ইন্তিজার হুসেইনের গল্প : শেহেরজাদের মৃত্যু



অনুবাদ : কুলদা রায়

এক হাজারেরও বেশি গল্প বলেছিল শেহেরজাদ এক হাজার এক রাতে। আর তিনটি ছেলের জন্মও দিয়েছিল এ সময়কালে। শ্রোতারা গল্প শোনার জন্য বায়না ধরত। আর সে গল্প বলত। গল্প বলার মাধ্যমেই কথক শেহেরজাদ বেঁচে থাকার সুযোগ পেয়েছিল। আর পাশাপাশি অগণিত কুমারীর জীবন রক্ষা হয়েছিল। এইসব কুমারীকে এক রাতের রানী হতে হতো। পরদিন তাদের মাথা কাটা যেতো। এই গল্প শুনে শুনে শ্রোতা দুনিয়াজাদ আর বাদশা শাহরিয়ার তাদের জীবন সম্পূর্ণভাবে বদলে ফেলেছিল। সব মেয়ের প্রতি শাহরিয়ারের খুব খারাপ মনোভাব ছিল। শেহেরজাদের বলা গল্পগুলো্র মাধ্যমেই সেই খারাপ মনোভাব ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গিয়েছিল। বাদশা নিয়ম করে এক রাতের জন্য একজন মেয়েকে বিয়ে করতেন। পরদিন ভোরে তার মাথা কেটে ফেলতেন। এই অভ্যাস ত্যাগ করেছিলেন।

তারপর ঐ রাজ্যে বেশ বড় আনন্দ-উৎসব হয়েছিল। উৎসবের সাজে সজ্জিত হয়েছিল রাজধানী। আয়োজন ছিল মহাভোজের। কিন্তু শেহেরজাদ ছিল বিভ্রান্তির মধ্যে। তার মন্দ ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয়েছে সেটা ভাবতে পারছিল না। এক হাজার এক রাত ধরে গল্প বলার দিনগুলোতে তার জীবন কাটত মৃত্যুর মেঘের নিচে–সেটা কী করে সে ভুলে যেতে পারে? আর তারপর যখনঐ রাতগুলো সত্যি সত্যি অতীতের ঘটনা হিসেবে সে মেনে নিতে শুরু করেছিল তখন তার গা শিউরে উঠেছিল। দীর্ঘ রাত জেগে থাকার চেষ্টা তাকে করতে হয়েছিল, আর ঘুমহীন রাত কাটাতে হয়েছিল। বাদশার কৌতুহল জাগিয়ে রাখার মতো করে গল্পের সুতো ঝুলিয়ে রাখতে হতো। এই বিষয়গুলো এখন তার বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। কীভাবে সে এতো গল্প বুনতে পেরেছিল? এগুলো নিশ্চয়ই খোদার মর্জিতে উপর থেকে এসেছিল।

শেষে, সে গল্প চালিয়ে যেতে পারছিল না। এক রাতে দুনিয়াজাদকে ডেকে তার বিছানায় বসালো। বলল, ‘প্রিয় বোন, ওগুলো নিয়ে যখন আমি ভাবি তখন আমার মনে মেঘ জমে আসে। এক হাজার এক রাত ধরে আমি গল্পগুলো আমি বলেছি! বল বোন, এটা কীভাবে সম্ভব হলো?’
দুনিয়াজাদ বলল,’ দিদি, তোর মনের মধ্যে যে এতো এতো গল্পের খনি আছে তা দেখে আমি আবাক হয়ে গেছি। ঐ রাতগুলো ছিল আতঙ্কের। নতুন সকাল কী আনবে সেটা ভেবে আমার হৃদপিণ্ড আতঙ্কে ধুকফুক করত। মৃত্যু এগিয়ে আসছে– সব সময়েই মৃত্যুকে কাছে দেখতে পেতাম। কিন্তু সেই কালো ও ভীতিকর রাতগুলো যেন পিদিমের মতো আলোকিত উঠত তোর বলা গল্পের মধ্য দিয়ে। যখন তুই কোনো গল্প বলা শুরু করতিস তখন কেউ জানতে পারত না কতো সময় কেটে যাচ্ছে–কখন রাত শেষ হয়ে যাচ্ছে। আর বাদশা… নির্বাক হয়ে বসে আছেন। শুনে চলেছেন তোর গল্প।

শেহেরজাদ বলল, বোন, আমি পৃথিবীতে হারিয়ে গিয়েছিলাম। আমার মাথার মধ্যে তখন একটাই চিন্তা ছিল যে আমাকে একটি গল্প বলতে হবে। আর প্রতি রাতেই আমার জীবন বাঁচাতে হবে। কিন্তু যখন আমি শুরু করতাম তখন গল্পের মধ্যে এমনভাবে ডুবে যেতাম যে বেঁচে থাকার চিন্তাভাবনাগুলো মিলিয়ে যেতো। তখন আমার মনের মধ্যে একটাই ভাবনা কাজ করত যেন গল্পটিকে যেন শেষ পরিণতিতে টেনে নিয়ে যেতে পারি।

‘তোমার গল্প শেষ পরিণতিতে পৌঁছেছে। কী অদ্ভুত গল্পের পরিণতি! গল্প শেষ হলে বাদশা একজন মানুষে রূপান্তরিত হয়ে গেছেন। একজন স্ত্রী-বিদ্বেষী স্বামী যে কিনা প্রতি ভোরে তার স্ত্রীর মাথা কেটে ফেলে – সেই লোকটি তোমার অনুগত হয়েছে– হয়ে গেছে নতুন একজন মানুষ!

আর দুইবোন আতঙ্ক, অনিশ্চয়তা ও চোখের জলের রাতগুলো থেকে মুক্তি পেয়েছে। তারপর তারা চোখের জল মুছে ফেলেছে। তাদের দুর্ভাগ্যের কাল শেষ হওয়ার জন্য ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানিয়েছে। ঈশ্বর শেহেরজাদকে গল্পগুলো বলার মতো শক্তি ও জ্ঞান দিয়েছে। এই গল্পগুলো তাদের জীবন রক্ষা করেছে।

বোনকে নিজের দু:খ ও ভয়ের কথাগুলো বলে শেহেরজাদ ভালো বোধ করল। শীঘ্রই উৎসব শেষ হয়ে গেল। রাজ্যে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে এলো। আগের মতোই সব কিছু চলতে লাগল। এক হাজার এক রাত অতীতের বিষয় হয়ে গেল। শেহেরজাদ বাদশার প্রিয়তম রানীর আসন পেল। সঙ্গে তিনজন রাজকুমারের মা হয়ে মহিলামহল পরিচালনা করল। দুনিয়াজাদ বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত নিল। তার বোনের ছায়ার নিচে দিন কাটালো।

শেহেরজাদের তিন ছেলে বড় হলো। বিপুল জাঁকজমক ও উৎসবের মধ্যে দিয়ে তাদের বিয়ে হলো। বিয়ের কণেগুলো ছিল খুব সুন্দর। মনে হতো রাজপ্রাসাদে চাঁদ নেমে এসেছে। তারা ছিল সৌভাগ্যবতী। যথাসময়ে ফুলের মতো ফুটফুটে মেয়ে হলো তাদের দুজনের। মেয়েরা যখন বড় হলো তখন দুনিয়াজাদ লক্ষ্য করে দেখল তারা আমোদ আল্লাদ আর খেলাধুলার বদলে গল্প শুনতে বেশি পছন্দ করে। সে তাদেরকে বলল, মেয়েরা, ‘তোমরা যদি সত্যি সত্যি গল্প শুনতে পছন্দ করো তবে তোমাদের দাদীর কাছে গিয়ে গল্প শোনার আব্দার করো। এই বিরাট পৃথিবীতে তার মতো গল্প কথক আর কেউ নেই।’

এই কথা শুনে মেয়ে তিনটি শেহেরজাদের কাছে গেল। গল্প বলার জন্য বায়না ধরল। শিশুদের এই জিদ দেখে শেহেরজাদ অবাক হলো। এক সময় সে ছিল সেরা গল্প কথক– এই কথাটি ভুলে গিয়েছিল। নাতনিদেরকে যথাসাধ্য নিরস্ত করার চেষ্টা করল। কিন্তু মেয়েরা কিছুতেই শুনল না। দুনিয়াজাদ তাকে অনুনয় করে বলল, ‘প্রিয় বোন, দাদী আর নাতনিদের মধ্যে আমার কথা বলা ঠিক নয়। কিন্তু ন্যায়বোধ আমাকে কথা বলিয়ে ছাড়ছে। এই মেয়েরা, আসলে তো তোমার নাতনি। বাড়িতে তাদের একজন দক্ষ গল্প কথক দাদী আছে। তাহলে কেনো এই মাগনা বিষয়গুলো তোমার সেরা উপহার হবে না? কেনো তারা গল্প শুনতে অন্যের দরোজায় টোকা দেবে?’

বোনের কথা শুনে শেহেরজাদের হৃদয় গলে গেল। নাতনিদেরকে বলল,’আমার জানেরা, অবশ্যই আমি তোমাদেরকে গল্প বলব। এই গল্পগুলো শোনাবার মতো তোমরা ছাড়া আর কে আছে আমার? কিন্তু এখন দিনের বেলা, দিনের বেলা গল্প বললে পথিক পথ হারিয়ে ফেলতে পারে। রাতের জন্য অপেক্ষা করো, তখন তোমাদেরকে গল্প শোনাবো।

কিভাবে তারা রাতের জন্য অপেক্ষা করে! রাত নেমে এলে নাতনি তিনজন দাদীকে ঘিয়ে বসল। দুনিয়াজাদও এসে পড়ল। দীর্ঘদিন পরে সেও শেহেরজাদের গল্প শুনবে।

কিন্তু একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। একটা গল্প মনে করার জন্য শেহেরজাদ খুব চিন্তা করতে লাগল, মাথা খাটালো। কিন্তু কিছুই তার মনে এলো না। এমনকি একটি গল্পও তার মনে পড়ল না। উদ্বিগ্ন হয়ে দুনিয়াজাদকে বলল, ‘ আমার স্মৃতি লোপ পেয়েছে। একটি মাত্র গল্পও মনে করতে পারছি না।’

‘কী বলছ?’ দুনিয়াজাদ চমকে উঠল। ‘তোমার স্বামীকে কত না গল্প বলেছ। তার একটি গল্প অন্তত এই মেয়েদেরকে কেন তুমি বলছ না?

‘কিন্তু কোনটি? একটিও মনে করতে পারছি না মনে হচ্ছে।’

‘প্রথম রাতে যে গল্পটি বলেছিলে…মনে করতে পারছ না..সেই যে সওদাগর আর জ্বিনের গল্পটি।’

‘সওদাগর আর জ্বিনের গল্পটি…’ বিড়বিড় করল শেহেরজাদ।

সে অনেক চেষ্টা করল সেটা মনে করার। যখন সে একটুখানিও মনে করতে পারল না তখন সে ভয় পেয়ে বলল, ‘দুনিয়াজাদ, সওদাগর আর জ্বিনের গল্পটিতে কী হয়েছিল সেটা মনে করতে পারছি না।’

‘তারমানে তুমি তোমার নিজের গল্পগুলো ভুলে গেছ? মনে করতে পারছ না…সেই যে সওদাগর খেজুর খেয়ে থুথু ফেলল পাথরের উপর। যখন সে পাথরের উপর থুথু ফেলল তখন মেঘের মতো ধোঁয়া বের হলো। একটি জ্বিন হাজির হলো। জ্বিন বাজখাই গলায় বলল পাথরটি তার ছেলের বুকে আঘাত করেছে। তাতে ছেলেটি সঙ্গে সঙ্গে মারা গেছে। জ্বিন গর্জে উঠল। বলল,’ এর মূল্য দিতে হবে তোমাকে। মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হও তুমি।’

শেহেরজাদ মনোযোগ ফিয়ে শুনল। এরপরে কী ঘটেছিল সেটা মনে আনার খুব চেষ্টা করল। কিন্তু মনের কুশায়া থেকে যখন কিছুই বের হয়ে এলো না তখন বলল,’প্রিয় বোন দুনিয়াজাদ আমার, মনে হচ্ছে গল্পটি মন থেকে মুছে গেছে। কিন্তু তোমার মনে আছে। এই গল্পটি তুমি কেনো গল্পটি মেয়েদেরকে বলছ না?’

দুনিয়াজাদ এক মুহূর্তে কিছুটা ভাবল। তারপর বলল, ‘তুমি হলে এক হাজার এক রাতের গল্পের গায়কপাখি। তোমার মতো গল্পের জাদু আনতে পারব না আমি। তুমি যদি জেদ করো তবে আমি এখন সাদামাটাভাবে গল্পটি বলতে পারি। কিন্তু একটা শর্ত আছে। সেটা হলো কাল তুমি তোমার অননুকরণীয়ভাবে পরের গল্পটি বলবে।’

বোনের এই শর্তে রাজী হলো শেহেরজাদ। আর শেহেরহাদ খুব রসিয়ে রসিয়ে সওদাগর ও জ্বিনের গল্পটি তিন খুদে মেয়ের কাছে বলল। মেয়েগুলো শুনে উৎফুল্ল হলো। দুনিয়াজাদ বলল,’আমার জিবে শেহেরজাদের মতো জাদু নেই। কাল, তোমাদের দাদী যখন এর পরের গল্পটি বলবে তখন তোমাদের আরো বেশি ভালো লাগবে।’

দুনিয়াজাদের গল্পটি শুনে শেহেরজাদের মনে ঝড় উঠল। তার মনের মধ্যে আগে বলা গল্পগুলো ঝাঁকে ঝাঁকে পাকিয়ে জেগে উঠল। কিন্তু কোনো গল্পই সম্পূর্ণ নয়। গল্পগুলো ছিল একটার সঙ্গে আরেকটার মিশানো–জগাখিচুড়ি পাকানো। সেগুলো এমনভাবে মনের মধ্যে বদলে গেছে তা বললে কোনো অর্থ হয় না। বেশ, কিছু মনে করো না, শেহেরজাদ নিজেকে সান্ত্বনা দিল। অবশেষে স্মৃতিগুলো কিছুটা হলেও ফিরছে। কাল যখন গল্প বলতে বসব তখন খোদার মর্জিতে সব ঠিক হয়ে যাবে। গল্পের পুরোটাই মনে আসবে।

পরদিন পূর্ণ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে নাতনিদের নিয়ে বসল শেহেরজাদ। দুনিয়াজাদও এসে তার তার পাশটিতে বসল। কিন্তু সওদাগর আর জ্বিন নিয়ে আগেরদিন দুনিয়াজাদ যে গল্পটি বলেছিল তার পরের গল্পটি মনে করার চেষ্টা করল। এরপরে সে গল্পটির কিছু মনে করতে পারল না। দুনিয়াজাদ তাকে উৎসাহ দিল। “বোন, একদা, এক জেলে নদীতে জাল ফেলেছিল। যখন জাল টানতে গিয়ে দেখল তা ভারী, তখন সে মনে করল জালে খুব বড় একটা মাছ বেঁধেছে। মাছটি বেশ মোটাসোটা। কিন্তু জালটি টেনে তুলল তখন দেখল তারমধ্যে একটা মুখে ছিপি আঁটা পিতলের বোতল উঠেছে। ছিপিতে বাদশা সোলায়মানের নাম লেখা। যখন সে ছিটিটা ভেঙ্গে বোতলটি খুলল, তখন একটা ধোঁয়া দিনের আলোকে কালো করে ফেলল। রাত নেমে এলো। সেই কালো ধোঁয়া থেকে বিশালাকার এক জ্বিন বেরিয়ে এলো।”

শেহেরজাদ মুগ্ধ হয়ে বলল, ‘আমার মনে হচ্ছে– তুমি গল্পটি খুব ভালো করে মনে করতে পারছ–বলছও সুন্দর করে। এর পরের গল্পটি আমার মনে না আসা পর্যন্ত তুমি বাকি অংশগুলো বলে যাও।

খোদার দয়ায় দুনিয়াজাদ ছিল স্বতস্ফূর্ত। জেলে আর জ্বিনের গল্পটি সে শেহেরজাদের মতো পুরো দৃঢ়তা নিয়ে বলতে শুরু করল। ভোর হওয়ার মধ্যে সে পুরো গল্পটি বলা শেষ করল। শেহেরজাদ শুনে বুঝল গল্পটি তার নিজের নয়– তার বোনের নিজের বানানো। সে এখন একজন শ্রোতা। খুদে মেয়েরা গল্পের জগতে ঢুকতে পেরেছে।

তার পরের রাতে সিরিজের তিন নম্বর গল্পটি মনে করতে পারবে বলে শেহেরজাদের আত্মবিশ্বাস ছিল। যখন সেই গল্পটি সে মনে করতে পারল না, তখন আরেকটি গল্প মনে করার চেষ্টা করল। আলাউদিন আর আশ্চর্য প্রদীপ গল্পটিকে মন থেকে বের করার চেষ্টা করল। কিন্তু পর পর কী কী ঘটছে গল্পটিতে তার পুরোটা খুঁজে পেলো না। আবার দুনিয়াজাদকেই সেটা বলতে হলো।

গভীর বিস্ময় নিয়ে গল্পগুলো শুনছে শেহেরজাদ। আমি কি এই গল্পগুলো বলেছিলাম? আশ্চর্য হয়ে ভাবল সে।

ধীরে ধীরে এই বিস্ময় বিষাদে পরিণত হলো। সে এক হাজার এক রাত ধরে গল্পগুলো বলেছিল। এই এক হাজার এক রাতের প্রতি রাতেই সে ভেবেছিল সেটাই হবে তার শেষ রাত । কিন্তু এখন, এতোগুলো বছর পরে, তার মনে হলো সেই রাতগুলো ছিল তার পূর্ণ জীবন। জাদুর মতো তার জীবন জুড়ে ছড়িয়ে আছে। ঐ রাতগুলোতেই একমাত্র আমি সম্পূর্ণভাবে বেঁচে ছিলাম। এটা ভাবল অত্যন্ত দু:খের সঙ্গে। আরেকবার, সেই ঘুমিয়ে থাকা রাতগুলো জেগে উঠে তার চারিদিকে পাক খেতে লাগল। রাত যত বেড়ে চলল ততই সে দিক দিগন্তে ঘুরে বেড়াতে লাগল– পার হয়ে যেতে লাগল অজানা দ্বীপ, সমুদ্র আর মরুভূমিতে– পার হতে লাগল সেইসব মানুষদের সঙ্গে যারা এক সময় তার গল্পের চরিত্র হয়েছিল। এই ঘোরাঘুরির মধ্যে এমনভাবে ডুবে গিয়েছিল যে, তার জীবন ও মৃত্যুর ভয় ও শঙ্কা থেকে বহু বহু দূরে চলে গিয়েছিল। রাত ফুরিয়ে এলো। কক কক করে মোরগ নতুন সকাল ঘোষণা করল, তখন আগের রাতে যে গল্প বলা থেকে বিরত ছিল–পরের রাতে বলবে বলে তার দৃঢ় বিশ্বাস হয়েছিল, সেই গল্পটির মৃত্যু ঘটল। তার আত্মবিশ্বাস দূরে সরে গেল।

শেহেরজাদ সেই গল্পভরা রাতগুলোর মধ্যে সম্মোহিত হয়ে ডুবে ছিল। আর যখন সে সম্মোহন থেকে জেগে উঠে বর্তমানের অন্ধকার ও শূন্য রাতগুলোর মধ্যে ঢুকে পড়ল, তখন সে ভাবল, ‘এখন আমার রাতগুলো শূন্য। তারা কেবল দীর্ঘ আর কালো। তাদের মধ্য থেকে জাদু চলে গেছে। তারা পরিণত হয়েছে বন্ধ্যা। কেঁপে উঠে গভীর বিষাদে সে ডুবে গেল।

যখন বাদশা হেরেমে এলেন, দেখতে পেলেন শেহেরজাদ অস্বাভাবিক রকম চুপ করে আছে। তার মুখমণ্ডল থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় নৈরাশ্য ঝরে পড়ছে। বাদশা সেদিন চুপ করে রইলেন। কিন্তু যখন তিনি দেখতে পেলেন পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হচ্ছে না,শেহেরজাদ গভীর বিষাদের খাদে আটকে আছে তখন সে উদ্বিগ্ন হলেন। শেষে তিনি আর চুপ করে থাকতে পারলেন না। শুধালেন, ‘বেশ কিছুদিন ধরে খেয়াল করছি–তোমার মুখে কোনো সুখের ঝলক নেই। তুমি হাসছ না। কথা বলছ না। তোমার মুখ মলিন দেখাচ্ছে– দেখাচ্ছে রোগাটে আর বিষাদে ভরা। তোমার কী হয়েছে? কী তোমাকে বিরক্ত করেছে?’

এ কথা শুনে শেহেরজাদের সব ধৈর্য্যের বাঁধ ছুটে গেল। সে কেঁদে উঠল। বলল, হে আমার প্রিয়তম স্বামী, কোন শেহেরজাদকে আপনি বলছেন? সেই উৎফুল্ল, বকবক করে গল্প বলা যে শেহেরজাদ আপনার প্রাসাদে এসেছিল সে বহু বহু দিন আগে মরে গেছে।’

এই কথাগুলো বাদশাকে স্তম্ভিত করে দিল। কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে গেলেন। বললেন, ‘একি শুনছি আমি? যদি কিছু তোমার হৃদয়ে আঘাত দিয়ে থাকে, তবে তার কারণ নিশ্চয়ই আছে।’

‘ও আমার বাদশা–প্রিয়তম স্বামী,’ কাঁদতে কাঁদতে শেহেরজাদ বলল, ‘আপনি আমার জীবন দান করেছেন। কিন্তু আমার কাছ থেকে গল্পগুলো ছিনিয়ে নিয়ে গেছেন। কেবল আমি বেঁচেছিলাম আমার গল্পের মধ্যেই। যখন আমার গল্পবলা শেষ হয়ে গেল, আমার নিজের গল্পগুলো সেগুলোর সঙ্গে শেষ হয়ে গেছে।’

----------------------
লেখক পরিচিতি:
ইন্তিজার হুসেইন – জন্ম ৭ ডিসেম্বর, ১৯২৩ – ব্রিটিশ ভারতের বুলন্দশহরে; মৃত্যু ২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ – পাকিস্তানের লাহোরে। পাকিস্তানি সাহিত্যিক – উপন্যাস, ছোটগল্প এবং কবিতা সর্বক্ষেত্রেই তাঁর বিচরণ। উর্দু ভাষায় সাহিত্য রচনা করেছেন। ২০১৩-র ম্যান বুকার প্রাইজ়ের জন্য মনোনয়ন পেয়েছিলেন।

ভারতীয় উপমহাদেশে জন্ম এবং ১৯৪৭-এ দেশভাগের পর পাকিস্তানে চলে যান। তাই তাঁর অনেক রচনাতেই দেশভাগের আগের জীবন নিয়ে স্মৃতিমেদুরতা ফুটে উঠেছে।

তাঁর অনেক লেখাই ইংরেজিতে অনুদিত হয়েছে, যেমন, The Seventh Door, Leaves, Basti. Basti উপন্যাসটি আন্তর্জাতিক স্তরে প্রশংসিত হয়েছে।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ