ডেভিড মিন্সের গল্প: চেয়ার





সমকালীন আমেরিকান গল্প
বাংলা রূপান্তর – দোলা সেন


দিনের পর দিন ছেলেকে মানুষ করে তোলার প্রক্রিয়ায়, ছেলে যতো শিখছে, আমিও তার চেয়ে কম কিছু শিখছি না। আমি কখনোই চাইনি যে সে শুধু বাধ্য ছেলের মতো কথা শুনে চলুক। আমি সবসময় চাই সে তার পাঁচ বছরের নিষ্পাপ পবিত্র মনটা দিয়ে দুনিয়ার মূল বিষয়গুলো জেনে নিক।শুধু তাকানো নয়, চোখে চোখ রেখে সে তার নিজের অস্তিত্ব জানান দিক। বিনয় প্রকাশ করতে ততটুকুই মাথা নাড়ুক, যাতে স্পর্ধা বা বশ্যতা কোনোটাই না প্রাধান্য পায়। অতিরিক্ত লজ্জায় যেন ললিতলবঙ্গলতাটি না তৈরি হয়। (অবশ্য সে তা নয়ও!) আবার বয়ঃসন্ধিতে পৌঁছে সে যেন গোমড়ামুখো জেদী না হয়ে ওঠে – সেটাও আমাকে দেখতে হবে বৈকি! তা নাহলে পরে সে এক হতাশাগ্রস্ত সাবালক হয়ে উঠবে। সামনে যা কিছু আছে, তাকে খোলা মনে নেওয়াটা খুব জরুরি বলেই আমি মনে করি। যেমন ধরুন, বিকেলে বাগানের টিলায় উঠবার সময়, সে যখন আমার নির্দেশগুলোকে কিছুটা অগ্রাহ্য করে – তখন আমার একটা অংশ খুশি হয়। আবার, টিলার চূড়ো থেকে সে যখন বাগানের পাঁচিলেরর দিকে দৌড়ে নেমে যায়, তখন আমার আরেকটা অংশ তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, চেয়ারে আটকে ফেলার জন্য তৈরি থাকে।
“শিগগির চেয়ারে বসো বলছি! ওখানেই বসে থাকো চুপটি করে। চেয়ারটা তোমার জন্যেই রাখা রয়েছে!”
 
কিন্তু বলি না। আমার পছন্দ তার ছোটখাটো অবাধ্যতা, তার স্বাধীন ভাবনার বিকাশ।আজ বিকেলবেলার কথাই ধরুন। যতক্ষণে আমি বাগানের টিলাটার চূড়ায় পৌঁছেছি, ততক্ষণে সে সেখান থেকে উত্তরের থম্পসনস স্কচ পাইনের দিকে দৌড় দিয়েছে। শনশনে হাওয়ায় ওর বোতামখোলা কোটের কোণা (একটি অবাধ্যতা, যা আমি দেখেও দেখি না) পতপত করে উড়ছিল। আমার দিকে একনজর তাকিয়ে, দু হাত তুলে ও আনন্দে চিৎকার করে উঠল।

আমার ডানদিকে বাগানের নিচু পাঁচিলের পিছনে প্রায় মাইল তিনেক জুড়ে নদী নিজেকে ছড়িয়ে দিয়েছে। তার মাঝখানটিতে শান্তির ছদ্ম মুখোশে ঢাকা জোয়ার ভাঁটার মিলনস্থল। নদীর অপর পাড়ে এই শরতে, সোনালি আর হলুদ পাতার গাছেরা আকাশের নীলের সঙ্গে মিলে, নিজেদের ছায়া দেখায় মগ্ন। একাকীত্বের মায়া মাখানো মধুর শরতের বিকেলে, ছেলেকে নিয়ে আমার আরও একটি দিন কেটে গেল।
আগামী শীতের হিমের পরশ মাখা হাওয়া আমার বুকের ওপর খেলা করছিল। ক্রমেই সে আরও জোরালো হচ্ছিল। থম্পসনস স্কচের গাছগুলো পাখির কলকাকলিতে ভরে উঠছে। এমন দিনে আমি ছেলেকে শেখাই কি করে চোখে চোখ রেখে তাকাতে হয়, হিসু করার সময় কিভাবে তার ছোট্ট নুঙ্কুটা সোজা করে ধরতে হয়, যাতে বেসিনের বাইরে একটুও না পড়ে! অথবা কিভাবে কাঁটা চামচ ধরতে হয়, খাবার চিবাতে হয়.....।

এরাও আমার সুন্দর মুহূর্তের অংশ। আমি এই দিনগুলিকে ভীষণভাবে উপভোগ করি।
 
এরপর হাওয়া আরও তীব্র হবে। হলদে পুরোনো পাতাগুলোকে মুচড়িয়ে গাছ থেকে আলাদা করে ছড়িয়ে দেবে বাগানের ঘাসে। তারা সেখানে শুয়ে শুয়ে, শনিবারের সকালের জন্য অপেক্ষা করবে। সেদিন চার পাঁচজনের একটি দল এসে মেসিনের ঘর্ঘর আওয়াজে তাদের বিদায় দেবে।
 
সন্ধ্যা নামার পরে ব্রিজের ওপর আলো জ্বলে উঠবে। নদীর জলে তারি আঁকাবাঁকা ছায়া। আকাশে একটি দুটি করে তারা ফুটবে। ঘরের ভেতর জ্বলবে নিরাপত্তা মাখা নরম আলো। আমি জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে এই অনাঘ্রাত সৌন্দর্য উপভোগ করব। ভবিষ্যতের কথা ভাবব।
 
ভবিষ্যৎ? গানার একদিন বড় হয়ে যাবে। কলেজ, বিয়ে ...। সময়ের আবর্তে হারিয়ে যাবে আজকের মধুর দিবসযাপন। শুধু স্মৃতিতেই ধরা থাকবে তাকে খাবার খাইয়ে দেওয়া, সিটবেল্ট বেঁধে দেওয়া, ভুরুর কাটার উপরের সেলাইয়ের মুহূর্ত। কাশির দমকে কেঁপে ওঠা ছোট্ট বুক হাত দিয়ে চেপে ধরা... এমনি হাজারো ছোটখাটো...। আর, আর সেই যে প্রথম স্কুলে যাওয়া? লাল টুকটুকে মুখ – সেই প্রথম বিচ্ছেদের দিন!
 
এইসব ভাবনার মঝেই আমার পিতৃত্বের অনুভূতি আমায় দিয়ে দ্বিতীয় সাবধানবাণীটি বলিয়ে নিল। এবারেরটা বেশ জোরে। কে জানে, হয়তো প্রথমটা শুনতে পায়নি! হয়তো দৌড়ে নামার আনন্দে, হয়তো পাখির ডাক তার মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল (আমি তাকে ঘাড় ঘুরিয়ে গাছের পাখিদের দিকে তাকাতে দেখেছিলাম)। অবশ্য কোনদিনই বা সে একবারে কথা শুনেছে? আমি তাই দ্বিতীয়বার চিৎকার করে সাবধান করলাম। তারপরে একটু পিছন থেকে তাকে অনুসরণ করলাম। ওঃ, নিজের ভণ্ডামি দেখে নিজেরই হাসি পায়। এই নাকি ছেলেকে স্বনির্ভর হতে দেওয়া?

তাই, প্রাণপণে তিন নম্বর হুঁশিয়ারিটা – “ তুমি যদি পাঁচিলের খুব কাছে যাও, তাহলে চেয়ারে চুপ করে বসে থাকতে হবে” – চেপে গেলাম। বরং, সকালে জানলা দিয়ে নদীটাকে দেখার কথা ভাবার চেষ্টা করলাম। শ্যারন দু সপ্তাহ ধরেই অনেক দেরি করে, রাতের খাওয়ার সময় পার করে বাড়ি ফিরছে। হয় ট্রেন লেট, অথবা ব্রিজের ওপরের ট্রাফিক জ্যাম... নিঁখুত সব অজুহাত। আচ্ছা, ও কি জানে না যে, আমাদের জানালা দিয়ে ব্রিজটা খুব ভালোভাবে দেখা যায়?...
 
আমি বাগানের পাঁচিলটা দেখি। ওটা ভেঙে পড়ার মুখে। আমার একেক সময় সন্দেহ হয়, ঘাস মাটির ওজন আর কতোটা ও নিতে পারবে। কিন্তু সারাইয়ের খরচাটাও তো ...। মিস্তিরি ডেকে পুরোটা খুঁড়ে ফেলে নতুন করে বানাতে হবে।

রাতে শ্যারনকে বলছিলাম – পাঁচিলটাকে মোটামুটি যদি খুঁটি আর সিমেন্ট দিয়ে ঠেকা দেওয়া যেত....
 
কংক্রিট – শ্যারন আমাকে শুধরে দিয়েছিল।

বাগানের পাঁচিলে কংক্রিট? সিমেন্ট নয়? – আমি অবাক হয়ে ভাবছিলাম। শ্যারন অজুহাতগুলো পরপর সাজাচ্ছিল – প্রচুর খরচ, অফিসের ব্যস্ততা ...
 
“বাড়ি আর বাচ্চা দেখাশোনার লোক হিসেবে নিজের অবস্থানটা আমার কাছে অদ্ভুত ঠেকছে। এমন নয় যে আমি সেটা অপছন্দ করি। গানারের সঙ্গে সময় কাটাতে আমর ভালোই লাগে। তবু...” – আমি বলে যাচ্ছিলাম। আর সে ঠোঁট টিপে, তার সুন্দর দুটি চোখ দিয়ে আমায় অপলকে দেখছিল। ট্রয়ের হেলেনের মতো এই সৌন্দর্যের জন্যেও যুদ্ধ লাগতে পারে – আমি ভাবছিলাম। আমার এমন কিছু করতে ইচ্ছে করে, যাতে ওর নামও ইতিহাসের পাতায় জ্বলজ্বল করে। হেলেনকে নিয়ে যুদ্ধ বেঁধেছিল। আমিও, ওর জন্য একটা যুদ্ধ শুরু করে দিতেই পারি। এই সুন্দর মুখ, যা পুরুষের বুকে তুফান তোলে, আমি তার জন্য একটা কীর্তিস্তম্ভ গড়ার কথা ভাবি।

(জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকার সময়, তার মানহাটানের ব্যস্ততা আমি অনুভব করার চেষ্টা করি। গাড়ি থেকে নামার সময় তার কোমরের দুলুনি, থুতনিতে নরম আঙুল চেপে, আমার সারাদিনের কথা মন দিয়ে শোনার ভঙ্গিমা, আমায় আকর্ষিত করে। তার আঙুলের মোহময় স্বচ্ছন্দ নড়াচড়া, তার গর্বিত ভঙ্গিমা, সৌন্দর্য যে শহরে আসক্ত হবে, এ তো জানা কথাই।)

সেইসব সকালে, যেদিন গানার ঘুমিয়ে থাকে, বেবি মনিটারে তার ঘুমের আওয়াজ ভেসে আসে – আমি বুঝতে পারি, গানারের দিনগুলো কতো নবীন, কতোখানি সতেজ। ওর জীবন তো সবে শুরু হয়েছে। পাঁচ বছর আমার তিরিশ বছরের জীবনের কাছে যতো ছোট অংশই মনে হোক না কেন, পাঁচ বছরের গানারের দিক থেকে ধরলে তার একটা দিনের ব্যাপ্তিও তার চেয়ে অনেকখানি বড়। সহজ ভগ্নাংশের অঙ্ক। আমি ভাবি। ভাবতেই থাকি।

সেই সেই দিন, জানালার কাচে মুখ ঠেকিয়ে, আমি কল্পনায় দেখতে পাই সে ট্রেনে যাবার জন্য অপেক্ষা করছে। তার অ্যাটাচি কেস তার পায়ে নরমভাবে ঘষা খাচ্ছে। সবার সঙ্গে এক গন্তব্যে যাবার লুকোনো উত্তেজনা সে অনুভব করছে। সে ট্রেনে উঠে অ্যাটাচিটা পায়ের কাছে নামিয়ে দেয়, পরিপাটিভাবে কগজগুলি ধরে রাখে। তার কাঁধের ওপর দিয়ে উজ্জ্বল নীল ত্রিপলে ঢাকা নৌকোদের বেঁধে রাখার জায়গাটা দেখা যাচ্ছে। একটা বিরাট ট্রাক রাস্তা দিয়ে চলে গেল। নদীটি শান্তভাবে গা এলিয়ে পড়ে থাকে। তার রঙ কোনোদিন নীল, আবার কোনোদিন ধূসর। 
 
আর জানলায় দাঁড়িয়ে আমি আগামী শান্ত দিনটির কথা ভাবি। আজ গানারকে নিয়ে অন্য একটি বাচ্চার সঙ্গে খেলার দিন। ওদের খেলার সময় আমি আর সেই ছেলেটির মা আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। আমাদের মধ্যে কোনো প্রেমজ ভাবনার জন্ম হয় না। সেইজন্যেই হয়তো আমরা আরও বেশি আড়ষ্ট বোধ করতে থাকি। কোনো তীব্র অনুভূতি না হোক, যেন একটা মৃদু কম্পন প্রত্যাশিত ছিল। ওদের দেখতে দেখতে আমরা কিছু নির্দেশ দিতে থাকি।

সাবধানে, এতো জোরে নয়, ভালোভাবে খেল, খেলনা ভাগ করে নাও গানার... অ্যানি এদিকে এসো, তোমর জুতোর ফিতেটা বেঁধে দিই, এতো জোরে নয়। 
 
যেভাবে গাছ আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে, সেভাবে ভাগ করে নেওয়ার, সকলের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করা, ওদের শিক্ষাদান পদ্ধতি, সবকিছু লক্ষ্য করতে শেখানো, কল্পনা শক্তির বিকাশ নিয়ে কিছু আলগা দার্শনিক কথাও আমরা বলি।

গ্রেস নামে মা এলে, সে তার ছেলের কল্পনাশক্তি বাড়াবার কাজে ভারি ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ছেলেকে ডেকে বলে– “আমার আর মিস্টার অ্যালিসনের জন্যে একটা পিৎজা বানাও দেখি সোনা।“

আমি মনে মনে বলি – “বব বলো। বব বলে ডাকো প্লিজ!”
 
জানলা থেকে জলে ঘেরা শহরটা দেখতে বেশ লাগে। আমাদের বাড়ির গা দিয়ে নদীটি বয়ে গেছে। এই পারে পাথরের চাঁই আর গাছেরা পাশাপাশি থাকে। নদীর অপর পারে মস্ত খোলা মাঠ, কাঁচা রাস্তা, রেললাইনের বেড়া। এই জানলায় দাঁড়িয়ে কর্মব্যস্ত শ্যারনকে আমি কল্পনায় অনুসরণ করতে থাকি। রাস্তা পার হয়ে সে কার্ড ঢোকালে দরজা খুলে যায়। সেই গ্লাসের দরজা, যা অতিক্রম করে ওপারে যাবার দক্ষতা সে অর্জন করেছে। তার কাছে বেয়ারা ও দর্শনার্থীরা তার অনুমোদনের সইয়ের জন্যে অপেক্ষা করে। কারো কারো মনে ভয়, এই বুঝি তার বড়ো ডেলিভারির অর্ডারটি বাতিল হয়ে গেল। তাহলে তো সে ভিতরে যাবার অনুমতি পাবে না!

আমি কল্পনায় দেখি শ্যারন তার সহকর্মীদের সঙ্গে ঠাসাঠাসি করে এলিভেটরে উঠে পড়ে। ভিড়ে তার কোনো বিরক্তি নেই। সে টাকা রোজগারের অভিযানের যাত্রী। তারপর কফির গন্ধে ভরা লবি... রিসেপশন ডেস্ক পার হয়ে নিশ্চিত পদক্ষেপে তার কামরায় চলে যাওয়া..। আমার রান্নাঘর থেকে কফি মেসিনের আওয়াজ কানে আসে।
 
আমার মনে হয়, আমরা বোধহয় এক চূড়ায় দাঁড়িয়ে আছি। তার একধারে রয়েছে আমার স্ত্রীর ব্যস্ত কর্মজীবন আর বাইরের জগতের আনন্দ। আর অপর দিকে রয়েছে পাখির কূজনে ভরা আমার একান্ত একাকীত্ব। পাখিগুলো পাগলের মতো এ ওকে ডাকছে,যেন কথা বলছে ওরা।
 
এখন শেষ বিকেলের আলো ছুঁয়ে যাচ্ছে নদীকে। তার মাঝখানটিতে ছোট ঘুর্ণি পাক খেতে শুরু করেছে। ছড়িয়ে যাচ্ছে কেন্দ্র থেকে বাইরের দিকে। হালকা ঢেউ ধাক্কা খাচ্ছে বাগানের পাঁচিলে। পাখিগুলো সে মুহূর্তে একবার থেমেই আবার জটলা পাকিয়ে ডানা ঝাপটাচ্ছে। জোয়ার আসছে।
 
আমি আবার গানারের দিকে তাকালাম। আমি ওর এই নিজের মতো করে বড়ো হয়ে ওঠাটাকে উপভোগ করি। আদরে, শাসনে, প্রতি মুহূর্তে. ওর সঙ্গে জড়িয়ে থাকায় আমার শান্তি, আমার সুখ, ভালোবাসা। ওর ছোট্ট মনে আমার বিশাল উপস্থিতি, ওর বেড়ে ওঠার পিছনে আমার প্রভাব .... আমি ভাবতেই থাকি। গানার যখন স্কুল থেকে বেরিয়ে আমায় খোঁজে, দৌড়ে আমার দুহাতের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে খিলখিলিয়ে হাসে, আমি ভালোবাসার মানে বুঝতে পারি। এলোঝেলো পোষাকেও তাকে ভারি মিষ্টি দেখায়। শ্যারনও তাই বলে। (গানারের এখনো পোষাকের ভালোমন্দ বোঝার বয়েস হয়নি। আর আমি সেই সুযোগটাই নিই।) কিন্তু তাকে কোলে তুললেই, সেই মুহূর্তের পবিত্র অনুভূতির ওপর ঘামে ভেজা কলারের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে! হয়তো বড়ো হবার পর তার স্মৃতিতেও আমার নিশ্বাসের ধোঁয়া আর কফির গন্ধও তার স্মৃতিতে থেকে যাবে।

পাখিরা জলের ওপর দিয়ে খানিকটা গিয়েই, পাক খেয়ে দ্রুত থম্পসনস স্কচ পাইনের দিকে ফিরে আসতে লাগল। তাদের দেখতে দেখতে, আমি একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম। যখন খেয়াল করলাম, তখন গানার প্রায় পাঁচিলের কাছে পৌঁছে গেছে। তার খুশিভরা চিৎকার হাওয়ার শব্দের সাথে মিশে আমার কানে ধাক্কা দিল।
 
আমি সব ভুলে, চেঁচিয়ে উঠলাম – “থাম, থাম এক্ষুণি। নয়তো চেয়ারে বসিয়ে রাখবো!“

বলছি, আর প্রাণপণে দৌড়াচ্ছি। কিন্তু ছেলেটা অনেকখানি এগিয়ে গেছে। এক মুহূর্ত পরেই সে পাঁচিলের দেওয়ালে পৌঁছে যাবে! তারপর পাঁচিলে চড়ে পা টিপে টিপে হাঁটা শুরু করবে। নিজের ভারসাম্য পরীক্ষা করতে হবে না? (গরমকালে ওকে আঙুল ধরে আমি ওপারে নামিয়ে দিতাম। তারপর দুজনে মিলে একটা পুরোনো মাছের ঝুড়ির ওপর বসতাম।)
 
ক্ষণিকের জন্যে সে আমার দিকে তাকিয়ে দেখেছিল। আমি বিড়বিড় করছিলাম - “ও আমার ছেলে। আমি থাকতে ওর কিছু হতে পারে না।“ হাওয়ায় আমার চুল উড়ছিল।

গানার ততক্ষণে টলমলো পায়ে পাঁচিলে উঠে পড়েছে। সে পিছনে হেলে গেল! তার দুহাত হাওয়ায় ছড়ানো!

“ না, গানার, না....” – এটা কি আমার চার নম্বর সতর্কীকরণ? আমি এটাই ভাবছিলাম? প্রবল আওয়াজ করে রূপোলী রেখার মতো একটা ডিজেল ট্রেন ছুটে যাচ্ছিল। গানার খিলখিল করে হাসছিল আর দুলছিল। ট্রেনের আওয়াজের সঙ্গে আমার কানে সেই শব্দও এসে ধাক্কা দিল। হে ভগবান! আমি সময়মতো পৌঁছাতে পারলাম না! গানার ভারসাম্য রাখতে পারল না। তার দুচোখ আতঙ্কে বিষ্ফারিত। দু হাত ছড়িয়ে সে পাঁচিল টপকে ওপারে ছিটকে পড়ল।
 
আমি দেওয়ালের ওধারে তাকালাম। জোয়ারে জল এগিয়ে আসছে। কালো জলে, কাদায় মাখামাখি গানার, ভিজে চুপ্পুস হয়ে বালিতে চিত হয়ে পড়ে আছে। তার চোখে এখন দুষ্টুমির ঝিকিমিকি। “আমার চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে থাক বাছা। নজর সরাস না।“ – জপছিলাম সমানে। নিঃসীম আতঙ্কে আমার হাড় হিম হয়ে যাচ্ছিল। ওকে মাটি থেকে তুলবার সময় আমার চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছিল। খুব যত্ন করে ওকে পাঁচিলের ওপরে উঠতে সাহায্য করলাম। পাঁচিলের ওপর সে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আমার দিকে চাইল। আমার মুখ তখন টকটকে লাল। আমি চোখ মুছছিলাম, আর আমার অজান্তেই, আমার মুখ বলে যাচ্ছিল – “যথেষ্ট স্বাধীনতা হয়েছে। একদম চেয়ারে বসে থাকবে এবার থেকে। জলাখাবার টাবার কিচ্ছুটি পাবে না। তিন চারবার মানা করার পরেও কথা শোননি। তোমার কপাল ভালো যে জোয়ার তখন পাড়ে এসে পৌঁছায়নি।“
 
দিন ফুরিয়ে আসছিল। ট্রেনটা চলে গেছে। জোয়ারের জল তীরের পাথরের ওপর আছড়ে পড়ছে। পাহাড়ের গা দিয়ে জোরালো উত্তুরে হাওয়া চামড়ায় তার কামড় বসাচ্ছে। ছেলে নিচু হয়ে হাত বাড়িয়ে দিল। তার হাত ধরার আগে দুজনের হাতের মাঝে বিশুদ্ধ ভালবাসায় ভরা বাতাসকে, সমস্ত হৃদয় দিয়ে অনুভব করছিলাম। কিন্তু এই স্নিগ্ধ অনুভূতির মেয়াদ বাড়ি ঢোকা পর্যন্তই। 
 
তারপরেই গানারকে আমি সেই চেয়ারটায় বসাতে বসাতে বললাম – “ঢের হয়েছে। নড়বে না একদম। শ্যারন আসা পর্যন্ত এখানেই বসে থাক।“
 
গানার বাধা দিচ্ছিল। চেয়ারে বসে সারা শরীর মোচড়াচ্ছিল। আমি যথেষ্ট জোর দিয়ে বললাম – “ মা বাড়ি না আসা পর্যন্ত তোমাকে ওই চেয়ারেই বসে থাকতে হবে। সে সময় হতে ঢের দেরি আছে। ততক্ষণ ওই চেয়ারেই ...“
 
 

 
 
লেখক পরিচিতি: জন্ম ১৭ই অক্টোবর, ১৯৬১, নিউ ইয়র্ক। নিউ ইয়র্কার, এস্কোয়্যার এবং হার্পার প্রকাশনায় তার লেখা প্রকাশিত হয়। কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে তিনি কবিতায় MFA উপাধি লাভ করেন। তাঁর লেখা উপন্যাস ‘হিস্টোপিয়া’ ২০১৬ সালের ব্রুকার প্রাইজের জন্য নির্বাচনের লিস্টে জায়গা করে নেয়।


অনুবাদক পরিচিতি:
দোলা সেন
গল্পকার। অনুবাদক
 আসানসোলে থাকেন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

3 মন্তব্যসমূহ

  1. অসামান্য একটি লেখা পড়ার সুযোগ করে দেয়ার জন্য অনুবাদক এবং গল্পপাঠ কে জানাই অশেষ ধন্যবাদ।

    উত্তরমুছুন
  2. অত্যন্ত সুন্দর অনুবাদ।

    উত্তরমুছুন
  3. শর্বরী সেনগুপ্তা১৫ মে, ২০২২ এ ১:৩১ AM

    অসাধারণ সুন্দর লেখার জন্য ধন্যবাদ জানাই!!! শেষ পর্যন্ত রুদ্ধ শ্বাসে পডলাম !!!

    উত্তরমুছুন