
সমকালীন আমেরিকান গল্প
অনুবাদ: মাহরীন ফেরদৌস
তিন বছরে এই নিয়ে তিনবার হলো এমন। তার উন্মাদ ছেলের জন্য উপহার হিসেবে কী নেয়া যাবে আর কী যাবে না এই নিয়ে তারা কথা বলেছিল। বলতে গেলে তেমন কিছুই নেওয়া অনুমতি ছিল না। কারণ, সবকিছুকেই এক ধরণের অস্ত্র বানিয়ে ফেলা সম্ভব। আর তাই, যা কিছুই নেওয়া হোক না কেন, আগে সেটাকে ফ্রন্ট ডেস্কে রেখে আসতে হতো। আর এরপর অনুরোধ করলে, এক বিশালদেহী স্বর্ণকেশী সহকারী আসত সেই উপহার পরীক্ষা করতে। পিট এক ঝুড়ি জ্যাম নিয়ে এসেছিল, কিন্তু জ্যামগুলা রাখা ছিল কাচের জারে। আর তাই সেটা অনুমতি পেল না। যদিও পিট বলেছিল যে, ও ভুলে গিয়েছিলো কাচের কিছু আনা নিষেধ। সেই জারগুলো সাজানো ছিল রঙ ধরে ধরে। সবচেয়ে উজ্জ্বল ক্লাউডবেরি থেকে ডুমুরের জ্যাম পর্যন্ত। যেন বা ক্রমান্বয়ে অসুস্থ হয়ে যাওয়া মানুষের বিভিন্ন সময়ে সংগ্রহ করা প্রস্রাবের নমুনা ওগুলো।
‘এইসব বাজেয়াপ্ত করাই উচিৎ।’ সেই মহিলা ভাবল। ‘ঠিকই এরা অন্য কিছু নিয়ে হাজির হবে।’
তার ছেলের বয়স বারো হবার সময়ই ও নিজের মনে বিড়বিড় করত। আর চুপ করে বসে থাকত। বন্ধ করে দিয়েছিলো দাঁত ব্রাশ করাও। ততদিনে পিট ওদের জীবনে আসার প্রায় ছয় বছর হয়েছিল। আর এখন, আরও চার বছর পেরিয়ে গেছে। পিটকে সত্যিই ওরা ভালোবেসেছিল। হয়তো মাঝেমধ্যে একটু কম, কিন্তু ভালোবাসাটুকু হারিয়ে যায়নি কখনও। তার ছেলে পিটকে একজন দয়ালু ও সৎ বাবার মতোই ভাবত। তিনি আর পিট একসাথেই বুড়ো হয়েছেন। যদিও সেটা তার চেহারাতেই ধরা পড়ে বেশি। তার কালো লম্বা পোশাক আর কলপ ছাড়া ধূসর চুল, যা বেশিরভাগ সময়ই স্প্যানিশ শ্যাওলার মতো করে ঝুলে থাকত। এ সবকিছুই বয়সের কথা বলে। যেদিন থেকে তার ছেলেকে সমস্ত পোশাক খুলে শুধুমাত্র একটা গাউন পরিয়ে 'সেখানে' রাখা শুরু করল, তিনিও সেদিন থেকে সমস্ত গলার হার, কানের দুল আর স্কার্ফ পরা ছেড়ে দিলেন। 'এগুলো সবই কৃত্রিম', পিটকে বলতে বলতে সবকিছু খাটের নিচে একটা ফাইলের ভেতর রেখে দিয়েছিলেন তিনি। এমনিতেও তার ছেলেকে দেখতে যাবার সময় এগুলো পরার অনুমতি ছিল না। তাই তিনি একবারে পরা ছেড়ে দেয়াই ভালো, ভাবলেন। তার বৈধব্যের উপর যেন আরেক নতুন বৈধব্য যুক্ত হলো। তার বয়সী আর সব মহিলাদের (যারা ছোট ছোট জামা আর গহনা পরে অবিরাম সবার নজরে পড়ার চেষ্টা চালাত) তার খুবই হাস্যকর লাগতো এইসব চেষ্টা করতে দেখতে। আর তাকে দেখলে মনে হতো তিনি হয়তো কোন আমিশ মহিলা, কিংবা আরও নিচু কেউ। যখন বসন্তের নিষ্ঠুর আলো তার মুখে এসে পড়ত, তখন কেউ তাকে আমিশ লোক ভেবেও ভুল করে বসতো। বয়স যখন হচ্ছেই, তাহলে বয়স্কই লাগুক, এই ছিল তার ভাবনা। পিটও আর বলত না, ‘আমার চোখে তুমি সবসময়ই সুন্দর।’
সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক মন্দায় পিট চাকরি হারিয়েছিল। বাধ্য হয়েই তাই পিটকে চলে আসতে হয়েছে তার সাথে থাকার জন্য। কিন্তু থেকেই থেকেই তার ছেলের উটকো ঝামেলা পিটকে সরে যেতে বাধ্য করত। যদিও পিট তাকে ভালোবাসতো কিন্তু তার জীবনে কিংবা বাড়িতে পিট নিজের জায়গাটুকু আসলেই খুঁজে পেতো না। ( এজন্য পিট ওর ছেলেকে দোষারোপ করত না, করত কি?) মাঝে মাঝেই সামনের ঘরটাকে লোভ আর ঘৃণাভরা চোখে দেখত পিট, যেখানে তার ছেলেকে বাসায় থাকলেই পাওয়া যেত, একটা বড়ো কম্বল, আইসক্রিমের খালি কৌটা, এক্সবক্স আর অনেকগুলো ডিভিডি সামনে নিয়ে।
তার ছেলের বয়স বারো হবার সময়ই ও নিজের মনে বিড়বিড় করত। আর চুপ করে বসে থাকত। বন্ধ করে দিয়েছিলো দাঁত ব্রাশ করাও। ততদিনে পিট ওদের জীবনে আসার প্রায় ছয় বছর হয়েছিল। আর এখন, আরও চার বছর পেরিয়ে গেছে। পিটকে সত্যিই ওরা ভালোবেসেছিল। হয়তো মাঝেমধ্যে একটু কম, কিন্তু ভালোবাসাটুকু হারিয়ে যায়নি কখনও। তার ছেলে পিটকে একজন দয়ালু ও সৎ বাবার মতোই ভাবত। তিনি আর পিট একসাথেই বুড়ো হয়েছেন। যদিও সেটা তার চেহারাতেই ধরা পড়ে বেশি। তার কালো লম্বা পোশাক আর কলপ ছাড়া ধূসর চুল, যা বেশিরভাগ সময়ই স্প্যানিশ শ্যাওলার মতো করে ঝুলে থাকত। এ সবকিছুই বয়সের কথা বলে। যেদিন থেকে তার ছেলেকে সমস্ত পোশাক খুলে শুধুমাত্র একটা গাউন পরিয়ে 'সেখানে' রাখা শুরু করল, তিনিও সেদিন থেকে সমস্ত গলার হার, কানের দুল আর স্কার্ফ পরা ছেড়ে দিলেন। 'এগুলো সবই কৃত্রিম', পিটকে বলতে বলতে সবকিছু খাটের নিচে একটা ফাইলের ভেতর রেখে দিয়েছিলেন তিনি। এমনিতেও তার ছেলেকে দেখতে যাবার সময় এগুলো পরার অনুমতি ছিল না। তাই তিনি একবারে পরা ছেড়ে দেয়াই ভালো, ভাবলেন। তার বৈধব্যের উপর যেন আরেক নতুন বৈধব্য যুক্ত হলো। তার বয়সী আর সব মহিলাদের (যারা ছোট ছোট জামা আর গহনা পরে অবিরাম সবার নজরে পড়ার চেষ্টা চালাত) তার খুবই হাস্যকর লাগতো এইসব চেষ্টা করতে দেখতে। আর তাকে দেখলে মনে হতো তিনি হয়তো কোন আমিশ মহিলা, কিংবা আরও নিচু কেউ। যখন বসন্তের নিষ্ঠুর আলো তার মুখে এসে পড়ত, তখন কেউ তাকে আমিশ লোক ভেবেও ভুল করে বসতো। বয়স যখন হচ্ছেই, তাহলে বয়স্কই লাগুক, এই ছিল তার ভাবনা। পিটও আর বলত না, ‘আমার চোখে তুমি সবসময়ই সুন্দর।’
সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক মন্দায় পিট চাকরি হারিয়েছিল। বাধ্য হয়েই তাই পিটকে চলে আসতে হয়েছে তার সাথে থাকার জন্য। কিন্তু থেকেই থেকেই তার ছেলের উটকো ঝামেলা পিটকে সরে যেতে বাধ্য করত। যদিও পিট তাকে ভালোবাসতো কিন্তু তার জীবনে কিংবা বাড়িতে পিট নিজের জায়গাটুকু আসলেই খুঁজে পেতো না। ( এজন্য পিট ওর ছেলেকে দোষারোপ করত না, করত কি?) মাঝে মাঝেই সামনের ঘরটাকে লোভ আর ঘৃণাভরা চোখে দেখত পিট, যেখানে তার ছেলেকে বাসায় থাকলেই পাওয়া যেত, একটা বড়ো কম্বল, আইসক্রিমের খালি কৌটা, এক্সবক্স আর অনেকগুলো ডিভিডি সামনে নিয়ে।
তিনি অনেকদিন থেকেই আর জানেন না পিট কোথায় কোথায় যায়। মাঝে মাঝে সপ্তাহের পর সপ্তাহ হয়ে যায়। তিনি ভাবতেন এটাই কাছে থাকা, কোন প্রশ্ন না করে, কোন খোঁজ না নিয়ে। একটা সময় তিনি এতোই বুভুক্ষু হয়ে গেলেন একটু স্পর্শের জন্য যে রাস্তার মোড়ের ‘ স্টরেসড ট্রেস’ সেলুনে এ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে নিলেন, শুধুমাত্র নিজের চুল ধোয়ার জন্য। যে কয়বারই তিনি বিমানে করে নিজের ভাই আর পরিবারকে দেখার জন্য বাফেলো গিয়েছেন, ইচ্ছে করেই এয়ারপোর্টে স্ক্রিনিং যন্ত্র দিয়ে যেতে অস্বীকার করেছেন, যাতে নিরাপত্তারক্ষীরা স্ক্যানিং মেশিনের পরিবর্তে উনার শরীরে হাত দিয়ে তল্লাশি করে।
যখনই তিনি একলা নিজের ছেলেকে দেখতে যেতেন, ‘পিট কোথায়?’ বলে ও চেঁচিয়ে উঠত। ওর মুখ এ্যাকনের কারণে রক্তাভ আর কিছুদিন পরপর দেওয়া নতুন নতুন ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় ফোলা ও প্রশস্ত হয়ে থাকত। উনি বলতেন,
‘আজকে পিট ব্যস্ত, কিন্তু খুব খুব দ্রুত, হয়তো বা আগামী সপ্তাহেই সে আসবে।’
মাতৃত্বের এক অনুতাপে ডুবে যেতেন তিনি। ঘরটা দুলে উঠত চারপাশে। আর উনার ছেলের কনুইয়ের ক্ষত চিহ্নগুলো চিৎকার করে উঠত, যেন বাবা হারানোর ক্ষত কোন গাণিতিক চিহ্নের মতো ওর চামড়ায় ফুটে উঠেছে। ক্রমাগত ঘুরতে থাকা এই ঘরের ভেতর ঐ সাদা দাগগুলো যেন একটা ক্যাম্পগ্রাউন্ডের গ্রাফিতি হয়ে যেত, যেখানে অল্পবয়সী ছেলেমেয়েরা পিকনিক টেবিল ও গাছের গায়ে খোদাই করে লিখেছে ‘পিস’ ও ‘ফাক’। আর ‘সি’ অক্ষরটা জুড়ে থাকত একটা বর্গের ( চতুর্ভুজের) তিন চতুর্থাংশ। শারীরিক ক্ষতেরও যেমন একটা ভাষা ছিল, তেমনই ভাষারও ছিল ক্ষত। এই ক্ষতগুলো তার ছেলেকে সেইসব মেয়েদের কাছে আকর্ষনীয় করে তুলত, যাদের অনেকেই, এমন করে নিজেকে কাটত। এবং ওরা খুবই কম দেখেছে কোন ছেলেকে এমন করতে, তাই গ্রুপ সেশনে ও হয়ে উঠেছিল জনপ্রিয়। যদিও, এই জনপ্রিয়তা ও কখনও গ্রাহ্য কিংবা খেয়ালই করত না। যখন আশেপাশে কেউ থাকত না, তখন কারুশিল্পের সেশনে পাওয়া শক্ত কাগজ দিয়ে ও নিজের পায়ের তালু কাটত। গ্রুপ সেশনে হাতের রেখা পড়ার মতো করে ও মেয়েদের পায়ের তালু পড়ার ভান করত, এবং তাদের জীবনের অনাগত প্রেমিক ও প্রেমের গল্প বলত। রোম্যান্সের নাম ও দিয়েছিল টোম্যান্স। আর মাঝে মাঝে পায়ের পাতার এই কাটাকাটিতে ও নিজের ভাগ্য দেখতে পেত।
এবার তিনি পিটসহ নিজের ছেলেকে দেখতে গেলেন জ্যাম না নিয়েই। কিন্তু নিজের বুকশেলফ থেকে নিয়ে গেলেন নরম কাগজে লেখা ড্যানিয়েল বুনের একটি বই। এটা নেওয়ার অনুমতি ছিল। উনার ছেলে বিশ্বাস করত এই বইয়ে ওর জন্য আছে দিক নির্দেশনা। যদিও গল্পটা বহু আগের, কিন্তু এই গল্প ছিল ওর জীবনের প্রতিটি একাকীত্ব, পরাজয়, হরণের দুঃখ ও জয়গাঁথা নিয়ে। ও ভাবত, নিজের জীবনকে বইয়ের পাতায় ও বিছিয়ে দিতে পারবে। যেন ওর জীবনের গল্পের অনন্য বার্তা আছে এই বইতে। যেমন, বইয়ের পাতায় থাকা শব্দ থেকে সূত্র খুঁজে ও পৃষ্ঠা নম্বরের সাথে নিজের বয়স মেলাত; ৯৭, ৮৮, ৪৬৬। বইয়ে এরকম আরও অনেক গোপন সূত্র থাকত ওর অস্তিত্বের। সবসময়ই থাকত।
ওরা একসাথে অতিথিদের টেবিলে বসেছিল। আর তার ছেলে বইটা একপাশে সরিয়ে রেখে তাদের দিকে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করল। ওর চোখের তারায় ছিল কোমলতা। যেই কোমলতা নিয়ে ও জন্মেছিল। যদিও ওর ভেতরের ক্রোধ সেই সব ছিন্নভিন্ন করে দিতে পারত। কেউ ওর ফ্যাকাসে চুলগুলো কেটে দিয়েছিল। অন্তত বলা যায়, কাটার চেষ্টা করেছিল। সম্ভবত, দায়িত্বরত লোকটি ওর কাছে কেঁচি হাতে দীর্ঘ সময় থাকতে চায়নি। ফলে, একবার কিছু চুল কেটে, সে লাফ দিয়ে সরে যাচ্ছিল। এরপর আবার এগিয়ে এসে আরেকটু কেটেই আবার লাফিয়ে সরে গিয়েছিল। দেখে অন্তত তাই মনে হচ্ছিল। ওর চুল ছিল ঢেউ খেলানো যা খুব যত্ন করে কাটতে হতো। এখন আর ওর চুল আগের মতো নেই। মাথার চারপাশে এলোমেলোভাবে ছোট ছোট চুল বেরিয়ে আছে, যেটা সম্ভবত একজন মা বাদে আর কারও কাছেই গুরুত্বপূর্ণ না।
‘তো কোথায় ছিলে তুমি?’ উনার ছেলে জিজ্ঞেস করলো পিটকে।
‘চমৎকার প্রশ্ন!’ পিট বলল। যেন এমনভাবে প্রশংসা করলেই এই প্রশ্নটা হারিয়ে যাবে। এমন একটা পৃথিবীতে মানুষ কি করে মানসিকভাবে সুস্থ থাকতে পারে?
‘তোমার কি আমাদের মনে পড়ে?’
পিট কোন জবাব দিলো না।
‘রাতের বেলা গাছের কালো ঝুরি দেখলে কি তোমার আমাকে মনে পড়ে?’
‘আমার মনে হয়, মনে পড়ে।’ পিট এমনভাবে ওর দিকে তাকিয়ে এটা বলল যাতে ওর একচুলও নড়তে না হয়। ‘আমি সবসময় চাই যে তুমি ভালো থাকো আর ওরা এখানে তোমাকে ভালোভাবে দেখে রাখুক।’
‘তোমার কি মেঘ দেখলে আমার মাকে মনে পড়ে?’
পিট আবার চুপ করে রইল।
‘যথেষ্ট হয়েছে!’ উনি এবার নিজের ছেলেকে বললেন।
ছেলেটি অভিব্যক্তি পালটে মায়ের দিকে তাকাল ও বলল,
‘আজকে বিকেলে কারও জন্মদিন উপলক্ষে কেক থাকার কথা।’
‘দারুণ ব্যাপার হবে!’ তিনি হেসে বললেন।
‘অবশ্য কোন মোম কিংবা কাঁটাচামচ নেই। আমাদের কেকের ফ্রস্টিংটা হাতে ধরে চোখের মধ্যে ঠেসে ধরতে হবে। তোমার কখনও মনে হয়, যখন মোমবাতি জ্বলে তখন সময় কেমন থেমে যায়? যদিও মুহুর্তগুলো সেই মোমবাতির ধোঁয়াকে বয়ে নিয়ে যায়। ঠিক যেন পুড়তে থাকা ভালোবাসার আগুনের মতো। তোমার কি কখনও মনে হয়, কেন কিছু মানুষের এতবেশি জিনিস আছে যা পাওয়ার যোগ্য তারা না। আর জিনিসগুলোও কতটা অযৌক্তিক। আর তুমি কি আসলেই বিশ্বাস করো, যে তুমি তোমার একান্ত ইচ্ছাটা কাউকে কখনও কখনও কখনও কখনও কখনওই না বললে আসলেই এটা সত্যি হয়ে যায়?’
বাড়ি ফেরার পথে, তিনি আর পিট একটা কথাও বললেন না। আর যতবারই তিনি পিটের বুড়োটে হয়ে যাওয়া হাতের দিকে তাকালেন, কাঁপা কাঁপা হাতে ওর স্টিয়ারিং ধরে থাকা, একটু বেঁকে থাকা সেই চেনা বুড়ো আঙ্গুল, ততোবারই তার মনে হলো কেমন বেপরোয়া একটা স্থানে তারা এসে দাঁড়িয়েছে। যদিও ওদের এই আকুলতা ভিন্ন কারণে। তিনি তার চোখের পাতায় কান্নার তীক্ষ্ণ চাপ টের পেলেন।
শেষবার যখন ওর ছেলে এমন কিছু করার চেষ্টা করেছিল, ডাক্তারের ভাষায় সেই পদ্ধতি ছিল, অস্বাভাবিকভাবে অভিনব। হয়তো সে সফলও হতো, কিন্তু ওরই গ্রুপের আরেকজন রোগী, একটা মেয়ে এসে শেষ মুহূর্তে ওকে থামিয়েছিল। হয়তো মেঝে থেকে রক্ত মুছতে হতো। হয়তো কিছু মুহূর্তের জন্য ওর ছেলে শুধু চেয়েছিল সবকিছু ভুলে থাকার মতো একটি বেদনা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ও চেয়েছিল, নিজেকে চিড়ে তার ভেতর দিয়ে পালিয়ে যেতে। জীবন ওর জন্য ছিল গুপ্তচর ও গোয়েন্দাগিরিতে পরিপূর্ণ। যদিও, মাঝে মাঝে সেই গুপ্তচরগুলোও পালাত। আর ওর ঢেউ খেলানো স্বপ্নের প্রান্তরের ওপর দিয়ে কাউকে ছুটতে হতো তাদের পিছু পিছু, ভোরের পর্বতমালার দিকে। ওদের হাত থেকে পালানোর জন্যই।
একটা ঝড় আসবে আসবে করছিল। মেঘের ফাঁকে এঁকেবেঁকে ছুটে বেড়াচ্ছিল বিদ্যুৎ। উনার নতুন করে জানার দরকার ছিল না যে দিগন্তকে ভেঙ্গে পড়া সূত্রে এমন করে চিরে ফেলা যায়। তবুও মেঘ আর বিদ্যুৎ সেটাই দেখাচ্ছিল। সেই বিদ্যুৎ চমকের মাঝেই বসন্তের তুষার পড়া শুরু করল। আর পিট উইন্ডশিল্ডের ওয়াইপার চালু করে দিল, যাতে কাচের অর্ধবৃত্তাকার পরিষ্কার জায়গা দিয়ে সামনের অন্ধকার হয়ে যাওয়া রাস্তা দেখতে পায়। তিনি জানতেন যে, এই পৃথিবীর সবকিছু শুধু তার জন্যই না। তবুও, তার ছেলের জন্য মাঝে মাঝে ব্যাপারটা ঘটেছিল। এই যেমন, এবারে গাছে ফুল এসেছে আগেই, যেই বাগানগুলো ওরা পেরিয়ে এসেছে সেগুলো হয়ে আছে গোলাপি। কিন্তু আগে আগেই গরম পড়ায় এবার মৌমাছি কম, আর তাই এবার ফল হবে ছোট ছোট। বেশিরভাগ ফুলই এবার ঝরে পড়বে এই ঝড়ে।
যখন তারা বাসায় পৌঁছে গেলো, হলওয়েতে দাঁড়িয়ে পিট আয়নায় নিজেকে দেখল। সম্ভবত নিশ্চিত হতে চাইল যে এখনও ও বেঁচে আছে, ভূত হয়ে যায়নি, যেমনটা ওকে দেখে মনে হচ্ছে।
‘তুমি কি নিজের জন্য কোন ড্রিংক চাও?’ তিনি বললেন, যাতে পিট থেকে যায়। ‘আমার কাছে ভালো ভদকা আছে, আমি তোমাকে চমৎকার একটা হোয়াইট রাশিয়ান বানিয়ে দিতে পারি।’
‘শুধু ভদকা’, প্রায় অনিচ্ছাসত্তেই বললো পিট, ‘পানি ছাড়াই।’
ভদকা খুঁজে বের করার জন্য ফ্রিজ খুললেন তিনি। তারপর ফ্রিজের দরজা বন্ধ করে কিছুক্ষণের জন্য দাঁড়িয়ে থাকলেন দরজার ফটো ম্যাগনেটগুলোর সামনে। ছোটবেলায় উনার ছেলেটা তার বয়সী অনেক বাচ্চাদের থেকেই হাসিখুশি ছিল। ছয় বছর বয়সেও ছিল প্রাণবন্ত ও উচ্ছল। সারাক্ষন হাত-পা ছুড়াছুঁড়ি করত, ওর নিখুঁত দাঁতগুলো করত ঝকঝক। আর ওর ছিল মধুরঙ্গা প্যাঁচানো চুল। দশ বছর বয়সে, একটা প্রছন্ন ভয় ও বিষণ্ণতা ছিল ওর চেহারায়। যদিও ওর দৃষ্টি ছিল উজ্জ্বল আর ওর প্রিয় কাজিনরা ছিল ওর পাশে। এই যে এই ছবিতে যেমন, এক গোলগাল কিশোর পিটকে জড়িয়ে ধরা। আর ওই কোণার ছবিতে ও আবার শিশু, ওর আত্মবিশ্বাসী ও সুদর্শন বাবার কোলে। যাকে ওর একদমই মনে নেই, কারণ তিনি বহু বছর আগেই মারা গেছেন। এই সবকিছুই মেনে নিতে হয়। বেঁচে থাকা মানে, একের পর এক খুশির প্রলেপ না। বরং এটা হলো কম দুঃখ পাবার প্রত্যাশা। তাস পেটানোর মতো এক আশার ওপর আরেকটা আশা ছুঁড়ে দেওয়া। খেলার ভেতর যেমন করে অপ্রত্যাশিতভাবে রাজা ও রাণী বেরিয়ে আসে তেমন করে জীবনে ক্ষমা ও দয়া পাবার আশা। সেই তাসগুলো তুমি রেখে দিতে পারো আবার খেলতেও পারো, তাতে কিছুই যায় আসে না। এই খেলায় কোন কোমলতা নেই, থাকলেও তা ভঙ্গুর।
‘তোমার আইস লাগবে?’
‘না’ পিট বলল। ‘না। ধন্যবাদ।’
তিনি রান্নাঘরের টেবিলে দুই গ্লাস ভদকা রাখলেন। এরপর তার মুখোমুখি চেহারে গা ডুবিয়ে দিলেন।
‘সম্ভবত এটা তোমাকে ঘুমাতে সাহায্য করবে।’ তিনি বললেন।
‘জানি না, আদৌ কোনকিছু সেটা পারবে কিনা।’ গ্লাসে একটা বড় চুমুক দিয়ে পিট বলল। ইনসমনিয়া ওকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিল।
‘আমি ওকে এই সপ্তাহে বাসায় নিয়ে আসব।’ তিনি বললেন। ‘ওর নিজের বাসা ফিরে পাওয়া দরকার। নিজের বাড়ি, নিজের ঘর। ও কারও জন্য কোন বিপদ না।’
পিট শব্দ করে চুমুক দিলো গ্লাসে। তিনি টের পাচ্ছিলেন পিট কোনভাবেই এটার অংশ হতে চায় না। কিন্তু তিনি জানেন এটা বাদে তার আর কোন উপায় নেই। ‘সম্ভবত তুমি সাহায্য করতে পারবে। ও তোমার ওপর ভরসা করে।’
‘কী রকম সাহায্য?’ পিট বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করল। ওর গ্লাসটা টেবিলে রাখার শব্দ হলো ঠক করে।
তিনি খুব সাবধানে উত্তর দিলেন, ‘আমরা রাতে ওর পাশে থাকার সময়টুকু ভাগ করে নিতে পারি।’
এমন সময় টেলিফোন বেজে উঠল। রেডিওশ্যাক ওয়ালফোনটা দুঃসংবাদ বাদে সচরাচর আর কিছুই এনে দিত না। আর তাই, এই ফোন বেজে ওঠার শব্দ, বিশেষ করে সন্ধ্যাবেলায়, উনাকে সব সময়ই চমকে দিত। তিনি কেঁপে ওঠা থেকে নিজেকে সামলালেন। কিন্তু তারপরেও তার কাঁধদুটো সংকুচিত হয়ে উঠল। যেন এখনই কেউ উনাকে মেরে বসবে।
তিনি উঠে দাঁড়ালেন।
‘হ্যালো।’ তৃতীয় রিঙ বাজার পর উত্তর দিলেন তিনি। উনার হৃদপিণ্ড শব্দ করছিল প্রবভাবে। কিন্তু ফোনের অন্য পাশের মানুষটি ততক্ষণে লাইন কেটে দিয়েছে।
তিনি আবার বসে পড়লেন। ‘মনে হয় রং নাম্বার।’ বললেন তিনি, তারপর যোগ করলেন,
‘সম্ভবত তুমি আরেকটু ভদকা চাও।’
‘অল্প একটু। তারপর আমাকে যেতে হবে।’
তিনি আরেকটু ভদকা ঢেলে দিলেন। উনার যা বলার ছিলো তা পিটকে বলে দিয়েছেন। এটা নিয়ে আর ওকে জোর করতে চানা না। তিনি এখন চান পিট যেন নিজে থেকে এগিয়ে আসে। উনার কিছু নিচুমনের বন্ধুদের সতর্কবার্তা সত্ত্বেও, তিনি বিশ্বাস করেন পিটের ভেতর কোথাও একটা ভালো দিক আছে। আর সেজন্যই তিনি সবসময়ই ধৈর্য ধরতেন। আর কীইবা করার আছে তার?
ফোনটা আবার বেজে উঠল।
‘সম্ভবত টেলিমার্কেটার।’ পিট বলে উঠল।
‘আমার ওদের অসহ্য লাগে’, তিনি বললেন। ‘হ্যালো’, আগের বারের চেয়ে উঁচু স্বরে বলে উঠলেন এবার তিনি।
এবার লাইনটা কেটে যাবার পর তিনি ফোনের উজ্জ্বল হয়ে জ্বলে থাকা প্যানেলটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন। যেটার দেখানোর কথা কোন নাম্বার থেকে ফোনটা এসেছে। তারপর আবার ফিরে এসে নিজের জন্য আরও ভদকা ঢেলে নিলেন।
‘তোমার এ্যাপার্টমেন্ট থেকে কেউ এখানে ফোন করছে।’ তিনি বললেন।
পিট বাকি ড্রিংকটুকু ছুঁড়ে ফেলল। ‘আমার যেতে হবে।’ বলেই ও উঠে পড়ল।
তিনি তার পিছু পিছু গেলেন। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে দেখলেন পিট শক্ত করে দরজার নবটা ধরে মোচড় দিচ্ছে। পুরো দরজা খুলে আয়নাটা ঢেকে দিলো পিট।
‘শুভরাত্রি’ পিট বলল। ওর মুখভঙ্গিই বলে দিলো, বহু দূরের থেকে আসছে এই কথাটা।
তিনি পিটকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে গেলেন কিন্তু ও চট করে নিজের মাথা সরিয়ে ফেলল আর উনার ঠোঁট যেয়ে পড়ল ওর কানে। উনার মনে পড়ে গেল, দশ বছর আগে যখন তাদের দেখা হয়েছিল, তখন ঠিক এই কাজটিই করেছিল পিট। এবং তখন ও ছিল ভালোবাসার এক দোটানায়।
‘আমার সাথে আসার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ’। বললেন তিনি।
‘ওয়েলকাম।’ পিট বলল। তারপর দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেলো নিজের গাড়ির কাছে। যেটা পার্ক করা ছিল সামনের রাস্তায়। তিনি ওকে এগিয়ে দেওয়ার কোন চেষ্টাও করলেন না। সামনের দরজাটা বন্ধ করে লক করতেই, আবারও টেলিফোনটা বাজতে শুরু করল। তিনি রান্নাঘরে গেলেন। আসলে তিনি চশমা ছাড়া কলার আইডিটি পড়তে পারছিলেন না। আর এটা যে পিটের নাম্বার সেটা উনি বলেছিলেন বানিয়ে। কিন্তু, পিট সেটাকেই সত্য প্রমাণিত করেছে। এটাই আসলে মিথ্যা ও সঠিক অনুমানের গোপন ক্ষমতা। এখন তিনি নিজেকে প্রস্তুত করলেন। শক্ত করে পা রাখলেন মাটিতে।
‘হ্যালো। পাঁচবার রিং বাজার পর উত্তর দিলেন তিনি। ফোন নাম্বার দেখানোর প্লাস্টিক প্যানেলটা ঘোলাটে হয়ে ছিল। যেন একটা মোটা কাপড় দিয়ে তা ঢেকে রাখা, যেন একটা পেঁয়াজের ওপর আরেকটা পেঁয়াজের খোসা কিংবা আস্ত পেঁয়াজের ছবি। যেন একটা ছবির ওপর আরেকটা ছবি।
‘শুভ সন্ধ্যা’ তিনি বললেন উঁচু স্বরে।
কী আসবে এখন তার সামনে? একটা বানরের থাবা। একজন মহিলা। একটা বাঘ।
কিন্তু তেমন কিছুই হল না।
লেখক পরিচিতি: মার্কিন সাহিত্যিক লরি মুরের সম্পূর্ণ নাম মেরি লরেনা মুর। জন্ম নিউ ইয়র্কে। মুরের সাহিত্যিক জীবন শুরু হয়েছিল উনিশ বছর বয়সে, যখন তিনি সেভেন্টিনের ফিকশন পুরস্কার জিতেছিলেন। তাঁর প্রথম ছোট গল্পের সংকলন,’সেল্ফ-হেল্প’ প্রকাশিত হয় ১৯৮৫ সালে। যা প্রথম প্রকাশের পরেই সাহিত্য সমালোচকদের চোখে হয়েছিল প্রশংসিত। তবে, মূলত নিজের তৃতীয় গল্প সংকলন ‘ দ্য বার্ডস অফ আমেরিকা’ তাকে সাহিত্য সমালোচক ও পাঠকদের মাঝে সবচেয়ে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করে তোলে। মুরের লেখনীর মাধ্যমে প্রতিদিনের সংকট, টানাপোড়েন ও ক্ষোভ বিদ্রূপ আকারে নিপুণভাবে উঠে আসে পাঠকে কাছে। আর হয়ে ওঠে এক মর্মস্পর্শী গল্প। নির্দেশক লরি মুরের গল্প রেফারেন্সিয়ালের বাংলা অনুবাদ।
মাহরীন ফেরদৌস
কথাসাহিত্যিক। অনুবাদক
যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন।
0 মন্তব্যসমূহ