স্বামীর মৃত্যুর অনেকদিন হয়ে গেলেও মেরিনা এখনও কাঁদে। নাভির গোড়া থেকে কান্না উঠে আসে। ভেতরে ভেতরে দম বন্ধ হয়ে আসে। ঘর থেকে ছুটে বাইরে বেরিয়ে যায়। বাচ্চাদের খেলনার সঙ্গে হোচট খায়। ড্রয়িংরুমের কোট রাখার র্যাক এবং আয়নার স্ট্যান্ডের মাঝখানে লুকায়। ডান হাত কামড়ে ধরে, যেন কান্নার শব্দ চাপা পড়ে। কান্না থামলে দাঁত আলগা করে। কিন্তু ততক্ষণে তার হাতে গোলাকার কামড়ের দাগ বসে যায়। এটিকে দুমড়ানো-মোচড়ানো ডাকটিকেটের মতো দেখায়। মেরিনা কান্না থামানোর অনেক পর পর্যন্ত এই কামড়ের দাগ রয়ে যায়। স্বামীর মৃত্যুতে দুঃখ করতে করতে থেমে যাওয়ার অনেক পরেও এই দাগ রয়ে যায়।
তার মৃত্যুও পর ত্রিশ বছর কেটে গেলেও দুঃখটা এখনও প্রায়ই টন টন করে। যখন ববি ফিশারের নাম রেডিওতে শুনলো তখন এই কষ্টটা আবার বোধ করলো। এক মক্কেলের সঙ্গে দেখা করার জন্য সে বরফজমা ব্রুকলিন স্ট্রীট ধরে গাড়ী চালিয়ে যাচ্ছিল। অল্প সাউন্ড দিয়ে রেডিওটা চালু রেখেছিল। কিন্তু ঘোষকের মুখে ঐ নামের বার বার ঘোষণা শুনতে পাচ্ছিল। সাউন্ড বাড়িয়ে দিলো। আবারও ঐ নাম শুনতে পেল। ববি ফিশার। ববি ফিশার মারা গেছেন। আইসল্যান্ডের রেইকজাভিকে ববি ফিশার মারা গেছেন। মেরিনা এবার পাশের রাস্তা ধরল। তারপর পিচ্ছিল রাস্তা হামাগুড়ি দিয়ে দিয়ে এলিজার বাড়ির দিকে এগিয়ে গেল। এলিজার খালি ড্রাইভওয়ে থেকে বরফ সরানো হয়নি। অগত্যা দুইপাশে জমাট বরফস্তুপের মাঝখানে তাকে গাড়ি থামাতে হলো। সামনের দরজার কড়া নাড়লো। প্রত্যুত্তর আসার আগেই দরজা খুলে গেল। এলিজা চেয়ারে বসা। ছোটখাটো একজন মানুষ; চামড়ায় ভাঁজ পড়া। মাথায় ক্যান্সার হ্যাট পড়া। তাকে রাতে দেখাশুনার দায়িত্বরত নাদুস নুদুস মহিলা ভ্যা ভ্যা করে চলতে থাকা টিভির সামনে বসে ঝিমাচ্ছে।
মেরিনা নার্সের নাম ধরে ডাকে। জাগাতে চায়। এক রকম গর্জন করেই সে চোখ খোলে। মুখম-ল কুচকে যায়। ওর মুখে শুকিয়ে যাওয়া লালার দাগ লেগে আছে। ঘুমিয়ে পড়ে ধরা খেয়ে বিব্রত বোধ করে। ঘুম থেকে জাগানোর জন্য সে রাগ করে। একটু সময় নিয়ে হাত-পা গুটিয়ে নেয়। বুটের চেইন লাগায়। এরপর বাইরের দিকে এগিয়ে যায়। এলিজা টিভি দেখতে থাকে।
টিভির দিকে নির্দেশ করে এলিজা বলে, “ববি ফিশার আজ মারা গেছেন।” ১৯৭২ সালে ফিশার দর্শক সম্মুখে আসেন। বিশাল মুখম-ল। আঁচিলে ভরা। উদ্বিগ্নতায় স্পন্দিত। ‘তুমি কি জান, ও কে?”
“ওহ, হ্যাঁ,” মেরিনা বলে। ‘রাশিয়াতে আমি ঐ ম্যাচ দেখছিলাম।”
ও হাত ধুতে যায়। যখন ফিরে আসে তখন এলিজা চেয়ারে ধপ করে বসে পড়ে। ব্যাথ্যায় মুখম-ল কুঁকড়ে যায়। মেরিনা ওকে ট্যাবলেট এগিয়ে দেয়। নিজের জন্য কাপে কফি ঢালে। তারপর সোফায় বসে পড়ে। টিভিতে ১৯৭২ সালের ফুটেজ দেখাচ্ছিল। রেইকজ্যাভিক এবং মস্কোর জনতা বেশ উল্লসিত। সারা আমেরিকার সব মানুষ উত্তেজিত। আমেরিকানরা ‘ফিশার’ ‘ফিশার’ করে উল্লাস-প্রকাশ করছিল। আর রাশিয়ানরা ‘স্পাশকি’ ‘স্পাশকি’ করছিল।
“দেখ দেখ, ওরা কেমন উল্লাস করছে?” এলিজা বলে। “আমি চ্যালেঞ্জ করে বলতে পারি, তুমি স্পাশকির সমর্থক!” ওর কথাগুলো তিরস্কারের মতো শোনায়।
“সত্য কথা, আমরা ফিশারের সমর্থক”, মেরিনা বলে। ইতোমধ্যে এলিজা ঘুমিয়ে পড়েছে। মাথার ভার বহন করার জন্য ওর ঘাড়টা যথেষ্ট মজবুত নয়। মাথাটা এলিয়ে পড়েছে বুকের উপর।
১৯৭২ সালে মেরিনার সব বন্ধুবান্ধব ফিশারকে সমর্থন করেছিল।
রাশিয়ার সব ইহুদি, যারা নিজেদের উদারপন্থী বলে দাবি করে, তারা চেয়েছিল ফিশার জিতুক। ওদের কাছে যা কিছু খারাপ এবং ধাপ্পাবাজিতে ভরা, তার সবই রাশিয়ার সঙ্গে যায়। আর যা কিছু ভালো তার সবকিছুর প্রতিভূ যুক্তরাষ্ট্র। আঁচিলে ভরা গণতন্ত্রের বিশাল মুখমন্ডল।
মেরিনার স্বামী সের্গেই ছিল ফিশারের একাট্টা ভক্ত। “আমার বিশ্বাস হয় না যে, ওরা কীভাবে ওকে উপস্থাপন করে”, ‘প্রাভদা’ পত্রিকা খামছে ধরে সে বলে। পা-বাঁকা টেবিলের উপর এমনভাবে পত্রিকায় থাপ্পর বসিয়ে দেয় যে, পাঁচ বছরের সাশা লাফিয়ে ওঠে। “শালা বেকুব কোথাকার! লোকটা কিন্তু তুখোড় প্রতিভাধর।”
“শ-শ!” সের্গেই যখন সাশার সামনে এভাবে ঘৃণা প্রকাশ করে, তখন মেরিনা তার সঙ্গে এভাবেই শব্দ করে থামতে বলে। যদিও সে এ ব্যাপারে সার্গির সঙ্গে একশত ভাগ একমত।
সোভিয়েত রাশিয়া সম্বন্ধে এমন অনেক বিষয় আছে যা এদের কুঁড়েকুঁড়ে খাচ্ছে। অনেক মিথ্যা, অনেক অপমান। তা সেটা ছোট হোক বা বড় হোক। আসল কথা হলো মেরিনাকে স্কুলে নেওয়া হয়নি, কারণ সেখানে ইতোমধ্যে একজন ইহুদিকে নেওয়া হয়েছিল। বিদেশে সার্গিকে একটি বিজ্ঞান বিষয়ক কনফারেন্সে যোগ দিতে দেওয়া হয়নি, কারণ সে পার্টির সদস্য ছিল না। অর্থাৎ, তাকে মাংস, টয়লেট পেপার বা আন্ডারপ্যান্ট কেনার জন্য লাইনে দাঁড়াতে হতো। একেবারে ধবধবে সাদা আন্ডারপ্যান্ট। ওগুলো খুব একটা ভালোও নয়। মুভি বা ম্যাগাজিনে দেখা আন্ডারপ্যান্টের রং মেরিনার ভালো লাগত। হলুদ, নীল এবং সবুজ রং করা গাড়ি ওর ভালো লাগত। গোলাপি রং করা বাড়ি, আসমানী রংয়ের সুইমিং পুল, লাল ব্রা এবং ক্রীম রং এর লিপস্টিক ওর পছন্দের ছিল।
দৈনন্দিন জিনিসপত্রের ব্যাপারে সোজাসাপটা ঈর্ষা ওর ভেতরে ভেতরে এক ধরনের অস্থিরতা তৈরি করেছিল। ওর মনে হতো, ও যেন কোন নিরানন্দ, নিকৃষ্ট দুনিয়ায় বন্দী আর অন্য সবাই উল্লাসে ভরা চমৎকার জীবনযাপন করছে। সের্গেই বিষয়টাকে জোরালোভাবে গ্রহণ করে। শৈশব থেকেই সের্গেই স্বাধীনতাহীনতা বোধ করে। সে তার চশমার ফ্রেম একটু ঢিলা রাখতে পছন্দ করে। যাতে ওর নাকের উপর সামান্যতম চাপও না পড়ে। ও কখনও হাতমোজা পড়ত না। প্রচন্ড শীতেও না। কারণ, হাতমোজা পড়লে ওর আঙ্গুলগুলো শক্ত হয়ে যেত। সাশা ঠিক ওর মতো হয়েই বেড়ে উঠছে। বা ওর চেয়েও খারাপ। ও কখনও টাই পরে না। উঁচু কলারের জামাও না। আর পায়ের মাপের অর্ধেক বড় জুতো কেনে।
১৯৭১ সালের শরতে সের্গেই ওকে বলল, অভিবাসনের ব্যাপারে ওদের গুরুত্বের সঙ্গে ভাবা দরকার। ওদের কিছু বন্ধুবান্ধব দেশত্যাগের প্রক্রিয়া শুরু করেছে। কেউ কেউ ইতোমধ্যে চলেও গেছে। ওদের তো হারানোর কিছু নেই। মেরিনার বাবা-মা মারা গেছেন। সার্গির বাবা-মার আরও দু’টো ছেলে আছে। সের্গেই মেধাবী রসায়নবিদ। ইউএসএ.তে সে অবশ্যই ভালো একটি চাকুরি পাবে। ওখানে সফল হওয়ার সীমাহীন সুযোগ আছে। এর সঙ্গে শুধু মেধা আর দৃঢ় সংকল্পের যোগ থাকলেই হয়। ও বলল, ওরা ইসরাইলে যাওয়ার ভিসা পেয়ে যাবে। ওখান থেকে যাবে ইউরোপে। তারপর ওখান থেকে যাওয়ার চেষ্টা করবে ইউএসএ- তে। কাজটি কঠিন। তবে অসম্ভব নয়। সবচেয়ে কঠিন কাজটি হলো সোভিয়েত ইউনিয়নের বাইরে যাওয়া। অনেকের আবেদন খারিজ হয়ে গেছে। ওদের বন্ধু অ্যান্ড্রি এবং নীনা বটকিনের আবেদন খারিজ হয়ে গেছে। এখন ওরা মারাত্মক রকমের ছন্নছাড়া অবস্থার মধ্যে বসবাস করছে। সোভিয়েত সরকারের চোখে ওরা এখন অযাচিত ব্যক্তি। ওদের দু’জনেরই চাকুরি চলে গেছে। অ্যান্ড্রি দূরের একটি রিসোর্টের দেয়াল রং করার কাজ করে, আর নীনা একটি বধীর স্কুলে পরিচ্ছন্নকর্মী হিসেবে কাজ করে। ওদের ছেলে কলিয়া কিন্ডার গার্টেন স্কুল থেকে বহিস্কৃত হয়। সে এখন ওর স্নায়ু বৈকল্যে ভোগা দাদীর তত্ত্বাবধানে আছে। মেরিনা এসব ভেবে ভয়ে আঁতকে ওঠে। সার্গিরও একই অবস্থা।
ভিসার জন্য আবেদন করা ওদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হবে কি-না, তা ভেবে ভেবে ওরা পুরো শীতকাল আর বসন্তেরও একটি অংশ কাটালো। মে মাসে, যখন স্পাশকি এবং ফিশারের ম্যাচের খবর একটি ঠান্ডা যুদ্ধ হিসেবে পত্রপত্রিকায় ছাপা হলো, তখন সের্গেই উত্তেজিত হয়ে বলল, সে চায়, এই ম্যাচটাই তাদের ভাগ্য নির্ধারণ করুক। ফিশার জিতলে ওরা দেশত্যাগের অনুমতির জন্য আবেদন করবে। যদি সে হেরে যায় তবে ওরা সোভিয়েত রাশিয়াতেই থেকে যাবে। মেরিনা এটিকেও গুরুত্বের সঙ্গে নেয়নি। গ্রীষ্মেও অবকাশ কাটানোর জন্য সে গ্রামে একটি বাড়ি খুঁজতে শুরু করলো।
ওসেলকি গ্রামে সে একটি বাড়ির খোঁজ পেল। স্টেশনের পাশে একটি পাহাড় ঘেষে এর অবস্থান। “আমরা বারান্দা থেকে তোমাকে আসতে দেখতে পাব, “সে সার্গিকে বলল। বাড়িটা দেখতে জঘন্য। পুরোটা ধূসর। দরজা-জানালার গোলাপী রং চটে গেছে। তবুও মেরিনার মনে ধরল।
ওসেলকি মস্কো থেকে তেত্রিশ কিলোমিটার দূরে। আর রেইকজাভিক থেকে তেত্রিশ শ’ কিলোমিটার দূরে। সময়ও চারঘন্টা এগিয়ে। সার্গিই এই দূরত্ব আর সময়ের ব্যবধান মাপযোগ করে বের করল যেন যথাসময়ে ম্যাচটা উপভোগ করা যায়। ‘সাতটা। এখন এখানে সাতটা বাজে, “ঘুম থেকে উঠেই বিড়বিড় করতে করতে বলল। “এখন রেইকজাভিকে ভোর তিনটে বাজে। ফিশার আর স্পাশকি অবশ্যই এখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।”
মেরিনা গোঙানি দিয়ে বিছানা ছেড়ে ওঠে। রাতে পরা পোশাকের উপর একটি চাদর জড়িয়ে নেয়। এরপর দৌড় দিয়ে বাইওে যায়। উষ্ণ সকালে ফুলের উপর জমে থাকা শিশির ধোঁয়ার মতো উবে যেতে থাকে। এখানে সেখানে খাবলা খাবলা হয়ে জন্মানো ঘাস ওকে মৃদু আনন্দ দেয়। বারান্দায় বসে ওরা সকালের নাস্তা সেরে ফেলে। সকালের নাস্তায় একটু রুটি আর চিজ খেয়েই সের্গেই খুশি। এরপর দৌড় দেয় স্টেশনে। তবে সাশা শুধু পুডিং খেতে চায়। মেরিনা পুরাতন ট্যাপ খাওয়া পাতিলে পুডিং জ্বাল দেয়। তারপর অগভীর বাটিতে ঢালে। এর উপর একতাল হলুদ মাখন দেয়। এরপর এগুলোর প্রত্যেকটির ভেতর দেয় আপেলের জেলি। সাশা এর উপরে থাকা প্যাঁচানো প্যাঁচানো নরম অংশটা আগে ধীরে ধীরে খেয়ে নেয়। শেষে খায় নীচের অংশ।
সকালের নাস্তা সেরে মেরিনা সাশা’কে বাগানে নিয়ে যায় গাছ থেকে বেরি ফল পাড়তে। জুলাইয়ে পাড়ে স্ট্রবেরি আর আগস্টে ব্লুবেরি। সাশার একটা ছোট্ট প্লাস্টিকের পাত্র আছে। আর মেরিনার সঙ্গে একটি বড় অ্যালুমিনিয়ামের জগ। ব্লুবেরি কিভাবে বোঁটার সঙ্গে লেগে থাকে, তা দেখতে সে খুব পছন্দ করে। বাড়ি ফিরে সাশা খেলনা তৈরির কাদা নিয়ে খেলে, আর মেরিনা বেরি ফলগুলো পরিষ্কার করার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। বেরিগুলো ছোট ছোট, ভেজা। এগুলোর আবার কিছু কিছু ইতোমধ্যে পঁচে গেছে। কিছু কাঁচা। এগুলো পরিষ্কার করতে অনেক সময় লাগে। মেরিনা তাতে কিছু মনে করে না।
দুপুরের খাবারের পর সাশাকে ঘুমাতে পাঠানোর পূর্বে এক এক করে ওর পোশাক-আশাক খুলে নেয়। ওর প্যান্টে বাগানের মাটির গন্ধ। সোয়েটারে খেলনা বানানোর কৃত্রিম কাদা লেগে থাকে। আর শার্টে আপেল জেলি। সাশার পুরো শরীর জুড়ে যে গন্ধ লেগে থাকে, তা মেরিনা কেমন পছন্দ করে, সেটি ভাষায় বর্ণনা করা যাবে না।
যখন সাশা ঘুমায়, সেই সময়টা সে তার গবেষণার কাজে ব্যয় করে। ১৯৭২ সালের গ্রীষ্মকাল পূর্বের যেকোন বছরের চাইতে বেশি গরম। সাশা দিনের এই সবচেয়ে গরম দুপুরে হালকা ঘুমিয়ে নেয়। তবে বাগানে ওর খুব একটা খারাপ লাগে না। ওখানে গাছের নীচে একটি কম্বল বিছিয়ে মেরিনা একটি বই নিয়ে শুয়ে শুয়ে পড়ে। সে এই গ্রামের বাড়িতে একটি টাইপ রাইটার মেশিন আর পাঁচ ঝুড়ি ভর্তি বই এনেছে। বইগুলো মানুষের আচরণগত মনস্তত্ত্বের উপর। কাজ না করার জন্য সের্গেই মেরিনাকে বকা দেয়। “আমি আমার গবেষণা করছি,” ও বলে। কিন্তু বইটা প্রায়ই হাত থেকে কম্বলের উপর নামিয়ে রাখে। কাত হয়ে শুয়ে সামনে কালো ঝুরঝুরে মাটির দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। যখন সাশা ওর পেটে তখন ওর মাটি খাওয়ার অদ্ভূত এক অভ্যেস তৈরি হয়েছিল। এই মুহূর্তে সে যা চায় তা হলো সের্গেই বাগানে আসুক আর ওর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কে মিলিত হোক। শরীরটা মাটির সঙ্গে লেপ্টে থাকবে। প্রথম প্রথম মাটির উষ্ণতা অনুভব করবে। তারপর ধীরে ধীরে শীতলতা অনুভব করতে করতে মাটির সঙ্গে মিশে যাবে।
মেরিনা তার এই কল্পনা কখনই সার্গির সঙ্গে শেয়ার করেনি। ওরা আসলে কখনও সেক্স নিয়ে কোন কথাই বলে না। কথা বলার দরকারও নেই।
প্রতিরাতেই মেরিনা বারান্দায় দাঁড়িয়ে সার্গির জন্য অপেক্ষা করে। ওর ট্রেন এসে পৌঁছে সন্ধ্যে সোয়া ছয়টায়। রেইকজাভিকে তখন মাত্র সোয়া দুইটা। আসলে রেইকজাভিকে কয়টা বাজলো কি বাজল না, তা নিয়ে ওর তেমন কোন মাথা ব্যথা নেই। সের্গেই কষ্ট করে ব্যাগ বয়ে আনে (রুটি, মাখন, মুরগী এবং ফলমূল। গ্রামের দোকানে অবশ্য খুব বেশি কিছু নেই পাওয়া যায় না)। কিন্তু ওর পীঠটা থাকে সবসময় সোজা। যেন ভান করে বুঝাতে চায়, এই ব্যাগের ওজন ওর কাছে তেমন কিছুই নয়। সেবার গ্রীষ্মে ও দীর্ঘ দাড়ি রাখে। তরুণ মুখে এই দাড়িতে ওকে হাস্যকর দেখায়। ওর সাদা শার্ট ঘামে ভিজে যায়। হাতের নীচে দাগ পড়ে যায়। পেছনেও। এমনি তেই তো ও হ্যাংলা, লিকলিকে। এই অবস্থায় ওকে আরোও লিকলিকে দেখায়। মেরিনা যখন ওর বাহুতে গলিয়ে পড়ে দু’হাত দিয়ে ওকে আলিঙ্গন কওে, তখন দেখে, ও কতটা নাজুক। সে ওর শিরদাড়ার কশেরুকাগুলো গুণতে পারে।
সাশা হঠাৎ করে পেছনের ঝোপ থেকে লাফিয়ে বের হয়। বাবাকে খেলনা পিস্তল দিয়ে গুলি করে। কখনওবা নাকের নীচে শুয়োপোকা ধরে নাড়ায়। আবার কখনও কখনও বাবার পা ধরে চিৎকার করে বলে , “বাবা! বাবা!” এরপর আবার খেলতে চলে যায়। তখনও মেরিনা তার স্বামীর বাহুপাশে আবদ্ধ থাকে। যেন জমে যায়। “দুষ্টু”, সের্গেই বলে। তারপর ওর দিকে ঝুঁকে কাঁধে চুমু দেয়। সে-ও ওকে আরও শক্ত করে আলিঙ্গন করে।
মাঝে মাঝে সের্গেই ওকে ‘আমার বাটার মিল্ক কাউ’ বলে সম্বোধন করে। কিন্তু কেন তা সে জানে না।
“মা, এতো ভয়ানক ব্যাপার!” মেরিনা যখন অনেক বছর পর এ কথা ওর মেয়েকে বলে তখন মেয়ে এরকম প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। “তার মানে, সে বুঝাতে চাইতো যে, তুমি মোটা!”
নাহ, আসলে সে বুঝাতে চাইতো যে, সে তাকে ভালোবাসে। তবে বিষয়টি তার মেয়েকে বুঝাবে কীভাবে, তা সে জানে না। সে সাশাকে “শব্দের মাস্টার” এবং “উন্নাসিক” বলত। ওকে যেকোন কিছুর চাইতে অধিকতর বেশি ভালোবাসত।
ওই গরমের সময়ে যেমন দরকার সেরকম খাবারই তারা রাতে খেত – সবুজ বাঁধাকপির স্যুপ, ঠান্ডা আলু, ফলের রস, আর বেরি দিয়ে সাওয়ার ক্রিম। সের্গেই এত হাউমাউ করে খেত যে ওর দাড়িতে অল্পবিস্তর খাবার আটকে যেত। আর স্যুপ তো ওর শার্টে গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ত।
স্যুপ খাওয়ার পর ওর প্রাভদা পত্রিকা পড়ার সময়। প্রতিদিন রেইকজাভিকের নতুন নতুন খবর ছাপা হতো এতে। প্রত্যেকদিন রাতের খাবারের টেবিলে আলোচনার বিষয় ছিল দাবা।
“দেখ, দেখ, ওটা দেখ!” সের্গেই বলল। কাটাচামুচ দিয়ে খবরের কাগজের একটি পাতার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলে।
“ম্যাচটা হবে কি-না, তা এখনও পরিষ্কার নয়।” আজ আবার ফিশার আয়োজকদের কাছে উদ্ভট সব দাবি-দাওয়া করে বসেছে।’ ওরা ওকে ‘অর্থলোভী জারজ’ বলে উপস্থাপন করার চেষ্টা করছে!”
মে মাসে এসে সের্গেই যখন বলল যে, ম্যাচের ফলাফল তাদের ভাগ্য নির্ধারন করতে যাচ্ছে, মেরিনা ধরে নিলো, সে মজা করছে। এখন ক্রমবর্ধমান উদ্বিগ্নতা দেখে ওর মনে হলো যে, নাহ, ও মজা করেনি।
“আমরা হেরে গেছি! ফিশার হেরে গেছে। আমি নিশ্চিত, ওরা ওর ওপর অনেক চাপ সৃষ্টি করেছিল।”
“আমরা আবার হেরে গেলাম! ফিশার খেলতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। কাজেই, স্পাশকি বিনা যুদ্ধে জিতে যায়। বিষয়টি খু-উ-ব অশোভন।”
“আমার মনে হয়, রেইকজাভিকের সোভিয়েতদের তার জন্য কিছু একটা করা উচিত ছিল।
“ওরা বলে, ফিশার ম্যাচ বাতিল করার হুমকি দিচ্ছে! কারণ, ও সন্দেহ করছে যে, ওর রেইকজাভিকের ঘরটা ছারপোকায় ভরা। আমি নিশ্চিত ওর ঘর ছারপোকা বোঝাই।”
শীঘ্রই সাশা রেইকজাভিক বলা শিখে গেল। ও নামটা এমনভাবে উচ্চারণ করে যেন এটি পরীর গল্পের কোন জন্তুর নাম, “রিক ইয়াভিক”। ডিনার শেষে সের্গেই কাচি দিয়ে প্রাভদা পত্রিকা চারকোণ করে কেটে কেটে সেগুলো নিয়ে বাড়ি বাইরে বৈঠকখানায় চলে যায়। সাশাকে নিয়ে সৈন্যদের গান গাইতে গাইতে মার্চ করতে করতে চলে যায়। ও যেন সোভিয়েত বিরোধী কাজে সাহসিকতা প্রদর্শন করছে। এ যেন শুধু টয়লেট পেপারের অভাব মেটানোর জন্য নয়, তার চেয়েও বেশি কিছু।
পরের দিন মেরিনা চাপা আনন্দ পায় প্রাভদার খবর পড়ে। ওদের বাইরের বৈঠকখানা বেশ প্রশস্ত এবং পরিচ্ছন্ন। বাজে গন্ধ নাই বললেই চলে। দিনের বেলা উপরের ছোট্ট একটি জানালা দিয়ে সূর্যের আলো আসে। এর পাশে বসে পড়ার জন্য যথেষ্ট জায়গা আছে। মেরিনা সবসময় বিনোদনের জন্য সংবাদপত্র পড়ে, তথ্য জানার জন্য নয়। লোকজন যে অতি প্রয়োজনে সংবাদপত্র পড়ে, যেমন সের্গেই পড়ে থাকে, তা মেরিনার খুব অপছন্দের। দেরিতে পাওয়া, অসম্পূর্ণ এবং প্রায়ই মিথ্যা সংবাদ এদের আপডেট রাখে বলে যে এরা বিশ্বাস করে, সেটিও মেরিনা ঘৃণা করে। বৈঠকখানার সেঁতসেঁতে, আর্দ্র পরিবেশে বসে পত্রিকা পড়তে মেরিনার খুব ভালো লাগে। “দশম গ্রেডের গালিয়া কলবাসিনা তরুণদের ট্রাক্টর চালনা প্রতিযোগিতায় জিতেছে। ট্রাক্টর চালনায় তার দক্ষতা ও জ্ঞান বিচারকদের মুগ্ধ করেছে। “স্লোবোদানের লোকজন তাদের শহরের গৌরবের ৪৫০তম বৎসর পালন করবে।” বলশই থিয়েটার মাদামা বাটারফ্লাই- এর প্রদর্শনী করবে সকালে এবং “সোয়ান লেক” এর প্রদর্শনী করবে রাতে। “দুনিয়ার মজদুর এক হও।”
এই খণ্ডখণ্ড সংবাদ পড়ার পর মেরিনার মন অদ্ভূত এক প্রশান্তিতে ভরে ওঠে। এই প্রশান্তির জায়গায় সে একা। যখন অন্য সবাই জীবনের টানে ছুটছে তখন এখানে সে একা বসে আছে। বাচ্চারা ট্রাক্টর চালনা প্রতিযোগিতা শেষ করেছে; বেলে ড্যান্স্যাররা নৃত্য করছে; স্লোবোদানের লোকজন উৎসব পালন করেছে এবং মজদুররাও এক হয়েছে। আসল কথা হলো, সোভিয়েত ইউনিয়ন নিয়ে সে খুব একটা মাথা ঘামায় না। ও মনস্থির করলো ফিশার হারলেও ওর বেশি কিছু আসে যায় না।
জুলাইয়ের মাঝামাঝির এক রাতে প্রাভদা পত্রিকা ভাঁজ করে উরুর সঙ্গে ঠেস দিয়ে নিয়ে সের্গেই বাড়ি ফিরল।
“আমরা জিতে গেছি,” মেরিনাকে দেখা মাত্রইসে চিৎকার করে বলল। সাশাকে কোলে তুলে নিয়ে শুন্যে ঘুরাতে লাগল।
মেরিনা প্রাভদা তুলে নিয়ে উল্টে-পাল্টে দেখতে লাগল। অবশেষে ছয় নম্বর পাতার নীচের দিকে ছোট্ট একটি খবর দেখল। ‘খবরটি বলছে না যে, ফিশার জিতেছে,” সে বলল।
“অবশ্যই,” সের্গেই হাসতে হাসতে বলল। ‘আমি খবরটি রেডিও লিবার্টিতে শুনেছি।”
“তুমি কিভাবে নিশ্চিত হলে যে, রেডিও লিবার্টি সঠিক খবর দিয়েছে?” সে জিজ্ঞস করল।
“তবে রেডিও লিবার্টির চাইতে প্রাভদাকে বেশি বিশ^াস করতে বলো না,” ঠাট্টার ছলে সের্গেই বলে।
“তুমি জান, আমি কিন্তু তা বলছি না। ফিশারের প্রথম জয় আমার কাছে বড় ব্যাপার। ওরা খবরটা প্রাভদাতে ছাপালে ভালো হতো। ওরা তো বিষয়টা এড়িয়ে যেতে পারে না।”
“ওহ, তাই নাকি?”সের্গেই জিজ্ঞেস করল। মেরিনার দিকে এমনভাবে তাকালো যেন এই প্রথম সে ওকে দেখলো। নিরাবেগভাবে সে তাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করল।
মেরিনা কল্পনা করে, সের্গেই যদি তাকে আর ভালো না বাসে, তবে তার অবস্থা কেমন হতে পারে। গরম স্বত্ত্বেও তার শরীরের ত্বক কুঁচকে গেছে।
প্রাভদা নিয়ে সে বাড়ি থেকে ছুটে বেরিয়ে যায়। ওই জায়গায় যেখানে গেলে ও শান্তি পাবে।
বাড়ির বৈঠকখানায় বসে উদ্দেশ্যহীনভাবে পত্রিকার পাতা উল্টাতে থাকে। সাশা লাঠি দিয়ে দরজায় কড়া নাড়ে। ‘মা, তুমি কি একটু বেরিয়ে আসবে?” মেরিনা উত্তর দেয় না। সে আবার দরজার কড়া নাড়ে। এরপর দরজায় মুখটা ঠেসে ধরে দুই তক্তার ফাঁক দিয়ে ভেতরে তাকিয়ে বলে, “আমি তোমাকে দেখতে পাচ্ছি! তুমি তো কিছুই করছ না। পড়ছ?”
মেরিনাকে বের হয়ে আসতেই হলো।
রাতে সার্গির সঙ্গে মেরিনার ঝগড়াটা বাড়ে। অবশেষে ক্রোধান্বিত হয়ে উভয়েই উষ্ণ বিছানায় নীরবে গা এলিয়ে দেয়। মেরিনা উসখুস উসখুস করছিল বলে সের্গেই অভিযোগ করে। মেরিনা ওকে লাথি মারে। বিছানা থেকে গড়িয়ে পড়ে যায় সার্গি। জানতে চায়, ও আসলে কী চায়। এরপর ওরা সংক্ষিপ্ত রতিক্রিয়ায় মেতে ওঠে। খুব একটা ভালো হলো না। সের্গেই ঘুমিয়ে পড়ে। কিন্তু মেরিনা বিছানা ছেড়ে উঠে বাইরে যায়।
বারান্দায় দাঁড়ায়। নিকষ কালো বাগানটার দিকে তাকায়। ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শোনে। ও দেশত্যাগ করতে চায় না। এখন ব্যাপারটা ওর কাছে পরিষ্কার। এর সঙ্গে আর একটি বিষয় পরিষ্কার। ও যদি অভিবাসী হতে না চায়, তবে ও সার্গিকে হারাবে।
তাপদাহ চরমে পৌঁছল। মস্কোর কাছে ময়লার ভাগাড়ে আগুন দেওয়া হয়েছে। গুটিগুটি পায়ে ধোঁয়ার মেঘ এগিয়ে আসছে গ্রামের বাড়িটার দিকে। গ্রামের দোকানে জড় হওয়া লোকজনের আলোচনার বিষয় এখন এই আগুন।
খবর বেরিয়েছে, বাড়ি-ঘরে আগুন লেগেছে। হাসপাতালগুলো আগুনে পোড়া মানুষে গিজগিজ করছে। মেরিনা সার্গির কাছে জানতে চায়, ওদের এখন মস্কোতে ফেরা উচিৎ কি-না। সের্গেই বলে, “নাহ”। পুরো শহর এখন হলুদাভ মেঘে ঢেকে গেছে। গরম এতটাই অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, সের্গেই দেখে, লোকজন মাঝে মাঝে সাবওয়েতে অজ্ঞান হয়ে পড়ছে। “ এখানে অন্ততপক্ষে সতেজ বাতাস তো পাচ্ছি,” সে বলে।
প্রাভদায় আগুনের খবর তেমন একটা ছাপা হয় না। মেরিনা পত্রিকায় বিপর্যয়ের খবর খোঁজে। কিন্তু সেখানে সে শুধু আইসক্রীমের খবর পায়: “তিন নম্বর আইসক্রীম ফ্যাক্টরিতে নতুন উৎপাদন লাইন বসানো হয়েছে। এতে আরও বেশি বেশি লোক মিষ্টি, ঠান্ডা বিনোদন উপভোগ করার সুযোগ পাবে।”
মেরিনা পত্রিকায় আইসক্রীমে ভরা ট্রে হাতে হাস্যজ্জ্বল একজন আইসক্রীম ইঞ্জিনিয়ারের ফটো দেখে। কল্পনা করে, সের্গেই ওর ঘাড়ের উপর দিয়ে গলা বাড়িয়ে পত্রিকা পড়ে আর ঢোক গিলে বলে, “মিষ্টি, ঠান্ডা, নাহ?”
জুলাই মাসের ২৪ তারিখে গরমে সাশা অসুস্থ হয়ে পড়ে। কাঁদতে থাকে। অভিযোগ করে বলে, “প্রতিবেশীরা চিকেন রোস্ট তৈরি করছে।” তারপর বমি করে। বাড়ি এতটাই তেতে ওঠে যে, দেয়ালও স্পর্শ করা যাচ্ছিল না। মেরিনা সাশাকে নিয়ে বাগানে যায়। ওকে ঠান্ডা চা পান করতে দেয়। সন্ধ্যার দিকে ও আগের চেয়ে একটু সুস্থ বোধ করে। মেরিনাকে বলে কাদা দিয়ে কিছু খেলনা প্রাণী তৈরি করতে ওকে সাহায্য করতে। কিন্তু ততক্ষণে মেরিনা খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। মেজাজও খিটমিটে হয়ে গেছে। রাতের খাবার তৈরি করতেও তার ভালো লাগছিল না।
সের্গেই আল্লাদে গদগদ হয়ে কাজ থেকে বাড়ি ফেরে। গতকালের ব্যাপারটি ঘুরে গেছে। ছয় নম্বর গেইমে ফিশার জিতে এখন এগিয়ে আছে।
“দেখ, দেখ!
এমনকি প্রাভদাও ফিশারের বিজয় স্বীকার করেছে,” সের্গেই মেরিনাকে বলে। ছয় নম্বর পৃষ্ঠায় বিরাট এক শিরোনাম: “ভুলের মাশুল দিতে গিয়ে স্পাশকি হেরে গেলেন।”
সেই রাতে খেতে বসে সের্গেই মেরিনার তৈরি স্যুপের প্রশংসা করে। তারপর বাটিটা মুখের কাছে ধরে দেয় একটা বড়সড় চুমুক। এক চুমুকে তলানিটুকুও শেষ করে ফেলে। সে দাবার রানী ঘুঁটির চাল, তার্তাকোয়ার ডিফেন্স, রাজার দিকের ঘুঁটির কাঠামো, আক্রমণ, প্রতিআক্রমণ এবং দাবার ব্যাপারে অন্যান্য যাঁরা অনভিজ্ঞ তাঁদের কথা বলে যায়। সেই সঙ্গে ফিশার খেলার সময় কতটা প্রচণ্ড এবং চমৎকার করে খেলে সে-কথাও বলে যায়। ওদের দাবার বোর্ড ছিল না। তাই সাশার প্রাণির অবয়ব তৈরির কৃত্রিম কাদামাটির বাক্স বের করে। এরপর সেগুলো টেবিলের উপর সাজিয়ে দেখায় রানীর চাল কী। মেরিনা বুঝতে পারে, দাবা খেলা সম্বন্ধে ওর ধারণা অস্পষ্ট। নীল বিড়াল চোখের দানবগুলো হলো নাইট। এবড়ো থেবড়ো লাল কুকুরটা হলো রানী এবং সবুজ শুকরছানা যার আগমন সারম্বরে ঘটেছিল সেটি হলো বিশপ। গরমে প্রাণিগুলো চটচটে হয়ে গেছে। বিড়ালগুলোর দাগ লেগে গেল সার্গির আঙ্গুলে। শুকর ছানার দাগ লেগে গেল টেবিলে। সের্গেই দাবা নিয়ে যতই গল্প করে, ফিশারের ততই প্রশংসা করে। মেরিনাও ততই ক্ষেপে যায়। সে চায়নি ফিশার জিতুক। সত্যি সত্যিই চায়নি। মনেপ্রাণে সে ফিশারকে ঘৃণা করে। ওর মনে হলো, সবগুলো প্রাণিকে ছেনেছুনে একেবারে কুৎসিত একটা ডেলা পাকিয়ে ফেলতে পারলে ভালো হতো।
সাশাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে ও বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। কিছুটা ঠান্ডা হয়েছে। আগের চাইতে ধোঁয়ার ঝাঁজ কিছুটা কমেছে। এখন এর গন্ধ ক্যাম্পফায়ারের মতো বা কয়লায় আলু পোড়ানোর গন্ধের মতো।
সের্গেই ওকে খুঁজতে বাইরে আসে। আলিঙ্গন করে কানে কানে বলে, ‘প্রিয়তমা, তুমি কি খুশি হওনি?”
মেরিনাও ওকে আলিঙ্গন করে বলে, সে খুশি।
এলিজা চোখ মেলে। “কিছু পান করবে?” মেরিনা জিজ্ঞস করে। “চা?” সে চা পান করতে চায় না। কিন্তু টিভির ভলিউমটা বাড়াতে বলে। এ পর্যায়ে অনুষ্ঠানটি ফিশারের জীবনের পরবর্তী অধ্যায়ের উপর আলোকপাত করছিল। ঊনিশ শ’ নব্বই এর দশক থেকে ওর ক্যারিয়ার মুখ থুবড়ে পড়ছিল। মুখভর্তি দাড়ি গজায়। পাগল হয়ে যায়। ও ইহুদিদের নিয়ে কথা বলতে পছন্দ করত। ইহুদিরা ছিল পরজীবী। ওরা শয়তান। ওদের ধ্বংস হয়ে যাওয়া উচিৎ। ওদের সবাই।
এলিজা মুচকি হেসে বলে, “ঐ যে তোমার ববি ফিশার।”
মেরিনা অবাক হয়, ভাবে, সের্গেই জানলে হয়তো হতাশ হতো।
ওরা যুক্তরাষ্ট্রে আসার এক বছর পর সের্গেই হৃৎযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যায়। তখন মেরিনার গর্ভে তিন মাসের কন্যা সন্তান। তখনও গর্ভপাত করা ওর পক্ষে সম্ভব ছিল। কিন্তু ও সন্তান নিতে সিদ্ধান্ত নেয়।
পায়ের কাছে একটি চিঠি দেখতে পায়। সম্ভবত সামনের দরজা দিয়ে কেউ ফেলে দিয়েছে।
“এলিজা, তোমাকে কি একটি কম্বল দেব?”
টিভির দিকে নির্দেশ করে সে মাথা ঝাঁকায়। “তুমি তো জান, আমি ওখানে ছিলাম।”
“কোথায়?”
“রেইকজাভিকে, ১৯৭২ সালে।”
“তুমি কি ফিশারকে দেখেছিলে?”
“হ্যাঁ, স্পাশকিকেও। আমি তখন নিউ ইয়র্ক টাইমস- এ কাজ করছিলাম। আইসল্যা- সুন্দর একটি দেশ। তবে ফিশারকে পাত্তা-টাত্তা দিতাম না।”
“দিতে না?”
“ও ছিল একটা হাঁদারাম। তখনও। সব রিপোর্টার ওকে ঘৃণা করত। দাবার সব লোক ওকে ঘৃণা করত। আমি ছিলাম স্পাশকির সমর্থক। ও ছিল ভদ্রলোক। তুমি কি জান, গেইম-৬ এ ও যখন হেরে যায় তখন ও কী কা- করেছিল?”
“কী?”
ও দাঁড়িয়ে ফিশারকে অভিনন্দন জানায়। এটিই তো খেলোয়ারোচিত আচরণ। ঐ ক্ষ্যাপা হাঁদারাম অবশ্য এমন ছিল না।
হঠাৎ মেরিনা ফিশারকে রক্ষা করার একটি তীব্র প্রয়োজন বোধ করে। শেষের সাক্ষাৎকারগুলোতে তাকে বিধ্বস্ত অসুস্থ এবং সন্ত্রস্ত বুড়োর মতো দেখাত। ওর জন্য মেরিনার করুণা হয়। ওর জন্য এক ধরনের বিকৃত টানও বোধ করে।
“আমার মনে হয় তুমি ফিশারের প্রতি খু-উ-ব নির্দয়,” ও এলিজাকে বলে। “আমিও ওকে ঘৃণা করতাম,” এর সঙ্গে যোগ করে ও আরও কিছু বলতে চাইল। কিন্তু ততক্ষণে এলিজা আবার ঘুমের কোলে ঢলে পড়েছে।
লেখক পরিচিতি: লারা ভাপনায়ার(Lara Vapnyar) একজন রুশ-আমেরিকান লেখিকা। বর্তমানে বাস করেন আমেরিকায়। জন্ম ১৯৭৫ সালে। লেখাপড়া করেছেন তুলনামূলক সাহিত্য নিয়ে। এ পর্যন্ত তাঁর চারটি উপন্যাস ও দু’টি ছোটগল্পের বই প্রকাশ পেয়েছে। ঊনিশ বছর বয়সে তিনি তাঁর জন্মস্থান রাশিয়ার মস্কো ছেড়ে আমেরিকায় অভিবাসী হিসেবে চলে যান এবং সেখানেই স্থায়ী হন। অভিবাসী হিসেবে তিনি নিজে যেমন তাঁর জীবনের অনিশ্চয়তা বোধ করেছেন, তেমনি তাঁর রচিত সাহিত্যকর্মের চরিত্রগুলোর মধ্যেও অভিবাসী-জীবনের স্মৃতিকাতরতা, শিকড়ছিন্ন হবার যাতনা ও দোদুল্যমানতা প্রকাশ পেয়েছে। অনুদিত গল্পটি লারা ভাপনায়ারের "Fisher vs Spassky" ছোটগল্পের বাংলা ভাষান্তর।
0 মন্তব্যসমূহ