ইসাবেল আইয়েন্দের গল্প : এবং আমরা সেই কাদামাটি থেকেই নির্মিত হলাম


নুবাদক: রঞ্জনা ব্যানার্জী


মেয়েটিকে যখন ওরা আবিষ্কার করলো তখন পাঁকের ভেতর থেকে কেবল ওর মাথাটাই জেগে ছিলো, চোখ ভরা নীরব আকুতি নিয়ে তাকিয়ে ছি্লো সে। প্রথম খ্রিষ্টপ্রসাদের দিনে মেয়েটির একটি আনুষ্ঠানিক নাম দেওয়া হয়েছিল, আসুসেনা। লিলি ফুল। সেই বিস্তীর্ণ মৃত্যুপুরীর হাওয়ায় লাশের গন্ধ ঝুলছিল, দূরদূরান্ত থেকে শকুনেরা উড়ে আসছিল ভোজের আভাস পেয়ে, বাতাস ভারী হয়ে ছিলো অনাথ শিশুদের কান্না এবং আহতদের আর্তনাদে, অথচ সেইসব ছাপিয়ে প্রাণপণে জীবন আঁকড়ে থাকা এই ছোটোখাটো মেয়েটিই সেই ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনার প্রতীক বনে গিয়েছিল। অকুস্থলে উপস্থিত টেলিভিশনের ক্যামেরাগুলি কাদামাটির তালের ভেতর থেকে কালো কুমড়োর মতো ফুটে থাকা ওর মাথার সেই দুঃসহ ছবি এত ঘনঘন সম্প্রচার করছিল যে এমন কেউ আর ছিলো না, যে কি না ওকে চিনতো না কিংবা ওর নাম জানতো না। এবং যতবারই আমরা ওর সেই মুখ দেখছিলাম ঠিক ততবারই ওর পেছনে আরো একজনকে দেখতে পাচ্ছিলাম, রল্‌ফ কার্‌লে, প্রতিবেদক হিসেবে দায়িত্বপালনের জন্যই সে সেখানে উপস্থিত ছিলো, ঘুণাক্ষরেও ভাবে নি, ত্রিশ বছর আগে ওর জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া এক-টুকরো অতীতও এই কাদামাটিতেই অচিরে খুঁজে পাবে সে।

ভূ-কম্পনের প্রথম ধাক্কাটা এসেছিল তুলোর ক্ষেতগুলির ওপর, মাটির তলার সেই কান্নার গমকে রাশি রাশি ঢেউয়ের ফেনার মতোই যেন গুটিয়ে যাচ্ছিল ক্ষেতগুলি। তারও আগে ভূতত্ত্ববিদেরা ভুকম্প-নির্দেশক যন্ত্রের পাঠ থেকে জেনে গিয়েছিলেন ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরিটি আড়মোড়া ভাঙছে। বেশ কিছুদিন ধরেই তাঁরা আশঙ্কা করছিলেন যে বিস্ফোরণের তাপে জ্বালামুখের ভেতরের বরফের ঢাল গলে যাবে। তাদের এই সতর্কবাণী আমলেই নেয়নি কেউ; ভীত প্রাচীণাদের পুরোনো গল্পগাছার মতোই অহেতুক আতঙ্ক হিসেবেই এই পূর্বাভাষকে দেখেছিল লোকজন। পাহাড়ের আশেপাশের জনজীবনে কোনো হেলদোল হয় নি। এবং নিত্যদিনের অভ্যস্ত জীবনের কোলাহল ছাপিয়ে পৃথিবীর বিলাপও শুনতে পায় নি কেউ, অন্তত নভেম্বরের সেই ভয়াবহ বুধবার রাতটির আগ পর্যন্ত তো বটেই। সেই রাতে বিরামহীন গর্জনে পৃথিবীর মৃত্যুসংবাদটিই যেন ঘোষিত হচ্ছিল এবং বরফের ধ্বসের সঙ্গে কাদামাটি, পাথর এবং জলের স্রোত হুড়মুড়িয়ে নেমেছিল পাহাড় বেয়ে আর সেই পার্থিব-বমনের অতল স্তুপের নিচে গ্রামগুলি হাপিস হয়ে গিয়েছিল। এই অকল্পনীয় দুর্ঘটনায় উদ্ধারপ্রাপ্তরা তাদের বিহ্বলতা সামলে উঠতেই আবিষ্কার করল দালানকোঠা, চত্ত্বর, চার্চ, সাদা-তুলোর ক্ষেত, কালো-কফির বন, গোচারণ ভূমি- সবকিছু উধাও হয়ে গেছে। তারও অনেক পরে যখন সেনাবাহিনী এবং সেচ্ছাসেবীরা জীবিতদের উদ্ধার এবং বিপর্যয়ের নিকেশ আন্দাজের চেষ্টা করছিল তখনই ক্রমশ জানা গিয়েছিল, এই থকথকে কাদার নিচে চাপা পড়ে পঁচছে বিশ সহস্রেরও বেশি মানবসন্তানসহ অগুন্তি প্রাণী। বনভূমি এবং নদীগুলিও মুছে গিয়েছিল কাদার স্রোতে, চারপাশ জুড়ে জেগে ছিলো কেবল এক অন্তহীন পাঁকের মরুভূমি।

রাত পোহাবার আগেই যখন স্টেশন থেকে ডাক এলো তখন আমি রল্‌ফের সঙ্গেই ছিলাম। বিছানা ছেড়ে ঘুম চোখে কফির জল চাপাতে গেলাম, তখন রল্‌ফ দ্রুত তৈরি হচ্ছিল। ওর নিত্য সঙ্গি সবুজ ক্যানভাসের ঝোলায় সমস্ত সরঞ্জাম ভরে নিয়েছিল, এরপরে যেভাবে অসংখ্যবার পরস্পরকে বিদায় জানিয়ে এসেছি এতকাল, ঠিক একইভাবে এবারও বিদায় জানিয়েছিলাম। কোনো অশুভ-চিন্তা আমার মনে আসে নি । রান্নাঘরে বসেই কফিতে চুমুক দিতে দিতে ওকে ছাড়া লম্বা দিনটা কাটানোর পরিকল্পনা করছিলাম, আমি নিশ্চিত ছিলাম যে পরের দিনই ও ফিরে আসবে। সে সবার আগেই অকুস্থলে পৌঁছেছিল কারণ অন্য রিপোর্টাররা যখন জিপ, সাইকেল কিংবা পায়ে হেঁটে দুস্তর সেই ধ্বংসযজ্ঞের কিনারে পৌঁছানোর জন্য সংগ্রাম করছে রল্‌ফ কার্লে ওর টেলেভিশন কেন্দ্রের নিজস্ব হেলিকপ্টরের সুবাদে সেই দুর্লংঘ্য যাত্রাপথটি আকাশপথে অতিক্রম করেছিল । আমরা টেলিভিশনের পর্দায় ওর সহকারীর ক্যামেরার ফুটেজে হারানো শিশু, আহত, উদ্ধারপ্রাপ্ত, এবং মৃতদেহের সেই বিশৃঙ্খলার মাঝখানে মাইক্রোফোন হাতে হাঁটুকাদায় দাঁড়ানো রল্‌ফকে দেখতে পাচ্ছিলাম। ওর শান্ত ধারাভাষ্যে দুর্যোগকবলিত এলাকার গল্পগুলি আমাদের কাছে পৌঁছে যাচ্ছিল। বিগত বছরগুলিতে সংবাদ-প্রতিবেদক হিসেবে রল্‌ফ একজন সুপরিচিত মুখ হয়ে দাঁড়িয়েছে, যুদ্ধক্ষত্রে কিংবা আকস্মিক দুর্ঘটনার কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে ও অদ্ভুত দৃঢ়তায় ঘটনার বিবরণ দিতে পারে। সে একজন অদম্য মানুষ এবং ওর বিপদ কিংবা দুর্ভোগ উভয় পরিস্থিতিকে সমান মেজাজে আত্মস্থ করার গুণটি আমাকে মুগ্ধ করে, মনে হয় যেন কোনো কিছুই ওকে ভড়কে দিতে কিংবা ওর কৌতুহলকে দাবিয়ে রাখতে পারবে না। কোনো ধরনের ভয়ভীতিও যেন ওকে স্পর্শ করে না, যদিও একবার ও আমার কাছে স্বীকার করেছিল যে ও মোটেও সাহসী নয় বরং এর উল্টোটি। আমার বিশ্বাস ক্যামেরার লেন্স, ওর ওপরে এক অদ্ভুত প্রভাব ফেলে, ওকে অন্য এক সময়ে স্থানান্তর করে দেয় যেখান থেকে ও ঘটনার সঙ্গে সংলগ্ন না থেকে কেবল দর্শকের চোখেই দৃশ্যাবলী অবলোকন করতে পারে। ওকে আপন করে জানার পরে আমি উপলব্ধি করেছি এই অলীক দূরত্বই ওকে ওর নিজস্ব অনুভূতি থেকে সুরক্ষিত রাখে।

আসুসেনার গল্পের সঙ্গে রল্‌ফ কার্‌লে একদম শুরু থেকেই যুক্ত ছিলো। রল্‌ফই সেই সেচ্ছাসেবকদের ক্যামেরায় বন্দি করেছিল যারা আসুসেনাকে আবিষ্কার করেছে, এবং সেই ব্যক্তিদেরও যারা মেয়েটির কাছে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল ; ক্যামেরা জুম করে ও মেয়েটির কালচে মুখ, বড়ো চোখের তারা, কাদায় লেপ্টে থাকা জট পাকানো চুল সব দেখাচ্ছিল আমাদের । মেয়েটির চারধারে কাদাজল চোরাবালির মতো ঘিরে ছিলো , ওর কাছে সশরীরে পৌঁছানোর চেষ্টা করা মানে নিজেদেরও তলিয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে ফেলা। ওকে উদ্ধারের জন্য ওরা রশি ছুঁড়ে দিয়েছিল সেটা ধরবার জন্য মেয়েটির দিক থেকে কোনো তাগিদ ছিলো না সেচ্ছাসেবকরাই ওকে চেঁচিয়ে ওটা ধরবার নির্দেশ দিয়েছিল, মেয়েটি সেই পাঁকের ভেতর থেকে হাত বাড়িয়ে তা ধরবার উপক্রম করতেই ওর শরীর আরো খানিক দেবে গিয়েছিল । রল্‌ফ ওর পিঠের সবুজ ঝোলাসহ অন্যান্য সরঞ্জাম নিচে ছুঁড়ে দিয়েছিল এবং কাদার ধ্বস ঠেলে এগোতে এগোতে ওর সহকারীর মাইক্রোফোনে জানাচ্ছিল, ওখানকার আবহাওয়া বেশ ঠান্ডা এবং লাশের পঁচা গন্ধ ওর নাকে এসে লাগছে।

“তোমার নাম কী?” সে মেয়েটিকে জিজ্ঞাসা করেছিল, এবং তখনই মেয়েটি ওর সেই ফুলের নামে নামটির কথা জানিয়েছিল।- “নড়বে না আসুসেনা,” রল্‌ফ কার্‌লে ওকে নির্দেশ দিয়েছিল এবং ওর মনোযোগ বিক্ষিপ্ত করতে যা মনে আসে তাই অবিরাম বলে চলেছিল, সেই সঙ্গে সন্তর্পণে কোমর-কাদা ঠেলে সামনে এগোচ্ছিল। ওর চারপাশের হাওয়াও কাদামাটির মতোই ঘোলাটে দেখাচ্ছিল।

যে পথ ধরে ও এগোচ্ছিল সেই দিক থেকে মেয়েটির কাছে কোনোমতেই পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছিল না, ফলে ওকে পেছাতে হয়েছিল এবং পা রাখার মতো শক্ত মাটির খোঁজে আশে পাশে বেশ খানিকক্ষণ ঘুরতে হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত যখন মেয়েটির কাছাকাছি যাওয়া সম্ভব হলো তখন সেই রশিটা মেয়েটির দুই বাহুর নিচে ও বেঁধে দিয়েছিল যাতে উদ্ধারকারীরা মেয়েটিকে সহজে টেনে তুলতে পারে। ও মেয়েটির দিকে তাকিয়ে ওর সেই চোখের কোণ-কুঁচকানো শিশুসুলভ হাসিটা হেসেছিল; মেয়েটিকে এই বলে আশ্বস্ত করেছিল যে সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে, ও এখন মেয়েটির কাছেই আছে এবং খুব শিগ্রী ওকে এই পাঁক থেকে উদ্ধার করা হবে। এরপরে ও অন্যদের টেনে তোলার সংকেত দিয়েছিল কিন্তু রশিতে টান লাগা মাত্রই মেয়েটি আর্তনাদ করে উঠেছিল। ওরা বেশ কবার চেষ্টা করেছিল, মেয়েটির কাঁধ এবং বাহুই কেবল দেখা গিয়েছিল এর বাইরে ওকে একচুলও নড়ানো সম্ভব হয় নি। কেউ একজন রায় দিয়েছিল, ওর শরীর নির্ঘাত বাড়ির দেওয়ালের নিচে চাপা পড়েছে, মেয়েটি জানিয়েছিল কেবল বাড়ির জঞ্জাল নয় ওর মৃত ভাইবোনেরাও ওর পা জড়িয়ে আছে।

“চিন্তা করো না, আমরা তোমাকে এখান থেকে বের করবোই”, রল্‌ফ ওকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। সম্প্রচারের দুর্বলতা সত্ত্বেও আমি টের পাচ্ছিলাম রল্‌ফের গলা আবেগে ভেঙে যাচ্ছে এবং আমি আগের চেয়েও ওকে আরো বেশি ভালোবেসে ফেলেছিলাম। আসুসেনা ওর দিকে তাকিয়েছিল কিন্তু কোনো কথা বলে নি।

শুরুর কয়েক ঘণ্টা মেয়েটিকে উদ্ধারের জন্য রল্‌ফ কার্‌লে ওর উদ্ভাবন-কুশলতায় যা কিছু সম্ভব তার সবই অনুসরণ করেছিল। লাঠি এবং রশি দিয়ে প্রাণপণে ওকে টেনে বার করবার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু প্রতিটি টান আটকে পড়া মেয়েটির জন্য অসহনীয় অত্যাচারে পর্যবসিত হয়েছিল। এরপরে লাঠিগুলির একটিকে উত্তোলক হিসেবে ব্যবহার করে ওকে আল্‌গা করবার চেষ্টাও করেছিল কিন্তু সেই কৌশলেও ব্যর্থ হয়। কিছু সময়ের জন্য সেনাবাহিনীর উদ্ধারদলের কয়েকজনকে রল্‌ফ তার সঙ্গে কাজ করাতে পেরেছিল কিন্তু চারপাশের অন্য আহতদের আর্তিতে সাড়া দিতে ওদেরও চলে যেতে হয়েছিল। মেয়েটি নড়াচড়া করতে পারছিল না, কোনোমতে নিশ্বাস নিচ্ছিল কিন্তু ওর মধ্যে কোনো মরিয়া ভাব ছিলো না, যেন বংশগত সমর্পণের পরম্পরায় সেও তার অদৃষ্টকেই মেনে নিয়েছিল। অন্যদিকে আমাদের এই প্রতিবেদক ওকে মৃত্যুর হাত থেকে ছিনিয়ে আনবার সঙ্কল্প নিয়েছিল । কেউ একজন ওকে একটা টায়ার দিয়ে গিয়েছিল যেটা সে মেয়েটির বগলের নিচে বয়ার মতো স্থাপন করেছিল এবং ফাঁকা জায়গাটার কাছে একটা তক্তা পেতেছিল যা ওকে দেহের ভারসাম্য রেখে মেয়েটির কাছাকাছি থাকতে সাহায্য করবে। অন্ধের মতো হাতড়ে ভেতরের ধ্বংসস্তুপের জঞ্জাল পরিষ্কার করা সহজ নয় সেই কারণে ও এক-দুই বার ডুব দিয়ে মেয়েটির পায়ের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টাও করেছিল কিন্তু প্রতিবারই সারা শরীরে কাদা মেখে এবং মুখের ভেতরে ঘুঁষে যাওয়া পাথরকুচির থুথু ছিটাতে ছিটাতে চুড়ান্ত হতাশ হয়ে ওকে বেরিয়ে আসতে হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত ও সিদ্ধান্তে এসেছিল যে পাম্প দিয়েই জল সেচে সরানো ছাড়া ওকে উদ্ধার অসম্ভব এবং বেতারবার্তায় সেটির জন্য অনুরোধ জানালে উত্তরে ওকে জানানো হয়, পরিবহনের অপ্রতুলতার কারণে পরদিন সকালের আগে পাম্পটি প্রেরণ করা সম্ভব হবে না।

“আমাদের হাতে অত সময় নেই”, রল্‌ফ কার্‌লে চিৎকার করে জানিয়েছিল, কিন্তু সেই চুড়ান্ত বিশৃঙ্খল পরিবেশে সহানুভূতি জানানোর জন্য কারো অবসর ছিলো না । যদিও আরো অনেক ঘণ্টা অতিক্রান্ত হলেই রল্‌ফও সময়ের এই নিশ্চলতা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল এবং এই রুঢ় বাস্তব আর কখনই পাল্টাবে না সেটিও জেনে গিয়েছিল। সেনাবাহিনীর এক চিকিৎসক মেয়েটিকে পরীক্ষা করে জানিয়েছিলেন, ওর হৃদযন্ত্র যথেষ্ট ভালো এবং যদি খুব বেশি ঠান্ডা না লাগায় তবে রাতটা ওর টিকে যাবার সম্ভাবনা আছে।

“সাহস রাখো আসুসেনা কালকের মধ্যেই পাম্পের ব্যবস্থা হয়ে যাবে,” রলফ মেয়েটিকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছিল।

“আমাকে এখানে একা রেখে যেও না তুমি”, মেয়েটি মিনতি করেছিল।

“না, আমি অবশ্যই তোমাকে ফেলে যাবো না”

কেউ একজন ওর জন্যে এককাপ কফি এনে দিয়েছিল এবং মেয়েটিকে ছোটো ছোটো চুমুকে সেই কফি পান করতে ও সাহায্য করেছিল। কফির উষ্ণতায় মেয়েটি খানিক তাজা বোধ করছিল হয়তোবা এবং সে ওর ছোটো জীবন, পরিবার, স্কুল, অগ্ন্যুৎপাতের আগের সেই নিজস্ব পৃথিবীর নানা কিছু নিয়ে কথা বলছিল। রল্‌ফ জেনেছিল ওর বয়স তের এবং ও কখনো এই গ্রামের সীমানার বাইরে পা রাখেনি। রল্‌ফ কার্‌লের অস্ফুট এক আশা উড়ালডানা পেয়েছিল, ও বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল যে শেষটা হয়তো ভালোই হবে: পাম্প এসে পৌঁছাবে, জল সেচে ফেলার পরে ইটপাথরের টুকরো সরানোও সম্ভব হবে এবং আসুসেনাকে হ্যালিকপ্টরে উড়িয়ে হাসপাতালে নেওয়া যাবে যেখানে ও দ্রুত সুস্থ হবে এবং রল্‌ফ উপহার নিয়ে ওকে দেখতে যাবে। রল্‌ফ মনে মনে ভাবছিল : পুতুল খেলার বয়স পেরিয়ে এসেছে সে, এবং আমি জানি না এই বয়েসের মেয়েরা কী পেলে খুশী হয়; হয়তো জামা। আমি মেয়েদের বিষয়ে তেমন কিছু জানিই না, ও নিজের ভাবনায় নিজেই মজা পাচ্ছিল। ভেবে দেখল এই বয়স পর্যন্ত ও কম নারীসঙ্গ করে নি কিন্তু তাদের কেউই মেয়েদের পছন্দ-অপছন্দ নিয়ে ওকে কোনো তালিম দেয় নি। সময় কাটাতে সে আসুসেনাকে ওর ভ্রমণ এবং খবর-শিকারের নানা রোমাঞ্চকর অভিযানের গল্প বলতে লাগল, এক সময় ওর স্মৃতির ঝুলি খালি হয়ে গেলে আসুসেনাকে খুশি করতে পারে এমন সব গল্প বানিয়ে বানিয়ে বলা শুরু করল। মাঝে মাঝে আসুসেনা ঝিমিয়ে পড়ছিল, তবুও ও যেন বোঝে যে রল্‌ফ ওর পাশে আছে এবং সেই সঙ্গে অনিশ্চয়তার ভয় দূর করতেও অন্ধকারের ভেতরেও রল্‌ফ অবিরাম কথা বলে যাচ্ছিল।

সেই রাতটি বড়ো বেশি দীর্ঘ ছিলো।

অকুস্থল থেকে অনেক দূরে নিজের বাড়ির টেলিভিশনের পর্দায় আমি রল্‌ফ কার্‌লে এবং আসুসেনাকে দেখছিলাম। একা বাড়িতে এই প্রতিক্ষা আমার কাছে অসহ্য লাগছিল, তাই আমি জাতীয় টেলিভিশন ভবনে চলে গিয়েছিলাম, যেখানে একসময় রল্‌ফের পাশে বসে ওর অনুষ্ঠান সম্পাদনার কাজ দেখতে দেখতেই অনেক রাত পার করেছি আমি । এই জায়গাটায় এলে মনে হয় যেন আমি ওর পৃথিবীটার কাছাকাছি আছি, এখানে থাকাতে অন্তত সেই চুড়ান্ত তিন দিন ও কীভাবে পার করেছিল সেটি অনুভব করতে পেরেছিলাম আমি। টেলিভিশন ভবনে বসেই আমি শহরের সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, সিনেটর, সশস্ত্র বাহিনীর প্রশাসকবৃন্দ, উত্তর আমেরিকার রাষ্ট্রদূত, এবং জাতীয় জ্বালানী প্রতিষ্ঠানের প্রধানের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম , জরুরি ভিত্তিতে কাদামাটি সরানোর জন্য একটা পাম্পের ব্যবস্থা করার মিনতি জানিয়েছিলাম, কিন্তু আমি কোনো প্রতিশ্রুতি নয় হাল্কা আশ্বাস পেয়েছিলাম। বেতারে ও টেলিভিশনেও জরুরি সাহায্যের আবেদন করেছিলাম কেবল নিশ্চিত হতে যে এই খানেও এমন কেউ নেই, যে আমাদের সাহায্য করতে পারে। এই সব ফোনকলের ফাঁকে ফাঁকে উপগ্রহের মাধ্যমে অকুস্থল থেকে পাঠানো উদ্ধার-কার্যক্রমের অগ্রগতি দেখতে সংবাদকক্ষে ছুটে যাচ্ছিলাম । প্রতিবেদকেরা যখন জনমনে অভিঘাত আনতে পারে এমন ফুটেজগুলিই বাছাই করতেন, আমার চোখ তখন ব্যস্ত থাকতো আসুসেনার কাদার ফাঁদের ফুটেজের খোঁজে। একসময় দুর্বিপাকের ধ্বংসলীলার সামগ্রিক ছবিটি একইতলে দেখাতে গিয়ে ছবিগুলো যখন ছোটো হলো মনে হলো যেন টেলিভিশনের পর্দাই সংকুচিত হয়ে আমার এবং রল্‌ফ কার্‌লের মধ্যেকার বিশাল দুরত্বটিই প্রকটভাবে প্রকাশ করে তুলছে , তা সত্ত্বেও আমি ওর সঙ্গেই ছিলাম। বাচ্চাটার যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুখ ওর মতোই আমাকেও পীড়িত করছিল; ওর নৈরাশ্য, অক্ষমতা সবই আমি অনুভব করছিলাম। রল্‌ফের সঙ্গে যোগাযোগ অসম্ভব জেনে এক দুর্দান্ত ভাবনা আমার মনে উদয় হয়েছিল, যদি চেষ্টা করি আমি হয়তো মানসিক ভাবে ওকে ছুঁতে পারবো এবং এভাবেই এখানে থেকেও ওকে উদ্দীপ্ত করতে পারবো। আমি আমার সকল মনোযোগ ওর ওপরেই নিবদ্ধ করেছিলাম যতক্ষণ না আমার মাথা ঝিমঝিম করা শুরু করেছিল- অসার পাগলপনাই ছিলো এটি। এক এক সময় ওদের জন্য আমি এমনই আবেগে কাতর হতাম যে কান্নায় ভেঙে পড়তাম আবার এক এক সময় হতাশা আমাকে এমনভাবে গ্রাস করতো মনে হতো যেন টেলিস্কোপের ভেতর দিয়ে সেই দূরবর্তী তারাটির দীপ্তি দেখছি , অনেককাল আগেই যার মৃত্যু ঘটেছে।

আমি প্রথম দিনের সম্প্রচারে সেই নরকের ছবি প্রত্যক্ষ করেছিলাম, এক রাতের তাণ্ডবে সৃষ্ট সেই বরফগলা নদীর ঢলের তোড়ে মানুষ এবং পশুর লাশ পাশাপাশি কীভাবে ভেসে বয়ে যাচ্ছে দেখেছি। কাদার ওপরে গাছের মাথা এবং গির্জার ঘন্টার চূড়া জেগে উঠেছিল যেখানে আশ্রিত মানুষেরা ধৈর্যসহকারে উদ্ধারকারী দলের অপেক্ষায় প্রহর গুনছিল। বেসামরিক প্রতিরক্ষাবাহিনীর সেচ্ছাসেবকরা তখনও সেই কাদার ধ্বস থেকে প্রাণের চিহ্ন খুঁজে ফিরছিল আর অন্যদিকে ছিন্নবস্ত্রধারী ছায়ামূর্তিরা তাদের ভাগের এক কাপ গরম সুরুয়ার জন্য অপেক্ষা করছিল। বেতারের যৌথ সম্প্রচারে জানাচ্ছিল অনাথ শিশুদের আশ্রয় দিতে আগ্রহী পরিবারদের কলের আধিক্যে তাদের ফোনলাইন স্থবির হয়ে আছে। খাবার পানির সংকটের সঙ্গে খাদ্য এবং জ্বালানীরও অপ্রতুলতা প্রকট হচ্ছিল। চিকিৎসকেরা উদ্ধারকৃতদের জীবনরক্ষার্থে চেতনানাশক ছাড়া হাত কিংবা পা ব্যবচ্ছেদে অপারগতা জানিয়েছিলেন অন্তত সেরাম এবং ব্যথানাশকের ব্যবস্থা করার জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে আর্তি জানাচ্ছিলেন; সড়কপথে সকল যোগাযোগ ব্যবস্থা পর্যুদস্ত হওয়ার হাঙ্গামার চেয়েও প্রশাসনিক জটিলতা অধিক বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এই সব কিছু ছাড়িয়ে গলিত মৃতদেহ কাদায় মিশে গিয়ে জীবিতদের জন্য মহামারীর ঝুঁকি তৈরি করেছিল।

যে টায়ার ওকে কাদার ওপরে ভাসিয়ে রেখেছিল তার ভিতরে আসুসেনা রীতিমত কাঁপছিল। একজায়গায় অমন আটকে থাকা এবং অনিশ্চয়তা ওকে অসম্ভব দুর্বল করে দিয়েছিল কিন্তু এরপরেও সে জ্ঞান হারায় নি এবং তখনও মাইক্রোফোন ধরলে ও উত্তর দিচ্ছিল। ওর গলার স্বরে একধরনের নম্রতা ছুঁয়ে ছিলো, মনে হচ্ছিল যেন চারপাশের হট্টগোলের জন্য সে ক্ষমাপ্রার্থী। রল্‌ফ কার্‌লের মুখে দাঁড়ির আভাস এবং চোখের তলায় কালো ছোপ; ওকে প্রায় নির্জীব দেখাচ্ছিল। এত দূর থেকেও আমি ওর ক্লান্তির প্রাবল্য টের পাচ্ছিলাম, এই অবসাদ ওর অন্যান্য অভিযানের অবসাদ থেকে একেবারেই ভিন্ন। ও যেন ক্যামেরার কথা ভুলে গেছে, লেন্সের চোখ দিয়েও ও আর মেয়েটির দিকে তাকাতে পারছিল না। আমরা আসুসেনার যে সমস্ত ছবি পাচ্ছিলাম তার সবই অন্য সাংবাদিকদের সৌজন্যে যারা আসুসেনাকে এমনভাবে উপস্থাপন করছিল যেন এই দুর্যোগের ভয়াবহতার প্রদায়ক হওয়াই ওর একমাত্র দায়িত্ব। ভোরের আলো ফুটতেই রল্‌ফ মেয়েটির চারপাশের সমস্ত সরঞ্জাম যা মেয়েটিকে ওর কবরে আবদ্ধ করে রেখেছিল তার সবই সরিয়ে ফেলতে লাগল। কিন্তু এই কাজে কেবল ওর দুই হাতই ব্যবহার করছিল মেয়েটি আঘাত পেতে পারে ভেবে সে অন্য কোনো ধরনের যন্ত্রের সাহায্য নিতে সাহস করে নি। সৈনিকদের পরিবেশিত এক কাপ ভুট্টার ছাতু এবং কলা সে আসুসেনাকে খাইয়েছিল কিন্তু গলা দিয়ে নামতে না-নামতেই আসুসেনা তা উগড়ে দিয়েছিল। একজন চিকিৎসক ওকে দেখে গিয়েছিলেন এবং জানিয়েছিলেন ওর জ্বর এবং এ-ও যোগ করেছিলেন এই জ্বর প্রশমনেও তিনি খুব বেশি কিছু করতে পারবেন না।অ্যাান্টিবায়োটিক কেবল গ্যাংগ্রিন হতে পারে এমন রোগীদের জন্য সংরক্ষিত। একজন ধর্মযাজকও ওকে দেখে গিয়েছিলেন, ভার্জিনের একখানা লকেট ওর গলায় ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন। সন্ধ্যার দিকে হাল্কা বৃষ্টি পড়া শুরু হলো ।

“আকাশ কাঁদছে”, আসুসেনা মৃদু স্বরে বলেছিল এবং সে নিজেও কাঁদতে শুরু করেছিল।

‘ভয় পেও না’, রল্‌ফ মিনতি করেছিল। “তোমাকে শক্তি ধরে রাখতে হবে এবং শান্ত থাকতে হবে। সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি তো আছিই যেভাবে হোক তোমাকে এখান থেকে উদ্ধার করবই”

সাংবাদিকেরা আসুসেনার ফটো তোলার জন্য আবার ফিরে এসেছিল এবং আগের প্রশ্নগুলিই আবার জিজ্ঞেস করছিল, আসুসেনা আর উত্তর দেওয়ার চেষ্টাই করছিল না। এরই মধ্যে টেলিভিশন এবং চলচ্চিত্রের লোকজন দল বেঁধে অকুস্থলে পৌঁছে গিয়েছিল এবং ওদের সঙ্গেই এলো বৈদ্যুতিন-তারের গোছা, এলো ফিল্ম, ভিডিও, সূক্ষ্ম-লেন্স, রেকর্ডার, শব্দ-নিরোধক, আলো, প্রতিবর্তী-পর্দা, সহায়ক-মোটর, বাক্সভর্তি নানা সরঞ্জাম, বিদ্যুত- মিস্ত্রি, শব্দগ্রাহক এবং চিত্রগ্রাহক। সারা বিশ্বের লক্ষাধিক টেলিভিশনের পর্দায় আসুসেনার মুখ ঝলসে উঠেছিল। এবং এই পুরোটা সময় ধরে রল্‌ফ কার্লে কেবল একটি পাম্পের জন্যই সনির্বন্ধ মিনতি জানিয়ে যাচ্ছিল । এইসব উন্নত যন্ত্রের সমাগমে সম্প্রচারের উৎকর্ষতা বেড়ে গিয়েছিল ফলে জাতীয় টেলিভিশনে সম্প্রচারিত ছবিগুলো আরো তীক্ষ্ণ এবং আওয়াজও স্পষ্ট শোনা যাচ্ছিল; হঠাৎ করেই সব কিছু বড় নিকটে চলে এলো যেন, এবং আমার এক অদ্ভুত অস্বস্তিকর অনুভূতি হচ্ছিল, মনে হচ্ছিল আসুসেনা এবং রল্‌ফ ঠিক যেন আমার পাশেই, এক অভেদ্য কাচ আমাদের বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। আমি প্রতি ঘন্টার ঘটনাপ্রবাহ অনুসরণ করতে পারছিলাম ; আমার ভালোবাসার মানুষটি আসুসেনাকে ওর বন্দিদশা থেকে মুক্ত করতে এবং ওর দুর্ভোগকে সহনীয় করতে যা কিছু করছিল আমি তার সবই জানতে পারছিলাম; ওদের কথোপকথনের ছিঁটেফোঁটা আমার কানেও ভেসে আসছিল এবং বাকিটুকু আন্দাজ করে নিতে আমার কোনো অসুবিধাই হচ্ছিল না। রল্‌ফকে যখন ও প্রার্থনা করতে শেখাচ্ছিল আমি সেখানে ছিলাম, যখন আসুসেনার মনোযোগ বিক্ষিপ্ত করতে রল্‌ফ, আমাদের সাদা মশারির নিচে, বিছানায়, এক হাজার এক রাতে আমারই বলা গল্পগুলো বলছিল তখনও আমি ওদের পাশেই ছিলাম।

দ্বিতীয় দিন রাত নামতেই রল্‌ফ ওর মায়ের কাছে শেখা অস্ট্রিয়ান পুরোনো লোকগান গুলি গেয়ে আসুসানার চোখে ঘুম নামানোর চেষ্টা করছিল, কিন্তু সে তখন ঘুম ছাড়িয়ে অনেক দূরে। অতঃপর এই দুই ক্ষুধার্ত এবং শ্রান্ত, নিশ্চল মানুষ ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে পরস্পরের সঙ্গে কথা বলেই রাতের বেশিরভাগ সময় পার করেছিল। সেই রাতেই, দীর্ঘদিন ধরে এক অনম্য দেয়াল দিয়ে রুখে রাখা রল্‌ফ কার্লের অতীতের বাঁধ ধীরে ধীরে ভাঙছিল, যা কিছু এতকাল ওর মনের গহীনে অগুন্তি গোপন পরতের আড়ালে লুকানো ছিলো স্মৃতির প্রবল জোয়ার দীর্ঘদিনের অবচেতনের সেই আগলটি ধ্বসিয়ে দিয়েছিল। ও সবটুকু আসুসেনাকে বলতে পারে নি; মেয়েটি হয়তো জানেই না ওর চেনা সমুদ্রের ওপারে আরেকটা দুনিয়া আছে এবং ওর যাপিত জীবনের গতকালের অতীতের পেছনে আরো সুদূর অতীত আছে; এছাড়াও যুদ্ধকালীন ইউরোপকে কল্পনা করাও ওর পক্ষে সম্ভব নয়। সেই জন্যেই ও সেই পরাজয়ের গল্পটি ওকে বলতে পারে নি, কিংবা সেই দুপুরের গল্পটিও নয় যখন রাশান সৈন্যদের নেতৃত্বে ওরা সেই বন্দিশিবিরে অনাহারে মৃত বন্দিদের অগুন্তি লাশ দাফন করেছিল। তাছাড়া ও কেনই বা সেই ভয়ঙ্কর দৃশ্যের বর্ণনা দেবে যেখানে নগ্ন দেহগুলি আগুনকাঠের স্তুপের মতো এমনভাবে রাখা হয়েছিল যে দেখে মনে হচ্ছিল যেন চিনামাটির তৈরি ভঙ্গুর কোনো আয়োজন? মৃত্যপথ যাত্রী এই শিশুকে ও কীভাবেই বা চুল্লী আর ফাঁসিকাঠের গল্প শোনাবে? ও সেই রাতের কথাটিও উহ্য রেখেছিল যে রাতে ও ওর নগ্ন মাকে দেখতে পেয়েছিল, লাল উঁচু গোড়ালির বুট পরা মা অপমানে কাঁদছিল।

এমন অনেক কথাই ও বলে নি কিন্তু ওর অবচেতন মন যা কিছু মুছে ফেলার চেষ্টা করেছিল সেই রাতের কয়েক ঘণ্টায়, সেই ঘটনাগুলোই প্রথমবারের মতো ও পুনর্যাপন করেছিল। আসুসেনা ওর সমস্ত ভয় রল্‌ফের কাছেই গচ্ছিত রেখেছিল তাই হয়তো না-চাইলেও রল্‌ফের নিজস্ব ভয়েরা ওর মুখোমুখি হতে ওকে বাধ্য করেছিল। সেই নরক-দুয়ারের মতো পাঁকের তালের পাশে দাঁড়িয়ে রল্‌ফের পক্ষেও নিজের কাছ থেকে পালানো দুরূহ ছিলো এবং ছেলেবেলার সেই দম-আটকানো ভয় ওকে আবার আষ্টেপৃষ্ঠে চেপে ধরেছিল। সে আসুসেনার বয়সে কিংবা তারচেয়েও কম বয়সের শৈশবকালটিতে ফিরে গিয়েছিল এবং আসুসেনার মতোই এক গভীর খাদে নিজেকে আবিষ্কার করেছিল যেখান থেকে পালানো অসম্ভব এবং সেই খাদ ওর জীবনের ভেতরেই প্রোথিত ছিলো, ওর মাথা জমিন থেকে ঠিক ততটুকুই উঁচুতে ছিলো যতটা উঁচুতে থাকলে ওর বাবার বুটজোড়া এবং পায়ের চলাচল দেখতে পাওয়া যায়, যিনি কোমর থেকে বেল্ট খুলে হাওয়াতে চাবুকের মতো হাঁকাচ্ছিলেন যা কিনা বিষধর সরিসৃপের মতোই হিসহিসিয়ে ছোবল হানতে কখনোই ভুল করতো না।

বিষণ্ণতায় মন ছেয়ে গিয়েছিল ওর, স্মৃতির অতলে ঘুমিয়ে থাকা বেদনা যেন একই তীব্রতা নিয়ে জেগে ওঠার অপেক্ষায় ছিলো। পরক্ষণেই মনে হয়েছিল সে যেন সেই অন্ধকার দেরাজের ভেতরে বসে আছে যেখানে কোনো এক অলীক অপরাধের শাস্তি হিসেবে ওর বাবা ওকে বন্দি করে রেখেছেন, অনন্ত সময় ধরে সে অন্ধকার এড়ানোর জন্য চোখ বুজে গুঁড়ি মেরে নুইয়ে ছিল, নিজের হৃদপিণ্ডের আওয়াজ এড়াতে দুই হাতে কান ঢেকে, কোণঠাসা ভয়ার্ত পশুর মত কাঁপছিল সে। সেই স্মৃতির গলিতে দিশাহীন ঘুরতে ঘুরতে রল্‌ফ ওর বোন ক্যাথেরিনাকেও খুঁজে পেয়েছিল, মিষ্টি প্রতিবন্ধী শিশুটি যে কি না তার সারাটি জীবনই লুকিয়ে পার করেছিল এই আশায় যে একদিন বাবা হয়তো বা ওর ত্রুটিযুক্ত শরীর নিয়ে জন্মানোর গ্লানি ভুলে যাবেন। ক্যাথেরিনার সঙ্গে রল্‌ফও খাবার টেবিলের তলায় হামা দিয়ে ঢুকে পড়তো, সাদা টেবিল ক্লথের লম্বা ঝুলের আড়ালে আজন্ম আলিঙ্গনে জড়াজড়ি করে থাকা ভাইবোন দুটি কান খাড়া করে শুনতো পায়ের আওয়াজ এবং গলার স্বর।ক্যাথেরিনার গায়ের সুবাস, ওর ঘামের গন্ধের সঙ্গে রান্নার রসুন, স্যুপ, সদ্য সেঁকা রুটির গন্ধ এবং এসবের ভেতরেই অনাকাঙ্খিত পঁচামাটির উৎকট গন্ধটিও মিলেমিশে একাকার হয়ে যেত। ওর হাতের ভেতরে ছোটো বোনটির হাত, ভয়ার্ত শ্বাস , ওর গাল ছুঁয়ে থাকা বোনটির রেশমি চুল এবং সেই স্বচ্ছ চাউনি সব উথলে উঠেছিল। ক্যাথেরিনা … ক্যাথেরিনা যেন ওর চোখের সামনেই মূর্ত হয়ে উঠল, পতাকার মতো হাওয়াতে ভাসতে লাগল, পরনে সাদা টেবিল ক্লথ, এখন যেন পাতলা চাদরে ওর শরীর মোড়ানো এবং অবশেষে সে ক্যাথেরিনার মৃত্যুর জন্য এবং ওকে ত্যাগ করার অনুশোচনার জন্য কাঁদতে পারল। ও তখনই বুঝতে পারল প্রতিবেদক হিসেবে ওর সমস্ত কৌশল, ওর যাবতীয় অর্জন এবং সম্মান এর সবকিছুই আদপে নিজের ভীতিকর সেই অতীতকে দূরে রাখারই এক প্রচেষ্টা মাত্র, সে আসলে দেখতে চেয়েছে লেন্সের পেছনে চোখ রেখে সত্যকে প্রত্যক্ষ করা অধিকতর সহনীয় কি না। তার দিনের বেলার অতিরিক্ত ঝুঁকির উদ্যম আসলে রাতের ভীতিকর দানবটিকে দমানোর জন্য সাহসী হওয়ার প্রশিক্ষণ ছাড়া আর কিছুই নয় । কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই নিষ্ঠুর সত্যের মুখোমুখি তাকে হতেই হলো; অতীতকে আর এড়ানো সম্ভব হলো না। ও নিজেই যেন আসুসেনা; এই কাদার পাঁকে ডুবে ছিলো; ওর এই আতঙ্ক, প্রায় ভুলতে বসা সুদূর শৈশবের কোনো আবেগ নয়, বরং গলার ভেতরে ভাসা তীক্ষ্ণ নখের চাপ। ওর চোখ ভেসে যাচ্ছিল জলে এবং সেই জলের তোড়ে স্মৃতির তল থেকে ভেসে উঠেছিলেন ওর মা-ও, কালো পোশাকে সজ্জিত মা, বুকের কাছে কৃত্রিম কুমিরের খোলসে বাঁধাই করা খুদে বইটি ধরে আছেন, ঠিক যেমনটি শেষবার জাহাজঘাটে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিল সে, সেদিন তিনি ওকে দক্ষিন আমেরিকামুখি নৌকায় তুলে দিতে এসেছিলেন। কিন্তু এই তিনি ওর চোখের জল মোছাতে আসেন নি, কোদাল তুলে নিতে বলতে এসেছিলেন: যুদ্ধ শেষ। মৃতদের এখনই গোর দেওয়া উচিত।

“কেঁদো না। আমার কষ্ট হচ্ছে না। আমি ঠিক আছি”, আসুসেনা সন্ধ্যা নামলে বলেছিল।

“আমি তোমার জন্যে কাঁদছিনা’, মৃদু হেসে উত্তর দিয়েছিল রল্‌ফ। “আমি আমার নিজের জন্য কাঁদছি।আমার সমস্ত শরীর জুড়েই ব্যথা”।

কালো মেঘের ফাঁকে ফ্যাকাসে আলোর আভাস নিয়ে সেই বিধ্বস্ত উপত্যকার তৃতীয় দিনটি শুরু হয়েছিল। প্রজাতন্ত্রের প্রধান তাঁর শরীরের মাপে বানানো সাফারি জ্যাকেট পরে উপদ্রুত এলাকা পরিদর্শন শেষে প্রত্যয়ন দিয়েছিলেন, এটিই শতাব্দীর অন্যতম দুর্যোগ; সমস্ত দেশ শোকে নিমজ্জিত, সমব্যথী সকল রাষ্ট্র ইতোমধ্যেই ত্রান প্রদানের প্রস্তাব দিয়েছে; তিনি দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছেন;সশস্ত্রবাহিনী এই বিষয়ে অনমনীয় ভূমিকা রাখবে, চুরি কিংবা অন্য কোনো অপরাধে সংশ্লিষ্টদের দেখা মাত্রই গুলি করা হবে। তিনি এ-ও যোগ করেছিলেন, সকল মৃতদেহ সরানো কিংবা নিখোঁজ ব্যক্তিদের সংখ্যা গণনা করা দুরূহ কাজ; সমস্ত উপত্যকাকেই তাই পবিত্র ভূমি ঘোষণা করা হলো এবং ধর্মযাজকগণ এখানেই মৃতদের আত্মার সদ্গতির জন্য যথাযথ আচার অনুষ্ঠান সম্পন্ন করবেন। এরপরে তিনি সেনাদের তাবুর মাঠে উদ্ধারপ্রাপ্তদের সমাবেশে ত্রাণসংক্রান্ত আবছা কিছু প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তার পরে তিনি অস্থায়ী হাসপাতালে কঠোর পরিশ্রমরত চিকিৎসক এবং সেবকদের উদ্দেশ্যে প্রণোদনামূলক দুই এক কথা বলেছিলেন। অতঃপর তিনি আসুসেনা নামের মেয়েটি, যাকে সারা বিশ্ব দেখে ফেলেছে তার কাছে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তিনি বালিকাকে উদ্দেশ্য করে তাঁর রাষ্ট্রপ্রধানসুলভ শিথিল হাতখানি দুলিয়েছিলেন, এবং মাইক্রোফোন সমূহ তাঁর আবেগাপ্লুত কণ্ঠ এবং পিতৃসুলভ সেই বক্তৃতাটি ধারন করেছিল যেখানে তিনি আসুসেনার উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, তার সাহস সমগ্র জাতির জন্য উদ্দীপনার স্মারক হয়ে থাকবে। রল্‌ফ তাঁকে থামিয়ে একটি পাম্প চেয়েছিল এবং রাষ্ট্রপতি এই বিষয়টি স্বয়ং দেখবেন বলে ওকে আশ্বস্ত করেছিলেন। আমি রল্‌ফকে কয়েক সেকেন্ডের জন্য সেই কাদার খাদের কাছে হাঁটুমুড়ে বসে থাকতে দেখেছিলাম। সন্ধ্যার সংবাদ সম্প্রচারেও দেখলাম ও একই ভঙিমায় বসে আছে; এবং গণক যেভাবে তার স্ফটিকগোলক স্পর্শ করে থাকে আমিও তেমন করেই টেলিভিশনের পর্দায় আমার চোখ সেঁটে রেখেছিলাম, ওর মধ্যে কোথাও একটা ভাঙচুর আমি অনুভব করতে পারছিলাম। আমি টের পেয়েছিলাম, কোনো ভাবে রাতে ওর সুরক্ষিত দূর্গটি গুড়িয়ে গেছে এবং সে তার শোকের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে; অবশেষে সে আর দুর্ভেদ্য রইল না। নিশ্চয় মেয়েটি ওর নাজুক কোনো স্তর স্পর্শ করেছে যেখানে রল্‌ফের নিজেরও অনুপ্রবেশ অসাধ্য ছিলো, এবং যা সে আমার সঙ্গেও কখনো ভাগ করে নি। রল্‌ফ আসুসেনাকে সান্ত্বনা দিতে চেয়েছিল কিন্তু আসুসেনাই ওর সান্ত্বনা বনে গেছে ।

আমি সেই বিশেষ মুহূর্তটি চিহ্নিত করতে পেরেছিলাম যখন রল্‌ফ রণে ভঙ্গ দিয়েছিল এবং মেয়েটির তিলে তিলে মরার দৃশ্যকে মেনে নিয়েছিল। এই তিন -দিন দুই- রাতের যাত্রায় আমিও ওদের সঙ্গে ছিলাম, জীবনের অন্য পার থেকে ওদের ওপর নজর রাখছিলাম। আমি ওখানেই ছিলাম যখন মেয়েটি ওকে বলছিল ওর তের বছরের জীবনে কোনো ছেলে আজও ওকে ভালোবাসে নি এবং ভালোবাসা কী তা না-জেনে এই পৃথিবী ছাড়ার মতো দুঃখজনক বিষয় আর কিছুই নয়। রল্‌ফ ওকে আশ্বস্ত করেছিল এই বলে ও তাকে এতটাই ভালোবেসেছে তেমন করে আর কাউকেই ও কখনোই ভালোবাসে নি, ওর মায়ের চেয়ে বেশি, বোনের চেয়ে বেশি, সেই সমস্ত নারী যারা ওর বাহুতে মাথা এলিয়ে ঘুমিয়েছে তাদের সকলের চেয়ে বেশি, এই আমি, যে কিনা ওর জীবনসাথী তার চেয়েও বেশি, যে কি না সব কিছুর বিনিময়ে সেই কাদার কূপে আসুসেনার বদলে আটকে পড়তে দ্বিধা করতো না, যে কি না আসুসেনার জন্য নিজের জীবন দিতে পিছ-পা হতো না এবং আমি দেখেছিলাম রল্‌ফ যখন হাঁটু মুড়ে ওর দুঃখি কপালে চুমু খাচ্ছিল তখন এক মিষ্টি অথচ বেদনাবিধুর নামহীন আবেগ ওকে আচ্ছন্ন করেছিল। আমি অনুভব করেছিলাম ঠিক সেই মুহূর্তেই ওরা দুজনেই সকল দুঃখ যন্ত্রণা পেরিয়ে কাদার তাল থেকে মুক্ত হয়ে শকুন এবং হেলিকপ্টরের পাখা এড়িয়ে, সকল দুর্নীতি এবং অনুশোচনার বিশাল জলাভূমির উর্দ্ধে অবলীলায় ভেসে বেড়াচ্ছে। আমি দেখতে পেয়েছিলাম কীভাবে ওরা মৃত্যুকে মান্যতা দিয়েছিল। রল্‌ফ কার্লে মেয়েটির দ্রুত মৃত্যুর জন্য মৌন প্রার্থনায় মগ্ন হয়েছিল কেননা এই যন্ত্রণা অসহনীয় ছিলো।

এই সময়ের মধ্যেই আমিও একটা পাম্প জোগাড় করে ফেলেছিলাম এবং একজন সেনা প্রশাসকের সঙ্গে যোগাযোগও হয়েছিল যিনি পরদিন সকালে সৈন্যদের কার্গো-প্লেনে চাপিয়ে তা পৌঁছে দিতে সম্মত হয়েছিলেন। কিন্তু সেই তৃতীয় রাতটিতে কোয়ার্টজ বাতির স্থির দিপ্তীতে এবং হাজার ক্যামেরার লেন্সের দ্যুতিতে আসুসেনা হার মেনেছিল, ওর চোখ জোড়া সেই বন্ধুটির চোখের তারায় আটকে ছিল যে কিনা শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত ওর যাত্রাকে সহনীয় করবার চেষ্টা করেছিল। রল্‌ফ কার্লে ওর হাতের নিচের বয়াটি খুলে দিয়েছিল, আলতো হাতে ওর চোখের পাতা বুজিয়ে দিয়েছিল, কিছুক্ষণের জন্য ওকে বুকের কাছে ধরে রেখেছিল এবং এর পরেই ওকে যেতে দিয়েছিল। মেয়েটি ধীরে ধীরে তলিয়ে গেলো, কাদার ফুলটির মতোই।

তুমি আমার কাছে ফিরে এসেছিলে, তবে তুমি আর সেই ‘তুমি’ নেই। আমি প্রায়ই তোমার সঙ্গে টেলিভিশন কেন্দ্রে যাই এবং দুজনে মিলে আসুসেনার ভিডিওগুলি বার বার দেখি; তুমি নিবিড়ভাবে অনুসন্ধান করে নিশ্চিত হতে চাও এমন কিছু কি ছিলো, যা করলে হয়তো ওকে বাঁচানো যেত অথবা এমন কোনো কৌশল যা সেই মুহূর্তে তোমার মাথায় আসে নি। অথবা তুমি হয়তো আয়নার সামনে নগ্ন হয়ে শরীর পরখ করার মতো এই সব ভিডিওতে নিজেকেই তন্ন তন্ন করে খুঁযে বেড়াও। তোমার ক্যামেরাগুলি দেরাজে পড়ে আছে অবহেলায়, তুমি লিখছ না গানও গাইছো না; ঘন্টার পর ঘণ্টা তুমি জানালার পাশে বসে দূরের পাহাড়গুলিতে চোখ পেতে রাখো। তোমার পাশে বসে আমি তোমার নিজেকে খোঁজার এই ভ্রমণের পরিসমাপ্তির প্রতিক্ষায় থাকি, তোমার পুরোনো ক্ষত উপশমেরও। আমি জানি এই দুঃস্বপ্ন থেকে তুমি ফিরে এলেই আমরা আবার আগের মতোই হাতে হাত রেখে হাঁটব।



লেখক পরিচিতি:
ইসাবেল আয়েন্দে চিলিতে জন্ম গ্রহণকারী একজন আন্তর্জাতিক পরিচিতিপ্রাপ্ত সাহিত্যিক। তাঁর তেইশটিরও বেশি বেস্টসেলার বই এবং জীবিত লেখকদের মধ্যে সবচে' প্রশংসিত, পঠিতদের একজন। তাঁর বই পঁয়ত্রিশের অধিক ভাষায় অনূদিত হয়েছে এবং সত্তর লক্ষের বেশি বিক্রি হয়েছে।








একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ

  1. চরম কষ্টের একটা কাহিনী। মানবতার মাথা হেঁট হয়ে আসে। নির্মাল্য কুমার মুখোপাধ্যায়

    উত্তরমুছুন