মার্গারেট মিচেল'এর ধারাবাহিক উপন্যাস : যে দিন ভেসে গেছে-- পর্ব ২৫


অনুবাদক : উৎপল দাশগুপ্ত

(২৫)

শরীরে অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে পরের দিন সকালে স্কারলেটের ঘুম ভাঙল। ভাঙা ওয়াগনে চেপে এবড়োখেবড়ো রাস্তা বেয়ে ঝাঁকুনি খেতে খেতে এতটা লম্বা পথ পাড়ি দেওয়া! প্রত্যেক ঝাঁকুনিই যেন হাড়গোড় ভেঙে দেবার উপক্রম করছিল। রোদের তাপে চোখমুখ ঝলসে গেছে, হাতের তালুতে দগদগে ঘা। গলায় জ্বালা করছে, তেষ্টায় ছাতি ফেটে যাচ্ছে – গেলাসের পর গেলাস জল খেয়েও সেই তেষ্টা মেটবার নয়! মাথা ভার, তাকিয়ে থাকলেই চোখ টনটন করে উঠছে। ব্রেকফাস্টের জন্য রাঙা আলু পোড়ানোর গন্ধে পেটের ভেতরটা গুলিয়ে উঠছে। ওয়েড পেটে আসার পরে ঠিক যেরকম লাগত। জেরাল্ড সজ্ঞানে থাকলে ঠিক ধরে ফেলতেন এসবই হচ্ছে প্রথমবার মদ্যপানের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া। উনি অবশ্য এসব কিছুই লক্ষ্য করলেন না। টেবিলে একদিকে মাথা হেলিয়ে অন্যমনস্ক ভাবে বসে আছেন। যেন উদগ্রীব হয়ে আছেন কখন এলেনের কাপড়ের খসখস আওয়াজটা শুনতে পাবেন – লেমন ভারবেনার সুগন্ধ ছড়িয়ে এলেন কখন আসবেন!

স্কারলেট এসে বসতেই মৃদুস্বরে বললেন, “একটু অপেক্ষা করতে হবে মিসেজ় ও’হারার জন্য। ওর বোধহয় একটু দেরি হবে।” মাথাটা যন্ত্রণায় ফেটে পড়তে চাইছে, তবু চমকে উঠে স্কারলেট ওঁর দিকে তাকাল। ম্যামি চেয়ারের হাতল ধরে ওঁর পেছনেই দাঁড়িয়ে ছিল। স্কারলেটের সঙ্গে চোখাচোখি হল। মিনতিভরা চাউনি। ইশারায় বোঝাল কিছু যেন না বলে বসে। নড়বড়ে পায়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে দিনের আলোয় বাপিকে ভাল করে লক্ষ্য করল। জেরাল্ড মুখ তুললেন। শূন্য দৃষ্টি। হাত দুটো কাঁপছে, মাথাটাও থেকে থেকে দুলে উঠছে।

স্কারলেটের অবচেতন মনে একটা আশা কাজ করছিল যে এবার জেরাল্ড শক্ত হাতে হাল ধরবেন। একটা ভরসার জায়গা খুঁজছিল যেন। আপদে বিপদে জেরাল্ড ওকে চালনা করবেন। পরামর্শ দেবেন। বাপির অবস্থা দেখে স্কারলেট ভেতরে ভেতরে কেঁপে উঠল। কালও তো ওঁকে এতটা অসংলগ্ন মনে হয়নি! হয়ত আগেকার মতন হম্বিতম্বি করেননি – হয়ত স্বাভাবিক উচ্ছ্বলতাও ছিল না – তবু পুরো ঘটনাটা গুছিয়ে বলতে তো পেরেছিলেন! আর আজ – এলেন যে আর নেই – এই কথাটাও ওঁর মনে নেই! ইয়াঙ্কিদের হানা দেওয়া আর এলেনের চলে যাওয়া – পরপর দুটো আঘাত ওঁকে স্তব্ধ করে দিয়েছে। স্কারলেট কিছু বলার চেষ্টা করতেই ম্যামি কঠোর দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকাল।

“বাপি কি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছেন?” বোঝার চেষ্টা করল স্কারলেট। এই সমস্যার কথা মাথাতে কখনও আসেনি। কী ভাবে সব কিছু সামাল দেবে? “কে জানে বাপি হয়তো সাময়িকভাবে বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছেন। শরীরটাও ভাল নেই। নিশ্চয়ই কাটিয়ে উঠবেন। কিন্তু ধরো ... যদি কাটিয়ে উঠতে না পারেন ... ! নাহ্‌, এসব কথা আমি এখন মনেই আনব না। মায়ের কথাও এখন ভাবব না। আগে একটু সামলে নিই। হাজারটা জিনিস রয়েছে দুশ্চিন্তা করার মত। সেগুলো নিয়ে আগে ভাবা দরকার। যা আমার হাতে নেই, সেটা নিয়ে ভেবে কী লাভ!”

খাবার ইচ্ছেটাই চলে গেল। টেবিল থেকে উঠে বাড়ির পেছনের উঠোনে চলে এল। ছেঁড়াখোঁড়া একটা চাপরাশ গায়ে জড়িয়ে পোর্ক খালি পায়ে সিঁড়িতে বসে একরাশ চীনেবাদামের খোলা ছাড়াচ্ছে। মাথার মধ্যে কেউ যেন হাতুড়ি পেটাচ্ছে। রোদে চোখ ঝলসে গেল। এলেন নীগ্রোদের সাথেও সৌজন্য দেখিয়ে কথা বলতেন। মনের এরকম অবস্থায় অতিরিক্ত বাক্যব্যায় করার কোনও ইচ্ছেই স্কারলেটের হল না। তাই সৌজন্যের ধারে কাছে না গিয়ে অত্যন্ত রূঢ়ভাবে প্রশ্নবাণ নিক্ষেপ করতে শুরু করল।

প্রশ্নগুলোর মধ্যে এতটাই রূঢ়তা প্রকাশ পাচ্ছিল আর হুকুমের সুর ছিল যে পোর্ক কিছু না বলে অবাক হয়ে ওর দিকে তাকাল। মুর্গীর বাচ্চা কিংবা তরমুজ চুরি করতে গিয়ে কেউ হাতেনাতে ধরা পড়লেও মিস এলেন কখনও এভাবে কথা বলেননি। বাগান, খেত আর গৃহপালিত পশুদের নিয়ে আবার প্রশ্নটা করল স্কারলেট। ওর সবুজ চোখ থেকে আগুন ঠিকরে পড়ছে। পোর্ক আগে কখনও ওর চোখ থেকে এমন আগুন ঠিকরে পড়তে দেখেনি।

“হ্যা ম্যাম, ঘোড়াটা মরে গেছে। ওই ওখানে জলের বালতির কাছে পড়ে আছে। না ম্যাম গোরুটা বেঁচে আছে। ও আপনি জানেন না? কাল রাতে ওর একটা বাছুর হয়েছে। তাই অত চেঁচাচ্ছিল।”

“সত্যি! তোমার প্রিসি কিন্তু খুব বড় একজন ধাই!” খোঁটা দিয়ে স্কারলেট বলে উঠল। “কাল আমাকে বলল কিনা দুধ দোয়ানো হচ্ছেনা বলে চেঁচাচ্ছে!”

পোর্ক খুব সাবধান হয়ে জবাব দিল, “আসলে ম্যাম, প্রিসি গোরুর বাছুর হওয়ার ব্যাপারে কিছুই জানে না। তবে ভাগ্যের কথা ওই বাছুরটা হওয়াতে গোরুটার কাছ থেকে অনেক দুধ পাওয়া যাবে। অসুস্থ মেয়েগুলোর জন্য। ইয়াঙ্কি ডাক্তার বলেছিলেন ওদের দুধ খাওয়া খুব দরকার।”

“ঠিক আছে। এছাড়া আর কিছু বেঁচে আছে?’

“না ম্যাম। শুধু একটা বুড়ো শুয়োর আর ওর ছানাটা ছাড়া। যেদিন ইয়াঙ্কিরা এল, আমি ওদের জলার ধারে ছেড়ে এসেছিলাম। কিন্তু ভগবানই জানেন ওদের কিভাবে উদ্ধার করব!”

“তুমি আর প্রিসি গিয়ে ওদের উদ্ধার করে নিয়ে এস।”

পোর্ক কথাটা শুনে যেমন অবাক হল, তেমনি মনে মনে রেগেও গেল।

“দেখুন মিস স্কারলেট, ওটা খেতমজুরদের কাজ। আমি সব সময় বাড়ির কাজ করে এসেছি।”

চকিতে স্কারলেটের মাথায় শয়তানি ভর করল।

“তোমাদের দুজনকেই শুয়োরটাকে উদ্ধার করতে হবে – আর না হলে খেত মজুরদের মত তোমরাও বিদায় হতে পার।”

অভিমানে পোর্কের চোখ ফেটে জল বেরিয়ে এল। শুধু যদি মিস এলেন আজ থাকতেন! উনি এই সব সুক্ষ্ম ব্যাপারগুলো বুঝতেন। খেত মজুর আর ঘরে কাজ করা নীগ্রোদের মধ্যে যে বিস্তর ফারাক আছে সেটা জানতেন।

“চলে যাব – মিস স্কারলেট? কোথায় যাবার জায়গা আছে মিস স্কারলেট?”

“সে আমি জানি না – কিছু এসেও যায় না আমার! কিন্তু টারাতে থেকে যে কাজ করতে চাইবে না সে ইয়াঙ্কিদের পেছন পেছন চলে যেতে পারে। কথাটা অন্যদেরও বলে দিও।”

“তারপর পোর্ক, খেতের ফসল আর তুলোর কী খবর?”

“ফসল? ভগবানের দিব্বি, ফসলের খেতে ওরা ঘোড়া চরাতো। তারপর যা কিছু পড়ে ছিল সব তুলে নিয়ে চলে গেছে। তুলোর খেতের ওপর দিয়ে কামান নিয়ে যেত। একটা গাছও বাঁচেনি। খাড়ির দিকটা ওরা খেয়াল করেনি। বড় জোর তিন বেলের মত তুলো নষ্ট হয়নি।”

মাত্র তিন বেল! এক সময় টারাতে কত শত বেল তুলোর উৎপাদন হত! স্কারলেটের মাথাটা আবার টিপ টিপ করতে শুরু করল। তি – ই – ন বেল! ওই কুঁড়ের বাদশা স্ল্যাটারিরা যা উৎপাদন করত তার থেকে হয়ত সামান্য বেশি হবে। এর ওপর আবার ট্যাক্স দেবার ঝামেলা আছে! কনফেডারেট সরকার অবশ্য টাকার বদলে তুলোতে ট্যাক্স নিতে আপত্তি করে না। কিন্তু তিন বেলে ট্যাক্সের পুরো টাকাটাই উঠবে না! আর ট্যাক্স বা কনফেডারেট সরকারের কথা ভেবেই বা কী হবে? খেতমজুররা তো সব পালিয়েছে। তুলো তুলবে কারা?

“নাহ্‌, এই কথাটাও মন থেকে সরিয়ে দিতে হবে,” মনে মনে ভাবল স্কারলেট। “ট্যাক্স নিয়ে মাথা ঘামানো মোটেই মেয়েদের কাজ নয়। বাপিরই দেখা উচিত। কিন্তু বাপি – উঁহু – বাপির কথাও এখন ভাবব না। কনফেডারেটরা ট্যাক্সের জন্য লাগাক তাড়া যত ইচ্ছে! খাবারের জোগাড় করা সব থেকে আগে দরকার!”

“আচ্ছা পোর্ক, টুয়েলভ ওকস আর ম্যাকিন্টশদের ওখানে গেছিলে কি? যদি ওদের বাগান থেকে কিছু পাওয়া যায়।”

“টারা ছেড়ে আমরা কোত্থাও যাইনি। ইয়াঙ্কিদের হাতে যদি ধরা পড়ে যাই!”

“ঠিক আছে, ডিলসিকে ম্যাকিন্টশদের ওখানে পাঠাব। যদি কিছু পড়ে-টড়ে থাকে। টুয়েলভ ওকসে আমি যাব।”

“আপনি? কার সাথে যাবেন বাছা?”

“একাই যাব। মেয়েদের কাছে ম্যামির থাকাটা জরুরি। মিস্টার জেরাল্ডও এই অবস্থায় – ”

পোর্ক এমন ভাবে চেঁচিয়ে উঠল যেটা স্কারলেটের কাছে খুবই বিরক্তিকর মনে হল। টুয়েলভ ওকসে ইয়াঙ্কিরা থাকতে পারে ... বা কোনও বজ্জাত ‘নিগার’ হয়ত লুকিয়ে আছে ওখানে। একা একা স্কারলেটের ওখানে যাওয়া মোটেই ঠিক হবে না।

“বাস – বাস – পোর্ক! তুমি ডিলসিকে বল এখুনি ওখানে যেতে। আর প্রিসিকে নিয়ে গিয়ে তুমি শুয়োর আর বাচ্চাটাকে খুঁজে নিয়ে এসো,” বলেই স্কারলেট ফিরে চলল।

***

পেছনের বারান্দার দেওয়ালের কুলুঙ্গি থেকে ম্যামির সান বনেটটা (রোদ টুপি) পেড়ে নিয়ে স্কারলেট মাথায় চাপিয়ে নিল। রঙ চটে গেলেও জিনিসটা পরিচ্ছন্ন। অন্য যুগের একটা স্মৃতি ফিরে এসে ওর মন মুহুর্তের জন্য ভারাক্রান্ত করে দিল। সবুজ রঙের পালক দেওয়া একটা সুন্দর বনেট রেট প্যারিস থেকে ওর জন্য নিয়ে এসেছিলেন। নিজেকে সম্বরণ করে ওকে কাঠের বড় ঝুড়িটা তুলে নিয়ে পেছনের সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল। শিরদাঁড়া থেকে মাথা অবধি যেন হাতুড়ি পিটছে কেউ!

গরমে তেতে পুড়ে আছে নদীর ধারে লাল রঙের রাস্তাটা। দুপাশে বরবাদ হয়ে যাওয়া তুলোর ক্ষেত। একটা গাছও দাঁড়িয়ে নেই ছায়া বিলোবার জন্য। রোদ্দুরের তাপ ম্যামির সান বনেটকে অগ্রাহ্য করে মাথায় গিয়ে বিঁধছে। বনেটটা যেন পুরু লিনেনের নয় পাতলা মসলিন দিয়ে তৈরি। বাতাসে ধুলো উড়ে এসে নাক আর গলায় ঢুকে গেল। কথা বললে বোধহয় গলার পর্দাটাই ফেঁসে যাবে! রাস্তায় বড় বড় গর্ত। ভারি ভারি কামান টেনে নিয়ে যাবার জন্য টানা গর্ত হয়ে গেছে। রাস্তা যেখানে সঙ্কীর্ণ, সেখানে তো খেতের মধ্যে দিয়েই ঘোড়া আর মানুষ হেঁটে গেছে, সবুজ ঝোপ একেবারে দলে দিয়ে গেছে। এখানে ওখানে লাগাম আর বকলসের ছেঁড়া টুকরো, ভাঙা জলের পাত্র, নীল টুপি, ছেঁড়া মোজা, ক্যারাভানের ভাঙা চাকা, এমনকি দু’একটা ছেঁড়াখোঁড়া রক্তাক্ত কম্বলও পড়ে আছে। যাবার সময় জায়গাটা ওরা খুবই নোংরা করে রেখে গেছে।

সামনে সেডার গাছের সারির ভেতর দিয়ে নীচু করে ইটের দেওয়াল তোলা জায়গাটা দেখতে পেল। বুকের ভেতরে একটা হাহাকার ছড়িয়ে পড়ল। ওখানেই ওদের পরিবারের লোকজন চিরনিদ্রায় শুয়ে আছে। ওর ছোট ছোট তিন ভাইয়ের কবরও রয়েছে ওখান। আর তার পাশেই নতুন একটা কবরে শুয়ে আছেন – নাহ্‌ কথাটা মন থেকে সরিয়ে দেবার চেষ্টা করল স্কারলেট। একটা ছোট্ট টিলা পেরিয়ে এল। একটা বেঁটেখাটো চিমনি আর পাশে ছাইয়ের ঢিপি। স্ল্যাটারিরা থাকত এখানে। একটা হিংস্র ইচ্ছে জেগে উঠল মনে মনে। পুরো স্ল্যাটারি পরিবার যেন ওই ছাইয়ের গাদার মত ধ্বংস হয়ে যাক! এলেন আজ আর নেই – সে তো ওদের জন্যই – ওই যে নষ্ট মেয়েটা – কী যেন নাম ওর – এমি – আর ওদের পরিবারের জন্যই তো – ওরা না থাকলে আজও এলেন বেঁচে থাকতেন!

উফ! ফোস্কাপড়া পায়ে একটা পাথরের কুচি বিঁধে যেতেই স্কারলেটের মুখ থেকে আর্তনাদ বেরিয়ে এল। ও কি সেই স্কারলেট ও’হারা যাকে কাউন্টির সবাই নয়নের মণি করে রাখত? যে ছিল টারার অহঙ্কার! ছেলেদের সঙ্গে হেসে কথা বললেই ওরা বর্তে যেত! ও কী করছে এখানে? এই এবড়োখেবড়ো রাস্তা দিয়ে প্রায় খালি পায়ে হেঁটে চলেছে! এই পা দুটো কি এই রাস্তায় হাঁটার জন্য? না পার্টিতে নাচবার জন্য? আদরে আবদারে বড় হওয়া স্কারলেট এখন ছেঁড়া স্লিপার পায়ে গলিয়ে, এবড়োখেবড়ো রাস্তা দিয়ে পাথরের খোঁচা খেতে খেতে কেন চলছে? না একটু খাবারের সন্ধানে। প্রতিবেশীদের ফেলে যাওয়া বাগানে যদি কুড়িয়ে বাড়িয়ে কিছু জোটে!

লম্বা টিলার থেকে নেমে আসার পর নদীটা পেল। বড় বড় গাছের শাখা প্রশাখা পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে নদীর ওপরে ছেয়ে আছে। কী শান্ত প্রকৃতি! নদীর জলটা কী ঠাণ্ডা! পা থেকে স্লিপার খুলে, স্কার্ট তুলে, জলে পা ডুবিয়ে বসল। আহ্‌ কী আরাম! যদি সারাটা দিনে এভাবে বসে থাকা যেত! টারার কোলাহল থেকে দূরে। এখানে শুধুই বাতাসে পাতা নড়ার সর সর শব্দ। পাখির কূজন। নদী দিয়ে জল বয়ে যাবার কুলুকুলু ধ্বনি। অনিচ্ছাভরে স্কারলেট জল থেকে পা তুলে স্লিপার গলিয়ে নিল। শ্যাওলায় ঢাকা নদীর পাড় ধরে চলতে শুরু করল। ইয়াঙ্কিরা ওপারে যাবার ব্রিজটা ভেঙ্গে দিয়ে গেছে। তবে একশ গজ দূরে একটু ঢালুতে গাছের গুঁড়ি দিয়ে তৈরি ছোট একটা ব্রিজ থাকার কথা। সাবধানে সেটা দিয়ে নদী পেরিয়ে টিলার ওপর উঠে আধ মাইল পথ পেরিয়ে টুয়েল্ভ ওকসে এসে পৌঁছল।

সার বেঁধে বারোটা ওক গাছ আগের মতই আকাশ ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আগুন লেগে পাতা আর শাখাপ্রশাখা সব ঝলসে গেছে শুধু। গাছের ফাঁক দিয়ে একদা গর্বভরে দাঁড়িয়ে থাকা জন উইল্কসের প্রাসাদোপম শ্বেত অট্টালিকার দগ্ধাবশেষ উঁকি মারছে। অতলস্পর্শ গহ্বর যেটা আগে সেলার হিসেবে ব্যবহার করা হত, পুড়ে যাওয়া ভিত্তিপ্রস্তর আর দুটো বিশালাকায় চিমনি অতীতের স্মৃতি বহন করে চলেছে। আধপোড়া একটা থাম ভেঙে চন্দ্রমল্লিকার ঝোপকে পিষে ফেলেছে।

স্কারলেট থামটার ওপর বসে পড়ল। অচিন্তনীয় দৃশ্যটা ওকে এতটাই অবসন্ন করে ফেলল, যে ওর পা আর চলতে চাইল না। উইল্কসদের গর্ব একদম ধুলোয় মিশে গেছে। যখনই এসেছে সবার সস্নেহ সম্ভাষণ পেয়েছে! এই সেই বাড়ি, যে বাড়িতে ওর পুত্রবধূ হয়ে আসতে চাওয়া! সুযোগ পেলেই চলে আসা, খাওয়াদাওয়া করা, নাচ গান হইহুল্লোড় করা, ছেলেদের সঙ্গে ফষ্টিনষ্টি করা! এখানেই মেলানিকে অ্যাশলের দিকে তাকিয়ে হাসতে দেখে হিংসায় জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে যাওয়া! এই গাছের ছায়াতেই চার্লস হ্যামিল্টন খুশিতে ওর হাত চেপে ধরেছিল, যখন ও চার্লসকে বিয়ে করার কথা বলেছিল!

“ওহ্‌ অ্যাশলে!, এই করুণ দৃশ্য দেখার চেয়ে তোমার মরে যাওয়াই ভাল! তুমি সহ্য করতে পারতে না!”

অ্যাশলে আর ওর বউয়ের বিবাহবাসর এ বাড়িতেই বসেছিল। ওর ছেলে বা ছেলের ছেলের বিয়ে এ বাড়িতে হওয়ার কোনও সম্ভাবনাই নেই! এই বাড়ির ছাদের তলায় আর কোনও দিন ভালবাসাবাসি হবে না! নতুন শিশুর জন্ম হবে না! কত ভালবাসত এই বাড়িটাকে, এই বাড়ির কর্ত্রী হবার স্বপ্ন ছিল! এই বাড়ি এখন মৃত! স্কারলেটের মনে হল বাড়ির সঙ্গে সঙ্গে অ্যাশলে পরিবারও যেন ধুলোয় মিশে গেছে!

“নাহ্‌ এখন এসব কথা ভাবলে চলবে না! তাহলে আমি কোনও কাজ করতে পারব না। পরে ভাবতে হবে!” কথাগুলো খুব চেঁচিয়ে বলে উঠল। তারপর চোখ সরিয়ে নিল।

খোঁড়াতে খোঁড়াতে স্কারলেট সেই ধ্বংসস্তূপের আনাচেকানাচে ঘুরতে লাগল। উইল্কস কন্যাদের প্রিয় গোলাপের বাগান মাটিতে শুয়ে পড়েছে। ধূমপান করার ঘরের সামনে ছাইয়ের গাদা। সব্জির বাগানের লোহার বেড়া ভেঙে গেছে। নরম মাটির ওপর দিয়ে ঘোড়ার খুরের ছাপ আর ভারি চাকার দাগ। সব্জির বাগান পুরোপুরি ধুলোয় মিশে গেছে। এখানে কিছুই পাওয়ার আশা নেই।

উঠোনের পেছন দিক দিয়ে চুনকাম করা সার সার ক্যাবিনের পাশ দিয়ে যেতে যেতে “হ্যালো” বলে আওয়াজ করল। কেউ জবাব দিল না। এমনকি একটা কুকুর অবধি ঘেউ ঘেউ করে উঠল না। উইল্কসদের নিগ্রোরা নিশ্চয়ই পালিয়ে গেছে আর নয়ত ইয়াঙ্কিদের পিছু পিছু চলে গেছে। প্রত্যেক ক্রীতদাসের একটা করে ছোট্ট বাগান ছিল। স্কারলেট জানত এটা। ওদের সেই বাগানগুলোতে নিশ্চয়ই হাত পড়েনি মনে মনে এই আশা নিয়ে ও কোয়ার্টারের দিকে এগোল।

খোঁজাখুঁজি বৃথা গেল না। জলের অভাবে তাজা ভাবটা ধরে রাখতে না পারলেও, শালগম আর বাঁধাকপি ফলে আছে। হলদে হয়ে যাওয়া তবু খাওয়া যাবে এমন সিম আর বরবটিও ছড়িয়ে ছিটিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব জাহির করছে। স্কারলেট এতটাই ক্লান্ত ছিল যে এই আবিষ্কারও ওকে খুশিয়াল করে তুলতে পারল না। একটা আলের ওপর বসে পড়ে ফোস্কা পড়া হাত দিয়ে মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে সবজি তুলে ঝুড়িটা ধীরে ধীরে ভরে তুলল। আজ রাতে টারার মানুষজন একটু পেট ভরে খেতে পাবে। অবশ্য সবজির মধ্যে আমিষ কিছুই পড়বে না। শুয়োরের চর্বি, যা দিয়ে ডিলসি আলো জ্বালাচ্ছিল, তার থেকে কিছুটা অন্তত স্বাদ আনবার জন্য রান্না করার সময় মিশিয়ে দেওয়া যেতে পারে।

একটা ক্যাবিনের পেছনের জমিতে এক সারি মুলো দেখতে পেয়ে ওর খিদে চাগাড় দিয়ে উঠল। এরকম তীব্র স্বাদের একটা কিছুর জন্যই যেন মনটা আঁকুপাঁকু করছিল। একটা মুলো উপড়ে নিয়ে, স্কার্টে ধুলো না ঝেড়েই, এক কামড়ে আধখানা মুলো মুখে দিয়ে চিবোতে লাগল। মুলোটা বুড়ো আর ছিবড়ে আর ঝাঁঝালো। ঝাঁঝে স্কারলেটের চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে এল। বড় টুকরোটা কোনও মতে চিবিয়ে গিলে ফেলার পরই ওর গা টা গুলিয়ে উঠল। ধুলোর ওপর ধপ করে বসে পড়ে হড়হড় করে বমি করে ফেলল।

ক্যাবিনের ভেতর থেকে বাতাসে ভর করে আসা নীগ্রো ঘামের হালকা গন্ধ বমির ভাবটা আরও বাড়িয়ে তুলল। পেট চেপে ক্রমাগত ওয়াক তুলতে লাগল। মনে হল চার পাশের গাছপালা সব চর্কির মতন বনবন করে ঘুরছে।

ঘাস বিছানো নরম মাটিতে চোখ বন্ধ করে কতক্ষণ শুয়ে ছিল খেয়াল নেই। মনে হচ্ছিল যেন পালকের বিছানায় শুয়ে আছে। একরাশ এলোমেলো উদ্ভট ভাবনা এসে জট পাকিয়ে দিচ্ছিল। ও হচ্ছে স্কারলেট ও’হারা – আর সে কিনা একটা নীগ্রো ক্যাবিনের পেছনে শুয়ে আছে!

একটা ধ্বংসস্তুপের মাঝখানে শুয়ে আছে! ক্লান্ত – অসুস্থ – নড়াচড়া করার ক্ষমতাটাও হারিয়ে গেছে! ও যে এখানে এভাবে পড়ে আছে – কেউ জানেও না! আর জানলেই বা কী? সেটা নিয়ে কার ভাববার সময় আছে? যে যার নিজের সমস্যায় জর্জরিত! ওকে – স্কারলেট ও’হারাকে এসব মুখ বুজে মেনে নিতে হচ্ছে – সারা জীবনে যাকে কুটোটিও নাড়তে হয়নি! যার একটু মাথা ধরলেও – বা যে একটু রেগে গেলেও সবাই তটস্থ হয়ে উঠত!

আর সে কিনা এখানে চিতপাত হয়ে পড়ে আছে! দুশ্চিন্তাগুলো মন থেকে সরাতে পারছে না! জোরে চেঁচিয়ে ওঠার শক্তিটুকুও নেই! বলে উঠতে পারছে না, ‘মা, বাপি, অ্যাশলে – এই ধ্বংসস্তুপ নিয়ে পারে ভাবব – এই মুহুর্তে আমি আর সহ্য করতে পারছি না!’ নাহ্‌, সত্যি এই ভাবনাগুলোকে সহ্য করার অবস্থায় ও নেই। তবুও ভাবনাগুলো মনে ভিড় করে আসছে – আনতে না চাইলেও আসছে! ভেসে উঠছে, আবার তলিয়ে যাচ্ছে। কখনও ঠোক্কর মেরে ক্ষত তৈরি করছে। ধুলোর ওপর মুখ রেখে নিথর হয়ে পড়ে রইল – যেন অনন্তকাল। রোদের তাপে শরীর পুড়িয়ে দিচ্ছে। ফেলে আসা দিন, চলে যাওয়া মানুষ – মনে পড়ে যাচ্ছে। আর কখনও ফিরে আসবে না। আগামী দিনগুলো কেমন হতে চলেছে? অন্ধকার – বিন্দুমাত্র আলোর রেখাও দেখতে পাচ্ছে না!

অনেকক্ষণ বাদে উঠে দাঁড়াতেই টুয়েল্ভ ওকসের কালো ধ্বংসস্তুপটা আবার নজরে এল। কোমলতা, সৌন্দর্যবোধ, তারুণ্য সব যেন ওর অস্তিত্ব থেকে চিরকালের জন্য হারিয়ে গেল। অতীত তো অতীতই। যাঁরা চলে গেছেন, শত হাহাকারেও তাঁরা তো আর ফিরে আসবেন না! স্বচ্ছন্দ, বিলাসী জীবন এখন এক মরীচিকা। আর ফিরবে না! বোঝাই ঝুড়িটা কাঁধে তুলে নিল। মনকে শাসন করল। ওর ভবিষ্যত কর্মপন্থা স্থির হয়ে গেছে।

অতীতকে তো পাওয়া যাবে না। আঁকড়ে ধরে থেকে কী হবে? মানেই হয় না কোনো। তার থেকে এগিয়ে যাওয়াই ভাল। এগিয়ে যেতে হবে।

অনেক মহিলাই – দীর্ঘদিন ধরেই হয়ত – অতীতের সুখস্মৃতিতে বিভোর হয়ে থাকবেন। চলে যাওয়া প্রিয়জনদের স্মরণ করে দুঃখ পাবেন। মিথ্যে এক অহঙ্কারবোধ নিয়ে দারিদ্র্যকে মহান করে দেখাতে চাইবেন, বরণ করে নেবেন। না, না, স্কারলেট মোটেই ওই দলে গিয়ে নাম লেখাবে না। পেছনপানে ঘুরে তাকিয়ে হাহাকার করার কোনও মানেই নেই।

শেষবারের মত টুয়েল্ভ ওকসের দিকে তাকাল। আগুনে ঝলসে কালো হয়ে গেছে। আসল রূপটা এক মুহুর্তের জন্য কল্পনায় ভেসে উঠল। এক গর্বিত জীবনধারার সাক্ষী। তারপর ভারি ঝুড়িটা তুলে নিয়ে টারায় যাওয়ার রাস্তা ধরে এগোতে লাগল। ঝুড়ির ভার ওর মাংসে যেন কেটে বসছে।

খিদেটা আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। চেঁচিয়ে উঠল, ‘ঈশ্বর তুমি আমার সাক্ষী থাকলে। তোমাকে সাক্ষী রেখে আমি বলছি যে ইয়াঙ্কিরা আমাকে দমিয়ে দিতে পারবে না। আমি শেষ দেখে ছাড়ব।


আর কোনও দিন আমি এরকম অনাহারে থাকব না – এমনকি পরিবারের কাউকেই আমি অনাহারে থাকতে দেব না। যদি চুরি করতে হয় – বা খুনও করতে হয় – তুমি সাক্ষী থাকলে ঈশ্বর – অনাহারে না থাকার জন্য আমি তাতেও প্রস্তুত!’



পরের দিনগুলোতে টারাকে মনে হত ক্রুসো’র মরূদ্বীপের মত। অপরিসীম নৈঃশব্দে বিরাজমান, নিখিল বিশ্ব থেকে সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন। অবশ্য সেই বিশ্বের সীমানা মাত্র কয়েক মাইলের মধ্যেই। তবু যেন মনে হয় টারা থেকে জোন্সবোরো কিংবা ফ্যেয়াটভিল কিংবা লাভজয়ের এমনকি টারার থেকে আশেপাশের প্ল্যান্টেশনের মধ্যে হাজার হাজার যোজন উত্তাল এক সমুদ্রের ব্যবধান। ওদের একটিমাত্র বুড়ো ঘোড়ার মরে যাওয়ার পর ওদের যাতায়াতের একমাত্র সম্বলটুকুও অদৃশ্য হয়েছে। সময় নেই, মনের জোরও অবশিষ্ট নেই লাল রঙের এই অনন্ত পথটুকু হেঁটে পার করার।

কখনো কখনো দিনভর হাড়ভাঙ্গা খাটুনি, অন্নের জন্য লড়াই আর তিনটে অসুস্থ মেয়ের পরিচর্যার ফাঁকে ফাঁকে স্কারলেট চেনাশোনা শব্দগুলো শুনতে পাওয়ার জন্য উৎকর্ণ হয়ে থাকত – কোয়ার্টার থেকে নীগ্রো শিশুদের খলখল করে হাসির আওয়াজ, খেত থেকে ওয়াগনের ঘরে ফিরে আসার ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ, মাঠঘাট পেরিয়ে ক্ষিপ্রগতিতে জেরাল্ডের ঘোড়ার ছুটে আসার বজ্রনির্ঘোষ, ড্রাইভওয়ে দিয়ে জুড়িগাড়ির চাকার ঘড়ঘড় আওয়াজ, আড্ডা মারতে আসা প্রতিবেশীদের উৎফুল্ল গুঞ্জন। হতাশ হতে হয়। জনহীন রাস্তাটা নিস্তব্ধ, লাল ধুলো উড়িয়ে অতিথি আগমনের বার্তা দেয় না। সবুজ টিলা আর লাল মাটিতে ঘেরা টারা যেন বিচ্ছিন্ন এক দ্বীপ।

চিরপরিচিত সেই পৃথিবী – যেখানে প্রতিটা পরিবার নিজের নিজের ছাদের তলায় নিশ্চিন্ত মনে খাওয়াদাওয়া করতে পারে, ঘুমোতে পারে – চিরতরে হারিয়ে গেছে। হারিয়ে গেছে সেই সব মেয়েরা যারা চমকদার পোশাক পরে চুটিয়ে প্রেম করত আর থেকে থেকে “এই নিষ্ঠুর যুদ্ধ স্তব্ধ হলে” গানের কলি ভাঁজতে থাকত। মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে ও নিজেও যা করেছে! জায়গায় জায়গায় তখন একটা লড়াই চলছিল, কামানের গর্জন, শহরে শহরে আগুনের লেলিহান শিখা, হাসপাতালে লড়াইতে জখম জওয়ানদের যন্ত্রণার কাতরানি আর গা গুলিয়ে ওঠা দুর্গন্ধ।

জায়গায় জায়গায় খালি পায়ে, ঘরে বোনা ময়লা পোশাক পরা, অভুক্ত, ক্লান্ত, বিনিদ্র এক দল সৈন্য কুচকাওয়াজ করে যেত, লড়াই করত বিষণ্ণ এক অবসন্নতা নিয়ে – যখন জয়লাভের সমস্ত আশা সুদূরপরাহত। অন্যদিকে জর্জিয়া পাহাড়ের জায়গায় জায়গায় অশ্বারূঢ় স্বাস্থবান ইয়াঙ্কি সৈন্যদের নীল উর্দিতে ভরে উঠল।

সেই যুদ্ধ ছিল টারার সীমানার বাইরে। সেই পৃথিবী ছিল টারার সীমানার বাইরে। প্ল্যান্টেশনের সীমানার মধ্যে না ছিল সেই লড়াই, না ছিল সেই পৃথিবী। ছিল শুধু শ্রান্তির মুহুর্তে ফিরে ফিরে আসা কিছু তিক্ত স্মৃতি আর সেই স্মৃতিকে দূরে সরিয়ে রাখবার জন্য প্রাণপণ লড়াই। অন্নসংস্থান আর বেঁচে থাকার জন্য লড়াই, টারার বাইরের সেই পৃথিবীকে ক্রমশ অস্পষ্ট করে তুলছে।

শুধু দু’মুঠো অন্নের জন্য কী আকুলিবিকুলি! অভুক্ত পেট সব স্মৃতিকে ছাপিয়ে যায়। দুঃখ ভুলে যেতে পারে স্কারলেট, পেটের জ্বালা সহ্য করতে পারে না। প্রতিদিন সকালে ঘুম ভেঙ্গে যাবার পরে, যুদ্ধ আর অনাহারের স্মৃতি ফিরে এসে জ্বালাতন শুরু করার আগে, ঘুমের রেশ থাকতে থাকতে বেশ কিছুক্ষণ বিছানায় গড়াগড়ি করতে করতে বেকন ভাজার আর রোল বেক করার মিষ্টি গন্ধের প্রতীক্ষা করতে থাকে। পরিচিত সেই গন্ধটা পাওয়ার আশায় এত জোরে জোরে নাক টানতে থাকে যে চোখ থেকে ঘুমের রেশটুকু একেবারে উধাও হয়ে যায়।

আপেল, রাঙা আলু, চিনেবাদাম আর দুধের মত সাধারণ এই খাবারগুলো টারার টেবিলে থাকে, কিন্তু পরিমান এতই অল্প যে সকলের পেট ভরানোর জন্য যথেষ্ট নয়। দিনে তিনবার এই খাবারগুলোর দিকে চোখ পড়লেই, স্কারলেটের মন পুরোনো দিনগুলোতে ছুটে চলে যায়। পুরোনো দিনের আহার্য, মোমবাতির আলোয় আলোকিত টেবিল আর লোভনীয় খাবারদাবারের মন মাতানো সুগন্ধে ভরপুর বাতাস।

কত অবহেলাই না ছিল তখন, কত অপচয়ই না করেছে সেই সব মহার্ঘ্য খাবারের! রোল, কর্ন মাফিন, বিস্কুট, ওয়্যেফ্‌ল, চুঁইয়ে পড়া মাখন – সবই একবেলার আহারের মেন্যুতে! টেবিলের এপ্রান্তে হ্যাম তো ওপ্রান্তে চিকেন। মাখনসমৃদ্ধ পট লিকারে ভেসে থাকা রকমারি শাকসব্জীর রসনাসিক্ত সাজ। ফুলতোলা উজ্জ্বল চিনেমাটির পাত্রে পাহাড় করে রাখা বীনস। স্ট্যু করা ঢেঁড়স, ঘন ক্রীম স্যসে ভেজানো গাজর। তিন রকমের ডেসার্ট – চকোলেট লেয়ার কেক, ভ্যানিলা ব্লঁ মঁজ়, আর হুইপড ক্রীম ঢালা পাউন্ড কেক – যাতে যে যার পছন্দ মত বেছে নিতে পারে। এই সব সুস্বাদু খাবারের কথা মনে পড়লে ওর চোখে জল চলে আসে। খিদেয মোচড় দেওয়া শূন্য পেট ক্রমশ গা-গোলানোভাবে বদলে যায়। যুদ্ধ আর মৃত্যুও ওকে এতটা কষ্ট দেয়নি। ওর খাই খাই স্বভাব নিয়ে ম্যামির কত আক্ষেপ ছিল। ঊনিশ বছরের একজন মেয়ের স্বাভাবিকে খিদে – সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনির জেরে এখন চারগুণ বেড়ে গেছে।

খিদেয় পেট চোঁ-চোঁ করা যে শুধুই ওরই সমস্যা তা তো নয়! চারপাশে তাকালেই সারি সারি সাদা আর কালো ক্ষুধার্ত মুখ দেখতে পায়। ক্যারীন আর স্যুয়েলেন তো খুব অল্প দিনের মধ্যেই টাইফয়েড থেকে সেরে উঠে বিশ্বগ্রাসী খিদে নিয়ে সামনে এসে দাঁড়াবে। ওয়েড তো ঘ্যানঘ্যান করতে শুরু করেই দিয়েছে, “ওয়েড রাঙা আলু খেতে ভালবাসে না। ওয়েডের খিদু পায়।”

বিড়বিড় করে অভিযোগ জানায় অন্যরাও।

“মিস স্কারলেট, আরেকটু বেশি না খেতে না পারলে বাচ্চাগুলোকে খাওয়ানোর জন্য বুকে দুধই হচ্ছে না!”

“মিস স্কারলেট, পেটে আরেকটু খাবার না পড়লে, গতরে জোর পাচ্ছি না যে! কি করে কাঠ কাটব?”

“ভরপেট না খেয়ে আমি যে মরেই যাব, বাছা!”

“মামণি, আমরা কি শুধুই রাঙা আলু খেয়ে থাকব?”

মেলানিই কেবল কোনও অভিযোগ করেনি। দিনে দিনে ও আরও রোগা হয়ে পড়ছে, পাণ্ডুর হয়ে পড়ছে, এমনকি ঘুমের মধ্যেও ব্যথায় কাতরে উঠছে।

“একদম খিদে নেই গো, স্কারলেট। তুমি বরং আমার ভাগের দুধটুকু ডিলসিকে দিয়ে দাও। বাচ্চাদুটোর দেখভাল করার জন্য ওটা ওর দরকার। শরীর ভাল না থাকলে খিদেই পায় না।”

মেলানির এই নিরুত্তাপ কৃচ্ছ্রসাধন দেখে স্কারলেট ভীষণ বিরক্ত হয়। এর চেয়ে অন্যদের ঘ্যানঘ্যানিও অনেক ভাল। বিদ্রুপ আর চেঁচামেচি দিয়ে ওদের থামিয়ে দেওয়া যায় – সেটাই করে থাকে। কিন্তু মেলানির নিঃস্বার্থ ব্যবহারের কাছে ও একেবারে নিঃসহায় হয়ে পড়ে। নিঃসহায় এবং অসন্তুষ্ট। জেরাল্ড, নীগ্রোরা এমনকি ওয়েডও মেলানিকে আঁকড়ে ধরেছে, কারণ এত অসুস্থতার মধ্যেও ও দয়ালু আর সহানুভূতিশীল, আর এই মুহুর্তে স্কারলেট কোনোটাই নয়।

বিশেষ করে ওয়েডকে তো মেলানির কাছ থেকে সরানোই যেত না। দিনে দিনে কেমন যেন খিটখিটে হয়ে উঠছে ছেলেটা! অবশ্য কারণটা খতিয়ে দেখার সময় নেই স্কারলেটের। ম্যামি বলল ওর নাকি কৃমি হয়েছে। তাই হবে নিশ্চয়। সুতরাং, নানারকম শেকড়বাকড় থেকে তৈরি জড়িবুটি, যা দিয়ে এলেন নীগ্রো শিশুদের কৃমির চিকিৎসা করতেন, ওয়েডকে গিলিয়ে দিল। কৃমির ওষুধ খেয়ে ছেলেটা আরও রোগা হয়ে পড়ল। আজকাল স্কারলেট ওয়েডকে আলাদা একটা মানুষ বলেই ভাবে না। ওয়েড ওর কাছে একটা ঝামেলা, বাড়তি একটা পেট। এই খারাপ সময়টা একবার কেটে যেতে দাও, তখন স্কারলেট ওর সঙ্গে আবার খেলাধুলো করবে, গল্প শোনাবে, অ-আ-ক-খ শেখাবে। কিন্তু এখন ওর কাছে একটুও ফুরসত নেই। আগ্রহও নেই। আর এত ঝামেলা আর ব্যস্ততার মধ্যেও ছেলেটা পায়ে পায়ে ঘুরে এত জ্বালাতন করতে থাকে যে স্কারলেট মাঝে মাঝেই বকুনি লাগিয়ে দেয়।

মায়ের কাছে বকুনি খেয়ে ছেলেটা এমন ভয় পেয়ে যায়, আর ভয় পেলে ওকে এমন অসহায় লাগে যে স্কারলেট আরও চটে যায়। আসলে স্কারলেট ধরতেই পারেনি যে ছেলেটা এমন একটা আতঙ্কের পৃথিবীতে বাস করে, যেটা বড়দের পক্ষে বুঝে ওঠা সম্ভবই নয়। ভয় ওয়েডের পিছু ছাড়ে না। ভয়ে ওর বুক দুরদুর করতেথাকে, ভয় পেয়ে ঘুমের মধ্যে কেঁদে ওঠে। আচমকা জোরে আওয়াজ হলে বা কেউ ধমকালে বেচারা কাঁপতে থাকে। আওয়াজ বা ধমকের সাথে ওর মনে ইয়াঙ্কিরা জড়িয়ে আছে। প্রিসির ভূতের ভূতের ভয় দেখানোর চেয়ে ইয়াঙ্কিদের ও বেশি ভয় করে।

অবরোধের দাপট শুরু হওয়ার আগে পর্যন্ত ওয়েডের ছিল হাসিতে খুশিতে ভরা সুখী আর শান্ত জীবন। ওর দিকে বিশেষ নজর না দিলেও, মায়ের কাছ থেকে আদর আর মিষ্টি কথাই শুনতে অভ্যস্ত ছিল, সেই ভয়ঙ্কর রাতটা আসার আগে পর্যন্ত। জোর করে ওকে ঘুম থেকে তুলে দেওয়া হল। আগুনের শিখায় আকাশটা লাল হয়ে গেছে। বিস্ফোরণের কান ফাটানো আওয়াজ ভেসে আসছে। সেই রাত্রে আর তার পরেরদিন মা ওকে প্রথমবার চড় মেরেছিল আর খুব জোরে ধমকে দিয়েছিল। পীচট্রী স্ট্রীটের বাড়ির চার দেওয়ালের ভেতরের সেই আনন্দময় জীবন – ওর চেনাশোনা একমাত্র দুনিয়া – সেদিন ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। সেদিনের সেই বেদনাবোধ আজও কাটিয়ে উঠতে পারেনি। অ্যাটলান্টা থেকে পালিয়ে আসার সময় সবকিছুই কেমন গুলিয়ে যাচ্ছিল। একটা কথাই মনে গেঁথে গেল যে ইয়াঙ্কিরা ওকে ধরতে আসছে। আর একবার যদি ইয়াঙ্কিরা ওর নাগাল পায় তাহলে ওকে টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলবে। এই রকম একটা আতঙ্ক নিয়ে দিন কাটে ওর। স্কারলেট সামান্য গলা তুলে বকাবকি করলেই, ও ভয়ে কাঁপতে থাকে। ওর শিশুমনে মায়ের কাছে প্রথমবার ধমক খাওয়ার অস্পষ্ট স্মৃতিটা ফিরে এসে জ্বালাতন করে। ইয়াঙ্কি আর ধমক খাওয়ার ভয় ওর মেনে চিরদিনের জন্য গেঁথে গেছে। মা’কে রীতিমত ভয় পায় ওয়েড।

ছেলেটা যে ক্রমশ ওর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, সেটা স্কারলেট নজর না করে পারল না। সারাদিনের পরিশ্রমের শেষে আর অফুরন্ত কর্তব্যের দায় মিটিয়ে বিরল কোনও মুহুর্তে যদি এই নিয়ে একটু ভাবার অবসর পেয়ে যেত, তখন ও রীতিমত বিচলিত বোধ করত। ওয়েডের ওর পায়ে পায়ে ঘোরার থেকেও এই ব্যাপারটা ওকে বেশি উদ্বিগ্ন করত। বিশেষত, ছেলেটা যে মেলানির কোল ঘেঁষে বসে থাকত, শান্ত হয়ে ওর সঙ্গে খেলত, ওর বলা গল্পগুলো মন দিয়ে শুনত, এতে স্কারলেটের মনে মনে হিংসে হত। ‘আন্টি’ বলতে ওয়েড একেবারে অজ্ঞান, মিষ্টি করে হেসে ওর সঙ্গে কথা বলে আর কখনও বলে না, “চুপ কর! তোমার কথা শুনে আমার মাথা ধরে গেল!” বা “অত ছটফট করছ কেন, ওয়েড? একটু শান্ত হয়ে বসতে পার না?”

সত্যি কথা বলতে কি, ওয়েডকে আদর করবার মত সময় স্কারলেটের ছিল না, তাড়নাও ছিল না। আর সেই কাজটা মেলানিকে করতে দেখে ওর হিংসে হত। একদিন দেখতে পেল ওয়েড মেলানির বিছানাতে মাথায় ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তারপর টাল সামলাতে না পেরে, মেলানির গায়ের ওপরেই পড়ে গেল। স্কারলেট ওকে এক চড় মারল।

“আন্টিকে এরকম জ্বালাতন করতে তোমার লজ্জা লাগে না? আন্টি কত অসুস্থ! যাও এখুনি উঠোনে গিয়ে খেলা কর। এখানে আর যেন তোমাকে না দেখি!”

কিন্তু মেলানি দুর্বল হাত বাড়িয়ে ফোঁপাতে থাকা ওয়েডকে জড়িয়ে ধরে কাছে টেনে নিল।

“না, না, ওয়েড, কেঁদো না, কাঁদেনা সোনা! তুমি তো মোটেই আমাকে জ্বালাতন করনি, তাই না? স্কারলেট ও আমাকে একটুকুও জ্বালাতন করে না। ওকে আমার কাছে থাকতে দাওয়, প্লীজ়। ওর দেখাশোনার ভার আমার ওপর ছেড়ে দাও। যতদিন না পুরোপুরি সেরে উঠছি, এটাই তো একমাত্র কাজ, যা আমি করতে পারি। নানান কাজ নিয়ে তুমি তো হিমশিম খেয়ে যাচ্ছ, তুমি কী করে নজর রাখবে?”

“বোকার মত কথা বোলো না তো মেলি,” স্কারলেট ফুঁসে উঠল। “এত সময় লাগছে তোমার সেরে উঠতে! তার ওপর যদি ও তোমার পেটের ওপর ওভাবে পড়ে যায়, তাতে কি ভাল হবে? শোনো ওয়েড, শুনে রাখ! আবার যদি তোমাকে আন্টির বিছানার পাশে ঘুরঘুর করতে দেখি, তবে তোমারই একদিন কী আমারই একদিন! মেয়েদের মত নাকে কাঁদা বন্ধ কর তো! ছেলেদের মত হবার চেষ্টা কর!”

ওয়েড ফোঁপাতে ফোঁপাতে ঘর থেকে দৌড়ে বেরিয়ে গেল, বাড়ির কোথাও নিজেকে লুকিয়ে ফেলার জন্য। অসহায়ভাবে মেলানি ঠোঁট কামড়াল। চোখ ফেটে জল বেরিয়ে এল। হলে দাঁড়িয়ে পুরো ঘটনাটা দেখে ম্যামি ভুরু কোঁচ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। স্কারলেটকে আজকাল কেউ কিছু বলতে চায় না। ওর মুখ ঝামটাকে সবাই ভয় পায়। ওর শরীরে ভর করে যে নতুন মানুষটা আজকাল চলাফেরা করে, তাকে সবাই ভয় পায়।

আজকাল টারা স্কারলেটের কথাতেই ওঠে বসে। হঠাৎ অনেক ক্ষমতা হাতে এলে যেমন হয়ে থাকে, ওর তর্জন গর্জন করার প্রবৃত্তিটা বাইরে বেরিয়ে এসেছে। স্কারলেটের যে কোনও রকম মায়া মমতা নেই এ কথা বলা যাবে না। আসলে এতটাই আতঙ্ক আর অনিশ্চয়তা ওকে গ্রাস করে ফেলেছে যে, পাছে ওর দুর্বলতাগুলো অন্যের কাছে ধরা পড়ে যায়, নির্দয় ব্যবহার করে সেটা চাপা দিতে চায়, যাতে কেউ ওর কথা অমান্য করার সাহস না পায়। তাছাড়া লোকজনকে চমকে ধমকে ভয় পাইয়ে দেওয়ার মধ্যে এক ধরণের তৃপ্তিও আছে। এটা করে যে অন্তত কিছুটা হলেও মানসিক উত্তেজনা প্রশমন করা যায় সেটাও স্কারলেট বুঝে ফেলেছে। ওর চরিত্রটা যে অনেকটাই বদলে গেছে, সেটাও স্কারলেট বুঝতে পারত। রুক্ষস্বরে হুকুম করায় যখন নীরবে পোর্কের মুখ ভার হত, বা ম্যামি নিজের মনে গজগজ করে বলত, “মেয়েটাকে যেন ভূতে পেয়েছে!”, তখন নিজেই অবাক হয়ে ভাবত যে ওর শিষ্টতাবোধগুলো কোথায় গেল! যে ভদ্রতাবোধ, যে শালীনতা এলেন ওর মধ্যে গেঁথে দিতে চেয়েছিলেন, সেগুলো হেমন্তের হিমেল হাওয়ার প্রথম ঝাপটা লাগতেই শুকনো পাতার মত ঝরে গেছে।

কতবার যে এলেন বলেছেন, “যারা তোমার ভরসায় আছে, বিশেষ করে ডার্কিরা, তাদের প্রতি দৃঢ় কিন্তু নম্র ব্যবহার করবে।” ডার্কিদের সঙ্গে নম্র ব্যবহার করলেই হয়েছে আর কী! আগে বাড়ির নিগারদের যে কখনও খেত মজুরের কাজ করতে হয়নি, সেটা নিয়ে হাহুতাশ করতে করতে কিচেনে বসেই সারাটা দিন আলসেমি করে কাটিয়ে দেবে!

“বোনেদের ভালবাসবে, যত্ন করবে, যারা অসুস্থ আর অপারগ তাদের দয়া দেখাবে,” এলেন বলতেন, “মানুষের বিপদে আপদে সহানুভূতি দেখিও।”

বোনেদের আজকাল মোটেই ভালবাসতে পারছে না স্কারলেট। ভারি বোঝার মত ওরা! তাই বলে যত্ন কি করছে না? স্নান করিয়ে দিচ্ছে! চুল আঁচড়ে দিচ্ছে! মুখের সামনে খাবার এনে দিচ্ছে! শাকসব্জির সন্ধানে প্রত্যেক দিন কত দূর দূর যেতে হচ্ছে, তাও আবার পায়ে হেঁটে!

গরুর দুধ দোয়ানো পর্যন্ত শিখতে হয়নি ওকে? একেবারে প্রাণ হাতে করে! একবার যদি ওই রাগী জানোয়ারটা মুখ ঘুরিয়ে গুঁতিয়ে দেয় ওকে! আর দয়া দেখানো মানে তো শুধু শুধু সময় নষ্ট করা! দয়া দেখাতে গেলে ওরা তো অনিশ্চিতকাল বিছানাতেই পড়ে থাকবে। যত তাড়াতাড়ি হোক ওরা নিজের পায় উঠে দাঁড়াক, যাতে সংসারের কাজে লাগবার জন্য আরও চারটে হাত অন্তত পাওয়া যায়। এটাই তো ওর মনোগত বাসনা!

কত সময় নিচ্ছে ওরা সেরে উঠতে! কঙ্কালসার চেহারা নিয়ে বিছানায় মিশে আছে! ওরা যে সময় অজ্ঞান হয়ে বিছানায় পড়ে ছিল, তার মধ্যে দুনিয়াটা কত বদলে গেছে! ইয়াঙ্কিরা দাপিয়ে বেড়িয়েছে, ডার্কিরা পালিয়েছে, মা চলে গেছেন! এমন অবিশ্বাস্য এই তিনটে ঘটনা ঘটে গেছে, অথচ ওরা সেটা বুঝতেই পারেনি। কখনও ওরা ভাবে ওরা একটা ঘোরের মধ্যে আছে, আর এসব ঘটনা মোটেই ঘটেনি। আর স্কারলেটকে এতটাই অন্য রকম লাগছে যে ও কিছুতেই সত্যিকারের স্কারলেট হতেই পারে না! ওদের বিছানার পাশ দাঁড়িয়ে স্কারলেট যখন সেরে ওঠার পর কী কী কাজ করতে হবে তার ফিরিস্তি শুনিয়েছে, ওরা এমনভাবে ওর দিকে চেয়েছে যেন ও স্কারলেটের অশরীরী আত্মা! এখন যে হকুম তামিল করার জন্য একশটা ক্রীতদাস পেছনে পেছনে ঘুরছে না, এটা ওরা বুঝতেই চাইছে না। ও’হারা পরিবারের মেয়েকে কায়িক পরিশ্রম করতে হবে, এটা ওদের কল্পনার বাইরে!

“কিন্তু দিদি,” ক্যারীন আদুরে গলায় ভয়ে ভয়ে বলল, “কী করে কাঠ কাটব? তাহলে তো আমার হাতের দফা রফা হয়ে যাবে!”

“তবে আমার হাত দ্যাখ,” ঠোঁটের কোনে তিক্ত হাসি টেনে এনে বলল। ফোস্কাপড়া হাতদুটো ওর সামনে বাড়িয়ে ধরল।

“তুই নিশ্চয়ই বোন আর আমার সঙ্গে কুৎসিত ব্যবহার করছিস,” স্যুয়েলেন চেঁচিয়ে উঠল। “আমার ধারণা মিথ্যে কথা বলে তুই আমাদের ভয় দেখাতে চাইছিস! এখানে মা থাকলে কখনোই আমাদের সঙ্গে তোকে এভাবে কথা বলতে দিত না! কাঠ কাটতে হবে! কী কথা!”

দুর্বল চোখে স্যুয়েলেন স্কারলেটের দিকে তাকাল। দু’চোখে ঘেন্না। মনে মনে ভাবল, এসব স্কারলেটের শয়তানি। মরতে বসেছিল স্যুয়েলেন। মা চলে গেছেন। একলা লাগছে ওর। ভয় লাগছে। মন চাইছে কেউ ওকে সান্ত্বনা দিক। আর তার বদলে কিনা এরকম শয়তানি! রোজ ওদের বিছানার পাশে এসে সবুজ চোখের বাঁকা দৃষ্টি দিয়ে দেখবে কতটা সেরে উঠল ওরা। আর বিছানা পাতা, রান্না করা, বালতি করে জল তোলা, কাঠ কাটা এসবের ফিরিস্তি শোনাবে! দেখে তো মনে হয় এসব বিটকেল কথা শুনিয়ে স্কারলেট বেশ তৃপ্তি পায়!

তৃপ্তি স্কারলেট সত্যিই পায়। কেবল মাত্র দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ আর ক্লান্তি থেকেই যে নীগ্রোদের ওপর জবরদস্তি বা বোনদের খোঁটা দিয়ে কথা বলে, তা কিন্তু নয়। এটা করলে কিছুক্ষণের জন্যেও অন্তত হতাশাকে দূরে সরিয়ে রাখা যায়। নিজেকে বোঝানো যায়, মায়ের দেওয়া উপদেশগুলো এরকম সময়ে কাজে লাগানো যায় না।

যা যা মা শিখিয়েছেন, আজ সেগুলো আজ সেগুলো কোন কাজে আসবে? দ্বিধাদ্বন্দ্বে জর্জরিত হয়ে পড়ে স্কারলেট। বিহ্বল হয় মনে মনে। সভ্যতার পতন যে এলেনের কল্পনার বাইরে ছিল, এই কথাটা স্কারলেটের মনে আসেনি। যে পরিবেশে উনি মেয়েদের বড় করে তুলেছিলেন ভাল মানুষ হবার শিক্ষা দিয়েছিলেন, একদিন যে সেই পরিবেশ তছনছ হয়ে যেতে পারে, সেকথা ভাবতে পারেননি। এটাও স্কারলেটের মনে আসেনি যে এলেন নিজের নিস্তরঙ্গ জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে মেয়েদের সামনেও এক সুস্থির ভবিষ্যতেরই কল্পনা করে নিয়েছিলেন। তাই ওদের ভদ্র, সদয়, আত্মমর্যাদাসম্পন্ন, সহানুভূতিশীল, নম্র আর সৎ হতে শিখিয়েছিলেন। সেই সময় এলেন বুঝিয়েছিলেন, যে সব মেয়ের মধ্যে এইসব গুণ থাকে, সমাজ তাদের সম্মানের আসনে বসায়।

তীব্র হতাশা নিয়ে স্কারলেট ভাবল, “মা যা কিছু আমাকে শিখিয়েছিলেন, তার কিছুই – কোনো কিছুই – আমার কাজে আসবে না! দয়া দেখিয়ে কী কার্যসিদ্ধি হবে এখন? আর ভদ্রতারই বা কী দাম? এর চেয়ে ডার্কিদের মত লাঙ্গল চালানো শেখালে বা তুলো সংগ্রহ করতে শেখালে কিছু কাজের কাজ হত! ওহ্‌ মা, তোমার শেখানো সব কিছুই ভুল!”

এলেনের সময়ের সুশৃঙ্খল পৃথিবীটা যে হারিয়ে গেছে, সেটা স্কারলেট একবারের জন্যেও ভেবে দেখেনি। তার জায়গা নিয়েছে নিষ্ঠুর, নির্মম এক পৃথিবী, যার সব বৈশিষ্ট, সমস্ত মূল্যবোধ চেনা পৃথিবীটার থেকে আলাদা। ও কেবল বুঝল বা মনে মনে ভাবল যে বুঝতে পেরেছে যে ওর মা যা যা শিখিয়েছেন, সবই ভুলভাল। এই নতুন পৃথিবীর সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার জন্য তাই সময় নষ্ট না করে নিজেকে বদলে নিতে লাগল।

কেবল টারা নিয়ে ওর আবেগে কোনও বদল হল না। এমন একটা দিনও যায়নি, যেদিন তুলোর খেতের ভেতর দিয়ে ক্লান্ত শরীরে বাড়ি ফিরতে ফিরতে সাদা রঙের বাড়িটা দেখতে পেয়ে ঘরে ফেরার আনন্দে ওর হৃদয় উদ্বেল হয়ে ওঠেনি। শোবার ঘরের জানলা দিয়ে সবুজে ঘেরা চারণভূমি, লাল মাটির খেত আর আলিঙ্গনবদ্ধ বনানীর অপার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে যায়নি। এই রক্তরাঙা মেঠো প্রান্তর, ঢালু পাহাড়ে ঘেরা লালমাটির বিস্তীর্ণ প্রান্তর, ইটের গুড়ো মেশানো ধুলো আর গাঢ় সবুজ ঝোপের প্রতি স্কারলেটের ভালবাসা কমে যায়নি। এসব ওর সত্তার অংশ হয়ে পড়েছে। আর সব বদলে গেলেও এই ভালবাসার টান আগের মতই রয়ে গেছে।

পৃথিবীর আর কোনও প্রান্তেই এমন দেশটি খুঁজে পাওয়া যাবে না।

টারার দিকে তাকিয়ে স্কারলেট বুঝতে পারে, পুরোটা না হলেও, একটু একটু, লড়াই কেন বেঁধে যায়। লড়াই যে শুধুই টাকার লোভেই লাগে, রেটের এই ধারণাটা ভুল। লড়াই বাঁধে উর্বর জমি, সবুজ বনানী, অলসভাবে বহমান নদী, ম্যাগনোলিয়া ঘেরা বাস্তুভিটে আর লাল খেতের দখলদারি সাব্যস্ত করার জন্য। এসবের জন্য লড়াই করার একটা যুক্তি আছে। আজ যা ওরা ভোগ করছে, কাল সেগুলোই ওদের সন্তানরা ভোগ করবে, তারপর ওদের সন্তানদের সন্তানরা, এভাবেই চলতে থাকবে।

মা আর অ্যাশলে চলে যাওয়ার পর, আর মানসিক আঘাত পেয়ে বাপির ভারসাম্যহীন অবস্থায়, এই কয়েক একর পদদলিত জমিই ওর একমাত্র সম্বল। নীগ্রো ক্রীতদাস, টাকাকড়ি, নিরাপত্তা আর সামাজিক প্রতিষ্ঠা সব কিছুই রাতারাতি হারিয়ে গেছে। যেন অন্য একটা যুগের কথা মনে পড়ে গেল। বাপি যখন বলেছিলেন, এক খণ্ড জমির জন্য প্রাণ পর্যন্ত দেওয়া যায়, কথাটা বিশ্বাস করেনি। কত অপরিণত ছিল তখন, কত বোকা!

“জমিই এই সংসারে একমাত্র সম্পদ, যার কোনো মূল্য আছে!” জেরাল্ড চেঁচিয়ে বলেছিলেন। “কারণ এই মাটিই অনন্তকাল টিঁকে থাকে। এ কথা ভুলে যেও না। এটাই একমাত্র সম্পদ, যার জন্য কাজ করতে হয়, লড়াই করতে, দরকার পড়লে প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়।”

হ্যাঁ ঠিক কথা! টারার জন্য প্রাণ পর্যন্ত দেওয়া যেতে পারে। কথাটা মনের মধ্যে গেঁথে নিল। আজ আর যুক্তি তর্ক দিয়ে খণ্ডন করার চেষ্টা করল না। কেউ কখনও টারা ওর কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারবে না। কেউ পারবে না ওকে আর ওর পরিবারকে আত্মীয়স্বজনদের দয়া বেঁচে থাকার জন্য বাধ্য করতে। টারাকে রক্ষা করতেই হবে, আর তার জন্য যদি সবার ওপর ছড়ি ঘোরাতে হয়, তবে তাই সই!


(চলবে)

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ