অনুবাদ- ফারহানা আনন্দময়ী
নেভানো সিগারেটটা আমার দু’আঙুলের ফাঁকে গোঁজা ছিল, তাকিয়ে এরকমটাই দেখলাম। ঠিক জানি না আমি, কে ওটা ওখানে রাখলো; কিন্তু টের পাচ্ছি অনেকগুলো পোকা যেন কিলবিল করছে ওর মধ্যে। হাজার হাজার পোকা- কিছুতেই আলাদা করা যাচ্ছে না, সবই দেখতে প্রায় একই রকম। সিগারেটটা তো নিজেই একটা প্রবল পোকা আর সে আরো কতগুলো ছোট ছোট পোকাকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে পেট থেকে মুখে আনছে, মুখ থেকে ফুসফুসে! সেখান থেকে জোট বেঁধে মিশে যাচ্ছে রক্তে।
ওই প্রতিবেশী যতক্ষণ পর্যন্ত না চিৎকার করে উঠলো, আমি ঠিক বুঝতে পারিনি, গোলমাল কিছু একটা হয়েছে। আমি আদতে তখনো মারা যাইনি। গাড়ির হর্নের আওয়াজ কানের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল আমার! উঠে দাঁড়ালাম আমি, কাপড়ের ধুলো ঝাড়তে লাগলাম। আর হলো কী, পথচারী যারা আমাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে ছিল, ওরা কেমন যেন ভয় পেয়ে সরে যেতে লাগলো। তাদের মধ্যে একজন ভয়ার্ত গলায় ফিসফিস করে বললো, “এই দেখো, ওর নাক দিয়ে কত পোকা বেরোচ্ছে!”
“না। শুধু বেরোচ্ছে না। ওরা ছড়াচ্ছে।“ বলেই আমি অ্যাপার্টমেন্টের দিকে হাঁটা শুরু করলাম।
***
“তুমি একটা অসহ্য” আয়নার মধ্যে থেকে লোকটা তাকে বলে উঠলো।
সে-ও চাইলো লোকটা তাকে দেখে চিৎকার করুক। একটা চড় মারুক। মুখে থুতু ছুঁড়ে মারুক। কিন্তু ওই যে “তুমি অসহ্য” এই বলাটুকুই যেন এসবের সবটুকু করে দিলো। সে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে, হিমশীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো লোকটার দিকে। সে একবার ভাবলো, লোকটাকে আঘাত করবে যেন সে আরো কিছু বলে। কিন্তু লোকটা হাল ছেড়ে দিয়েছে ততক্ষণে। ও পেছনে সরে আসতে আসতে দেখলো, ওর গা থেকে অজস্র পোকা বেরিয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাচ্ছে! একইরকম দেখতে অগুণতি পোকার মাথা, সকলের মুখ দিয়ে সেই একটা কথাই বেরোচ্ছে, “অসহ্য, তুমি অসহ্য”।
***
এগুলো সব হয়ে উঠলো ওর জন্য একটা ভীতিকর স্বপ্ন। প্রতিরাতে, প্রতিক্ষণে টুকরো টুকরো ভয়ার্ত মুখের আদল হয়ে সেগুলো ফিরে ফিরে এলো। কখনো কপালের একটা অংশ! কিংবা চোখের একটা পাশ! আবার কখনো চিবুকের খানিকটা কিংবা নাকের কিছু অংশ! ফিরে ফিরে এলো।
খানিক পরে তার ঘুম ভেঙে গেল ভয় পেয়ে। ধাতস্থ হয়ে সে ঠিক করলো, আচ্ছা, এই টুকরো টুকরো ভয়ের স্বপ্নগুলোকে যদি জোড়া লাগানো যায়! মানে ক্যানভাসে এঁকে ওদেরকে একটা রূপ দিতে চেষ্টা করলো। আয়নার মধ্যে যে মানুষটাকে সে দেখে, তাকে পুরোটা আঁকতে চাইলো। কিন্তু যেই না অর্ধেকটা আঁকা শেষ হয়, ঠিক তখুনি তার হাতটা অসাড় হয়ে আসে। আর আঁকতে পারে না। ছবিটা অর্ধেকই রয়ে যায়। বাকি অর্ধেক কখনোই আর আঁকা হয়ে ওঠে না।
এরপর স্বপ্নটা যখনই দেখে, সে আর ঘুম থেকে উঠতে চায় না। ইচ্ছে করেই ঘুমের মধ্যে শুয়ে থাকে। ভাবে, এভাবে থাকলে হয়তো ওই মানুষটাকে আরো বেশিক্ষণ দেখতে পাবে। টুকরোগুলোকে আরো জমাট করে একত্রে বেঁধে ফেলা যাবে। নিজেকেই সে বলতে থাকে, “ধৈর্য ধরো। চুপ করে শুয়ে থাকো। চোখ খুলো না।“ স্বপ্নের মধ্যেই সে জোরজবরদস্তি করতে থাকে, লোকটাকে চেপে ধরতে চায়, নখ দিয়ে আঁচড়িয়ে ওকে ক্ষত বিক্ষত করতে চায়। দেয়ালের সাথে সেঁটে ধরে ওর পুরোটা দেখতে চায়।
কিন্তু প্রত্যেকবারই সে জেগে ওঠে আর ছড়িয়ে থাকা টুকরোগুলো ছড়ানোই পায়। কিছুতেই আর এক করতে পারে না। তীব্র অস্থিরতা নিয়ে সে জেগে ওঠে, ঘামতে থাকে আর আবারো সেই ভাঙা টুকরোগুলোকেই ক্যানভাসে আঁকবার চেষ্টা শুরু করে।
***
বিছানা ছেড়ে আমি এইবার স্টুডিয়োতে যাই। আশ্চর্য! গিয়ে দেখি আমার অসম্পূর্ণ ছবিটা ক্যানভাসে আঁকা হয়ে আছে। পুরোটা। যেভাবে আমি দেখতে চেয়েছি, ঠিক সেভাবেই। প্রতিটা মুখাবয়ব যেন আমার দিকে তাকিয়ে কথা বলছে। এবার কাউচের দিকে এগোই। আরে! সেখানে গিয়ে দেখি মনিকা বেলুচি শুয়ে আছে! ওর পাশে গিয়ে বসি আমি। চুলের মধ্যে আঙুল বুলিয়ে দিই। ওর স্তনস্পর্শ করি। এরপর মেতে উঠি উদ্দাম সঙ্গমে।
বাইরে কিসের যেন আওয়াজ হয়। এগিয়ে যাই। দেখি অ্যাপার্টমেন্টের ঠিক উল্টোদিকের বাড়ির ছাদে কতগুলো কিশোর-কিশোরী আনন্দ-উল্লাস করছে। পরীক্ষাশেষে পার্টি দিয়েছে। এই হইচইয়ের মধ্যেই পাশের বাড়ির বুড়ো আর্মি অফিসারটা বিরক্ত হয়ে ইলেক্ট্রিকের ফিউজ বন্ধ করে দিয়েছে! কী আর করা! ওরা অন্ধকারেই একে একে নেমে আসতে শুরু করলো ছাদ থেকে! প্রতিবেশীদের এই বিরক্তি প্রকাশটা এভাবেই ওদেরকে ঝিমিয়ে দিলো। আমিও ফিরে এলাম ঘরে, ওদের গানবাজনার আওয়াজ আর শোনা গেল না।
আমার ক্যানভাসে যে রঙ ধরেছিল একটু আগে, ফিরে এসে দেখি তা বিবর্ণ। আর ওই যে একটু আগে মণিকা ছিল যেখানে, সে দেখি টেবিলে একটা ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদমুখ হয়ে বসে আছে এখন। কাউচে ওর জায়গায় বসে আছে আরেকজন- সে ইনসমনিয়া!
***
ঘুমভাঙা চোখে সে সকালে উঠেই দেখলো, সামনের দেয়ালটা আর দেয়াল নেই। অদ্ভুত একটা বিস্তারি জায়গা, সীমানাহীন… সেখানে আলোর আভা, কিন্তু ঠিক আলোর মতো উজ্জ্বল নয়। ঝাপসা, অস্পষ্ট, শীতল। আরেকটু কাছে এগিয়ে গিয়ে সে ভালোমত বুঝতে চেষ্টা করলো। কিন্তু কিছু বদল হলো না। যা দেখছিল, তাই-ই রইলো। বেডসাইড টেবিল থেকে চশমাটা চোখে লাগিয়ে আবারো দেখলো। না। সেই একই। মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেয়ালের প্রান্তটা সে খুঁজতে চাইল, কিছুই পেল না। ভয়ভয় করতে শুরু করলো ওর। এবার সে বিছানা থেকে নেমে আসল রহস্যটা কী, সেটা অনুসন্ধান করবে বলে মনস্থির করলো।
ঘরের আলোটা জ্বাললে হয়তো বিষয়টা বুঝতে ওর সুবিধা হবে। সে কী! সুইচবোর্ডটা যে দেয়ালে থাকবার কথা, সেই দেয়ালটাই তো নেই! এবার মনে হলো, জানালাটা খুলে বাইরের বাতাস পেলে হয়তো মাথাটা ঠিকঠাক কাজ করবে। কিন্তু যে দেয়ালের গায়ে সেঁটে জানালা থাকে, সেই দেয়ালটাও তো নেই দেয়ালের জায়গায়! শেষমেশ ভাবলো এক কাপ কফি খাওয়া যাক! কিচেনের দিকে এগোতেই সে দেখলো যে দরজা দিয়ে বেরুবার কথা, কিচেনে যেতে- দেয়াল না থাকায় দরজাটাও অদৃশ্য এখন! আয়নাটা, সবসময় যে দেয়ালে টাঙানো থাকে, সেটাও অদ্ভুতভাবে শূন্যে ভাসছে! আর অসংখ্য টুকরো টুকরো মুখের অংশ- যারা সকলেই একইরকম দেখতে- হীমশীতল মুখে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
***
আমি প্রাণপণ চেষ্টা করছিলাম সাঁতরে উপর দিকে উঠবার, কিন্তু কিছুতেই জলের উপরের স্তরটা ছুঁতে পারছিলাম না। অতল টানছিল আমাকে শুধু। কিন্তু এরকম অবস্থায় যা হয় আর কী, দমবন্ধ লাগে, আমার কিন্তু ওরকম কিছু লাগছিল না। বরং হঠাৎ মনে হলো, আমি যেন মাছ হয়ে গেছি; আমার ফুসুফুসে মাছের মতো দুটো ফুলকো গজিয়েছে!
এরকম ভাবে ভেসে উঠবার চেষ্টার এক পর্যায়ে মনে হলো, আমি যেন একটা পথ খুঁজে পেলাম, হারিয়ে ফেলা পথ, যে পথে আমার অনেককিছু পড়ে আছে- যা আমি একদা হারিয়েছি। আমার ভালোবাসা, যে আমাকে ছেড়ে গিয়েছিল, তাকে পেলাম। খুঁজে পেলাম আমার মাকে, যাকে আমি হারিয়েছি আমার জন্মের সময়ে। সেই শিল্পীকে খুঁজে পেলাম, যে আমার শিল্পসত্তাকে তাচ্ছিল্য দেখিয়েছিল- নিৎসে, ওর মাথাটা ওরই হাতের তালুতে, আর ভ্রূদু’টো নাচছে ক্লাউনের মতো!
সাঁতরাতে সাঁতরাতে যেন ক্লান্ত হয়ে পড়লাম আমি একটা সময়ে- আবার কুকড়ে গেলাম মাতৃগর্ভের ভ্রূণের মতো!
ঠিক তখুনি কানে ভেসে এলো সেই প্রতিবেশীর চিৎকার, গাড়ির হর্নের আওয়াজ আর সেই মানুষের কোলাহল, যারা আমাকে ঘিরে জমায়েত হয়েছে!
***
প্রবল একটা চাপ অনুভব করতে লাগলো সে। শরীরের তরলগুলো তাকে এমনভাবে চাপ দিতে থাকলো যেন শরীর ফেটে বেরিয়ে আসবে সব। তার মনে হতে থাকলো, সে বুঝি মরেই যাচ্ছে। পা দিয়ে জোরে জোরে ধাক্কা দিচ্ছে, শ্বাস নেবার চেষ্টা করছে, পরিত্রাণ চাইছে এই অসহ অবস্থা থেকে- হঠাৎই তার পায়ুপথ দিয়ে যেন দমকা বাতাসের মতো বেরিয়ে গেল তীব্র ব্যথাটা! এতক্ষণ পরে সে প্রথম শ্বাস নিতে পারলো। এবং চোখ মেলেই ঘরের দেয়ালটাকে আবার দেখতে পেল দেয়ালের জায়গায়। কিন্তু সে দেয়ালে নেই সেই সুইচবোর্ড, জানালা, দরজা- নেই সেইসব। দেয়ালে শুধু ফিরে এলো আয়নাটা। আর সেই আয়নায় অজস্র মুখ, একইরকম দেখতে- তারা বিমর্ষ মুখে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
***
এরপর দ্বিতীয় ঘটনা যা ঘটলো, তার মনে হলো, ঘরের আলোটা ঝুলে নেমে এলো একদম তার নাকের ডগায়!
তৃতীয় ঘটনা হিসেবে সে শুনতে পেল বাইরে কতগুলো কুকুর ডাকছে।
চতুর্থ ঘটনা ঘটলো, তার বিছানাটা উলটে গেল! খাট-তোষক উলটে মেঝেমুখি হয়ে রইল। আর সে মেঝের দিকে তাকিয়ে নিজেকেই বললো, কতদিন বিছানার নিচটা পরিষ্কার করা হয়নি! ইশ্!
পঞ্চম ঘটনায় সে দেখলো, একটা ময়ূর হেঁটে যাচ্ছে তার পাশ দিয়ে! পাখনা মেলে দিয়ে তার দিকে তাকাতে তাকাতে সে হেঁটে চলেই গেল।
ষষ্ঠ ঘটনা হিসেবে ঘটলো, দিগন্তের ওপারে দূরে একটা শহর পুড়ছিল।
শেষবারের মতো সে যখন চোখ বুজে আবার খুললো, দেখলো, তার দু-আঙুলের ফাঁকে একটা সিগারেট গোঁজা আছে- আর সে বুঝতে পারছে ওটার মধ্যে হাজার হাজার পোকা কিলবিল করছে। অভ্যাসবশতঃ সে সিগারেটের মুখে আগুন ধরিয়ে টান দিলো কয়েকটা। আর কী মনে করে জানালার কাছে এসে মুহূর্তেই নিচে লাফ দিলো।
এবং ঠিক এর আগেই যে আয়নাটা সে ঘুষি মেরে দু’টুকরো করেছিল, সে আয়নায় আরেকটি অন্যরকম মুখচ্ছবি ভেসে উঠলো।
-----------------
মূল গল্প- হিশাম বুস্তানি, 'আ ফিউ মোমেন্টস আফটার মিডনাইট'
লেখক পরিচিতি: হিশাম বুস্তানির জন্মস্থান জর্ডানের আম্মান শহরে। আরবি সাহিত্যে পরাবাস্তব ধারার গল্পলেখায় তিনি সাড়া ফেলেছেন সমসাময়িক থিম, স্টাইল ও নিজস্ব ভাষারীতি ব্যবহার করে। এরইমধ্যে তার চারটি ছোটগল্পের গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। বুস্তানির গল্প পাঁচটি ভাষায় অনুবাদ হয়েছে। ইংরেজিতে অনূদিত গল্পগুলো আমেরিকা, কানাডা ও ইংল্যাণ্ডের বিভিন্ন বিখ্যাত পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। জর্ডানের শীর্ষস্থানীয় সমসাময়িক ছ’জন লেখকের মধ্যে তিনি অন্যতম। বুস্তানির তৃতীয় গল্পগ্রন্থ ‘The perception of meaning’ আরকানসাস বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেষ্ঠ অনূদিত আরবি সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছে।
হিশাম বুস্তানির এই ‘মধ্যরাত্রির খানিক পরে’ গল্পটিও সম্পূর্ণভাবে পরাবাস্তবতার ছায়ায় আবৃত। গল্পের ঘটনার সাথে বাস্তবের কিছুমাত্র মিল খুঁজে পাওয়া কঠিন।
1 মন্তব্যসমূহ
আমার তৃপ্তি , হিশাম বুস্তানিকে বাংলা ভাষায় আমিই প্রথম আনতে পেরেছি। এখন তিনি অনূদিত হচ্ছেন। এই অনুবাদ ভালো। গল্পপাঠকে ধন্যবাদ। হিশাম বুস্তানির একটি গল্প ও সাক্ষাতকার সংকলন বেরোচ্ছে সৃষ্টিসুখ থেকে।
উত্তরমুছুন