হঠাৎ করে শীতটা খুব জাঁকিয়ে পড়ে গেল। তার সঙ্গে প্রবল তুষারপাত। দরজার তলা দিয়ে ঠাণ্ডা হাওয়া ঢুকে পড়ে। ঢিলে হয়ে যাওয়া জানলার শার্সিতে লেগে একঘেয়ে ঝনঝন শব্দ তোলে। গাছের শেষ পাতাটা অবধি ঝরে গেছে। পাইনের সারিই কেবল আবরণ সমেত বিবর্ণ আকাশের তলায় থমথমে শীতলতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এবড়োখেবড়ো লাল রাস্তার ওপর বরফ জমে পাথর, জর্জিয়ার আকাশে বাতাসে নিরন্ন হাহাকার।
গ্র্যান্ডমা
ফোনটেনের সঙ্গে সেদিন কী কথা হয়েছিল, মনে
পড়ে মনটা তেতো হয়ে গেল স্কারলেটের। দু’মাসও
হয়নি, অথচ মনে হল যেন কত বছর পেরিয়ে গেছে। মাসদুয়েক আগের সেই অপরাহ্ণে, বৃদ্ধাকে স্কারলেট বলেছিল, চরমতম বিপর্যয় যা কারও জীবনে
আসতে পারে, সেটা ওর দেখা হয়ে গেছে, মন থেকে
বিশ্বাস করেই বলেছিল কথাগুলো। আজ মনে হচ্ছে কথাগুলো যেন স্কুলের এক অপরিণত মেয়ের অতিশয়োক্তি। শেরম্যানের লোকদের টারার ওপর দ্বিতীয়বার হানা দেওয়ার আগে পর্যন্ত, ওদের দু’বেলা খাবার তো জুটে যাচ্ছিল, হাতে টাকাকড়িও কিছু ছিল। কয়েক ঘর প্রতিবেশিও ছিল যাদের অবস্থা তুলনামূলকভাবে ওর থেকে ভাল। তার ওপর কিছু তুলো উঠিয়েছিল, ভেবেছিল বসন্তকাল আসা পর্যন্ত চালিয়ে নিতে পারবে। তুলো তো গেছেই, খাবারদাবারও আর নেই, টাকাকড়ি হাতে কিছু থাকলেও, সে আর কাজে লাগবে না, কারণ, সেই টাকা দিয়ে কেনবার মত খাবারদাবার নেই। আর প্রতিবেশিদের অবস্থা ওর থেকেও খারাপ। ওর অন্তত একটা গরু আর বাছুরটা রয়েছে, আর আছে কয়েকটা শুয়োরের ছানা আর একটা ঘোড়া। প্রতিবেশিদের কাছে তাও নেই, ওই যেটুকু মাটিতে পুঁতে বা জঙ্গলে লুকিয়ে রাখতে পেরেছিল, সেটুকু ছাড়া।
ফেয়ারহিল – টার্লটনদের বসতবাড়ি - একেবারে ভিত পর্যন্ত জ্বালিয়ে ছাই করে দিয়েছে।
মিসেজ় টার্লটন চার মেয়েকে নিয়ে এখন ওভারসিয়ারের বাড়িতে মাথা গুঁজেছেন। লাভজয়ের কাছে মুনরোদের বাড়িও মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছে। মিমোজ়ার বাড়ির কাঠের অংশটা পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। মূল বাড়ির কাঠামোটা পাকা ছিল আর ফোনটেন মহিলা আর দাসদাসীর কম্বল আর লেপ জলে ভিজিয়ে আগুন নেবানোর প্রাণপাত করা চেষ্টায় সেটা কোনোক্রমে রক্ষা পেয়ে যায়। ক্যালভার্টদের বাড়িটা অবশ্য এবারও রক্ষা পেয়ে গেছে, ওদের ইয়াঙ্কিই ওভারসিয়ারের মধ্যস্থতায়। তবে গৃহপালিত পশু, নিদেন একটা মোরগ এমনকি একদানা শস্যও রক্ষা করতে পারেনি।
টারা সহ কাউন্টির সর্বত্র একটাই সমস্যা - খাদ্যদ্রব্য। রাঙা আলু আর চিনেবাদামের ফলনের উদ্বৃত্ত অংশ আর বন থেকে শিকার করে আনা পশু পাখি – বেশিরভাগ পরিবারকে এটুকু নিয়েই দিন গুজরান করতে হচ্ছে। যার যতটুকু আছে সেটাই কম ভাগ্যবান বন্ধুবান্ধবদের সাথে ভাগাভাগি করে নিচ্ছে, ঠিক যেমন ভাল সময়েও করে থাকত। তারপর এমন একটা সময় এল, যখন ভাগাভাগি করবার মতও কিছুই আর রইল না।
টারাতে কখনো-সখনো ওদের খরগোশ, কাঠবেড়ালি আর মাগুরমাছ জুটে যেত, যদি পোর্কের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়ত। তা না হলে পাতে পড়ত সামান্য দুধ, হিকরির দানা, ঝলসে নেওয়া পাইনের ফল বা রাঙা আলু।
খিদে মিটতেই চাইত না। স্কারলেটের মনে হত সবাই ওর পানে কাতর প্রত্যাশা নিয়ে তাকিয়ে আছে। নিজেকে পাগল পাগল মনে হত। অন্যান্যদের মত সেও তো সমান ক্ষুধার্ত।
বাছুরটাকে জবাই করতে বলল একদিন, মহার্ঘ দুধের অনেকটাই ওর পেটে চলে যেত। সেদিন রাতে পেট পুরে বাছুরের মাংস খেয়ে সবাই অসুস্থ হয়ে পড়ল। শুয়োরের একটা ছানাকেও জবাই করতে হবে, স্কারলেট ভেবে রেখেছিল। কিন্তু বারবারই দিনটা পিছিয়ে দিচ্ছিল, যাতে আরও একটু বড় হয়। বড়ই ছোট ওগুলো। এখুনি মেরে ফেললে তেমন কিছুই মাংস পাওয়া যাবে না, ওথচ একটু সবুর করলে, অনেকটাই পাওয়া যাবে। নগদ কিছু টাকা দিয়ে ঘোড়ায় করে পোর্ককে বাইরে পাঠানোটা ঠিক হবে কি না সেটা নিয়ে প্রতিদিন রাত্রে মেলানির সঙ্গে আলোচনা হত। কিন্তু টাকা আর ঘোড়া দুটোই লুট হয়ে যেতে পারে এই ভয়ে ওরা সিদ্ধান্ত নিতে পারত না। ইয়াঙ্কিরা ঠিক কোথায় আছে সেটাও ওদের জানা ছিল না। ওরা হাজার মাইল দূরেও থাকতে পারে কিংবা কে জানে হয়ত নদীর ওপারেই ওদের ঘাঁটি। অতিষ্ঠ হয়ে স্কারলেট তো একবার নিজেই ঘোড়ায় চড়ে খাবারের খোঁজে বের হতে শুরু করল। কিন্তু পরিবারের সবাই মিলে এমন কান্নাকাটি জুড়ল ইয়াঙ্কি হামলার ভয়ে যে ওকে সেই পরিকল্পনায় দাড়ি টানতে হল।
মাঝে মাঝে পোর্ক দূরে কোথাও চলে যেত, রাত্রে বাড়ি ফিরত না। কোথায় গেছিল, স্কারলেট কখনোই ওকে জিগ্যেস করেনি। কখনো-সখনো কিছু শিকার নিয়ে ফিরত, বা কয়েক গোছা ভুট্টার শিষ, বা এক থলি শুকনো মটর।
একবার একটা মোরগ নিয়ে এসে বলল জঙ্গলে পেয়েছে।
বাড়ির সকলেই খুব তৃপ্তি করে আহার করল, তবু একটা অপরাধবোধের কাঁটা সবার মনেই লেগে থাকল, কারণ ওটা যে পোর্ক চুরি করেই এনেছে তাতে কারোর মনেই বিন্দুমাত্র সংশয় ছিল না, যেমন ভুট্টা আর মটরের দানাও ও চুরি করেই এনে থাকে। এর পরে পরেই, এক রাত্রে, বাড়ির সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়েছে, পোর্ক ভয়ে ভয়ে এসে স্কারলেটের ঘরের দরজায় মৃদু আঘাত করল। স্কারলেট দেখল পোর্কের একটা পায়ে ছোট বুলেটের ক্ষত। ক্ষতের ওপরে স্কারলেট ব্যান্ডেজ বেঁধে দেবার সময় পোর্ক ভয়ে ভয়ে জানাল ফ্যেয়্যাটভিলে একটা মুরগির খামারে চুরি করতে গিয়ে নাকি ও ধরা পড়ে গেছিল। কার খামার, স্কারলেট জানতে চায়নি, শুধু অশ্রুসজল চোখে, পোর্কের পিঠে সস্নেহে হাত বুলিয়ে দিল। নিগ্রোরা মাঝে মাঝে জ্বালাতনের কারণ হয়ে ওঠে, বোকামি করে, আলসেমিও করে। তবুও ওদের আনুগত্য সংশয়াতীত, টাকা দিয়ে সেটা কেনা যায় না। সাদা চামড়ার মানুষকে ওরা এতটাই একাত্ম যে তাদের জন্য খাদ্যের অন্বেষণে নিজেদের জীবন সংশয় করেতেও ওরা পিছিয়ে যায় না।
আগেকার দিন হলে পোর্কের এই সব ছিঁচকে দুরিচামারিকে মোটেই লঘুভাবে নেওয়া হত না। হয়ত চাবুক মারার হুকুম হত। অন্য সময় হলে স্কারলেটকে অন্ততপক্ষে কড়াভাবে তিরস্কার করতেই হত। “সর্বদা মনে রাখবে, সোনা,” এলেন
বলেছিলেন, “ডার্কিদের নৈতিক এবং শারীরিক কল্যাণের দায়িত্ব ঈশ্বর
তোমার ওপরে ছেড়ে দিয়েছেন। মনে রাখবে ওরা শিশুদের মত, তাই শিশুদের মতই ওদের সঠিক পথে চালাতে হবে। তোমাকে ওদের আদর্শ হয়ে উঠতে হবে।”
তবে সেদিন স্কারলেট তিরস্কার করবার ভাবনাটা মাথা থেকে সরিয়ে দিল। ও যে চুরিচামারিতে প্রশ্রয় দিচ্ছে, হয়ত এমন কারোর কাছে থেকে যে ওর চেয়েও বেশি দরিদ্র হতে পারে, এই সব ভাবনা আর ওর বিবেককে বিব্রত করে না। সত্যি বলতে কী, নীতিবোধ ব্যাপারটাকে আজকাল ও হালকাভাবেই নিচ্ছে। শাস্তি দেওয়া বা তিরস্কার করার বদলে, পোর্কের গুলি লাগার জন্যই ও দুঃখ প্রকাশ করল।
“আরও বেশি সাবধান হতে হবে, পোর্ক। আমরা কেউ চাইনা, তোমার ভালমন্দ কিছু হয়ে যাক। তুমি না থাকলে আমাদের চলবে কেমন করে? তুমি অত্যন্ত ভাল আর বিশ্বস্ত, আবার যখন আমরা টাকা জমিয়ে ফেলব, আমি তোমাকে একটা সোনার ঘড়ি কিনে দেব, আর তাতে বাইবেলের কোনো বাণী খোদাই করে দেব, ‘তুমি উত্তম কর্ম করিয়াছ, হে আমার বিশ্বস্ত সেবক’।”
প্রশংসা শুনে পোর্কের মুখচোখ চকচক করে উঠল। ব্যান্ডেজ করা পায়ে সাবধানে হাত ঘষতে লাগল।
“সেটা তো দারুণ ব্যাপার হবে, মিস স্কারলেট। তা কতদিনে সেই টাকাটা জমাতে পারবেন বলে মনে করছেন?”
“কী জানি, পোর্ক, তবে যে করেই হোক কখনো না কখনো টাকা আমি জমিয়ে ফেলবই।” তীব্র হতাশায় ভরা দৃষ্টি আড়াল করতে গিয়ে স্কারলেট পোর্কের দিকে ঝুঁকে পড়ল। পোর্ক ঘেমে উঠল। “কোনো না কোনো একদিন, লড়াই যখন খতম হয়ে যাবে, আমি আবার অনেক টাকা জমিয়ে ফেলব। আর সেটা যখন করতে পারব, আমি আর কখনও ক্ষুধার্ত থাকব না, শীতে কষ্ট পাব না। আমাদের কেউই ক্ষুধার্ত থাকবে না, শীতে কষ্ট পাবে না। আমরা ভাল ভাল পোশাক পরব, প্রত্যেকদিন ফ্রায়েড চিকেন খাব, আর – ”
কথাটা বলতে বলতে থেমে গেল স্কারলেট। টারার সকলের জন্য কড়া অনুশাসন একটা, ওর নিজেরই জারি করা অনুশাসন, আগে ওরা কত ভাল ভাল খাবার খেত, আর সুযোগ পেলে কী কী ভাল খাবার খাবে, এসব নিয়ে আলোচনা করায় কড়া নিষেধাজ্ঞা।
স্কারলেট অন্যমনস্কভাবে দূরের পানে তাকিয়ে রইল। পোর্ক আস্তে আস্তে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। পুরোনো সেই দিনগুলো – আর ফিরে আসবার কোনও সম্ভাবনাই নেই – বেশ জটিল ছিল তখনকার জীবন, সমস্যাগুলোও খুব সহজ সরল ছিল না। অ্যাশলের ভালবাসা জয় করে নেবার আকুলতা, সঙ্গে সঙ্গে ডজন খানেক প্রণয়ীকে নিজের চারপাশে শুকনো মুখে ঘুরঘুর করতে দেওয়া। ছোটখাট বেয়াদবি বড়দের থেকে আড়াল করে রাখার সযত্ন প্রয়াস। কুচুটে মেয়েদের সঙ্গে রেশারেশি করা বা আপস করে নেওয়া। কী ধরণের পোশাক পরা হবে, কী ভাবে চুল বাঁধা হবে, এই সব খুঁটিনাটি আরও কত শত ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামাতে হত! এখনকার জীবনযাত্রা তো একেবারেই সাদাসিধে। আজকাল মাথা ঘামানোর প্রধান বিষয় হল খাবার জোগাড় করা, যাতে ভুখা না থাকতে হয়, প্রয়োজনীয় পোশাক-আশাক, যাতে শীতে জমে যেতে না হয়, আর মাথার ওপর একটা ছাদ, যার থেকে খুব বেশি জল চোয়ায় না।
এই সময় থেকে স্কারলেট বারবার একটা দুঃস্বপ্ন দেখতে শুরু করল, যে দুঃস্বপ্ন ওকে বহু বছর ধরে তাড়া করে বেড়িয়েছে। স্বপ্নটা একই রকম, খুব কিছু অদলবদল হয় না। কিন্তু প্রতিবার যখন স্বপ্নটা দেখে আতঙ্ক বহুগুণ বেড়ে যায়। জেগে থাকার মুহুর্তগুলোও বিভীষিকাময় হয়ে ওঠে, পাছে ওর আশঙ্কা সত্যে পরিণত হয়। দুঃস্বপ্নটা যেদিন থেকে দেখতে শুরু করে, সেদিনের ঘটনাগুলো বিস্তারিতভাবে ওর স্মৃতিতে গেঁথে আছে।
হাড় কাঁপানো বৃষ্টি চলছিল ক’দিন ধরেই, ঘরের ভেতর শিরশিরে ঠাণ্ডা, সঙ্গে ঠাণ্ডা হাওয়ার দাপট আর একটা স্যাঁতস্যাঁতে ভাব। ফায়ারপ্লেসের কাঠের গুঁড়িগুলো ভেজা, যত না গরম করতে পারছিল, তার থেকে বেশি ধোঁয়ায় ভরিয়ে দিচ্ছিল।
ব্রেকফাস্টের সময় দুধটুকু ছাড়া সারাদিনে আর কোনও খাবার জোটেনি, কারণ রাঙা আলু ফুরিয়ে গেছিল, আর পোর্কের বর্শিতে কোনও মাছ গাঁথেনি, বা ফাঁদে কোনও শিকারও ধরা পড়েনি।
পরের দিন একটা শুয়োরছানা মারতেই হবে, যদি কিছু খেতে হয় তো। সাদা, কালো, অবসন্ন, ক্ষুধার্ত চোখে স্কারলেটের পানে তাকিয়ে, যেন নীরবে খাবারের জন্য করুণ মিনতি জানাচ্ছে। কিছু কেনাকাটা করবার জন্য, ঘোড়া বেহাত হবার ঝুঁকি নিয়েই পোর্ককে পাঠাতে হবে। এত সব জ্বালাতনের মধ্যে আবার ওয়েডের শরীরটাও ভাল নেই। গলায় ব্যথা আর জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে, অথছ না আছে ডাক্তার, না ওষুধ।
ছেলের দিকে নজর রাখতে রাখতে ক্ষুধার্ত, অবসন্ন স্কারলেট ওকে মেলানির জিম্মায় কিছুক্ষণের জন্য রেখে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল একটু ঘুমিয়ে নিতে। পা’দুটো জমে কাঠ হয়ে আছে, বিছানায় এপাশ ওপাশ করতে থাকে, ঘুম আর আসে না, ভয় আর হতাশায় একেবারে জেরবার। বারবার ভাবতে লাগল, “কী করব আমি? কোনদিকে যাব? দুনিয়ায় কেউ কি আছে, যে আমাকে সাহায্য করতে পারে?” দুনিয়া থেকে নিরাপত্তা নামে জিনিসটা কোথায় যেন হারিয়ে গেল? শক্তিশালী আর বুদ্ধিমান কেউ কি নেই, যে ওর কাঁধ থেকে বোঝাটা নামিয়ে নিতে পারে? এতটা বোঝা বইবার ক্ষমতা ওর যে নেই। কী ভাবে এই বোঝা টেনে নিয়ে যেতে হয় সেটা ওর জানা নেই। মনের মধ্যে এই সব কথা ভাবতে ভাবতে অস্বচ্ছন্দ তন্দ্রায় ঢুলে পড়ল।
এক অচেনা অনাসৃষ্টির দেশে ও যেন এসে পড়েছে। চতুর্দিকে ঘন কুয়াশার আস্তরণ। চোখের সামনে ধরেও হাতদুটোকে ঠাহর করতে পারছে না। পায়ের তলার মাটি অস্থির। জনমানবশূন্য স্থান, সর্বব্যাপী নৈঃশব্দের স্তব্ধতা। রাতের অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া শিশুর মত ভয়ার্ত ও। ঠাণ্ডায় জমে গেছে, অসহ্য খিদেও পেয়েছে, কুয়াশার আড়ালে লুকিয়ে থাকা অজানা বিভীষিকার কল্পনায় আতঙ্কিত, আর্তনাদ করে উঠতে চাইছে, গলা দিয়ে আওয়াজ বেরচ্ছে না। কুয়াশার আড়াল থেকে কারা যেন হাত বাড়িয়ে ওর স্কার্ট টেনে ধরেছে, পায়ের তলার চোরাবালির গভীরে ওকে তলিয়ে দেওয়ার জন্য। মমতাহীন, শব্দহীন, অশরীরী হাত। তারপর মনে হল, ওই অর্ধস্বচ্ছ কুয়াশার অন্তরালে কোথাও যেন সুনিবিড় শান্তি আর মমতার উষ্ণতায় ঘেরা এক আশ্রয় ওকে হাতছানি দিচ্ছে। কিন্তু কোথায় সেই আশ্রয়? ওই হাতগুলো ওকে ধরে চোরাবালির অতলে তলিয়ে দেওয়ার আগেই কি পারবে ওখানে পৌঁছে যেতে?
হঠাৎ করে স্কারলেট দৌড়তে শুরু করল, পাগলের মত, কুহেলিকার মধ্য দিয়ে দৌড়তে লাগল, কাঁদতে কাঁদতে, দু’হাত ছুঁড়ে ফাঁকা হাওয়া আর ভিজে কুয়াশাকে আঁকড়ে ধরে। কোথায় সেই আশ্রয়? ধরা দিচ্ছে না, কিন্তু আছে, লুকিয়ে আছে, কোথাও না কোথাও। যদি পৌঁছে যেতে পারত! একবার পৌঁছে গেলেই আর ভয় নেই! কিন্তু আতঙ্কে ওর পা অবশ হয়ে আসছে, অনাহারে চেতনা হারিয়ে ফেলছে। বুকফাটা একটা আর্তনাদ বেরিয়ে আসতেই জেগে উঠে দেখল মেলানি চিন্তিত মুখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে আর ঠেলা দিয়ে ওকে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করছে।
দুঃস্বপ্নটা বারেবারে ফিরে আসত, খালি পেটে ঘুমিয়ে পড়লেই। আর তেমনটা তো ঘনঘনই ঘটত। আতঙ্কটা এমনভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরল যে ঘুমোনোর কথা মনে হলেই ওর ভয় করতে থাকত। নিজেকে প্রবোধ দেওয়ার চেষ্টা করত ওই স্বপ্ন দেখে ভয় পাওয়ার মত কিছুই নেই। স্বপ্নের মধ্যে ওই কুয়াশা দেখে ভয় পাওয়ার কিছুই নেই। একদমই কিছু নেই – তবু সেই কুয়াশাচ্ছন্ন স্থানে গিয়ে পড়বার ভাবনাটা ওকে এতটাই আতঙ্কগ্রস্ত করে ফেলল যে ও মেলানির সঙ্গে শুতে আরম্ভ করল। গুমরে উঠলেই, বা ছটফট করলে, বা কেঁদে উঠলেই মেলানি বুঝতে পারবে যে ও আবার সেই দুঃস্বপ্নের কবলে পড়েছে, আর ওকে জাগিয়ে দিতে পারবে।
শারীরিক এবং মানসিক ধকলে স্কারলেট ক্রমাগত ফ্যাকাসে আর রোগা হয়ে পড়ল। গাল বসে গিয়ে, চোখ কোটরে ঢুকে গিয়ে, ওর মুখের সুডৌল সৌন্দর্যের অনেকটাই ম্লান হয়ে গেল। ওর সবুজ দুটো চোখ যেন শিকারি বেড়ালের ক্ষুধার্ত চাউনি।
“কোনো স্বপ্ন না দেখেই দিনের বেলাটাও আমার কাছে দুঃস্বপ্নের মত মনে হয়,” মরিয়া হয়ে স্কারলেট ভাবে, আর নিজের ভাগের খাবারদাবার জমিয়ে রেখে দেয়, শুতে যাবার আগে খাবে বলে।
***
বড়দিনের সময়
ফ্র্যাঙ্ক কেনেডি কমিসারি বিভাগের অল্প কয়েকজনের একটা দল নিয়ে টারায় এসে হাজির হলেন। সৈন্যবাহিনীর জন্য খাদ্যশস্য আর
পশুর বৃথা অন্বেষণে। শতছিন্ন পোশাক, উদ্ভ্রান্ত চেহারা নিয়ে খোঁড়া ঘোড়ায় চেপে এল সকলে। একমাত্র ফ্র্যাঙ্ক ছাড়া এদের কেউই
অক্ষত অবস্থায় নেই। কারও একটা হাত নেই তো কারও একটা চোখ গেছে, কেউ বা হাঁটু মুড়তে পারে না। সেনাবাহিনীতে সক্রিয় ভূমিকা নেওয়ার
মত অবস্থায় এরা কেউই নেই। অনেকের পরনেই আটক ইয়াঙ্কি জওয়ানদের
থেকে কেড়ে নেওয়া নীল ওভারকোট। অল্পক্ষণের জন্য হলেও টারার সকলেই আবার শেরম্যানের বাহিনী এসে
পড়েছে ভেবে ভয় পেয়ে গেল।
সেই রাতটা ওরা প্ল্যান্টেশনেই কাটিয়ে দিল। বসার ঘরের মেঝেতে গড়িয়ে ঘুমিয়ে নিল। ভেলভেটের গালিচার ওপর শুয়ে আড়মোড়া কাটতে কাটতে। কতদিন হয়ে গেল ওরা ছাদের তলায় ঘুমোনোর সুযোগই পায়নি। খোলা আকাশের তলায়, এবড়োখেবড়ো জমিতে পাইনের কাঁটার খোঁচা খেতে খেতে ঘুমিয়েছে। ভাল বাড়ির ছেলে সবাই, যদিও মুখভর্তি দাড়িগোঁপের জঙ্গলে আর ছেঁড়া পোশাকে, খুবই ময়লা দেখাচ্ছে ওদের। বড়দিনের আগের রাতটা এত বড় একটা বাড়িতে কাটাতে পেরে ওদের সবার মনে খুব স্ফূর্তি। সুন্দরী মহিলারা ওদের ঘিরে বসেছে। ঠিক আগে যেমন হয়ে থাকত। লড়াই নিয়ে গুরুগম্ভীর কোনও আলোচনা হতেই দিল না। উলটে লড়াই নিয়ে উদ্ভট যত মিথ্যে গল্প বলে মেয়েদের হাসিয়ে চলল। অনেকদিন পরে যেন পরিবেশ হাল্কা হয়ে বাড়িটা উৎসবের মেজাজে ডুবে গেল।
“বাড়িতে পার্টি হলে আগে যেরকম মনে হত, আজ ঠিক সেরকমই লাগছে, তাই না?” স্কারলেটের কানে কানে স্যুয়েলেন বলল। বাড়িতে নিজের প্রেমিককে পেয়ে স্যুয়েলেন খুশির সপ্তম স্বর্গে ভাসছে।
ফ্র্যাঙ্ক কেনেডির ওপর থেকে চোখ সরাতেই পারছে না। রোগা হয়ে গেলেও স্যুয়েলেনকে যে এতটা মিষ্টি লাগতে পারে, সেটা দেখে স্কারলেট বেশ অবাক হল। গালদুটো রাঙা হয়ে উঠেছে, চোখ জ্বলজ্বল করছে।
“ফ্র্যাঙ্ককে স্যুয়েলেন তাহলে সত্যি সত্যিই ভালবাসে,” কিছুটা অবজ্ঞা নিয়েই ভাবল স্কারলেট। “আর কোনোদিনও যদ নিজের একজন বর জোটে, তাহলে মনে হয় স্বভাবটা ওর কিছুটা হলেও কোমল হবে, সেই বর যদি হাড়কৃপণ বুড়ো ফ্র্যাঙ্কও হয়, তাহলেও।”
ক্যারিনও বেশ কিছুটা হাসিখুশি। এমনকি ওর চোখের সেই স্বপ্নচর চাউনিটাও অনেকটাই কেটে গেছে আজকের সন্ধ্যেয়। ওদের মধ্যে ব্রেন্ট টার্লটনকে চিনত এমন একজন মানুষের সন্ধান পেয়েছে, যেদিন ও মারা গেল, সেদিন ওর সঙ্গেই নাকি ছিল। সাপারের পর ওর সঙ্গে অনেকক্ষণ ধরে কথা বলবে, মনে মনে ঠিক করে রাখল।
সাপারের সময় সবাইকে অবাক করে দিয়ে মেলানি ভীরুতার আবরণ ছেড়ে বেরিয়ে এসে খুব উচ্ছল হয়ে উঠল। হাসি মস্করা করে আসর জমিয়ে দিল। একজন একচোখো জওয়ানের সঙ্গে তো অনেক নষ্টামিই করল, অবশ্যই শালীনতা রক্ষা করে। সেই লোকটাও উৎসাহ পেয়ে লড়াইয়ে নিজের বীরত্বের কাহিনী রঙ চড়িয়ে বলতে লাগল। মেলানিকে এই উদ্যম নিতে শারীরিক এবং মানসিকভাবে কতটা পরিশ্রম করতে হয়েছে, স্কারলেট সেটা ভালমতই উপলব্ধি করল। পুরুষমানুষের সামনে ওর মধ্যে একটা জড়তাবোধ কাজ করে। তাছাড়া শরীরটাও ওর ভাল নেই। বলে যদিও একটুও দুর্বল নয়, আর ডিলসির থেকেও বেশি কাজ করে সেটা প্রমাণ করে দেখায়, তবুও স্কারলেট জানে যে ও মোটেই সুস্থ নয়। ভারি জিনিস তুলতে গেলেই ওর মুখ সাদা হয়ে যায়, আর ক্লান্ত হয়ে পড়লেই ধপ করে বসে পড়বার অভ্যেস, যেন পায়ে আর জোর নেই। অথচ আজ রাত্রে, স্যুয়েলেন আর ক্যারিনের মত, বড়দিনের আগে জওয়ানদের মনোরঞ্জনের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছে। একমাত্র স্কারলেটই অতিথি সমাগমের আনন্দ উপভোগ করতে পারছে না।
সাপারে ম্যামির
পরিবেশন করা শুকনো মটর, শুকনো আপেল আর চিনেবাদামের
স্ট্যুয়ের সঙ্গে নিজেদের রেশনের রোদে শুকিয়ে যাওয়া ভুট্টা আর মাংস জুড়ে দিল। বলল, অনেকদিন পর ওরা এত ভাল খাবার খেতে পেয়েছে। ওদের তৃপ্তি করে খাওয়া দেখে স্কারলেট
মনে মনে অস্বস্তি করছিল। ওদের প্রত্যেক গ্রাস মুখে তোলা দেখে
ওর যে কেবল রাগই হচ্ছিল তাই নয়, ভয়ে কাঁটা হয়েও ছিল, পাছে ওরা কোনোভাবে জেনে যায় যে গতকাল পোর্ক একটা শুয়োরছানাকে জবাই করেছে। ওটা এখন প্যান্ট্রিতে ঝোলানো
আছে, আর বাড়ির সবাইকে হুমকি দিয়ে রেখেছে যে ঘুণাক্ষরেও কেউ যদি
শুয়োরছানাটা কিংবা ওর ভাইবোনরা – যাদের জলার ধারের খোঁয়াড়ে সযত্নে
বেঁধে রাখা হয়েছে – তাদের কথা অতিথিদের সামনে তোলে, তাহলে স্কারলেট তার চোখ উপড়ে তুলে নেবে। এই বুভুক্ষুর দলের সামনে
পড়লে একবারেই পুরো শুয়োরছানাটা ওরা উদরসাৎ করে ফেলবে। আর যদি জ্যান্ত শুয়োরগুলোর কথা জানতে
পারে তাহলে তো বাহিনীর জন্য দখল করে নেবে। এছাড়া গরু আর ঘোড়াগুলোর জন্যও ওর মনে ভয়। জঙ্গলের ধারে মাঠে খুঁটির সঙ্গে
বেঁধে না রেখে যদি জলার ধারে লুকিয়ে রাখা যেত তাহলেই ভাল হত। কমিসারি যদি এই সমস্ত কিছুর দখল
নিয়ে নেয়, তাহলে টারায় শীতের দিন গুজরান করা অসম্ভব হয়ে
পড়বে। ওগুলোর বিকল্প আর জোগাড় করার কোনো উপায় নেই। সেনাবাহিনীর লোকেরা কী খাবে তা নিয়ে
ওর বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই। সেনাবাহিনীই তাদের নিজেদের লোকদের
জন্য খাবারের বন্দোবস্ত করুক – যদি সম্ভব হয়। নিজের লোকদের জন্য ওকে তো মুখে রক্ত
তুলেই খাবারের বন্দোবস্ত করতে হচ্ছে।
ডেজ়ার্ট হিসেবে
ওরা ঝোলা থেকে ‘র্যামরড রোল’
বের করল। কনফেডারেরটদের খাদ্যতালিকার
এই বহুল চর্চিত জিনিসটা – যেটা নিয়ে হাজারটা রসিকতা
চালু আছে, যেমন আছে উকুন নিয়ে – স্কারলেট
এই প্রথম চর্মচক্ষে দেখল। প্যাঁচানো পোড়া কাঠের একটা টুকরোর মত দেখতে জিনিসটা। একটুকরো স্কারলেটকে চেখে দেখতে বলল। চেখে বুঝতে পারল জিনিসটা আসলে উনুনের
আঁচে কালো করা আবরণের তলায় লবণ ছাড়া ভুট্টার রুটি। জওয়ানরা ভুট্টার ছাতুর সঙ্গে জল মিশিয়ে একটা মণ্ড বানায়, লবণ থাকলে সেটাও মেশায়। সেই মণ্ডটা র্যামরডের
ওপর পুরু করে মাখিয়ে আগুনে ঝলসে নেয়। জিনিসটা যেমন শক্ত, তেমনই কাঠের গুড়োর মত বিস্বাদ। একটা কামড় লাগিয়েই স্কারলেট তাড়াতাড়ি
জিনিসটা ওদের ফেরত দিয়ে দিল। ওরা জোরে জোরে হেসে উঠল। মেলানির চোখে চোখ পড়তেই বুঝল যে ভাবনা ওর মনে ঘুরপাক খাচ্ছে, সেই একই ভাবনা মেলানির মনেও – “এই যদি খাবারের
বহর হয়, তাহলে লড়াই ওরা করবে কেমন করে?”
খাওয়াদাওয়া বেশ
মজা করেই মিটল। এমনকি জেরাল্ডও কিছুক্ষণের জন্য মানসিক জড়তা সরিয়ে ফেলে গৃহকর্তা
হিসেবে দ্বিধাজড়িত হাসি দিয়ে অতিথিদের আপ্যায়ন করলেন। ছেলেরা অনর্গল বকবক করে চলল, আর মেয়েরা হেসে হেসে ওদের উৎসাহ দিতে লাগল। মিস পিটিপ্যাটের খবর নেবার জন্য
ফ্র্যাঙ্ক কেনেডির দিকে আচমকা ঘুরেই স্কারলেট ওঁর মুখের অভিব্যক্তি দেখে হকচকিয়ে গিয়ে
যা বলবার জন্য ঘুরল, সেটা ভুলেই গেল।
স্যুয়েলেনকে
ছেড়ে ওঁর নজর ঘরের চারদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে, জেরাল্ডের
শিশুসুলভ বিভ্রান্ত দৃষ্টি, কার্পেটহীন মেঝে, সরঞ্জামশূন্য তাক, ইয়াঙ্কিদের বেয়নেটের আঘাতে স্প্রিং
বসে যাওয়া গদি আর ছিঁড়ে যাওয়া সোফা, ড্রেসিং টেবিলের ওপরের ভাঙা
আয়না, লুটেরারা আসার আগে দেওয়ালে যেসব জায়গায় ছবি টাঙানো থাকত
সেখানকার চৌকো চৌকো দাগ, জাঁকজমকহীন পরিবেশন, মেয়েদের পরনে পুরোনো কিন্তু সযত্নে রিফু করা পোশাক, ময়দার
বস্তা দিয়ে ওয়েডের জন্য তৈরি ইজের, ইত্যাদি।
লড়াই বাঁধবার
আগের টারাকে কল্পনা করার চেষ্টা করছিলেন ফ্র্যাঙ্ক, চোখে মুখে বেদনার ছাপ, শ্রান্ত কিন্তু নিষ্ফল ক্রোধের
অভিব্যক্তি। স্যুয়েলেনকে উনি ভালবাসেন, ওর বোনদের পছন্দ করেন, জেরাল্ডকে শ্রদ্ধা করেন আর মনে
মনেএই প্ল্যান্টেশন সম্বন্ধে অকৃত্রিম অনুরাগ পোষণ করেন। জর্জিয়ার ওপর দিয়ে শেরম্যান বাহিনীর তুফান বয়ে যাওয়ার পর ফ্র্যাঙ্ককে
রসদ জোগাড় করার খাতিরে অনেক জায়গায় যেতে হয়েছে, অনেক
আতঙ্ককর দৃশ্যের সাক্ষী হতে হয়েছে, কিন্তু টারার করুণ অবস্থা
ওঁর মনে যতটা দাগ কেটেছে, আর কোনও জায়গা ততটা দাগ কাটতে পারেনি। ও’হারাদের জন্য,
বিশেষ করে স্যুয়েলেনের জন্য উনি কিছু করতে চান, কিন্তু উনি নিতান্তই সামর্থ্যহীন। কাতর অন্যমনস্কতায় উনি মাথা নাড়াচ্ছিলেন, জিভ দিয়ে বের হচ্ছিল সমবেদনাসূচক শব্দ। ঠিক এই সময় স্কারলেটের চোখে ওঁর
দৃষ্টি পড়ল। মনে হল ওর চোখে আহত
অহঙ্কারবোধের ক্ষুব্ধ দৃষ্টি, অপ্রস্তুত হয়ে উনি
চোখ খাবারের থালার দিকে নামিয়ে নিলেন।
মেয়েরা খবর শোনবার
জন্য ব্যগ্র। অ্যাটলান্টার পতনের পর থেকে ডাকবিভাগ পুরোপুরি বন্ধ, চার মাস হয়ে গেছে, ইয়াঙ্কিরা এখন ঠিক কোথায়
আছে সেটা ওদের জানা নেই, কনফেডারেট বাহিনীই বা কেমনভাবে লড়াই
চালিয়ে যাচ্ছে, তাও জানা নেই। অ্যাটলান্টার কী অবস্থা, পুরোনো বন্ধুবান্ধবদেরই বা কী খবর, কিছুই
জানা নেই। কর্মসূত্রে ফ্র্যাঙ্ককে সর্বত্র চষে বেড়াতে হয়, তাই উনি হলেন খবরের কাগজের বিকল্প, তার চেয়েও হয়ত বেশি কিছু, কারণ অ্যাটলান্টার উত্তরে ম্যাকন শহরের প্রায় প্রত্যেককেই উনি ভাল করে চেনেন,
বা চিনতে আগ্রহী, ফলে বাজারে চালু অনেক গুজব,
অনেক রসালো খবরই উনি রাখেন, যেসব খবরের কাগজে ছাপা
হয় না। স্কারলেটের চোখে চোখ
পড়ায় খুবই অপ্রস্তুত বোধ করায়, উনি আর সময় নষ্ট
না করে সেই সব খবরের ধারাবিবরণী দিতে শুরু করলেন। উনি জানালেন, শেরম্যানের লোকরা চলে যাবার পর কনফেডারেটরা অ্যাটলান্টা পুনর্দখল
করে নিয়েছে, তবে লাভের লাভ কিছুই হয়নি, কারণ যাওয়ার আগে শেরম্যানের লোকেরা সব জ্বালিয়ে পুড়িয়ে শেষ করে দিয়ে গেছে।
“আরে,
আমার তো মনে হয়েছিল যেদিন রাত্রে
আমি অ্যাটলান্টা ছাড়লাম সেদিনই জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল,” স্কারলেট
হতবাক হয়ে চেঁচিয়ে উঠল। “আমাদের ছেলেরাই পুড়িয়ে দিয়েছিল বলে ভেবেছিলাম।”
“না,
না, মিস স্কারলেট!” ফ্র্যাঙ্ক
অবাক হয়ে বললেন। “আমাদের নিজেদের শহর, যেখানে আমাদের মানুষরা
আছেন, সে কি আমরা জ্বালিয়ে দিতে পারি? আপনি
কেবল আমাদের গুদামঘর আর রসদের ভাণ্ডারে আগুন জ্বলতে দেখেছেন। আর আমাদের ফাউন্ড্রি আর অস্ত্রশস্ত্র। ওগুলো ইয়াঙ্কিদের হাতে পড়ুক সেটা
আমরা চাইনি। বাস্, মাত্র ওটুকুই। শেরম্যানের লোকেরা যখন এল, তখনও বাড়িঘরদোর আগের মতই অক্ষত ছিল। ওরা ওখানেই ওদের থাকার জায়গা বানিয়ে
নিল।”
“আমাদের
মানুষদের কী হল? ওরা কি – উনি কি ওঁদের
মেরে ফেললেন?”
“কিছু
তো মেরেছিলেনই – তবে গুলি চালিয়ে নয়,” সেই
এক চোখওয়ালা জওয়ানটা বলল। “দলবল নিয়ে শহরে ঢোকার পর মেয়রকে বলে দিলেন শহরের সব মানুষকে শহর
থেকে বেরিয়ে যেতে হবে, সব জীবিত মানুষকেই। তার মধ্যে অনেক বৃদ্ধ মানুষ ছিলেন, যাঁরা পথশ্রম সইতে পারবেন না আর বেশ কিছু অসুস্থ মানুষ যাঁদের
নড়ানো যাবে না। কিন্তু উনি ওঁদের বেরিয়ে যেতে বাধ্য করলেন, সে কি বিশাল ঝড়ঝঞ্ঝার মধ্যে, আপনারা কল্পনাও
করতে পারবেন না, শয়ে শয়ে মানুষ, আর সবাইকে
রাফ অ্যান্ড রেডির জঙ্গলে পাঠিয়ে দিয়ে জেনারাল হুডকে নির্দেশ দিলেন ওঁদের নিয়ে যাওয়ার
জন্য। কষ্ট সহ্য করতে না পেরে অনেকেই নিউমোনিয়াতে প্রাণ হারালেন।”
“ইশ্, কিন্তু এমন করলেন কেন? ওঁরা তো কোনও ক্ষতি করতে পারতেন না,” মেলানি কাতরস্বরে কেঁদে উঠল।
“উনি বললেন, ওঁদের লোকজন আর ঘোড়াদের বিশ্রাম দেওয়ানোর জন্য শহরটা ওঁর দরকার,” ফ্র্যাঙ্ক বললেন। “নভেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত উনি ওখানেই ওদের বিশ্রাম নেওয়ালেন, তারপর বেরিয়ে গেলেন। যাওয়ার আগে সারা শহরে আগুনি জ্বালিয়ে সব কিছু পুড়িয়ে দিলেন।”
“না, না, সবকিছু নিশ্চয়ই নয়!” মেয়েরা সমস্বরে বেদনার্ত গলায় বলে উঠল।
যে প্রাণোচ্ছল শহরটার সঙ্গে ওরা সবাই পরিচিত, যেখানে এত মানুষের বাস, সেনাবাহিনীর ভিড় লেগে থাকত, ভাবাই যায় না, সেই শহরটার অস্তিত্ব আর নেই। সেই সব ছায়া ঘেরা সুন্দর সুন্দর বাড়ি, বড় বড় স্টোর, ভাল ভাল হোটেল – কিছুই আর নেই – না, না এ হতে পারে না! মেলানির তো প্রায় কেঁদেই ফেলার জোগাড়, ওর তো ওখানেই জন্ম, আর কোনও বাড়ির কথা ও ভাবতেই পারে না।
স্কারলেটও বিষণ্ণ হয়ে উঠল, টারার পরে ওই শহরটাকেই ও ভালবেসে ফেলেছিল।
“ওই হল আর কি, প্রায় সব কিছুই,” তাড়াতাড়ি ফ্র্যাঙ্ক নিজেকে শুধরে নিলেন, এদের মুখ চোখের অবস্থা দেখে। একটা খুশি খুশি ভাব দেখানোর চেষ্টা করলেন, কারণ মহিলাদের মনে কষ্ট হোক সেটা উনি চান না। মহিলাদের মনে কষ্ট হলে উনি অত্যন্ত অসহায় বোধ করেন।
বাস্তব পরিস্থিতির কথা উনি আর নিজের মুখে বর্ণনা করতে পারলেন না। ওঁরা বরং অন্য কারোর কাছ থেকে জানুন।
সেনাবাহিনী অ্যাটলান্টায় ফিরে আসার পর কী দেখেছিল, সেটা আর ফ্র্যাঙ্ক বললেন না, একরের পর একর জুড়ে ভস্মস্তূপের মধ্য থেকে মাথা চাড়া দিয়ে কালো হয়ে যাওয়া চিমনির সারি দাঁড়িয়ে আছে, আধপোড়া জঞ্জালের স্তূপ, রাস্তা আটকে পড়ে থাকা ইটের পাহাড়, আগুন লেগে জ্বলে যাওয়া গাছের সারি, কয়লা হয়ে যাওয়া তাদের শাখা প্রশাখা ঠাণ্ডা হাওয়ার দাপটে মাটিতে পড়ে গেছে। সেই দৃশ্য দেখে উনি যে কতটা অসুস্থ বোধ করেছিলেন, সেটা মনে পড়ল, মনে পড়ল শহরের ভগ্নদশা দেখে কনফেডারেটদের দীর্ঘশ্বাস। সমাধিক্ষেত্র লুঠের কথাটা মহিলাদের কানে না ওঠাই ভাল।
ওঁরা সহ্য করতে পারবেন না। চার্লি হ্যামিলটন, মেলানির মা, মেলানির বাবা, সবাই ওখানে শায়িত। সেই সমাধিক্ষেট্রটার দশা মনে পড়লে ফ্র্যাঙ্ক এখনও শিউরে ওঠেন। মূল্যবান অলঙ্কারপত্র মৃতদের সঙ্গে কবর দেওয়া থাকবে ভেবে ইয়াঙ্কিই সৈন্যরা কবরের ফলক ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে, কবর খুঁড়ে ফেলেছে। দেহাবশেষও লুঠ করেছে, সোনা রুপো দিয়ে তৈরি নামের ফলক, রুপোর তৈরি হাতল সব লুঠ করে নিয়ে গেছে। কঙ্কাল আর মৃতদেহ, ভাঙাচোরা শবাধার যত্রতত্র ছড়িয়ে রেখে গেছে। বড়ই করুণ সে দৃশ্য।
কু শহর ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য করা হয়েছেকুর বেড়ালদের কথাও ফ্র্যাঙ্ক বলে উঠতে পারলেন না। পোষ্যদের নিয়েও লেডিরা খুবই অনুভূতিপ্রবণ। কিন্তু হাজার হাজার অভুক্ত পশুপাখি – যাদের প্রভুরা শহর ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হওয়ায় গৃহহীন হয়ে পড়েছে – তাদের দুর্দশা দেখেও ফ্র্যাঙ্ক ব্যথিত হয়েছিলেন, সমাধিক্ষেত্রের দুর্দশা দেখে ব্যথিত হওয়ার থেকে তা কোনও অংশে কম নয়, কারণ ফ্র্যাঙ্ক কুকুর বেড়াল ভালবাসতেন। প্রাণীগুলো ভীত সন্ত্রস্ত, শীতার্ত, ক্ষুধার্ত। বন্যপ্রাণীদের মতই তাদের আচরণ। শক্তিশালীরা অপেক্ষাকৃত দুর্বলদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে, দুর্বলরা দুর্বলতরদের মৃত্যুর প্রতীক্ষা করছে, ক্ষুধার তাড়নায়। শহরের ধ্বংসস্তূপের ওপরে শীতের আকাশ জুড়ে বাজপাখিরা ডানা মেলে কদাকার শরীর নিয়ে পাক খেয়ে চলেছে।
এমন কোনও খবর যা দিলে মহিলারা খানিকটা স্বস্তি বোধ করতে পারেন, ফ্র্যাঙ্ক এরকম কিছুর জন্য মনে মনে হাতড়াতে লাগলেন।
“কয়েকটা বাড়ি অবশ্য এখনও দাঁড়িয়ে আছে,” ফ্র্যাঙ্ক বললেন, “অন্যান্য বাড়িগুলোর থেকে বেশ কিছু দূরে অনেকটা জায়গা নিয়ে যে সব বাড়ি ছিল, ওদিকে আগুন পৌঁছতে পারেনি। এছাড়া গির্জাগুলো আর ফ্রীমেসনদের হলঘরটা। কয়েকটা স্টোরও। তবে ব্যবসাবাণিজ্যের এলাকা, রেললাইনের ধারঘেঁষা অঞ্চল আর ফাইভ পয়েন্টস – লেডিরা, শহরের সেই সব অঞ্চল একেবারে মাটির সঙ্গে মিশে গেছে।”
“তার মানে,” স্কারলেট তীব্র হতাশায় বলে উঠল, “চার্লি যে গুদামঘরটা আমার জন্য রেখে গেছিল, রেললাইনের ধার ঘেঁষে, সেটাও গেছে?”
“রেললাইনের ধার ঘেঁষে যদি হয় তো গেছে, তবে – ” হঠাৎ ওঁর মুখে হাসি ফুটে উঠল। কথাটা আগে মনে পড়ল না কেন? “লেডিরা, অমন মুষড়ে পড়বেন না! আপনাদের আন্ট পিটির বাড়িটা এখনও দাঁড়িয়ে আছে। একটু ক্ষতি হয়েছে বটে, কিন্তু আছে।”
“বাঁচল কী ভাবে?”
“আসলে বাড়িটা তো ইটের তৈরি, আর স্লেট পাথরের ছাদ অ্যাটলান্টাতে ওই একটা বাড়িতেই। আমার আন্দাজ, সেই জন্যই বোধহয় ফুলকি থেকে আগুন ছড়াতে পারেনি। এছাড়া এটা শহরের উত্তরদিকের শেষ বাড়ি বলেও হয়ত, ওইদিকে আগুনে বিশেষ লোকসান হয়নি।
ইয়াঙ্কিরা যারা ওখানে আস্তানা গেড়েছিল, তারা হাতের কাছে যা পেয়েছে, ভাঙচুর করে গেছে। এমনকি বেসবোর্ড আর সিঁড়ির মেহগিনির রেলিংটা পর্যন্ত জ্বালানি কাঠ হিসেবে ব্যবহার করেছে। দুর্ভাগ্যজনক! তবে বাড়িটা ঠিকঠাকই আছে। গত সপ্তাহে ম্যাকনে মিস পিটির সঙ্গে যখন দেখা হল – ”
“দেখা হয়েছে আপনার সাথে? কেমন আছেন উনি?”
“ভাল। ভালই আছেন। যখন বললাম যে ওঁর বাড়িটা এখনও খাড়া আছে, সঙ্গে সঙ্গে বাড়ি ফেরার ব্যাপারে মনস্থির করে ফেললেন। মানে – বুড়ো ডার্কি, পিটার, ওঁকে আসতে দেয়। অ্যাটলান্টার অনেকেই ফিরে এসেছেন, ম্যাকনে থাকা নিয়ে ওঁরা সামান্য বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন। শেরম্যান ম্যাকন দখল করেননি ঠিকই, কিন্তু ওঁদের ভয় হচ্ছিল উইলসন ওঁর হানাদার বাহিনী নিয়ে খুব শিগগিরই চলে আসবেন, আর উনি শেরম্যানের থেকেও এক কাঠি ওপরে।”
“যেখানে মাথা গোঁজবার ঠাঁই নেই, সেখানে ফিরে আসার মত বোকামি কেন যে করলেন! ওঁরা কোথায় থাকছেন?”
“মিস স্কারলেট, ওঁরা তাবু বানিয়ে থাকছেন, ঝুপড়িতে থাকছেন, গাছের গুঁড়ি দিয়ে ঘর বানিয়ে আছেন, আর যে কটা বাড়ি এখনও দাঁড়িয়ে আছে, সেখানে ছ’সাতটা পরিবার গাদাগাদি করে রয়েছেন। নতুন করে আবার বাড়ি তোলার চেষ্টা করছেন। ওঁদের বোকা বলবেন না, মিস স্কারলেট। অ্যাটলান্টার মানুষদের আপনি আর আমি দুজনেই ভাল করে জানি। অ্যাটলান্টা বলতে ওঁরা পাগল, অনেকটা চার্লস্টনের মানুষজনের মতই। আগুন লাগিয়ে সব কিছু জ্বালিয়ে দিলেও ইয়াঙ্কিরা ওঁদের বাগে আনতে পারবে না। অ্যাটলান্টার মানুষজন – মিস মেলি, কিছু মনে করবেন না – এখানকার খচ্চরদের চেয়েও বেশি একগুঁয়ে। কেন জানি না আমার খালি মনে হয়, এই শহরটা অসম্ভব একবগগা আর বেয়াড়া। অবশ্য আমি নিজে একজন গাঁয়ের মানুষ, শহর আমার ভাল লাগে না। তবে একটা কথা বলতে পারি, যাঁরা আগে আগে ফিরে এলেন, তাঁরাই বেশি বুদ্ধিমান। পরের দিকে যাঁরা আসবেন তাঁরা নিজেদের বাড়ির ইট, কাঠ, পাথর আর একটাও খুঁজে পাবেন না, কারণ যিনি যেখান থেকে পারছেন ইট, কাঠ, পাথর তুলে নিয়ে নিজের নিজের বাড়ি বানানোর কাজে লাগাচ্ছেন। এই তো পরশুই দেখলাম মিসেজ় মেরিওয়েদার, মিস মেবেল আর ওঁদের বৃদ্ধা ডার্কি একটা ঠ্যালাগাড়িতে করে ইট নিয়ে ফিরছেন। আর মিসেজ় মীড বললেন ডাক্তারবাবু ফিরলেই উনি গাছের গুঁড়ি দিয়ে একটা ঘর বানানোর কথা ভাবছেন। বললেন, প্রথম যখন অ্যাটলান্টায় পা রাখেন, তখন উনি গুঁড়ি দিয়ে বানানো ঘরে থেকেছেন, তখন জায়গাটার নাম ছিল মার্থাসভিল। সেটা যদি আবারও করতে হয় তবে তাই সই। সে উনি রসিকতা করেই নাহয় বলেছেন, কিন্তু এর থেকেই সবার মনোভাবটা আন্দাজ করা যায়।”
“তাহলে বলতেই হয়, ওঁরা খুবই উদ্যমী,” খুব গর্বের সঙ্গে মেলানি বলল। “কি বল স্কারলেট?”
স্কারলেট ঘাড় হেলালো। যে শহরটাকে আপনার করে নিয়েছে, তার জন্য গর্বে হতে লাগল। ওই যে ফ্র্যাঙ্ক বললেন, জায়গাটা একবগগা আর বেয়াড়া, সেই জন্যই শহরটা ওর এত পছন্দের। অন্যান্য পুরোনো শহরগুলোর মত এখানে গোঁড়ামির জায়গা নেই, পরিবর্তনবিমুখতা নেই,
বরং সম্ভাবনাময়, প্রাণবন্ত। “আমি অ্যাটলান্টার মতই,” মনে মনে ভাবল। “আগুন লাগিয়ে সব কিছু জ্বালিয়ে দিলেও ইয়াঙ্কিরা আমাকে বাগে আনতে পারবে না।”
“আন্ট পিটি অ্যাটলান্টাতে ফিরে এসে থাকলে, আমরাও তো ফিরে গিয়ে ওঁর সাথে থাকতে পারি, স্কারলেট,” স্কারলেটের চিন্তার জাল ছিন্ন করে মেলানি বলে উঠল। “একা একা থাকলে উনি তো ভয়েই মরে যাবেন।”
“এখান থেকে এখন আমি যাই কী করে, মেলি?” স্কারলেট অপ্রসন্ন গলায় বলল। “তা তোমার যখন এতই ইচ্ছে, চলে যাও, আমি বাধা দেব না।”
“না, না, আমি সেভাবে বলতে চাইনি, সোনা,” মেলানি কাতর গলায় বলল। “সত্যি কী স্বার্থপরের মত বললাম! তুমি কী করে টারা ছেড়ে যাবে – আমার মনে হয় আঙ্কল পিটার আর কুকি আন্টির দেখাশোনা করতে পারবে।”
“তোমার যাওয়া আটকাবে না,” স্কারলেটের রাগ এখনও পড়েনি।
“আমি মোটেই তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাব না, তুমি ভাল করেই জান,” মেলানি জবাব দিল। “আর
– আর তুমি কাছে না থাকলে আমি ভয়ে মরেই যাব।”
“সে তুমি যা ভাল বোঝ। তবে আমি তোমার পেছন পেছন অ্যাটলান্টা চলে সে কথা মনেও এনো না।
দু’চারটে বাড়ি আবার যেই মাথা তুলবে, শেরম্যানের লোকেরা ফিরে আসবে আর আবার আগুন জ্বালিয়ে দেবে।”
“উনি আর ফিরছেন না,” ফ্র্যাঙ্ক বললেন, কিন্তু শত চেষ্টা করলেও মাথা হেট করে ফেললেন। “এখন ওঁর লক্ষ্য উপকূলবর্তী অঞ্চল। স্যাভান্না কব্জা হয়ে গেছে, এই সপ্তাহেই, আর শোনা যাচ্ছে ইয়াঙ্কিরা দক্ষিণ ক্যারোলাইনার দিকে এগোচ্ছে।”
“স্যাভান্নাও গেছে!”
“আজ্ঞে হ্যাঁ। যাবারই ছিল স্যাভান্না। প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য যথেষ্ট লোক ছিল না, যদিও সব রকম চেষ্টা যে ওরা করেনি, তা বলা যাবে না – এমনকি যারা পা ঘষটেও চলতে পারে তাদেরও কাজে লাগানো হয়েছিল।
জানেন কি, ইয়াঙ্কিরা যখন মিলেজভিলের ওপর দিয়ে মার্চ করে যাচ্ছিল, ওরা মিলিটারি অ্যাকাডেমির সব শিক্ষানবিসকে ডেকে নিয়েছিল, কমবয়সি হলেও ডেকে নিয়েছিল। এমনকি কয়েদখানা খুলে বন্দীদের মুক্ত করে দেওয়া হয়েছিল। শুধু লোকবল বাড়াবার জন্য। হ্যাঁ, ঠিকই শুনছেন লেডিরা, যে সব কয়েদি লড়াই করতে ইচ্ছুক, যুদ্ধের শেষে বেঁচে থাকলে তাদের ক্ষমা করে দেওয়া হবে, এই শর্তে তাদের মুক্তি দেওয়া হয়েছিল।
আমার তো গায়ে কাঁটা দিত, চোর ডাকাত খুনেদের নিয়ে তৈরি করা ওই বাহিনী দেখে।
“ওই সব খুনে গুণ্ডা বদমাশদের আমাদের মধ্যে ছেড়ে দেওয়া হল!”
“দেখুন মিস স্কারলেট, অমন ঘাবড়ে যাবেন না। প্রথমত, ওরা এখান থেকে অনেকটাই দূরে আছে। তাছাড়া, ওরা খুবই লড়াকু জওয়ান। আমার বিশ্বাস খুনে বদমাশ হলেই যে ওরা লড়াকু জওয়ান হতে পারবে না, এরকম কথা বলা যাবে না। ঠিক কিনা?”
“আমার মতে, দারুণ সিদ্ধান্ত,” মেলানি মৃদুস্বরে বলল।
“ভাল কথা, কিন্তু আমার মতে নয়,” স্কারলেট ওর মুখের ওপর বলে দিল। “এমনিতেই দেশ জুড়ে খুনে বদমাশের কমতি নেই, এক ইয়াঙ্কিতেই রক্ষা নেই, তার ওপরে আবার – ” কথাটা বলতে গিয়েই নিজেকে সামলে নিল, কিন্তু পুরুষের দল হেসে উঠল।
“এক ইয়াঙ্কিতেই রক্ষা নেই, তার ওপর আবার আমাদের কমিসারি বিভাগ আছে,” কথাটা ওরাই পুরো করে দিল। স্কারলেট বিব্রত বোধ করতে লাগল।
“কিন্তু জেনারাল হুডের দল কোথায়?” মেলানি তাড়াতাড়ি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করল। “উনি নিশ্চয়ই স্যাভান্নাকে রক্ষা করতে পারতেন।”
“একথা কেন বললেন, মিস মেলানি,” ফ্র্যাঙ্ক সামান্য বিস্মিত, একটু ভর্ৎসনার সুরেই বলে উঠলেন। “জেনারাল হুড তো ওদিকে ছিলেনই না। উনি লড়াই করছিলেন টেনেসিতে, জর্জিয়া থেকে ইয়াঙ্কিদের হঠানোর জন্য।”
“আর ওঁর সেই মতলবটা কাজেই লাগল না!” বেশ শ্লেষের সঙ্গে স্কারলেট বলে ফেলল। “এই সব হারামজাদা ইয়াঙ্কিদের হাত থেকে আমাদের রক্ষা করার ভার কিছু স্কুলপড়ুয়া, খুনে গুণ্ডা আর হোম গার্ডদের হাতে তুলে দিয়ে উনি নিশ্চিন্তে কেটে পড়েছেন!”
“মামণি,” জেরাল্ড যেন জোর করে নিজেকে ঘুম থেকে তুলে বললেন, “তুমি গালি দিয়ে কথা বলছ। তোমার মা কষ্ট পাবেন।”
“ইয়াঙ্কিরা হারামজাদাই!” তেজের সঙ্গে স্কারলেট চেঁচিয়ে উঠল। “ওদেরকে অন্য কোনও নামে ডাকতে আমার বয়েই গেছে!”
এলেনের কথা উঠে পড়ায় সকলেই একটু আশ্চর্য হল, কথাবার্তাও হঠাৎ থেমে গেল। মেলানিকে আবার হস্তক্ষেপ করতে হল।
“ম্যাকনে যখন ছিলেন, ইন্ডিয়া আর হানি উইল্কসের সঙ্গে দেখা হয়েছিল আপনার? ওদের কাছে – মানে ওরা কি অ্যাশলের ব্যাপারে কিছু বলছিল?”
“দৈবাৎ যদি অ্যাশলের কোনো খবর আমার কানে পৌঁছত, তৎক্ষণাৎ আমি ঘোড়া ছু