো গর্ত তৈরি হয়ে গিয়েছিল।সকালে আর বিকালে কলে পানি আসতো। এই দু’বেলায় আশে পাশের সব বাড়ি থেকে পানি ভরতে আসতো সবাই। হাসি-হুল্লোড়ে ভরে থাকতো কলতলা। একজন ভিস্তিওয়ালা একটি চামড়ার ব্যাগ ভরে পানি নিয়ে রাস্তার উপর ছিটাতো।

এই একটি ছোটো বাসায় তখন আমরা সব ভাই বোন মিলে থাকতাম। তেমন কোন অসুবিধা হতো বলে মনে পড়ে না। ঘরের মাঝখানটায় একটা মার্কিন কাপড় ঝুলিয়ে পার্টিশনের কাজ চলতো। এদিকে আব্বা আম্মা আমি বুলু। ঐদিকে মিনুবু, শিরীবু জেবনবু। সামনের বসার ঘরে সেজ ভাই । বাইরে তো আগেই বলেছি মেজভাইর পড়ার জন্য এবং ব্যায়ামাগার। পড়ায় তেমন মন নেই, ব্যায়ামাগার নিয়ে মেতে থাকেন বেশি।

আনুদের পুকুরে এই বাসার দিক থেকে একটা ঘাট ছিল। কুমিল্লার দিকে তখন সব পুকুরে ঘাট থেকে বেড়া দিয়ে অনেকদুর পর্য ̈ন্ত টেনে দেওয়া হতো- একটা লম্বা ঘরের মতো করে। মেয়েদের পর্দার জন্য̈। এর ভেতরেই সবাই গোসল করতো। গ্রামে থাকতে এই রকম কিছু ছিল না। পুকুর আমাদের একার ছিল। আর সংলগ্ন অন্য কোনো বাড়িও ছিল না।

যে কারণে কুমিল্লায় আসা তার সুরাহা হলো। মিনুবু’র বিয়ে ঠিক হলো চরতার আব্দুল কাদির চৌধুরী অর্থাৎ বাচ্চু ভাইয়ের সঙ্গে । দারোগা বাড়ির পুকুরের ঠিক পুব পাড়ে। ঐ বাড়িটা এখনও আস্তররবিহীন ইট বের হওয়া অসম্পূর্ণ অবস্থায় আগের মতোই আছে। বিয়ে হয়ে মিনুবু চলে গেলো চরতায় শ্বশুর বাড়ি। শীতকাল । পরদিন সকালে আব্বা আমাকে আর আনুকে পাঠালেন মিনুবুকে দেখতে। সঙ্গে বেশ কিছু শীতের সব্জি। আব্বার একজন প্রিয় রিকসা চালক ছিল, ইব্রাহিম। ও থাকতো আনুদের বাড়ি ছাড়িয়ে সামান্য দূরে । ডাকা হলো ইব্রাহিমকে । ওর এক কমবয়েসী ভাগ্নে বায়না ধরল ও সওয়া্রি নিয়ে যাবে। ইব্রাহিমের কথায় আশ্বস্ত হয়ে আব্বা শেষে রাজি হলেন। ছেলেটা মোটামুটি চালিয়ে নিয়ে গেল আমাদের। কিন্তু দারোগাবাড়ির পুকুর পাড়ের রাস্তায় পৌছেই রিক্সার ব্যালেন্স হারিয়ে একেবারে পুকুরে। কোনোমতে ভেসে উঠলাম আমি। এক মুহূর্ত পরে অনেকের সহযোগিতায় আনুও। ভীষণ ভয় পেয়ে গেলাম। ঐ ভেজা অবস্থায় মিনুবুর শ্বশুরবাড়িতে নিয়ে যাওয়া হলো আমাদের। মিনুবু’র মেজ-জা বেদানাবু’ তাঁর শাড়ি পরিয়ে আমাদের দুজনকে বসিয়ে দিলেন চুলোর কাছে আগুন পোহাতে।

বাচ্চু ভাই ছিলেন সুদর্শন । খুব শৌখিনও ছিলেন। ভালো ফুটবল খেলতেন, বাঁশী বাজাতেন। কোঁকড়া চুল, ব্যাক -ব্রাশ করা, অশোক কুমারের ষ্টাইলে। এটাই তখন ফ্যাশন। বাচ্চু ভাইদের এই বাড়িতেই থাকতেন তাঁর মামা রহুল আমীন সাহেব। তিনি সাব-ডেপুটি ছিলেন। ভারি আমুদে মানুষ! তাঁর মেয়েরা কেউ সেতার বাজাতো, কেউ গান করতো। আনুর চাচাতো ভাই বজলুরের স্ত্রী বিজু, ডেপুটি মামার মেয়ে। কিছুদিনের ব্যবধানে বজু আর বিজু দুজনেই মারা যায় কয়েক বছর আগে। বজু আমার খুব ঘনিষ্ঠ ছিল কুমিল্লার সেইসব দিনে।

এই বাসায় থাকতেই বড়ো ভাইয়েরও বিয়ে হয় কলকাতায়। প্রচণ্ড দাঙ্গার মধ্যে ১৯৪৬ সালের শেষের দিকে। আমি তখন ভিক্টোরিয়া কলেজিয়েট স্কুলে ক্লাস ফাইভে পড়ি। কথা ছিল আমিও কলকাতায় যাব তাজু ভাইদের সঙ্গে। সারা দুপুর ঘুরে মোগলটুলীর ধোপা বাড়ির কার্তিকের মা’র কাছ থেকে সব কাপড় এনে প্রস্তুত হব, দেখি এর আগেই আমাকে ফেলে সবাই চলে গেছে। আমার আর কলকাতা যাওয়া হলো না। ওদিকে রায়ট চলছিল বলেই শেষ পর্যন্ত আমাকে নেওয়া হয়নি। যাক দুদিন পরই ভুলে গেলাম। তোড়জোড়ে তৈরী হলাম ভাবীকে রিসিভ করার জন্য। যে রাতে ভাবী আসবেন ইস্ত্রি করা কোট, ম্যাচ করা হাফ প্যান্ট, সুন্দর ফুল-মোজা পায়ে, নটিবয় স্যু পরে চুলে টেরী কেটে তৈরী আমি। আমি বেশ নাদুস নুদুস ছিলাম দেখতে। ভাবী বলতেন, ভারি আদুরে চেহারা। রাতে ঘোড়ার গাড়ির আওয়াজে ছুটে গেলাম বারান্দায় । ঘোড়ার গাড়ি থেকে নামলো একটি ছোটখাটো মেয়ে বেশ ভালো কাপড় চোপড়ে সেজে। কিন্তু দেখতে মোটেই নতুন বৌয়ের মত দেখাচ্ছিল না। আমি খুব হতাশ হলাম। আসলে ও ছিল বাপের বাড়ির পরিচারিকা, এটাই তখনকার সময়ের দস্তুর। একটু পরেই নামলেন ভাবী। বেশ সুন্দরী, ছিমছাম। বসানো হলো শোবার ঘরের মাঝখানটায়। মেজভাইয়ের হাতে দেওয়া হলো একটা হ্যাজাক। আম্মা আমাকে নিয়ে একদম সোজা বসিয়ে দিলেন নতুন বৌয়ের কোলে। বললেন, এই নাও তোমার ছোটো দেওর। ও ভারি সুন্দর গান গায়। ভাবী আহলাদ করে বললেন, একটা গান শোনাও তো ভাই! আমি অমনি কোন লজ্জাশরমের বালাই না রেখে ধরলাম ‘ভালবাসা মোরে ভিখারী করেছে তোমারে করেছে রানী’। কী ভেবে সেদিন আমি ঐ গান ধরলাম! ‘একথা লইয়া ভাবীসাব মোরে তামাশা করিত শত।’

এই বাসা থেকে রোজ হেঁটে যাই ভিক্টোরিয়া কলেজিয়েট স্কুলে। পড়ি ক্লাস ফাইভে। কালেক্টরেটের ভেতর দিয়ে রাণীর কুটিরের বকুলতলা হয়ে যেতাম। কালেক্টরেটের ভেতর একটা সূর্যঘড়ি ছিল। পিতলের ডায়াল। রোমান অক্ষরে সব ঘণ্টার চিহ্ন। আমার খুব পছন্দ। কাছেই একজন মুচি বসতো জুতো সেলাই নিয়ে। একটা লোহার জুতো সেলাইর ‘টি’ এর উপর জুতো উল্টো করে পরিয়ে দিয়ে পেছন থেকে তারকাটা মারা হতো। আমার জন্য খুব আকর্ষণীয় ছিল ওর জুতো সেলাইর ভঙ্গিটা। দু’পায়ের পাতা দিয়ে চেপে ধরতো একটা জুতো। সুতোয় মোম লাগিয়ে মসৃণ করে নিতো। ধারালো সুঁচ ফুটিয়ে ফোঁড় করে তার মাথায় সুতো লাগিয়ে টেনে আনতো অপরদিকের সুতোর সঙ্গে গিঁট দেবার জন্য। সেলাইর কৌশলটা খুব সুন্দর। আমার ভালো লাগত। আরো ভালো লাগত খুব ধারালো বাটালি দিয়ে ও যখন সুন্দর করে জুতোর তলার চামড়া কেটে হাফসোল লাগাতো। এসব দেখে শুনে স্কুলে পৌঁছতে প্রায়ই দেরি হতো। এই ̄স্কুলে সেজ ভাইও পড়তেন ক্লাস সেভেনে। ভুগোলের স্যার ছিলেন একজন খুব বুড়োবয়সের, চোখে ভালো দেখতেন না। দু’হাতের আঙুলগুলো দূরবিনের মতো গোল করে চোখের সামনে ধরে বইয়ের লেখা পড়তেন।

ক্লাসের একটি ছেলে সাত্তারের সঙ্গে আমার খুব বন্ধুত্ব হয়। ও বয়সে আমার কিছু বড়ো ছিল। থাকত আনুদের বাড়ির পেছনে কাপ্তান বাজারে। ওর সঙ্গে এর পর আবার দেখা ১৯৫০ এ জেলা স্কুলে ক্লাস এইটে যখন কিছুদিন পড়েছিলাম তখন। এই সময়কার আমার আরেক সহপাঠী ছিল শফিক। মমতাজ স্যারের ছোটো ভাই। মমতাজ স্যার বড়ো ভাইয়ের বন্ধু। সিদ্ধেশ্বরী স্কুলে কিছুদিন আমাদের অংক পড়িয়েছেন। শফিক পরবর্তীকালে একজন সফল ব্যারিস্টার এবং তারও পরে আইনমন্ত্রী হন। মাশু’র মেয়ের বিয়ে হয় শফিকের ছেলের সঙ্গে। ছেলেও ব্যারিস্টার।

সাত্তারের সঙ্গে আমি সবসময় যোগাযোগ রাখতাম। ১৯৫৪ সালে যখন ভিক্টোরিয়া কলেজে ইন্টার মেডিয়েট সেকেন্ড ইয়ারে ভর্তি হই তখন সাত্তার চাকুরি নেয় জজ কোর্টে। ও মোহামেডান ক্লাবে ফুটবল খেলতো। মনোহরপুরের বাসায় থাকতে আমি প্রায়ই যেতাম ওদের কাপ্তান বাজারের বাড়িতে। শহরের খানিক বাইরে, আধো-গ্রাম, আধো-শহরের মত। অবস্থাপন্ন গৃহস্থ বাড়ি, সব ভিটায় ঘর। জ্ঞাতি-গুষ্ঠী নিয়ে ওরা বিরাট পরিবার। বাড়ির সামনে বিরাট পুকুর। পুকুরের পশ্চিম পাড়ে বেশ বড় মসজিদ। মসজিদের প্রায় কাছাকাছি বাইরের ঘরে ওর ছোটোভাই ওদুদ তখন ম্যাট্রিক পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল। ও ভালো ছাত্র। আমি বরিশালে প্র্যাকটিস করার সময় যখনই কুমিল্লা গেছি তখনই সাত্তারের সঙ্গে দেখা করতে ওদের বাড়ি গেছি। ওদুদ ইনকাম ট্যাক্স কর কমিশনার ছিল। থাকতো মোহাম্মদপুরে। একদিন আমাকে ওর বাসায় যেতে বললো। ওর ভাই আমার বন্ধু সাত্তারও আসবে। আমি সন্ধ্যার দিকে গেছি ওদুদের বাসায়। খানিক পরেই ঘরে ঢুকলো সাত্তার। আমাকে দেখে মুচকি হেসে হঠাৎ চুপ হয়ে গেল। আমি অনেক কথা বলতে থাকলাম ও কিছুই বললো না। যখন বুঝলাম কিছু একটা ঘটে গেছে তখন ওদুদ আর আমি ওকে নিয়ে গেলাম ডাঃ নওয়াব আলী এবং নিউরোলজিষ্ট প্রফেসর মান্নানের কাছে । কেউ কিছু করতে পারলেন না। দুজনেই বললেন হঠাৎ কোন উত্তেজনার কারণে এমন হয়ে থাকবে। হবেওবা । ও শেষ পর্যন্ত আর কথা বলেনি। বছর কয়েক আগে মারা যায়। ওর ভাই ওদুদও মারা যায় কিছুদিন আগে।

নয়

মিনুবু’র এবং ওদিকে বড়ভাইয়ের বিয়ের কিছুদিন পরই বিষ্ণুপুরের বাসার পাট চুকিয়ে আমরা আবার ফিরে গেলাম মকিমপুরে। আব্বা-আম্মা, বুলু আর আমি। আর ছিলেন সেজভাই। শিরীবু জেবনবু’কে দেওয়া হল ফয়জুন্নেসা স্কুল হোস্টেলে। মেজ-ভাই থাকলেন বড়বুবুদের বাসায়। বড়ো ভাই চলে গেলেন ঢাকায়, বাচ্চু ভাই-মিনুবুদের শান্তিনগরের বাসায়।

এই সময়টায় সেজভাইকে বেশ কিছুদিন কাছে পাই। সেজভাইয়ের বন্ধুত্ব হল মীরপুরের ফিরোজের সঙ্গে। তার ভাই হাশেম সাহেব কলকাতা থেকে বি,কম পাশ করেন, বড়ভাইয়ের একই সময়ে। হাশেম সাহেব বিয়ে করেন, বরিশালের ডি.সি. শামসুল হক এবং ব্যারিস্টার আখতার ইমামদের বোনকে। ফিরোজ তখন টর্চ লাইটের বাল্ব দিয়ে তার পড়ার ঘরে আলোর ব্যবস্থা করেছিলেন। আমার ভারি আশ্চর্য লাগলো। শহরের মত সুইচ টিপে গ্রামেও বাতি জ্বালানো সম্ভব এ আমি ভাবতেই পারতামনা। বললাম, সবজান্তা সেজভাইকে। অতি সহজ করে বুঝিয়ে দিলেন কী করে টর্চের বাল্বের ব্যাটারির পজেটিভ নেগেটিভ স্পর্শ করলেই বাল্ব জ্বলে ওঠে। শুধু বুঝিয়েই ক্ষান্ত হলেন না। হাতে-কলমে একটা বানিয়েও ফেললেন। ওটা মীরপুরের ফিরোজের বাতির চাইতেও উজ্জ্বল হলো। তখন বুঝিনি সেজ ভাইয়ের হাতের গুনে নয়, বেশি বাটারি লাগানোর কারণেই।

এখন আর আমার আর সেজ ভাইয়ের স্কুলে যাবার কোন তাড়া নেই। বড়ভাই নেই পড়া ধরবার। মহাখুশি আমরা দুজনেই। সারাদিন সেজভাইয়ের সঙ্গে ঘুরে বেড়াই পুকুরের চার পাড়ে। পশ্চিমের গাঙ থেকে কাঁকড়ার মাটি এনে গুলতির জন্য গুলি বানাই। কখনও পুকুর পাড়ের জঙ্গলে পাখির পিছনে ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হই। অন্য সময় সেজভাই নিজ মনে ছবি আঁকেন, মূর্তি গড়েন। আমাদের কারু সঙ্গে মিশতে দেয়া হতো না। আমরা দুইভাই বয়সের বেশ ব্যবধান সত্ত্বেও একে অপরের বন্ধু হয়ে গেলাম। রাতে সেজভাই তার সব বানানো গল্প ফাঁদেন। ডিটেক্টিভ গল্প। এইসব গল্পের নায়ক সেজভাই নিজেই। আমি তম্ময় হয়ে শুনি। আম্মার সঙ্গে কিছুদিন কক্সবাজারে থাকার দরুণ তাঁর ওখানকার কেয়াং অর্থাৎ বুদ্ধমন্দির সম্বন্ধে বেশ অভিজ্ঞতা ছিল। এই সব কেয়াং এর ভিতর কী করে সব সাংঘাতিক অপরাধী চক্র আশ্রয় নিয়ে নিত্য-নতুন অপরাধ ঘটিয়ে চলতো, কী করে সেজভাই সেসব অপরাধ উদঘাটন করে অপরাধীদের ধরিয়ে দিতেন একজন প্রাইভট ডিটেক্টিভ হিসাবে তারই সব চমকপ্রদ কাহিনী। আমি অবাক মানতাম।

লেখাপড়ার ঝামেলা নেই, মিনুবুর শাসন নেই। আমাদের দুজনকে পায় কে? সেজ ভাই সকালে অনেক দেরি করে উঠতেন, তারপর মুড়িচিড়া যা হোক একটা কিছু দিয়ে সকালের নাশতার কাজ সেরে সামনের সড়ক ধরে যেতেন প্রাইমারী স্কুলের সামনের ভাঙ্গানিটার এপারে। এর উপর কোন সাঁকো ছিল না। এপারে বসতেন সেজ ভাই, ওপারে ছিদুভাই, হুমায়নের ছোটো চাচা। দুজনেই খুব অলস প্রকৃতির। খোশ আলাপে কাটিয়ে দিতেন দিনের অনেকটা সময়। তারপর বাড়ি ফিরে হয় ঘুমানো নয় গুলতি নিয়ে পাখির খোঁজে, নয় ছবি আঁকা, মূর্তি গড়া। সেজ ভাই থাকতেন দক্ষিণ ভিটার বাইরের ঘরে। যদু চাচাও থাকতেন এই ঘরে। সেজভাইয়ের ডিটেকটিভ গল্পে প্রায়ই বোতাম টিপে দরজা বন্ধ করবার ঘটনা থাকত। আমি কল্পনার সেই বোতাম টিপে দরজা বন্ধ করার কৌশল বাস্তবে দেখতে চাইতাম। খুব পিড়াপিড়ি করলে সেজভাই এই ঘরের সামনের দরজার উপর পেরেক লাগিয়ে সরু দড়ি দিয়ে কী এক ব্যবস্থা করলেন। তাঁর বিছানা থেকে একটা দড়ি টানলেই সামনের দরজাটা বন্ধ হয়ে যেত। আমি অবাক হয়ে সেজভাইয়ের প্রতিভার প্রতি শ্রদ্ধাবনত হলাম। কৌশলটা ছিল খুব সহজ। আজকালকার ঘরের কিংবা মঞ্চের পর্দা সুতো দিয়ে টানার মত। যাকে বিরাট জানি যাকে ভক্তি করি তার কোন ত্রুটিই চোখে পড়ত না। নয়ত সেজ ভাইয়ের এই বিশাল সৃষ্টি, এই অটোমেটিক দরজা শুধু যে কেবল বন্ধই করা যেত খোলা যেত না, এই সাধারণ ত্রুটিটা অবশ্যই চোখে পড়ত।

এই সময় মনু এসে থাকল আমার সঙ্গে কিছুদিন। ওকে পেয়ে আমি আকাশে চাঁদ পেলাম। সেজভাইয়ের এর সাগরেদী ছেড়ে আমি এবার মনুর ওস্তাদ বনে গেলাম। ওকে নিয়ে দুপুরের ভরা রোদে পোনা মাছ ধরতে বেরুতাম সামনের নিচু জমিগুলোতে। বর্ষায় এগুলো ডুবে একাকার । রাতে দুজনে সেজভাইয়ের গল্প শোনার জন্য বায়না ধরতাম।পরবর্তী জীবনে আমি যখন বরিশালে ব্রাউন কম্পাউন্ডের বাসায় তখন মনু এসে আমার সঙ্গে ছিল বেশ কিছুকাল। বি,এম কলেজে পড়ত। আমীর হোসেন আমু ছিলেন ওর সহপাঠী এসময়ে ও ক্রিকেট মাঠে খুব পরিচিত ছিল। স্টিমার কোম্পানির অফিসাররা ওকে ওদের টিমে নিতে টানাটানি করত।

আমাদের মকিমপুরের বাড়ি ছিল অনেকটা জায়গা জুড়ে । কাছাকাছি অন্যান্য বাড়ি থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে। এই বিশাল বাড়ির সব দিকটাই ছিল খোলা। পূর্ব দিকে অনেকখালি জমি, সবই আমাদের তারপর ইউনিয়নবোর্ডের এক অনুচ্চ সড়ক উত্তরদিকে প্রাইমারি স্কুল হয়ে নন্দীবাড়ি পর্যন্ত দক্ষিণে মীরপুর হয়ে মাধবপুরের পুল পর্যন্ত । আমাদের বাড়ির দক্ষিণে একটা ছোটো খালের পর থেকেই শুরু হত মীরপুরের সীমানা। সামনের সড়কের মাথায় ছিল একটা ভাঙা । ওর উপর একটা ভাঙ্গাচোরা কাঠের উঁচুমতো পুল ছিল বটে । কিন্তু এর বেশির ভাগ অংশে কোন তক্তা ছি্ল না। বস্তুত সংস্কারের অভাবে পুলটা কোনো কালেই ব্যবহারের উপযুক্ত ছিল না। পুলের নিচ দিয়েই সবাই চলাচল করত। এই সড়ক দিয়ে বর্শা হাতে ঘুঙুর বাজিয়ে ছুটে চলত গ্রামের ডাক হরকরা। আব্বার পত্রিকা আসত কলকাতা থেকে, স্ট্যাটসম্যান আর আনন্দবাজার পত্রিকা, পরে আকরাম খাঁর দৈনিক আজাদ। হরকরা এগুলো সড়কের উপর ফেলে বর্শার ঘুঙুর বাজিয়ে আমাদের জানান দিয়ে যেত। আমি ছুটে গিয়ে পত্রিকার প্যাকেটগুলো নিয়ে আসতাম। আব্বা ততক্ষণে তাঁর গ্যাটাবারচারের চশমা এঁটে সামনের কাঁঠাল গাছটার গোড়ায় মাদুর পেতে তৈরী। অকেক্ষণ ধরে পড়বেন এখন এই পত্রিকাগুলি, আমিও কিছু কিছু পড়ব তার সঙ্গে, বুঝি আর না বুঝি। আমার পড়ার দৌড় বাগবানের মুকুলের মহফিল পর্যন্ত।

এই সময়ে মিনুবু এলেন বাড়িতে। তার অতিপরিচিত গৃহে। আমাদের আর শাসন করেন না। সর্বক্ষণ কাছে বসিয়ে আদর করেন। আমি তার খুব প্রিয় ছিলাম, ভাই এবং ছাত্র হিসাবে। সন্তান-সম্ভবা তিনি। এই বাড়ির পুবের ঘরটায় কার্তিকের এক বর্ষামুখর রাতে তাঁর প্রথম সন্তান নীনার জন্ম হয়।এর কিছুদিন আগে বড়বুবুও নাইওর এসেছিলেন এই প্রথম এই বাড়িতে। ছবিটা আমার খুব মনে পড়ে। তখন আমাদের গ্রামের পূর্ব দিকের চট্টগ্রাম- সিলেট হাইওয়ে হয়নি। সবটাই এক বিশাল খালি প্রান্তর। এরই মাঝখান দিয়ে মদন ভাইসাব এর বাড়ির উত্তর দিক দিয়ে বুড়িগাঙ বয়ে গেছে। ত্রিপুরার পাহাড়ে তার উৎপত্তি, বেশ খরস্রোতা।শীত মওশুমে এই গাঙ নিতান্ত শীর্ণকায়। কিন্তু নৌকা চলাচল করত সারা বছর। বড়বু’ আসবেন তাঁর রাজপুত্রের মতন পুত্র নিয়ে শুনছিলাম ক’দিন থেকেই। বাড়ির সামনের কাঁঠাল গাছের গোড়ায় দাঁড়িয়ে আমে চেয়ে থাকতাম এই গাঙের দিকে, কখন দেখা যায় সেই প্রত্যাশিত নৌকা। একদিন দুপুরে দেখি দুর থেকে তিরতির বেয়ে আসছে পাল-তোলা একটা ছোটো ছৈ দেওয়া নৌকা। এসে ভিড়ল মদন ভাইয়ের বাড়ির উত্তরদিকে। নৌকা থেকে নামলেন একজন বৌ মত সঙ্গে ছোটো একটি শিশু। সামনে মাঝিদের মাথায় ছোটখাটো দুই পোর্টম্যান্টো আর হোল্ড-অল। আমার নিশ্চিত মনে হল এইই আমার বড়বু এবং তারঁ রাজপুত্র। চোখের নিমেষে ছুটে গেলাম নৌকার কাছে। বড়বু কেমন করে চিনে ফেললেন আমাকে। আমি এর আগে কোনদিন বড়বুকে দেখেছি বলে মনে পড়ল না।অপরূপ সুন্দরী বড়বু’। গায়ের রং কী ফর্সা! আব্বার গায়ের রঙের মতো। পরনে সিল্কের শাড়ি, সারা গায়ে গয়না ঝলমল করছে। আমাকে দেখেই কোলে তুলে নিলেন। আমি একেবারে বর্তে গেলাম। কলকাতা থেকে এসেছিলেন বড়বু’ । সঙ্গে প্রমান সাইজের টিনের ট্রাংকের মত। এগুলোকেই পোর্টম্যান্টো বলে। ওর ভেতর থেকে অনেক কাপড় বের করে সবাইকে দিলেন। আমার জন্য অবাক করে দেওয়া বেশ কিছু চাবি দেয়া জাপানি খেলনা। সব সময় ঘুরঘুর করি বড়বু’র চারপাশে। তিনি যে আমার নিজেরই বোন আমার আপনজন একথা মনে হতো না। ক্রমেই কেটে গেল এই আড়ষ্টতা।

আনু এক পা দু পা হাঁটতো তখন। আমার মনে পড়ে, দুটো লালমরিচ হাতে নিয়ে ধরতাম খানিক দুর থেকে। ও এক পা- দু পা করে এগিয়ে আসতো লাল মরিচের আকর্ষণে।এই বাড়িতেই সেই উত্তরের ভিটার ঘরে মনুর জন্ম। একটু বড়ো হয়ে ও আমার খুব ন্যাওটা হয়ে পড়ে। কুমিল্লায় বড়বু'র বাসায় থেকে আই,এ পরীক্ষা দেই। এই সময়ে ও সর্বক্ষণ ঘুরঘুর করতো। আর আনুর সম্বন্ধে আমার কাছে নালিশ করতো আমি যেন আনুর উপর বিরূপ হয়ে ওকে বেশি আদর করি।

এই সময়ে কিছু করার নেই। । স্কুলে যাচ্ছি না। খেলার সাথী হিসেবে জুটল মীরপুরের মোগল। বিকেলের রোদ পরে আসতেই ছুটতাম মোগলের কাছে। ওর সঙ্গে মিশে উন্নতি হলো এক ধাপ। লুকিয়ে লুকিয়ে একটা দুটো বিড়ি খেতে শুরু করলাম ওর একান্ত চেষ্টা আর উৎসাহে।গ্রামের ছেলে বিড়ি খাওয়া তেমন দোষনীয় ধরত না কেউ। কিন্তু আমাদের পরিবারে তো অন্য ব্যাপার। আম্মা দেখা থাক, শুনতে পেলেই পুঁতে ফেলবেন জ্যান্ত। একটু বড়ো হয়েছি। এখন এদিক সেদিক যাই। গ্রামের এক প্রান্তে সাহাদের দোকান থেকে আম্মার ফরমাশ মত মুদি সামগ্রী আনি। কখনও যাই মাধবপুর বাজারে হাটের দিনে। কুটির বাজার পর্যন্ত গেলাম একদিন। সে অনেকদুরের পথ, আর পথটাও আমার অজানা। আগে আব্বার সঙ্গে নৌকা করে এসেছি। বিরাট বাজার, পাটের বিরাট গঞ্জ। বিশাল বিশাল পাটের নৌকা ভিড়ত এই গঞ্জে। এখানে রেলী ব্রাদার্সের একটা অফিস ছিল। কাঠের সুন্দর বাংলো । একজন ইংরেজ সাহেব সাদা হাফ প্যান্ট আর সাদা গেঞ্জী পরে পাট কেনার তদারকী করতেন । তার কোলে থাকত খুব সুন্দর একটা বিলেতি কুকুর। এই বাংলোর পাশেই ছিল ত্রিপুরা মডার্ন ব্যাংক। এর প্রতিষ্ঠাতা ত্রিপুরার মহারাজাধিরাজ মাণিক্য বাহাদুর। এই ব্যাংকে ছিল আব্বার লেনদেন। পাশেই ছিল বোয়ালিয়ার বিখ্যাত মনিহারী দোকান। কী না পাওয়া যেত! আমি এই দোকান থেকে শখ করে এক জোড়া জুতো আর একটা বেল্ট কিনেছিলাম। শীত মওশুমে আমাদের গ্রাম থেকে কুটি যেতে হত পায়ে হেঁটে। নন্দীবাড়ি র পেছন দিয়ে অনেক দূর গেলে একটা খেয়া থাকতো বুড়ি গাঙের পারাপারের জন্য । যখন মাঝি কেউ থাকতোনা তখন ঐ খেয়ার দুই দিকে লম্বা দুটি দড়ি থাকতো পারের দুই দিকে। ঐ দড়ি টেনে যেতে হত এপার-ওপার। আমার ভারি মজা লাগত।

এই বাজারের দিকে আসতে হতো কামার বাড়ির উপর দিয়ে। কর্মকারদের কাজ আমার খুব ভালো লাগত। হাপড়টা টানে টানে উঠতো পড়ত। বেশ লাগত। গনগনে লাল লোহার টুকরো নেহাইর উপর ফেলে পিটিয়ে বিভিন্ন আকার দেয়া হত। ধান কাটার কাঁচি, খেত নিড়ানোর ক্ষুন্তি, দা, কোদাল, বটি ইত্যাদি। গ্রামের এই সব নিত্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের চাহিদা তখন গ্রামের কর্মকারেরাই মিটাতো। উদ্বৃত্ত উৎপাদন হাটের দিনে কুটির বাজারে বিক্রির জন্য নেওয়া হত। এইসব কারিগর যেমন, কর্মকার, সূত্রধর, কুম্ভকার, তাঁতী, এরা এক একজন শিল্পী। কিছুদিন আগে গ্রামের এক কর্মকার নৃপেন সীমগাছের লতার পোঁচে চোখের মণিতে আঘাত পেলে আমি ঢাকায় এনে ওকে বিশিষ্ট চক্ষু চিকিৎসক ডা. মুস্তাফিজ রহমানকে দিয়ে ওর চোখের অস্ত্রোপচার করিয়ে সারিয়ে দিই। ও কিছুই দেখতো না, একটা চোখ হারিয়েছিল আগেই আগুনের ফুলকি পরে। অপারেশনের পর মাসাধিককাল থেকেছিল আমাদের বাসায়। আমার বড়ো মেয়ে সীমা ওর খুব যত্ন করতো। একদিন পাওয়ার দেওয়া চশমা ওর চোখে পরাতে ও আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেল। বলতে থাকল, ‘দাদামশাইগো আমি আবার সব দেখতে পাচিছ! কী সুন্দর সুন্দর রঙ!’ ও এখন আর বেঁচে নেই। কষ্টের সংসার সংগ্রাম করতে করতে নৃপেণ একসময় হারিয়ে গেছে জীবন থেকে, মুছে গেছে সব রঙ।


(ক্রমশ)


লেখক পরিচিতি:
আলী নূর
পেশায় আইনজীবী।
বই পড়া, গানশোনা, ফুল ফোটানো, নাটক কিংবা ওড়িশি নৃত্য অথবা উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত, যন্ত্রসঙ্গীত এইসব নিয়েই তাঁর আনন্দযাপন। তাঁর নানা শখের মধ্যে দেশভ্রমণ, ছবি আঁকা, ফটোগ্রাফি এবং সিনেমাটোগ্রাফি অন্যতম। তিনি জীবনযাপন নয় জীবন উদযাপনে বিশ্বাসী।

বৃটিশ-ভারত, পাকিস্তান এবং স্বাধীন বাংলাদেশ এই তিন কাল তিনি দেখেছেন, দেখছেন। তুচ্ছদিনের গান কেবল তাঁর জীবনের গল্প নয় বরং গল্পচ্ছলে ইতিহাসের পরিভ্রমণ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

3 মন্তব্যসমূহ

  1. অপূর্ব এই লেখা। বিশেষ করে যারা অনেকদিন আগেই শৈশব ও কৈশর্য্য পেরিয়ে অন্যঘাটে চলে এসেছেন, তাদের কাছে এই পরিবেশনের তুলনা নেই। শরৎচন্দ্রের ইন্দ্রনাথ, মার্ক টোয়েনের হাক ফিন যেমন ম্যাজিক তৈরী করে মনের ভেতরে নূর সাহেবের লেখায় ও সেই ম্যাজিক।

    ওঁর লেখা আমার খুবই প্রিয়। অপেক্ষায় রইলাম আসছে instalment এর জন্যে।

    সৌমেন সেনগুপ্ত

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. আমার স্মৃতির পথে আপনিও হাঁটছেন আমার সঙ্গে প্রথম থেকে।অশেষ ধন্যবাদ আপনাকে।

      মুছুন
  2. এত প্রানবন্ত লেখা খুব কমই পড়েছি। এটা ভেবে অবাক হই কি করে একজন মানুষের স্মরণশক্তি এত প্রখর হয়! একেবারে মন্ত্রমুগ্ধের মত অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে পাঠককুলে....আমার শ্রদ্ধা ও শুভাশীষ জানবেন।

    উত্তরমুছুন