বাংলায় অনুবাদ: রুখসানা কাজল
ও ফোন করল, কিন্তু কেউ সাড়া দিল না। আবার, বারবার নম্বরটিতে ও ট্রাই করে চলল। সারাটি দিন বিরতিহীনভাবে ফোন করতেই থাকল, কিন্তু শুধু ফোনের আওয়াজটুকুই ও শুনতে পেল। ও মনে করতে পারে না, ওর প্রিয়জন শেষ কবে এতবেশী সময় ধরে ঘরের বাইরে ছিল। ও অনুমান করল হয়তো খুরশিদ অসুস্থ হয়ে পড়েছে। কিম্বা হয়ত এমন কিছু ঘটেছে যার জন্যে সে ওর ফোনের উত্তর দিতে পারছে না।
শেষ পর্যন্ত রাত নয়টার দিকে কেউ একজন ওর ফোনের উত্তর দিল। তার ‘হ্যালো’ বলা শুনে কিছুতেই ও নিঃশ্বাস নিতে পারছিল না।ও যখন কাবুলে একজন ছাত্র ছিল, সে সময় আলিয়ার সঙ্গে ওর বাগদান সম্পন্ন হয়েছিল। তখন ও ফোন করত এবং কথা শুরু করার জন্য নিঃশব্দে আলিয়ার জন্য অপেক্ষা করে থাকত। আসলে আলিয়ার হৃৎস্পন্দন শুনতে চাইত। এটা অভ্যাস করে নিয়েছিল। এভাবে প্রতিদিন ফোন করবে কিন্তু প্রথমেই ও কথা শুরু করবে না। আলিয়াও এটি বুঝে গেছিল, তাই ফোন এলে ‘হ্যালো’ না বলে মুচকি হেসে জিজ্ঞাসা করত, ‘সুলেমান, তুমিই তো ?
ফোনের ওপারের মহিলাটি না হেসে বরং ব্যঙ্গ করে জানতে চাইল, তার কি পেট ব্যথা করছে যে কথা না বলে চুপ করে আছে। শুনে ওর চোখের পানি শুকিয়ে গেল। ওর মনে পড়ে না, এমন কর্কশ সুরে আলিয়া কখনও ওকে উত্তর দিয়েছে কিনা ।
বরং ওর মনে পড়ে গেল, সে সময় ওদের ফোনালাপের মধ্যে কিছুদিনের জন্য একেবারে নিয়মিত ভাবে একটি ভুতুড়ে কল আসত। কল করে নিশ্চুপ হয়ে থাকত। সুলেমান কয়েকবার তাদের কাছে অনুনয় করেছিল, কিন্তু তা ছিল একেবারে নিরর্থক তাই ওদের নীরবতা ভাঙ্গতে সুলেমান ব্যর্থ হয়েছিল। তবে এ ব্যাপারে আলিয়ার মত ছিল এরকম, যদি অই ভুত কলার একশ বার ফোন করে কিছুই না বলে, তবুও কোন রকমের অশ্লীল কথাবার্তা বলা করা যাবে না।
মহিলাটি এবার বিরক্ত না হয়ে জানতে চাইল, ‘আপনার কি পেট ব্যথা করছে ?’ কিন্তু ফোনকলটি যখন সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল, তখন ও নম্বরটিতে আবার ডায়াল করল। এবার আর ওর হাত কাঁপল না। বেশ জোরে ও নম্বরগুলোকে এবার প্রেস করছিল।
ফোনের ওপারে থাকা মহিলাটি কড়া কন্ঠে বলে উঠল, ‘হ্যালো’। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে তারপর দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে ও জানতে চায়, ‘এখানে কি আলিয়া আছে ?’
ও বুঝতে পেরেছিল, এই মহিলাটি কখনও আলিয়া হতে পারে না। মহিলাটি অনেক সময় নিয়ে বেশ টেনে টেনে এবং উচ্চস্বরে হ্যালো শব্দটি বলেছে। আলিয়া কখনও এরকম করে না।
ও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল যখন মহিলাটি বলল,
‘না, আপনি ভুল নম্বর ডায়াল করেছেন।’
ও দ্রুত ফোন রেখে দেয় কিন্তু ফোন রেখে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে প্রশ্ন করে এটা কি করে সত্যি হতে পারে। না–– কোন ভাবেই ভুল নম্বরে ডায়াল করার কোনো উপায় নেই। এ ব্যাপারে ওর আত্মবিশ্বাস আছে। ও আবার ফোন করে। এইবার ও মহিলাটির সঙ্গে সাবলীলভাবে কথা বলে। নিজেকে আলিয়ার একজন দূর সম্পর্কের আত্মীয় হিসেবে পরিচয় দিয়ে জানায়, একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলিয়ার সঙ্গে কথা বলার জন্য অন্য একটি প্রদেশ থেকে ও এসেছে।
মহিলাটি এবার স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে এবং বোঝে যে এটি কোনও বিরক্তিকর বাজে ফোন নয়। তখন ব্যাখ্যা করে জানায় যে তিন বছর আগে তারা একটি পরিবারের কাছ থেকে এই বাড়িটি কিনে নিয়েছে। ও পরিবারটির নাম জানতে চাইলে মহিলাটি উত্তরে জানায়:
‘তার নাম আকবরী। জারঘাম আকবরী।’
কোন রকমের সন্দেহ না রেখে মহিলাটি আবার নিশ্চিত করে,
‘তিনি ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার আকবরী।’
মহিলাটি জানতেও পারছে না, ফোনের অপর প্রান্তে থাকা ব্যক্তিটির সংজ্ঞাহারা হওয়ার অবস্থা হয়ে যাচ্ছে। ‘আলিয়ার দূরবর্তী আত্মীয়’এর সঙ্গে সে কথা বলে যেতে থাকে, বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিতে থাকে, পরিবারটি এখন কোথায় থাকে সঠিকভাবে সে জানে না, তবে শুনেছিল যে আলিয়ারা চক-ই গুল-হা, নামে একটি অভিজাত পাড়ায় বসবাস করত।’
সুলেমান ওর মুখের ভেতর জমে থাকা লালা গিলে ফেলে জিজ্ঞাসা করে, সে কি সত্যিই নিশ্চিত যে ইঞ্জিনিয়ার আকবরীর স্ত্রীর নাম আলিয়া। মহিলাটি ওকে সুনিশ্চিত করে এবং হেসে একথাও জানিয়ে দেয় যে, আলিয়ার বড় মেয়ের নাম হচ্ছে খুরশিদ।
খুরশিদ খুবই চমৎকার একটি মেয়ে,’ মহিলাটি আরও জানায়, ‘আমি ওকে আমার ছেলের বউ করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু ভাগ্য সহায় হয়নি। মেয়েটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাচ্ছিল, আর আমার ছেলে কিছুতেই বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া স্ত্রী চাইছিল না।’
সুলেমান প্রচণ্ড রকম ঘামতে শুরু করে যখন ও শুনতে পায় যে মহিলাটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ওকে জানায়, ‘দুনিয়া কোথায় চলেছে কে জানে।’ শহীদের মেয়েরাও আজকাল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাচ্ছে…… ’
সুলেমান এটি বুঝতে পারে না। ও আড়ষ্ট কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে, ‘শহীদ কন্যা ? কোন শহীদ ?
মনের মত কথা বলার জন্য কাউকে পেয়ে মহিলার বেশ আনন্দ হচ্ছিল। মহা আনন্দে মহিলাটি কথা চালিয়ে যাচ্ছিল, ‘সে কী ব্যাপার ! আপনি যদি এই ব্যাপারটি না জানেন তবে আপনি ওদের পরিবারের কেমন সদস্য ভাই ?’
মহিলার এ কথা শুনে সুলেমান কোনরকমের একটি কৈফিয়ত দেওয়ার চেষ্টা করে কিন্তু তার আগেই মহিলা বলে উঠে : ‘আমি আসলে তেমন বেশি কিছু জানি না। তবে ওদের প্রতিবেশীরা জানিয়েছিল যে, সে হচ্ছে একজন শহীদের মেয়ে। কারণ ওর আম্মু তার স্বামীকে হারিয়েছিল। এর দু বছর পর, স্বামীর একজন বন্ধু কমরেড, যিনি আবার একজন স্থপতি, তাকে ওর মা বিয়ে করেছে। মহান আল্লাহ এখন তাকে আরেকটি সন্তান দান করেছেন। আমরা যখন এই বাড়িটি কিনেছিলাম, তখন ছেলেটির সবে মাত্র জন্ম হয়েছে। ওরা ছেলেটির নাম রেখেছে সুলেমান। খুবই সুন্দর হয়েছে ছেলেটি।’
ওর দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল কিছুতেই নিঃশ্বাস নিতে পারছিল না। শুধু বিড়বিড় করে বলছিল, ‘সুলেমান।’ এরপর ও ফোনকল কেটে দেয়।
ওর হাতে থাকা ছবিটির দিকে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকে। কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিল না, ওর স্ত্রী আবার বিয়ে করেছে। ওর ছোট্ট খুরশিদ এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হয়ে গেছে। ও বুঝতে পারছিল, সবাই ওকে শহীদ হিসাবে ভেবে নিয়েছে। তার সেই বন্ধু, জারঘাম এখন আলিয়ার স্বামী। তারা তাদের ছেলের নাম রেখেছে ওর নামে। গলার ভেতর প্রচন্ড ব্যাথা অনুভব করে ঠোঁট দুটি আষ্টেপৃষ্ঠে চেপে ধরে ও।
** ** **
পরদিন বিছানা থেকে উঠে ও জানালা খুলে দিল। ছয় ছয়টি বছর কেটে গেছে ওকে বন্দী করে রাখার। পানির জগটি তুলে সরাসরি জগ থেকে পানি খেলো ও। গলগল করে পানি পড়ে ভিজে গেল ওর বুক। বিছানায় ফিরে আসার আগে বাকি পানিটুকু নিজের মাথায় ঢেলে দিল ও।
সেই সব দিনে ইচ্ছে করে ওর জিহবাকে আগলে রাখত --- জারঘামের সঙ্গে কখনও নিজের স্ত্রী সম্পর্কে কোন কথা বলেনি বা স্ত্রীর কোন বর্ণনাও দেয়নি। ধূসর হয়ে যাওয়া চুলের মধ্যে ও আঙ্গুল বুলিয়ে চললো। অবশ্য স্বস্তি পাচ্ছিল এই ভেবে, একদিকে এটা ভালই হয়েছে যে ও এখনও বাড়িতে চলে যায় নি –– নইলে প্রতিবেশীরা সবাই ওকে চিনে ফেলত। ও চোখ দুটি বন্ধ করে ফেলে। ওর গলার কাছে দলা পাকিয়ে আটকে আছে এক টুকরো পিণ্ড । শেষ পর্যন্ত উঠে পড়ে এবং কিছুক্ষণ ফোনের দিকে তাকিয়ে থেকে অই একই নম্বরে ডায়াল করলে সেই কর্কশকন্ঠি মহিলাটিই আবার ফোন ধরে।
‘আপনি কেন ফোন রেখে দিলেন ভাই ?’ কোন রকমের উত্তরের অপেক্ষা না করে, মহিলাটি বলে যেতে থাকে, ‘আমি আকবরীদের একজন পুরানো প্রতিবেশী, মিসেস সাবরিকে ফোন করেছিলাম। তাকে জানিয়েছি যে ওদের একজন আত্মীয় ফোন করেছে। উনিও জানে না যে আকবরীরা ঠিক কোথায় বসবাস করছে। তবে এটা সিওর যে তারা সে সময় চক গুলহায় থাকত, যেমনটি আমি আপনাকে বলেছি। তবে মিসেস সাবরী জানিয়েছে, আলিয়া শুক্রবার দিন শহীদদের কবরস্থান, মানে পাহাড়ের উপরে অজ্ঞাত শহীদদের কবরস্থানে যায়।’
‘একজন বৃদ্ধা মহিলা ওদের সঙ্গে থাকতেন। আপনি কি জানেন তাঁর কি হয়েছে- ’ মহিলাটি ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল: ‘ওহো আপনি কি বিবিজানের কথা বলছেন ? আমি যখন তাদের প্রতিবেশী ছিলাম তখন উনি খুব অসুস্থ ছিলেন। কথা বলতে পারতেন না। প্রতিবেশীরা বলাবলি করত, ছেলের শহীদ হওয়ার খবর পেয়ে উনি স্ট্রোক করেছেন। এর এক বছর পর বেচারী বিবিজান মারা গেছেন।’
কথা শেষ হতেই মহিলাটি এবার ফোন রেখে দেয়। ধারে কাছের কোন কিছুতে হেলান দিয়ে জোরে জোরে কাঁদতে শুরু করে সুলেমান।
যখন ও চোখ খোলে তখন সকাল হয়ে গেছে।
বৃহস্পতিবার ও শহরে বেড়াতে গেল। আলিয়া এবং খুরশিদকে নিয়ে যে সমস্ত জায়গায় ঘুরতে যেত সেই সব জায়গায় গেল। পুরনো সুখ স্মৃতিগুলিকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য, ও সেই সব জায়গায় বসেছিল যেখানে কোন এক দিন একটি পরিবার হিসাবে ওরা বসে থাকত।
সন্ধ্যায় দাড়ি কামানোর জন্য দোকানে গেলে ও অনুভব করল নাপিত ওর ঘাড়ে পেঁচানো চুলে ক্লিপার চালিয়ে দিলে ওর সুড়সুড়ি লাগছে। এ সময় ওর মনে পড়ে যায়, বাগদানের পর আলিয়া বলেছিল, ও দাড়ি কামিয়ে ফেলুক এটা সে চায় না, কারণ একজন মহিলার সৌন্দর্য যেমন তার দীর্ঘ লম্বা চুলে তেমনই একজন পুরুষের দাড়ি এবং গোঁফের মধ্যে বিরাজ করে তার সুন্দরতা এবং পুরুষত্ব। যখন প্রথমবার ও দাড়ি লম্বা করতে শুরু করে তখন আলিয়ার চোখে একটা ঝলকানি খেলে যেতে দেখেছিল। যেন আলিয়া প্রশংসা করে ওকে বলছে, দাড়িতে ওকে খুব সুন্দর মানাচ্ছে এবং ওকে দেখতে একজন দেবদূতের মতো লাগছে।
ওর মনে পড়ে গেল আলিয়ার চিত্রকর্মের কথা। সেইসব দিনগুলিতে আলিয়া দেবদূতদের একটি চিত্রকর্ম আঁকার কাজ করছিল ; সেখানে সবাই ছিল লম্বা চুলের পুরুষ। ও আলিয়াকে মনে করিয়ে দিয়েছিল যে কিছু মেয়ে ফেরেশতাও আছে যারা কানে শোনে না। চিত্রকর্মটি সম্পূর্ণ শেষ হলে সেটি মুড়ে ওকে উপহার হিসাবে দিয়েছিল আলিয়া।
সুলেমানের দাড়ি কামানো হয়ে গেছে। বাকি আছে শুধু গোঁফ। ও এটা স্পর্শ করে। নাপিত বার কয়েক জানতে চায়, সে গোঁফও কামিয়ে ফেলবে কিনা, তখন সুলেমান মুখ তুলে বলে, ‘তুমি কি মনে কর গোঁফ রাখলে আমাকে মানাবে ?’ নাপিত ওর গায়ের কেপটি সরিয়ে দিয়ে ওর পিঠে টোকা দিয়ে জানায়, ‘গোঁফ ছাড়া একজন পুরুষকে সত্যিকারের পুরুষ হিসেবে মনেই হয় না।’ সুলেমান হেসে ফেলে এবং চেয়ার থেকে উঠে আয়নার দিকে তাকায়। নিজেকে দেখে ও চিনতে পারে না।
পরদিন খুব ভোরে কবরস্থানের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যায়। তখনও নিরাপত্তা অফিসটি বন্ধ ছিল। এভাবে কয়েক ঘণ্টা কেটে যায়। একটি উইলো গাছের নিচে শুয়ে ছোট ব্যাগটি মাথার নিচে রেখে নীচের দিকে ঝুলন্ত একটি ডালের দিকে তাকিয়ে থাকে। এই গাছটি খুঁজে পেতে ওকে প্রচুর অনুসন্ধান করতে হয়েছে।
আর এখন নাম না জানা শহীদ কবরস্থানে নিজেকে খোঁজা ছাড়া ওর আর কিছু করার ছিল না। অনেক খোঁজাখুঁজি করে কবরস্তানে ওর নাম পাওয়া যায় নি, তাই ও অফিস খোলার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে।
কবরস্তানের খাদেম এসে উপস্থিত হলে সুলেমান ওর নাম ও উপাধি তাকে জানিয়ে দেয়। খাদেম ওকে জানায় যে, এই সুলেমানকে তারা শহীদ এলাকায় দাফনের জন্য একটি প্লট বরাদ্দ করতে চেয়েছিল, কিন্তু তার মেয়ে তীব্রভাবে প্রত্যাখান করে জোর করতে থাকে যে তার আব্বুকে নিখোঁজদের তালিকাভুক্ত করা হোক। তাই এই শহীদের মাথার ফলক দেওয়া হয়নি। ‘মেয়েটি প্রতি শুক্রবার এখানে আসে––কখনও একা কখনওবা তার মায়ের সঙ্গে । প্রথমে এখানে আসে, পরে তারা অন্যান্য শহীদদের কবর জিয়ারত করে। এরপর সে আমার অফিসেও আসে।
এসেই সে প্রশ্ন করে, কেউ কি এসেছিল ওর আব্বুর সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে। মেয়েটি সব সময় এই একই প্রশ্ন করে। আর এখন তো, নিখোঁজ প্রিয়জনদের খোঁজ খবর নিতে উদ্বিগ্ন থাকে এমন পরিবারের অভাব নেই। তাই সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য, আমরা এমন কিছু হাড় তাদের দিই, যেগুলো বছরের পর বছর ধরে নিখোঁজ একজন সৈনিকের দেহাবশেষের মতো করে সাজানো থাকে।’
সুলেমানের হাতগুলো ঠাণ্ডা হয়ে যায় এবং দম বন্ধ হয়ে আসে। ও চোখ বন্ধ করে এবং খাদেম লোকটিকে ধন্যবাদ জানায়, ফিরে যাওয়ার আগে নিজের কবর কিম্বা হয়ত নিজেকে খুঁজে বের করার জন্য। এ সময় উইলোর ঘনপাতার মাঝে ঠান্ডা বাতাস বয়ে যায়। আর সেই ঝুলন্ত শাখার নীচে ফিরে যাওয়ার জন্য ও পথ খুঁজে পায়।
সেখানে এসে বুকের সঙ্গে পা জড়িয়ে ধরে, হাঁটুর উপর চিবুক রেখে ও বিশ্রাম নিতে থাকে। সূর্য উঠে গেছে, কবরের উপর থেকে ভোরের ছায়া সরিয়ে দিচ্ছে রোদ্দুর। বৃষ্টির গন্ধ, জ্বলন্ত বুনো রোয়ে বীজের ধোঁয়া আর মাঝে মাঝে প্রার্থনার শব্দ বাতাসকে পূর্ণতায় গ্রাস করে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
ধীরে ধীরে চারপাশে লোকজন জড়ো হতে থাকে। মনে পড়ে যেদিন খুরশিদকে ওরা হাসপাতাল থেকে বাসায় নিয়ে এসেছিল সেই দিনটিকে। মেয়ে হয়েছে শুনে বিবিজানকে অনেকটা বিমর্ষ দেখাচ্ছিল। সুলেমান অবশ্য দারুণ উচ্ছ্বসিত ছিল।
বুকের সঙ্গে মেয়েকে চেপে ধরে আলিয়াকে জিজ্ঞেস করেছিল, মেয়ের কোন নাম ঠিক করেছে কিনা। আলিয়া মাথা নেড়ে না বলেছিল। এরপর মেয়ের মুখে চুমু খেয়ে ও বলেছিল, “আমি নিজেই ওর নাম রাখব। ও হবে ওর আব্বুর খুরশিদ। ওর আব্বুর সূর্য।’
খুরশিদ যখন বড় হতে থাকে তখন ওরা এত জোরে কবিতা পড়ত যে আলিয়া বাধ্য হয়ে ওদের চুপ করতে বলত। হাত ধরাধরি করে বাগানে ফুলের টব দিয়ে সাজানো পুলের চারপাশে ওরা ঘুরে বেড়াত। সুলেমান গান গাইত, খুরশিদ খানম ওঠো এবং হাসো, তোমার আব্বুকে হ্যালো বল, খুরশিদ খানম—
ও যেখানে ছিল সেখানেই দাঁড়িয়ে পড়ল। বুঝতে পারল ওর হৃৎস্পন্দন ক্ষীণ হতে শুরু করেছে। চোখদুটিকে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না। এ যে তার আলিয়া --- সুলেমানের নিজের আলিয়া। ও ঢোক গিলতে ভুলে যায়। অবিশ্বাসে ওর চোখের পাতা পড়তে থাকে। কিন্তু নিজেকে সংযত করে ও ভাবে, ‘ অবশেষে তুমি এসেছে’। সঙ্গে হাস্যমুখী মাথায় স্কার্ফ পরা ওর সমান একটি মেয়ে। আলিয়ার কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এক সঙ্গে হাঁটছিল। সুলেমান মনে মনে নিজেকে শুনিয়ে বলে, ‘এটা ওরা। অবশ্যই ওরা, আলিয়া এবং তার আব্বুর খুরশিদ খানম।’
ও নিজেকে গাছের গুঁড়ির আড়ালে লুকিয়ে ফেলে, যেন চিনতে না পারে সে জন্যে হাতের ব্যাগটি তুলে মুখ ঢেকে ভাবে, ‘মহিলাদের মত বড় হয়ে উঠেছে মেয়েটি।’
খুরশিদ ওর ব্যাগ থেকে কিছু বের করে আনে—এক প্যাকেট খেজুর। সবুজ স্কার্ফের নীচ থেকে ওর চুল দেখা যাচ্ছিল। আশেপাশের সবাইকে ও পবিত্র খেজুর উপহার দিচ্ছিল। আলিয়ার সঙ্গে অদ্ভুত রকমের সাদৃশ্য রয়েছে মেয়েটির। যেদিন প্রথম ওরা দেখা করেছিল, মেয়েটি সেদিনের ওর মায়ের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে।
খুরশিদ হঠাত থেমে গেল। কেউ তার নাম ধরে ডাকছিল। একজন লোক এবং একটি ছোট ছেলে ওর কাছাকাছি এসে পৌঁছেছে। আলিয়া লোকটির হাত থেকে ছোট ছেলেটিকে নিয়ে নিল। জারঘাম বুড়ো লোকদের মতো হতে চলেছে, যেমন সেও হয়েছে। তার চুল ধূসর হয়ে গেছে।
সুলেমান হাঁপাচ্ছে, ওর হৃদয় ভেঙ্গে খান খান হয়ে গেছে। আলিয়া লোকটির সঙ্গে চলে গেছে। খুরশিদও চলে গেল। সুলেমানের মনে হল, ও যেন ভেঙ্গেচুরে যাচ্ছে। লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। উইলো গাছের নীচে নরম মাটির বুকে মুখ গুঁজে সশব্দে কেঁদে উঠলো। হাতের মুঠিতে মাটি আঁকড়ে ধরে চিৎকার করে উঠলো। ও চাইছিল ওখানে অই মুহুর্তে ওর দম বন্ধ হয়ে যাক। চাইছিল যেন ওর হৃদয় শিরায় শিরায় রক্ত সঞ্চালন বন্ধ করে দিক। অশ্রুপ্লাবনে ভেসে যাচ্ছিল ওর চোখ, পরিষ্কার কামানো কুঁচকানো গাল বেয়ে গড়িয়ে নামছিল অশ্রুকণার বন্যা। ও হাঁটু গেঁড়ে বসে পড়ে। মাথা দিয়ে বার বার মাটিতে আঘাত করতে থাকে। ও তো এদেরকে ভুলতে পারেনি।
হাঁটু ভিজে গেছে ওর চোখের পানিতে। আলিয়া চলে গেছিল। জারঘাম আর ছোট ছেলেটিও চলে গেছে। কেউ একজন আলিয়ার মতো দেখতে মহিলা অফিসের দিকে হেঁটে যাচ্ছে। বাতাসে তার স্কার্ট উড়ছে। বড্ড দ্রুত সে হেঁটে যাচ্ছে। ও নিশ্চিত এটা খুরশিদই হবে। ওর নিশ্চয় খাদেমকে করার জন্যে একটি প্রশ্ন আছে—সেই পুরনো একই প্রশ্ন।
সুলেমান ঠিক আগের জায়গাতে দাঁড়িয়েছিল। এরপর ব্যাগ তুলে মুঠি শক্ত করে খাদেমের ঘরের দিকে চলতে শুরু করে। পা কাঁপছিল, ধীরে ধীরে নড়বড়ে পা ফেলে ও হাঁটছিল। ওর মনে হচ্ছিল পেছন থেকে ওগুলো যেন ওকে ঠেলে নিয়ে চলেছে। খুরশিদ অপেক্ষা করছে। অফিসের লোকটি ফোনে ব্যস্ত ছিল বলে খুরশিদ তখনও কোন প্রশ্ন করেনি।
সুলেমান তখনও সেখানে দাঁড়িয়েছিল আর ভাবছিল, ও কি মেয়েকে হারিয়ে ফেলবে নাকি ফেলবে না। কান্নায় ওর সমস্ত মুখ ভেসে গেছে। কিছুতেই ও খুরশিদকে হারিয়ে ফেলতে পারবে না এবং হারাতে চায়ও না। নিজেকে সুস্থির করে দ্রুত হাঁটতে থাকে এবং মেয়ের খুব কাছাকাছি চলে আসে। একেবারে পেছনে এসে আস্তে আস্তে নিঃশ্বাস নিতে থাকে। ফোনে কথা বলা শেষ করে মেয়েটির দিকে তাকায় খাদেম। মেয়েটি তাকে জিজ্ঞেস করে, ‘মাফ করবেন চাচা, কেউ কি এসেছিল আমার আব্বুর কবর সম্পর্কে খোঁজ নিতে ?’
মেয়েটিকে উত্তর দিতে আরম্ভ করতেই তার দৃষ্টি সুলেমানের দিকে তাকিয়ে স্থির হয়ে গেল।
-----------
[আফগান লেখক বাতুল হায়দারী(batool haidari)। দারি থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন পারওয়ানা ফাইয়াজ। বাংলায় অনুবাদ করেছে, রুখসানা কাজল।]
0 মন্তব্যসমূহ